পরিত্রাণ পর্ব ৪+৫

#পরিত্রাণ
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৪

অনিক রাতে বাসায় ফেরে নি। এদিকে ছেলের চিন্তায় ইউসুফ চৌধুরীর মনটা খারাপ হয়ে আছে। বারান্দার রকিং চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন তিনি। তাঁর এই দীর্ঘ ছাপ্পান্ন বছর বয়সে জ্ঞানত তিনি কোন অন্যায় করেন নি। তবে কিসের শাস্তি ভোগ করছেন ? কেন তার জীবনটা এমন দুর্বিষহ হলো? কি দিয়ে ছেলের মনের সব দুঃখ কষ্ট দূর করবেন? যাকে টাকাপয়সা, বিলাসিতা, ঐশ্বর্য এমনকি নারীর রূপ পর্যন্ত বেধে রাখতে পারে না তাকে কোন মন্ত্রবলে সুস্থ করবেন ইউসুফ সাহেব? এমন কিছু কি আছে যা অনিকের মনের সমস্ত কথা, সমস্ত চাহিদা, সমস্ত দুঃখ টেনে বের করতে পারবে? এভাবে তিলে তিলে অনিকের শেষ হয়ে যাওয়া তিনি আর সহ্য করতে পারছেন না। অনিকের কি সত্যিই ভালোবাসা অভাব? তিনি তো অনিককে কম ভালোবাসেন নি? সবসময়ই বন্ধুর মত ছেলের সাথে মিশতে চেয়েছিলেন। হ্যাঁ কখনো কখনো ব্যস্ততার কারণে পেরে উঠেন নি। কিন্তু তাই বলে তো অনিককে ভালোবাসার কোন কমতি তিনি রাখেন নি? তাহলে কিসের দুঃখ অনিকের? তার মায়ের জন্য? সেই দুঃখ কি ইউসুফ চৌধুরীও পান নি? একটা ভূল মানুষকে বিয়ে করে সারাজীবন তার মাশুল গুনেছেন।
তাই বলে তিনি তো নিজেকে শেষ করে দেন নি? অনিকের জন্য নিজেকে শক্ত রেখেছেন। তবে অনিক কেন তাঁর জন্য নিজেকে শক্ত রাখতে পারলো না? অবশ্য রাখবে কি করে? অনিকের মাঝে তো সন্দেহের দানা বেঁধেছে। অনিক তো তার মায়ের কথা বিশ্বাস করে বসে আছে। আজ কতবছর ইউসুফ সাহেবকে ‘বাবা’ বলে ডাকে না সে।
কিন্তু বিশ্বাস কি কেবল অনিকই করেছে? ইউসুফ চৌধুরী করেন নি? নতুবা অনিকের বারবার বলা সত্ত্বেও কেন তিনি তাঁর এবং অনিকের ডিএনএ টেস্ট করাতে রাজী হলেন না। সত্যিটা বেরিয়ে আসবে বলে?
কিসের সত্যি? মন ঘুরিয়ে নিলেন ইউসুফ সাহেব। তার কাছে সবচেয়ে বড়সত্যি অনিক তাঁর সন্তান! তিনিই অনিকের বাবা। নইলে পরের ছেলেকে কি কেউ এত ভালোবাসতে পারে? অনিক কেন সেটা বোঝে না। ইউসুফ সাহেব প্রাণাধিক ভালোবাসেন তাঁকে। তাঁর শুধু একটাই ভয় হয় কখনো যদি তিনি জানতে পারেন অনিক তাঁর সন্তান নয় তখন তিনি মরে যাবেন। অনিক ছাড়া তাঁর সমস্ত পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যাবে!

রুমু নিঃশব্দে এসে ইউসুফ চৌধুরীর পেছনে দাঁড়িয়ে ডাক দিলো,’বাবা?’

ইউসুফ চৌধুরী চোখ মেলে চাইলেন। পেছনে ফিরে সস্নেহে বললেন,’কি গো মা?’

-‘আপনার ছেলে তো ফিরলো না?’

জবাবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন ইউসুফ সাহেব। মৌনমুখে বললেন,’রহমানকে খুঁজতে পাঠিয়েছি।’

রুমু চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে। অনিকের কষ্টগুলো সে বুঝতে পারে। বুঝতে পারে ইউসুফ সাহবের কষ্টগুলোও! কিন্তু ইউসুফ চৌধুরীর প্রতি অনিকের এত চাপা ক্ষোভ কেন এই কথা সে বুঝতে পারে না। অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বললো,আপনার ওপর ওর এত রাগ কেন বাবা? আপনি তো কোন দোষ করেন নি?’

ইউসুফ চৌধুরী আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চশমা খুলে চোখ মুছে বললেন,’ ওর ধারণা আমি ওর বাবা নই। তাই আমি ইচ্ছে করে আমি টেস্ট করাই নি। সেজন্যই এত রাগ ওর!

রুমু নিরুত্তর হয়ে চেয়ে রইলো। অনিলা চৌধুরীর ওপর তাঁর খুব রাগ হচ্ছে। ভদ্রমহিলা নিজে তো ডুবেছেন সে সাথে বাপ ছেলের সুন্দর সম্পর্কে কলুষিত করে দিয়ে গেছেন। তার বিষাক্ত মনোভাবের কারণে শুধুমাত্র সন্দেহের উপর ভিত্তি করে পিতা ডাক থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নিরপরাধ ইউসুফ চৌধুরী।

-‘তবে টেস্ট করাচ্ছেন না কেন বাবা। অন্তত ওর শান্তি মিলতো।’

-‘ভয় হয় মা। অনিলা যা বলে গেছে সেসব কথা ভাবলেও ভয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। আর কয়দিনই বা আছি। এই বয়সে এসে এসব টেনশন সহ্য করতে পারবো না মা। আমি জানি অনিক আমার সন্তান, কিন্তু তবুও ভয় হয়।’

রুমু অসহায়ভাবে ইউসুফ চৌধুরীর মুখের দিকে চেয়ে রইলো। এই মানুষটা ভেতরে ভেতরে কতটা অসহায়। অনিক কি কখনো বুঝবে তাঁকে? গলাটা নরম করে বললো,’অনিক আপনাকে ভালোবাসে বাবা।’

ইউসুফ চৌধুরী হতাশভাবে হাসলেন। বললেন,’তোমার তাই মনে হয়?’

-‘হ্যাঁ বাবা। ও যদি সত্যিই টেস্ট করাতে চাইতো তাহলে আপনাকে লুকিয়েই করে ফেলতে পারতো কিন্তু ও করে নি। সব দোষ আপনার ঘাড়ে চাপিয়ে নিজের স্বস্তি খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওর আসল রাগ ওর মায়ের ওপর, আপনাকে ও ভালোবাসে বাবা। শুধু ওর মায়ের রাগটা আপনার ওপর ঝেড়ে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে।’

ইউসুফ চৌধুরী ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। বললেন,’অনিলা কেন এমন করলো? আমার ছেলেটাকে কেন এত দুঃখ দিয়ে গেলো মা? ও তো কোন দোষ করে নি?’

রুমু নিঃশব্দে কিছুক্ষন ইউসুফ চৌধুরীর পায়ের কাছে বসে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলো।সফুরা এসে জানালো রাতের খাবার তৈরী। টেবিল গোছাতে বেরিয়ে যাচ্ছিলো রুমু। ইউসুফ চৌধুরী পুনরায় ডাক দিলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,’আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি মা। আমার সমস্ত ব্যবসা, বাণিজ্য যা কিছু আছে সব তোমার আর অনিকের ভবিষ্যৎ সন্তানের নামে উইল করে দিয়ে যাবো।এবার আমার মুক্তি চাই সারাজীবন তো কাজ করেই কাটালাম। এবার তোমার হাতে তুলে দেবো সব। আমার ছেলেটাকেও!’

রুমু অবাক হলেও মনে মনে হাসলো। তাঁর আর অনিকের সন্তান? আদৌ কি সম্ভব? পরক্ষনেই ভেতরের রুমুটা শাসনের সুরে বললো,’কেন সম্ভব নয়? অনিককে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্যই তো এই বাড়িতে আবার ফিরে আসা। তবে কেন সম্ভব নয়?

ইউসুফ চৌধুরী রুমুর চিন্তিত মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন,’ তোমাদের সন্তান না আসা পর্যন্ত এবং পরবর্তীতে তার সঠিক বয়স হওয়ার আগ পর্যন্ত পাওয়ার অফ অ্যাটোর্নি তোমার নামে থাকবে। এবার অনিকের ব্যপারে তুমি কি সিদ্ধান্তে নেবে সেটা সম্পূর্ণ তোমার ওপর ছেড়ে দিলাম।’

রুমু হাসলো। নিশ্চয়ই বাবা এই বুদ্ধি দিয়েছেন। আসিফ ইকবাল রুমুকে ভালো করেন চেনেন। কখন তাঁর মেয়ের কোন সুযোগের প্রয়োজন সেটা তিনি ভালো করেই বুঝতে পারেন। অনিককে বশে আনার জন্য এইমুহূর্তে এই সুযোগটার খুব প্রয়োজন ছিলো রুমুর। কিন্তু লজ্জায় বলতে পারছিলো না। আফটার অল পরের মেয়ের হাতে নিজের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি তুলে দেওয়ার মত মন সবার হয় না। তাই আসিফ ইকবাল নিজে এই ব্যপারে ইউসুফ চৌধুরীর সাথে কথা বলেন। দুপক্ষের আস্থা, ভরসা বজায় রাখার জন্যই সম্পত্তির আসল মালিকানা অনিকের অনাগত সন্তার নামে করার প্রস্তাব দিলেন তিনি। রুমুর এতে কোন আপত্তি নেই। টাকা পয়সা সে চায় না, কারণ বর্তমান কালে ইউসুফ চৌধুরীর চাইতে টাকাপয়সা কোন অংশে কম নেই আসিক ইকবালের। রুমু শুধু চায় অনিক ঠিক হোক, নিজের দায়িত্ব নিতে শিখুক, তাহলেই হবে। রুমু হাসিমুখে ইউসুফ চৌধুরীর দিকে চেয়ে থেকে বললো,’অনেক ধন্যবাদ বাবা। আশাকরি আপনি আমাকে বুঝবেন!’

ইউসুফ চৌধুরী হাসলেন। বললেন,’বুঝবো না কেন মা? এখন তো তুমিই একমাত্র ভরসা মা। আমার বোকা ছেলেটাকে ঠিক করার সমস্ত দায়িত্ব তোমার।’

দুদিন বাদের ঘটনা, অফিস ছুটির পূর্বমুহূর্তে অনিকের অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে পাহারা দিচ্ছিলো রহমান। গতদুদিন অনিক সুযোগ বুঝে ফস্কে গেছে। কিন্তু আজকে রহমান জায়গা থেকে একবারের জন্যেও নড়ে নি। আজকে অনিককে বাড়ি নিয়েই ফিরবে সে।
কিন্তু আজকেও অনিক ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। তার আগেই রহমান দেখতে পেয়ে, অনুনয় বিনয় করে, হাতে পায়ে ধরে ওকে গাড়িতে উঠতে বাধ্য করে।

সন্ধ্যায় ছাদে কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটির পর ঘরে ফিরে এলো রুমু। ভেতরে ঢুকতেই দেখলো খাটের ওপর অনিক আধশোয়া হয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। বুকের ওপর বন্ধ ল্যাপটপ! হাত দুটো ভাঁজ করে ল্যাপটপের ওপর রাখা। চোখে পাওয়ারি চশমা!
কাছে এগিয়ে গেলো রুমু! অনিকের ঘুমন্ত মুখখানার দিকে চোখ পড়তেই কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখ সরাতে পারলো না সে! না চাইতেও মুগ্ধ হলো সে। আশ্চর্য! এমন পাষণ্ড, পাপিষ্ঠের মুখ এত নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ হয় কি করে? সৃষ্টিকর্তা কোন খেয়ালে এমন লোকের এত রূপ দিলেন? এত মায়া যার মুখে সে কেন এমন করে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে? রুমু চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসলো। খুব সাবধানে অনিকের চোখ থেকে চশমা খুলে নিলো। এবং আবারো মুগ্ধ হলো সে! অনিকের জোড়া মিশকালো ভ্রুযুগল কি সুন্দর ভাবে গোছানো! কি অপূর্ব লাগছে ওকে! একটুও ঘৃণা হচ্ছে না। হাসলো রুমু! নিজের ওপর আফসোস হচ্ছে তার। লোকমুখে নিজের রূপের অনের প্রশংসা শুনে এসেছে সে। এইবাড়িতে ঝি-চাকরাও আড়ালে তার রূপের প্রশংসা করে। তবে কি লাভ এই রূপ দিয়ে? তার এতরূপ কেন এই হতচ্ছাড়াকে এতটুকু আকর্ষন করলো না? কেন? ইশ ঢং দেখো! উনি যেন দেবতা! নারীর রূপ উনাকে আকর্ষন করে না। ইচ্ছে করছে গাল টেনে ঘুম থেকে তুলে দিয়ে বলতে,’এই যে ভদ্র মাতাল, এভাবে পড়ে পড়ে ঘুমালে চলবে না। তোমার যে একটা সুন্দরী বউ আছে তার খেয়ালও তো রাখতে হবে!’
আপনমনেই হেসে ফেললো রুমু। অনিকের একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আলতো করে চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বললো,’তোমার সব দুঃখ আমি দূর করে দেবো।’ হাসতে হাসতেই হঠাৎ দুফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়লো অনিকের হাতের ওপর। ঘুম ভেঙ্গে গেলো অনিকের। নিজের এত কাছাকাছি রুমুকে দেখে অবাক হলো সে। রুমু তখনোও আত্মসংবরণ করতে পারে নি। আচমকাই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। অনিক নিঃসংকোচে আঙ্গুলের ডগায় রুমুর মুখটা তুলে ধরে বলল,’কাঁদছো যে?’

-‘আমি তো কাঁদার জন্যই তোমার সংসারে এসেছি।’, অভিমানী কন্ঠে জবাব দিলো রুমু।

-‘বেশ কাঁদো।’

বলেই বার পূর্বের ন্যায় শুয়ে পড়লো অনিক।নিতান্ত অভিমানে রুমুর বুকটা ভরে গেলো। এ কেমন পাষাণ মানুষ! দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে সে অনিকের কলার চেপে ধরে তাকে টেনে তুললো। তারপর অনিকের হাঁটুতে কপালে ঠেকিয়ে পূর্বের সুরে রোদন শুরু করলো। অনিক বাধা দিলো না। উদ্ভ্রান্তের মত বসে রইলো। ধীরে ধীরে রুমুর চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে সস্নেহে বললো,’ফিরে না এলেই পারতে!’

তৎক্ষণাৎ সসংকোচে অনিকের কাছ থেকে সরে গেলো রুমু। লজ্জায় গাল লাল হয়ে গেলো।এতদিন রোজ যাকে গালমন্দ করে এসেছে আজ তাঁর হাটুতে মাথা রেখে কাঁদছিলো সে! ইশ! কি লজ্জা! অনিক মুচকি হাসতে দেখে রুমু ভেংচি কেটে বললো,’এমনি এমনি ফিরে আসি নি। আসতে বাধ্য হয়েছি। নইলে তোমার মত বদলোকের চেহারা রোজ রোজ দেখার কোন ইচ্ছে আমার নেই।’

অনিক জবাব না দিয়ে ল্যাপটপটা বুকের ওপর থেকে সরিয়ে নিলো। খাট থেকে নেমে ড্রিংকসের বোতল বের করে গ্লাসে ঢালতে যাচ্ছিলো, কিন্তু তখনই অঘটন ঘটে গেলো। ওর হাতে ড্রিংকস দেখে রুমুর মেজাজ বিগড়ে গেলো। ছোঁ মেরে ওর হাত থেকে বোতলটা নিয়ে ঠাস করে আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেললো! অনিক হতবিহ্বল,অবাক হয়ে বললো,’এটা কি করলে? ‘

-‘বেশ করেছি।’

-‘না বেশ করো নি। এমনিতেই আমার হাতে এখন টাকা পয়সা নেই। এই এক বোতলই ছিলো। তাও তুমি ভেঙ্গে গেলে! এখন তুমি টাকা দেবে।’

-‘না দেবো না। তোমাকে এসব কেনার টাকা দেওয়ার জন্য তোমার বউ হয়ে আসি নি আমি। আমার মনেও তো অনেক কষ্ট কিন্তু তাই বলে আমি কি এসব খাচ্ছি ? খাচ্ছি না। তাই আজ থেকে তুমি খেতে পারবে না।’

-‘এসব খাওয়া তোমার কর্ম নয়। তুমি খেতে পারবে না বলে আমাকে বাধা দিচ্ছো কেন?

-‘আমার কর্ম নয় মানে কি? এসব খাওয়া কি খুব মহৎকর্ম? দুনিয়ার সব নিষ্কর্মা লোকেরাই তো বসে বসে এসব খায়।’

-‘কথাটা আংশিক সত্য। কেবল নিষ্কর্মারা এসব খায় না। কিছু কিছু গুণীজনের কাছেও এসব অমৃত।’

-‘তুমি কোনটা?’

-‘নিঃসন্দেহে আমি গুণীজন নই। আমাকে নিষ্কর্মাদের দলেই ধরতে পারো। এখন বলো তোমার কিসের দুঃখ?

-‘নিষ্কর্মাদের কাছে বলে লাভ কি?’, বাকা চোখে চাইলো রুমু।

তাঁর রিয়েকশন দেখে হেসে ফেললো অনিক। মিষ্টিমধুর কন্ঠে বললো,’সব যদি তুমিই বলো তাহলে আমি কোন দিকে যাবো ভাই?’

-‘আমি যেদিকে বলবো সেদিকে।’

-‘ঠিক আছে যাবো। এখন বলো হঠাৎ আমাকে খোঁচানোর কি উদ্দেশ্য? আমেরিকা থেকে পড়াশোনা করে এসেছো কি আমার মত একটা মাতালের সাথে খোঁচাখুঁচি করার জন্য?’

-‘হ্যাঁ। তাই। তোমার কারণে আমার এই অবস্থা তাই তোমাকে আমি ছাড়বো না।

-‘আমার কারণে নয়। ইউসুফ চৌধুরীর কারণে!’

-‘ইউসুফ চৌধুরী নয় বাবা বলো।’

-‘কেন তোমার কথায়?’

-‘না। কারণ তুমি তাঁকে ভালোবাসো।’

অনিক হো হো করে হেসে উঠে কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু রুমু তার আগেই ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,’ হেসে কোন লাভ নেই। আমি সব জানি।’

-‘কি জানো তুমি?’

-‘এই যে তুমি ইউসুফ চৌধুরীকে ভালোবাসো?’

-‘কি করে বুঝলে?’

-‘কারণ যেই দোষ তুমি উনার ঘাড়ে চাপাচ্ছো সেই দোষ তুমিও করেছো। উনি ডিএনএ টেস্ট করাতে রাজী হন নি কারণ উনি তোমাকে ভালোবাসেন। তোমাকে হারানোর ভয় কাজ করে উনার মধ্যে। তাই সব দোষ উনার। কিন্তু তুমি তো চাইলেই উনাকে লুকিয়ে টেস্ট করাতে পারতে। তুমি কেন করালে না?

অনিকের হাসি মিলিয়ে গেলো। যেন, চুরি ধরা পড়া গেছে! গম্ভীর গলায় বললো,’অনেক বেশি বুঝে ফেলেছো তুমি।’

-‘ঠিক বলেছো। তাই বলছি এখনো সময় আছে সাবধান হও। নইলে কপালে দুঃখ আছে তোমার!’

-‘দুঃখ? এখন কি খুব সুখে আছি?’

-‘সেটা আমি কি করে বলবো। যাইহোক তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো।’

-‘কি?’

-‘বাবা তাঁর সমস্ত সম্পত্তি আমার নামে ট্রান্সফার করে দিয়েছেন।’

অনিকের রিয়েকশন খানিকটা চমকে যাওয়ার মত হলেও সামলে নিয়ে বললো,’বেশ তো ভালোই। এখন তাহলে একটা কাজ করো, টাকায় বিছানার গড়াগড়ি খাও আর ইউসুফ চৌধুরীর নামে জয়ধ্বনি করো।’

-‘আমি কিন্তু তোমার সাথে মজা করছি না অনিক। বিশ্বাস না হলে ডকুমেন্টস গুলো তোমাকে দেখাতে পারি?’

-‘আমি দেখে কি করবো?’

-‘না দেখতে চাইলে নাই। কিন্তু চাইলে আমি দেখাতে পারি।’

অনিক এর কোন জবাব না দিয়ে বললো,’তাহলে সিনেমার নায়কদের মত আমিও কি তোমাকে এই প্রশ্নটা করবো, টাকার জন্যই কি তুমি এই বাড়িতে ফিরে এসেছো রুমানা চৌধুরী? ভালোবাসার কি কোন মূল্য নেই তোমার কাছে?’, এটুকু বলে অনিক হাসলো। রুমু কিন্তু হাসলো না। গম্ভীর গলায় বললো,’তোমার কি মনে হয়?’

-‘আমার? আমার তো মনে হয় আমাকে খোঁচানোর জন্যই তুমি ফিরে এসেছো।’

এবার রুমু হাসলো। অনিকের কাধে আলতো চাপড় মেরে বললো,’এই তো ঠিক ধরেছো। এই না হলে আমার বর?’

-‘এসব বুদ্ধি তোমাকে কে দিয়েছে? আমি কি পাগল যে আমাকে ঠিক করার দায়িত্ব নিতে হবে তোমার? কেন শুধু শুধু আমার পেছনে পড়ে নিজের লাইফটাকে বরবাদ করতে চাইছো? সুন্দরী, হট, অ্যাট্রাক্টিভ, শিক্ষিতা তুমি। ইউ ডিজার্ভ বেটার দ্যান মি!’

রুমু যেন অনিকের কথা শুনতেই পায় নি, ঘোষনার সুরে বললো,’ফ্রম টুড্যে এন্ড ফরএভার, এই বাড়িতে ড্রিংকস বন্ধ! কেউ যদি আমার বাড়িতে ড্রিংক করে কিংবা করার চেষ্টা করে তাহলে ঘাড় ধরে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হবে।’

অনিক বিরক্ত মুখে বললো,’তুমি আমাকে থ্রেট দিচ্ছো? তুমি জানো আজকেও রহমান আমাকে অনুরোধ করে এই বাড়িতে ফিরিয়ে এনেছে?’

-‘নেক্সট টাইম থেকে আর আনবে না।’

-‘বেঁচে যাই।’

-‘তোমার মুরোদ আমার জানা আছে। বন্ধুর বাড়িতে কয়দিন পড়ে থাকতে পারবে?’

-‘বন্ধুর বাড়িতে থাকবো কেন? আলাদা বাসা নিয়ে থাকবো?’

-‘তাই নাকি? কিন্তু তুমি যেখানে থাকবে আমিও তো সেখানেই থাকবো। আর আমি যেখানে থাকবো সেখানে তো ড্রিংকস থাকতে পারবে না?’

অনিকের সুর নরম হয়ে গেলো। রুমুকে বশে আনার চেষ্টা করে বললো,’ কেন আমার পেছনে লেগেছো রুমু? আমি তোমার কি ক্ষতি করেছি?’

-‘কেন এখন আর রুমু,চুমু ডাকবে না? ভয় পেয়েছো? ডাকো দেখি, তোমার কত সাহস? তোমার সব পাগলামি আমি ছুটিয়েই ছাড়বো।’

চাপা রাগে অনিক মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রুমু অনিকের সেদিনের কথা অনুকরণ করে বললো,’এখুনি এত হাইপার হলে চলবে কি করে? আরো কতকিছু বলার আছে তোমাকে?’

-‘আমি শুনতে আগ্রহী নই।’

-‘আমি বলবো।’

-‘দোহাই তোমার। অনেক হয়েছে!’

রুমুর অনিকের অনুরোধের বিন্দুমাত্র
পাত্তা না দিয়ে নিজের মত বলতে শুরু করলো,’আমাকে যেহেতু বিয়ে করেছো তাই আমার সব দায়িত্ব তোমার। চাকরীর টাকা দিয়ে এতদিন যেই ফুটানি করতে সেটা এখন থেকে বন্ধ। আমার হাত খরচের টাকা দিতে হবে।’

-‘কেন ইউসুফ চৌধুরী টাকায় হচ্ছে না?’

-‘সেটা তিনি স্বেচ্ছায় আমাকে দান করেছেন। তাই বলে তোমার দায়িত্ব তো তুমি এড়িয়ে যেতে পারো না?’

অনিক সোজা গিয়ে খাটে শুয়ে পড়লো। সব ষড়যন্ত্র! তাকে ফাঁসানো জন্য ইউসুফ চৌধুরী ইচ্ছে করে এমন করেছে। নতুবা হঠাৎ করে নিজের বিষয়সম্পত্তি সব রুমুর নামে লিখে দেবে কেন? রুমুও তার পাশে শুয়ে দুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরতেই ঝাড়া মেরে হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,’আমি ঘুমাবো।’

-‘ঘুমাও না। আমি কি বারণ করেছি। সকালে তো আবার অফিস যেতে হবে।’

-‘যাবো না আমি অফিস।’

-‘সেটা তোমার ইচ্ছে। আমার হাত খরচের টাকা আমি পেলেই হলো। আইনত তোমার স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্ব তোমার। তুমি কিভাবে ম্যানেজ করবে সেটা তোমার ব্যপার। না পেলে কীভাবে আদায় করতে হবে সেটা আমার ব্যপার। আমি অশিক্ষিত মূর্খ নই যে স্বামীর অন্যায় মুখ বুঝে সহ্য করবো। বেশি বাড়াবাড়ি করলে ডিরেক্ট মামলা করে দেবো। ‘

অনিক হাল ছেড়ে দিয়ে হতাশ কন্ঠে বললো,’ঠিক আছে। পাবে, পাবে সব পাবে। এবার আমাকে ছাড়ো।’

রুমুর ছাড়লো না। উল্টো অনিকের ওপর চেপে বসে বললো,’স্ত্রীকে ভালোবাসাও স্বামীর কাজ।’

-‘আমার দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে রুমু।’

রুমু ছেড়ে দিয়ে নিরবে হাসলো। আচ্ছা জব্দ হয়েছে ভদ্র মাতালটা! নিজের টাকায় মদ কিনে খাবে, খুব আত্মসম্মান তাই না? এবার খাও? রুমুও দেখবে কি করে তুমি নিজের টাকায় মদ কিনে খাও?
.
.#পরিত্রাণ
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৫

সকাল আটটা বাজে। অনিক ঘুমোচ্ছে! রুমু
ঘুম ভেঙ্গেছে খুব সকালে। রান্নাঘরে সবার জন্য নাশতা তৈরী করছিলো সে। রুটির বানানোর মাঝে হঠাৎ করে সফুরাকে উদ্দেশ্য করে বললো,’অনিককে একটু ডেকে দিতে পারবেন, চাচী?’

-‘অনিক বাবাজি তো এত সকালে উঠে না।’

-‘আজকে উঠবে। আপনি কষ্ট করে একবার গিয়ে ডাক দিন অথবা কাউকে পাঠান, বলবেন আমি ডাকছি।’

সফুরা প্রতিউত্তর করলো না বটে,. চুপচাপ বেরিয়ে গেলো। কিন্তু তার মুখ দেখে মনে হলো সে শতভাগ নিশ্চিত অনিক উঠবে না। হলোও তাই! কিছুক্ষন পরই সফুরা মৌনমুখে রান্নাঘরে ফিরে এসে বললো,’উঠে নি।’

রুমু রুটির আটা মলছিলো। সে নিজেও জানতো অনিক উঠবে না। তবুও সফুরাকে দিয়ে ট্রাই করে দেখতে চাইলো কি হয়?ফলাফল শূন্য দেখে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে নিজেই উপরে উঠে গেলো। রুমে ঢুকতেই দেখলো অনিক পাশবালিশ জড়িয়ে ধরে কাত হয়ে ঘুমাচ্ছে। হাতে আটা লেগে থাকায় কনুই দিয়ে অনিককের পিঠে আলতো করে গুঁতো দিলো সে। অনিক পাশ ফিরে চোখ খুললো। ফের চোখ বন্ধ করে বিরক্ত মুখে বললো,’কি হয়েছে?’

-‘ওঠো। তোমার অফিস আছে না?’

-‘আরো পরে।’

-‘দশটা বেজে গেছে।’

অনিক বালিশের পাশ থেকে হাতড়ে হাতঘড়ি বের করলো। ঘড়ির সময় দেখেই কপালে কুঞ্চন দেখে দিলো তাঁর। ঘুমঘুম কন্ঠে বললো,’বিরক্ত করো না তো রুমু। যাও নিজের কাজ করো।’

-‘তুমি উঠবে না?’

-‘না।’

-‘আমি কিন্তু গায়ে পানি ঢেলে দেবো।’

-‘সকাল সকাল কেন অশান্তি করছো? আমার সময় হলে আমি নিজেই উঠবো।’

রুমু নিরবে হাসলো। কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে চট করে অনিকের গালে একটুখানি আটা মাখিয়ে, দিলো একদৌড়! কিন্তু আশানুরূপ কিছুই ঘটলো না। সে ভেবেছিলো অনিক রেগে গিয়ে রিয়েক্ট করবে, কিন্তু নাহ্ অনিকের কোন হোলদোল হলো না। চোখ বন্ধ রেখেই গালে মাখানো আটা বালিশে মুছে ফেললো সে। রুমু বিরক্ত হলো। কি অদ্ভুত মানুষ! একটু তো রাগ করা উচিৎ ছিলো। আবারো এগিয়ে গেলো সে। এবার একদম ভালো করে আটা মাখিয়ে দেবে। রুমুও দেখবে কতক্ষন সহ্য করে! কিন্তু খাটের কাছে পৌঁছাতেই অনিক আচমকা চোখ খুলে ফেললো। রুমু ভড়কে গেলো! অনিক কিছুক্ষন চেয়ে থেকে মিষ্টি করে হাসলো। ওর চোখ দেখে মনে হলো ঘুমের ঘোরেই হাসছে সে। অনিক পুনরায় চোখ বন্ধ করতেই তাঁর পিঠের ওপর জেঁকে বসলো রুমু। অনিক ওকে পিঠের ওপর থেকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বললো,’বড্ড বেশি সাহস তোমার! বারণ করেছিলাম না?’

-‘তুমি উঠছো না কেন? একা একা নাশতা করতে আমার ভালো লাগে না!’

অনিক ধমকের সুরে বললো,’আবার কথা বলে?’

-‘তো কি করবো? তোমার মত দিনের দশটা পর্যন্ত শুয়ে থাকবো?’

-‘না। তোমাকে কেউ শুয়ে থাকতে বলছে না। তুমি নিচে যাও। আমি একটু শান্তিতে ঘুমাবো।’

রুমুর প্ল্যান হচ্ছে কথা বলতে বলতে অনিকের ঘুম নষ্ট করে দেওয়া। তাই নিজের উদ্দেশ্যহীন কথাবার্তা চালিয়ে গেলো সে। বললো,’না দিলে কি করবে?’

-‘একদম বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেবো।’

-‘ইশ। কত যেন ক্ষমতা তোমার? অধিকার আছে বউয়ের ওপর?’

রুমুর খোঁচানিতে অনিক মুচকি হাসলো। বললো ,’তোমার মুখে মধু দেয় নি, না? সব সময় শুধু খোঁচা দিয়ে কথা বলো।’

রুমু হাসলো না। মুগ্ধ হয়ে অনিকের হাসিহাসি মুখখানার দিকে চেয়ে রইলো সে। ইশ! কি সুন্দর! অথচ কত দুঃখ! আলতো করে অনিকের ডান গালে চুমু খেলো সে। অনিক ঠোঁট কামড়ালো। চোখ বন্ধ রেখেই রুমুকে আরেকটু কাছে টেনে নিয়ে বললো,’আই অ্যাম নেভার গ’না কিস ইউ? কে যেন বলেছিলো? এখন একটা অভদ্র, মাতাল, বেকুবের গালে কেন চুমু খাওয়া হচ্ছে? মাতালটা যদি উল্টোপাল্টা কিছু করে বশে তবে দোষ কার? এদেশে যত দোষ সব মাতালের!’

রুমু হাসলো। সস্নেহে অনিকের মুখপানে চেয়ে বললো,’ওঠো, অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছে।’ এবার না উঠলে বাস্তবিকই দেরী হয়ে যাবে। আর ঢিলেমি করলো না অনিক। বাধ্য ছেলের মত বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো।


নাশতা সেরে অফিসের জন্য রেডি হচ্ছিলো অনিক। রুমু এসে তাঁর হাতে একটা লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে বললো,’অফিস থেকে ফেরার সময় জিনিসপত্র গুলো নিয়ে আসবে।’

অনিক লিস্টটা হাতে নিয়ে খুব ভাব নিয়ে বললো,’কি এটা?’

-‘লিস্ট। এইজিনিসগুলো আনতে হবে।’

অনিকের মুখে বিরক্তি দেখা দিলো। সকালের খানিকটা প্রশ্রয়ে রুমু বাড়বাড়ি শুরু করেছে! নাহ! আর প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। এত সহজে অনিক পিছলে পড়বে না। লিস্টটা ফের আরো একবার রুমুকে দেখিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,’তোমার কি মনে হয় আমি এগুলো আনবো?’

-‘কেন আনবে না?’, যেন বেশ অবাক হয়েছে রুমু। অনিক থতমত খেয়ে গেলো। রুমু কি সত্যিই জানে না? নাকি জেনেও না জানার ভান করছে? তাঁর রিয়েকশন দেখে তো মনে হচ্ছে অনিক যেন বহুকালযাবত তাঁর বাধ্য স্বামী ছিলো। তাই আজকে সে না করাতে খুব অবাক হয়েছে রুমু। অনিক গম্ভীর গলায় বললো,’না আনবো না। এসব আনার জন্য বাড়িতে অনেক লোক আছে।’

রুমু পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ অবাক হওয়ার ভান করলো। চোখ বড়বড় করে বললো,’তোমার বউয়ের পার্সনাল জিনিসপত্র তুমি অন্যলোককে দিয়ে আনাবে? দেখি আবার বলো, ফোনে রেকোর্ড করে নিই। মামলা করতে সুবিধে হবে।’

এবার অনিক ধরে ফেললো! এতক্ষন ইচ্ছে করে তাঁকে কনফিউজড করার চেষ্টা করছিলো রুমু। বিরক্তিতে মুখ কালো করে ফেললো সে। তাঁর রিয়েকশন দেখে রুমু হাসি আটকানোর বহু চেষ্টা করেও পারলো না। হো!হো করে হেসে ফেললো। যদিও এইমুহূর্তে হাসাটা মস্ত বড় বোকামি। তবুও হাসি চাপতে পারে নি সে। কিন্তু
পরোক্ষনেই সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে বললো,’হেসেছি বলে ভেবো না মিথ্যে মিথ্যে বায়না করেছি। জিনিসগুলো সত্যিই আমার লাগবে।’
অনিক টাইয়ের নট ঠিক করতে করতে বললো,’আমার কাছে এখন টাকা পয়সা নেই।’

-‘কিন্তু আমার যে জিনিসগুলো লাগবেই?’ ঠিক সময়মত মুখটা আবার করুণ বানিয়ে ফেললো রুমু। ওর অবস্থা দেখে অনিক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বাস্তবিকই তাকে জ্বালাতে ফিরে এসেছে এই মেয়ে! চুপচাপ লিস্টটা নিয়ে লিখে দেওয়া জিনিসপত্রগুলোর নাম পড়লো সে। সবই মেয়েলি জিনিস! লিস্টটা পকেটে ঢুকিয়ে বললো,’যদি মনে থাকে নিয়ে আসবো।’

-‘তুমি যে বললে তোমার কাছে টাকা নেই?’

-‘হ্যাঁ বলেছি?’

-‘তাহলে আনবে কি করে?’

-‘সেটা দিয়ে তুমি কি করবে? তুমি কি দেবে টাকা?’

-‘চাইলে ধার হিসেবে দিতে পারি? কিন্তু পরে ফেরত দিতে হবে।’

রাগ করার মিথ্যে প্রচেষ্টা চালিয়ে চোখ রাঙালো অনিক। কিন্তু লাভ হলো না। রুমু মিষ্টি করে হেসে বললো,’ভয় পাই নি!’

অনিক ফিরলো রাত দশটায়। সারাদিনের কাজের চাপে ক্লান্ত হয়ে অফিস ছুটির পর আজকে সোজা বাসায় ফিরে এসেছে। ভেতরে ঢুকতেই রুমু হাসিমুখে স্বাগতম জানালো। বললো,’এসেছো? আজকে এত দেরী হলো যে?’

-‘কাজের চাপ ছিলো।’, সংক্ষিপ্ত জবাব অনিকের। কথা শেষ করেই দ্রুত উপরে উঠে গেলো সে। রুমুও পেছন পেছন এলো।

ফ্রেশ হতে ঢুকেছে অনিক। অফিস থেকে খালি হাতেই ফিরে এসেছে সে। রুমুর দেওয়া লিস্টটা পকেটেই পড়ে আছে। কাজের চাপে জিনিসগুলো আনার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো। কিন্তু রুমু ভেবেছে ইচ্ছে করে আনে নি। মন খারাপ হয়ে গেলো তাঁর। অনিকের তাহলে সত্যিই রুমুর প্রতি আগ্রহ নেই। অপমানে, অভিমানে চোখে পানি চলে এলো। নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো সে।

অনিক ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখলো রুমু নেই। মনে মনে খুশি হলো সে! এই সুযোগ! আলমারি থেকে ড্রিংক্সের বোতল বের করা সোজা ছাদে চলে যাওয়া যাবে। রুমু টের পাওয়ার আগেই চুপচাপ কয়েক পেগ গিলে নিবে। নতুবা, রুমু দেখলে নির্ঘাত একটা ক্যাচাল শুরু করে দেবে। কিন্তু আলমারি খুলতেই তাঁর চোখ কপালে উঠে গেলো। বোতল নেই! জামাকাপড়ে ভেতরে এই এক বোতল বহু কষ্টে লুকিয়ে রেখেছিলো সে। এখন জামাকাপড়ের জায়গায় জামাকাপড় আছে কিন্তু বোতল নেই! নিশ্চয়ই রুমু ফেলে দিয়েছে। মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো তাঁর। এত দামী বোতল ফেলে দিয়েছে! মেজাজ কন্ট্রোল করতে না পেরে খানিকটা গলা চড়িয়েই ডাক দিলো রুমুকে। সফুরার কাছ থেকে খবর পেয়ে রুমু বেশকিছুক্ষণ পর ধীরেসুস্থে ঘরে এসে ঢুকলো। প্রচন্ড রাগের দরুণ তার মলিন মুখ অনিকের নজরে পড়লো না। সে তাঁর নিজের মত চেঁচিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করলো,’আমার বোতল ফেলেছো কে?’

-‘আমি?’, নির্বিকার জবাব রুমুর। রোবটের মত শোনালো তাঁর কন্ঠস্বর!

রুমুর নির্লিপ্ত ভাবভঙ্গি অনিকের রাগ আরো বাড়িয়ে দিলো। রাগে দাঁতেদাঁত চেপে বললো,’তুমি প্রচন্ড বাড়াবাড়ি করছো রুমু? আমার কিন্তু মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তোমার ভাগ্য ভালো আমি এখনো তোমাকে কিছু বলছি না। কিন্তু নেক্সট টাইম থেকে আমার আলমারিতে হাত দেবে না তুমি।’

রুমুও রাগে চোখমুখ লাল করে বললো,’দেবো। দেবো, একশোবার দেবো। আমার জিনিসগুলো আনো নি কেন তুমি?’ বলতে বলতেই কেঁদে ফেললো সে। অনিক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো! কোথায় সে রাগ করবে, তার এত সাধের বোতল রুমু ভেঙ্গে ফেলেছে কিন্তু না রুমু তো উলটো রাগ করে বসে আছে। মেয়ে মানুষের জাতটাই অদ্ভুত! কনজেনিটাল অভিনেত্রী এরা! নতুবা তাঁর মত একটা ছন্নছাড়া মানুষকেও কি না বউয়ের কাছে খোঁটা শুনতে হয়! বাধ্য হয়ে রাগ সামলে নিতে হলো তাঁকে। গলার স্বর নরম করে বললো,’আমার মনে ছিলো না।’

রুমুর ওপর রাগ ধরে রাখতে না পেরে মনে মনে নিজের ওপর রাগ হলো অনিকের। কিন্তু রুমুর কান্না থামলো না। কাঁদতে কাঁদতেই প্রতিবাদের সুরে বললো,’মিথ্যে কথা। তুমি ইচ্ছে করে আনো নি। আমি জানি। তুমি আমাকে একটুও সহ্য করতে পারো না।’

-‘সেটা যখন বুঝতেই পেরেছো, তখন চলে গেলেই তো পারো?’

-‘কাবিনের টাকা শোধ করে দিতে পারবে? সেই ক্ষমতা আছে তোমার? থাকলে আমার দেনমোহর শোধ করে দাও, এক্ষুনি চলে যাবো।’

অনিকের জবাব বন্ধ হয়ে গেলো। মনে মনে রুমুর বুদ্ধির তারিফ না করে পারলো না সে। আচমকাই হেসে ফেললো। মুচকি হেসে বললো,’কাবিনের টাকা দিলে সত্যি সত্যিই ঘাড় থেকে নামবে তো? তাহলে একটা কিডনী বেঁচে দেবো।’ জবাবে রুমু ভেংচি দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
.
.
.
চলবে
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here