#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_১৪
রোদ্দুর এক পলক উথাল পাথাল করে দেয়া বিস্তর ক্ষমতার মানুষটির দিকে চেয়ে বলে,
—“হাত ধরেছিস মানলাম।এরপর যেন কোলে উঠতে চাইবি না।তা কিন্তু মেনে নিবো না।আগেই বলে রাখলাম।”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রোদ্দুরের হাতে টান পড়ল।হালকা ঘুরে চেয়ে দেখে অহি আবার নিচে বসে পড়েছে।অবাক হয়ে বলল,
—“আবার বসে পড়লি কেন অজান্তা?আজ কি বাসায় ফেরার ইচ্ছে নেই?”
—“আছে রোদ্দুর ভাই।বাসায় গিয়ে টানা সতেরো ঘন্টা ঘুম দিবো।”
—“তো?হাঁটছিস না কেন?তাড়াতাড়ি উঠ।”
—“আমি আর হাঁটবে পারবো না রোদ্দুর ভাই।আমায় কোলে করে নিয়ে চলুন।”
—“কি সাংঘাতিক!এই ছিলো তোর মনে?”
অতঃপর বিস্ফারিত নয়নে চারপাশে পরখ করলো রোদ্দুর।সন্ধ্যার পর এখানে আরো মানুষের ঢল নেমেছে।জোড়া, জোড়া ছাড়া! সব ধরনের মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে।এত মানুষের সামনে অহিকে কোলে নেওয়া জাস্ট ইম্পসিবল!
সে অহির দিকে চেয়ে অনুরোধের কন্ঠে বলল,
—“অজান্তা লিসেন!এটা বিদেশ নয়,বাংলাদেশ!এত মানুষের মধ্যে তোকে কোলে নিয়ে যাওয়া কেমন দৃষ্টিকটু দেখায়।তুই আর একটু কষ্ট কর।দশ মিনিটের মতো গেলে রিকশা পাব।”
অহি চিন্তিত গলায় বললো,
—“তাই তো!তাহলে রোদ্দুর ভাই, আপনি কথা দিন যে বাসার সামনে গিয়ে মূল ফটক থেকে সদর দরজা পর্যন্ত কোলে করে নিয়ে যাবেন?”
রোদ্দুর হেসে ফেলল।অন্ধকার ছাপিয়ে সে হাসির সুর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।অহি কান পেতে শোনে।যেন এই পরিবেশে হাসিটা একদম উপজীব্য!
রোদ্দুর হাসি থামিয়ে বলে,
—“তোর হঠাৎ এত কোলে উঠার শখ জাগলো কেন?”
—“আপনি মনে করিয়ে দিলেন তাই!”
—“এতো দেখছি নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনলাম।আচ্ছা এখন হাঁট!কোলে নিবো তখন!”
বলে রোদ্দুর অহির হাতে টান দিল।কিন্তু অহি তারপরও উঠলো না।সে মন খারাপ করে নিচের দিকে চেয়ে আছে।রোদ্দুর চারপাশ এক নজর দেখে চট করে মাথা নিচু করে অহির ডান গালে গভীর এক চুমু বসিয়ে দেয়!তারপর অহির হাত ছেড়ে হেঁটে সামনে এগিয়ে যায়।
অহির সর্বত্র মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে।দ্রুত উঠে দৌঁড়ে রোদ্দুরের সমানে সমানে হাঁটতে থাকে!
——————-
বাসার কাছে রিকশা থামতে রোদ্দুর অহির থেকে হাত ছাড়িয়ে নেমে পড়ে।ওয়ালেট বের করে ভাড়া দেয়।রিকশা উল্টো ঘুরে চলে যেতে সে অহিকে বল,
—“চল!বাসার সবাই আজ অনেক বকা দিবে রে!অনেক রাত হয়ে গেছে।”
—“কই রাত হয়েছে?”
রোদ্দুর উত্তর না দিয়ে হাঁটা ধরে।বেশিদূর আগাতে পারে না।অহি তার হাত টেনে ধরে।এদিকটা অন্ধকার!অন্ধকারে রোদ্দুর বিস্মিত চোখে অহির দিকে তাকায়।অহির মুখ স্পষ্ট নয়!তাকে অনেকটা ছায়া মানবীর মতো লাগছে!তাকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে!গভীর ছোঁয়া!
রোদ্দুর ঢোক গিলে বলে,
—“দাঁ-দাঁড়িয়ে পড়লি কেন অজান্তা?”
অহি উত্তর না দিয়ে দু পা এগিয়ে এসে রোদ্দুরকে জড়িয়ে ধরে।রোদ্দুরের হাত নিজের অজান্তে অহির পিঠে চলে যায়।অহিকে দু হাতে আষ্টেপৃষ্টে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়!অহি ফিসফিস করে বলে,
—“আপনাকে এক পৃথিবী ধন্যবাদ রোদ্দুর ভাই।”
রোদ্দুর উত্তর দেয় না।সে চোখ বন্ধ করে আছে।ভেতরে অন্য ধরনের অনুভূতি হচ্ছে।কয়েক সেকেন্ড পর অহির মতোই ফিসফিস করে বলে,
—“অজান্তা!আমার এত কাছে আসিস না।প্লিজ!”
অহি আরো শক্ত করে রোদ্দুরকে জড়িয়ে ধরে।কয়েক মিনিট পর অহি হঠাৎ মৃদু শব্দ করে আর্তনাদ করে।রোদ্দুর দ্রুত ছেড়ে দিয়ে চিন্তিত গলায় বলে,
—“কি হলো অজান্তা?ব্যথা ট্যথা পেয়েছিস কোথাও?”
অহি রাগী কন্ঠে বলে,
—“এভাবে কেউ পায়ের উপর ভর দিয়ে জড়িয়ে ধরে?দিলেন তো বুট দিয়ে পায়ের পাতা একদম পিষে!আপনি এত গাধা কেন রোদ্দুর ভাই?”
রোদ্দুর আমতা আমতা করে বলল,
—“ইয়ে মানে স্যরি রে!খেয়ালে ছিল না।বেশি ব্যথা পেয়েছিস?”
—“রোদ্দুর ভাই! আপনার ডান পা এখনো আমার কড়ে আঙুলের উপর!”
রোদ্দুর এক পলক নিচের চেয়ে দ্রুত দু পা পিছিয়ে যায়।মনে মনে নিজেকে জঘন্য একটা গালিও দেয়।পুনরায় আবার এগিয়ে এসে এক ঝটকায় অহিকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা ধরে।
অহি প্রথমে অবাক হলেও মুহুর্তে খুশি হয়।রোদ্দুর ভাই তাকে কোলে তুলে নিয়েছে যেন বিশ্বাস হতে চায় না!তার কপালে এত সুখ সইবে তো!
সে দুহাতে রোদ্দুরের গলা জড়িয়ে ধরে।এই মানুষটাকে সে কখনো কষ্ট পেতে দিবে না।নিজের সবটা দিয়ে বাকি জীবনটাতে আগলে রাখবে!
সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রোদ্দুর অহিকে নামিয়ে দেয় কোল থেকে।কিন্তু অহি তার গলা ছাড়ে না।দুহাতে আরো শক্ত করে ধরে।রোদ্দুরের মাথাটা নিচু হয়ে আসে।সে ইশারায় গলা ছাড়তে বলে কলিং বেলে চাপ দেয়!
অহির দিকে পুনরায় তাকানোর আগেই অহি নিষিদ্ধ ও ভয়ংকর একটা কাজ করে। রোদ্দুরের সারামুখে এলোপাথাড়ি চুমু খেয়ে ছেড়ে দিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়!রোদ্দুর আর চোখ তুলে অহির দিকে তাকাতে পারে না।সে যেন হাওয়ায় ভাসছে!বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে।তার হার্ট অ্যাটাক আজ কেউ আটকাতে পারবে না।কেউ না!
একহাতে বুক চেপে আরেক হাতে অনবরত কলিং বেলে চাপ দেয়!কেউ খুলছে না কেন?
দরজা খুলতেই রোদ্দুর এক দৌঁড়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়!ভাগ্যিস ড্রয়িং রুমে তেমন কেউ ছিল না।নইলে তার হঠাৎ এমন আচরণে সবাই আরেক দফা অবাক হতো!
——————-
শাওয়ার নিয়ে অহি মাথার চুল মুড়িয়ে বের হয়।রোদেলা আপু এখনো রুমে আসেনি।কিন্তু রোদেলা আপুর সাথে তার অনেক কথা জমে আছে।অনেক কিছু জিগ্যেসও করতে হবে।সাদিদ স্যারের সাথে সময় কিভাবে কাটলো,কি কি কথা হলো সব!
সে বাসায় ফিরেই শুনেছে রোদেলা আপু নাকি স্ট্যাডি রুমে কিছু একটা দরকারী কাজ করছে।
এ বাসায় একটা ছোট্ট রুম আছে যেটা লাইব্রেরির মতো অনেকটা।প্রচুর বই দিয়ে ভর্তি।সংস্কৃত থেকে শুরু করে মিয়ান সভ্যতার পুরনো সব বই আছে।এই সবকিছু তার খালু সংগ্রহ করেছে।তিনি প্রতি রাতের খানিকটা অংশ লাইব্রেরীতে বই পড়ে কাটিয়ে দেয়!
অহি মাথার চুল ঝেরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে।আয়নায় নিজের প্রতিকৃতির দিকে তাকায়।সে কি অনেক বেশি সুন্দর?কই নাতো!কেমন ফোলা ফোলা গাল,একটু বোঁচা নাক!একপাশের টোল টাও বেশি বোঝা যায় না।রোদ্দুর ভাই তাতেই মুগ্ধ হয়ে গেল?
অহি আর আয়নায় তাকাতে পারে না।তার লজ্জা লাগে।ভীষণ লজ্জা লাগে।এমনিতেই মানুষটার সামনে সে কত নির্লজ্জ কাজ করেছে।এখন মুখ দেখাবে কি করে?
মোবাইলের টুং আওয়াজে ঘোর কাটে অহির।ড্রেসিং টেবিল থেকে উঠে পড়ে।বিছানার উপরে আধ শোয়া হয়ে বালিশের তলা থেকে ফোনটা হাতে নেয়।একটা এসএমএস এসেছে আননোন নাম্বার থেকে!এটা যে রোদ্দুর ভাইয়ের নাম্বার তা অহির বুঝতে বাকি রইলো না।কারণ এই নাম্বার থেকেই তার রোদ্দুর ভাইকে কনফেশনের মেসেজটা পাঠিয়েছিল!
সে মেসেজটা পড়া শুরু করলো।
“নিজেকে ভেঙে চুড়ে,সম্পূর্ণ টুকরো টুকরো করে তোমায় ভালো বেসে ফেলেছি।আমার মন নামক ছোট্ট শহরটা আজ শুধু ‘তুমি’ নামক মানুষটার দখলে।এখন তোমার নৈশব্দিক পদচারণার গুঞ্জনে আমার শহরে অন্ধকার কাটিয়ে ভোর হয়।তোমার প্রসারিত ঠোঁটের একটুখানি হাসি সূর্য হয়ে আলো ছড়ায়!তোমার ভারী নিঃশ্বাসের গন্ধ মেখে আমার শহরের দিন কাটে।
তোমার ঘন পল্লবঘেরা আড়চোখের একটুখানি চাহনি আমার শহরে ফকফকে জোসনা হয়ে ঝরে পড়ে।তোমার বাঁকা ঠোঁটের একটুখানি হাসি,আমার শহর তোলপাড় করে দেয়!তোমার এলোচুলের একটু দোলা,আমার শহরে পাগলা হাওয়া বইয়ে দেয়।তোমার হঠাৎ হঠাৎ লজ্জা মিশ্রিত মুখ,ফাগুনের আগুনে ভাসিয়ে দেয় আমার শহর!
তেমনি তোমার হঠাৎ হঠাৎ কুঁচকানো কপালের গভীরতা মেপেই আমার শহরে বৃষ্টি ঝরে।শেষ বিকেলের চায়ের কাপ হাতে নিয়ে উদাস হয়ে প্রকৃতি পানে তাকিয়ে থাকা তোমার মন খারাপের বিকেল আমার শহর এলোমেলো করে দেয়।বিষণ্ণতার ডাকে ছেয়ে যায় আমার শহর।ফের তুমি যখন মুচকি হাসো, আমার শহর যেন প্রাণ ফিরে পায়।
এভাবেই আমার শহরের নামহীন প্রতিটি স্তরে শুধু ‘তুমি’ নামক মানুষটার বিচরণ!আমার শহরে তোমার নিমন্ত্রণ রইলো।এক সমুদ্র ভালোবাসা নিয়ে দরজায় কড়া নেড়ো।আমি দু হাতে তোমায় বুকে আগলে নিবো।আমার রাজ্যের আমার মায়াপরীকে।ভালোবাসি!ভালোবাসি!ভালোবাসি!”
এইটুকুই লেখা।অহির বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে।সুখের ঝড়,ভালোবাসার ঝড়!সে ফোনটা বুকের উপর নিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
—“আমায় পাগল করে দেবেন না রোদ্দুর ভাই।একদম পাগল করে দিবেন না।আমি পাগলামি শুরু করলে তখন সামলাতে পারবেন না!”
আবার টুং করে মেসেজের আওয়াজ আসলো।সে দ্রুত ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো এবার ‘রোদ্দুর ভাই’ নাম দিয়ে সেইভ করা সেই পুরাতন নাম্বার থেকে এসএমএস এসেছে।বাংলায় লেখা…
“অজান্তা!যেখানেই থাকিস না কেন দুই মিনিটের মধ্যে আমার রুমে আয়।দরজায় টোকা দিতে হবে না।দরজা খোলা!দুই মিনিটের এক সেকেন্ড যেন নড়চড় না হয়।
আদেশক্রমে
রোদ্দুর হিম”
অহি হেসে ফেলল আবারো।মানুষটা তাকে নিয়ে এ কি খেলা শুরু করলো?প্রেম কথোপকথন এক নাম্বার দিয়ে।আর ঝাড়ি দেয় আরেক নাম্বার দিয়ে!
সে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো।
#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_১৫
অহি উঠে দাঁড়ালো।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে বার কয়েক আঙুল চালালো।তারপর মাথায় কাপড় দিয়ে হাঁটা ধরলো।দরজার কাছে পৌঁছাতে রোদেলা ভেতরে ঢুকে বলল,
—“কই যাস রে অহি?”
রোদেলার বিধ্বস্ত চেহারা অহির নজর এড়ালো না।মেয়েটা এত কেন পরিশ্রম করে?মুখটা কেমন চুপসে আছে।রাত বারোটার কাছাকাছি।এখনো ঘুমানোর কোনো তাড়াহুড়ো নেই।আবার তো ভোরবেলা উঠতে হবে!
অহি হাঁটতে হাঁটতে বলল,
—“আপু তুমি বসে রেস্ট নাও একটু।আমি চা করে আনছি।”
বলে সে সিঁড়ি দিয়ে নামলো।
ড্রয়িং রুম অন্ধকার।কুটি হয়তো লাইট বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে।এ বাসায় কুটি আর ফজিলা খালা রান্নাঘরের সাথের রুমটাতে থাকে।এর আগে রুমে একটা বড় খাট ছিল।সেখাতে দুজন একসাথে ঘুমাতো।কিন্তু মাঝে একদিন বাগড়া ধরে কুটি।ফজিলা খালার ঘুমানোর নাকি শ্রী নাই।বুকের আঁচল টাচল ঠিক থাকে না।একত্রে ঘুমাতে পারবে না।সেজন্য সে খালুকে আলাদা বিছানার কথা বলে!পরে অনেক ভেবে স্টিলের দুটো সিঙ্গেল খাটের ব্যবস্থা করা হয়েছে।এখন দুজন একই রুমে দু বিছানায় ঘুমায়।
অহি রান্নাঘরে সুইচ টিপে লাইট অন করলো।সাবধানে ডেকচিতে পানি দিয়ে চুলায় বসালো।সে শব্দ করতে চাচ্ছে না।কারো ঘুম যেন ভেঙে না যায়।ডিনারের পরপরই কুটি আর ফজিলা খালা ঘুমের অতলে হারিয়ে যায়!
কিছুক্ষণ পর গরম চা ছেঁকে তিনটা কাপে ঢাললো অহি।রং চা!রোদেলার আপুর কাপে এক চামচ চিনি,রোদ্দুর ভাইয়ের কাপে দেড় চামচ চিনি আর নিচের কাপে দু চামচ চিনি দিয়ে টুংটাং আওয়াজ তুলে নাড়াচাড়া করলো।
রান্নাঘরের লাইট বন্ধ করে ফোনের আলো জ্বলাল।তারপর ট্রে টা হাতে নিয়ে বাইরে কয়েক পা এগুতে কেউ পেছন থেকে ঝাপটে ধরলো।
অহি কিছু বলার আগেই কুটির কন্ঠ কানে আসলো।কম্পিত কন্ঠে বলছে,
—“ভূত ধরছি।হিম দাদার রুমের ছায়ার মতন ভূতটা ধরছি।আইজ ভূতের রক্ষে নাইক্কা!ওঝা ডাইক্যা ভূত বোতলে ভরমু!”
অহির ফোনটা ফ্ল্যাশ জ্বালানোর পর মুখে আটকানো ছিল।সে একহাতে ট্রে ধরে আরেক হাতে ফোন হাতে নিয়ে মুখ মুক্ত করে বলল,
—“কুটি!ছাড়ো তো আমায়।আমি অহি!”
—“অ্যা?”
—“ছাড়ো কুটি!আমাকে বোতলে ভরতে পারবে না।”
কুটি অহিকে ছেড়ে দিল।অহি ঘুরে নিজের মুখে ফোনের আলো ধরে বলল,
—” কুটি,চিনতে পেরেছো আমাকে?আমি কুঁজো ভূত নই!”
কুটি কিছু বললো না।লজ্জিত মুখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।অহি এক কাপ চা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
—“ভূত দেখলে তো!এখন সহজে ঘুম আসবে না।তার চেয়ে চা খাও রুমে গিয়ে।”
কুটি খুশি হয়ে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসলো।অহি বলল,
—“কুটি লাইট জ্বালিয়ে আরাম করে খাও।সাথে অল্প সাউন্ড দিয়ে টিভিও দেখতে পারো।কুঁজো ভূত ফের ডিস্টার্ব করলে তোমার কাপে থেকে তাকেও এক চুমুক চা দিয়ো।”
—“আফা,আপনে যান।আমার অন্ধকারে বইসা চা খাইতে অনেক মজা লাগে।কিন্তু আলিস্যার জন্যি বানান অয় না।”
অহি মুচকি হেসে উপরে উঠে গেল।।সে বেশ বুঝতে পেরেছে কুটি ইচ্ছে কৃত ভাবে তাকে ভূত ভেবে আটকেছিল।তার মূল উদ্দেশ্য ছিল চা খাওয়া।
রোদ্দুরের দরজায় হালকা টোকা দিয়ে অহি ভেতরে ঢুকল।রোদ্দুর ভাইও রুম অন্ধকার করে শুয়ে আছে।তার রুমে বেলকনিতে সবুজ বাতি জ্বালানো থাকে রাতের বেলা।কারণ বেলকনিতে চারটে কোয়েল পাখি আর দুটো লাভ বার্ডস আছে।
বেলকনির আলোর কিছুটা অংশ রুমে এসেছে।অন্ধকার হলেও সব বোঝা যাচ্ছে।অহি তবুও সুইচ টিপে বলল,
—“রোদ্দুর ভাই, আপনার জন্য চা করেছি!”
রোদ্দুর এক হাত কপালে আর এক হাত মাথার নিচে রেখে শুয়ে আছে।তার চোখ বন্ধ।অহির ডাক সে শুনতে পেয়েছে।বন্ধ চোখে বলল,
—“তুই চৌদ্দ মিনিট বত্রিশ সেকেন্ড পর রুমে এসেছিস!অথচ রোদ আপুর রুম থেকে আমার রুমে আসতে সাতচল্লিশ সেকেন্ড লাগে।”
—“আপনার জন্য চা করছিলাম রোদ্দুর ভাই।”
—“ভালো করেছিস।নিজেই চুমুক দিয়ে খেয়ে নে।”
—“আপনি কি রাগ করেছেন?”
রোদ্দুর পাশ ফিরে শুলো।শান্ত কন্ঠে বলল,
—“না!”
অহি চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রাখলো।সে চলে যাবে কি না বুঝতে পারছে না।রুমে আসার পর রোদ্দুর ভাই এক পলকের জন্যও তার দিকে তাকায়নি।চোখই খুলেনি!তাছাড়া অহির মনে চিন্তা হচ্ছে।খালামণি খালু ঘুমিয়ে পড়েছে।যদি কোনোভাবে তাদের মনে সন্দেহ জাগে?শুধু রোদেলা আপু জানে সে রোদ্দুর ভাইয়ের রুমে!
—“রোদ্দুর ভাই, আমি তাহলে যাই।”
রোদ্দুর চোখ খুলল।কিন্তু পাশ ফিরে অহির দিকে তাকালো না।সে আগে থেকে শপথ করে রেখেছে অহির দিকে তাকাবে না।এবার যদি অহির মতো সেও উল্টা পাল্টা কিছু করে ফেলে?
সে দেয়ালের দিকে চেয়ে বলল,
—“ড্রেসিং টেবিলের নিচের ড্রয়ারে দেখ মুভ আছে।পায়ে লাগিয়ে নিবি!আর গিয়ে রোদ আপুর থেকে ব্যথার ট্যাবলেট খেয়ে নিস।না হলে কিন্তু সকালে পা ফেলতে পারবি না।”
—“আমি কি আপনার পায়ে মুভ লাগিয়ে দিবো?”
রোদ্দুর চোখ বন্ধ করলো।সে অহিকে পায়ে মলম লাগিয়ে দেয়ার জন্যই ডেকেছিল।কিন্তু এখন মত চেঞ্জ করে ফেলেছে।এই মেয়ে ছুঁয়ে দিলেই সে কেমন জানি হয়ে যায়!
সে নরম গলায় বললো,
—“অজান্তা!রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।যাওয়ার সময় আমার রুমের দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে যাস!”
অহি ড্রয়ার খুলে একগাদা মেডিসিনের মধ্য থেকে মুভটা বের করলো।এক নজর রোদ্দুরের দিকে তাকালো।মৃদু স্বরে বলল,
—“শুভ রাত্রি রোদ্দুর ভাই।”
তারপর লাইট বন্ধ করে রুম থেকে বের হয়ে গেল।অহি বের হতেই রোদ্দুর এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠলো।টেনে টেনে শ্বাস নিল।মেয়ে টা আশপাশে থাকলেই সে কেম জানি হয়ে যায়।গুছিয়ে রাখা সব কথা অবিন্যস্ত হয়ে যায়।আজ অবধি অজান্তাকে তার একবারও মুখে ভালোবাসি কথাটা বলা হয়নি।ভেবে রেখেছিল আজ ফট করে বলে দিবে।কিন্তু কিছুতেই বলতে পারলো না।
টেবিলে এখনো চায়ের কাপ রয়ে গেছে।রোদ্দুর উঠে গিয়ে কাপটা হাতে নিল।তারপর বেলকনিতে গিয়ে বসলো।আজ রাতে তার ঘুম হবে না।মস্তিষ্কে অজান্তাকে নিয়ে সংসার সাজাতে সাজাতে রাত পেরিয়ে যাবে।
সামনের অন্ধকারের দিকে তাকালো রোদ্দুর।সমস্ত অন্ধকার ছাপিয়ে সে যেন সব জায়গা অজান্তার মুখটা দেখছে।চোখের সামনে শুধু একটা রমণী!
সে মুচকি হাসলো।প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে বাংলায় টাইপ করা শুরু করলো।
“আমার প্রতিটি অস্থির, দম বন্ধ করা সন্ধ্যায় তোমায় পাশে চাই!তোমার উপস্থিতি আমার অস্থিরতা দূর করে দিবে!তোমার একটুখানি পরশে আমার দমবন্ধ ভাব নিমেষে উধাও হয়ে যাবে।
হাজারো ক্লান্তি নিয়ে মন খারাপের বিকেলে অফিস থেকে ফিরেই তোমায় পাশে চাই।তুমি এগিয়ে এসে বিষণ্ণ নয়নে বুকে, বাহুতে হাত বুলিয়ে দিবে।চোখের পলকে আমার সব ক্লান্তি ফুস!
মাঝরাতে হুট করে যদি কোনো দুঃস্বপ্নে ছটফট করি,তুমি মাথাটা বুকে চেপে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে।আমাকে বুঝিয়ে দেবে যে তুমি আমার পাশে আছো!সবসময়!
রাত জেগে কাজ করতে করতে যদি শক্তি হারিয়ে ফেলি তখনো তোমায় পাশে চাই।তোমার উপস্থিতি,ঠোঁটের স্পর্শ আমায় পুনরায় শক্তি যুগিয়ে যাবে।
আমার অসুস্থের দিনগুলোতে তোমায় পাশে চাই। জ্বরে পড়লে তুমি রাত জেগে আমার সেবা করবে,আমার পাশে থাকবে।ক্ষণে ক্ষণে তাপমাত্রা পরিমাপের অজুহাতে কপালে তোমার ছোঁয়া পেতে তোমাকে পাশে চাই।ভীষণ ভাবে চাই!
পরিশেষে, আমার সমস্ত সুখে,দুঃখে,সমঝোতায়, সবকিছুতে তোমাকে পাশে চাই।যা নতুন, যা পুরাতন!সব অনুভূতির সাক্ষী হতে তোমাকে পাশে তাই।মিসেস রোদ্দুর হিম অজান্তাকে চাই!তুমি আমার রোজান্তা (রোদ্দুর + অজান্তা)ফরএভার!!”
এতটুকু লিখে আননোন নাম্বার থেকে সেন্ড করে দিল
এর আগেও এসএমএস পাঠিয়েছিল।সে সামনাসামনি অজান্তাকে তুমি করে বলতে পারে না।এভাবে বলাতেও সে শান্তি পায়।আহা!জীবন এত সুন্দর কেন?
————————–
কলেজ থেকে ফিরে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল রোদেলা।বিকেলের দিকে তার ঘুম ভাঙে শাহিনুরের চিৎকারে।
গায়ে থেকে কম্বল না সরিয়েই বলে,
—“কি হয়েছে মা?কেউ হার্ট অ্যাটাক করেছে?”
শাহিনুর সমানে কাঁপছে।তার প্রেশার সত্যি সত্যি হাই হয়ে গেছে।সে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল,
—“করেনি!কিন্তু এক্ষুণি করবে রে রোদু!”
রোদেলা ঝট করে চোখ খুলে বলল,
—“কে মা??”
—“আমিহ!আমি!”
—“কি সাংঘাতিক।তোমার আবার কি হলো?”
—“রোদু রে!তোর প্রিন্সিপাল আইছে বাড়িতে!”
—“অহ!”
পরক্ষণেই এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠলো রোদেলা।কম্পমান কন্ঠে বলল,
—“ক-কি বললে মা?ক- কে এসেছে?”
শাহিনুর বিছানায় বসে পড়লো।বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা সে।বসে বলল,
—“সুদর্শন,রাজপুত্তরের মতো একটা ছেলে।সাথে ফুলের মতো একটা পিচ্চি মেয়ে।আর সাথে আধ বুইড়া একটা লোক।এসে তো বলল যে তোর কলেজের প্রিন্সিপাল।তোর সাথে দেখা করতে এসেছে।তবে কোনটা প্রিন্সিপাল জানি না।”
রোদেলার মাথা শূন্য হয়ে যাচ্ছে।সাদিদ স্যার হঠাৎ ফ্যামিলি নিয়ে তার বাসায় কেন?তাও আবার কোনো আগাম খবর না দিয়ে?দুপুরেও তো রোদেলা কলেজে ছিল।তখন তো কিছু বলেনি।
শাহিনুর রোদেলাকে তাড়া দিয়ে বলল,
—“নিচে যাস না ক্যান?যাহ!ভালো মন্দ রান্না করতে হবে
প্রিন্সিপাল মানুষ বলে কথা।কি কি রান্না করা যায় বলতো?”
রোদেলা উত্তর দিল না।শাহিনুর ফিসফিস করে বলল,
—“আমার কি মনে হয় জানিস রোদু?বুইড়া প্রিন্সিপাল তার বড় ছেলেকে সাথে নিয়ে ছোট ছেলের জন্য হয়তো তোকে দেখছে আসছে।একটু সাজগোছ করে নিচে নাম।আমি যাই!রান্না চড়িয়ে দেই!”
বলেই শাহিনুর লজ্জা মিশ্রিত মুখে রুম থেকে বের হয়ে গেল।যেন রোদেলাকে নয়,তাকে দেখতে এসেছে!
দশ মিনিট পর রোদেলা অগোছালো মনটাকে একটু স্থবির করে নিচে নামলো।সিঁড়ির শেষ ধাপ পার হতেই সাদিদ স্যারের চোখে চোখ পড়লো।
(চলবে)
রিচেক করা হয়নি।বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।আজ বোনাস পার্ট দেয়ার চেষ্টা করবো।😍
(চলবে)
প্রেমে পড়েছে মন প্রেমে পড়েছে…..(উল্টা সেন্টি ইমোজি)