#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_১৬ (বোনাস পার্ট)
সিঁড়ির শেষ ধাপ পার হতেই সাদিদ স্যারের চোখে চোখ পড়লো রোদেলার!মুহুর্তে বুকের ধড়ফড়ানি আরো বেড়ে গেল।সে এগিয়ে যেতেই ছিনজা দৌঁড়ে এসে তার কোলে উঠলো।
রোদেলা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে একটু হাসার চেষ্টা করলো।ছিনজার কপালে চুমু দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দিল দুজনকে।বরাবরের মতো সাদিদ স্যার এবারও তার সালামের উত্তর দিল না।ছিনজার দাদু রোদেলাকে দেখেই হাসিমুখে বলল,
—“ওয়ালাইকুম সালাম মা!কেমন আছো মা গো?”
—“আমি ভালো আঙ্কেল!আপনি কেমন আছেন?”
—“আমিও অনেক ভালো।পাশে এসে বসো তো!”
রোদেলা মৃদু হেসে ছিনজাকে কোলে নিয়ে পাশে গিয়ে বসলো।সাদিদ স্যার হুট করে পরিবার সাথে নিয়ে কেন তার বাসায় এসেছে তার সমীকরণ মেলাতে পারছে না রোদেলা!
সবাই চুপচাপ নিরবতা পালন করে যাচ্ছে যেন!হঠাৎ রান্নাঘর থেকে শাহিনুর এসে সামনের সোফায় বসলো।ছিনজার দাদুকে প্রশ্ন করলো,
—“দাদা,আমি রোদেলার মা!”
—“আমি দেখেই চিনতে পেরেছি।রোদেলার সাথে আপনার চেহারার অনেক মিল আছে!”
রোদেলার মায়ের মুখ চুপসে গেল।পরক্ষণে তিনি হাসার চেষ্টা করে বললেন,
—“জ্বি দাদা!”
—“আমি এনামুল হক!আর কাউকে দেখছি না।আপনার ছেলে, তারপর রোদেলার বাবা!এরা কোথায়?”
—“রোদেলার বাবা আজ অফিস থেকে ফিরেই হাঁটতে বের হয়েছে।আর ছেলেটা আমার ছোট বোনের বাড়ি গেছে।অফিস থেকে বাড়ি আসেনি।কি একটা দরকারে যেন ও বাড়ি গেছে।এসে পড়বে সবাই!”
কুটি রান্নাঘর থেকে বের হয়েছে।রোদেলার কোলে মিষ্টি বাচ্চা দেখেই তার লোভ জাগলো।একটু কোলে নেয়ার লোভ!
রোদেলা ছিনজাকে নিয়ে উঠে পড়লো।ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম বের করে ছিনজার হাতে দিয়ে বলল,
—“আজ আন্টি এতো চুপচাপ কেন?”
ছিনজা মুখ ফুলিয়ে বলল,
—“আন্টি পঁচা।আমি আন্টির সাথে কথা বলবো না।”
—“কেন মা?আন্টি কি করেছে?”
—“আন্টি সেদিন আসার সময় বলেছিল যে রোজ আমার সাথে দেখা করবে।আমাদের বাসায় যাবে।কিন্তু সে যায় নি।সে পঁচা।কারণ পাপা বলেছে যে কথা দিয়ে কথা রাখে না সে পঁচা!”
রোদেলা হেসে ফেলল।এতটুকু একটা মেয়ে।কিন্তু কি সুন্দর পাকনা পাকনা কথা বলে।এটা অবশ্য সত্যি যে সে সেদিন ছিনজাকে অনেক বুঝিয়ে তবে ছাড়া পেয়েছিল।আজ দুই সপ্তাহের মতো হলো সে ছিনজার সাথে আর দেখা করেনি।মেয়েটার রাগ করারই কথা!মেয়েটা কেন জানি তার বাধক হয়ে গেছে।
রোদেলা ছিনজার গাল টেনে বলল,
—“পাপা বলেনি,যারা রাগ করে তারাও পঁচা!কিন্তু তুমি তো লক্ষী মেয়ে।”
—“তাহলে আমি আর রাগ করবো না।”
—“আন্টি কিভাবে বুঝবে যে তুমি আর রাগ করবে না?”
ছিনজা রোদেলাকে জড়িয়ে তার গালে একটা চুমু দিয়ে দিল।তারপর হেসে বলল,
—“আমি আর রাগ করে নেই!তুমি আমায় নামিয়ে দাও।আমি আইসক্রিম খাব।”
রোদেলা নামিয়ে দিতেই কুটি তাকে লুফে নিল।কোলে নিয়ে বলল,
—“বাবু,কাঁদে না।ওলে লে!চলো,আমরা সোফায় বইসা তোমারে গল্প শোনাই!”
কুটি ছিনজাকে কোলে নিয়ে ডাইনিং এর চেয়ার টেনে বসলো।রোদেলা সেদিকে পা রাখতে সাদিদ পেছন থেকে গলার স্বর খাদে নামিয়ে ডাক দিল।
—“মিস রোদেলা!”
—“জ্বি,বলুন!”
—“আমার একটু ইমার্জেন্সি!যেতেই হবে!”
রোদেলা অবাক হয়ে বলল,
—“কোথায় যাবেন স্যার?কোনো মিটিং পড়েছে?অবশ্যই যান!আমাকে বলতে হবে কেন?”
সাদিদ ইতস্তত করে চারপাশে এক নজর তাকিয়ে বলল,
—“একটু ওয়াশরুমে যাব মিস রোদেলা।আপনার বুদ্ধি তো দেখি ছিনজার থেকেও কম!”
রোদেলা ভীষণ লজ্জা পেল।তারপর বলল,
—“উপরে আসুন!”
সাদিদ যেন এটার অপেক্ষাই করছিল।সে রোদেলার পেছন পেছন দ্রুত পায়ে হেঁটে গেল।রোদেলার রোদ্দুরের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
—“এটাতে যান।নিচেও আছে।কিন্তু পরিষ্কার আছে কি না জানা নেই!”
—“এটা কি আপনার রুম?”
—“জ্বি না।এটা আমার ছোট ভাইয়ের।”
সাদিদ ঢুকতে নিয়ে থেমে গেল।দু একবার খুকখুক করে কেশে বলল,
—“মিস রোদেলা!আপনি কি আমায় আপনার রুমটাতে নিয়ে যাবেন?ইট’স ইমার্জেন্সি!”
—“কিন্তু আমার রুম বোধ হয় একদম অগোছালো।আ…..”
—“আমি কোনো দিকে তাকাব না।সোজা আপনার ওয়াশরুমে ঢুকে যাব!”
রোদেলা আর বাঁধা দিল না।সাদিদকে নিজের রুম দেখিয়ে চলে আসতে নিতে সাদিদ বলল,
—“মিস রোদেলা জান্নাত!নিচে যাবেন না।একটু ছাদে গিয়ে অপেক্ষা করুন প্লিজ!আমি আসছি।কিছু কথা আছে!”
রোদেলা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। একূল ওকূল ভাবতে ভাবতে ছাদে উঠে গেল।
উত্তর দিকের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল রোদেলা।সন্ধ্যা হবে হবে!সূর্য ডুবে গেছে পশ্চিম কোণে।কিন্তু অন্ধকার এখনো চারপাশ ঘেরাও করতে পারেনি!
তার মাথায় প্রচুর প্রশ্নেরা এসে জড়ো হচ্ছে।সাদিদ স্যার তাকে কি বলতে পারে?কি এমন বলবে যে নিরিবিলি আসতে বলল?
সাদিদের জন্য রোদেলার অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হতে চায় না।সে ছটফট করতে থাকে!ছাদের এ মাথা থেকে ও মাথা চক্কর দিতে থাকে।তার নিজের মাথা ঘোরা শুরু হয় কিন্তু সাদিদ ছাদে আসে না!ভুলে গেছে নাকি?
অনেক চিন্তা করে যখন রোদেলা সিদ্ধান্ত নিল নিচে নেমে যাবে তখন সাদিদের দেখা মিলল।সাদিদের দিকে চোখ পড়তে রোদেলা কেঁপে উঠলো।একি অবস্থা উনার?মাথার চুল সম্পূর্ণ ভেজা।বোঝা যাচ্ছে এতক্ষণ মাথায় পানি ঢেলেছে নিজে নিজে।চোখ গুলো লাল লাল।চুলের পানিতে আকাশি রঙের শার্টটার অনেকখানি ভিজে গেছে।শার্টের ইন টিন কিচ্ছু ঠিক নেই।
রোদেলা বিস্মিত কন্ঠে বলল,
—“স্যার, আর ইউ অলরাইট?”
সাদিদ এগিয়ে এসে বলল,
—“আমি ঠিক নেই!আপনাকে আজ কিছু কথা বলবো।সেজন্য নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম।মিস রোদেলা,আপনি কি আপনার ওড়নার এক অংশ দিয়ে একটু মাথা মুছতে দিবেন?”
—“কি!”
—“আসলে আমার সাইনোসাইটিসের সমস্যা আছে।ভেজা চুলে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”
—“রুমে তো টাওয়াল ছিল!”
—“এত কিছু খেয়াল করিনি।ওয়াশরুমে খুঁজলাম পেলাম না।”
রোদেলা অনিচ্ছা নিয়ে নিজের ওড়নার ডান অংশ এগিয়ে ধরলো।সাদিদ চোখ বন্ধ করে মাথাটা মুছে নিল।রোদেলার বুক কাঁপে!সাদিদ স্যার এমন কিছু বলবে না তো,যা সে মেনে নিতে পারবে না?
ধীরে ধীরে সাদিদের অবয়ব ঝাপসা হতে লাগলো।কারন চারপাশ ক্রমেই অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।সাদিদ রেলিং এ হাত রেখে সামনে দৃষ্টি মেলল।রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
—“রোদেলা তোমাকে আমার জীবনের কিছু গল্প শোনাই!
রোদেলার সারা শরীরে শিহরণ বয়ে গেল।সাদিদ স্যার তাকে কত গুলো বছর পর তুমি করে বলল!সে রেলিং শক্ত হাতে চেপে ধরে!
সাদিদ ফের বলে,
—“আমি পড়াশোনা করি ঢাকাতে হলে থেকে।বাবা মা সিলেট থাকতো। ফিজিক্সে অনার্স,মাস্টার্স করে কানাডা চলে যাই উচ্চ শিক্ষার জন্য।আমি হলাম বাবা-মার একমাত্র সন্তান।আমার স্কুল শিক্ষক বাবার স্বপ্ন ছিল আমাকে বিদেশে পড়ানোর।তার সেই স্বপ্ন নিজের মধ্যে লালন করে বিদেশ চলে যাই!বিদেশে সময় গুলো অনেক ভালো কাটছিলো।পার্ট টাইম জব করি।প্রচুর টাকা ইনকাম করি।নিজের খরচ বাদে সব বাসায় পাঠাই।ভার্সিটি যাই আর পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকি।সময় গুলো কেমন দ্রুত কাটছিলো।
আজ থেকে ছয় বছর আগে আমার ইউনিভার্সিটিতে ইমার্জেন্সি কল করে দেশে আসতে বলা হয়।আমি কিছু জানতাম না।আমার ইউনিভার্সিটির প্রক্টর আমার হাতে পাসপোর্ট আর টিকেট ধরিয়ে দিয়ে বলে,’ইমার্জেন্সি দেশ থেকে ঘুরে আসো!’ সঙ্গে সঙ্গে আমার রক্ত শীতল হয়ে যায়।আমি বুঝে যাই,বাসায় কিছু একটা হয়েছে।সেই কিছু একটা যে এতটা কষ্টকর কিছু ধারণাতে ছিল না।
দেশে ফিরে দেখি আমার মা মারা গেছে।সাত দিন লাইফ সাপোর্টে ছিল মা।কিন্তু আমি চিন্তা করবো বলে আমাকে জানানো হয়নি।”
সাদিদ থেমে যায়।তার গলা ধরে এসেছে।রোদেলার চোখ ঝাপসা হয়েছে অনেক আগে।সে একটু এগিয়ে এসে সাদিদের পাশে দাঁড়ায়।খুব ইচ্ছে হয় সাদিদের হাতটি শক্ত করে ধরে সান্ত্বনা দেয়ার।কিন্তু সাহসে কুলায় না।
সাদিদ নিজেকে সামলে আবার মুখ খুলে,
—“মাকে নিজ হাতে দাফন করে আসি।নিজে একটু বুক উজাড় করে কান্না করার ফুরসত পাই না।আমি ভেঙ্গে পড়লে বাবাকে সামলাবে কে?নিজের কষ্ট গুলো লুকিয়ে বাবাকে সামলাই।এর মধ্যে ইউনিভার্সিটিতে আবেদন করে পনেরো দিনের ছুটি ম্যানেজ করি।কিন্তু তবুও মনে চিন্তা হতে থাকে।পনেরো দিন তো দেখতে দেখতে চলে যাবে।আমি চলে গেলে বাবাকে দেখবে কে?এর মধ্যে বাবার মাথায় কোনো আত্মীয় আমায় বিয়ে করানোর পোকা ঢুকিয়ে দেয়।একদিন সন্ধ্যা বেলা বাবা এসে আবদার করে নতুন বউ ঘরে তোলার।বাবার মুখের দিকে চেয়ে হ্যাঁ বলে দিই।বাবার পাত্রী আগে থেকেই ঠিক করা ছিল হয়তো।কারণ সে রাতেই ঘরোয়া ভাবে পিতৃ-মাতৃহীন একটা মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায়।
বাসর ঘরে ঢুকে দেখি বাচ্চা একটা মেয়ে।বয়স পনেরো-ষোলো!সদ্য দশম শ্রেণীতে উঠেছে।আমার বড্ড মন খারাপ হয়ে যায়।মনে মনে ভাবি আর মাত্র সাতদিন পর তো চলে যাব।এতটুকু একটা মেয়ে কিভাবে সব সামলাবে?
সেদিন আমি বিছানায় বসে তার নাম জিজ্ঞেস করতেই কেঁদে গঙ্গা বানিয়ে ফেলে!ভয়ে আর ঘাটি না।পরের দিন বাবার মুখে থেকে তার নাম শুনি।ওর নাম ছিল ছিত্তিমা।ছয়দিন আমরা দুজন দু গ্রহের প্রাণীর মতো থাকি।সে শুধু আমাকে ভয় পায়,আমার থেকে আড়ালে থাকে।কিন্তু আমার বাবার সাথে ঠিকই ভাব জমে।
আগামীকাল রাত তিনটেয় আমার কানাডার ফ্লাইট।তখন আমরা গ্রামের বাড়ি থাকতাম।সকাল দশটাতে আমাকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিবো।সেই রাতে তাকে সাহস করে বললাম,’কাল আমি চলে যাব।তুমি বাবার সাথে থেকো।আর বাবার যত্ন নিয়ো।আমি রেগুলার ফোনে কথা বলবো।’এটুকু বলে আমি কাপড় চোপড় গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।হঠাৎ করে দমকা হাওয়ার মতো ছিত্তিমা এসে আমায় পেছন থেকে জড়িয়ে কেঁদে দিল।আমি এত পরিমাণ অবাক হলাম যে আমার হাত থেকে গোছানো কাপড় খসে পড়ে গেল।আমি ঘুরে তাকে পরম যত্নে বুকে জড়িয়ে নিলাম।
সেই রাতে আমার আর কাপড় গোছানো হলো না।আমাদের মধ্যে অন্য কিছু হলো।একদম অন্য কিছু!নতুন এবং গভীর কিছু।সেই রাতের সাক্ষী হিসেবেই আজকের ছোট্ট ছিনজা!”
রোদেলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে।কেন করছে সে জানে না।সাদিদের হয়তো সেদিকে নজর নেই।রোদেলা কান্না করতে করতে বলল,
—“তারপর?ছিত্তিমার কি হলো?”
—“পরেরদিন দশটায় আমি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।রওনা হওয়ার আগে বাবার পা ছুঁয়ে সালাম করলাম।আর আমার পিচ্চি বউটার ভেজা চোখের পাতায় চুমু দিয়ে বিদায় নিলাম।কানাডা পৌঁছে আমার কি যেন হয়ে গেল।অনেক চেঞ্জ হয়ে গেলাম।সবসময় ফুরফুরে মেজাজে থাকি।দেশে নিয়মিত যোগাযোগ করি।বাবা আর ছিত্তিমার সাথে সবসময় কানেক্টেড থাকি।বিদেশে যাওয়ার পর বুঝতে পারি আমি আমার পিচ্চি বউয়ের কাছে কিছু একটা রেখে গেছি।সেই কিছু একটা হলো আমার ‘মন’।বুঝতে পারি আমি তাকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছি।
এর প্রায় তিন মাস পরেই আমার জন্য আরো একটা সুখবর অপেক্ষা করছিল।সেদিন কানাডাতে প্রচুর তুষাড় পড়ছিল।রাস্তা ঘাটে কয়েক মিটার উঁচু হয়ে তুষাড় জমেছে।আশপাশের বাড়িঘর বরফ খনির মতো মনে হচ্ছে।তুষাঢ় ঝরা সেই সন্ধ্যায় ছিত্তিমা আমায় ফোন করে চুপিচুপি বলে,’আপনি বাবা হতে চলেছেন!”‘ ব্যস!আমার খুশি আর ধরে কে!কেমন অন্য রকম অনুভূতি।ছিত্তিমার প্রতি একরাশ কৃতজ্ঞতায় মন ভরে যায়।যেন পারলে আমি তাকে আমার জীবন দিয়ে দেই!
এর পরের সময়টাতে আমি প্রচুর পরিশ্রম করতে থাকি।টাকা জমাতে থাকি।কাগজাদি ঠিক করতে থাকি।বাচ্চা হলেই বাবাকে আর ছিত্তিমাকে কানাডা নিয়ে আসবো।ছিত্তিমার ডেলিভারির আনুমানিক ডেট মাথায় রেখে টিকেট কেটে রাখি দেশে ফেরার।ওই সময়টাতে তার পাশে থাকতে হবে যে!
অক্টোবর মাসের সতেরো তারিখ আমি দেশে ফিরি।এয়ারপোর্টে নেমে চারপাশে খুঁজে বাবাকে পাই না।বাবার সাথে কথা হয়েছিল যে তিনি কার ভাড়া করে রেডি থাকবেন।কিন্তু বাবা আসেনি!বুকের ভেতর পাথর চাপা কষ্ট হয়।আট ঘন্টার ট্রেন জার্নি করে সিলেট পৌঁছাই।বাসায় গিয়ে শুনি ছিত্তিমাকে হসপিটালে এডমিট করা হয়েছে।মুহুর্তে আমি দু চোখে অন্ধকার দেখি।জিনিসপত্র সব ফেলে হসপিটালে দৌঁড়াই।
গিয়ে দেখি ছিত্তিমাকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়েছে।তার নরমাল ডেলিভারি হচ্ছে না।ফিটাসে কিছু একটা গোলমাল হয়েছে।বাবা এনামুল হক উদ্ভ্রান্তের মতো অপারেশন থিয়েটারের সামনে বসে আছে।বাবাকে জড়িয়ে ধরে আমি হাউমাউ করে কান্না করতে থাকি।কেন করি জানি না। হয়তো আমার মন জেনে গিয়েছিল যে ছিত্তিমাকেও মায়ের মতো হারাতে বসেছি!
রাত ন’টার সময় ছিত্তিমাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়।ততক্ষণে আমার সব ভরসা শেষ।কারন ইতোমধ্যে ডাক্তার রা বলে দিয়েছে যে, অল্প বয়সে প্রেগনেন্সির জন্য তার শরীরে নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে।ছিত্তিমার শরীর ব্লাড গ্রহণ করছে না।কিন্তু জ্ঞান আছে।
আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে অনেক আকগেই।উদ্ভ্রান্তের মতো হয়ে গেছি।কেউ একজন আমাকে বলল,চাঁদের মতো আপনার একটা মেয়ে সন্তান হয়েছে।আমি সেদিকেে নজর দেই না।পাগলের মতো ছুটে ছিত্তিমার কাছে যাই।কি বিধ্বস্ত চেহারা হয়েছে ওর!মনে হচ্ছে একদিনে বয়স বেড়ে গেছে।ওর মুখে এক গাদা নল লাগানো।আমি কাঁদতে কাঁদতে ওর মুক্ত হাত টা বুকে জড়ালাম।ছিত্তিমার দু চোখের কার্নিশ বেয়ে জল ঝরছে।আমি দুহাতে মুছে দিয়ে ওর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালাম।ইশারায় বুঝালাম,তোমার কিচ্ছু হবে না।আমি এসে গেছি।
তার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো।মুখের মাস্ক খুলে আমায় শেষ বারের মতো কিছু বলে অন্য ভুবনে চলে গেল।”
সাদিদ ফ্লোরে বসে পড়েছে।সে কান্না করছে।বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে।ক্ষণে ক্ষণে তার শরীর কেঁপে উঠছে।
#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_১৭
সাদিদ ফ্লোরে বসে পড়েছে।সে কান্না করছে।বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে।ক্ষণে ক্ষণে তার শরীর কেঁপে উঠছে।তার কষ্টগুলো যেন অন্ধকার ছাপিয়ে চারপাশে বিরহের করুণ সুর ধরেছে।দূরে কোথাও একটা কুকুর অনবরত ডেকে যাচ্ছে।
রোদেলার হাত পা শক্ত হয়ে গেছে।অনেক কষ্টে সে রেলিং থেকে নিজের হাত ছাড়ায়।এগিয়ে এসে সাদিদের সামনে বসে পড়ে।সাদিদের মুখের দিকে ভেজা দৃষ্টিতে তাকায়!তার মানে এতদিন শুধু সে একা কষ্ট পায়নি।এ মানুষটা তার চেয়ে ভয়ংকর মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে দিন কাটিয়েছে।হোক না সে অন্য কারো জন্য কষ্ট পেয়েছে!রোদেলা সাদিদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেও দেয় না।মানুষটাকে সামলে উঠার সময় দেয়।
সাদিদ নিজেকে সামলে নেয়।বাম হাতে চোখ মুখ মুছে বলে,
—“ছিত্তিমার চলে যাওয়ার পর একদিকে বিধ্বস্ত মন,অন্য দিকে ছিনজার প্রাণ সংকট!দুটো মিলে যেন আমার করুণ দশা!দেড় মাস ছিনজাকে হসপিটালের স্পেশাল কেয়ারের জন্য রাখি।তারপর বাড়িতে এনে আমি আর বাবা মিলেই সব সামলাতে থাকি।নতুন করে মহিলা কাজের লোক নিযুক্ত করি!
তিন মাসের ছুটিতে দেশে ফিরেছিলাম আমি।ছুটি শেষ হতে বাবাকে আর ছিনজাকে নিয়ে কানাডা পাড়ি জমাই।দুজন মহিলা নিযুক্ত করি ছিনজার খেয়াল রাখার জন্য। তাছাড়া আমি তো আছিই!আমি ইউনিভার্সিটি গেলে বাবা সবসময় ছিনজার পাশেই থাকতো।আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চার হিসেবে যোগ দিছি।দিনের বেশিরভাগ সময় ল্যাবে কাজ করি।তারপর বাসায় ফিরেই ছিনজার পাশে থাকি।এভাবে বাকি দিনগুলো কাটছিলো।
কিছুদিন আগে বাবা বায়না ধরে,দেশে ফিরবে।একেবারের জন্য।বাবা ছিনজাকে সারাদিন বাংলা শিখাতো।সে স্পষ্ট বাংলায় আমাকে হুমকি দেয়,তার দেশে যাবে।আমারও তখন ইউনিভার্সিটিতে কাজের প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে।ঠিক মতো ছিনজাকে সময় দিতে পারি না।সেজন্য সব ছেড়ে ছুঁড়ে দেশে চলে আসলাম।ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট কিনে সেখানেই থাকি এখন।প্রায় আট মাসের মতো হলো দেশে ফিরেছি।প্রথম যখন ছিনজাকে নিয়ে বাংলাদেশ আসলাম,তখন ওর গায়ের রং কাগজের মতো সাদা ছিল।এ কয়েক মাসে দেশী আবহাওয়ায় একটু চেঞ্জ হয়েছে!”
চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে।অন্ধকারের নিজস্ব আলোতে চারপাশ স্পষ্ট।সাদিদ পকেট থেকে টিস্যু জাতীয় কিছু বের করে নাক মুছলো।পুনরায় আবার বলল,
—“তোমাদের কলেজে যখন আমার জয়েন করার কথা হয় তখন ভাইস প্রিন্সিপালের থেকে সব ডিটেইলস শুনি।উনি আমায় কলেজের গত বছরের একটা ম্যাগাজিন হাতে ধরিয়ে সব উল্টে পাল্টে বুঝিয়ে দেয়।এক পর্যায়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাৎ তোমার ছবিতে চোখ আটকে যায়।
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি।তোমাকে বড্ড চেনা চেনা লাগছে।কোথায় দেখেছি যেন!কিন্তু মনে করতে পারি না।মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়।পরের সময়টুকুতে স্যারের কথায় আর মনোযোগ দিতে পারি না।সেদিন রিশেপশনের সময় তোমায় এক নজর দেখেই চিনতে পারি তোমার কলেজে আমি গেস্ট টিচার ছিলাম।তবে তোমার হঠাৎ করে সেন্সলেস হওয়া আমাকে প্রচন্ড ভাবায়।
অনেক কৌতূহল জন্মে।সেজন্য তোমারে ব্যাপারে সব ইনফরমেশন যোগাড় করে ফেলি এবং জানতে পারি যে কোন একটা অজ্ঞাত কারণে তুমি আজও বিয়ে করোনি।আমার তখন বুঝতে বেগ পেতে হয় না।কারণ আমি তোমার সতেরো বছর বয়সের আমায় নিয়ে তোমার স্বপ্ন দেখার বিষয়টি বুঝতে পারতাম।বুঝতে পেরেই কিন্তু তোমায় আর দশটা মেয়ের মতোই ট্রিট করতাম।কোনো আলাদা ফ্যাসিলিটিজ দিতাম না যাতে তুমি ভুল ধারণা পোষণ করো।তাছাড়া আমি ভেবেছিলাম এটা বয়সের দোষ।একটু বড় হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু সেই কিশোরী বয়সের আবেগ টাকে যে এত প্রাধান্য দিবে স্বপ্নেও ধারণা করি।যদি কোনো ভাবে আমাকে তোমার সত্যিকার অনুভূতির কথা জানাতে হয়তো আমাদের গল্পটা অন্য রকম হলেও হতো!
তোমাকে সেদিন আমার কেবিনে ডেকে কিছু বলার সুযোগ করে দিলাম।কিন্তু তুমি আমাকে না চেনার ভান করলে।এরপর অহির সাথে আমার একটা এপয়েন্টমেন্ট হয়।অহি নিজে থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করে।হয়তো কোনোভাবে তোমার ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিল।”
রোদেলা বিস্ময় নিয়ে বলে,
—“তার মানে সেদিন হাতিরঝিল আপনার সাথে হওয়া কাকতালীয় কিছু নয়।সব প্রি প্লান ছিল?”
—“অনেকটা তেমনই!অহির থেকে যতটা জানতে পারি তাতে বুঝতে পারি যে তোমার পক্ষে এ জীবনে আর কারো মায়ায় জড়ানো সম্ভব না।এতগুলো বছর একটা মানুষকে না দেখে,না ছুঁয়ে, কথা না বলে শুধু অনুভব করে এতটা ভালোবেসে গেছো!নিজের সবটা উজাড় করে তাকে নিয়ে কল্পনার শহর সাজিয়েছো।তাকে পাবে কি পাবে না এমন হাজারো অনিশ্চয়তা জেনেও তার প্রতি তোমার অনুভূতির বিন্দুমাত্র নড়চড় হয়নি,ভবিষ্যতেও হবে না।তুমি এত পাগল কেন?কেন?
জানো রোদেলা,সেদিন অহির থেকে সব শুনে তীব্র আত্মগ্লানিতে ডুবে যাই। দিন-রাত ঘুমাতে পারি না।কোনো কাজ করতে পারি না।শুধু বুকের ভেতর ক্ষততে জ্বালা পোড়া করে।এই শহরেই কেউ একজন প্রতিটা সেকেন্ড আমার কথা ভাবে,আমায় নিয়ে স্বপ্ন সাজায়,আমার নামে শ্বাস নেয়,নিঃশ্বাস ফেলে যা আমায় প্রচন্ড পীড়া দেয়!নিজেকে ক্ষুদ্র, অস্তিত্ব হীন মনে হয়।
কিন্তু আমি তো এতদিন দিব্যি ভালো ছিলাম।ছিত্তিমার শোক কাটিয়ে উঠেছিলাম অনেক আগেই!তার সাথে কাটানো অতি অল্প সময়ের স্মৃতিও সময়ের নিষ্ঠুরতার কাছে হার মেনে ফিকে হয়ে গেছে।আমি তো ছিনজাকে নিয়ে, বাবাকে নিয়ে হাসি তামাশায় দিন কাটিয়ে দিচ্ছিলাম।এইতো বেশ ছিলাম।এই জীবনে আর কারো হাত ধরার ইচ্ছেও মরে গেছিল।
কিন্তু এই তুমি আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিলে।নতুন করে তীব্র মানসিক যন্ত্রণার কারণ হলে।সবসময় তোমার কষ্টে মনে অপরাধ বোধের সৃষ্টি হয়।ঘুমাতে পারি না,কাজ করতে পারি না,খেতে পারি না!কি একটা বাজে অবস্থা।
নিজের অপরাধ বোধ থেকে মুক্তির জন্যই ছিত্তিমার শেষ আবদার পূরণের কথা ভাবলাম।ছিত্তিমা মৃত্যুর আগে আমার হাত আকড়ে বলেছিল, ‘এই পৃথিবীর কেউ একজন আপনাকে আমার থেকে বেশি ভালোবাসে।যদি কখনো তার সামনা-সামনি হোন,তাকে গ্রহণ করে নিয়েন।আপনি তার হাতটা না ধরলেও আপনার হাতটা তাকে ধরতে দিয়েন।’
এখন বুঝতে পারছি ছিত্তিমা তোমার কথা বলেছে।মৃত্যুর আগে মানুষ দিব্যশক্তি লাভ করে না জানি না।হয়তো ভবিষ্যৎ দেখতে পারে।তবে এটুকু জানি যে ছিত্তিমা তোমার কথা বলেছে।”
রোদেলা নিশ্চুপ হয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।তার প্রতিত্তর দেয়ার শক্তিটুকু নেই যেন!সাদিদ তার মুখপানে চেয়ে বলে,
—“তুমি যদি অন্য কাউকে সুখী হতে তাহলে আমার আফসোস থাকতো না।কিন্তু আমি জানি তুমি আমাকে না পেলে চিরকুমারী থেকে যাবে।আর কোনো পুরুষের গলায় বরমাল্য দিবে না।যেটা আমার জন্য আরো যন্ত্রণা দায়ক!রোদেলা,আমি ছিনজাকে আকড়ে ধরে বাকি জীবনটা পাড়ি দিতে পারবো।কিন্তু তুমি অবিবাহিত একটা মেয়ে, একাকী জীবন যুদ্ধে হাঁপিয়ে উঠবে।একা একা জীবন নামক দূর্গম জার্নিটা সমাপ্ত করতে পারবে না।প্রতি পদে পদে বিপদ আর লাঞ্ছিত হবে।একট্ সময় তুমি চরম নিঃসঙ্গতায় নিমজ্জিত হবে।
জীবন নাম ট্র্যাকটা পাড়ি দিতে তোমার পাশে কাউকে প্রয়োজন যে তোমার দুঃখ বুক পেতে নিবে,নিজের জীবন বাজি রেখে তোমায় সব বিপদ থেকে প্রটেক্ট করবে,তোমায় ভরসা দিয়ে আগলে রাখবে।
রোদেলা,আমি আমার জন্য নয়!তোমার জন্য তোমার পাশে থাকতে চাই।ছিনজার জন্য নয়, তোমার জন্য তোমার পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে চাই!আমার হাত ধরার অধিকার তোমায় দিলাম।তুমি কি আমার হাত ধরবে?”
রোদেলা কান্না করছে।সে উঠে গিয়ে রেলিং চেপে দাঁড়াল।দৃষ্টি প্রসন্ন করে সামনের অন্ধকারে যেন কিছু একটা হাতড়ে বেড়াচ্ছে।সাদিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কবিতার লাইন বলা শুরু করলো,
“তুমি যাবতীয় দুঃখকে ছুঁড়ে দাও
আমি বুক পেতে নেবো
বুক ভাঙবেনা ।
দুয়ার বন্ধ করলেই
আমি ফিরে যাবো নির্বিকার ,
অস্বীকার করো মেনে নেবো ।
এলবামে স্মৃতি নেই বলে
আদৌ দুঃখ করিনা ,
সোনালি নিসঙ্গতায় আমার
বিচিত্র দুঃখের সমাবেশ সঞ্চয় – ।
ব্যথা দাও , বুকে রাখবো
ব্যথায় ভাঙবেনা বুক
বুকে ব্যথা আছে ।
-রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্”
রোদেলা কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না।সে নিঃশব্দে কান্না করছে যা সাদিদের বুঝতে অসুবিধা হলো না।সে উঠে গিয়ে রোদেলার থেকে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল।গম্ভীর গলায় বললো,
—“রোদেলা,আমার গল্পের পরিশিষ্টে হয়তো তুমি আছো বলেই ছিত্তিমা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেল।আমি তোমাকে নিয়ে নতুন করে গল্প সাজাতে চাই।তুমি কি তোমার গল্পের পরিশিষ্ট আমায় নিয়ে রচনা করবে?তোমার গল্পের পরিশিষ্টে আমায় স্থান দিবে?”
রোদেলা শব্দ করে কেঁদে উঠলো।দু হাতে শক্ত করে রেলিং চেপে ধরলো।এতক্ষণে সাদিদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।রোদেলার মতো একটা স্ট্রং একটা মেয়ে কত ছেলেমানুষি কাজ করে!সে শার্টটা টেনে টুনে ঠিক করলো।কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে রোদেলার কাছাকাছি দাঁড়ালো।
মনে মনে গুনগুন করে বলল,
“মন গড়া অভিযোগ…
জানি ভুলে যাবি তুই……
কাছে এসে আলতো করে…
যদি তোর হাতটা ছুঁই!!”
সাদিদ ডান হাত বাড়িয়ে চট করে রোদেলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।তারপর নরম গলায় বললো,
—“এত অভিমান আমার উপর রোদ?আমি তো জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে যাব!”
রোদেলা আর পারলো না।নিজের সব অভিমানের গোড়ায় জল ঢেলে ডান হাতে সাদিদের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো।যত ঝড়,ঝঞ্ঝা আসুক কখনো এই হাত ছাড়বে না।এই হাতটা যে তার একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থল।তার অনেক সাধনার ফল!
———————
মাঝরাতে দরজার উপর ধুমধাম কড়াঘাতে ঘুম ভেঙে গেল রোদ্দুরের।কপাল কুঁচকে এপাশ ওপাশ হয়ে চারপাশে হাতড়ে ফোন খুঁজলো।বালিশের চিপায় পেয়ে গেল।
রাত ৩ টা বেজে ২১ মিনিট।এত রাতে আবার কে দরজা ধাক্কায়?যার ইচ্ছে সে ধাক্কাতে থাকুক।ক্লান্ত হয়ে থেমে যাবে।রোদ্দুর উল্টো ঘুরে আবার চোখ বন্ধ করলো।সঙ্গে সঙ্গে তার কানে অহির গলা ভেসে আসলো।মৃদুস্বরে বার বার বলছে,
—“রোদ্দুর ভাই!রোদ্দুর ভাই!দরজা খুলুন।”
স্প্রিংয়ের মতো তড়িৎ গতিতে উঠে বসলো রোদ্দুর।অজান্তা এত রাতে কেন তাকে ডাকছে?সে এক দৌঁড়ে দরজা খুলে দেখে অহি দাঁড়িয়ে আছে।ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই অহি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
—“বাব্বাহ আপনার ঘুম!সেই কখন থেকে ডাকছি।”
—“তুই দেখলি না কত রাতে ঘুমিয়েছি?ছাগলের মতো তাও ডাকছিস কেন?কি এমন দরকারী কথা যা রাত তিনটেয় ঘুম ভাঙিয়ে বলতে হবে?সকালে বললে হতো না?”
—” না হতো না!”
—” অজান্তা,কি বলবি উগ্লে ফেল তাড়াতাড়ি!বাসার কেউ দেখলে আজ রাতেই বিয়ে পড়িয়ে দিবে।”
—“খালামণিই তো আপনাকে ডাকতে পাঠালো।”
—“সে কি!কেন?”
—“আমাদের দুজনকে আজ রাতেই বিয়ে দিয়ে দিবে !”
রোদ্দুর বিরক্ত গলায় বললো,
—“অজান্তা,এত রাতে ঘুম থেকে টেনে উঠিয়ে এসব কোন ধরনের পাগলামি করছিস?থাপ্পড় চিনোস?যা রুমে যা!”
রোদ্দুর দরজা বন্ধ করতে নিতে অহি বাঁধা দিল।হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,
—“ড্রয়িং রুমে আপনাকে ডাকছে মশাই!সবাই ড্রয়িং রুমে।খালামণির মাথায় আইস ব্যাগ চেপে আছে কুটি!তার মাথা গরম হয়ে গেছে।”
—“সে কি!মায়ের আবার কি হলো?”
—“কারণ সাদিদ ভাই এত রাতে নিজের বাসা থেকে গাড়ি ড্রাইভ করে এখানে এসেছে।ড্রয়িং রুমে বসে আছে এখন।সেটা দেখেই খালামণির মাথা গরম হয়ে গেছে। ”
—“রাত আটটার সময় না গেল! আজ মাত্র দুজনের বিয়ে ঠিক হলো,আর আজ রাতেই এসে হাজির?চল, নিচে যাই তো!”
রোদ্দুর অহিকে সাথে করে নিচে নামে।নিচে মোটামুটি একটা জটলা।সাদিদ সোফার মাঝে বসে আছে।তার একপাশে মুজিবুর রহমান।আরেক পাশে ফজিলা খালা।শাহিনুর বসে আছে সাদিদের মুখোমুখি।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সাদিদের দিকে চেয়ে আছে।তার মাথায় আইস ব্যাগ ধরে কুটি বিস্ফারিত নয়নে সব অবলোকন করছে।
রোদ্দুর চারপাশে তাকিয়ে রোদেলাকে কোথাও দেখতে পেল না।সে বলল,
—“রোদ আপু কই?কুটি গিয়ে আপুকে ডেকে আন তো!কুটি থাক!অজান্তা যা!”
(চলবে)