#গল্পের_নাম : পরিশিষ্ট
#লেখিকা : অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_০৪
রোদ্দুর কোনো কথা না বলে অহিকে একটানে রুম থেকে বের করে দিয়ে তার মুখের সামনে ঠাস করে দরজা আটকে দেয়।অহি কিছু বলার সুযোগটাও পায় না।
সে ফের দরজায় টোকা দিতে নিয়েও হাত ফিরিয়ে আনে।রোদ্দুর এখন অনেক রেগে আছে।রাগের বশে তাকে চড়, থাপ্পড় মারতে পারে আবার।যেটা খুবই লজ্জাজনক হবে!
অহি নিচে নেমে আসে।সোফায় শাহিনুর আধ শোয়া হয়ে আছে।রোদেলা পাশে বসে মায়ের মাথায় তেল পানি ঘষে দিচ্ছে।অহিকে দেখেই রোদেলা ঝটপট বলে,
—“কি রে!খাওয়াতে পারলি কিছু রোদ্দুরকে?”
রোদেলা রোদ্দুরের থেকে বয়সে দুই বছরের বড়ো।তার বয়স কয়েক মাস পর আটাশে পড়বে।কিন্তু এখনো বিয়ে করেনি।তাকে বিয়ের জন্য অনেক জোরজবরদস্তি করেও রাজি করানো যায় নি।বাধ্য হয়ে তার আগেই রোদ্দুরের বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিল।
অহি ডাইনিং এর চেয়ার টেনে এনে খালার মুখ বরাবর বসে। খালাও অধির আগ্রহ নিয়ে তার মুখপানে চেয়ে আছে।রোদ্দুর খেয়েছে কি না তার উত্তর জানতে চায়।
খালাকে দুশ্চিন্তা মুক্ত করার জন্য অহি বলে,
—“খালামণি, রোদ্দুর ভাই খাচ্ছে।আমি দেখে এসেছি।খেয়ে ঘুমাবে একটু।সেজন্য আমি চলে আসলাম।”
শাহিনুর ব্যথাতুর গলায় বললো,
—“চারপাশে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।আমার দুটো মাত্র সন্তান।তার একটা পণ করেছে জীবনে বিয়ে করবে না।আরেকটার বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে পাগলপ্রায় অবস্থা।”
এটুকু বলেই তিনি কিশোরী মেয়েদের মতো নাক টেনে কান্না শুরু করলো।রোদেলা বিরক্ত হয়ে বলল,
—“মা,আমি কবে বলেছি যে, আমি জীবনে বিয়ে করবো না?বলেছি যে, তোমরা যে ছেলে ধরে আনো তাদের আমার পছন্দ হয় না।আর অপছন্দের কিছু নিয়ে আমি সারাজীবন একত্রে সংসার করতে পারবো না।”
—“তা তুই কাউকে পছন্দই কর না!তোর পছন্দের কাউকেই নিয়ে আয়।বিয়ে দিয়ে চিন্তামুক্ত হই আমরা।”
রোদেলা কিছু বলতে নিতেই অহি থামিয়ে দিল।নরম গলায় বললো,
—“আপু, তুমি খালাকে ধরো।রুমে শুইয়ে দিয়ে আসি।”
দুজন দুপাশ থেকে ধরে শাহিনুরকে রুমে নিয়ে শুইয়ে দিয়ে আসে।তারপর দুজন রোদেলার রুমে ঢুকে।
এ বাসায় আসলে অহি রোদেলার রুমই নিজের করে নেয়।থাকার মতো অসংখ্য ফাঁকা রুম থাকলেও অহি রোদেলা আপুর সাথেই থাকে।আপু অনেক মজার মানুষ।আর প্রচুর জ্ঞান।জ্ঞানীদের মতো গুছিয়ে, কি সুন্দর করে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলে।অহি মুগ্ধ হয়ে তার প্রতিটা কথা শোনে।
আর রোদেলার প্রতিটি কথা সে বেদ বাক্যের মতো মানে।
রোদেলা আপুর ইংরেজিতে অনার্স, মাস্টার্স শেষ তিন বছর হলো।এখন ঢাকার টপ প্রাইভেট কলেজের ইংরেজির প্রফেসর।নিজেদের বিজনেসে তাকে জব করতে বলেছিল।কিন্তু আপু রাজি হয়নি।
তার নাকি শিক্ষকতা প্রচুর ভালো লাগে।
রোদেলা রুমে ঢুকেই এক লাফে বিছানায় উল্টো হয়ে শোয়।কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করে বলে,
—“রোদ্দুর এখনো কিছু খায়নি,তাই নারে অহি?”
অহি চমকিত হয়।নিজেও আপুর পাশে শুয়ে বলে,
—“তুমি কিভাবে বুঝলে আপু?”
—“ছাড় না!বুঝতে পেরেছি আমি।তোকে নিশ্চয়ই কোনো একটা কারণে রেগে মেগে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে।আমরা দুজন একই মায়ের গর্ভের হয়েও কতটা আলাদা দুজন, দেখছিস অহি?রোদ্দুর প্রচন্ড রাগী, জেদি,কথা বলতে চায় না বেশি,বললেও মুখের উপর ঠাস করে সব বলে দেয়।আর আমি ওর থেকে পুরো ভিন্ন।শান্ত,বোকা টাইপের,রাগ-জিদ কিচ্ছু নেই,বাচাল,অগোছালো ভাবে বকবক করতে থাকি সবসময়।সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো চরিত্র।”
—“তুমি জানো আপু,তুমি মানুষ হিসেবে অসাধারণ।আমাকে যদি পাঁচ জন ভালো মানুষের লিস্ট করতে দেয় তাহলে এক নাম্বারে তুমি থাকবে আপু।”
রোদেলা হেসে বলে,
—“আমাকে এক নাম্বার স্থান দিয়ে দিলি?তাহলে তোর রোদ্দুর ভাইকে কয় নাম্বারে রাখবি?নিজের ভালোবাসার মানুষকে এক নাম্বারে রাখবি না,এটা কেমন কথা?”
অহির সারামুখে লজ্জা ছড়িয়ে পড়ে।রোদেলা আপু তাহলে তার ব্যাপারটাও ধরে ফেলেছে?সে কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে।
রোদেলা অহির দিকে না তাকিয়েই বলে,
—“বেশি চিন্তা করিস না।বৃষ্টি রোদ্দুরের জন্য সঠিক ব্যক্তি ছিল না।ব্যাপারটা ভাইও কিছুদিন পর বুঝতে পারবে।আসলে বৃষ্টি রোদ্দুরকে ছেড়ে চলে যাওয়ায় যতটা না কষ্ট পেয়েছে তার চেয়ে বেশি ইগো তে লেগেছে।এতগুলো মানুষের সামনে বিয়ে ভেঙে যাওয়া চূড়ান্ত অপমানকর।কিছুদিন গেলেই ভাই ঠিক হয়ে যাবে।নতুন করে তখন নিজের করে নিস।তুই তো আর ছোট নেই অহি।প্রকৃতি কিন্তু সব মানুষকে সেকেন্ড চান্স দেয় না।এবার রোদ্দুর অন্য কারো হওয়ার আগেই নিজের আঁচলে বেঁধে নিস।”
রোদেলা থামে।অহি শোয়া অবস্থাতেই হাত বাড়িয়ে বালিশ টেনে আনে।একটা নিজের মাথার নিচে দিয়ে আরেকটা রোদেলার মাথার নিচে দেয়।তারপর একপাশ হয়ে রোদেলার দিকে তাকায়।
চিকন ভ্রু যুগল,একটু মোটা নাক,পাতলা ঠোঁট,ফর্সা ত্বক,আর ঝলমলে চোখ দুটো নিয়ে কি সুন্দর চেহারা রোদেলা আপুর।যে কেউ রোদেলা নামক মানুষটাতে আটকে যাবে!রোদেলা আপুর সবকিছুতে অহি মুগ্ধ।
সে রোদেলার ঘন চুলে হাত বুলিয়ে বলে,
—“আপু,তুমি এত ভালো কেন?তোমার মন এত সুন্দর কেন?জানো,যেই মানুষটা তোমায় পাবে সে এই পৃথিবীর সবচেয়ে লাকি পারসন হবে!”
রোদেলা হাসে।কি প্রাণবন্ত সে হাসি!হাসতে হাসতে অহির নাকে আলতো করে ছোঁয়।
অহি ফের বলে,
—“আচ্ছা, আপু!এতগুলো বসন্ত পেরিয়ে গেল।অথচ সত্যিই কি তোমার কাউকে পছন্দ হয়নি কোনোদিন?ইট,পাথরের শহরের এত এত প্রেমিক যুগলের ভীড়ে তোমার একবারের জন্যও কারো হাত ধরতে ইচ্ছে হয়নি?”
রোদেলা পাশ ফিরে অহির মুখোমুখি হয়।হাসি হাসি মুখে বলে,
—“বাদ দে এসব।তোকে একটা গল্প বলি।একটা মেয়ের গল্প।সদ্য ১৭ তে পা রাখা প্রাণোচ্ছল একটা মেয়ে। নতুন কলেজে উঠেছে তখন সে।নতুন কলেজ,নতুন পরিবেশ, নতুন টিচার,নতুন বন্ধুবান্ধব।এত এত নতুনত্বের মাঝেও মেয়েটা নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিল না।বহু কষ্টে এক মাস ক্লাস করার পর সে যখন সিদ্ধান্ত নেয় টিসি নেবে তখন তার জীবনে একটা মীরাকল ঘটে।একদিন একটু লেটে ক্লাসে ঢুকতে গিয়ে দেখে নতুন এক শিক্ষক।ঝাকড়া চুলের সদা হাস্যোজ্জ্বল এক সুদর্শন ছেলে।
কি মনে করে যেন ছেলেটি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে প্রথম দেখাতেই স্মিত হাসলেন।ব্যস!সেই হাসিতেই কিশোরী মেয়েটা ঘায়েল।তাকে নিয়ে মস্তিষ্কে জলজ্যান্ত এক সংসার সাজাতে বসলো।একটু সময়, সুযোগ পেলেই কল্পনার শহর খুলে বসতো।ক্লাসে হা হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতো।
তিন মাসের মাথায় হুট করে স্যারটা আসা বন্ধ করে।কিশোরী মেয়েটা দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়।এর ওর মুখে শুনতে পায়,স্যারটা নাকি এ বছরই ভার্সিটি কমপ্লিট করেছে এবং পিএইচডির জন্য কানাডা চলে গেছে।বিদেশ যাওয়ার মাঝের তিন মাস কলেজে গেস্ট টিচার হিসেবে ছিল।
ব্যস!কিশোরী মেয়েটার মনটা ভেঙে চুড়ে, খান খান হয়ে যায়।মস্তিষ্কে স্বযত্নে সাজানো প্রথম ঘর বাঁধা সংসারটা ঝড়ো বাতাসে দুমড়ে মুচড়ে যায়।কিশোরী মেয়েটার সব অভিমান গিয়ে জমা হয় টিচারবেশী ছেলেটার উপর।কেন, মেয়েটির থেকে বিদায় নিয়ে যায় নি?তবে কি সে মেয়েটির মনের ভাষা পড়তে পারেনি?না পারলে কেন মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আশকারার হাসি দিত?কেন টুকটাক কথা বলে তার কল্পনার শহরে রামধনু উঠাতো?
সেই থেকে কিশোরী মেয়েটার কি যেন হয়ে গেল।তার বয়স বাড়লো ঠিকই, কিন্তু ছোট্ট মনটাতে আর কাউকে বসাতে পারলো না কোনোদিন!”
রোদেলা কাঁদছে।নিরব,নিঃশব্দ সে কান্না।সে কান্নার আওয়াজ যেন অহির কান অবধিও পৌঁছে না।শুধু থেকে থেকে তার শরীর কেঁপে উঠে।অহি ডান হাতে রোদেলার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে শুধু।
অহির দু চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকায়।তার রোদ আপুরো এত কষ্ট?কই, কাউকে তো কখনো বুঝতে দেয় না?তার বাচ্চাদের মতো ওই খিলখিল হাসির আড়ালে লুকানো কষ্টের পাহাড়টা কেন কারো চোখে পড়েনি?
অহি মনে মনে আওড়ায়—
“ক্ষত শুকিয়ে গেলেও কিছুটা
চিহ্ন তো থেকেই যাবে
পোড়া স্মৃতির মতো
অথবা সঞ্চিত বিষাদ।
তুমি তো আঙুল তুলেই দেখিয়ে দিলে
অথচ বললে না
কোন পথে যেতে হবে আমাকে
কোন দিকে!
কবিতাঃকোন পথে যেতে হবে আমাকে
-রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্”
চারিদিকে সন্ধ্যা নামা শুরু হয়েছে।রুমটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।তবুও অহি উঠে আলো জ্বালায় না।যাদের মনের শহরে এত এত অন্ধকার, বাহ্যিক আলো কি তা দূর করতে পারবে?
———————-
রাতের বেলা এক প্লেট খাবার হাতে নিয়ে রোদ্দুরের দরজার সামনে দাঁড়ায় অহি।অনেক সাহস করে এসেছে সে।বিকেলের পর এক সেকেন্ডের জন্যও দেখা হয়নি দুজনের!
দরজায় টোকা দিতেই খুলে গেল।ভেড়ানো ছিল শুধু।বাহ!অবস্থার একটু বোধ হয় উন্নতি হয়েছে।দরজা যেহেতু খুলে রেখেছে।
রোদ্দুর বিছানায় শুয়ে ফোন টিপছিল।তার ভ্রু যুগল কুঁচকানো।পরণে কালো টিশার্ট আর কালো ট্রাউজার।টিশার্টের কলার উঁচু নিচু হয়ে আছে।মাথার চুল গুলো শাওয়ারের পর ব্রাশ করা হয়নি।এলোমেলো ভাবে কপাল লেপ্টে আছে।
অহি যে ভেতরে ঢুকে সেটা এখনো অনুভূতিতে আসেনি।অহির মন খারাপ হয়ে গেল।সে কত মনোযোগ দিয়ে মানুষটার খুঁটিনাটি পরীক্ষা করে।আর মানুষটা!তার দিকে কোনো নজরই নেই।সে কি রঙের জামা পড়ে,কি ফুল খোঁপাতে গুঁজে,চোখে কাজল দেয় কি না এসব কিচ্ছু খেয়াল করে না।
রোদ্দুর ভাই তার ব্যাপারে এত উদাসীন কেন?তার ডান চোখের কোণার তিলটা কি রোদ্দুরের কখনো নজরে এসেছে?ঠোঁটের দুই ইঞ্চি উপরের বাদামি তিলটাতে কি কখনো চুমু খেতে ইচ্ছে হয়নি?
এই যে সে এখন রোদ্দুর ভাইয়ের প্রিয় রঙের কথা মাথায় রেখে পার্পল কালারের থ্রি পিস পড়েছে।এত রাতে শাওয়ার নিয়ে মাথার চুল ছেড়ে রেখেছে এসব কি নজরে পড়ে না?
অহি নিঃশব্দে হেঁটে গিয়ে রোদ্দুরের মাথার কাছে দাঁড়ায়।অনেক কষ্টে মুখ খুলে বলে,
—“রোদ্দুর ভাই, আপনার খাবার।খেয়ে নিন!”
রোদ্দুর এক লাফে উঠে খাটে হেলান দিয়ে বসে।চোখে মুখে গম্ভীর গম্ভীর ভাব।ফোন থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই বলে,
—“অজান্তা,খাইয়ে দে তো।আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করি।ক্ষুধায় শেষ আমি!”
অহি আবার চমকায়।তার হাত কাঁপে।রোদ্দুর ভাই কি বিকেলের কথা ভুলে গেছে?
#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_০৫
—“অজান্তা, খাইয়ে দে তো আমায়!আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করি।ক্ষুধায় শেষ আমি!”
অজান্তা আবার চমকায়।তার হাত কাঁপে।রোদ্দুর ভাই কি বিকেলের কথা ভুলে গেছে?এতদ্রুত ভুলে গেল?কিভাবে সম্ভব?
রোদ্দুর এক মনে ফোনে কি যেন করছে।দেখে মনে হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কিছুই!কয়েক সেকেন্ড পর সে ফোন থেকে চোখ সরিয়ে অহির দিকে তাকালো।ভ্রু কুঁচকে বলল,
—“খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন ?নে বোস।খাইয়ে দে।”
রোদ্দুর একটু সরে গিয়ে অহির জন্য জায়গা করে দেয়।তার ধমকেই অহি বসে পড়ে। প্লেটটা বেডে রেখে ভাত মাখানো শুরু করে।তিন রকমের ভর্তা দিয়ে সাদা ভাত শুধু।তরকারি রান্না হয়েছে আজ।কিন্তু অহি জানে রোদ্দুর ভাই ভর্তা বেশি পছন্দ করে।
শুটকি ভর্তা দিয়ে সে ছোট্ট করে একটা লোকমা করে রোদ্দুরের মুখের সামনে ধরে।আজ প্রথম সে রোদ্দুরকে খাইয়ে দিবে।তার যেন বিশ্বাসই হতে চায় না।যেই মানুষটা থেকে সবসময় পালিয়ে বেড়াতো,কিভাবে যেন সেই মানুষটার এত কাছাকাছি যাচ্ছে!
রোদ্দুর ভাতের লোকমা টা মুখে পুড়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খায়।একটুপর ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বলল,
—“অজান্তা,তোকে বললাম ভাত খাইয়ে দে।আর তুই সঙ্গে সঙ্গে ভাত মাখানো শুরু করলি।হাত ধোয়ার প্রয়োজন বোধ করলি না?”
অহি জিভ কাটে।ছি!মনেই তো ছিল না।তার নিজের উপর বড্ড রাগ হয়।এতটা বেখেয়ালি মানুষ কিভাবে হয়?সে নিচু হয়ে দ্রুত হাতের ভাত ছাড়িয়ে বলে,
—“মনে ছিল না।এক্ষুনি হাত ধুয়ে নিচ্ছি।”
রোদ্দুর হো হো করে হেসে উঠে।অহি মুগ্ধ হয়ে তার দিকে চেয়ে থাকে।মানুষটা হাসলে সাথে চোখও হাসে।কি অনিন্দ্য সুন্দর সে দৃশ্য!এই মানুষটার হাসির শব্দও এত সুমধুর কেন?কানে মৃদু ঝংকার তুলে যায়।
সে বিড়বিড় করে বলে,
“তুমি হাসলে আমার ঠোঁটে হাসি
তুমি আসলে জোনাকি রাশিরাশি
রাখি আগলে তোমায় অনুভবে
বলো কি করে বোঝাই ভালোবাসি!”
রোদ্দুরের কানে তা পৌঁছাল না।সে প্রাণ খুলে হাসছে।হাসতে হাসতেই বলল,
—“তুই এতটা ডাফার আমি তো জানতাম না রে!ভাত মাখানো শেষ।এখন বলছিস হাত ধুবি!”
হঠাৎ করেই রোদ্দুরের হাসি থেমে যায়।অনেকটা বসন্তের পাগলা হাওয়ার মতো।হুট করে শুরু হয়ে হুট করে শেষ হয়ে যায়।
রোদ্দুর যেন ভুল করে হেসে ফেলেছিল।এক ধরনের অপরাধ বোধ জেগে উঠেছে তার সারা মুখ জুড়ে।সে ফোন নিয়ে পুনরায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
অহি বুঝতে পারে।সে ভাতের আরেক লোকমা তার মুখে পুড়ে দিয়ে অপরাধী সুরে বলে,
—“আমার হাত পরিষ্কার ছিল রোদ্দুর ভাই।মাত্র শাওয়ার নিয়েছি।”
—“তুই খেয়েছিস তো?”
অহির মুখে অযাচিত হাসি ফুটে উঠে।মাথা নেড়ে বলে,
—“হুঁ!”
তারপর বেশ কিছুক্ষণ দুজনের কেউ কোনো কথা বলে না।একটুপর রোদ্দুর নিজে থেকে জিজ্ঞেস করলো,
—“আমার জন্য বাসার সবাই চিন্তিত, তাই না রে অজান্তা?”
অহি কিছু বলে না।কি না কি বলে ফেলবে,আর রোদ্দুর ভাই আবার রাগ করবে।সে শুধু মাথা নেড়ে সায় জানায়।
রোদ্দুর নিজে থেকে বলে,
—“এভাবে নিজের জন্য এতগুলো মানুষকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই।ভাবতেছি কাল থেকে অফিস করবো।”
—“সেটা খুবই ভালো সিদ্ধান্ত।”
—“তোরা সবাই আমাকে খাওয়ানো নিয়ে ব্যস্ত।কিন্তু কেউ একবারের জন্যও জিগ্যেস করলি না হুট করে আমি খাওয়া বাদ দিলাম কেন?”
অহির চোখে মুখে ছটফটানি ভাব ছড়িয়ে পড়ে।সে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,
—“কেন?”
—“সাত দিন পর আজ ভোরে অনলাইনে ঢুকেছিলাম।উদ্দেশ্য বৃষ্টির আপডেট জানার জন্য।ভেবেছিলাম ও হয়তো আমাকে সমস্ত সোস্যাল মিডিয়ায় ব্লক করে দিয়েছে।কিন্তু না!কোনো জায়গা তেই ব্লক করেনি।উল্টো আমার ম্যাসেন্জারে ওর বিয়ের পিক পাঠিয়ে রেখেছে।”
—“কি!বৃষ্টি আপু ইতোমধ্যে বিয়ে করে নিয়েছে?”
—“হ্যাঁ রে।তাও আবার ওর সেই বেস্টফ্রেন্ডকে।শাকিল না কি যেন নাম!ওদের দুজনকে আমি মাঝে মধ্যে একসাথে দেখতাম।বৃষ্টিকে কিছু বলতেই ও বলতো,বন্ধু মানুষ।এভাবে ধোঁকা দিবে ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি।এই আমি কে,এই রোদ্দুর হিমকে ও ধোঁকা দিয়েছে?এটা ভাবা যায়?”
রোদ্দুরের চোখের কোণ ভিজে গেছে।সাদা আলো সেখানটায় প্রতিফলিত হয়ে বালির মতো চিকচিক করছে।অহি মানুষটার ব্যথা অনুভব করতে পারছে যেন!
রোদ্দুর নিজেকে সামলে বলে,
—“বুঝলি অজান্তা!সকালবেলা ভেতরটা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল।কেমন যেন পাগল পাগল আর শূন্য লাগছিল নিজেকে।সেজন্য ভাবলাম,নিজেকে শারীরিক ভাবে কষ্ট দিবো।তাতে যদি মনের কষ্ট একটু কমে!এবং অবাক করা বিষয় হলো তাতে সত্যি মনের কষ্ট কমতে শুরু করলো।দুপুরের দিকেই বৃষ্টির কষ্ট ছাপিয়ে ক্ষুধার কষ্ট মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল।রাত হতে হতেই অনেকখানি কমে গেছে।আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বৃষ্টিকে ভোলার জন্য, ওকে উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য, অন্য কাউকে বিয়ে করবো।কি বলিস?”
অহির হাত থেমে যায়।বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠে।রোদ্দুর ভাই তাহলে আবার অন্য কাউকে বিয়ে করবে?
অহি প্লেটের বাকি ভাতটুকু রোদ্দুরের মুখে পুড়ে দিয়ে বলল,
—“বিয়ে করবেন, ভালো কথা।এতদ্রুত মেয়ে কোথায় পাবেন?”
—“তোরা খোঁজ নিবি।রোদ আপু আছে,তুই,মা, খালামণি,খালু সবাই আছে।বাইরে গিয়ে রোদ আপুকে পাঠিয়ে দিস তো।কথা বলবো।”
অহি উঠে দাঁড়ালো।প্লেট গুছিয়ে হাতে নিয়ে সামনে পা বাড়াতেই রোদ্দুর ধমকে বলল,
—“পানি খাওয়াবে কে?টেবিল থেকে পানির গ্লাস দিয়ে যা।আমি ভেবেছিলাম তুই হয়তো একটু পরিবর্তন হয়েছিস।না তো!তুই তো সেই আগের মতই বেয়াদব আছিস।হুট করে কিছু না বলেই চলে যাচ্ছিস।”
অহি থামে।তার পা ভারী হয়ে গেছে।গলা দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না।নিজেকে কেমন অসাড় অসাড় লাগছে।সে এগিয়ে গিয়ে টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে রোদ্দুরের হাতে ধরিয়ে দিল।
রোদ্দুর এক চুমুকে পানিটুকু শেষ করে বলল,
—“নিচে প্লেট রেখে আরেক বার আমার রুমে আসিস তো।রান্নাঘর থেকে সরিষার তেল নিয়ে আসবি।আমার মাথায় সরিষার তেল ঘষে দিবি।আমি একটু ঘুমাব।অনেক দিন হলো ঘুমাতে পারি না।”
অহি দৃঢ় কন্ঠে বলল,
—“আমি পারবো না রোদ্দুর ভাই।অন্য কাউকে বলুন।”
অহির কাঠ কাঠ জবাব শুনে চমকে তার মুখপানে তাকায় রোদ্দুর।কয়েক সেকেন্ড পর বলে,
—“তুই হঠাৎ এমন কঠিন হয়ে গেলি কেন?আমি কি তোকে ভুল কিছু করতে বলেছি?মাথায় একটু জাস্ট তেল দিয়ে দিতে বলেছি।কবে জানি তোদের বাসায় গিয়ে দেখলাম, অপূর্বর মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছিস।সেজন্য বললাম।অপূর্ব আর আমার মধ্যে তফাৎ কোথায়?মেয়ে জাতি মানেই অদ্ভুতের কারখানা। যা যা!লাগবে না।তুই রোদ আপুকে পাঠিয়ে দে।আপু দিয়ে দিবে।”
অহি কিছু বললো না।দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকালো।সে বড় হয়ে গেছে।কিছুদিন পর তার বয়স বাইশে পড়বে।এই বয়সে হুটহাট কান্না করা একদম সাজে না।
সে অসাড় পা দুটোকে টেনে টেনে প্লেট হাতে বাইরে বের হয়ে গেল।একবারের জন্যও পিছন ফিরে তাকালো না।ভোর হলেই সে এ বাসা থেকে চলে যাবে।আর কোনোদিন পা রাখবে না।
——————
অহি নিজের বাসায় তার বিছানায় শুয়ে ফোন নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।এই ভোরবেলাতেই ‘রোদ্দুর হিম’ নামক মানুষটার ফেসবুক আইডি পনেরো বারের মতো দেখা হয়ে গেছে।
এক মাসের বেশি হলো সে ও বাসা থেকে চলে এসেছে।আর যায় নি।ইতোমধ্যে নতুন করে রোদ্দুরের বিয়ের তোড়জোড় চলছে।ডজন ডজন মেয়ে দেখা হচ্ছে।সেসব মেয়ে খালামনির নাকি পছন্দ হচ্ছে না।রোদ্দুর এবার নাকি পরিবারের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করবে।
কিন্তু কেউ একটি বারের জন্যও অহির নামটি উচ্চারণ করছে না।রোদেলা আপু,অপূর্ব এ দুটো মানুষ তো অন্তত জানে সে রোদ্দুরকে ভালোবাসে।কিন্তু তারাও কেমন নির্বাক রয়েছে।
বিগত এক মাসে রোদ্দুর বেশ কয়েকবার মেয়ে দেখার জন্য অহিকে ফোন করেছে।কিন্তু সে ইচ্ছে করে ফোন রিসিভ করেনি।কেন করবে?মানুষটা তাকে কেন বোঝে না?সে যে সামনাসামনি রোদ্দুর ভাইকে প্রোপোজ করবে সে সাহসও নেই।ভয় লাগে।যদি বৃষ্টি আপুর সতো প্রথমেই রিজেক্ট করে দেয়?তাহলে সে মুখ দেখাবে কি করে?
অহি এক লাফে বিছানা থেকে উঠে সারা রুমে পায়চারি করলো।কয়েক বার বেলকনিতে গিয়েও ঘুর ঘুর করলো।কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না।ভেতরটা কেমন অশান্ত!আজ তার মা কাজের লোকসহ সবাইকে নিয়ে আবার খালামণির বাসায় গেছে।সদরঘাটের ওদিকে নাকি মেয়ে দেখতে যাবে।
অহি কয়েক সেকেন্ড এক জায়গা দাঁড়িয়ে গভীর কিছু চিন্তা করলো।টেবিলের উপর রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে শেষ করলো।তারপর বিছানা থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে বেলকনিতে বসলো।
রোদ্দুর হিম নামক আইডির ম্যাসেন্জারে ঢুকে বাংলায় টাইপ করলো,
“রোদ্দুর ভাই, এবার যদি আমাকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করিস তাহলে তোকে একদম খুন করে ফেলবো।তারপর নিজের গলায় দড়ি দিবো।আমার গল্পের প্রথম পাতায়, মাঝামাঝিতে বা শেষ অধ্যায়ে তুই না থাকলেও পরিশিষ্টে তোকে চাই।শুধু তোকে চাই।রোদ্দুর হিমকে চাই।”
এটুকু লিখে সেন্ড করে দিল।অহির হাত পা কাঁপছে।এভাবে লেখা কি খুব প্রয়োজন ছিল?রোদ্দুর ভাই কি না কি ভাববে কে জানে?
অহি নেশাখোর দের মতো টলতে টলতে রুমে ঢুকলো।বিছানায় গা এলিয়ে দিল।তার মাথা ঘুরছে।সাথে পুরো পৃথিবী!
চোখ বন্ধ করে ফোনটা হাতে নিল।দ্রুত ম্যাসেন্জারে ঢুকে ম্যাসেজটা রিমুভ করতে চাইলো।কিন্তু হলো না।সে ফোনটা এক ঢিল দিয়ে বিছানার অপরপাশে ফেললো।তারপর নিজেকে জঘন্য ভাষায় গালি দিল।
মিনিট দশেক পরেই তাদের বাসার কলিং বেল বাজা শুরু হলো।অহি চমকে চোখ খুলে বড়ো বড়ো করে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।এই সময় আবার কে এলো?
রোদ্দুর ভাই না তো?আল্লাহ গো!
অহি এক লাফে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে ভেতরে ঢুকে বসে রইলো।সদর দরজার ওপাশে কেউ অনবরত কড়া নেড়ে যাচ্ছে।ভেঙে ফেলবে প্রায়!কিন্তু কেউ খুলছে না কেন?
পরমুহূর্তে অহির মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল।বাসায় তো সে বাদে দ্বিতীয় কেউ নেই!
(চলবে)
রিচেক করা হয়নি।ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।🥰🙂
(চলবে)
গল্পটা কেমন লাগছে আপনাদের কাছে?কত পর্বের হলে খুশি হন?সবার কাছে থেকে গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।💕
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।🙂