##পরীজান
#পর্ব ৪
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
“তারপর পুত্র সন্তান জন্ম দেন তিনি। শুক্রবার মানে জুমার দিন জন্মেছে তাই ছেলের নাম রাখা হলো জুম্মান। জুম্মান ওর মায়ের মতো কালো হয়নি। আব্বার গায়ের রং পেয়েছে। শ্যামবর্ণ,আমি প্রথমে জুম্মানকে কোলে নিতাম না। রুপাই রাখত বেশি তখন আমি পরীর দেখাশোনা করতাম। পরীর বয়স পাঁচ বছর হয়েছে। কিন্তু প্রতিটি পদে পদে আমি পরীকে দেখে অবাক হতাম। ছোট্ট পরী এতটা শক্ত তা কখনোই ভাবিনি আমি। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন নাকি পোকামাকড় পশু পাখি অনেক ভয় পেতাম আম্মা সবসময় বলত। রুপার ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু পরী সম্পূর্ণ আলাদা। ওকে কখনো ভয় পেতে দেখিনি। আমাদের রগচটা গরুটার দিকেও সাহস নিয়ে এগিয়ে যেতো ও। গরুটাও ছুটে আসতো পরীকে গুঁতো মারার জন্য কিন্তু পরী তৎক্ষণাৎ সরে যেতো। দড়িতে টান খেয়ে গরুটা আর এগোতে পারতো না। তখন ভয় পাওয়ার বদলে পরী খিলখিলিয়ে হাসতো। তা দেখে সেদিন আমার বুক কেঁপে উঠেছিল। আমারও তখনও সাহস হয়নি ওই গরুর সম্মুখে দাঁড়ানোর। তারপর একদিন পরীকে সাপে কাটলো। তখন ওর বয়স সাত বছর। ওঝা যখন পরীর পা থেকে বিষ নামাচ্ছিল চোখমুখ শক্ত করে বসেছিল পরী। এতটুকু শব্দ ওর মুখ দিয়ে বের হচ্ছিল না। চোখদুটো লাল হয়ে গেছে। পানি পড়ছে চোখ থেকে কিন্তু মুখে শব্দ নেই। অথচ দেলোয়ার কাকার মেয়েকে যখন সাপে কাটলো বিষ নামানোর সময় কি চিৎকার তার। তখন তার বয়স ছিল ষোল বছর। কিন্তু ওইটুকু বয়সে পরী কিভাবে চুপ করে রইলো?
কি ভাবছিস পরী তোকে এসব কথা বলার জন্য খাতাটা দিয়ে গিয়েছি?নাহ পরী, তোকে অনেক কিছু বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু এতো কথা বলার সময় আমার কাছে নেই তাই টানা একসপ্তাহ ধরে আমার মনের সব কথা এই খাতায় বন্দি করেছি। তুই বড্ড কঠিন মানুষ পরী। তোর মনে আমরা দুই বোন ও আম্মার জন্যই ভালোবাসা আছে। এছাড়া বাকি সবাইকে তুই ঘৃণা করিস আমি তা বেশ বুঝতে পারতাম। সাত বছর বয়সে আব্বার জন্য যে ঘৃণা দেখেছি সে ঘৃণা আমিও আব্বাকে করতে পারি নাই। জানি না জুম্মানকে তুই আদৌ ভালোবাসিস কি না? তবে ছোট্ট ছেলেটাকে একটু ভালোবাসা দিস।
ভালোবাসা ছাড়া কেউ কখনো বাঁচে না পরী। যেদিন তুই ভালোবাসতে শিখবি সেদিন ই বুঝবি। তবে আজকে তোকে এক বিশেষ মানুষের কথা বলব। যার কথা শুনে তোর ইচ্ছা করবে ইশ তোর জীবনে যদি এরকম কেউ আসতো তাহলে মন্দ হতো না। অবশ্য তাকে এতদিন তুই চিনে ফেলেছিস, কিন্তু দেখেছিস কি না জানি না!সে হলো রাখাল। নামটা রাখাল হলেও সে রাখাল ছিলো না। সে শুধুই আমার রাখাল, একান্তই আমার। স্কুলে পড়াকালীন বইতে কবিতা পড়তাম ‘রাখাল বাজায় বাঁশি কেটে যায় বেলা’ কিন্তু আমার রাখাল বাশি বাজাতে পারতো না,গরু ছাগল ও চড়াতো না। কিন্তু তবুও সে রাখাল, আমাদের গ্রামের রাখাল রাজা,,,,,,,”
তবে পরের টুকু আর পড়া হলো না পরীর। তার আগেই কোন একটা শব্দে সেদিকে তাকালো সে। এখন রাত অনেক, শুধু বৃষ্টির শব্দ আর ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছে। তবে পরী বেশ বুঝতে পারছে যে অন্দরমহলে কোন নতুন পুরুষের আগমন ঘটেছে। এবিষয়ে বরাবরই পরী সচেতন। ভেতরে কোন নতুন মানব আসামাত্রই পরী তা টের পেয়ে যায়। খাতাটা বন্ধ করে হারিকেনের আঁচ কমিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। পালঙ্কের পেছন থেকে মোটা লম্বা লাঠিটা বের করলো। এই লাঠি দিয়েই ছোটবেলায় সে চর্চা করতো। এখনও করে,বলতে গেলে লাঠি চালনায় খুব পারদর্শী পরী। সময় পেলেই লাঠালাঠি শুরু করে দেয় সে। অন্ধকার থাকায় মুখটা ঢাকতে হলো না পরীর। কারণ সে জানে এই মুহূর্তে ঘরে চোর ঢুকেছে এবং চোর অন্ধকারেই চুরি করে। পরী তাই লাঠি হাতে বেরিয়ে পড়লো। প্রথমেই গেল রান্নাঘরে,সেখানে গিয়ে সে চুপিচুপি কুসুমকে ডেকে তুলল। তারপর একটা গামছা নিয়ে বেরিয়ে গেল।
অন্ধকারে লাঠি চালিয়ে রক্তাক্ত করে দিলো চোরকে। পুরো মুখে গামছা জড়িয়ে দিয়ে উঠোনের কোনের পেয়ারা গাছের সাথে বেঁধে দিলো।
ঘটনাটা কেমন যেনো তাড়াতাড়ি ঘটে গেল। বৃষ্টিতে ভিজে গেলেও যেন শীত লাগছে না পরীর। শরীর আরো গরম হয়ে আসছে। সেটা কি রাগে!! বেশি ঘাঁটাঘাঁটি না করে পোশাক বদলে ঘুমিয়ে পড়লো সে।
সকাল হতেই সারা গায়ে ঢোল পড়ে গেল। কাল রাতে জমিদার বাড়িতে চোর এসেছিল। এবং পরীই চোরকে ধরে ফেলে। আর আজকেই চোরের বিচার হবে। এই গুঞ্জনে কেউই ঘরে থাকতে পারলো না। নৌকা আর ভেলায় চড়ে সোজা জমিদার বাড়িতে হাজির হলো। সবার আগ্রহ চোরের বিচার দেখা। সবাই ভাবছে চোরের এতো সাহস হলো কিভাবে যে জমিদারের বাড়িতে হানা দেয়।
সারারাত ঘুমাতে না পেরে মাথা ব্যথা হয়েছে পালকের। মিষ্টি আর রুমির ও একই অবস্থা। বাইরে লোকজনের আওয়াজ পেতেই ওরা বুঝলো যে বিচার আরম্ভ হতে চলেছে তাই ওরা ঘর ছেড়ে বের হলো। একটু এগোতেই মুখোমুখি হলো আবেরজানের। তিনি বললেন,’কই যাও তোমরা বিচার দেখতে?’
রুমি মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলতেই তিনি বাজখাঁই গলায় বললেন,’বেডাগো সামনে যাও তো মাথায় কাপড় কই? মাথায় কাপড় দেও তাড়াতাড়ি।’
কোনরকমে তিনজন মাথায় কাপড় টেনে অন্দরমহল থেকে বের হয়ে গেল। বাইরে এসে দেখলো অনেক মানুষ সেখানে। একপাশে মহিলারা আরেকপাশে পুরুষ। পালক ভিড়ের মধ্যে নাঈমকে খুঁজতে লাগল। কিন্তু অতো মানুষদের মধ্যে খোঁজা কি সম্ভব?এর মধ্যেই আফতাব উদ্দিন এসে চেয়ারে বসলেন সাথে আঁখির ও। এছাড়া গ্রামের কয়েকজন মুরুব্বি ও আছেন। চোরকে টেনে আনলো দুজন লোক। গামছা টা সরিয়ে মুখ দেখাতেই সবাই অবাক হয়ে গেছে। এ তো উওর পাড়ার কানাই। ওর এতো বড় সাহস হলো কিভাবে?
আফতাব উদ্দিন গোমড়া মুখে কানাইকে জিজ্ঞেস করল,’তুই আমার বাড়িতে চুরি করতে এলি কোন সাহসে। তাও আবার অন্দরমহলে ঢুকেছিস।’
কানাই কোন জবাব দিলো না। রাতভর বৃষ্টিতে ভেজায় এখন জ্বরে কাঁপছে। মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। এরই মধ্যে আঁখির বলে উঠলো,’যাই হোক চুরি করেছে যখন শাস্তি পেতেই হবে। গ্রামের সবাই আমার ভাইকে সম্মান করে শ্রদ্ধা করে আর কানাই যা করেছে তা অন্যায়। এতে আমাদের জমিদারি কে অপমান করেছে সে। তাই ওর কঠিন থেকে কঠিনতর সাজা হওয়া উচিত। বাকিটা গ্রামের মুরুব্বিরাই ভালো বুঝবেন।’
বলেই সবার দিকে দৃষ্টি মেলল আঁখির। পালক মিষ্টি আর রুমি যেন প্রাণ ফিরে পেলো। নাঈমরা তাহলে নিরাপদ। কিন্তু ওরা এখন কোথায়?পালক দৌড়ে ভেতরে চলে এলো। ওর পিছু পিছু মিষ্টি রুমিও এলো। বৈঠকঘর পেরিয়ে ঢুকলো নাঈমের ঘরে। ওরা রেডি হচ্ছিল। পালক গিয়েই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,’তোরা এখানে বাইরে কি হচ্ছে জানিস কিছু?’
নাঈম জুতার ফিতা বাধছিলো। পালকের কথায় এক পলক সেদিকে তাকিয়ে আবার ফিতা বাঁধতে বাঁধতে বলল,’শুনলাম চোর ধরা পড়েছে তাই আর বের হইনি। ভেবেছি একসাথে রেডি হয়ে বের হবো।’
রুমি পালককে ঠেলে ওর জায়গায় দাঁড়িয়ে বলল,’চোরটা কে ধরেছে জানিস পরী!’
পরীর নামটা শুনেই চমকে তাকালো নাঈম। শেখর শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে এগিয়ে এসে বলল,’পরী ধরেছে!!সর সর সর গিয়ে দেখি কেমন চোর ধরেছে আমাদের পরী!’
মিষ্টি শেখরের কলার চেপে ধরে ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে,’ছাগল কোথাকার আমরা কত ভয় পেয়েছি জানিস? ভেবেছিলাম তোরাই বুঝি ধরা খেলি।’
শেখর কলার ছাড়িয়ে শার্ট ঠিক করতে করতে বলল,’রাতে যে বৃষ্টি হয়েছে বের হতাম কিভাবে?ঘুম পেয়ে গেলো তো তাড়াতাড়ি।’
নাঈম উঠে সোজা বাইরে চলে গেছে। বাকি সবাই বিচারে গিয়ে উপস্থিত হলো।
পরী এখনো ঘুমে আচ্ছন্ন। রাতে ভেজার দরুন ওর গায়েও জ্বর নেমেছে। তাই তো ভোরের স্নিগ্ধ রশ্নি আখিপল্লবে পড়তেই কাথাটা দিয়ে মুখটা ঢেকে নেয়। এবং আবার ঘুমিয়ে পরে। কিন্তু এই ঘুমটা আর ধরে রাখতে পারলো না পরী। কুসুম আর জুম্মান হন্তদন্ত হয়ে ছুটে পরীর ঘরে ঢুকলো। ডেকে তুলল পরীকে, প্রথমে বিরক্ত হলেও পরে জুম্মানের কথায় অবাক চাহনিতে তাকালো পরী। জুম্মান বলেছে,’পরী আপা আব্বা কইছে কানাই কাকার হাত কাইটা ফালাইতে। চুরির সাজা নাকি এইডাই ভালো।’
পরী ঘুম পুরোপুরি ছুটে গেছে। একটানে গায়ের কাথাটা সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আলমারি খুলে নিজের বোরখাটা গায়ে জড়িয়ে নিল। নেকাবটা আটকে দিলো। চোখ দুটো ও খোলা রাখলো না। পাতলা কাপড়ে ঢেকে দিলো রক্তিম চোখদুটো। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। অন্দরমহল থেকে বের হয়ে যেই না বৈঠক ঘর পেরুতে যাবে তখনই বাঁধ সাধে মালা। মেয়ের হাত টেনে ধরে বলে,’কই যাস?’
কম্পিত কন্ঠে পরী বলে উঠলো,’আম্মা কানাই কাকার হাত কাটবো আব্বায়?’
মালা মাথাটা হালকা নিচু করে জবাব দিলো, ‘হ!’
পরী জোর গলায় বলে,’আব্বা অন্যায় করতাছে আম্মা। আমারে যাইতে হইবো। আমার হাত ছাড়েন।’
পরীর কথায় হাতটা আরো শক্ত করে ধরলেন মালা,’তুই যাবি না পরী। মনে আছে আমারে কি কথা দিছোস তুই?’
‘মনে আছে আম্মা। আপনেরে কথা দিছি আমার এই মুখ কোন পুরুষরে দেখামু না। তার লাইগাই বোরখা পরছি। অহন হাত ছাড়েন আম্মা।’
কিন্তু মালা ছাড়লো না। সে মেয়েকে এতো লোকের সামনে যেতে দেবে না কিছুতেই। জোড়াজুড়ির এক পর্যায়ে জেসমিন এসে মালার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,’পরীরে যাইতে দেন আপা। কিচ্ছু হইবো না। একটা মানুষের প্রাণ বাঁচবে।’
অতঃপর জেসমিন মাথা দুলিয়ে পরীকে যেতে বলল। এই প্রথম পরী কৃতজ্ঞতার সহিত তাকালো জেসমিনের দিকে তারপর ছুটে গেল বিচার সভায়। এদিক ওদিক না তাকিয়ে পরী এক দৌড়ে গিয়ে আফতাবের পাশে দাঁড়ালো। মেয়েকে এমন সময় কল্পনাও করেনি আফতাব। আড়চোখে সামনে বসা মুরব্বিদের দিকে তাকিয়ে নিজের মেয়েকে বললেন,’তুমি এখানে?ঘরে যাও।’
পরী অত্যন্ত নমনীয় কন্ঠ বলে,’এখানে অন্যায় হইতাছে আব্বা। আর যেইহানে অন্যায় হয় সেইহানে আমি থাকি তা আপনে জানেন।’
আফতাব উওর দিলেন না তবে আঁখির বলল, ‘কি অন্যায় পরী?তুই জানস না যে কানাই চুরি করছে?এই বিচার ই ঠিক হবে তুই ঘরে যা।’
ঘৃণা দৃষ্টিতে আঁখিরের দিকে তাকালো পরী কিন্তু চোখদুটো নেকাবের আড়ালে থাকায় তা আঁখির দেখতে পেলো না।
‘আব্বা কানাই কাকা চোর হইছে তো আপনাগো কারণেই। একবার ভাইবা দেখেন। বন্যায় সব ভাইসা গেছে কাকার। অহন পোলাপাইন লইয়া কেমনে থাকব কাকায়?আপনারা যদি সাহায্য করতেন তাইলে তো কাকায় চুরি করতে আইতো না।’
পরীর কথায় চুপ করে রইলো আফতাব সহ সব মুরুব্বিরা। কথাটা পরী ঠিকই বলছে। এই বন্যায় তো কারোরই কাজ নেই। ভরসা করার মতো তো ওদের একজনই আছে সেটা হলো আফতাব। আফতাবের উচিত ছিল গ্রামের সবার খেয়াল রাখার। পরী আবার বলতে লাগলো,’পেটের খুদা কখনো ধর্ম মানে না। খুদা এমন একটা জিনিস যা সব ধর্মেই হার মানে। খুদার জ্বালা বড় জ্বালা তা একটু বুঝেন! কানাই কাকার হাত না কাইটা তারে একটা কাম দেন। ওই হাত দিয়া খাইটা খাইবো উনি। ওনার হাত কাটলে বউ পোলাপান গো কি খাওয়াবো?হেয় তো মরবোই তার সাথে বউ পোলাপান ও মরব। কাকা চুরি কইরা অপরাধ করছে। তার সাজা সে রাতভর পাইছে। অহন তার হাত কাইটা আপনারা অন্যায় কইরেন না। এমন ও তো হইতে পারে কাকার হাত দুইটাই আপনাগো একদিন কাজে লাগবো।’
কথাগুলো শেষ করেই পরী পা বাড়ায় অন্দরমহলে। তবে এতটুকু সময়ে বলা কথাগুলো শুনে সভার সবাই চুপ করে গেল। আফতাব ও কিছু বলল না। বিচারের বাকি কাজ তিনি মুরুব্বিদের হাতেই ছেড়ে দিলেন। কেউ কোন কথা বলতেছে না দেখে গ্রামের সবচেয়ে বেশি বয়স্ক যিনি সে বলে উঠলো, ‘পরী তো হক কথাই কইছে। কানাইয়ের বউ পোলাপাইন গো কথাও তো ভাবতে হইবো।’
তারপর তিনি আফতাবের দিকে তাকিয়ে বললেন,’তুমি কি কও আফতাব?কানাইরে কি করবা?’
আফতাব মাথা নিচু করে বলল,’আপনেরা যা ভালো বুঝেন তাইই করেন। কথা তো সব পরী বলেই দিছে।’
তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। কানাইকে কাজ দেওয়া হলো সম্পানের সাথে। যাতে কটা টাকা রোজগার করে চলতে পারে। পেটের দায়ে সে এসেছিল জমিদার বাড়িতে চুরি করতে। কারণ এই গাঁয়ে ধনী বলতে আফতাব। আরো কয়েকজন আছে তবে এই মুহূর্তে তাদের ঘরবাড়ি ও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে আছে। তাই সে জমিদার বাড়িতেই এসেছে চুরি করতে। কিন্তু কপাল খারাপ যে পরীর হাতেই ধরা পড়লো। যখন ওর হাত কাটার নির্দেশ দেওয়া হয় তখন সে হাউমাউ করে কেঁদেছিলো। বারবার ক্ষমা চেয়েছিল,তার হাত যেন না কাটা হয়। কিন্তু কেউ শোনেনি। এখন কানাই পরীর প্রতি কৃতজ্ঞ হলো। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো কোন এক সময় পরীকে কৃতজ্ঞতা জানাবে।
নাঈমের চোখদুটো খুশিতে চকচক করছে পরীকে দেখে। এতক্ষণ ধরে মেয়েটার মধুর বানি শুনছিল সে। গলার স্বর টা সত্যি খুব সুন্দর। এখনও কানে বাজতেছে। কথা শুনে এখন পরীকে দেখার ইচ্ছা আরো প্রবল হচ্ছে। তবে পরীর কথাগুলো বেশি মুগ্ধ করেছে ওদের। শেখর নাঈমের কাঁধে হাত রেখে বলল,’এই মেয়েকে দেখা অতো সহজ হবে না নাঈম। আশা দেখছি এখানেই ছাড়তে হবে। নাহলে আশার জালে আমরাই পেচাবো।’
ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে নাঈম বলল,’উহু এখন মেয়েটাকে দেখার ইচ্ছা আরো গভীর হলো।’
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে না গিয়ে আজকে ওরা জমিদারের বাগান বাড়িতে গেলো। সেখানেও অনেক মানুষের উপস্থিতি। তবে বেশ কয়েকজন একটু বেশি অসুস্থ তাই তাদের স্থানীয় একটা হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে বলল ওরা। এরইমধ্যে আরেকটা নৌকা এসে পাড়ে ভিড়লো। সেখান থেকে কয়েকজন লোক বেরিয়ে আসলো। তারা চারিদিকে চোখ বুলিয়ে এগিয়ে গেলো নাঈমের কাছে। সবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখে নাঈম কিঞ্চিৎ হেসেই এগিয়ে গেলো। লোকটা সবিনয়ে হাত মিলানোর জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো। বিপরীত দিক থেকে নাঈম ও হাত বাড়িয়ে দিলো এবং
বলল,’সেদিন আপনার নামটা জানা হয়নি আর নিজেরটাও বলা হয়নি। ব্যস্ততা দুজনেরই ছিল। যাই হোক,আমি নাঈম আহমেদ।’
বিপরীতমুখে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটাও হেসে জবাব দিল,’শায়ের।’
নামটা শুনে নাঈমের চোখ দুটো হালকা ছোট হয়ে এলো বলল,’শুধুই শায়ের?’
লোকটা আবারও হাসলো। অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো,’সেহরান শায়ের। আশাকরি এবার বুঝতে পেরেছেন।’
চলবে,,,,,,,,,,
সবার রেসপন্স আশা করছি।পরীজান
#পর্ব ৫
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
মেঘাবৃত সূর্যটা যেন কিছুতেই বের হওয়ার চেষ্টা করে না। সারাক্ষণ ওই মিশকালো মেঘের আড়ালে থাকে সে। একটু দেখা দিলে কি এমন ক্ষতি হয় তার?উল্টে দেখা না দিয়েই কত মানুষের ক্ষতি করে দিলো। এইসব ভাবনা আপন মনে ভেবে চলছে পরী। জানালার ধারে জলচৌকি পেতে বাইরের দৃশ্য আপন মনে দেখছে পরী। হাতের উপর হাত রেখে তার উপর মাথা দিয়ে স্থিরচিত্তে দেখে যাচ্ছে আজকের মেঘমালা। এই গোমড়া মেঘের উপর একরাশ ঘৃণা এসে জন্মায় পরীর। তখনই মনে পড়লো সোনালীর বলা কথাগুলো। সত্যিই কি পরী সবাইকে শুধু ঘৃণা করে? ভালোবাসে না কাউকে? তাহলে আজকে কেন কানাইকে বাঁচালো সে?সেটা কি ভালোবাসা নয়?তাহলে কি সেটা?মায়া!!হ্যা মায়াই হবে হয়তো। সোনালী এতো কঠোর বলে গেল কেন পরীকে? সোনালী যখন চলে যায় তখন পরীর বয়স তো মাত্র সাত ছিল। অতটুকু বয়সে পরীর মধ্যে কি এমন দেখেছিল সোনালী?সব প্রশ্নের উত্তর ওই খাতাটায় পাবে সে। কিন্তু এখন আর পড়তে ইচ্ছে করছে না পরীর। কানাইয়ের জন্য খুব খারাপ লাগছে। যদিও কানাইকে সাজা দেওয়া হয়নি তবুও ভালো লাগছে না পরীর।
বারবার সোনালীর কথাই মাথায় আসছে।
আফতাবের বড় মেয়ে সোনালী। যেদিন সোনালীর জন্ম হয় সেদিন পুরো জমিদার বাড়ি খুশিতে মেতে উঠেছিল। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছে সোনাকন্যা। দেখতে যেমন সুন্দরী তেমনি গাঁয়ের গড়ন। তাই এই সোনাকন্যার নাম রাখা হয় সোনালী। প্রথম মেয়ে বলে সবাই আহ্লাদী করে রাখতো সোনালীকে। বাড়ির বড় মেয়ে বলে কোন শখ অপূর্ণ রাখেনি সোনালীর। সবসময় সবার কোলে কোলেই থাকতো। বড় হওয়ার পর সবার প্রিয় পাত্রী হয়ে ওঠে সোনালী। পদ্মআঁখি, প্রিয়ংবদা, প্রাণচঞ্চল যেন এই মেয়েটিকেই বলা যায়। সবসময় হাসিখুশি আর সবার সাথে সুন্দর ব্যবহার করতো সে। গ্রামেরই একটা স্কুলে পড়তো। সব শিক্ষকদের পছন্দের তালিকায় সোনালী সবসময়ের জন্য জায়গা করে নেয়। কিন্তু এই চঞ্চল মেয়েটার মুখে গাম্ভীর্য এনে দেয় সময়। সে যেন সোনালীর এই খুশিকে মানতে পারেনি। হিংসার তাড়নায় সে মেয়েটির মুখ থেকে হাসি কেড়ে নিলো। সোনালীর পাঁচবছর বয়সে মালা জন্ম দেন রুপালীর। তখন থেকেই জমিদার বাড়িতে কেমন গুমোট ভাব নেমে আসে। সবাই ভেবেছিল ছেলে হবে কিন্তু মালা মেয়ের জন্ম দিয়েছেন। আবেরজান এতে ক্ষুব্ধ হলেন সাথে আফতাবও। একটা পুত্র সন্তানের জন্য শেষ করে দিলেন মালার প্রতি তার ভালোবাসা। মায়ের প্রতি অবহেলা দেখে সোনালীর কোমল হৃদয় কেঁদে উঠলো। বাবাকে আস্তে আস্তে ঘৃণা করতে শুরু করলো। তবে সেই ঘৃণা কখনোই আফতাবের সামনে প্রকাশ করতো না সে। নিরবে নিভৃতে চোখের পানি ফেলতো। ভাবতো নিজে অভিশাপ দিতে পারেনি তো কি হয়েছে ওর চোখের পানি তো অভিশাপ হয়ে দাড়াতেই পারে। পরীর জন্ম যেন সবার কাল হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে একটা ছেলেই জন্ম দিতে পারেনি মালা যেখানে রূপবতী মেয়ের জন্ম দিয়ে কি হবে?রূপ যেন অভিশাপ এনে দিয়েছে মালা ও তার মেয়েদের জীবনে।
মেঘের গর্জনে পরীর ধ্যান ভেঙ্গে দেয়। ঝড়ো হাওয়া বইছে বাইরে। বাতাসে মেঝেতে লুটানো ঘাগড়াটা দুলছে। সামনের কোড়ানো চুলগুলো ও বাতাসের সাথে মেতে উঠেছে যেন। শীত লাগছে পরীর। জ্বরটা এখনও কমেনি। তবে এই জ্বর কখনোই কাবু করতে পারেনি পরীকে। আজকেও তার ব্যতীক্রম হলো না। তবে জলচৌকি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সে ঘরের সব জানালাগুলো বন্ধ করতে লাগলো। হঠাৎই তার একটা কথা মনে পড়ল। মালা বলেছিলেন সোনালী নাকি শহরে চলে গেছে। সেখানেই রাখালের সঙ্গে থাকে সে। আর ওই মেয়ে ডাক্তার গুলোও তো শহর থেকেই এসেছে। যদি ওরা সোনালীর কোন খোঁজ দিতে পারে?
এসব ভেবে দ্রুত জানালা বন্ধ করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল পরী। এক প্রকার ছুটেই চলে এলো মেহমানদের ঘরের দরজায়। কিন্তু ভেতরে যেতে ওর শরীর কাঁপছে। জ্বরে নয়, একটু অস্বস্তি লাগছে ওর। যদি ওরা সোনালীর খবর দিতে না পারে!পরী আস্তে করে দরজায় হাত রাখতেই ঝণাৎ করে দরজা খুলে গেল।
দরজা খোলার শব্দে পালক পেছনে ঘুরে তাকিয়ে পরীকে দেখে অনেক অবাক হলো। রুমি আর মিষ্টি ঘুমাচ্ছে। পালক ও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছিল। বাগান বাড়ি থেকে ওরা তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। কারণ আকাশের অবস্থা ভালো না,ঝড় হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই ওরা তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। দুপুরের খাবার খেয়ে একটু আগেই ঘরে এসেছে। রুমি মিষ্টি ক্লান্ত থাকায় ঘুমিয়ে পড়েছে।
পরী এগিয়ে এসে পালকের সামনে দাঁড়ালো। ইতিমধ্যে ঘাম ছুটে গেছে পরীর। এমতাবস্থায় পরীকে দেখে পালক জিজ্ঞেস করে,’কোন সমস্যা পরী? মানে তুমি কিছু বলতে চাও?’
প্রশ্নটা ঝংকার তুলে দিলো পরীর সারা শরীরে। কথা বলতে ওর ঠোঁট কাঁপছে। আচ্ছা সোনালীর সম্পর্কে কি কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে? কিন্তু সোনালীর জন্য বুকটা খুব জ্বালা করে পরীর। তাই সে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল,’আপনেরা তো শহর থাইকা আইছেন?’
পালক পরীর অবস্থা দেখে এগিয়ে এলো। সামনের জলচৌকিতে বসে ইশারায় পরীকে বসতে বলে। দুহাতে নিজের ঘাগড়া খামচে ধরে এগিয়ে গিয়ে বসে পরী। পালক মুচকি হেসে বলল,’হ্যা আমরা শহর থেকেই এসেছি।’
পালকের সুন্দর আচরণে পরী যেন সাহস পেল। সে চট করেই বলে উঠলো,’আপনেরা কি আমার সোনা আপার খবর আইনা দিতে পারবেন?’
কথাটা পালক বুঝলো না তাই পরীর প্রশ্নের বিপরীতে সে প্রশ্ন করে,’সোনা আপা কে? চিনলাম না সব গুছিয়ে বলো তাহলে বুঝতে পারবো।’
‘আমার বড় আপা,সোনা আপা। শহরে থাকে, আর আপনেরাও তো শহর থাইকাই আইছেন। আমার সোনা আপার একটু খবর আইনা দিবেন খুব ভালো হয় তাইলে। কতদিন আপারে দেখি না।’
পরীর মায়াবতী মুখখানি দেখে পালকের কষ্ট হলো। এই মুখটা দেখলে বোধহয় পুরুষ কেন কোন নারীও পরীকে ফেরাতে পারবে না। টসটসে জলে ভরা চোখদুটো সবাইকে ঘায়েল করার প্রধান অস্ত্র।
‘তোমার আপা শহরে থাকে বুঝলাম। কিন্তু বাড়িতে আসে না? তোমার বাবাকে বললেই তো পারো। তোমাকে শহরে নিয়ে যাবে তখন তুমি তোমার আপাকে দেখতে পারবে।’
পালকের কথায় পরী ঘনঘন মাথা নেড়ে বলে, ‘নাহ আব্বা আমারে কোনদিনই শহরে নিয়া যাইবো না। আপার কথা কইলে তো নিবোই না।’
‘কেন?কি এমন করেছে তোমার আপা?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল পরী। নিচের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,’আপা আমাগো গেরামের একটা পোলারে ভালোবাসতো অনেক। কিন্তু আমার আব্বা মাইনা নেয় নাই তার লাইগা আমার আপা হ্যারে নিয়া শহরে চইলা গেছে। আর আহে নাই। আব্বায় কইয়া দিছে এই বাড়িতে যেন আমার সোনা আপার নাম কেউ না নেয়। আম্মা অনেক কান্দে আপার লাইগা। তাই আমি একবার আপার লগে দেহা করতে চাই।’
পরীর কথার মাঝে একরাশ কষ্ট দেখতে পেলো পালক। মেয়েটাকে প্রথম দেখে বদমেজাজি ভাবলেও এখন সে বেশ বুঝতে পারছে যে পরীর কঠোরতার পেছনে রয়েছে এক সাগর কোমলতা। ঠিক নারকেলের মতো। উপরের শক্ত খোসা যে ভাঙতে পারবে একমাত্র সেই পারবে কোমলতা স্পর্শ করতে। পালক এবার বুঝতে পারছে যে এই বাড়ির বড় মেয়ের সাথে কারো কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু মেজ মেয়ে??সে কোথায় এখন? উওর জানতে তাই সে জিজ্ঞেস করে, ‘আর তোমার মেজ বোন এখন কোথায়?’
পরী মাথা নিচু রেখেই জবাব দিলো,’রুপা আপার বিয়া হইয়া গেছে।’
‘বুঝলাম কিন্তু পরী শহরটা তো তোমাদের গ্রামের মতো ছোট না যে খুঁজলেই তোমার আপাকে পেয়ে যাবো। তাছাড়া তোমার আপাকে তো আমি কখনো দেখিনি। আর আমি মেয়ে হয়ে কিভাবে তোমার আপাকে খুঁজবো? এভাবে খোঁজা তো সম্ভব নয় তবে চেষ্টা করে দেখবো।’
মনটা খারাপ হয়ে গেল পরীর। এটার ভয়ই পাচ্ছিল সে। হয়তো ওরা কেউই সোনালীর খবর দিতে পারবে না। গোমড়া মুখেই পরী বলল,’তাইলে কি কোনদিন আপার খোঁজ পামু না?’
কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ালো পরী। ছোট ছোট পা ফেলে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। স্থির নয়নে তা দেখলো পালক। আজকে পরীর আচরণে বেশ অবাক হয়েছে পরী। দু’দিন আগেই তো ওদের থাকা নিয়ে কত কথা শুনালো আর আজকে এভাবে মিশে গেল। তবে পরীর সাথে সাক্ষাৎ হয়ে বেশ ভালই লাগল পালকের। মেয়েটা সুন্দর তবে কথাগুলো যেন আরো বেশি সুন্দর।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে যেন ঝড়টা আরো বাড়লো। আফতাব আজকে বোধহয় বাড়িতে ফিরতে পারবে না। এই ঝড়ের মধ্যে কোন মাঝিই নৌকা চালাবে না। পুরো জমিদার বাড়িতে অচেনা তিন পুরুষ ছাড়া আর কোন পুরুষ নেই। নাঈম বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে আপন মনে। ঝড়ো হাওয়া গায়ে লাগছে শীতও করছে কিন্তু ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে না তার। উল্টে হাত বাড়িয়ে সে বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দেখছে। সকালের কথা ভাবছে নাঈম এখন। অল্প সময়ের ব্যবধানে কত কথাই বলে গেল পরী। অথচ ওই সময়টুকু বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। পরীকে এক পলক দেখার ইচ্ছা যেন বাড়ছে নাঈমের। আজকে রাতে কি তাহলে ও ঘুমাতে পারবে?নাকি পরীকে দেখতে যাবে?নাঈম স্থির করলো আজকে যেভাবেই হোক অন্দরে সে ঢুকবেই। তার উপর আজকে কেউই নেই বাড়িতে।
আসিফ এসে নাঈমকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,’এই ঠান্ডায় এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন তুই?চল ভেতরে?’
নাঈম দৃষ্টি বৃষ্টিতে স্থির রেখে বলল,’আজকে পরীকে দেখতে যাব।’
‘এই ঝড়ের মধ্যে?পাগল হয়ে গেছিস তুই। সকালে কি হলো দেখলি না। পরী যেমন মেয়ে তোকে বেঁধে ফেলবে আমি নিশ্চিত। এরকম করিস না। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারিস না। চল ঘরে।’
কিন্তু নাঈম তা মানলো না। সে পরীকে দেখবেই দেখবে। এ নিয়ে কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি করল আসিফ আর নাঈম। আসিফ ভয় পেতে লাগলো আর নাঈম ওকে সাহস দিতে লাগল। কিন্তু ভাগ্য যেন ওদের সহায় হলো না। তখনই সদর দরজা খোলার শব্দ এলো। অন্ধকারে একটা অবয়ব দেখতে পেলো দু’জনেই। তবে বুঝতে পারলো না সে কে?তাই ওরা পূর্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো আগন্তুকের দিকে। বারান্দায় হারিকেন জ্বলছিল বিধায় আগন্তুক সেদিকেই আগে গেলো। সাথে সাথে ব্যক্তির মুখটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো। অস্ফুটস্বরে নাঈম বলে উঠলো, ‘আপনি!!’
ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে উঠল শায়েরের। বৃষ্টিতে ভিজে সে একাকার, হাসি মাখা ঠোঁট দুটো কাঁপছে তার। পরনের সাদা পাঞ্জাবি ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে। নাঈম অবাক হয়ে বলল,’এই বৃষ্টিতে ভিজে এলেন কেন আপনি?এই সময় ভেজা ভালো না জ্বর আসতে পারে। তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবি বদলে ফেলুন।’
শায়ের নাঈমের ঘরের মুখোমুখি ঘরটাতে প্রবেশ করে। পাঞ্জাবি খুলে আরেকটা পাঞ্জাবি পড়ে নেয়। দড়িতে ঝোলানো গামছাটা নিয়ে মাথার চুলগুলো মুছতে লাগলো সে। আফতাব বাড়িতে নেই বলেই শায়েরকে আসতে হলো। নাহলে তার ঠেকা পড়েছে এই ঝড়ের মধ্যে আসতে। কোন মাঝি আসতে চায়নি বিধায় সে নিজে এসেছে নৌকা চালিয়ে। সাথে কাকভেজা ও হয়েছে। আফতাবের সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক হলো সেহরান শায়ের। বলতে গেলে ডান হাত। আঁখিরের থেকে সে শায়েরকে বেশি ভরসা করে। সব কাজের দায়িত্ব একমাত্র শায়েরকে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারেন সে। কোন কাজে আজ পর্যন্ত দেরি করেনি শায়ের। তাছাড়া ওর কাজের হাত চমৎকার। বলতে গেলে যেখানে হাত দেয় সেখানেই সোনা পায়। এজন্য আফতাব একটু বেশি স্নেহ আর বিশ্বাস করে শায়েরকে। এমনকি শহর থেকে ডাক্তার আনার জন্যও শায়েরের হাত আছে। শায়েরের পরামর্শেই আফতাব ডাক্তার এনেছেন। শায়ের বলেছে এতে নাকি আফতাবের নাম বাড়বে। সবাই আরো বেশি বেশি শ্রদ্ধা করবে তাকে। হয়েছেও তাই,সবার মুখে মুখে এখন আফতাবের গুনগান ছাড়া কিছুই শোনা যায় না। নাঈমের সঙ্গে শায়েরের দেখা শহরেই হয়েছিল তবে তা ক্ষণিকের জন্য। এরপর নাঈম আর শায়েরকে দেখেনি। সে অন্য শহরে গিয়েছিল। আজই গ্রামে ফিরেছে আর এসেই কাজে লেগে পড়েছে।
এখন শায়েরের প্রধান কাজ হলো এই জমিদার বাড়ি রক্ষা করা। যেন বাইরের কেউ এই বাড়িতে ঢুকতে না পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে খুদায় পেট জ্বলছে ওর। কিছু না খাওয়া অবধি সে কিছুই করতে পারবে না। তাই সে ছাতা হাতে বের হলো। অন্দরমহলের দরজায় কয়েকবার টোকা দিল কিন্তু কেউই সাড়া দিলো না। অতঃপর শায়ের কুসুমকে কয়েকবার ডাকতেই কেউ একজন দরজা খুলে দিল। মুখোমুখি হলো পালক আর শায়ের। পালককে শায়ের একদমই আশা করেনি। ভেবেছিল বুঝি কুসুম আসবে। শায়ের নিজের বিষ্ময়তা বিনা প্রকাশে বলল, ‘কুসুমকে একটু ডেকে দিবেন?’
হারিকেনটা একটু উঁচু করে ধরে পালক। এতে শায়েরের মুখটা আরেকটু স্পষ্ট হয়। পালক বলে,’কুসুম তো নেই বোধহয় বাড়িতে গেছে।’
‘তাহলে বড় মা??’
পালক একবার পেছনে তাকিয়ে আবার শায়েরের দিকে তাকালো বলল,’ঘরে আছেন। কিছু লাগবে আপনার? আমাকে বলুন।’
শায়ের অনিচ্ছা প্রকাশ করে বলে,’নাহ,বড় মা’কে বলুন শায়ের এসেছে তাহলেই তিনি আসবেন।’
মাথা নেড়ে হারিকেন হাতে নিয়ে চলে গেল পালক। মালার ঘরে যেতেই দেখলো জেসমিন মালার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছেন আর থেমে থেমে কেশে উঠছে মালা। পালক এগিয়ে গিয়ে বলে,’কি হয়েছে ওনার?’
মুখ তুলে চকিতে তাকালো জেসমিন বললেন, ‘তুমি এঘরে এসেছো কেন?আর আপার বেশি কিছু হয়নি সামান্য জ্বর। সেরে যাবে তুমি নিজের ঘরে যাও।’
পালক শায়েরের কথা বলতেই জেসমিন ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তার সাথে পালককেও নিজের ঘরে যেতে বলে।
ঘরে এসেই পালঙ্কে গা লাগিয়ে শুয়ে পড়ে পালক। রুমি আর মিষ্টি খাতা কলম নিয়ে কিসব হিসাব কষছে। এসব ভালো লাগছিলো না বিধায় পালক নিচতলার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। অন্দেরের দরজা ধাক্কার শব্দে সে দরজা খুলল। কিন্তু চোখের সামনে কঙ্খিত পুরুষটিকে দেখে যেন মুগ্ধতা এসে ভেড়ে দুই নেত্রে। এই নিয়ে তৃতীয় বারের মতো শায়েরের সাথে দেখা তার। প্রথম দেখা হয়েছিল শহরে। অদ্ভুত এই পুরুষটির চোখে আটকে গিয়েছিল পালকের নয়ন জোড়া। অন্যরকমের মাধুর্য আছে শায়েরের চোখে। সুরমা পড়ায় চোখদুটোর সৌন্দর্য বেশিই ছড়াচ্ছে। সেখানেই পালক কিছু পল আটকে গিয়েছিল। তারপর আর দেখা হয়নি। আজকে বাগানবাড়িতে দ্বিতীয়বার দেখা হয়। তবে তা দূর থেকেই,আর এখন যে এইভাবে শায়েরের সাথে পালকের দেখা হবে তা ভাবেই নি পালক।
চলবে,,,,,,
যেহেতু এটা উপন্যাস তাই সামনে আরো কিছু নতুন চরিত্রের সাথে পরিচিত হবেন সবাই। তবে কে ভালো কে খারাপ তা এখনি বলা মুশকিল। আস্তে আস্তে সব পরিষ্কার হবে।