পরীজান পর্ব -০২+৩

#পরীজান
#পর্ব ২
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

বিশাল ছই বাঁধানো নৌকাটি থামলো গাঁয়ের জমিদার আফতাব উদ্দিন এর বাড়ির সামনে। গাঁয়ের সব ঘরবাড়ি বন্যায় তলিয়ে গেলেও জমিদার বাড়ির উঠোন ছুতেও পারেনি এই পানি কিন্তু যদি টানা আরো কয়েকদিন বৃষ্টি হয় তবে অনায়েসে এই বাড়ির উঠোনে পানি প্রবেশ করবে তা নিশ্চিত। বলা যায় উঁচু জায়গায় বাড়িটি হওয়ার দরুন বন্যার পানি স্পর্শ করেনি এই বাড়িটি কে। মোঘল আমলের বাড়িটি। সামনের উঠোন পেরিয়ে সদর দরজা পেরুলেই ডানে বামে দুটি বড় বড় পাকা ঘর। তারপর আরো একটি দরজা পেরুলেই বড় দোতলা দালানটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাড়ির দেয়ালগুলো কেমন নিস্তেজ। রং উঠে গিয়ে কেমন সবুজাভ বর্ণ ধারণ করেছে। আফতাব চাইলে এই বাড়ি নতুন করে রং করাতে পারে কিন্তু তা তিনি করেন না। কারণ তার পূর্ব পুরুষদের চিহ্ন এই বাড়ি। তাদের ছোঁয়া আছে এই বাড়ির প্রতিটি আনাচে কানাচে। অভিজাত্যের ছোঁয়া তাই এই বাড়িতে তিনি দিতে চাননা। বৃষ্টি বাদলে দেয়াল ভিজে কালচে হয়ে যাচ্ছে তবুও বাড়ির দিকে ফিরেও তাকান না তিনি। এতে লোকে যা বলার বলুক তাতে তিনি কান দেন না।
নৌকা থেকে বের হয়ে এলো ছয়জন যুবক যুবতী। তাদের ব্যাগ গুলো মাঝিরা বের করছে। ছেলে তিনজন নৌকা থেকে নেমে আসলেও মেয়ে তিনজন আসতে পারলো না। কারণ সামনে কাদায় ভরা। এখানে নামলে নির্ঘাত আছাড় খাবে ওরা। তাই সম্পান কাঠের তক্তাটা নৌকা থেকে মাটি বরাবর রাখল। সহজেই মেয়েগুলো নেমে পড়লো। সবাই নিজেদের ব্যাগ হাতে নিয়ে বাড়ির উঠোনে আসতেই অবাক হয়ে দেখতে লাগল বাড়িটি। সত্যিই বাড়িটি অনেক পুরোনো। সদর দরজার সম্মুখে আসতেই দুজন জোয়ান লোক লাঠি হাতে সামনে দাঁড়ালো। গমগম কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,’কারা আপনারা?কি চাই?’

নাঈম নামের ছেলেটি লোকটির কথার জবাব দিলো,’আমরা শহর থেকে এসেছি। এই গ্রামের জমিদার এনেছেন আমাদের। বন্যায় অনেক মানুষ নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাই,’

কথা শেষ করতে পারলো না নাঈম তার আগেই পেছন থেকে সম্পান বলে উঠলো, ‘আরে দাদা ওনারা ডাক্তার। জমিদার বাবু শহর থাইকা আনাইছে।’
আর কথা বলতে হলো না সম্পানকে। লোক দুজন সবাইকে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিলো। সদর দরজা পেরিয়েই বৈঠকঘরে আসলো সবাই। তৎক্ষণাৎ একটা মেয়ে দৌড়ে এসে বলল,’খারান বাবু পুরুষ মানুষ ভেতরে যাইতে পারবেন না। আপনেরা এইহানে বহেন আমি বড় মা’রে ডাইকা আনতাছি।’

ওদের বসতে দিয়ে মেয়েটা ছুটে ভেতরে চলে গেল। নাঈম ইশারায় সবাইকে বসতে বলে নিজে একটা কাঠের চেয়ার টেনে বসলো। শহর থেকে ছয়জন এসেছে ওরা। আরো কয়েকজন বড় বড় ডাক্তার আসবে তবে একটু সময় লাগবে। মেডিকেলের স্টুডেন্ট ওরা। নাঈম,আসিফ,শেখর, মিষ্টি,রুমি ও পালক। ওদের টিম প্রতিটি দলে ছয়জন করে ভাগ হয়ে একেক গ্রামে গিয়েছে। দেশের অবস্থা ভালো না। বন্যায় ভেসে গেছে গ্রামের পর গ্রাম। সাথে সাথে অসুখ ও বাড়ছে। বিশেষ করে কলেরা,গ্রামের মানুষেরা সতর্ক থাকে না বিধায় এইসব রোগ বেশি হয় তাই ওরা এসেছে সবাইকে সতর্ক করতে এবং চিকিৎসা করতে। অবশ্য সব ধরনের ট্রেনিং করেই এসেছে। তবুও বড় ডাক্তার সামনের সপ্তাহে এসে দেখে যাবেন।

বড়সড় ঘোমটা টেনে বৈঠক ঘরে এলেন মালা। সাথে একটু আগে আসা মেয়েটি ও। মালা নিচু স্বরে বললেন,’কুসুম হেগোরে নাস্তা পানি দে।’

সাথে সাথে কুসুম সবাইকে শরবত আর পিঠা দিলো। শরবত খেয়েই সবাই ক্ষ্যান্ত হলো আর খাবে না ওরা। মালা কুসুমকে দিয়ে ছেলেদের বৈঠক ঘরের পাশের ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দিলো। আর মেয়েদের নিয়ে ঢুকলেন মহিলা অন্দরমহলে। মালা ওদের নিয়ে পরীর ঘরেই বসালো। তারপর আবার রান্নাঘরে চলে গেল কাজে।
পরী এখনও আসছে না দেখে চিন্তিত মালা। ঘরে তিনজন নতুন পুরুষ এসেছে না জানি মেয়েটা কোন অবস্থাতে ঘরে এসে ঢোকে। তাই তিনি আগেভাগেই কুসুমকে পাঠিয়ে দিলেন নৌকা ঘাটে। কুসুম পানিতে পা ডুবিয়ে বসে রইল পরীর অপেক্ষায়।

কিছুক্ষণ পরেই দুইটা নৌকা ভিরল পারে। জুম্মান হাতে এক মুঠো শাপলা নিয়ে লাফ দিয়ে নেমে পড়লো। লতিফ আর দেলোয়ার বাকি শাপলা নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। সবশেষে বের হলো পরী। ওর হাতে একগুচ্ছ শাপলা। শাপলা দিয়ে একটা মালা বানিয়ে গলায় জড়িয়েছে সে। কুসুম দৌড়ে গিয়ে পরীর সামনে দাঁড়িয়ে বলল,’পরী আপা তাড়াতাড়ি ঘরে চলেন। বড় মা কইছে আপনের ঘরে যাইতে। আর বাইর হওয়া যাইবো না। ঘরে তিনজন নতুন পুরুষ আইছে। আহেন আমার লগে।’
পরী নিজের ঘাগড়া উঁচু করে ঝারছিল। কুসুমের কথায় হাত আপনাআপনি থেমে গেল তার। বুঝতে বাকি রইল না যে এই সেই মেহমান যার কথা সকালেই ওর আম্মা বলেছিলো। পরী বলল,’ক্যান??আম্মা ঘরে ঢুকতে দিলো??’

কুসুম গলা ঝেড়ে বলল,’ক্যান দিবো না। শহরের ডাক্তার তারা। রোগী দেখতে আইছে। থাকতে তো দিবোই।’
কুসুম আর কথা বলতে পারলো না। তার আগেই ঝপ ঝপ করে বৃষ্টি নেমে এসেছে। বৃষ্টির বড় বড় ফোটা ভিজিয়ে দিচ্ছে ওদের। জুম্মান আগেই ঘরে ঢুকে পড়েছে। পরী আর কুসুম একসাথে দৌড় লাগালো। হাতের শাপলা গুলোর পাপড়ি ঝরে পড়তে লাগলো মেঝেতে। বৈঠক ঘরের উঠোন পাকা করা। পরীর কর্দমাক্ত পা ফেলার দরুন পায়ের ছাপ সেখানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সাথে শাপলার পাপড়ি ছড়িয়ে পড়ছে। নাঈম নিজের ঘরের বারান্দায় বসে বসে নিজের জুতো পরিস্কার করছিল। আসার সময় কাদা লেগে গেছে। হঠাৎ কারো পায়ের শব্দে উঠোনের দিকে তাকালো। দুজন মেয়ে দৌড়ে চলে গেল। তারমধ্যে একজনকে নাঈম চেনে। সে হলো কুসুম এই বাড়ির কাজের মেয়ে। কিন্তু দ্বিতীয় জনকে সে চিনলো না। ওড়নাটা বোরখার নেকাবের ন্যায় পড়ে আছে বিধায় মুখটাও দেখতে পারলো না সে। মেঝেতে তাকিয়ে এক দৃষ্টিতে পরীর পায়ের ছাপ আর শাপলার পাপড়িগুলো দেখতে লাগল। বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না সে পায়ের ছাপ। বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে মুছে গেল। নাঈম বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। তারপর নিজ ঘরে চলে গেল।

বৈঠক ঘর পেরিয়ে মহিলা অন্দরে ঢুকতেই বৃষ্টির তোড় যেন বাড়ালো। বড় উঠোন পেরিয়ে খোলা বারান্দায় আসতে আসতেই ভিজে গেছে পরী। হাতের শাপলা গুলো মেঝেতে রেখে হাত পা ঝাড়লো সে। কুসুম ততক্ষণে রান্নাঘরে চলে গেছে। বাড়িতে মেহমান এসেছে রান্না করতে হবে তো! ভেজা জামাকাপড় ছাড়বে বলে পরী আবার দৌড় দিলো। ধুপধাপ শব্দ এলো পরীর পায়ের। কিন্তু পরক্ষণেই থেমে গেল সে। নিজের ঘরে অচেনা গন্ধ পেয়ে। রুমি বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। পালক আর মিষ্টি ব্যাগ খুলে কিছু খোজায় ব্যস্ত। কারো আগমনের আভাসে দু’জনেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। পরীকে দেখে চিনলো না ওরা। পরী নিজ কক্ষে প্রবেশ করতে করতে বলল,’কারা আপনারা আমার ঘরে কি করেন??’

ওরা দুজনেই থতমত খেয়ে গেল। কার ঘরে মালা ওদের রেখে গিয়েছে তা ওরা জানে না। যেখানে ওদের থাকতে দেওয়া হয়েছে ওরা সেখানেই থাকছে। পরী আরেকটু কাছে এসে দাঁড়িয়ে আবার একই প্রশ্ন করতেই মিষ্টি জবাব দিলো,’আমরা শহর থেকে এসেছি। এই গ্রামের জমিদারের গিন্নি মানে মালা বেগম আমাদের এই ঘরে থাকতে বলেছেন।’

সঙ্গে সঙ্গে পরীর রাগ আসমান ছুঁয়ে গেল। যেখানে নিজের জিনিস পত্রে কারো হস্তক্ষেপ সে পছন্দ করে না সেখানে একই ঘরে এই মেয়েদের নিয়ে সে থাকবে কিভাবে?সাথে সাথেই পরী গলা ফাটিয়ে মালাকে ডাকতে শুরু করে দিল,’আম্মা,আম্মা, আম্মাজান এট্টু এদিকে আহেন??’
কিন্তু মালার পরিবর্তে ঘরে এসে হাজির হলো আবেরজান বেগম। লাঠিতে ভর দিয়ে এসে তিনি বললেন,’মাইয়া মানুষ এতো গলা বাজাস ক্যান তোরে না করছি না?এতো চিল্লাস ক্যান বারবার?’
পরী দ্রুত পদে দাদির নিকটে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,’আমারে না জানাইয়া আমার ঘরে অন্য মানুষ ঢুকতে দিলা ক্যান?’

আবেরজান পান চিবুতে চিবুতে বলল,’অহনই তো আইলো ওরা। একটু জিরাইতে দে?তোর মায়ের মেলা কাম এহন। পরে ওগোরে অন্য ঘরে দিয়া আইবো। তুই ভিইজা গেছস কাপড় বদলা।’
লাঠির ভরে চলে গেল আবেরজান। মিষ্টি আর পালক লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলেছে। প্রথম দিনেই এতো বড় অপমান মেনে নিতে পারলো না ওরা। মেয়েটা কিভাবে সামনাসামনি কথাগুলো বলে ফেলল? রুমি এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিল,পরীর চিল্লানোর ফলে ধড়ফড়িয়ে ওঠে সে। পরবর্তী কথাগুলো ওর কানে যেতেই লজ্জাবোধে মাথা নিচু করে ফেলে। এখন ওদের মনে হচ্ছে এই গ্রামে আসাটাই ভুল হয়েছে ওদের।
পরী কথা না বলে সামনে পা বাড়ালো। কাঠের সাথে লাগানো আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। অনেকটা দেখতে ড্রেসিং টেবিলের মতো। তার সামনে কয়েকটা কৌটা আর কতগুলো রং বেরঙের ফিতা। এতক্ষন ধরে মুখে ওড়না বাঁধা থাকলেও এখন সেটা এক টানে খুলে ফেলল পরী। তারপর চুল থেকে ফিতার বাঁধন খুলতে ব্যস্ত হলো।
মিষ্টি আর পালক চোখ তুলে পর্যন্ত তাকাতে পারলো না। কিন্তু রুমির ধাক্কায় সেদিকে দু’জনে তাকালো। রাগ জড়ানো কন্ঠে পালক বলল,’কি হয়েছে ধাক্কা দিচ্ছিস কেন?’

রুমি হা করে সামনের দিকে চোখ রেখে বলে উঠলো,’হ্যা রে এটা কি মেয়ে নাকি কোন মোমের পুতুল? একটু কি ছুঁয়ে দেখব?’

রুমির কথার মানে ওঁরা দুজনের বুঝতে পারলো না। রুমির দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই ওদের দৃষ্টি স্থির হলো সামনের আয়নাতে। আয়নার প্রতিবিম্বে যেন একটা পরীর আগমন ঘটেছে। পুরো পুতুলের মতোই লাগছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে। গাঁয়ের রং টা উজ্জ্বল ফর্সা। তার উপর পানির ফোঁটাগুলো চিকচিক করছে। এই প্রথম মেয়ে হয়ে কোন মেয়ের উপর চোখ আটকে গেছে ওদের। ঘোর থেকে কিছুতেই বের হতে পারছে না ওরা। চুল থেকে বেগুনি রঙের ফিতাদুটি খুলে রেখে ওড়না হাতে পিছনে ঘুরতেই তিনজন যুবতীকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে পরী কপাল কুচকালো। তবে কিছু বলল না। কাঠের তৈরি আলমারি থেকে নিজের কাপড় বের করে ঘর থেকে বের হতে নিলে পালকের ডাকে থমকে দাঁড়ায় পরী। পালক জিজ্ঞেস করে বসে,’নাম কি তোমার?’

পরী পেছনে না ফিরেই উওর দিলো,’পরী।’
অতঃপর ঘরে ছেড়ে বের হয়ে গেল। এবার ওদের কাছে সব পানির মতো পরিস্কার হয়ে গেল। এই মেয়ের কথাই বিন্দু আর সম্পান বলাবলি করছিল। বিন্দুকে সাথে করে নিয়েই ওরা শাপলা বিলে আসে। কিন্তু তার আগেই লতিফ আর দেলোয়ার ওদের পথ রোধ করে দাঁড়ায়। কিছুতেই ওদের এদিক দিয়ে যেতে দিবে না ওরা। সম্পানের অনেক অনুরোধে ও লতিফের মন গলল না। কারণ জমিদার কন্যা পরীর কড়া‌ হুকুম সে থাকা কালীন শাপলা বিলে কোন পুরুষের আগমন ঘটতে পারবে না। শাপলা বিলে সাঁতার কাটার জন্য কথাটা পরী বলেছিল কিন্তু তবুও তার সাঁতার কাটা হলো না। শেষে বিন্দু পরীর নৌকায় গিয়ে ফিসফিসিয়ে শলা পরামর্শ করে অনুমতি নিলো। তারপর সম্পান নৌকা নিয়ে অনায়াসে শাপলা বিলে বৈঠা ফেলল। পালক ভেবেছিল জমিদার কন্যা না জানি কেমন হবে? কিন্তু সামনাসামনি দেখল এতো একটা পুঁচকে মেয়ে। বয়স চৌদ্দ কি পনের হবে। এই মেয়ের রূপের যেমন তেজ মেজাজের তেমন ঝাঁঝ। সব মিলিয়ে আগুন বলা যায়।
মিষ্টি বড় একটা দম ফেলে বলল,’এটা মেয়ে নাকি বিছুটি পাতা? এভাবে কেউ কারো সাথে কথা বলে?শহর থেকে এসেছি মেহমান ই তো ওদের। সেজন্য এভাবে কথা বলবে?’

তবে মিষ্টির কথা কেউ কানে তুলল না। রুমি চোখ কচলে বলল,’এতো সুন্দর মেয়ে আমি এই প্রথম দেখলাম।’

‘হবেই তো। দেখলি না এই পরীর মা কত সুন্দর। যৌবন কালে ওই মহিলার ও তার মেয়ের মতো রূপ ছিল। মায়ের মতোই হয়েছে মেয়েটা।’
পালকের কথায় রুমি খাট থেকে নেমে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,’ছেলে হলে এই মেয়েটাকে এখুনি বিয়ে করে ফেলতাম।’
হাসলো পালক,’তোর মতো সাধারণ মেডিকেল স্টুডেন্টের কাছে জমিদার তার মেয়ের বিয়ে দিতো বুঝি?’

‘জমিদার,রাজকুমার,রাজা হওয়ার একটা সুবিধা আছে জানিস? রাজ্যের সবচেয়ে সুন্দরী রমণী তাদের জন্য বরাদ্দ থাকে।’

পালক আর রুমির দুষ্টুমি পছন্দ হলো না মিষ্টির। মেয়েটার নাম মিষ্টি কিন্তু কথায় ঝাল মেশানো থাকে সবসময়। মুল কথা হলো পরীর সৌন্দর্য ওর পছন্দ হয়নি। ওরাও সুন্দর,ফর্সা গায়ের রং কিন্তু পরীর মতো অতো নয়।
দুপুরে খাওয়ার ডাক পড়তেই সবাই একসাথে খেয়ে নিলো কিন্তু খাওয়ার সময় ওরা পরীকে দেখতে পেলো না। ছেলেদের আগে খেতে দেওয়া হলো এবং মেয়েদের পরে। খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বের হলো ওরা। ঘাটে ওদের জন্য নৌকা বাধাই আছে। ব্যাগপত্র নিয়ে দ্রুত নৌকায় চেপে বসে সবাই। এখন ওরা গ্রামের আশ্রয়কেন্দ্রে যাবে। সেখানে শতাধিক মানুষ আছে। অর্ধেকের বেশি অসুস্থ। সেখান থেকে ওরা জমিদারের বাগান বাড়িতে যাবে। সেটিও বর্তমানে আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত করেছে আফতাব। নৌকায় বসে পালক আর রুমি ফিসফিস করে কথা বলছে আর হাসছে। ওদের কান্ড দেখে নাঈম জিজ্ঞেস করল,’কি রে তোরা নিজেদের মধ্যে কি বলছিস?আমাদের কেও বল শুনি?’
শেখর তাতে তাল মিলিয়ে বলল,’বোধহয় বিয়ের পর হানিমুন বাচ্চা গাচ্চার প্ল্যান করছে।’
বলতে বলতে হাসলো শেখর। পালক শেখরের বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বলল,’জ্বী না মশাই। আমরা জমিদারের মেয়ে পরীর কথা বলছি। জানিস মেয়েটি দেখতে খুব সুন্দর একদম পুতুলের মতো। নাম পরী আর দেখতেও পরীর থেকে কম নয়। আমি কখনো রাজকন্যা দেখিনি। কিন্তু রাজকন্যারা বোধহয় এই পরীর মতোই দেখতে।’
কৌতূহল হয়ে পালকের কথা শুনতে লাগলো শেখর নাঈম আর আসিফ। তবে পুরোপুরি হয়তো কথাটা বিশ্বাস হলো না ওদের। আসিফ ব্যাঙ্গাত্বক সুরে বলল,’ফাজলামো করছিস?গ্রামের এরকম নোংরা পরিবেশে এতো সুন্দর মেয়ে!!’

ধমকে উঠলো রুমি,’চুপ থাক। একটা মেয়ে কখনোই আরেকটা মেয়ের রূপের বর্ণনা দেয় না দিতে চায় না। কিন্তু আমি না দিয়েও পারছি না। আসলেই মেয়েটা খুব সুন্দর।’

নাঈম ওদের সবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তাহলে তো দেখতে হচ্ছে মেয়েটাকে। দেখি কেমন সুন্দর?’
‘তা দেখবি কিভাবে? অন্দরমহলে তো পুরুষ ঢুকতে দেওয়া হয় না।’
রুমির দিকে তাকিয়ে কপাল কুচকালো নাঈম। সত্যি তো!! তাহলে কি পরীকে দেখা হবে না?
‘যদি পরী বাইরে আসে তাহলে দেখবো।’

পালক ভেংচি কাটলো নাঈমের দিকে তাকিয়ে বলল,’অতো সোজা না বাবু। ওই মেয়ে বাইরে বের হয় কিভাবে দেখোনি? আজকে শাপলা বিলে তো নৌকায় ওই পরীই ছিলো। বাবা কতো জোর করে আমরা আসতে পারলাম।’

নাঈমের মুখে চিন্তার রেশ দেখা গেলো। পালক আর রুমি যেভাবে মেয়েটার বর্ণণা দিলো,একবার না দেখা পর্যন্ত ও ক্ষ্যান্ত হবে না। শেখর দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,’তাহলে আমরা রাতে চুরি করে অন্দর মহলে ঢুকব কি বলিস তোরা?আমি কিন্তু পরীকে না দেখে শহরে ফিরছি না।’

শেখরের কথায় সবাই হাসলো শুধু মিষ্টি বাদে। ও ছইয়ের বাইরে বের হয়ে চারপাশ দেখছে। নাঈম শেখরের কথা ভেবে দেখল মন্দ না। সে বলল,’তাহলে আজ রাতেই মিশনে নেমে পড়া যাক? কি বল?’
এবার আসিফ ও সায় দিল। ও দেখতে চায় কেমন সুন্দর মেয়ে!পালক ওদের কথা শুনে মাথা নেড়ে বলল,’পাগল তোরা সব। ধরা খেলেই বুঝবি। জমিদার মশাই তোদের গর্দান নিবে দেখিস। আহারে এসেছি ছ’জন যেতে হবে তিনজন।’
কথাটা আফসোসের সুরে বলল পালক। নাঈম বলল,’আমারা ধরা খেলে তোদের নাম বলব। তোরাই তো লোভ দেখালি। মেয়েটা এতো সুন্দর!গর্দান গেলে সবার যাবে।’
#পরীজান
#পর্ব ৩
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌

গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় কে আশ্রয় কেন্দ্র বানানো হয়েছে। এখানে সবাই তাদের মালপত্র নিয়ে কোন এক স্থানে ঘাপটি মেরে থাকছে। গত পাঁচদিনে আফতাব উদ্দিন কিছু কিছু খাবার দিয়েছে সবাইকে তাছাড়া কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকেও সাহায্য করা হচ্ছে অসহায় মানুষদের। নৌকা থেকে আশ্রয় কেন্দ্রে নামতেই নাঈম সহ সবাই হা হয়ে সবটা দেখতে লাগলো। এই গ্রামের সবকিছুই অদ্ভুত ধরনের। এমনকি জমিদার বাড়িটাও। অদ্ভুত ধরনের জিনিসপত্রের ভরপুর বাড়িটি। ওরা যতক্ষণ ওবাড়িতে ছিল ততক্ষণ ধরে শুধু দেখেই যাচ্ছিল।
সবাই ওদের দেখেই বুঝতে পারল যে ওরা শহুরে ডাক্তার। গায়ে সাদা রঙের এপ্রোন জড়ানো বিধায় চিনতে সুবিধা হয়েছে। খাটো মোটা করে একজন লোক এগিয়ে এলো ওদের দিকে। ঘুরে ফিরে সবাইকে একপলক দেখে নিয়ে বলল,’আহেন আপনারা,ওদিক থেকে শুরু করেন।’
নাঈম সায় জানিয়ে লোকটার পিছু পিছু গেল। একপাশে কাঠের টেবিল ও চেয়ার পাতা হয়েছে। মিষ্টি চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো। এটুকু তেই হাঁপিয়ে গেছে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে নাক সিটকে সে বলে উঠলো,’এই নোংরা জায়গায় থাকতে হবে এখন। আমার তো বাবা বমি আসছে। ইচ্ছা করছে এখুনি ঢাকা ফিরে যাই।’

পালক নিজের চেয়ারটাতে বসতে বসতে বলল,’তা হচ্ছে না কন্যা। স্যার তো বলেই দিয়েছে আমাদের এখানেই থাকতে হবে। এতে তোর বমি আসলে করে ফেল। তোকেও রোগি বানিয়ে এখানে ভর্তি করিয়ে দিবো।’

নাঈম স্টেথোস্কোপটা গলায় ঝুলিয়ে ব্যাগ থেকে খাতা কলম বের করতে করতে বলল, ‘তাড়াতাড়ি কাজ শেষ কর তাহলে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবি।’
শেখর নিজের ব্যাগ খুলতে খুলতে বলল,’হ্যা আর তাড়াতাড়ি পরীকে দেখতে পারবো।’
রুমি শেখরের মাথায় গাট্টা মেরে বলল,’পরীর চক্করে যেন ভুলভাল চিকিৎসা করিস না তাহলে তুই শেষ।’
ওরা ছয়জন কাজে লেগে পড়লো। লাইন ধরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। নাঈম চেয়ার পেতে বসে আছে আর একেকজনের সমস্যার কথা শুনছে আর ওষুধ লিখছে। শেখর আর আসিফ ওষুধ দিচ্ছে। আর মেয়েদের চিকিৎসা করছে রুমি মিষ্টি আর পালক। কারণ এখানকার মেয়েরা পুরুষ ডাক্তারদের কাছে আসতে অস্বস্তি বোধ করে তাই এরকম ব্যবস্থা করা। তবে লোকসংখ্যা দেখে মনে হচ্ছে আজকে রোগি দেখে শেষ করতে পারবে না। ইতিমধ্যে বিকাল গড়িয়ে এসেছে।

হঠাৎ করেই নাঈমের চোখ গেল ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা সম্পানের দিকে। কিছু একটা ভেবে নাঈম তার নিজের জায়গায় আসিফকে বসিয়ে উঠে গেল। সম্পানের সামনে গিয়ে দাড়াতেই এক গাল হাসলো সম্পান। বিনিময়ে নাঈম ও মুচকি হাসি উপহার দিলো সম্পানকে। বলে উঠলো,’কি অবস্থা?? তুমিও কি এখানে থাকো??’

‘না বাবু!! আমার কি একখানে খাড়ানের সময় আছে। নাও নিয়াই পইড়া থাহি। মেলা কাম আমার। পুরা পদ্মাই আমার বুঝছেন।’

সম্পানের কথায় হাসলো নাঈম। অদ্ভুত ভাবে সেই হাসি অবলোকন করে সম্পান। শহরের লোক হওয়ায় অন্যরকম দেখতে নাঈম। চুলগুলো কি সুন্দর!!গায়ের রং ও ফর্সা। পরনের পোশাকআশাক বলে দেয় ছেলেটা বড় ঘরে জন্মেছে। সেখানে সম্পান নিন্তান্ত চুনোপুঁটি। আয়নায় নিজের চেহারা না দেখলেও প্রতিদিন নদীর পানিতে নিজের চেহারা দেখে সে। মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল শ্যামলা গায়ের রং আর পরনের পোশাক তো সবসময় নোংরা থাকে। এভাবে কি তাকে সুন্দর দেখাবে? সুন্দর দেখাতে হলে আগে তাকে সুন্দর পোশাক পড়তে হবে। নাঈমের মতো চুলগুলোর যত্ন করতে হবে। কিন্তু ওসবের ক্ষমতা নেই সম্পানের। পরের নৌকা চালিয়ে যা পায় তাতে তো সংসার ঠিকমতো চলে না। তার উপর এই সর্বনাশা বন্যা সব শেষ করে দিলো। ঘরবাড়ি সব ডুবিয়ে দিয়েছে। এখন ওর পরিবারের ঠাঁই হয়েছে নিজের আধভাঙ্গা নৌকা খানিতে। ফুটো দিয়ে পানি ঢুকতেই থাকে অনবরত আর ওর মা পানি ফেলতে ফেলতে হয়রান হয়।
সম্পানকে ভাবতে দেখে নাঈম হাল্কা ধাক্কা দিলো সম্পানকে,’কি ভাবছো??’

সম্পান হেসে বলল,’না কিছু না!’
নাঈম এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল কেউ আছে কি না!সম্পানকে একপাশে টেনে নিয়ে আস্তে করে বলল,’তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব সত্যি সত্যি বলবে?’

‘কি কথা??’
খানিকটা ইতস্তত করে নাঈম বলল, ‘জমিদারের মেয়ে পরীর সম্পর্কে বলতে পারবে??’
মুহূর্তেই সম্পানের চেহারায় আধার নেমে এলো। হাসি মুখখানি তে ভয়ের ছাপ দেখা দিলো। সে মাথায় হাত রেখে বলল,’ঠাকুরের দিব্যি বাবু আমি পরীর কিছুই জানি না। আমারে এইসব জিগাবেন না। আমি কইতে পারুম না।’
কথা শেষ করে সম্পান চলে যেতে চাইলে নাঈম ওর হাত খপ করে ধরে ফেলে। অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,’এতো ভয় পাচ্ছো কেন তুমি?কি আছে ওই পরীর মাঝে যে এতো ভয় পাও তুমি? আমাকে নির্ভয়ে বলতে পারো। আমি কাউকে বলবো না।’
কিন্তু সম্পান বলতে নারাজ। নাঈম অনেক জোরাজুরি করতে লাগলো। শেষে সম্পানকে বলতেই হলো পরীর সম্পর্কে।

‘পরী আমাগো জমিদারের ছোট মাইয়া। আপনারা পরীগো বাড়িতেই গেছেন। পরীর মা বাপে অনেক শাসন করে ওরে। সবসময় ঘরের ভিতরে বইসা থাকে বাড়ি থেকে বাইর হয় না একটুও।’

মনোযোগ দিয়ে সম্পানের কথাগুলো শুনলো নাঈম তারপর বলল,’কেমন দেখতে পরী? তুমি কি কখনো ওকে দেখেছো?’
হাসলো সম্পান। হাত নাড়িয়ে বলল,’আমি ক্যান বাবু এই গাঁয়ের কোন বেডা মাইনষেও পরীরে দেহে নাই। আমি দেখমু কেমনে?’

‘কারো কাছে শোননি পরী কেমন দেখতে?’

‘হ,বিন্দু কইছিলো পরী নাকি মেলা সুন্দর। এর বেশি তো জানি না।’

সন্দেহ ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে নাঈম বলল,’ব্যাস এটুকুই? এটুকু বলতেই এতো গলা কাঁপছে তোমার? আমার মনে হয় তুমি সব কথা বলো নি।’

এবার সম্পান আর দাঁড়ালো না। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল ঘাটে। দ্রুতপদে চেপে বসলো নৌকায়। নাঈম শান্ত চাহনিতে সম্পানের চলে যাওয়া দেখলো। নাঈমের মনে হচ্ছে সম্পান কিছু লুকাচ্ছে। কিন্তু কি??জানতে হবে ওকে। তবে সবার আগে পরীকে দেখার প্রয়োজন। এসব ভাবতে ভাবতে নিজের কাজে মন দিলো সে।

মাগরিবের আজান পড়েছে ঘন্টাও হয়নি। ওযু করে একসাথে নামাজ আদায় করলেন জেসমিন ও মালা। মোনাজাতে মন ভরে দু’জনে দোয়া করল এই গ্রামের সকল মানুষের জন্য। যে বন্যা দেখা দিয়েছে মনে হচ্ছে গ্রামকে পুরোপুরি গ্রাস না করা পর্যন্ত থামবে না। জায়নামাজ ভাজ করে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে বের হতেই মালা দেখলেন পরী বড়বড় পা ফেলে রান্না ঘরের দিকে এগোচ্ছে। কৌতূহল নিয়ে মালাও এগোলেন সেদিকে। রান্না ঘরে উঁকি দিতেই দেখলেন থালা ভর্তি ভাত নিয়ে খেতে বসেছে পরী। বড়বড় ভাতের দলা মুখে পুরছে আর কাঁচা মরিচে কামড় বসাচ্ছে। ঝালে ঠোঁট দুটো লাল হয়ে গেলেও পরী খেয়েই যাচ্ছে। সামনেই জ্বলছে হারিকেন। হলুদ আলোয় পরীর চেহারায় লাল আভা দেখা যাচ্ছে। মালা বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখল মেয়েকে। এক পা ভাঁজ করে আরেক পা মেলে দিয়ে মেঝেতে বসে খাচ্ছে পরী। গায়ের ওড়না অপরাধির ন্যায় পাশে পড়ে আছে। মালা হাজার চেষ্টা করেও পরীকে বোঝাতে পারে না যে সভ্যতা কাকে বলে। কিভাবে চলতে হয়,খেতে হয়,কথা বলতে হয়!এই নিয়ে দুঃখের শেষ নেই মালার। পরীর জন্য শ্বাশুড়ির কাছেও কথা শুনতে হয়। শ্বাশুড়ি পরীর সাথে পেরে ওঠে না বিধায় মালাকেই কথা শোনায়। এই মেয়েকে নিয়ে মালা আর পারছে না।
মালা রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থেকেই বলে উঠলো,’এই সাঁঝের বেলা খাইতে বইলি যে?’

মুখ তুলে একবার মা’কে দেখে নিলো পরী তারপর আবার খাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘দুপুরে কিছু খাই নাই। তাই খিদা লাগছে।’

‘তোরে কতবার কইছি এইরম ভাবে খাইতে বইবি না। ওড়না ঠিক কর তাড়াতাড়ি!’

মায়ের কড়া চাহনিতে পরী ওড়না তুলে গলায় ঝুলায়। তারপর গপাগপ খেতে খেতে বলে, ‘আমার ঘর খালি হইছে নাকি?হেরা গেছে?’

মালা গম্ভীর কন্ঠে বলে,’হ গেছে। তুই তো থাকতে দিবি না।’

কিছু একটা ভেবে পরীর খাওয়া হঠাৎ থেমে গেল। চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,’আমার সোনা আপার ঘরে থাকতে দিছেন?’

‘তোর সোনা,রুপা আপার ঘরে থাকতে দেই নাই। এহন খা জন্মের মতো। পেট না ভরলে আমারে খা।’
মালা রাগে ফুস ফুস করতে করতে চলে গেলেন। পরী তা দেখে হাসলো। দরজার দিকে উঁকি দিয়ে মায়ের যাওয়া নিশ্চিত করে গায়ের ওড়নাটা আবার ফেলে দিলো সে। শান্তি মতো বসে খেতে না পারলে পেট ভরে না পরীর।

নাঈমরা ফিরল সন্ধ্যার পর পরই। এসেই যার যার ঘরে চলে গেল। সন্ধ্যা থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। রাতে জোরে বৃষ্টি নামবে বোধহয়।
রুমিদের ঘর আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। পরীর যে মেজাজ তাতে ওদেরও মন সায় দিলো না দ্বিতীয় বার ওই ঘরে পা ফেলার।

একটু রাত করেই বাড়িতে ফিরলেন আফতাব উদ্দিন। প্রায় তিনদিন পর বাড়িতে এসেছেন তিনি। সাথে ওনার ছোট ভাই আঁখির উদ্দিন ও এসেছেন। তবে সে অন্দরমহলে ঢুকতে পারলেন না। কারণ আফতাব ছাড়া অন্দরমহলে কোন পুরুষ প্রবেশ নিষিদ্ধ। এই প্রথা শুধুমাত্র পরীর জন্য নয়। এটা ছিল পরীর মা মালার জন্য। আফতাব যেদিন মালা কে বিয়ে করে ঘরে তোলেন সেদিনই সবাই মিলে নববধূ দেখার জন্য আসে। মালাকে দেখে সবাই সেদিন হা হয়ে গিয়েছিল। অন্যান্য পুরুষেরা কুনজর দিয়েছিল মালার উপর। সুন্দরের দিকে সব মানুষের চোখ আটকে যায় কিন্তু সবাই সুন্দর নজরে তাকাতে পারে না কারো কারো নজরে নিকৃষ্টতা মেশানো থাকে। তবে মালার দিকে সর্বপ্রথম নোংরা নজরে দেখে আফতাবেরই ভাই আঁখির। সেটা কয়েকদিনের মাথায় ঠিকই বুঝতে পেরেছিল আফতাব। সেজন্য মহিলা অন্দরমহলে তিনি ব্যতীত অন্য পুরুষের ঢোকা নিষেধ করে দিয়েছিলেন আফতাব। পরে যখন ওনার তিন মেয়ের দিকে তাকান একই ভাবনা আসে ওনার মাথায়। কেননা মালা একটি নয় তিন তিনটা পরী জন্ম দিয়েছে। ছেলেদের বদ নজর আর মেয়েদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আফতাব।

যেই মালার জন্য এতকিছু করল আর সেই মালাকে ফেলেই আরেকজনকে বিয়ে করে ঘরে তুলল আফতাব সেটাই বুঝতে পারে না পরী। বেশি ভালোবাসায় মরিচা ধরে নষ্ট করে দেয় সেই ভালোবাসা। এই ভেবেই পরীর মনে আগুন জ্বলে সবসময়। শুধু পরী কেন এজন্য সোনালী আর রুপালি ও বাবাকে অপছন্দ করে। তবে তা প্রকাশ করে না কেউই।

কাজ শেষে আফতাব আসতেই তার দুই বিবি এগিয়ে গেলেন। জেসমিন হাত মুখ ধোয়ার পানি এগিয়ে দিলেন আর মালা গেলেন খাবার আনতে।

তিমির নিশাকালে ঘুটঘুটে অন্ধকার ছেয়ে আছে চারিদিকে। বৃষ্টির শব্দ আর ব্যাঙের ডাক ভেসে আসছে। গুমোট ভাবটা এতে কাটছে কিছুটা। কিন্তু এই সময়টাতে যেন চারিদিকে ভয় ছড়িয়ে পড়েছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে বৃষ্টির তান্ডব যেন বাড়ছে বৈ কমছে না। কালকে সকালে না জানি কতটা পানি বাড়ে?এই জন্য ঘুম আসছে না মালার। পাশেই জুম্মান বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আফতাব আজকে জেসমিনের ঘরে ঘুমিয়েছে তাই জুম্মান আজকে বড় মায়ের সাথে ঘুমাচ্ছে। মালা অনেক রাত পর্যন্ত এপাশ ওপাশ করলো। চোখটা সবে লেগে এসেছে অমনি কারো গলার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল। তড়িঘড়ি করে মালা বাইরে এসে বোঝার চেষ্টা করলো যে কে এমনভাবে চিল্লাচ্ছে। তবে বাইরে এসে বুঝতে পারলো এটা কুসুমের গলা।
নিচ তলার বারান্দায় সে এদিক ওদিক হারিকেন নিয়ে দৌড়াচ্ছে আর জোরে জোরে বলছে,’কেডা কোথায় আছো গো ঘরে চোর আইছে চোর।’
মালা ভীত হয়ে দৌড়ে এলো নীচ তলায়। ততক্ষণে জেসমিন ও আফতাব বের হয়ে এসেছেন।
কুসুমের গলার স্বরে সবার আগে পালকের ঘুম ভাঙল। রুমি আর মিষ্টি কেও ডেকে তুলল। ঘটনা জানতে ওরা ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। ওখান থেকে নীচ তলার উঠোন স্পষ্ট তবে অন্ধকারে এখন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আফতাব এগিয়ে এসে বললেন,’কি হয়েছে কুসুম?’
কুসুম হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,’কর্তাবাবু ঘরে চোর আইছে গো চোর।’
মালা ঘোমটা টেনে এগিয়ে এসে বললেন,’কস কি?কি কি চুরি করছে?’

কুসুম হাল্কা হেসে বলল,’পরী আপা থাকতে চুরি করব কেমনে?বেডারে মাইরা ভর্তা বানাইয়া দিছে।’
মালার চোখ কপালে। অন্ধকারের মধ্যে পরীকে খুঁজতে লাগলো মালা। কুসুম ছাতা মালার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,’ওই যে উঠোনে পরী আপা। এতক্ষণে বেডারে বাইন্ধা ফালাইছে।’
বলেই মুখে হাত দিয়ে হাসলো কুসুম। হারিকেন হাতে নিয়ে ছাতা মাথায় দিয়ে আফতাব আর মালা এগিয়ে গেল উঠোনের কোনে। বড় পেয়ারা গাছের সাথে লোকটার হাত দুটো বাধছিলো পরী। লোকটার পুরো মুখে গামছা পেঁচানো এতে চেহারা দেখা যাচ্ছে না। পরী আর লোকটা সম্পূর্ণ ভিজে গেছে। মোঠা লাঠিটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো পরী। আফতাবের দিকে তাকিয়ে বলল,’চোর ধরা শ্যাষ আর আপনে অহন আইলেন?যাক গে কাইল ওর বিচার কইরেন। আইজ রাইত ভর এইহানে বৃষ্টিতে ভিজুক।’

আফতাব গোমড়া মুখে তাকালেন পরীর দিকে। অনেক কিছুই বলতে চাইছে তিনি কিন্তু রাত বেশি হওয়ায় আর কথা বাড়ালেন না তিনি। পরীকে ঘরে যেতে বললেন।

উপরে দাঁড়িয়ে সবই শুনলো রিমি মিষ্টি ও পালক। এখন ওরা ভয় পাচ্ছে খুব। যদি নাঈম শেখর বা আসিফের মধ্যে কেউ একজন হয়? ভাবতেই গলা শুকিয়ে এসেছে তিনজনের। পালক ভয় মিশ্রিত কন্ঠে বলে, ‘কোন চোর ধরেছে পরী?নাঈম তো বলেছিল আজকে পরীকে দেখতে অন্দরমহলে আসবে। তাহলে ওরা পরীর হাতে ধরা পড়ে গেল?’

রিমি নখ কামড়াতে কামড়াতে বলল,’এই মেয়েটা তো খুব ভয়ানক রে। অন্ধকার ওকে কাবু করতে পারে না বরং অন্ধকার ওকে দেখে কাবু হয়। নাহলে এই অন্ধকারে কি করে একটা মানুষকে মারতে পারে?’
এবার মিষ্টিও ভয় পেল খানিকটা। কোন বিপদ হবে না তো? তখনই পরীকে আসতে দেখা গেল। তবে হারিকেনের আলোয় পরীর হাতের লাঠির মাথায় রক্ত দেখল ওরা। এতে ওদের ভয় আরো বেড়ে গেল। পরী ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,’আপনেরা ভয় পাবেন না। পরী থাকতে অন্দরমহলের কোন মাইয়ার গায়ে কেউ হাত দিতে পারে নাই আর পারবেও না কোনদিন। আপনেরা অহন ঘুমাইতে যান। কাইল বিচার হবে তখন সব দেখতে পারবেন।’

বলেই পরী চলে গেল। কিন্তু ওদের ঘুম কি আদৌ আসবে?বড়সড় একটা চিন্তা ওদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কোন মতে নাঈমা বা শেখর যদি হয় তাহলে ওদের মানসম্মান সব শেষ।

চলবে,,,,,,,,,,
যেহেতু এই প্রথম কোন উপন্যাস লিখছি তাই আমি চাই এটি সবার কাছে আমার মেইন আইডি থেকে পৌঁছাক। তাই কেউ কপি করবেন না।
আরেকটা কথা বলতে চাই,তা হলো অনেকেই ভাবছে এই উপন্যাস টা পদ্মজার মতো হবে। চরিত্র একই কিন্তু নাম ভিন্ন,এটা সম্পূর্ণ ভুল। পদ্মজা আমিও পড়েছি।
পরী কখনো পদ্মজার মতো হতে পারবে না আর পদ্মজা ও পারবে না। উপন্যাস শেষ হলেই সেটা বুঝতে পারবেন। তাই অযথা মন্তব্য না করে উপন্যাস সম্পর্কে কিছু লিখুন আমার ভালো লাগবে।
ধন্যবাদ সবাইকে,,,,
চলবে,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here