#পরীজান
#পর্ব ২২
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
সব ভালোবাসা সুখকর হয়না। পায়না সে নিজস্ব পূর্ণতা। কিয়ৎকালের জন্য সুখ দিয়ে সারাজীবন দেয় বেদনা। প্রহর গুলোতে আনন্দ দিলে,ঋতু জুড়ে দেয় বেদনা। ভালোবাসা কি আদৌ সুখ দেয়?ভালোবাসা ছাড়া কি বেঁচে থাকা যায় না?ভালোবাসা যদি সুখ দিতো তাহলে বিশ্বজুড়ে ভালোবাসাতে ভরে যেতো। কষ্ট চেনার সাধ্য কারো হতো না। সবার ক্ষেত্রে ভালোবাসা আনন্দময় হয় না।
ভালোবাসা নামক সুখ পাখিটা সবার জীবনে ডানা ঝাপটাবে। কিন্ত পাখিটা কি আদৌ পোষ মানবে কি? সবাই তো পোষ মানাতে পারে না। কিছু অবহেলায় পাখিটা চলে যায় আবার কেউ যত্ন করেও পোষ মানাতে পারে না। ভাগ্য যে কাকে কোথায় নিয়ে যাবে তা কেউই জানে না। বিধাতার লিখন যে কেউ খন্ডাতে পারবে না।
বিন্দুর জীবনে সুখ পাখিটা ডানা ঝাপটে ছিল। ধরা দিয়েছিল বিন্দুর হাতে। কিন্ত যত্নেও পোষ মানাতে ব্যর্থ বিন্দু। যার কারণে তার শাস্তি পেয়েছে সম্পানও।
সম্পানের কিছু প্রহর আনন্দে কেটেছে কিন্ত বাঁকি ঋতুগুলো বোধহয় আনন্দ আর কখনোই আসবে না।
প্রিয়তমা তার সাথে করে সেই সুখটুকুও যে নিয়ে গেছে। তাই সে তার সুখের স্থির দেহের পাশে বসে শেষ দেখা দেখে নিচ্ছে। মুখের অজস্র কাটা ছেড়া তার প্রিয়তমার। তার মধ্যে থেকেই সুখ খুঁজে যাচ্ছে সে। অথচ কত কষ্ট দিয়েই না তার সুখের প্রানটা তার দেহ থেকে বের করে নেওয়া হয়েছে।
রাস্তা দিয়ে দৌড়ে আসছে পরী। গায়ের চাদরটা বৈঠকে পড়ে গেছে আসার সময়। গাঢ় কুয়াশার ভেতর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ফর্সা শরীরে বিন্দু বিন্দু শিশির কণা জমেছে। চুলের খোপা যে কখন খুলে পিঠ ছড়িয়েছে তা সে টেরই পায়নি। পরীর দৌড় থামলো বিন্দুকে দেখে। দূর থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল বিন্দুর মুখখানা। একটু থেমে পরী দৌড়ে গিয়ে ধপ করে সম্পানের পাশে বসে পড়ল।
জঙ্গলের ভেতরে গাছের ডালে বিন্দুর লাশ ঝুলতে দেখা যায়। সকালে ভোরে গ্রামেরই কেউ যাচ্ছিল কালী মন্দিরে। হঠাৎই তার চোখ যায় গাছের ডালে থাকা ঝুলন্ত বিন্দুর দিকে। এই খবর ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না। কেউ কেউ ভেবেছিল যে বিন্দু আত্মহত্যা করেছে। কেননা সবাই জানে বিন্দু সম্পান কে ভালোবাসে। আর বিন্দুর বিয়ে অন্য ছেলের সাথে ঠিক হয়েছে। বিন্দু তাই মানতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। কিন্ত লাশ নামাতে গিয়ে সবাই বুঝলো বিন্দু আত্মহত্যা করেনি। মেয়েটার ক্ষত বিক্ষত শরীর টাই তার আসল প্রমাণ। বিন্দুর পরনের লাল পাড়ের সাদা শাড়িটি দিয়ে গলা পেঁচিয়ে গাছের ডালে ঝুলানো ছিল।
বিন্দুর লাশ জঙ্গলের বাইরে এনে শোয়ানো হয়েছে। শাড়িটিও ওর গায়ে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। একে একে ভিড় জমতে লাগলো।
নিজের প্রান প্রিয় সখির স্থির দেহের দিকে তাকিয়ে আছে পরী। কি সুন্দর মায়াবী চোখ বিন্দুর!!ওই চোখজোড়া খুলে আর দেখবে না পরীকে। দেখবে না ভালোবাসার সম্পান কে। গজদন্তিনী আর হাসবে না। আর সে হাসিতে পরীও মুগ্ধ হবে না। সে আর দৌড়ে জমিদার বাড়িতে উঠবে না। হবে না মায়ের হাতের মার খাওয়া। ঘুম কাতুরে বিন্দু আজ চিরকালের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছে। শত ডাকেও সে সাড়া দিবে না।
পরী আলতো করে বিন্দুকে ঝাঁকিয়ে বলে,’এই বিন্দু তুই ঘুমিয়ে আছিস কেন? ওঠ,এতো ঘুমালে চলে? তুই তো বিয়ে করতে এসেছিস। এই দেখ আমি এসেছি সম্পান মাঝি এসেছে। তোর আর সম্পান মাঝির বিয়ে হবে। ওঠ না,আমার আসতে দেরি হয়েছে বলে রাগ করে ঘুমিয়ে থাকবি? ওঠ,ওঠ না,ওঠ বিন্দু!!’
নাহ বিন্দুর সাড়া নেই। যে মেয়েটা পরীর এক ডাকে দৌড়ে চলে আসে আজ সেই মেয়েটা পরীর শত ডাকেও উঠছে না। পরী বিন্দুর দেহ ধরে ঝাকুনি দিচ্ছে আর উঠতে বলছে। কিন্ত মৃত ব্যক্তি কি কখনো জীবিত হতে পারে? তাই বিন্দুও উঠলো না। পরী এবার বিন্দুকে ছেড়ে দিয়ে সম্পানের দিকে তাকালো বলল,’সম্পান মাঝি,তুমি বললে বিন্দু ঠিক উঠবে। তুমি ওরে উঠতে বলো। তোমরা বিয়ে করবা না? আমার বিন্দুরে ঘরে তুলবা না?’
চোখের পানিতে বক্ষ ভেসে যাচ্ছে পরীর কিন্ত সম্পান এখনও চুপ করে দেখছে বিন্দুকে। হঠাত করেই সম্পান পরীর হাত থেকে সিঁদূর কৌটো নিয়ে নিলো। হাতে কৌটোর সব সিঁদূর ঢেলে রাঙিয়ে দিলো বিন্দুর সিঁথি। ঠোঁটের কোণে স্নিগ্ধময় হাসি ফুটল সম্পানের। সে বলল,’তোরে খুব সুন্দর লাগতাছে বিন্দু। একেবারে বউ। তুই তো চাইছিলি আমার বউ হইতে। আমার হাতের সিঁদূর পরতে। দেখ আমিও সিঁদূর পরাইছি। আয়নায় একবার দেখ কত সুন্দর লাগতাছে তোরে। না থাক, তুই তো ঘুমাইতাছোস। উঠলে দেহিস। অহন ঘুমা তুই।’
-‘সম্পান মাঝি কি বলো এইসব তুমি? বিন্দু,,’
সম্পান পরীর দিকে তাকিয়ে তর্জনী আঙুল মুখে চেপে বলল,’হুসসস বিন্দু ঘুমায় পরী। কথা কইয়ো না। চুপ থাকো চুপ থাকো।’
সম্পান আবার বিন্দুকে দেখায় মন দিলো। পরী থাকতে না পেরে চেপে ধরে সম্পানের কলার। নিজের দিকে সম্পান কে ঘুরিয়ে বলে,’তুমিও কি পাগল হয়ে গেলে সম্পান মাঝি? হ্যা ? বিন্দুর ভালোবাসায় কি পাগল হয়ে গেলে? কথা বলো না? আমার দিকে তাকাও?’
গ্রামের সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটাও আজ সম্পানের চোখ সরাতে পারছে না বিন্দুর থেকে। ভালোবাসা তো এমনই হওয়া উচিত। সৌন্দর্য থাকবে না কিন্ত মাধুর্য থাকবে অপরিসীম। সে ভালোবাসায় মন জুড়াবে। পরী সম্পান কে ছেড়ে আবারো বিন্দুকে ডাকতে লাগল।
নারী পুরুষের ভিড় জমেছে। সবাই পরীকে অবাক হয়ে দেখছে। যে মেয়ের চেহারা কোন পুরুষ দেখেনি আজকে কতশত পুরুষ দেখে নিলো সেই পরীকে। শোক পালনের থেকে এখন সবাই পরীকেই দেখে চলেছে। কিন্ত পরীর সেদিক কোন খেয়াল নেই।
চন্দনা বিন্দুর খবর শুনে বেশ কয়েকবার জ্ঞান হারিয়েছে। পরে সেও এখানে চলে এসেছে। এসেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল চন্দনা। বলতে লাগল,’ও আমার বিন্দু রে,,তুই ক্যান আমাগো ছাইড়া গেলি? এট্টু চাইয়া দ্যাখ,,’
বিলাপ করছে চন্দনা। ইন্দু আর সখা ও দিদির জন্য কাঁদছে। মেয়েকে এমতাবস্থায় দেখে মহেশ ও নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চন্দনার কান্না আর সহ্য হলো না সম্পানের। দুহাতে চেপে ধরে চন্দনার গলা। মাটিতে ফেলে আরো জোরে চেপে ধরে সম্পান। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে চন্দনার। চোখ উল্টে গেল তৎক্ষণাৎ। সম্পান বলতে লাগে,’তোর লাইগা আইজ এই অবস্থা। তোর লাইগা বিন্দু আমারে ছাইড়া চইলা গেছে। আমি তোরে শ্যাষ কইরা ছাড়মু।’
মহেশসহ কয়েক জন মিলে সম্পানকে টানতে লাগল। কিন্ত ছাড়াতে পারছে না। এই মুহূর্তে সম্পানের শক্তির পরিমাণ দ্বিগুণ বেড়েছে। দূর থেকে নাঈম এসব দেখতে পেলো। তাই সে দৌড় দিলো সেদিকে। নাঈম শুনেছে বিন্দুর খবর,এও শুনেছে যে পরীও এখানে এসেছে। তাই সে দেরি না করেই ছুটে এসেছে। সে দৌড়ে কাছে আসতেই কেউ একটা চাদর দিয়ে পরীর মুখসহ পুরো শরীর ঢেকে দিলো। চকিতে তাকালো নাঈম। সেই ব্যক্তিটি আর কেউ না। স্বয়ং মালা। মালা চাদরসুদ্ধ মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে। যাতে কেউ তার মেয়েকে দেখতে না পারে। নাঈম কাছে এসেও পরীকে দেখতে পেলো না। মায়ের সান্নিধ্য পেয়ে পরীও নিজেকে গুটিয়ে নিলো। ঠান্ডা শরীরটা একটু উষ্ণতায় নেতিয়ে গেলো। পরীর কান্নার আওয়াজ বা কথার আওয়াজ ও শোনা গেল না।
কুসুম এসে বলে,’বড় মা,বড় কর্তা আইবো তো। তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলেন।’
মাথা নেড়ে মালা পরীকে গাড়িতে উঠিয়ে বাড়িতে নিয়ে গেলেন।
একটুর জন্য নাঈম পারলো না পরীর মুখ দেখতে। আরেকটু জলদি আসলেই দেখতে পারতো। নিজেকেই নিজে কিছুক্ষণ গালমন্দ করলো সে। এরই মধ্যে আফতাব সেখানে আসে। সবাই রাস্তা করে দেয় আফতাব কে। শায়ের ও সাথে এসেছে। বিন্দুর মৃত্যুর খবর শায়ের কেও ভাবাচ্ছে। মেয়েটাকে এভাবে নৃশংস ভাবে হত্যা করলো কারা?
পুলিশ কে খবর আগেই দেওয়া হয়েছিল। ঘটনাস্থলে তারাও চলে আসে। সবাইকে দূরে সরিয়ে দিলো। সম্পান কে সবাই মিলে ধরে রেখেছে। চন্দনা জ্ঞান হারিয়েছে আবার। তাকে সবাই ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে যায়। পুলিশ সব দেখছে। শায়েরের পরিচিত ই তারা। শায়ের পুলিশ প্রধান কে বলে,’আপনি একটু ভাল করে দেখবেন। আমাদের গ্রামে এমন কখনোই হয়নি। অপরাধি কে বা কারা তাদের তাড়তাড়ি ধরার চেষ্টা করুন।’
-‘আমরা চেষ্টা করব শায়ের সাহেব। তবে এটা বুঝতে পারছি বেশ কয়েকজন যুবক ছিল। নাহলে মেয়েটাকে এভাবে,,’
চোখ বন্ধ করে নিলো শায়ের। কিছু পল ওভাবে থেকে চোখ মেলে বলল,’আমার মনে হয় কালকে যারা যাত্রা দেখতে এসেছিল তাদের কেউই হবে।’
পুলিশ প্রধান একটু ভেবে বলে,’আমার মনে হয়না এরকম সাহস কোন সাধারণ মানুষের হবে। মনে হচ্ছে কোন অপরাধী এরকম করেছে। আমার মনে হচ্ছে,,!’
-‘কি মনে হচ্ছে?’
-‘শশীল নয়তো? ও তো বড় একজন অপরাধী। আপনার মনে আছে চার বছর আগের সেই ঘটনার কথা?’
-‘হ্যা আছে। কিন্ত শশীল তো,,,’
-‘গাঁ ঢাকা দিয়েছে। ওকে ধরার চেষ্টা করছি দুবছর ধরে কিন্ত পারছি না। এমনও তো হতে পারে যে শশীল যাত্রা পালায় আসা মানুষের সাথে মিশে এসব করেছে।’
আফতাব একথা শুনে হুংকার দিয়ে উঠলো। আশেপাশে থাকা সবাই কেঁপে উঠল। আফতাব বলল,’ওই জানো**য়ার টাকে তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করেন। সবার সামনে ওর গলা কেটে শান্ত হবো আমি।’
-‘আমরা এখনো সঠিক বলতে পারছি না। আগে তদন্ত করি তারপর বলা যাবে।’
নারকেল পাতার পাটিতে মুড়িয়ে বিন্দুকে নিয়ে পুলিশ চলে গেল। সম্পান দৌড়ে গিয়ে টেনে ধরেছিল বিন্দুকে। কিন্ত গ্রামের লোকজন তাকে টেনে নিয়ে এসেছে। সম্পান বারবার বলেছে বিন্দুকে যেন না নিয়ে যায় কিন্ত কেউ ওর কথা শোনেনি।
অন্দরের উঠোনে পরী চাদর জড়িয়ে বসে আছে। কাঁপছে ওর সারা শরীর। বিন্দুর মুখটা এখনও ভেসে উঠছে চোখের সামনে। মুখের প্রতিটা ক্ষত কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। পরীর চোখে এখনও তা ভেসে উঠছে। মালা পরীর কাছে এসে বলে,’পরী অহন ঘরে যা।’
পরী মায়ের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠল। মালার হাত দুটো ধরে বলল,’আম্মা আমার বিন্দু!!
ওরা আমার বিন্দুকে মেরে ফেলেছে। আমি কাল রাতে ওই জঙ্গলে গিয়েছিলাম বিন্দু আর সম্পানের বিয়ে দিতে আম্মা। আমি পারি নাই আম্মা। কারা জানি এসেছিল সেখানে। ওরাই মনে হয় আমার বিন্দুকে মেরে ফেলেছে আম্মা। আমি কেন পালিয়ে আসলাম? আর ওই আগুন!!’
আগুনের কথা মনে হতেই পরী থমকে যায়। তখন আগুন লাগলো কীভাবে?? এখন তো শীতকাল। শিশিরে ভিজে ছিল খড় গুলো। হারিকেন ছিটকে পড়লে তো আগুন নিভে যাওয়ার কথা। তার বদলে আগুন জ্বলে উঠল কীভাবে??তার মানে ওই খড় গুলোতে কেরোসিন দেওয়া ছিল। তাই হারিকেন পড়তেই আগুন জ্বলে উঠেছে। এজন্যই পরী তখন কেরোসিনের গন্ধ পাচ্ছিল। তারমানে ওরা বিন্দুকে মারার পর পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিল কিন্ত আগুন লাগার কারণে গাছের সাথে ঝুলিয়ে দিয়ে গিয়েছে। হ্যা তাই হবে। পরী এতক্ষণে সব বুঝতে পারল। উঠে দাঁড়িয়ে আবার পা বাড়ালো বৈঠকের দিকে। মালা এবার শক্ত করে টেনে ধরে পরীকে। বলে,’অনেক হইছে পরী। আর না। তুই আর বাইর হবি না। আমার কসম।’
-‘আম্মা আমাকে আব্বার কাছে যেতে হবে। সব বলতে হবে। বিন্দুকে ওরা পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিল। কাল রাতের সবকিছু আমি জানি। আমি বলব সব। ওদের ধরে কঠোর সাজা না দিলে আমি শান্ত হবো না।’
-‘ওদের শাস্তি হবে। পুলিশ কে খবর দেওয়া হয়েছে। ওনারা ঠিক খুঁজে বের করবে।’
আফতাব কথাগুলো বলতে বলতে অন্দরে ঢুকলো। পরী সেদিকে তাকিয়ে বলল,’কি বলেছে পুলিশ? জানতে পেরেছে কিছু? কারা করেছে খুন?’
উত্তেজিত হয়ে গেছে পরী। আফতাব বলে,’পুলিশ সন্দেহ করছে শশীলের উপর। আগে শশীলকে ধরুক তারপর জানা যাবে।’
পরী সাথে সাথেই চিৎকার করে উঠল। ঘোর বিরোধিতা করে বলল,’নাহ শশীল এই কাজ করতে পারে না। আপনি ওদের মানা করুন। একাজ অন্য কেউ করেছে।’
-‘পুলিশের থেকে বেশি বোঝো তুমি? যাও ঘরে যাও। মেয়ে মানুষ এতো কথা বলো কেনো??’
-‘আপনি বোঝেন না। আপনার কি কোন দায়িত্ব নেই নাকি? কিসের জমিদার আপনি?’
পরীকে রাগারাগি করতে দেখে মালা বলে,’পরী, বাপের লগে খারাপ কথা কওয়ার সাহস পাইলি কই তুই?’
-‘আম্মা উনি বোঝে না কেন শশীল খুন করে নাই।’
মালা রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,’তুই কেমনে জানলি শশীল খুন করে নাই?’
-‘শশীল বেঁচে থাকলে তো খুন করবে আম্মা। দুইবছর আগে আমি নিজ হাতে শশীল কে খুন করছি আম্মা, নিজের হাতে।’
#পরীজান
#পর্ব ২৩
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
নূরনগরের পার্শ্ববর্তী এলাকার বেশ স্বনামধন্য ব্যক্তি সম্রাট মির্জার একমাত্র পুত্র শশীল। একমাত্র সন্তান
হওয়ায় বাবা মায়ের একমাত্র আদরের সে। যখন যা চায় তাই পায়। ছেলের আবদার পুরন করতে করতে কখন যে ছেলেকে বিপথে পাঠিয়ে দিয়েছেন তারা নিজেরাও বুজতে পারেননি। বুঝতে পেরেছে শেষ সময়ে। এখন সম্রাট তার ছেলেকে ঠিক করতেই পারছেন না। বেশ কয়েকবার জেল থেকে টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে এনেছেন। তবুও ছেলের অন্যায় কমাতে পারছে না। নিষিদ্ধ জায়গায় গিয়ে নিষিদ্ধ মেয়েদের সাথে মেলামেশা আর নেশা করতে করতে চরিত্র টাই বখে গেছে।
ওই খারাপ চোখের ললুপ দৃষ্টি পড়ে রুপালির উপর।
রুপালি তখন স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী। ওর সাথে সবসময় একজন রক্ষি থাকতো বিধায় শশীল শুধু লালসার দৃষ্টি দিতো। বারবার চেষ্টা করেও রুপালির ধারে কাছে সে ঘেষতেও পারে না। এতে দিন দিন আরো ক্ষিপ্ত হয় শশীল। সবসময় হিংস্র বাঘের মত ওত পেতে থাকতো। কিন্ত সে তার শিকার কে ঘায়েল করতে পারতো না।
তবে একদিন সে সুযোগ এসেই গেলো। সেদিন ছিল জমিদার বাড়িতে অনুষ্ঠান। অনেক মানুষের আনাগোনা। সন্ধ্যার পর জলসার আয়োজন করা হয়েছিল প্রাঙ্গনে। এরই মধ্যে রুপালির কাছে একটা ছোট বাচ্চা এসে চিঠি ধরিয়ে দিলো। চিঠিতে লেখা ছিলো,”তোমার জন্য বাড়ির পিছনে অপেক্ষা করছি।
সিরাজ,,,”
তখন ওদের দুজনের ভালোবাসা আরো গভীরে চলে গিয়েছিল। খুব বিশ্বাস করতো সিরাজকে। তাই হারিকেনের আবছা আলোয় ওতটুকু পড়েই রুপালি সেখানে চলে গেল। বাড়িতে অনেক মেহমান। ওকে কেউ খুজবে না। সেই সুযোগে রুপালি চলে গেল। কিন্ত সেখানে সিরাজের পরিবর্তে ছিলো শশীল। জমিদার বাড়ির পেছনে খানিকটা জঙ্গল ছিল তখন। তবে এখন তা পরিষ্কার করা হয়েছে।
রুপালির চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে আরেকটু ভেতরে নিয়ে গেল শশীল। চিৎকার করলেও কেউ শুনতে পাবে না। কেননা দেওয়ালের ওপারে শব্দ খুব কমই যায়। তাছাড়া গান বাজনা চলছে এতে আরো শুনতে পাবে না কেউ। তবুও রুপালি চিৎকার করছে। শশীল সম্পর্কে গ্রামের সবাই অবগত। ওর কর্মকান্ড সবাই জানে। রুপালির ভয়ে জ্ঞান হারানোর অবস্থা।
শশীল রুপালিকে মাটিতে ফেলে হাতটা পা দিয়ে চেপে ধরে। ব্যথায় গোঙ্গাতে লাগলো রুপালি। শশীল তার হাতের থাবা রুপালির শরীরে দেওয়ার আগেই সে স্থির হয়ে গেলো। রুপালি খেয়াল করল তরল জাতীয় কিছু শশীলের থেকে নির্গত হয়ে রুপালির গলায় পড়ছে। হাত ভেজালো রুপালি সে তরলে। চন্দ্রের একটুখানি আলো গাছের ফাঁক দিয়ে এসে পড়ছে। রুপালি সেই আলোতে হাতটা এগিয়ে ধরতেই শিউরে ওঠে। ততক্ষণে শশীলের দেহ মাটিতে পড়ে গেছে। রুপালি স্থির দেহের দিকে তাকালো। একটু ও নড়ছে না। তারমানে মারা গেছে শশীল। রুপালি মুখ ঘুরিয়ে তাকালো এবং পরীকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। দা হাতে দাঁড়িয়ে পরী। চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে দা থেকে। শশীলের চোখদুটো এখনো খোলা। পরী দায়ের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে দিয়ে বলে,’রুপালির দিকে নজর দিয়েছিস কিন্ত এই পরীর দিকে তোর মৃত চোখ দুটোও নজর দিতে পারবে না।’
ওড়নার বাঁধন খুলে পরী নিজের মুখটা বের করে। এই মুহূর্তে ভয় পেলো না পরী। নিজের করা প্রথম হত্যা তবুও পরী ভয় পেলো না। দ্রুত রুপালিকে ধরে ওঠায়। রুপালি তখনও কাঁপছে। পরী জিজ্ঞেস করে,’তুমি ঠিক আছো আপা??’
-‘পরী তুই খুন করলি!!’
-‘মরে গেছে!!সত্যি সত্যি!’
একটু অবাক হলো পরী। কারণ সে বাজে ভাবে জখম করতে চেয়েছিল। কিন্ত পরীর ধারণার চাইতে কোপ টা একটু জোরে হয়ে গেছে। রুপালি পরীর হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলে,’কি করলি পরী!!এখন কি হবে?’
-‘তো কি করবো?নাহলে ওই শয়তান টা তোমার সর্বনাশ করতো যে।’
রুপালির ভয় আরো বাড়লো। সে বলল,’সবাই জানলে কি হবে পরী? তোকে পুলিশ ধরবে যে। এটা তুই কি করলি পরী?’
রুপালি কাঁদতে লাগল। শশীলের শরীর দেখে ভয় পেতেও লাগল। এতো জোরেই আঘাত করেছে পরী যে মাথার অর্ধেক কেটে গেছে। রাতের বেলা ঠিক মতো দেখা যাচ্ছে না। দিন হলে রুপালি নির্ঘাত জ্ঞান হারাতো। পরী রুপালির হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। আর বলতে লাগল,’এতো বোকা তুমি কি করে হও? ওই কাগজের লেখাটা সিরাজ ভাই লেখেনি। হাতের লেখা বোঝনি তুমি? আর সিরাজ ভাই এমন লোক না যে তোমাকে ওই জঙ্গলের মধ্যে ডাকবে।’
রুপালি দাঁড়াল, সত্যি তো। সিরাজ তো কখনোই এখানে আসতে বলতো না। হারিকেনের আলোয় হাতের লেখা ঠিক খেয়াল করেনি রুপালি। তাহলে কি শশীল নিজেই চিঠি পাঠিয়েছিল! রুপালি আবার চমকালো বলল,’পরী,শশীল কিভাবে জানলো আমার আর সিরাজের সম্পর্কের কথা? আমি তো সব লুকিয়ে গেছি।’
-‘এখন কথা বলার সময় নয়। আগে ঘরে যাই তারপর সব কথা হবে।’
মেহমান থাকার কারণে ওরা গাছ বেয়ে ছাদে উঠলো। তার পর দুজনেই পরীর ঘরে গেল। আলোতে নিজের শরীরে রক্ত দেখে গা গুলিয়ে এলো রুপালির। পরীর শরীরেও কিছু রক্ত লেগেছে। দুজনে গোসল সেরে জামা কাপড় ধুয়ে দিলো।
কিন্ত আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো পরের দিন সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল। শশীল যে মারা গেছে তা গ্রামের কেউ জানতে পারলো না। শশীলের লাশ কেউ কি দেখেনি? লাশটা তো ওখানেই ফেলে এসেছে ওরা। তাহলে!!!শশীলের পরিবার ও তার খোঁজ করেনি। কারণ কদিন আগে সে একটা মেয়েকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে। সেজন্য পুলিশ তাকে খুঁজছে। শশীলের বাবা ওকে ভারত পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল। বাবার কাছ থেকে বিদায় নিলেও শশীল গ্রামেই পলায়িত ছিল। শশীলের নজর রুপালির দিকে তখনো অটুট। তাই ভারতে যাওয়ার আগে রুপালির উপর শেষ থাবা দিতে চেয়েছিল কিন্ত ও নিজেই শেষ হয়ে গিয়েছে। সম্রাট ভেবেছে হয়তো তার ছেলে ভারতে চলে গেছে।
পরী কিছুতেই বুঝতে পারছে না শশীলের লাশ কোথায়? সেজন্য ওই জঙ্গলে পরী যেতে চাইলে রুপালি আটকে দেয়। বলে,’তুই যাবি না পরী। ভালোই হয়েছে কেউ জানেনা। পুলিশ জানাজানি হলে তোকে ধরে নিয়ে যাবে। একটু চুপ থাক পরী। তুই একজন গ্রামের মেয়ে সেভাবেই পড়ে থাক। এতো গোয়েন্দা গিরি করবি না। দেখ আম্মা কিন্ত তার বড় মেয়েকে হারিয়েছে। এখন আমাদের হারালেন আম্মার কি অবস্থা হবে ভেবেছিস কখনো? এতো সাহসী হওয়া ভালো না পরী।’
বোনের কথায় মনক্ষুণ্য হলো পরীর। মালাকে সে অসম্ভব ভালোবাসে। মালাকে সে আর কষ্ট দিতে চায়না। তাই কিছু ঘেটে দেখতে পারলো না সে। ওই ঘটনা চাপা পড়ে গেল পরী রুপালির মাঝে। আরও কেউ আছে যে লাশ সরিয়েছে। সে কে তাও চাপা পড়ে গেল। পরী এরপর থেকে নিজেকে বদলে ফেললো। একজন গ্রামের মেয়ে তৈরি করলো নিজের মধ্যে।
আজ পরী নিজের পুরোনো সত্ত্বায় ফিরে এসেছে। সেদিন খুন ইচ্ছা করে করেনি পরী। চেয়েছিল সামান্য আঘাত করতে কিন্ত সেটা খুন হয়ে গেল। আজ পরীর সত্যিই খুন করতে ইচ্ছা করছে। বিন্দুকে যারা মেরেছে তাদের আরও নির্মম ভাবে খুন করতে চাইছে পরী।
সিরাজের কথা বাদ দিয়ে পরী শশীল কে খুন করার কাহিনী সবই বলে দিলো। আফতাব মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। আর মালা মুখে হাত চেপে কাঁদতে লাগল। এ কেমন মেয়ে জন্ম দিয়েছেন তারা যে মানুষ মারতেও দ্বিধা বোধ করে না। আর পাঁচকান হলে তো বিপদ। রুপালি নিজ কক্ষের দরজায় বসে সব শুনেছে। সেও কাঁদছে। পরীকে বারণ করা সত্ত্বেও সে বলে দিয়েছে। শুধু কুসুম ই ছিল সেখানে উপস্থিত। পরী খুন করেছে শুনে সেও ঘাবড়ে গেছে। এতো সুন্দর কোমল মেয়েটা যে মানুষ খুন করতে পারে তা জানা ছিল না কুসুমের। সে ভয়ে চুপ করে আছে।
আফতাব বলে উঠল,’এই কথা যেন আর কেউ না জানতে পারে। আর পরী তোমার এখন থেকে ঘর থেকে বের হওয়াও বন্ধ। তোমার সবকিছুই ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। মালা নিজের মেয়েকে তুমি সামলাও নাহলে খারাপ হয়ে যাবে কিন্ত।’
পরী চেঁচিয়ে উঠলো,’নাহ আমি ঘরে থাকবো না। আমার বিন্দুকে কে মেরেছে তা আমাকে জানতে হবে।’
-‘জেনে কি করবে তুমি? আবার খুন করবে? তারপর কি হবে জানো? বাইরের জগত ঘরে বসে দেখা যায় না। আমার সম্মান নষ্ট করবে না। মালা মেয়েকে কাছে রাখতে চাইলে আটকে রাখো।’
আফতাব অন্দর থেকে বেরিয়ে গেল। পরী আরো চেঁচিয়ে বলতে লাগল সে ঘরবন্দি হবে না। বিন্দুর খুনিকে সে নিজে খুজবে। মালা পরীর হাত ধরে দোতলার ঘরে নিয়ে যেতে লাগল। পরী বলল,’আম্মা হাত ছাড়েন আমার। আমার বিন্দুকে ওরা মেরে ফেলছে আমি ওদের শাস্তি দেবো।’
-‘তার লাইগা পুলিশ আছে। তারা খুজবো। তুই ঘরেই থাকবি।’
পরীকে আর বলতে না দিয়ে ওকে ঘরে আটকে রাখেন মালা। পরী মেঝেতে বসেই কাঁদতে লাগল। সাথে বিন্দুর সাথে কাটানোর মুহূর্ত মনে করলো। কতই না আনন্দের ছিল সময়টা আর আজ! সেই বিন্দুটাই নেই। এই ক্ষতটা পরীর সারাজীবন থাকবে।
এরই মধ্যে পরীর জন্য অনেক গুলো সম্বন্ধ এসে পড়েছে। কোথায় শোক কোথায় কি? পরীর বিয়ের আলোচনা চলছে এখন। আফতাব এখন নিজেও চায় এই মেয়ে বিদায় হোক। এই মেয়ে ঘরে থাকলে ওনাকে নির্ঘাত থানা পুলিশ দৌড়াতে হবে। সম্মান নিয়ে টানাটানি হবে। এর চেয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়াই হবে উত্তম কাজ।
এসব ঘটনা দেখে নাঈম নিজেই চমকে গেছে। একটু আগে কত কিছু ঘটে গেল। ঘরের বাইরে শোক পালন করে এসে ঘরের ভেতরে বিয়ের আলাপ করছে। সত্যিই এই জমিদার বাড়ি আর লোকজন অদ্ভুত। তবে গ্রামের মানুষ এরকমই হয়ে থাকে।
নাঈমের সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে পরীকে দেখতে না পারার কারণে। রাতে সে যা ভেবেছিল তার উল্টো হয়েছে। রুপালির প্রসব বেদনার কারণেই নাঈম ভেতরে ঢুকতে পারেনি। তখন অনেক মানুষ ছিল। নাঈম ধরা পড়ে যেতো। তবুও হাল সে ছাড়েনি। জেগেছিলো সারারাত যদি একটু সুযোগ সে পায়। তাও পায়নি নাঈম। তাই গাঢ় ঘুমে বিভর ছিল সকালে। যখন ঘুম ভাঙলো সব শুনে দৌড়ে গেল। কিন্ত ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। পরীকে সে দেখতে পারলো না।
নিজের ঘরে নাঈম মনমরা হয়ে বসে আছে। নিজের প্রতি নিজেই সে বিরক্ত। তখনই আসিফ এসে ঘরে ঢুকলো। নাঈম কে উদ্দেশ্য করে বলল,’নাঈম তুইও কি পরীকে দেখেছিস আজকে??’
নাঈম নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। আসিফের কন্ঠস্বর শুনে চমকে তাকালো বলল,’নাহ,কেন বলতো?তোরা কি দেখেছিস?’
আসিফ ভীত কন্ঠে বলল,’আমি দেখিনি তবে শেখর দেখেছে।’
নাঈম চট করে দাঁড়িয়ে গেল বলল,’তুই আর শেখর তো একসাথে যাত্রা দেখতে গিয়েছিলি।’
-‘হ্যা গিয়েছিলাম। কিন্ত শেষ প্রহরে শেখর শায়েরের সাথে চলে এসেছিল আমি আসিনি। যাত্রা দেখতে দেখতে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’
নাঈম কিছু বলল না। আসিফ একটু চুপ থেকে বলে উঠল,’পরীর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে নাঈম।
-‘জানি,সেতো আরো আগে ঠিক হয়েছে।’
-‘নাহ নাঈম এই মাত্র ঠিক হলো। জানতে চাইবি না কার সাথে পরীর বিয়ে?’
-‘কার সাথে?’
-‘শেখরের সাথে। সব ঠিকঠাক করে ফেলেছে শেখর। সামনের মাসে বিয়ে ঠিক করা হয়েছে।’
নাঈমের মনে হলো কেউ তাকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলো। ক্ষত না হলেও ব্যথা অনুভব করছে নাঈম। সব জেনে শেখর এটা কিভাবে করতে পারলো? নাঈম ঘর থেকে বের হতে নিলে আসিফ বলে,’গিয়ে লাভ নেই। শেখর শহরে চলে গিয়েছে। সে আমাদের সাথে আর সম্পর্ক রাখবে না।’
নাঈম এবার বেশ রেগে গেল। সে বাইরে বের হতে হতে বলল,’ওর সাথে শেষ কথা তো আমাকে বলতেই হবে।’
#পরীজান
#পর্ব ২৪
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
কোলাহল পূর্ণ শহরের রাস্তায় যানবাহনের আনাগোনা। গাড়ির হর্ণে কান তব্দা দেয়। ফুটপাত জুড়ে রয়েছে ছোটখাট দোকান। মানুষের ভিড়ে চলাফেরা করা মুশকিল। গ্রামে শীতকাল চললেও শহরে শীতের ছিটেফোটাও নেই। এ যেন চৈত্র মাস। লোকজনের মাঝে শীত নিজেই ঢুকতে পারছে না। কথাটা বেশ হাস্যকর মনে হলেও এটাই বাস্তব।
নাঈম রিকশায় বসে আছে। জ্যামে আটকে গেছে সে। আটকেছে গিয়ে একেবারে সূর্যের নিচে। গাছের ছায়া ও নেই সেখানে। তপ্ত গরমে ঘেমে একাকার সে। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। লাল বর্ণ ধারণ করেছে ফর্সা মুখখানা। পকেট থেকে রুমালটা বের করে ঘাম মুছে নিলো সে। জ্যাম ছাড়তেই রিকশা চলতে লাগল। শেখরের বাসার সামনে নামলো নাঈম। ভাড়া মিটিয়ে এগিয়ে গেল সে। চারতলা বিল্ডিং এর দোতলায় থাকে শেখর। কলিং বেল চাপতেই শেখরের ছোট বোন এসে দরজা খোলে। নাঈম কে দেখে সে খুব খুশির হলো। ভাইয়ের বন্ধু হিসেবেই অত্যন্ত ভালো জানে সে নাঈম কে। নাঈম সৌজন্য মূলক হাসি দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। তারপর সোজা শেখরের ঘরে চলে গেল। শেখর কে কিছু বলতে না দিয়েই বলল,’কি রে আমাকে না জানিয়ে চলে এলি?আমাকে বললে আমিও তো আসতাম।’
শেখর সোজা হয়ে দাঁড়াল বলল,’কাজ ছিলো।’
-‘কাজ তো থাকবেই বিয়ে বলে কথা। আমাকে একবার জানালি না। আর তুই নাকি আমাদের সাথে সম্পর্ক রাখবি না।’
-‘আরে আসিফ আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছিলো তাই ওসব বলেছি।’
-‘আসিফ তোর মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল না। সত্যি কথা বলতেছিল। এমনটা করার কারণ কি শেখর? তুই সব জেনেও এমন সিদ্ধান্ত কীভাবে নিলি?’
-‘শোন,তুই কিন্ত পরীকে দেখিসনি। আমি দেখেছি। আমি বললে ভুল হবে আরো অনেকেই দেখেছে।’
-‘এক দেখাতে মোহ সৃষ্টি হয় শেখর। তুই তোর পরীকে ভালোবাসিস না। আর জানিসই তো আমি পরীকে,,’
নাঈম কে থামিয়ে শেখর বলল,’তুই তোর দেখিসনি তাহলে তুই কিভাবে ভালোবাসিস বল? আমি দেখে ভালোবাসতে না পারলে তুইও পারিসনি নাঈম। হ্যা মানছি আমি পরীর সৌন্দর্যে মোহিত হয়েছি তাহলে তো তুইও হয়েছিস। দেখিসনি পরীকে কিন্ত মুখের কথা শুনেই তোর এই অবস্থা আর আমার দেখে কি অবস্থা হয়েছে ভাবতে পারছিস?’
ঘৃণায় চোখ ফিরিয়ে নিলো নাঈম। ছিঃ!!এতোটা জঘন্য মনের মানুষ শেখর তা আজ জানলো নাঈম। শেখরের দৃষ্টিভঙ্গি এতোটা কুৎসিত!!ওর মতো ছেলে পরীকে পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
-‘তোর দৃষ্টি যে এতো নোংরা তা আমার জানা ছিল না
শেখর। ওই মেয়েটার দিকে ভালোবেসে তাকানোর বদলে ললুপ দৃষ্টি দিচ্ছিস?’
-‘আমি খারাপ নজরে দেখিনি পরীকে। তুই যদি তখন একবার পরীর স্নিগ্ধ মুখশ্রি দেখতে তাহলে তুইও এক দেখায় আবার নতুন করে মেয়েটির প্রেমে পড়তি। বিশ্বাস কর আমি খারাপ চোখে দেখিনি। আমি কেন কোন পুরুষ ই বিকৃত নজরে দেখার কথা ভাবতেও পারবে না। মোহে আটকে গেলেও একদিন ঠিকই ভালোবেসে আগলে রাখব।’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নাঈম বলে,’আমি মানতে পারছি না শেখর। বন্ধু হয়ে এইভাবে বেঈমানি করে ঠিক করলি না।’
-‘নিজের পছন্দ কে পাওয়াটা বেঈমানি নয়।’
নাঈম আর কথা বলল না। চলে যেতে উদ্যত হয়েও ফিরে তাকালো। শেখর কে উদ্দেশ্য করে বলল,’যদি কোনদিন শুনি পরী তোর কাছে ভালো নেই সেদিন তোকে খুন করতেও আমি পিছপা হবো না।’
——-
শশ্মানে কাঠ পোড়ার ধোঁয়া উঠছে এখনো। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে বিন্দুর চিতায়। দূরে মাটিতে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সম্পান। নাহ আজ তার চোখে এক ফোটা জল নেই। সব শুকিয়ে গেছে। বিন্দুর কথাগুলো মনে পড়ছে খুব। বিন্দু তো বলেছিল সে সম্পান কে ভুলবে না। তাহলে আজ কেন ওকে ভুলে রেখে গেল? সম্পান কেও তো সাথে নিয়ে যেতে পারতো? হঠাৎই সম্পান শুনলো বিন্দু আগুনের ভেতর থেকেই যেন বলছে,’তোমার নামের সিঁদুর ছাড়া অন্য নামের সিঁদুর আমার মাথায় পড়ার আগেই যেন আমার মরণ হয়। আমি তোমার বউ হমু মাঝি।’
সম্পান তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়াল। ‘বিন্দু’ বলে দৌড়ে এগিয়ে গেলো আগুনের দিকে। কিন্ত তার আগেই কয়েকজন লোকেরা টেনে ধরে সম্পান কে। চেতনা হারিয়ে সম্পান ঝাপ দিতেও পারে ওই আগুনে। সম্পান চিৎকার করে বলতে লাগল,’আমি তোরে সিঁদুর পরাইছি বিন্দু। তাও আমারে রাইখা যাইস না। তোরে ছাড়া আমি ভালো থাকমু না বিন্দু।’
মহেশ সম্পানের পাগলামো দেখতেছে আর চোখের পানি ফেলছে। এখন মহেশের মনে হচ্ছে সম্পানের সাথেই বিন্দু ভালো থাকতো। ছেলেটা সত্যিই বড্ড বেশি ভালোবাসে তার মেয়েকে। কিন্ত এখন এসব বলে কি লাভ?? সেই বিন্দুটাই তো নেই। মহেশের এখন মনে হচ্ছে এই পরিস্থিতির জন্য একমাত্র দায়ী চন্দনা। চন্দনা যদি রাজি হতো সম্পানের সাথে বিন্দুকে বিয়ে দিতে তাহলে এসব হতো না। আদরের মেয়ে বিন্দুর এমন পরিণতি হতো না।
বিন্দুর শেষকৃত্য সম্পন্ন হতেই সবাই চলে গেল। সম্পান হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে কিছুটা ছাই হাতে নিলো। পানি দিয়ে আগুনের আভা কমানো হলেও এখনও ছাই বেশ গরম। তবে প্রেমিক পুরুষ সম্পানের হাত তা সয়ে নিলো। ছাই নিয়ে সে ছুটলো। গন্তব্য কোথায় তা সে নিজেও জানে না।
——
জমিদার বাড়িতে আজ যেনো ছোটখাটো অনুষ্ঠান। অন্দরের উঠোনের খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে বসে আছে তিনজন মধ্যেবয়স্ক নারী। তারা তাদের ব্যাগ থেকে নানা ধরনের শাড়ি বের করছে। আবেরজান আর শেফালি একটা একটা করে পরীর গায়ে ধরে দেখছে। কোনটাতে পরীকে বেশি মানাচ্ছে। সবগুলো রঙেই পরীকে সুন্দর লাগছে। পরী নির্জীব হয়ে বসে আছে। রঙহীন হয়ে আছে মুখখানা। বিন্দু চলে গেছে আজ সাতদিন পার হয়ে গেছে অথচ কোন খবর পরী পায়নি। কে মারলো বিন্দুকে তাও জানেনি কেউ। পরী রোজ কুসুম কে দিয়ে খবর নেয়। সেদিনের পর থেকেই পরী ঘরবন্দি। আজকেই তাকে বাইরে আনা হয়েছে। আর আজকেই পরী জানতে পারলো যে শেখরের সাথে তার সামনের মাসে বিয়ে। অন্য কোন সময় হলে পরী হয়তো কিছু বলতো কিন্ত আজ তার কিছুই ভালো লাগছে না। প্রাণহীন মনে হচ্ছে নিজেকে। পরীকে নিশ্চুপ বসে থাকতে দেখে আবেরজান বলল,’এই,এমনে চুপ থাকলে হইবো?চোখ ঘুরাইয়া দেখ কোনডা পছন্দ হয়?’
বিরক্ত হলো পরী বলল,’তুমিই দেখো দাদি।’
-‘কাপড় পইরা তো আমি জামাইর কাছে খারামু না তুই?দেখ।’
পরী এবার বেশ চটে গেল। মোড়া থেকে দাঁড়িয়ে বলল,’তুমিই দেখো বুড়ি। একটা কাপড় পরে দাঁড়াও আমি তোমাকে আকাশে ছুড়ে মারি। নিজের জামাইকে তখন দেখাইও।’
-‘তোর আর কইতে হইবো না। তোর মতো বয়সে কতো দেখাইছি।’
-‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তবে আমাকে এর মধ্যে টানবে না বুড়ি।’
পরী নিজের ঘরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর রুপালি কুসুম কে দিয়ে কয়েকটা শাড়ি পাঠালো পরীর ঘরে। পরী তখন পড়ার টেবিলে বসে সোনালীর খাতাটা নেড়ে দেখছিল। কুসুম আস্তে করে পরীর পাশে দাঁড়িয়ে বলে,’আমার অনেক কষ্ট হইতাছে বিন্দুর লাইগা আপা। আপনেও কষ্ট পাইতাছেন জানি। কিন্ত এখন আপনার বিয়া না দিলেও পারতো। আপনার মনডা তো ভালা নাই। আপনে চইলা গেলে আমি আর জুম্মান থাকমু কেমনে আপা?’
পরী কুসুমের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ জোড়া জলে ভরা। তবুও পরী ঠোঁটে হাসির রেশ ধরে বলে,’আমার রুপা আপা আর তার ছেলেকে দেখে রাখিস কুসুম। ওদের দায়িত্ব আমি তোকে দিয়ে গেলাম। যেকোন বিপদে তুই ওদের পাশে থাকবি।’
-‘কথা দিলাম আপনেরে আমি হ্যাগো পাশে থাকমু।’
পরী হাসলো। কুসুম ওকে অনেক বিশ্বাস করে। পরী জানে কুসুম তার কথার খেলাপ করবে না। এতে ওর প্রাণ সংকটে হলেও না।
আজ রাতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল শায়েরের। সামনের মাসে পরীর বিয়ে। জমিদার বাড়ির মেয়ের বিয়ে বলে কথা। এখন থেকেই টুকটাক কাজ সারতে হবে। সেজন্য শায়ের শহরে গিয়েছিল। আসতে আসতে তাই অনেক রাত হয়ে গেছে। বৈঠকে গিয়ে আগে কলপাড় থেকে হাতমুখ ধুয়ে নিলো। তারপর নিজের ঘরে গেল। হারিকেনের আচ কমানো ছিল। সেটা বাড়িয়ে দিয়ে পেছন ফিরতেই দুকদম পিছিয়ে গেল শায়ের। সামনের জলচৌকিতে কেউ বসে আছে। সেটা যে পরী তা শায়েরের বুঝতে বেগ পেতে হলো না। নেকাবের আড়ালে থেকেই পরী বলল,’ভয় পেলেন নাকি?’
-‘এতো রাতে আপনি আমার ঘরে কেন এসেছেন?’
পরী শান্ত গলায় জবাব দিলো,’বিন্দুকে কারা মেরেছে?’
-‘আমি এখনো জানতে পারিনি। তবে পুলিশ তদন্ত,,,’
বাকিটুকু শায়ের বলতে পারলো না। পরী মৃদু চিৎকার করে বলে,’কথা ঘোরাবেন না। আমি জানি আপনি সব জানেন।’
#চলবে,,,,,