পরীজান পর্ব -২০+২১

#পরীজান
#পর্ব ২০
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে শীত বাড়তে থাকে। এসময়ে কুয়াশাচ্ছন্ন হয় চারিদিক। দূর থেকে কুয়াশার ভেতর থেকে মানুষ বের হয়ে আসতে দেখা যায়। কোন সাদা পর্দা মনে হয় এ কুয়াশাকে। অদৃশ্য সে পর্দা ভেদ করে মানুষের চলাফেরা। সবার গায়ে থাকে শীত নিয়ন্ত্রণ বস্ত্র। তবুও যেন শীত মানতে চায় না। ঠকঠক করে কাঁপে বৃদ্ধরা। ঊষার আলো ফুটতেই উঠোনে জটলা বাধে সবাই। মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে আরাম করে।
ঘাসে জমে থাকা কোমল শিশির বিন্দুর অপরূপ সৌন্দর্য যেন আরো মোহনীয় করে তোলে শীতকালকে। মানুষের পদচরণে ভাঙে সে শিশিরের ঘর। মাকড়সার জালে জমে থাকা শিশির দেখে মনে হয় এ যেন সচ্ছ কাচের তৈরি ঘর। কারিগর যেন খুব যত্নে তৈরি করেছে। আঙুল দিয়ে টোকা দিতেই ঝরঝর করে শিশির ঝরে পড়লো। জালের উপর থাকা মাকড়সাটা দৌড়ে চলে গেল। বিন্দু খিলখিল করে হেসে উঠল তা দেখে। এই কাজটা করতে ওর ভিশন ভালো লাগে। এজন্য সে শীত কালের অপেক্ষায় থাকে।
-‘কি গো কারিগর পলাইলা ক্যান? ঘর বানাইবা শক্ত কইরা যাতে কেউ ভাঙতে না পারে। আর তোমারেও পলাইতে না হয়। ঘর বানাও তুমি থাকো তুমি আবার ডর পাও তুমি। এমন হইলে চলবো না।’
আবার উচ্চস্বরে হেসে ওঠে বিন্দু। ওর হাসিতে মুখরিত হয় এই কুয়াশাময় সকাল। খেজুর গাছের উপর থেকে মহেশ মেয়ের হাসির শব্দ শুনে হাঁক ছাড়ে,’কি রে মা কার লগে কথা কইয়া হাসোস??’

রসের হাড়িটা শক্ত হাতে ধরে বাবার পানে চেয়ে বিন্দু বলে,’কিছু না,তুমি নামো তাড়াতাড়ি।’
মহেশ ধীর গতিতে নেমে পড়ল। বাবার হাত থেকে আরেকটা হাঁড়ি সে হাতে নিলো। লম্বা বাঁশের দুই প্রান্তে ছয়টা করে মোট বারোটা রস ভর্তি হাঁড়ি বাধা আর বিন্দুর দুই হাতে দুটো। মহেশ বাঁশটা কাঁধে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিলো। বিন্দু চললো বাবার পিছু পিছু। শীতকালে মাছ ধরে না মহেশ কারণ তখন পানি শুকিয়ে যায়। পদ্মায় জাল ফেলে তখন মাছ পাওয়া দুষ্কর। খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে সে। আর চন্দনা বাড়ির আঙ্গিনায় সবজি চাষ করে। তা দিয়েই চলে সংসার।
এখনও সূর্যের আলো দেখা দেয়নি। এই সময়ে রোজ
মহেশ আর বিন্দু বের হয় রস আনতে। বাবার সাথে যেতে বিন্দুর বেশ লাগে। মহেশ আর বিন্দুর আগমনে দৌড়ে যায় সখা। রসের হাঁড়ি হাতে নিয়ে খুশিতে গদগদ করে মায়ের কাছে গেল। চন্দনা বড় পাতিল চাপিয়েছে মাটির চুলায়। ইন্দু উনুন ধরাচ্ছে। চন্দনা এক হাঁড়ি রস বিন্দুর হাতে দিয়ে জমিদার বাড়িতে দিয়ে আসতে বলে। বিন্দুও সাথে সাথে ছুটলো। মেয়ের যাওয়ার পানে দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চন্দনা।
মেয়েটার মাথা থেকে যে সম্পানের ভুত নেমেছে তাতেই সন্তুষ্ট সে। নাহলে রক্ষে ছিল না। গাঁয়ের মানুষ যে ছিঃ ছিঃ করতো। বাপের নাই খবর,না জানি কোন অকাম করে বাচ্চা জন্ম দিয়েছে!!ভালোই হয়েছে বিন্দু বুঝতে পেরেছে।
চন্দনা মহেশকে ডেকে বলে,’হ্যাগো শুনছো,পশ্চিম পাড়া থাইকা বিন্দুর লাইগা একখান সম্বন্ধ আইছে। পোলা খুব ভালা। শহরে কাম করে। ফুলি বু আইয়া কইলো। আমি কিছুই কই নাই। তুমি এট্টু খোঁজ নিয়া দেহো। ভালো হইলে আগামু।’
মহেশ মাথা নেড়ে বলে,’দেখমুনে,পোলা যদি ভালা হয় তাইলে আমি আপত্তি করমু না। আমার বড় মাইয়া ভালো থাক এইডাই চাই আমি।’
স্বামীর কথায় যারপরনাই আনন্দিত হলো চন্দনা। মেয়েটাকে ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পারলেই খুশি সে। দিন দিন গায়ের রঙ আরো চাপা হচ্ছে বিন্দুর। হবেই না বা কেন??সারাদিন রোদে টোকলা সেধে বেড়ালে এমন তো হবেই। নাহলে মেয়েটা আরেকটু ফর্সা হতো বলে মনে করে চন্দনা।
শহর থেকে গ্রামের ফেরার পথটার দিকে তাকিয়ে আছে বিন্দু। সে রোজ এখানে এসে দাঁড়ায়। ওর সম্পানের জন্য। কিন্ত সম্পান মাঝির দেখা মেলে না। সেই যে গেছে আর আসেনি। বিন্দু তাকে জানাতে পারেনি যে তার মা সব জেনে গেছে। সেদিন পরীর কথামতো কাজ করেছিল বিন্দু। চন্দনা প্রথমে বিশ্বাস না করলেও বিন্দুর হাবভাবে বুঝেছে। তার মেয়ে
সম্পান কে ভুলে গেছে। কিন্ত বিন্দুর মনে সম্পানের জন্য এখনও আগের মতো ভালোবাসা আছে তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি চন্দনা।
বিন্দু প্রতিদিন অপেক্ষা করে কবে আসবে তার মাঝি?কবে লাল রঙে রঙিন করবে তার সিঁথি?মন যে আর মানছে না। বিরহের দহনে পুড়ছে মন,ঝলসে যাচ্ছে সারা অঙ্গখানি। কবে তার প্রিয়তমের হাতের ছোঁয়ায় ঠান্ডা করবে মন?যন্ত্রণায় সে যে ছটফট করছে। অশান্ত মনকে মিথ্যা শান্তনা দিতে দিতে বিন্দু এগিয়ে চলল জমিদার বাড়ির দিকে।

জমিদার বাড়িতে লোকজনের সমাগম সবসময়ই থাকে। আজকে এর বিচার তো কালকে ওর বিচার। কাজ নিয়ে সবসময় দরবার হতেই থাকে। পাহারা তো আছেই। শামসুদ্দিনের উপর পাল্টা হামলা করা আর হয়নি। পুলিশ কেস হয়ে গিয়েছিল। পুলিশ দুই পক্ষকে কঠিন হুশিয়ার করে গিয়েছে। এরপর কোন সংঘর্ষ হলে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে বাধ্য হবে। এ কথায় দুই পক্ষ দমে যায়। তবে সুযোগ পেলে কেউ কাউকে ছাড় দেবে না।
সপ্তবর্ণে রক্ষিদের পাশ কাটিয়ে অন্দরে ঢুকল বিন্দু। উঠোনের এক কোণে একটু রোদ এসে পড়েছে। মালা সেখানে বসে রোদ পোহাচ্ছে। শরীর টা তেমন ভালো নেই। তাই রান্না করতে যাননি। জেসমিন আর বাকিরা সব দেখছে। বিন্দু মালার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,’জেডি তোমাগো রস।’
-‘রান্ধাঘরে দিয়া ছাদে যা তো। পরী আছে, ওরে ডাইকা নিয়া আয়। রস খাইবোনে।’
বিন্দু তাই করলো। এই সকাল বেলা পরী ছাদে কি করে তা ভাবতে ভাবতে ছাদে উঠলো বিন্দু। পরী বেলিফুল ছিঁড়ে চুলে গাঁথছিল। বেলিফুল তার ভিশন প্রিয়। মন মাতানো তার সুবাস। এই সুবাস নিতে সে ছাদে আসে। মাটির টবে অনেক গুলো বেলিফুল গাছ লাগিয়ে ছিল পরী। ফুলে ভরে গেছে ছাদ। বিন্দু পরীর কাছে গিয়ে বলে,’এই সক্কাল বেলা ছাদে আইছোস ক্যান পরী?’
বিন্দুর দিকে তাকিয়ে একগাল হাসলো পরী। কানে দুটো ফুল গুঁজে বলল,’দেখতো কেমন লাগছে?’

-‘তুই তো এমনেই সুন্দর। তোর গায়ে আছে বইলা ফুল গুলা সুন্দর লাগতাছে। কিন্ত ওই গাছের ফুল গুলা সুন্দর লাগতেছে না।’
পরী শব্দ করেই হাসলো। বিন্দুর মুখে পরী সবসময় নিজের প্রশংসা পায়। পরী বিন্দুর কানে দুটো ফুল গুঁজে দিয়ে বলে,’তোকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে।’

-‘ইশশ আমি তো কালো।’
-‘আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর নারী তুই। তুই সুন্দর বলেই সম্পান মাঝির ভালোবাসা পেয়েছিস। আর আমি এখনো পাইনি।’
সম্পানের নাম শুনে বিন্দুর মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। গোমড়া মুখে বলল,’মাঝি তো এহনও আইলো না পরী।’
পরী বিন্দুর চিবুক স্পর্শ করে বলে,’চিন্তা করিস না এসে পড়বে। চল রস খাই।’
বিন্দু প্রতিদিন জমিদার বাড়িতে রস দিতে আসে। কারণ জুম্মান আর পরী সকাল বেলা ঠান্ডা রস খেতে খুব ভালোবাসে।
দুটো গ্লাসে রস নিয়ে বসে আছে মালা। পরী দৌড়ে এসে বসে। কোথা থেকে জুম্মান ও চলে আসে। নিজের গ্লাসটা হাতে নিয়ে পরীকে বলে,’আপা চলো দেখি কে আগে সব রস শেষ করতে পারে?’
-‘আচ্ছা দেখি।’
দুজনে একসাথে গ্লাসে চুমুক দিলো। একটু খেয়ে দুজনেই কাশতে লাগল। এতো ঠান্ডা রস কি তাড়াতাড়ি খাওয়া যায়? মালা ধমক দিয়ে বলে, ‘আস্তে খা। নাইলে খাইতে দিমু না আর।’
সাথে সাথে চুপ হয়ে গেল দুজনেই। আস্তে আস্তে রস পান করলো দুজনে।

দুদিন পর সম্পান বাড়ি ফিরলো। এবার আসার সময় বিন্দুর জন্য আরেকটা শাড়ি এনেছে। সাথে কিছু চুড়ি ফিতা। বিন্দুর কানে খবর যেতেই সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। তার মাঝি এসেছে। এবার তাহলে ওকে এখান থেকে নিয়ে যাবে। বিন্দুর খুশি লাগছে অনেক। বাড়ি থেকে বের হওয়ার বাহানা খুঁজছে সে। সম্পান কে একটু চোখের দেখা দেখবে। কিন্ত চন্দনা এটা ওটা বলে আটকে দিচ্ছে বিন্দুকে। তখনই ফুলি এলো চন্দনার কাছে। এসেই বলল, ‘কিগো তাড়াতাড়ি করো। ওরা আইলো বইলা। মহেশ কই?’
অতঃপর তিনি বিন্দুর দিকে তাকিয়ে বলে,’আরে তুই এইহানে খারাইয়া আছোস ক্যান? ভালো একখান কাপড় পর।’
বিন্দু আগা গোড়া কিছুই বুঝতাছে না। কে আসবে? আর ওর মা কেন এতো আয়োজন করছে?বিন্দু কিছু বলার আগেই মহেশ মিষ্টি নিয়ে এসে চন্দনার হাতে দিলো। চন্দনা বিন্দুকে নতুন কাপড় পরতে পাঠালো। মনে সংশয় নিয়ে নতুন কাপড় পরলো বিন্দু। চন্দনার কাছে কিছু জিজ্ঞেস করলেই ধমক দিচ্ছেন। ইন্দু নিজের বোনকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো। চুল বেঁধে চোখে কাজল পরিয়ে দিলো। বিন্দু চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
পাত্র পক্ষ এসে পড়েছে। তাদের খাবার এগিয়ে দিচ্ছেন চন্দনা আর ফুলি। সাথে মহেশ ও আছে। মহেশ খবর নিয়েছে ছেলের। খুবই ভাল ছেলে। তার মেয়ে সুখেই থাকবে সেখানে। তাই সে ও রাজি।
বিন্দুকে দেখে সবাই পছন্দ করে। তা শুনে চন্দনার খুশি দেখে কে!!বিয়ের দিনও ঠিক হয়ে গেল। এখন পৌষ মাস চলছে। পৌষ মাসে বিয়ে হওয়া অমঙ্গল। তাই মাঘ মাসের শুরুতে বিয়ে ঠিক হয়। কেউ গিয়ে বিন্দুকে জিজ্ঞেস করেও না যে সে রাজি কি না। সে অন্য কাউকে ভালোবাসে কি না?সবাই তাদের মতামত দিচ্ছে। বিন্দু আর অপেক্ষা করলো না। পাত্র পক্ষ চলে যেতেই সে ছুট লাগালো।

হলুদ শর্ষে ক্ষেতের পাশ দিয়ে দৌড়ানো রমণীর চক্ষুযুগল ভেজা। কাজল লেপ্টে গেছে চোখের জলে। শাড়ির আঁচল শর্ষে ক্ষেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কোন দিকে তাকাচ্ছে না সে শ্যামবতী। সে দৌঁড় থামালো সম্পানের বাড়িতে গিয়ে। রাঁখিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল বিন্দু। আচমকা বিন্দুর কাজে ভড়কে গেল রাঁখি। সম্পান ঘুমিয়ে ছিল। বিন্দুর কান্না ওর ঘুম ভাঙালো। উঠে এলো সে। বিন্দু রাঁখিকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল,’আমারে তোমার পোলার বউ বানাও গো জেডি। নাইলে এই বিন্দু মইরা যাইবো। ওরা আমার চিতা সাজাইতাছে যে।’

সম্পান টেনে তুললো বিন্দুকে। ইশশ চোখের পানি তে কাজল ধুয়ে গালে লেগে আছে। চোখদুটো ফুলে গেছে। সারা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে এসেছে। সম্পান বিন্দুর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,’কি হইছে বিন্দু? আমারে ‘ক’?’
ফোঁপাতে ফোঁপাতে বিন্দু বলল,’মায় আমার বিয়া ঠিক করছে মাঝি। আমি ওই পোলারে বিয়া করমু না। আমি তো তোমার ঘরের বউ হইতে চাই মাঝি। ওরা ক্যান বোঝে না?’
বিন্দু ঝাপিয়ে পড়ল ওর প্রিয়তম মাঝির বুকে। আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরে সম্পান কে। তড়িৎ গতিতে সবকিছু হওয়াতে সম্পান ভড়কে গেল। বিন্দু সম্পান কে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,’তোমারে ভোলার আগে আমি নিজেরেই ভুলমু। আমার শরীর নিস্তব্ধ হইবো,চোখের পাতা বন্ধ হইবো,হাত পা ঠান্ডা হইবো,নিঃশ্বাস শ্যাষ হইবো তাও তোমারে আমি ভুলমু না। আমি থাকতে পারমু না মাঝি। তোমার নামের সিঁদুর ছাড়া অন্য নামের সিঁদুর আমার মাথায় পড়ার আগেই যেন আমার মরণ হয়।’

-‘বিন্দু কস কি এইয়া? চুপ থাক,তুই আমার বউ হবি। নাইলে কারো বউ হবি না।’
বলেই সম্পান অসহায় দৃষ্টিতে রাঁখির দিকে তাকালো। রাঁখি ছেলের সম্পর্কে অবগত। বিন্দুকে তিনিও ছেলের বউ হিসেবে দেখতে চান। আজকে বিন্দুর কান্না দেখে তারও কষ্ট হচ্ছে। রাঁখি সম্পান কে উদ্দেশ্য করে বলে,’চল সম্পান, আমি আইজই কথা কমু বিন্দুর মা’র লগে।’
রাঁখি সম্পান আর বিন্দুকে নিয়ে উপস্থিত হলো চন্দনার কাছে। বাড়িতে তখন বিন্দুর খোঁজ চলছিল। চন্দনা ভাবছিল মেয়েটা গেল কোথায়? তখনই ওদের তিনজনকে আসতে সেদিকে এগোয় চন্দনা। রাঁখি চন্দনার হাতদুটো ধরে বলে,’তোমার মাইয়ার হাত দুইটা আমার পোলার লাইগা ভিক্ষা চাই গো দিদি। ওরা দুইজন দুইজনরে পছন্দ করে। বিয়া হইলে সুখে থাকবো।’
রেগে গেলো চন্দনা। ঝাড়ি মেরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,’দূর হও বাড়ি থাইকা। তোমার পোলার জন্মের ঠিক নাই। আবার ওই পোলার লগে আমার মাইয়া বিয়া দেবার কয়!!শখ কতো!!ওর লগে মাইয়া বিয়া দিলে লোকে ছিঃ ছিঃ করবো।’

-‘না দিদি,ওর বাপ আছে।’

-‘তা কয়জন ওই পোলার বাপ?’

-‘ভুল বুইঝেন না দিদি। আমার সম্পানের বাপ আছে। তার কোন খোঁজ নাই। আমার গায়ে কোন কলঙ্ক নাই দিদি।’
-‘হইছে আর কথা কইয়ো না। একটা বে**ন্মা পোলার হাতে আমার মাইয়া দিমু না।’
এই পর্যায়ে সম্পান ভয়ানক রেগে গেল। তেড়ে গেল চন্দনার দিকে। রাখিঁ টেনে ধরে সম্পান কে।
-‘আমার মা’র নামে খারাপ কথা কইলে আপনার গায়ে হাত উঠবো কইলাম।’
চন্দনা চেঁচিয়ে বলে,’পোলার সাহস কত বড়! আমারে মারব আবার আমার মাইয়া বিয়া করব। এই নেমকহারাম বের হ বাড়ি থাইকা।’

চেঁচামেচিতে লোকজন জড়ো হয়েছে। তবে কেউ কথা বলছে না। সম্পান পাল্টা জবাব দিচ্ছে আর চন্দনা ও খারাপ খারাপ কথা বলতেছে। শেষে মহেশ এসে চন্দনাকে টেনে সরিয়ে নিলো। এখানে মহেশ নিজেও কিছু বলতে পারছে না। চন্দনার কথাই শেষ কথা। কয়েক জন সম্পান কে বাড়ি যেতে বলল। যার মেয়ে সে বিয়ে না দিলে কার কি করার আছে?অবশেষে সম্পান মা’কে নিয়ে ফিরে গেল।

বিন্দু দৌড়ে পরীর কাছে গেল। এই মুহূর্তে পরী ব্যতীত কেউ ওর সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। চন্দনার ভাষা শুনে বিন্দু আর সেখানে দাঁড়ায়নি। সম্পানের অপমান সে দেখতে পারবে না।
পরী তখন নিজের ঘরে বসেছিল। বিন্দু এসেই হাঁপাতে লাগলো। সখির অবস্থা দেখে পরী গিয়ে ধরলো বিন্দুকে। চিন্তিত হয়ে পরী বলল,’কি হয়েছে বিন্দু? এরকম করছিস কেন?’
বিন্দু সকল ঘটনা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছে। পরীর এবার রাগ হলো চন্দনার উপর। মহিলাটা ভিশন কঠোর। এই মহিলার কঠিন তম শাস্তি হওয়া উচিত। রুষ্ঠচিত্ত কন্ঠে পরী বলে,’তোর মা ভাল না বিন্দু। একটা শিক্ষা দিতে হবে তোর মা’কে।’

-‘আমি জানি না তুই কি করবি কিন্ত আমারে বাঁচা। মাঝিরে ছাড়া আমি থাকতে পারমু না।’
পরী বিন্দুকে শান্ত হতে বলে। পরী নিজে গিয়েও কিছু বলতে পারবে না। কেননা সে নিজেই চুক্তিবদ্ধ মায়ের কাছে। তাই যা করার বিন্দু আর সম্পান কেই করতে হবে।
পরী কাঠের আলমারি থেকে বিন্দুর সিঁদুর কৌটো বের করে বলল,’সিঁদুর পড়ালেই বিয়ে হয় তাই না বিন্দু?’
#পরীজান
#পর্ব ২১
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌

পৌষের শীত রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌছে যায়। ভোরে গরম কম্বলের নিচ থেকে কেউ উঠতেই চায় না। পরীও কম্বল গায়ে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। রুপালি এসেছিল
পরীকে দেখতে। সে পরীর ঘর থেকে বের হয়ে আস্তে আস্তে নিচতলায় নেমে এলো। গরম চাদর গায়ে জড়িয়ে উঠোন জুড়ে হাটাহাটি করতে লাগলো। পেটটা বেশ উঁচু হয়েছে। কয়েক দিন বাদেই পৃথিবীতে ভুমিষ্ঠ হবে ওর সন্তান। মা হওয়ার আনন্দ সব মেয়েরই থাকে। কিন্ত কেন জানি রুপালি সে আনন্দ পাচ্ছে না। সেদিনের পর তো কবির আর তার কোন খবর নেয়নি। নেয়ার সাহস ও নাই। এই বাড়িতে পা রাখলে কবির প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে কি সন্দেহ।
যদি রুপালিকে কবির ভালোবাসতো তাহলে সে প্রাণের মায়া না করে ঠিকই আসতো। রূপের মোহে কবির তাকে বিয়ে করেছে ঠিকই কিন্ত ভালোবাসতে পারেনি। তার কাছে মেয়েদের দেহটাই প্রধান। রুপালির প্রথম মনে হতো সে’ই পারছে না কবির কে স্বামী হিসেবে টেনে নিতে। কিন্ত আস্তে আস্তে তার ভুল ধারণা ভেঙে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলা আর মালার চোখের জল সহ্য করা ছাড়া রুপালির আর কিছুই করার নেই।

রোদ উঠেছে বেলা আটটা নাগাদ। এতক্ষণ কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল চারিদিক। এরই মধ্যে জমিদার বাড়িতে এসে হাজির হলো নাঈম,শেখর,আসিফ। বৈঠকে ওদের বসতে দেওয়া হলো। মালা ও জেসমিন গিয়ে দেখা করে ওদের সাথে। অনেক দিন পর দেখা হতে ওদের ভালোই লাগলো। গরম গরম ভাপা পিঠা ওদের খেতে দেওয়া হলো।
নাঈম ভাবছে আজকের দিনটা ইনিয়ে বিনিয়ে থেকে যেতে হবে। পরীকে দেখার ইচ্ছাটা ওর কখনোই মিটবে না। একটাবার সে পরীকে দেখার জন্য আকুলিবিকুলি করছে। কিন্ত অতি আবেগের শেষ ফলাফল শুন্য।
আসিফ নাঈম কে বলে,’কি সিদ্ধান্ত নিলি? থাকবি নাকি চলে যাবি?’

-‘সবে তো এলাম দেখি কি করি?’
-‘তোর না দেখা বউয়ের দেখা শ্বশুর বাড়ি। থাকলে সমস্যা নেই।’
বলেই হাসলো সে। নিজের ঘর থেকে বের হতেই নাঈমদের দেখেই সেদিকে এগিয়ে গেল শায়ের। বলল,’আপনারা!! কখন এসেছেন??’
নাঈম মৃদু হেসে জবাব দিল,’এইতো কিছুক্ষণ। আপনার অবস্থা কেমন??’
-‘জ্বী ভালো। তা হঠাৎ আমাদের কথা মনে পড়ল??’
-‘হঠাৎ মানে?’
-‘মানে এতদিন পর এলেন তাই বললাম।’

নাঈমের বদলে আসিফ বলে,’আসলে এসেছি গ্রামটা দেখতে। বন্যার সময় এক রকম ছিল আর এখন আরেক রকম। এটাই দেখতে এসেছি। একটু পরেই চলে যাবো।’
নাঈম চোখ গরম করে আসিফের দিকে তাকালো। বিনিময়ে হাসলো আসিফ। দিলো সবকিছু মাটি করে। আগ বাড়িয়ে কথাটা বলার প্রয়োজন ছিল কি?
-‘আজকে বরং থেকেই যান। পাশের গ্রামে যাত্রাপালা হচ্ছে। রাতে সবাই দেখতে যাবো। আপনাদের ভালোই লাগবে।’
শায়েরের কথা শুনে নাঈম তৃপ্তির হাসি হাসল বলল,’তাই নাকি!!তাহলে তো যেতেই হয়। সমস্যা নেই আমরা থাকবো।’
-‘শুনে খুশি হলাম। আচ্ছা আপনারা থাকুন আমি আমার কাজে যাই। রাতে দেখা হচ্ছে।’
শায়ের চলে গেল। নাঈম মনে মনে খুব খুশি। আজকে অন্তত শেষ চেষ্টা করে দেখবেন সে। পরীর মুখোমুখি সে হবেই।

নিজের ঘরে বসে কুসুমের পরনের কাপড়টা ভাজ করছে পরী। কুসুম কে একখানা নতুন চাদর দিয়ে ওর পুরোনো চাদরটাও এনেছে। এমনকি জুতো টাও কুসুমের। কোন রকম ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত নয় পরী। আজকে রাতের আঁধারে বের হবে সে। অনেক বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরী। বিন্দু আর সম্পানের বিয়ে দেবে সে তাও নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। বিন্দুকে বলেছে যাতে সে সম্পান কে সব বলে। সম্পান ও রাজি। আর কি চাই? পরিকল্পনা অনুযায়ী,পশ্চিমের জঙ্গলের মধ্যে একটা পুরোনো কালী মন্দির আছে। ওখানেই বিয়ে সম্পন্ন হবে। একবার বিয়ে হয়ে গেলে চন্দনার আর কিছুই করার থাকবে না। বিন্দু সম্পান ও সুখে থাকবে। তাই আগে থেকেই তৈরি হচ্ছে পরী। রুপালির বাড়ি যাওয়ার সময় কুসুম দেখিয়েছিল জঙ্গলটি। কুসুমের ধারণা এই জঙ্গলে ভুত প্রেতের বাস। তাই দিনের বেলাতেও কেউ যায় না। এটাকেই হাতিয়ার হিসেবে ধরেছে পরী। তবুও কেউ যাতে দেখে না ফেলে তাই রাতেই সেখানে যাবে ওরা। এখন শুধু রাতের অপেক্ষা।

সন্ধ্যা নামতেই চারিদিক হালকা কুয়াশায় ভরে গেলো। গ্রামের মানুষ দলে দলে বের হলো যাত্রা দেখবে বলে। আফতাব সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত। তাই সবাই রওনা হলো। কিন্ত নাঈম গেলো না। শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে শুয়ে থাকলো। সেজন্য সবাই তাকে ফেলে যেতে বাধ্য হলো। আসিফ আর শেখর সব বুঝলো কিন্ত কিছু বলল না।
ওরা চলে গেল যাত্রা দেখতে। জমিদার বাড়ির সব পুরুষ চলে গেল শুধু রয়ে গেল নাঈম আর রক্ষিরা।

রাতের অন্ধকার একটু গাঢ় হতেই রুপালির চিৎকার শোনা গেলো। রুপালির প্রসব বেদনা শুরু হয়েছে। বাড়িতে একটা হইচই পড়ে গেল। ইতিমধ্যে কয়েকজন মহিলা এসে পড়েছে। আবেরজান নাতনির কথা শুনে আর থাকতে পারলেন না। তিনিও চলে এলেন। সবাই এখন রুপালিকে নিয়ে ব্যস্ত।
পরী সেই ফাঁকে বেরিয়ে গেল। এর মধ্যে কেউই পরীর খোঁজ করবে না। সদর দরজা দিয়েই বের হয়েছে সে। কুসুমের পোশাকে ছিল বিধায় কেউ বুঝতে পারেনি। রক্ষিরা ভেবেছে হয়তো কোন কাজে কুসুমকে পাঠানো হয়েছে কারণ সে দ্রুত যাচ্ছে। বাঁধা দিলে রাগ করবে।
পরী ক্ষেতের আইল দিয়ে যাচ্ছে। কারণ অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে পরীর। তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে ওর। বিন্দু সম্পান হয়তো আরো আগে পৌঁছে গেছে।
হারিকেনের আলোয় দ্রুত পা চালায় পরী। সম্পান বিন্দুকে এক করতে পারলে সবচেয়ে বেশি খুশি হবে পরী। বেশ সময় লাগলো জঙ্গলে পৌঁছাতে। কিন্ত কালী মন্দিরটা কোথায়??সেটা তো পরী জানে না। খুঁজতে হবে। জঙ্গলটা বেশ বড়। তবুও পরী খুঁজতেছে। কিছুক্ষণ খুঁজে পেয়ে ও গেলো। তবে আশ্চর্যজনক ব্যাপার যে বিন্দু সম্পান এখনো আসেনি। পরীর হাতে বিন্দুর সেই সিঁদূর কৌটো। এটা দিয়েই বিয়ে হবে। কিন্ত ওরা এখনো আসছে না কেন?
পরী ওদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। তবুও বিন্দু সম্পানের নাম গন্ধও নেই। পরীর এবার ওদের জন্য চিন্তা হচ্ছে। বিন্দু কি বের হতে পারবে? নাকি চন্দনার হাতে ধরা পড়ে যাবে?
বকুল ফুলের ঘ্রাণে ম ম করছে চারিদিক। পরী থাকতে পারলো না আর। পাশেই একটা বড় বকুল ফুল গাছ। তলায় চাদরের মতো বিছিয়ে আছে সাদা ফুলগুলো। হারিকেনটা মাটিতে রেখে ফুল কুড়ায় পরী। মাঝে মাঝে ঘ্রাণ নেয়। পরী ফুল দিয়ে কোচড় ভর্তি করে ফেলেছে। তখনও কেউ আসছে না। পরী আবার আগের জায়গাতে বসে পড়ল।
কারো পায়ের আওয়াজ পাচ্ছে পরী। পাতার খসখস আওয়াজ টের পাচ্ছে। সে খুশি হলো। তারমানে ওরা এসে পড়েছে। পরী হারিকেন হাতে নিয়ে একটু এগিয়ে থেমে গেল। ও বুঝতে পারল বিন্দু সম্পান আসছে না। বেশ কয়েকজন লোক আসছে। তাদের গলার স্বর শুনতে পাচ্ছে পরী। এখানে থাকাটা ঠিক হবে না ভেবে উল্টো দিক দিয়ে দৌড় দিলো পরী। পরী বুঝতে পারল তাকে দেখে ফেলেছে এবং তাড়া করছে। তাই সে প্রাণপণে ছুটলো। বেত ঝারের মধ্যে দিয়ে দৌড়াচ্ছে পরী। গায়ের চাদর কিছুর সাথে আটকে গিয়েছিল বিধায় সেটা ফেলেই চলে এলো। এখন দাঁড়ানোর সময় নেই। ধরা পড়লে চলবে না। অনেকটাই এগিয়ে এসেছে পরী। হঠাৎই গাছের সাথে ধাক্কা লেগে হারিকেনের কাচ ভেঙে গেল। হারিকেনটা ও ছিটকে পড়ে। কোথায় পড়ে তা পরী খেয়াল করে না। সে দৌড়াতে থাকে।

অনেক আলো আসতেই পরী পেছন ফিরে তাকায়। আগুনের ফুলকি উঠছে। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। পরী বুঝতে পারলো যে হারিকেনটা ছিটকে খড়ের গাদায় পড়েছে। আগুন দেখেও অপেক্ষা করে না পরী। আবার দৌড় দিলো। রাস্তায় এসে হুশ ফিরলো পরীর। ঘাড় ঘুরিয়ে জঙ্গলটা দেখে নিলো সে। আগুনের লাল আলো এখনো দেখা যাচ্ছে। স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল পরী। হঠাৎ করে কি হয়ে গেল তা বোধগম্য হচ্ছে না ওর। বিন্দু সম্পান কোথায়? আশেপাশে ভালো করে তাকায় সে। অন্ধকারে কিচ্ছু দেখা যায় না। মাথা ধরে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো পরী। এই রাস্তায় বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব নয়। কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ। চাদরটাও হারিয়ে গেছে। মুখটা শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢাকলো পরী।
তারপর হাঁটা ধরে বাড়ির পথে। এক পা এগোতেই পায়ে ব্যথা অনুভব করে পরী। জুতো খুলে দেখে তাতে বড়সড় বেল কাটা বিঁধে আছে। টেনে কাটা বের করার চেষ্টা করে পরী। কিন্ত পারে না তাই জুতো খুলে খালি পায়ে রওনা হলো। ঠান্ডা মাটি তার উপর গায়ে চাদর নেই। তাছাড়া শরীর জ্বালাপোড়া করছে খুব। শরীরের কিছু কিছু জায়গায় কেটে ছিঁড়ে গেছে। এতক্ষণ উত্তেজনায় পরী কিছু টের না পেলেও এখন পাচ্ছে। অন্ধকারে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটতে লাগল পরী। কোনরকম পথ চিনে বিন্দুর বাড়িতে গেলো।

অনেক মানুষের জটলা বিন্দুদের বাড়ি। চন্দনা মাটিতে হাত পা ছড়িয়ে কাঁদছে আর সম্পান কে গালমন্দ করছে। সম্পান নাকি বিন্দুকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। এটা বলছে আর সম্পান কে অভিশাপ দিচ্ছে। পরী এবার বেশ অবাক হলো। ওরা যদি পালিয়ে যাবে তাহলে পরীকে বলল না কেন??এক মুহূর্ত দেরি না করে পরী ছুটলো নিজের বাড়ির দিকে। তবে এবার সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে পারলো না সে। তাই বাড়ির পেছন দিক দিয়ে গাছে উঠে ছাদে গেল সে। তারপর নিজের ঘরে গেল।
মালাকে ওর ঘরে দেখে আঁতকে ওঠে পরী। মালা যে এসময় ওর ঘরে আসবে তা ভাবেনি পরী।
আজ মালা ভয়ানক রেগে আছে। ফর্সা মুখখানি লাল বর্ণ ধারণ করেছে। মাকে এভাবে দেখে ভয় হলো পরীর। মালা জিজ্ঞেস করল,’কোথায় গিয়েছিলি??’

পরী চট জলদি জবাব দিতে পারলো না। মালা অপেক্ষাও করলো না। ঠাস করে চড় মেরে দিলো পরীর গালে। এমনিতেই পরীর শরীর দূর্বল। তাই সে তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল। মালা পরীকে টেনে তুলে আবার থাপ্পড় দিলো। পরপর কয়েকটা থাপ্পড় দিতেই রক্ত লাল হয়ে গেছে পরীর গাল দুটো। শক্ত হাতের মারে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে যেনো। পরী চুপচাপ রইলো। মালা চিৎকার করে উঠল বলল,’এই দিন কি দেখতে চাইছি আমি??তোরে সব বিপদ থাইকা আগলাইয়া রাখতে ঘর থাইকা বাইর হইতে দেই না। ক্যান জানোস?? কারণ সুন্দরের কদর সবাই করে না। লালসার চাহনি অনেক ভয়ংকর। সুন্দর সবাই ধরতে চায়। চোখ দিয়া তারা শরীরে হাত দেয়। তোরে সেই সব থাইকা বাঁচাইতে ঘরে আটকাইয়া রাখি। আর তুই রাইত বিরাইতে বাইরে যাস। আমার কথা তো বুঝোস না। ঝিনুকের মুক্তা যহন মানুষ দেখে তহন বেইচা দেয়। না দেখলে ওই মুক্তা সুরক্ষিত থাহে। তোরে তেমনিই সুরক্ষিত রাখতে আমি ঝিনুকের মধ্যে রাখলাম যাতে কেউ দেখতে না পারে। আর তুই!! তুই কি আমার মাইয়া??’

মালা পরীকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। পরী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মা ওকে কিসব বলে গেল?? কোন লালসার কথা বলে গেল??তাহলে নিশ্চয়ই মালাও এরকম কিছুর শিকার ছিলো। কোন কিছু নিয়ে ভিশন ভয় পাচ্ছে মালা। যার কারণে পরীকে সে ঘরবন্দি করে রাখে। সেই ভয়ের কারণ টা কি?? একে তো বিন্দুর চিন্তা আর মালাও কি বলে গেলো। মাথায় প্রশ্নের জটলা পেকে গেছে। তাকে যে জানতে হবে সব প্রশ্নের উত্তর।
সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি পরী। কাপড় বদলে নিজের পোশাক পড়ে নিলো সে। বিন্দুর সিঁদুর কৌটো হাতে নিয়ে সারারাত ভেবেই গেল। বিন্দু সম্পান কোথায় গেলো?সত্যিই পালিয়ে গেল??এসব ভাবনা পরীকে ঘুমাতে দিলো না। সকাল হতেই নিজ ঘর ছেড়ে বের হয় পরী। হাতে তার তখনও সিঁদুর কৌটো আছে। সেটা পরী খেয়াল করলো না। বাইরে এসে দেখে অন্দরের উঠোন ভর্তি মহিলা। সবাই রুপালির ঘরে উঁকি দিচ্ছে। পরী দ্রুত রুপালির ঘরে যায়। নবজাতক কে দুগ্ধ পান করাচ্ছে রুপালি। পরী গিয়ে আস্তে করে রুপালির পাশে বসে। অসম্ভব সুন্দর বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে অষ্ফুটস্বরে বলে উঠল,’মাশাল্লাহ’
আবেরজান পাশেই বসা ছিলেন। তিনি বললেন, ‘তোর অহন আহার সময় হইলো? পোলা হইছে কোন রাইতে।’
দাদির কথায় রুপালি বলল,’আহ দাদি থাক না। পরী তো ঘুমাচ্ছিল। এখন তো এসেছে।’
পরীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল রুপালি। পরীও হাসলো কিন্ত মনটা এখনও কু গাইছে। পরী বাচ্চাটাকে কোলে নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালো। পরীর হাতে সিঁদুর কৌটো দেখে রুপালি জিজ্ঞেস করে,’তোর হাতে এটা কেন??’
পরী জবাব দিতে পারে না। রুপালিও ফের প্রশ্ন করতে পারে না। কারণ বাইরে থেকে জুম্মানের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সে ‘পরী আপা’ বলে ডাকছে। পরী দৌঁড়ে বের হয়ে জুম্মানের কাছে গেলো। জুম্মান তখনো হাপাচ্ছে। পরী জিজ্ঞেস করে, ‘কি হয়েছে জুম্মান??’
জুম্মান হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’আপা,,,’
-‘কি??’
-‘আপা বিন্দু দিদি,,’
-‘বিন্দু কি??’
ভয়ে কথা বলতে পারছে না জুম্মান। শরীর এখনো কাঁপছে জুম্মানের। পরী চিৎকার করে জুম্মান কে ঝাঁকিয়ে বলে,’বল না বিন্দুর কি হয়েছে??’

-‘বিন্দু দিদি পশ্চিম জঙ্গলে গাছের ডালে ঝুলতাছে আপা।’

জুম্মান কে সরিয়ে পরী দৌড় দিলো। মালা সাথে সাথেই পরীকে টেনে ধরে। কিন্ত এবার মায়ের কোন বাঁধা মানে না পরী। ঝাড়ি মেরে মালার হাত ছেড়ে দৌড়ে চলে যায়। আজ পরী ভুলে গেছে মায়ের দেয়া কসম। ভুলে গেছেন নেকাব পরতে। ভুলে গেছে নিজের সৌন্দর্য লুকাতে। যে পরীর সৌন্দর্য পর্দার আড়ালে লুকানো ছিল আজ সেই পরী পর্দা ভেদ করে বের হয়েছে।

#চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here