পরীজান পর্ব -১৮+১৯

#পরীজান
#পর্ব ১৮
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌

রক্তলাল দিবাকর মেঘেদের আড়ালে লুকাতেই উদয় হয় এক টুকরো সুধাকর। মুহূর্তের মধ্যেই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে তার কোমল আলো। সেই আলোতে ধান ক্ষেত গুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হাল্কা বাতাসে দুলছে ধানের শীষ। প্রাকৃতিক এই স্নিগ্ধ রূপ দেখে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে পরী। গ্রামের এই দৃশ্য কখনোই সে দেখেনি। তাই দুচোখ ভরে দেখছে সে। এটা তার প্রথম জ্যোৎস্না বিলাস। এর আগেও সে দেখেছে,তবে তা নিজ কক্ষের জানালা দিয়ে। আর আজ রাস্তার ধারে বসে কোমল জ্যোৎস্না গায়ে মাখছে। ইচ্ছা করছে নেকাব খুলে মন ভরে শ্বাস দিতে কিন্ত শায়ের সামনে আছে বিধায় পারছে না। রাস্তার ধার ঘেষে ঘাসের ওপর বসে আছে পাঁচজন ব্যক্তি। তবে কারো মুখে কোন শব্দ নেই। এতক্ষণ শায়ের কথা বলছিল। নওশাদের বাবা আর আফতাবের কাহিনীর পুনরাবৃত্তি করেছে। কথা শেষ করতেই পরীর রাগ হলো নিজের বাবার ওপর। কথা দিয়ে আফতাব কোন কালেই কথা রাখেনি। যদিও সে নওশাদ কে পছন্দ করে না তবুও ওর কিছুটা হলেও খারাপ লাগছে। কিন্ত আপাতত নওশাদের চিন্তা বাদ দিয়ে চাঁদের আলোয় মন দিলো।
নেকাব টা খুলতে খুব ইচ্ছা করছে। ঠান্ডা হাওয়া থেকে ঘ্রাণ নিতে চাচ্ছে সে। কিন্ত এই শায়ের গন্ডগোল পাকিয়ে দিলো। পরী মুখ বিকৃত করে শায়ের কে উদ্দেশ্য করে বলে,’আপনি একটু ওদিক ঘুরুন তো। আমি নেকাব টা খুলবো।’

শায়ের কথা বলল না। চুপচাপ অন্যদিকে ফিরে ঘাসের ওপর টান হয়ে শুয়ে পড়ল। একহাত চোখের উপর দিয়ে রাখলো। পরী একটু খুশি হলো। নেকাব সরিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিলো। আহা চারিদিক থেকে কত রকমের ঘ্রাণ আসছে। এরকম অনুভুতির সাথে কখনোই মিলিত হয়নি পরী। উঠে দাঁড়িয়ে পরী ধান ক্ষেতের দিকে দৌড় দিলো। আশেপাশের ক্ষেতের মধ্যে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালো। জুম্মান চেঁচিয়ে পরীকে বলে,’আপা আসো বাড়ি যাই। বড় আম্মা চিন্তা করবো।’
পাশে থেকে কুসুম বলে উঠল,’পাখি খাঁচা থাইকা ছাড়া পাইছে তো তাই উড়তাছে।’

পরী সাবধানে রাস্তার উপর উঠল। নেকাব পড়ে নিল। শায়ের আগের মতোই শুয়ে আছে। জুম্মান বলল, ‘সুন্দর ভাই উঠেন বাড়ি যাই।’
চট করে উঠে বসে শায়ের। তারপর সবাই হেঁটে হেঁটে বাড়ির পথ ধরে। তবে যাওয়ার সময় কেউ কারো সাথে কথা বলে না।
জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গনে শ’খানেক মানুষের উপস্থিতি। তাদের মাঝে আফতাব বসে আছে এবং আখির ও আছে। তারা গভীর আলোচনা করছে। শায়ের কে আসতে দেখেই সবাই রাস্তা ছাড়লো। পরীরা পাশ কাটিয়ে বাড়ির ভেতর যাচ্ছিল। কিন্ত আখিরের কর্কশ কন্ঠস্বর শুনে থেমে গেল পরী। সে শায়ের কে ধমকে বলছে,’এতক্ষণ কোথায় ছিলে ওদের নিয়ে? যদি কোন বিপদ হতো তাহলে কি করতে? একা সামাল দিতে পারতে?’
তবে এবার শায়ের জবাব দিলো,’বিপদ কি হয়নি আজকে?কার জন্য হয়েছে এই বিপদ?’

-‘দেখছেন ভাই কতবড় বেয়াদব এই ছেলে? মুখে মুখে তর্ক করছে আমার। এই ছেলে তুমি কি জানো কার সাথে কথা বলছো তুমি? আমি চাইলে তোমাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিতে জানো তুমি?’

আফতাবের আগেই পরী এগিয়ে এসে জবাব দিল,’আপনার ভাইকে জবান সামলে কথা বলতে বলুন আব্বা। না জেনে ওনাকে কেন দোষ দিচ্ছেন? দোষ তো আপনাদের। কথা দিয়ে কথা রাখেননি আপনারা যার জন্য আমাদের বিপদে পড়তে হয়েছে। আর উনি না থাকলে আমাদের বেঁচে ফেরা সম্ভব হত না।’
আফতাব কিছুই বলল না। শুধু কড়া চোখে তাকালো পরীর দিকে। পরী তা গ্রায্য করলো না।

-‘পরী তুই ঘরে যা। আমরা সব দেখছি।’
আখিরের কথা শুনতেই রাগ হয় পরীর। ওর নামটা এই খারাপ লোকের মুখে শুনতে চায় না। এখানে অনেক মানুষ আছে বিধায় চাচাকে কথা শোনাতে সে পারলো না। শায়েরের দিকে এক পলক তাকিয়ে সে অন্দরে চলে গেল। পরী চলে যেতেই আখির আবার শায়ের কে কতগুলো কথা শোনালো। শায়ের এবার আর কিছু বলে না। শেষে আফতাবের ধমকে আখির থামে।
শামসুদ্দিনের উপর পাল্টা হামলা করা হবে। আজকে ভাগ্যক্রমে আজ ওরা বেঁচে গেছে। তাই ওদের আরো শক্তিশালী হতে হবে। এনিয়ে অনেক কথা বলে সবাই। পরবর্তী সভা কাল সকালে হবে। এখন রাত হয়ে গেছে। তবে সবার আগে শায়ের নিজের ঘরে চলে গেল। মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে আখিরের কথা শুনে। পাশে থাকা জলচৌকিতে লাথি মেরে নিজের রাগ দিনের চেষ্টা করলো। কিন্ত আজ সে কিছুতেই নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। কি করে না সে? জমিদার বাড়ির জন্য নিজের প্রাণ দিতে প্রস্তুত সে। তবুও আখির ওকে অপমান করে। এটা সবসময়ই করে,কিন্ত আফতাব কে কখনোই প্রতিবাদ করতে শায়ের দেখেনি। অথচ শায়ের কে ছাড়া কোন সিদ্ধান্ত আফতাব নিতে পারে না। তাহলে এই বৈষম্যতা কেন?? পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরায় সে। সুখটান দিতে থাকে একের পর এক। সিগারেট খুব একটা খায় না শায়ের। যখন অতিরিক্ত রেগে যায় তখন খায়।

সকালে পরীর ঘুম ভাঙে কোলাহলে। বিরক্ত হয়ে সে অন্দরের উঠোনে আসলো। সোনালী আর ওর শ্বাশুড়িকে দেখে সেদিকে দ্রুত পদে এগিয়ে গেল। মালা জেসমিন ওখানেই ছিলেন। রুপালির শ্বাশুড়ি মালার হাতদুটো চেপে ধরে চোখের জল ফেলছে আর বলছে,’আপনের কাছে আমি আমার মাইয়া দিয়া গেলাম। ওরে ভাল কইরা রাইখেন। ওইহানে থাকলে ও বাঁচবো না। ওরা মাইরা ফেলাইবো ওরে।’

বলতে বলতে তিনি জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন। রুপালিও নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না। শ্বাশুড়িকে সে খুব ভালোবাসে। ঠিক নিজের মায়ের মতো। ওই বাড়িতে এই একটা মানুষকে সে নিজের থেকে বেশি বিশ্বাস করে। নিঃস্বার্থ ভাবে এই মানুষ টা তাকে বেশি ভালোবাসে। তাই তিনি রুপালির চিন্তা করে ওকে এখানে রেখে গেলেন। কেননা কবির এখন তার আসল রূপে ফিরে এসেছে।
শুধু কবির নয়। ওনার বাকি তিন ছেলেও ক্ষেপেছে। আফতাবের পতন ঘটাতে চায় সবাই। এমনকি তার নিজের স্বামী ও।
শামসুদ্দিন রুপালির শ্বাশুড়ির ভাই। বেশ নামডাক তার। টাকা পয়সা জমি জমার অভাব নেই। সাথে আছে ক্ষমতা। আফতাবের করা অপমান তিনি মানতে পারেননি তাই তার লোক দিয়ে পরীকে তুলে এনে ছেলের সাথে বিয়ে চেয়েছিলেন কিন্ত তাতে সফল হননি। তারপর চোখ পড়ে রুপালির উপর। রুপালিকে কেন্দ্র করে আফতাবকে নাচাবে। গর্ভবতী রুপালিকেও ছাড় দেবে না। একথা রুপালির শ্বাশুড়ি জানতে পারে তাই ভোর হবার আগেই রুপালিকে নিয়ে চলে আসে।
সে জানে এতে সেও বিপদে পড়বে। তবুও পুত্রবধুকে তিনি বাঁচাবেন।
পরী রুপালির কাছে গিয়ে ওর দিকে তাকাতেই চমকে গেল। রুপালির গালে তিন আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। ফর্সা গাল রক্ত লাল হয়ে গেছে। ঠোঁটের কোণে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। রুপালির দুবাহু চেপে ধরে পরী বলল,’আপা তোর এই অবস্থা কে করেছে?’

রুপালি জবাব দিল না পরীর প্রশ্নের। অন্য কথা বলল সে,’পরী চল ঘরে। তারপর সব বলছি। মা আপনি তাড়াতাড়ি চলে যান। নাহলে আমার আব্বাও আপনার ক্ষতি করে দেবে। এরা এখন পিচাশে পরিণত হয়েছে।’
রুপালির মাথায় হাত বুলিয়ে ওর শ্বাশুড়ি চলে গেল। রুপালি মালার দিকে তাকালো। মালা কাঁদছে তা দেখে রুপালি বলল,’কাঁদবেন না আম্মা। আপনার কান্না আমার ভাল লাগে না। ভাগ্য যেখানে নিয়ে যাবে সেখানে যেতেই হবে আমাদের। শুধু দোয়া করবেন পরীর ভাগ্য যেন ভালো হয়। আপনার স্বামী যেন পরীর জীবন নষ্ট না করে।’
রুপালি পরীর হাত ধরে নিচতলার একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। পালঙ্কের উপর আস্তে করে বসে পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,’অনেক প্রশ্ন তোর মনে তাই না পরী?আমার বিয়ের পর থেকেই তোর মনে হাজার প্রশ্ন। আজ সব বলবো তোকে শুনবি?’
চুপ করে রুপালির ক্ষতের দিকে তাকিয়ে আছে পরী। রুপালি বলতে শুরু করে,
-‘যদি কোন পুরুষ নারী নেশায় আটকে যায় তাহলে যত সুন্দর মেয়ে তার জীবনসঙ্গী হোক না কেন সেই নেশা পুরুষ কাটিয়ে উঠতে পারে না। অভ্যাস বদলানো খুব কঠিন। সেরকম একটা পরিবারে বিয়ে হয়েছে আমার। আমার মুখে যে ক্ষত দেখছিস এটা নতুন কিছু না খুব পুরনো। যখন মেয়েদের নেশায় বুদ থাকতো প্রতিবাদ করতাম। তারপর আমার এই হাল করতো সে। ইচ্ছে করলে আম্মাকে সব কথা পারতাম কিন্ত বলিনি। কারণ বড় আপাকে হারিয়ে আম্মা এখনও কষ্ট পাচ্ছেন। আমার কষ্টের কথা শুনলে তিনি আরো কষ্ট পাবে। কিন্ত তা হলো না পরী। আল্লাহ মনে হয় আম্মাকে কষ্ট পেতেই দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন।
প্রথম প্রথম কবির ভালোই ছিল। আমার সাথে ভালো ব্যবহার ও করতো। কিন্ত ওর ছোট ভাইয়ের চাহনি অত্যন্ত নোংরা ছিল। আমার দিকে সবসময় নোংরা ভাবে তাকাতো। বিশ্রী কথাবার্তা বলতো। গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করতো। এসব কবির দেখেও না দেখার ভান করতো। আমি সেদিন খুব অবাক হয়েছিলাম। কবির ওর ভাইকে কিছু বলছে না দেখে। তাই আমার শ্বাশুড়িকে সব বলি। তিনি আমাকে বাঁচাতে ছোট ছেলের বিয়ে দেন। আমার শ্বাশুড়ি সত্যিই খুব ভাল আমাকে অনেক ভালোবাসে। কালকে তোরা আসার পর কবির আর ওর ভাইয়েরা মিলে জঘন্য পরিকল্পনা করে। ওদের মামার অপমানের প্রতিশোধ নিতে জোর করে তোর সাথে নওশাদের বিয়ে দেবে। কিন্ত তোরা নাকি নিজেদের বাঁচিয়ে গ্রামে চলে এসেছিস। তার পর ওদের চোখ পড়ল আমার ওপর। ওরা ভেবেছে আব্বার দূর্বলতা আমি। মেয়েকে বাঁচাতে আব্বা সবকিছু করবেন। কিন্ত ওদের ধারণা যে ভুল পরী। আব্বা নিজের সম্মানের জন্য যেভাবে বড় আপাকে ছেড়ে দিয়েছেন সেভাবে আমাকেও মরে যেতে দেখতে পারেন। আমার শ্বাশুড়ি আমার ভাল চান বলেই আজকে দিয়ে গেলেন আমাকে। না জানি তার কি অবস্থা করবে আমার শ্বশুর??
ভাবিরা অমাকে হিংসে করতো তার কারণ তাদের স্বামীরা সবসময় আমার রূপের প্রশংসা করতো। তাদের চোখ ও যে নোংরা তা আমি ঠিকই টের পেয়েছি। কিন্ত ভাবিরা আমার খারাপ চায়নি কখনো।
সবশেষে এটা বলতে পারি কবিরদের পরিবারে ভাবিরা আর আমার শ্বাশুড়ি ছাড়া সবাই কুৎসিত লোক। আর কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না পরী। তবে আরো অনেক কথা তোর অজানা। পরে বলব সব।’

নিজের কথা শেষ করে লম্বা দম ফেলে রুপালি। পরীর চেহারায় শান্ত ভাব দেখে চমকায় সে। কিন্ত পরীর তো রাগার কথা। পরী ধীর পায়ে এসে রুপালির পাশে বসে। খুব শান্ত গলায় বলে,’তুমি যদি বিধবা হও,তোমার সন্তান যদি পিতৃহারা হয়ে তাহলে তুমি কষ্ট পাবে না তো??’
সর্বাঙ্গ তড়িৎ গতিতে ঝাকুনি দিয়ে উঠল রুপালির। মাথা ঘুরে উঠলো। এসব বলছে কি ওর বোন? মৃত্যু খেলা খেলবে নাকি?
-‘পরী তুই এসব বলছিস কি?’
-‘তিন বছর আগে যা হয়েছিল আবার তা হবে।’
-‘পরী আমার কথা শোন পিছনে যা হয়েছে তা ভুলে যা।’
-‘পরী কিছুই ভোলে না আপা। ওরা তোমার গায়ে হাত তুলতো তুমি তা না বলে অন্যায় করেছো। শাস্তি তোমাকেও পেতে হবে। শাস্তি হিসেবে বিধবা হতে হবে তোমাকে। নিজেকে তৈরি করো।’

-‘পরী এমন করিস না বোন আমার। আমি ভাল নেই তো কি হয়েছে তোকে ভাল রাখবো আমি। ওদের সাথে তুই পারবি না পরী। ওরা ভয়ানক,আমার কথা শোন পরী।’
-‘তাতে আমার কিছু যায় আসে না আপা। ওরা তোমার গায়ে হাত তুলেছে। মনে আছে তোমার গায়ে হাত দেওয়ার কারণে শশিলকে আমি,,,’

বাকি কথা বলতে দিলো না রুপালি। হাতের তালু দ্বারা আবদ্ধ করে নিলো পরীর ঠোঁট জোড়া। অসম্ভব কাঁপতে লাগলো রুপালি। পরীকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো সে। কিন্ত পরী নাছোড়বান্দা। সে হাল ছাড়বে না। সে বলল,’আমি নওশাদ কে বিয়ে করব আপা।’

-‘নাহ পরী এটা কিছুতেই সম্ভব না।’
-‘কেন তুমিই তো বলেছিলে নওশাদ ভালো ছেলে। তাহলে??’
-‘আমি এখনো বলছি নওশাদ ভালো ছেলে। কিন্ত ওর পরিবারের কেউ ভাল না পরী।’
-‘নওশাদ কে বিয়ে করলে আমি ওই পরিবারে ঢুকতে পারবো। তার পর আমি আমার প্রতিশোধ নিবো। ছাড়বো না কাউকে আমি।’
-‘আব্বা তোকে এ বিয়ে করতে দেবে না।’
-‘আমি বিয়ে করবোই।’

পরী দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। অন্দরের উঠোনে দাঁড়িয়ে আব্বা আব্বা বলে চিল্লাতে লাগল। আফতাব কথা বলছিল আখির আর শায়েরের সাথে। পরীর গলার আওয়াজ পেয়ে তিনি অন্দরে গেলেন। আফতাব কে দেখা মাত্রই পরী বলে উঠল,’আমি নওশাদ কে বিয়ে করব আব্বা। আপনি সব ব্যবস্থা করেন।’
#পরীজান
#পর্ব ১৯
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌

আফতাবের রাগ যেন আকাশ ছুঁয়েছে। শত্রুপক্ষের সাথে আত্মীয়তা করতে চাইছে তার মেয়ে!!একথা আর পাঁচকান হলে তো সর্বনাশ। শত্রুর সাথে মিলিত কখনোই সে হবে না। মালাও চলে এসেছে মেয়ের চিৎকার শুনে। পরীর কথা শুনে সে হতভম্ব। আফতাব আছে বিধায় কিছু বলেনা মালা। আফতাব বলে,’তোমার সাহস দিনকে দিন বাড়ছে পরী। আমার মুখের উপর এতবড় কথা বলতে বাধলো না তোমার??’
-‘বাধলে বলতাম নাহ।’
-‘মেয়েকে বোঝাও মালা। নাহলে খুব খারাপ হবে কিন্ত। মেয়ে মানুষের এতো জেদ ভাল না।’
-‘আর পুরুষ মানুষের এতো অবহেলাও ভালো না।’

আফতাব এবার কড়া চোখে মালার দিকে তাকিয়ে বলে,’পাগল হয়ে গেছে তোমার মেয়ে। সামলাও মেয়েকে।’
বলেই আফতাব অন্দর ছেড়ে চলে গেলেন। মালা পরীর গালে পরপর কয়েকটা থাপ্পড় বসিয়ে ওর ঘরে আটকে রাখলো।

জানালার ধারে বসে আকাশের দিকে তাকালো পরী। কি সুন্দর নীল আকাশ। টুকরো টুকরো সাদা মেঘ আনন্দের সহিত ভাসছে। ওদের দিন রাত নিশ্চয়ই খুব সুখে কাটে? নাহলে এতো আনন্দ পায় কোথায় ওরা?পরীর ভাবনায় সবসময় পাখি আর আকাশ নিয়ে। ওই পাখির মতো যদি সে আকাশে উড়ে বেড়াতো তাহলে কতই না ভালো হতো!! কেউ তাকে বকতো না। না কোন বিপদ হতো। এসব ভাবনা প্রতিনিয়ত পরীর মগজ খায়।
দরজা খোলার শব্দে ফিরে তাকায় পরী। কুসুম শব্দহীন পা ফেলে পরীর কাছে এসে বলল,’আপা আপনেরে বড় আম্মা বৈঠকে যাইতে কইছে। শায়ের ভাই কথা কইবো আপনের লগে।’
শায়ের পরীর সাথে আবার কি কথা বলবে?ভাবনাটা মনের ভেতর রেখে মাথায় ওড়না জড়ালো পরী। তারপর এগিয়ে গেলো বৈঠক ঘরের দিকে। কুসুম ও সাথে গেলো। ইশারায় শায়েরের ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল সে। পরী পা রাখলো চৌকাঠের ভেতরে। শায়ের তার জন্য অপেক্ষা করছে। পরীকে আসতে দেখে সে হাত দিয়ে জলচৌকি দেখিয়ে বসতে বলে। তাই করে পরী। মাথা নিচু করে শায়েরের সামনে বসে পরী।
-‘শুনলাম আপনি নাকি নওশাদ কে বিয়ে করতে চান?’
-‘হুমম।’
-‘কতকিছু হয়ে গেল এসব নিয়ে তারপরও আপনার এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ কি?’
পরী জবাব দিল না দেখে শায়ের আবার
বলে,
-‘আপনার কি মনে হয় এভাবে প্রতিশোধ নেওয়া সম্ভব?আপনাকে যতটা বুদ্ধিমতি মনে করেছিলাম আপনি ততটাই বোকা দেখছি। নওশাদ কে বিয়ে করলে আপনি প্রতিশোধ নিতে পারবেন এটা আপনার ধারনা। কিন্ত এতে আপনার ক্ষতি হবে বেশি। আচ্ছা বিয়ের পর আপনি কিভাবে প্রতিশোধ নিবেন? ওদের সাথে একা কিভাবে লড়াই করবেন? কালকে তো সাত জনের সাথেই লড়াই করতে পারলেন না। আর ওই বাড়িতে যত লোক আছে তাদের সাথে কি শক্তিতে পারবেন? নাহ,কারণ আপনি মেয়ে। একজন দুজনের সাথে পারলেও শতজনের সাথে পারবেন না। আর আপনার বাবাকে তো চেনেন। দরকার পড়লে আপনাকে খুন করে ফেলবে তবুও নওশাদের সাথে আপনার বিয়ে দেবেন না। নিজের বিপদ ডেকে আনবেন না। আর মাথা গরম না করে ঠান্ডা মাথায় ভাবুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন।
একা যুদ্ধে জয় করা অনেক কঠিন। আপনি যা ভাবছেন তা আপনার জন্য বিপদজনক। তাই ওসব চিন্তা বাদ দিন। তার জন্য আমরা সবাই আছি। আপনি ঘরের দিক সামলান। আমি জানি আপনি শক্ত মনে মানুষ কিন্ত আপনার মা এবং বোন কিন্ত তা নয়। যা করবেন ভেবে করবেন।
আমিও আবারো বলছি এভাবে কখনোই প্রতিশোধ নেওয়া সম্ভব না। মাথা ঠান্ডা রাখুন।’

শায়েরের বলা প্রতিটি কথাই সত্য। তা মাথা খাটিয়ে ভেবে দেখলো পরী। ইশশ কি বোকা সে?ভাবতেই ওর নিজেরই লজ্জা করছে। নিজের গ্রামে পরী যা’ই করুক না কেন অন্য গ্রামে তা পারবে না। আফতাব নিজেই তো পারলো না। মেজাজ আরো খারাপ হলো
পরীর। তবে তা এই মুহূর্তে প্রকাশ করে না। চুপ করেই বসে আছে সে। পরীকে এখনো চুপ থাকতে দেখে শায়ের বলে,’তো এখন কি সিদ্ধান্ত নিলেন? নওশাদ কে বিয়ে করবেন?’
পরী চট জলদি উঠে দাঁড়িয়ে বলে,’আমি আসি।’
-‘প্রশ্নের উত্তর টা দিলে ভালো হয়।’
-‘আপনাকে বলার প্রয়োজনবোধ করছি না।’

এক দৌড়ে নিজের কক্ষে চলে এলো পরী। ভাবনা ওর বাড়ছে। কবিরের কাছে তাহলে ও পৌঁছাবে কিভাবে?রুপালিকে করা আঘাত গুলো পরীকে পোড়াচ্ছে খুব। সহ্য হচ্ছে না পরীর। কবিরকে খুন করতে পারলে ভালো হতো। কিছু একটা মনে করে পরী ছুটলো নিচ তলায়। পথেই মালা ওকে টেনে ধরে কলপাড়ে নিয়ে যায়। কয়েক বালতি ভর্তি পানি। আরেক বালতি ভরার জন্য কল চাপছে কুসুম। মালা পরীকে বসিয়ে মাথায় পানি ঢালতে লাগল। অবাক হয়ে পরী বলে,’আম্মা করেন কি?’
-‘চুপ থাক। সবসময় মাথা গরম থাহে। আইজ সব ঠান্ডা কইরা দিতাছি।’
হতাশ হলো পরী। মাথায় পানি ঢাললে তো মাথা ঠান্ডা হবে। কিন্ত ওর মনে যে দাবানল হচ্ছে তা কিভাবে ঠান্ডা হবে?পরী মাথার তুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,’মাথায় তো ঠান্ডা পানি দিতেছেন। পরাণে ঠান্ডা পানি কেমনে দিবেন?’

মালার হাত থেমে গেল। আর পানি ওঠাতে পারলেন না তিনি। কুসুম কে পানি ঢালতে বলে চলে গেলেন।

কেটে গেছে দুদিন। এই দুদিন পরী শুধু শায়েরের কথাগুলো ভেবেছে। একবার নয় বারবার ভেবেছে। এটা করলে অনেক বড় ক্ষতি হতো পরীর। তাই ওসব বাদ দিয়েছে পরী।
আজকে নিঃশব্দে বিন্দু এসে পরীর পাশে দাঁড়াল। বিন্দুর অস্তিত্ব পেয়ে পরী ফিরে তাকালো। প্রিয় সখির মুখটা দেখে খুশি হতে পারলো না পরী। কেননা আজকে যে সে মুখ ভার করে রেখেছে। বিন্দুর বিরসচিত্ত বদনের দিকে তাকিয়ে পরী জিজ্ঞেস করে, ‘কি হয়েছে বিন্দু? মুখটা শুকনো কেন?’

প্রশ্নের জবাবে কেঁদে দিলো বিন্দু। মুক্তার ন্যায় অশ্রু গুলো হানা দিলো শ্যামা কপোলে। পরী চিন্তিত হলো বিন্দুর চোখে পানি দেখে। যে গজদন্তিনীর ঠোঁটে সর্বদা হাসি থাকতে আজ সে ঠোঁট কান্নায় ভাঙছে!

-‘কি হয়েছে বিন্দু? বল আমাকে?’
-‘পরী আমি মনে হয় মাঝিরে পামু নারে।’ বলেই বিন্দুর কান্নার বেগ বাড়লো। পরী ওর চোখের জল মুছে দিয়ে বলে,’আগে আমাকে সব বল। নাহলে বুঝব কিভাবে?’
-‘ওইদিন মাঝি আমারে কাপড় দিছে,সিঁন্দুরের কৌটা দিছে। এই কথা কেডা জানি আমার মায়রে কইয়া দিছে। মা আমারে অনেক মারছে পরী। আমার লাল কাপড় টা পোড়াইয়া দিছে। অখন সিঁন্দুরের কৌটা কোথায় তা জিগাইতাছে। আমি কি করমু পরী?’

-‘বলে দে তুই সম্পান মাঝিকে ভালোবাসিস। বিয়ে করতে চাস। আর সম্পান মাঝিও এখন তোকে বিয়ে করতে পারবে।’
-‘কইছি পরী কিন্ত মা বিয়া দিবে না মাঝির লগে। মাঝির নাকি বাপের পরিচয় নাই। হের মায় ও নাকি জানে না ওর বাপ কেডা।’
বিন্দুর কথায় বিষ্মিত হলো না পরী। সম্পান যে পিতৃহারা তা জানে পরী। গর্ভবতী অবস্থায় নিজের ভাইয়ের বাড়িতে উঠেছিল সম্পানের মা। নিজের বোন বলে সেদিন সম্পানের মামা তাকে থাকার জায়গা দিয়েছিল। বাড়ির এক কোণে ছোট্ট একটা ঘর তুলেছিলো সম্পানের মা রাঁখি। সেখানেই জন্ম সম্পানের। গ্রামের অনেক লোক কথা শুনিয়েছিলো রাঁখিকে। কেননা নিজের ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিল রাঁখি। বছর খানেক বাদেই ফিরে আসে সে। কিন্ত ওর স্বামীর খবর কেউ জানে না। রাঁখির ভাষ্যমতে ওর স্বামী ওকে রেখে শহরে কাজে গেছে তিন মাস আগে। আর আসেনি,রাঁখি আর থাকতে না পেরে চলেই আসে। তবে রাঁখির বিশ্বাস তার স্বামী একদিন ফিরে আসবেই। সেজন্য আজও অপেক্ষা করছে রাখি। সবার কটু কথা সহ্য করে ছেলেকে নিয়ে পড়ে আছে এখানে। গ্রামের সবাই সন্দেহ করে রাঁখিকে। অবৈধ সন্তান হিসেবে জানে সম্পান কে। সম্পান কেও কম কথা শুনতে হয় না। কিন্ত মায়ের অতীত সম্পর্কে অবগত সে। রাঁখি সবই বলেছে ছেলেকে। এও বলেছে সম্পানের বাবা এখনো বেঁচে আছে। সেজন্য রাখি আজও শাখা সিঁদূর পড়ে।
ঠিক এই কারণেই চন্দনা নাকচ করেছে সম্পান কে। মেয়ের মুখে সম্পানের কথা শুনতেই বিষ্ফোরিত হয়ে নিজের মেয়ে কে কয়েক ঘা বসিয়ে দেয়। বিন্দুকে সম্পানের সাথে বিয়ে দিলে লোকে কি বলবে?? চুনকালি পড়বে মুখে। চন্দনা তা হতে দেবে না। দরকার পড়লে মেয়েকে হাত পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখবে। তবুও সম্পানের হাতে বিন্দুকে তুলে দেবে না।
পরী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বিন্দুর হাত ধরে টেনে পালঙ্কের উপর বসিয়ে বলল,’চিন্তা করিস না। তোর বিয়ে সম্পান মাঝির সাথেই হবে। আপাতত চুপচাপ থাক। সম্পান মাঝি এখন কোথায়??’
বিন্দু নাক টেনে জবাব দিলো,’শহরে গেছে। আইবো কবে জানি না।’
-‘এক কাজ কর তুই। তোর মা’কে কিছু বুঝতে দিবি না। ভান ধরবি যে তুই সম্পান মাঝিকে ভুলে গেছিস। সম্পান মাঝি আগে গ্রামে ফিরে আসুক তার পর পরবর্তী চিন্তা ভাবনা করা যাবে।’
বিন্দু জড়িয়ে ধরে পরীকে। চোখের জলে ভাসালো পরী কাধ। সে জোরে জোরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আমি মাঝিরে ছাড়া বাঁচমু না পরী। সত্যি করে মইরা যামু।’
নিজের থেকে বিন্দুকে ছাড়িয়ে নিলো পরী। রেগে গিয়ে বলল,’মরার কথা বলস কেন? থাপ্পড় চিনোস?
যা বলেছি তাই করবি। এখন বাড়িতে যা।’
নিজেকে ধাতস্থ করে উঠে দাঁড়াল বিন্দু। দরজা পর্যন্ত যেতেই পরীর ডাকে ঘুরে দাঁড়াল সে।

-‘বিন্দু,মানুষ পাগলের মতো ভালোবাসে কেমনে?’
এতক্ষণে একটু খানি হাসলো বিন্দু। ঠোঁটে হাসির রেশ ধরেই বলে,’পাগলের মতো কেউ ভালোবাসে না। ভালোবেসেই মানুষ পাগল হয়।’
-‘সুখান পাগলার মতো?’
-‘কি জানি?আমি তো আর দেখিনি সুখান পাগলা ওর বউরে কেমন ভালোবাসতো।’
একটুখানি চুপ থেকে বিন্দু আবার বলল, ‘সত্যি ভালোবাসলে মানুষ পাগল হবেই। কেউ বাইরে থেকে তো কেউ ভেতর থেকে।’
বিন্দুর প্রস্থানও পরীর ঘোর কাটলো না। তবে বিন্দুর কথাটা বাস্তব। সত্যিকারের ভালোবাসা একটা মানুষ কে পাগল বানিয়ে দেয়। প্রিয় মানুষকে হারানোর যন্ত্রনা সবাই সহ্য করতে পারে না। যারা সহ্য করতে পারে তারা মন থেকে ভেঙে পড়ে। আর যাদের সহ্য হয়না তারা মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে পাগল হয়ে যায়। শরীরের ক্ষত সারানো গেলেও মনের ক্ষত সারানো সম্ভব না।
পুরোনো স্মৃতি আকড়ে ধরে বেঁচে থাকা অনেক কঠিন। প্রতিদিন মৃত্যু সমতুল্য যন্ত্রণা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়। অভাব,অনটন,টাকা পয়সা হীন,অসহায় হয়েও বেঁচে থাকা যায় কিন্ত বেদনাময় অতীত কে সাথে নিয়ে বেঁচে থাকা অধিকতম কষ্টকর। তার জলজ্যান্ত প্রমাণ সুখান পাগল। নিজের প্রিয়তমাকে হারিয়ে সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। তার স্মৃতিচারণ করতে করতে আজ সে এমন স্থানে এসেছে যে এখন তার স্মৃতিতে তার প্রিয়তম ছাড়া অন্য কিছুই নেই।
পরী শুধু ভাবছে কীভাবে মানুষ এতো ভালোবাসতে পারে? কই সে তো পারছে না কাউকে ভালোবাসতে। তার জীবনে তো কেউ আসেনি এখনো। কীভাবে সে বুঝবে যে একটা মানুষ তাকে ভিশন ভালোবাসে?
সোনালী,বিন্দু আর সুখান নিজেদের ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছে। পরীকে কে কেউ কি তার ভালোবাসার প্রমাণ দেবে না? নাকি পরী নিজেই তার ভালোবাসা খুঁজে নেবে?কিন্ত কীভাবে?

#চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here