পরীজান পর্ব -১৬+১৭

#পরীজান
#পর্ব ১৬
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌

হারিকেনের জ্বলন্ত অগ্নিশিখা কাঁপছে। এমনি এমনি নয়,মৃদু বাতাস বইছে যার ফলে অগ্নিশিখা দুলে চলছে। শায়েরের দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পরী। এখন তো শায়ের আবার ওকে অপমান করবে বৈঠকে আসার জন্য। যার জন্য এতো রাতে এলো তাতেও কাজ হলো না। সেই শায়েরের মুখোমুখি হয়েই গেল। রাগে পরী তাই ফিরেও তাকালো না। সে চুপচাপ ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।
-‘দাঁড়ান!!’ পা দুটো আপনা আপনিই থেমে যায় পরীর। ঘোমটা টা আরো বড় করে টেনে ঘুরে দাঁড়াল। শায়ের পরীর দিকে এগিয়ে এসে বলে,’এতো রাতে আপনি এখানে কেন এসেছেন?’
-‘সেই কৈফিয়ত কি আমি আপনাকে দেব?’
হাসলো শায়ের তবে শব্দ হলো না।
-‘জানতে চেয়েছি কৈফিয়ত চাইনি। আপনার ইচ্ছা না হলে বলবেন না। তবে রাতের বলা বৈঠকে আসবেন না। এখানে নতুন দুই পুরুষের আগমন ঘটেছে। তারা কেমন তা না জানা পর্যন্ত এখানে না আসাই ভালো।’

-‘আমার সুরক্ষা আমি নিজে করতে জানি।’
-‘পুরুষের শক্তির সামনে নারীর শক্তি যে নগন্য ছোট কন্যা।’
ছোট কন্যা নামটি শুনে পরী অবাক চোখে তাকায় শায়েরের দিকে। এটা কেমন নাম? শায়ের কমপক্ষে সাত আট বছরের বড় পরীর থেকে। সেক্ষেত্রে সে পরীকে নাম ধরে ডাকতেই পারে। কিন্ত তা শায়ের কখনোই করে না। আপাতত এসব না ভেবে পরী শায়েরের কথার জবাব দিলো,’পরীক্ষা করতে চান তো পারেন। এই লাঠিয়াল পরীর সাথে পারেন কি না?’
-‘আমি মেয়েদের সাথে লড়াই করি না। মেয়েরা ফুলের মতো। তাদের শুধু ভালোবাসার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। লড়াই করার জন্য নয়।’
থমকালো পরী। হারিকেনের আলোয় ভাল করে তাকালো শায়েরের পানে। ছেলেটার চোখে সুরমা সবসময়ই থাকে। এতে ভিশন মায়াবী লাগে শায়ের কে। মুখ দিয়ে যেমন সুন্দর কথা বের হয় তেমনি চোখ দিয়ে ও মায়া ছড়ায়। পরী কেমন যেন ঘোরের মধ্যে পড়ে গেল। মাথা ঘুরে উঠলো তার। আর কিছুক্ষণ থাকলে হয়ত সে জ্ঞান হারাবে। তবুও পরী শায়েরের এই কথাটার ও জবাব দিলো,’ভালো কথা জানেন আপনি। তা বিয়ে করে নিলেই পারেন। দিন রাত বউকে সুন্দর সুন্দর কথা শোনাবেন।’
ওষ্ঠাধরে সূক্ষ্ম হাসির রেশ দেখা দিলো শায়েরের। সে শান্ত গলায় বলল,’বউ তো আছেই শুধু তিন কবুল পড়ে ঘরে তোলা বাকি। কিন্ত এই গরিবের যে ঘর নেই। আছে মন,আর মন দেখে তো আর কেউ আমার কাছে আসবে না।’
রাগ থাকলেও শায়েরের কথাগুলো মুগ্ধ করছে পরীকে। ওর কথাতে শুধু মায়া নয় ভালোবাসা ও জড়ানো। যা শুধু পরী নয় যে বা যারা শুনেছে তারাই মুগ্ধ হয়েছে শায়েরের প্রতি। পরী এবার কোন কথা বলে না। চুপ করে তাকিয়ে রইল।
-‘আপনি নূপুর খুঁজতে এসেছেন তাই না?কিন্ত আপনি তো এখানে আসেন না তাহলে নূপুর পড়বে কেন?’
একটু ভেবে শায়ের আবার বলে উঠল,’হবু বরের সাথে দেখা করতে এসেছেন নাকি?’
নওশাদের কথা শুনে গায়ে জ্বালা ধরে গেল পরীর। রাগে গজ গজ করে বলল,’বাজে কথা বলবেন না।আর ওটা কোথায় ঘুমিয়েছে এখনই ওটাকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবো।’
-‘বরকে মারলে আপনি যে বিধবা হবেন বিয়ের আগেই। তাছাড়া এখনই গোবরে ফেলে যে অবস্থা করেছেন বেচারা খুব তাড়াতাড়ি মরবে বোধহয়।’

শায়ের জানলো কিভাবে এসব পরীর কল্পনা?একটু ভয় ও পেলো পরী। শায়ের যদি সবাইকে বলে দেয় তাহলে কি হবে? মালা তো পরীকে খুব মারবে। পরী নিজের ভয় লুকিয়ে বলে,’ভুলে যাবেন না সামান্য এক কর্মচারী আপনি। জমিদার কন্যার দিকে আঙুল তোলার সাহস হলো কিভাবে আপনার?’

শায়ের মাথা ঝুঁকে বলে,’ক্ষমা করবেন ছোট কন্যা আমার বড় ভুল হয়ে গেছে।’
কথাটা বলে পকেট থেকে একটা মলমের কৌটা বের করে এগিয়ে দিলো সে। সকালে পরীর পা চিনতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি তার। সেদিন রাতে পরীর হোঁচট খাওয়া ও চোখ এড়ায়নি। পরীর পা যে অনেক খানি ছড়ে গেছে। সেদিকে পরীর খেয়াল নেই। পায়ে ব্যথা অনুভব করলেও পরী তাতে পাত্তা দেয় না। তবে শায়ের তা ঠিকই দেখেছে। তার কাছে মলমের কৌটা ছিল তাই সে সেটা পরীকে দিলো।
-‘আপনার পায়ে আঘাত পেয়েছেন। এটা লাগিয়ে নিলে ঠিক হয়ে যাবে।’
পায়ের জ্বালা তো মিটানো যাবে কিন্ত পরীর মনের জ্বালা কে মেটাবে??শায়ের যে ওকে অপমান করেছে তা আবারও মনে পড়ে গেল। ওর কারণেই তো সে ব্যথা পেয়েছে। ব্যথা দিয়ে আবার মলম দেওয়া হচ্ছে। রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে পরী চেপে ধরে শায়েরের হাত। এতে চমকে যায় শায়ের। হাতটা টেনে হারিকেনের কাচের গায়ে চেপে ধরে হাতের তালু। প্রচন্ড গরম সে কাচ। আগুনের আচে যেন দ্বিতীয় অগ্নিশিখা। হাত পুড়ে যাচ্ছে শায়েরের। তবুও সে কিছু বলছে না। চোখদুটো বন্ধ করে রেখেছে। পরী ছেড়ে দিলো শায়েরের হাত। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’মলমটা এখন আপনার কাজে লাগবে।’

দ্রুত পদে পরী এগিয়ে গেল অন্দরের দরজার দিকে।কিন্ত শায়েরের বলা বাক্যে সে থেমে গেল আবার। শায়ের বলছে,’সামান্য কর্মচারীকে তো ছুঁয়ে দিলেন ছোট কন্যা।’
পরী পেছন ফিরে না তাকিয়েই জবাব দিলো,’এটা মধুরতম ছোঁয়া নয় শাস্তির ছোঁয়া।’
দরজার খুলে পরী চলে যেতেই শায়ের নিজের পোড়া হাতের দিকে তাকালো। ইতিমধ্যেই কালচে হয়ে গেছে হাতটা। এই হাতে এখন ওর কাজ করা মুশকিল হবে। এই মেয়েটা প্রচন্ড জেদি আর রাগি। রাগ নাকের ডগায় সবসময়ই থাকে। জমিদার কে না জানি কত কিছু পোহাতে হয়। মাঝে মাঝে আফতাবের প্রতি মায়া হয় শায়েরের। এমন জল্লাদ মেয়ে সে আর দুটো দেখেনি। নওশাদের কপালে যে আর কি কি আছে তা ভেবেই সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। হাতের তালুতে অপর হাত বুলাতে বুলাতে নিজের ঘরে চলে গেল।

আজ ঘুম থেকে উঠে সাবধানের সহিত পা ফেলে নওশাদ। চারিদিক সতর্কতার সাথে চক্ষু বিচরণ করলো। নাহ কোথাও গোবর নেই। খুশিমনে সে কলপাড়ে চলে গেলো। তবে অসাবধানতার বসে পা পিছলে পড়ে গেল। ফলে বাম পা মচকে গেছে। ব্যথায় নীল হয়ে গেল ফর্সা চেহারা তার। ওঠার চেষ্টা করেও উঠতে পারলো না।
নওশাদের পা মচকে গেছে শুনে অন্দরের সবাই এলো দেখতে। পরী আর আবেরজান এলো না। পরীর তো নিষেধাজ্ঞা আছে আর আবেরজান এর শরীর ভাল না। কোথায় হবু জামাই এর সাথে জমিয়ে গল্প করবে!! তাই তার মনটা ভীষণ খারাপ। এই শরীর নিয়ে সে পারে না বেশি হাটাচলা করতে। আর তার ঘরটাও দোতলায়। সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা কষ্টকর। তাই তিনি আসতে পারলেন না। নওশাদ ব্যথায় কাতরাচ্ছে কবির চিন্তিত হয়ে বসে আছে।

-‘কবির তুমি বরং ওকে শহরের কোন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। তাহলে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।গ্রামে তো ভালো ডাক্তার নেই।’
আখিরের কথায় কবির ও সায় দিল। কারণ অবস্থা সুবিধার ঠেকছে না কবিরের কাছে। নওশাদ প্রথমে অমত পোষন করলেও পরে রাজি হয়। কবির নওশাদকে নিয়ে বের হয়ে গেল।
রুপালি আর মালা ঘাটে গিয়ে ওদের নৌকায় তুলে দিলো। মালা আগে আগে চলে গেলেও পেটের ভারে আস্তে আস্তে হাটছিল রুপালি। আচানক আখিরের সামনে পড়ল সে। আখির রুপালিকে ভাল করে দেখে বলে,’আসার পর তো একবার দেখা করলি না? তা কি খবর তোর?’
ঘৃণায় চোখ সরিয়ে নিলো রুপালি। এই মানুষ টাকে সে মন প্রাণ দিয়ে ঘৃণা করে। শুধুই রুপালি নয়। সোনালী,মালা আর সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে পরী। রুপালি অন্যদিকে তাকিয়েই বলে,’আপনাকে দেখে আমার রুচি নষ্ট করার ইচ্ছা ছিলো না।’
-‘ক’দিন পর বাচ্চার মা হবি আর এখনও এত তেজ কোথা থেকে আসে তোর? সম্পর্কে আমি তোর কাকা হই ভুলে গেছিস?’
-‘আমি ভুলিনি কিছুই। কিন্ত আপনি ভুলে গেছিলেন আপনি আমাদের কাকা। তাই তো নিজের হিংস্র থাবা মেরেছিলেন সোযোগ বুঝে। সোনালী নরম ছিল আর আমিও কিছুটা দুর্বল ছিলাম। কিন্ত পরী ছিল না। তাইতো পরীর হাতেই আপনার পতন ঘটেছিল। আপনার অবস্থা দেখে আমার হাসি পায়। এখন শুধু আপনার ওই নোংরা চোখদুটো উপড়ে ফেলা বাকি।’

-‘তোর সাহস তো কম না আমাকে শাসাস!!ভয় দেখাস আমাকে??সেদিনের পুচকে মেয়ে। জীব টেনে ছিড়ে ফেলব তোর বাপ ও কিছু বলবে না।’

-‘পরীর কলিজায় হাত দেবেন এতো বড় কলিজা আপনার??ওই কলিজায় তলোয়ার চালাতে পরীর হাত কাঁপবে না। সাবধান,আপনাকে কিন্ত পরী ছেড়ে দিবে না।’
রুপালি আর কথা বাড়ালো না ধীর পায়ে চলে গেল। আখির ক্ষিপ্ত চোখে তাকিয়ে রইল রুপালির দিকে। এই মুহূর্তে তার খুন করতে ইচ্ছা করছে। কিন্ত তা সম্ভব না তাই নিজের অদম্য ইচ্ছাকে মনের ভেতর কবর দিলো।
অন্দরে পা ফেলতেই ঘৃণায় দুঃখে চোখের পানি ফেলে রুপালি। নিজের আপন কাকা যে ওদের ওপর লালসার হাত বাড়াবে তা রুপালি ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।
সময়টা ছিল রুপালির বালিকা বয়সের। আফতাব তখন সবে জেসমিন কে বিয়ে করেছে। বাবার প্রতি তখনও ক্ষোভ জন্মায়নি রুপালির। সে তখন ওসব বোঝে না। আখিরকে রুপালি খুব ভালো জানে। কাকা কাকা বলে গলা জড়িয়ে ধরতো দেখা হলেই। সেই সুযোগ টাই কাজে লাগালো আখির। হিংস্র থাবা দিলো ছোট্ট কোমল ফুলের উপর। কাকার আচরণ রুপালিকে অবাক করে দিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে সেদিন সোনালীর কাছে সব বলেছিল। ছোট্ট রুপালির মুখে আখিরের লালসার কথা শুনে কেঁদে ফেলেছিল সোনালী। তার নিজের সাথে ও একই ঘটনা ঘটেছে। তারপর থেকে আখিরের ধারে কাছে ঘেষতো না সে। আর এখন রুপালির দিকে হাত বাড়িয়েছে শয়তান টা। সোনালী সেদিন অনেকক্ষণ আরশিতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখেছিল। কি আছে এই সৌন্দর্যে?? যার কারণে আপন মানুষ পর্যন্ত ছাড় দেয় না?? নিজের সুন্দর চেহারাকে একটা অভিশাপ মনে করে সে। তার সৌন্দর্য ই পুরুষদের আকর্ষণ করে তাকে কেউ ভালোবাসে না। কিন্ত কালো কেও তো কেউ পছন্দ করে না। তাহলে কি কালো ও অভিশাপ?? সোনালীর মনে হচ্ছে মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়াই অপরাধ। কিন্ত আল্লাহ তো নারীদের স্থান সর্বোচ্চ করেছে। মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেস্ত রেখেছে। তাহলে তো নারীর মূল্য অনেক। কারণ প্রতিটা নারীই একদিন মা হবে। তবে দুনিয়ার পুরুষ কেন মেয়েদের লালসার শিকার বানায়?? অনেক কেঁদেছিল সোনালী বারবার প্রার্থনা করেছিল আল্লাহ যেন ওর রূপ ফিরিয়ে নেয়। দরকার নেই এই সৌন্দর্যের।
কিন্ত যেদিন আখির পরীর দিকে নিজের থাবা দিলো সেদিন ই ওর কাল হয়ে দাঁড়াল। সেদিনের পর কয়েক বছর পার হয়ে যায়। পরী সবে ছয় শেষ করে সাতে পা দিয়েছে। সোনালী আর রুপালি সবসময়ই পরীকে আখিরের থেকে দূরে রাখতো। ওরা চাইতো পরী যেন এই ঘটনার সম্মুখীন না হয়। কিন্ত ভাগ্যবশত সেই একই ঘটনা পুনরাবৃত্তি করে আখির। পরী দৌড়ে গিয়ে খুশিমনে কাকার কোলে চড়ে বসে। পরীর সুন্দর কোমল দেহে লালসার হাত বিচরণ করতে বড়ই ভালো লাগলো আখিরের কিন্ত পরী কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। ছোট্ট পরী বুঝে গেল আখিরের উদ্দেশ্য। তবুও সে চুপ করেই রইল। পরীর হাত টেনে আখির নিষিদ্ধ স্থানে রাখতেই পরী মুখ খিচে ফেলে। রাগটা মাথায় চড়ে বসে। আখির দেখতে পায় না পরীর লাল আভা ছড়ানো মুখখানা।
হাতে চাপ প্রয়োগ করে পরী। একধ্যানে সামনের দিকে তাকিয়েই হাতের চাপ আস্তে আস্তে বৃদ্ধি করে সে। আখির ঘাবড়ে যায় পরীর কাজে। ঠেলে সরিয়ে দিতে চায় পরীকে। কিন্ত তার শক্তি সে হারিয়েছে। পরী এতো জোরে তাকে ধরেছে যে আখির নিজের শরীরের ভর ছেড়ে দিলো। এখন তার নিঃশ্বাস দিতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্ত পরী তাকে ছাড়ছে না। সে পরীকে কিছু বলতেও পারছে না। প্রথম দিকে সে পরীকে চড় থাপ্পড় মেরেছে ধারালো নখ দাবিয়ে ও দিয়েছে। কিন্ত লাভ হয়নি। এই মুহূর্তে পরী হিংস্র হয়ে গেছে। তাকে থামানো কষ্টকর। ওদিকে মুখ দিয়ে বুদবুদ বের হচ্ছে আখিরের। ঠিক তখনই ছুটে এলো পরীর দুবোন। টেনে ছাড়িয়ে আনলো আখিরের থেকে। আখির মাটিতে গড়াগড়ি করতে লাগল। কিন্ত পরী থেমে রইল না। ছুটে গেল রন্ধনশালায়। বটি নিয়ে আবার দৌড় দিলো। মেয়েকে এভাবে বটি নিয়ে ছুটে যেতে দেখে মালাও ছুটে গেল।
সোনালী পরীকে টেনে ধরে আর রুপালি বটি কেড়ে নিল। পরীকে এখন না থামালে খুন সে করেই দেবে। পরীর চিৎকারে জুম্মান কে কোলে নিয়ে ছুটে এলো জেসমিন। উপস্থিত ঘটনা দেখে সেও ঘাবড়ে গেছে। কি হয়েছে জানতে চাইছে। পরী গলা ছেড়ে বলে, ‘আমাকে ছেড়ে দাও আপা। জা**রের বাচ্চাকে আমি আজ খুন করেই ছাড়বো। ওর রক্ত দিয়ে গোসল না করা পর্যন্ত আমি পরী শান্ত হবো না।’
মালা পরীকে টেনে দুটো থাপ্পড় লাগালো তারপর পরীকে নিয়ে ওর ঘরে আটকে রাখলো। জেসমিন খবর পাঠায় আফতাবের কাছে। আখিরের অবস্থা ভাল না তাই তাকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেদিন সোনালী,রুপালি প্রথম মায়ের কাছে সব খুলে বলে। এর আগে আখিরের হুমকির সম্মুখীনে পড়ে কাউকেই তারা কিছু বলেনি। কিন্ত আজ বলে দিচ্ছে। দুই মেয়েকে বুকে চেপে ধরে মালা। অশ্রুজলে ভাসায় বুক। সৌন্দর্য যে মালাকেও এই পরিস্থিতির সামনে দাড় করিয়েছিল। মা মেয়েরা যেন এক লালসার প্রাণী যে সবাই থাবা মারে।
তবে সেদিনের পর নিজের পুরষত্ব হারায় আখির। ডাক্তারের অনেক চেষ্টায় প্রাণ ফিরে পেলেও নিজের পুরষত্ব ফিরে পায় না। যার কারণে আখির আজও পরীর উপর ক্ষ্যাপা। আর পরীর মাথায় চাপা প্রতিশোধের আগুন এখনও আছে। প্রাণ চায় সে আখিরের।
কিন্ত ওই ঘটনার পর থেকে মালা পরীকে নিয়ে আরো সচেতন হয়। মালা বুঝে যায় পরী আখিরের থেকে প্রতিশোধ তুলবেই। প্রয়োজনে আফতাবের উপর আক্রমণ করতেও পিছ পা হবে না। বাপ মেয়ের লড়াই থামাতে পরীকে ঘরবন্দি করে রাখে সে। কিন্ত সোনালী চলে যাওয়ার পর আফতাব নিজেই সবাইকে অন্দরে বন্দি করে দেয়।
কিন্ত এতবছর পরও প্রতিশোধের আগুন একটুও কমেনি পরীর। আখির ও পরীর প্রতি জন্মানো ক্ষোভ যত্ন করে পুষছে। কখন যে চাচা ভাতিজীর যুদ্ধ শুরু হয় তা এখন কেউই বুঝতে পারবে না। কারণ দুজনেই ঠান্ডা মাথার খিলাড়ি।

—-
দুপুরে খেতে বসে শায়ের পড়লো বিপদে। ডান হাত টাই পুড়িয়ে দিয়েছে পরী। এখন সে খাবে কিভাবে?? সকালে দুটো রুটি খেয়েছিলো বিধায় তেমন সমস্যা হয়নি কিন্ত এখন তো ভাত মেখে খেতে হবে। শায়ের পারলো না খেতে। মালা শায়ের কে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল,’কি হইলো শায়ের??খাওনা ক্যান??’
ইতস্তত করে শায়ের প্লেটে হাত রাখতেই মালার চোখ পড়ল ওর হাতে। মৃদু চিৎকার দিয়ে মালা বলে উঠল, ‘ওমা,হাতের এই অবস্থা হইলো ক্যামনে?? এখন খাবা ক্যামনে??’
শায়ের মাথা নিচু করে বলে,’হারিকেনের সাথে লেগে পুড়ে গেছে।’
-‘একটু দেইখা কাম করবা তো!!আহারে কতখানি পুইড়া গেছে!!আহো আমি খাওয়াইয়া দেই।’
-‘নাহ বড়মা আমি পারব।’

-‘কথা কইয়ো না। তুমি তো আমার ছেলের মতোই। আমার সোনালীও তো তোমার বয়সী আছিলো। আমি খাওয়াইয়া দিতাছি।’
#পরীজান
#পর্ব ১৭(প্রথমাংশ)
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌

মায়ের ভালোবাসা কপালে লেখা নেই শায়েরের তাইতো অকালে মাকে হারাতে হয়েছে। মাকে কখনো বলতে পারেনি যে,মা আজ তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাবো। আর তুমি আমাকে গল্প বলবে। সেই গল্প শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে পড়বো। এটা ওটা বায়না করা হয়নি মায়ের কাছে। আঁচলে মুখ মোছা হয়নি। একটু খানি মাতৃত্বের গন্ধ ও নাকে ঢেউ খেলেনি। কারণ তাকে জন্ম দিয়েই সে পরলোকগমন করেছেন। তাইতো শায়েরের জীবনটা অতি বিষাদময় কেটেছে। শৈশব কেটেছে আরো অবহেলায়। এতগুলো বছর পর কেউ তাকে খাইয়ে দিচ্ছে ভাবতেই ভালো লাগছে ওর। মালা পরম যত্নে খাবার তুলে দিচ্ছেন শায়েরের মুখে। আর শায়ের বাচ্চাদের মতো খাচ্ছে। খাওয়া শেষ করে বাইরে এসে চোখের কোণে জমে থাকা জলটুকু সযত্নে মুছে নিলো সে।
মালা যে শায়ের কে খাইয়ে দিয়েছে তা পরীর কানে যেতে সময় লাগলো না। পরীর চামচা কুসুম গিয়ে বলে,’জানেন পরী আপা বড় মায় শায়ের ভাইরে খাওয়াইয়া দিছে আইজ। ভাইয়ের হাত নাকি পুইড়া গেছে। আমি নিজের চক্ষে দেইখা আইলাম।’

-‘কি বলিস??আচ্ছা আম্মাকে কিছু বলছে সে??’
-‘কি কইবো??’
-‘হাত পুড়েছে কিভাবে??’
-‘কইলো তো হারিকেনে পুড়ছে।’
পরী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ভয় পেয়ে গিয়েছে সে। যদি শায়ের ওর নাম বলতো তাহলে মালা ওর হাতটাও পুড়িয়ে দিতো। কিন্ত মালা শায়ের কে খাইয়ে দিয়েছে শুনে মুখ বাকিয়ে সে বলে,’সামান্য একটা কাজের ছেলেকে আম্মা খাইয়ে দিলো!!’

-‘কি করবে কন আপা। একে তো হাত পুইড়া গেছে। তার উপর জ্বর উঠছে। নিজের বাড়িও যাইতে পারব না। মা নাই তো। কে সেবা করবো?ভাইডা অনেক ভালা আপা।’
মনক্ষুণ্য হলো পরীর কথাটা শুনে তবে অতটা খারাপ লাগলো না। কারণ মা হারা শায়েরের কষ্ট টা সে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারলো না। মা হারা সন্তানের কষ্ট সেই বোঝে যে মা হারিয়েছে। মায়ের আঁচলের নিচে থেকে অতি আদরে বড় হয়েছে পরী। তাই সে শায়েরের কষ্ট বুঝবে কি??

কবির নওশাদকে নিয়ে বাড়ি চলে গেছে। কেননা নওশাদের পা কেবল মচকায়নি। বাজে ভাবে ভেঙে গেছে। তাই কবির নূরনগরে না এসে নওশাদের বাড়ি চলে গেছে। ডাক্তার পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে ওষুধ ও দিয়েছে। একজনকে দিয়ে আফতাব কে খবর পাঠিয়েছে কবির।
খবরটা জানার পর সবচেয়ে বেশি খুশি হলো পরী। যাক আপদ বিদায় হয়েছে। এখন সে দুই রাকাআত নফল নামাজ পড়বে। মোনাজাতে পরী আল্লাহ কে বলেছিল,’আল্লাহ ওই নওশাদকে তুমি আমার কপাল থেকে উঠাইয়া নাও তাহলে দুই রাকাআত নফল নামাজ পড়বো।’
আল্লাহ পরীর দোয়া কবুল করেছে। তাই পরীও নফল নামাজ পড়বে। খুশিমনে পরী নিজের ঘরে চলে গেল।

অক্টোবর মাস,,,,,

বন্যার সমাপ্তি ঘটেছে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে। পুরো তেত্রিশ দিন প্রলয়কারি বন্যা ছিলো। বাংলাদেশের ৬৮ শতাংশ ডুবে গিয়েছিল এ বন্যায়। সেই দুর্ভিক্ষ এখনও নূরনগরের বাসিন্দারা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পুনরায় নিজেদের ঘরবাড়ি ঠিক করে কোনমতে জীবনযাপন করছে। তবে অভাব তাদের ফুরাচ্ছে না। তাই গ্রামের অধিকাংশ পুরুষই শহরে পাড়ি জমিয়েছে। সম্পান মাঝিও শহরে গেছে। পদ্মা তো তার সব জল নিয়ে গেছে। এখন আর মাঝিগিরি করলে তার পোষাবে না। বিন্দুকে নিজের ঘরোনি করতে হবে তো। কাজ না করলে মহেশ কি তার হাতে বিন্দুকে তুলে দেবে?? সম্পান ভেবেছে ফেরার সময় বিন্দুর জন্য লাল রঙের শাড়ি কিনে আনবে। এর আগে আনতে চেয়েছিল কিন্ত আচানক পালকের মৃত্যুতে তা আর হয়ে ওঠেনি। কিন্ত এখন সে বিন্দুর জন্য নিজে পছন্দ করে শাড়ি নিয়ে যাবে।

সম্পানের ভাগ্য ও ভালো বলা বাহুল্য। গ্রামে আসতেই পথে বিন্দুর দেখা। সম্পান খুশি হয়ে বিন্দুর কাছে এগিয়ে গেল। শাড়ির ব্যাগটা বিন্দুর হাতে দিয়ে সুধালো,’দ্যাখ বিন্দু তোর লাইগা শাড়ি আনছি।’

শাড়িটা বের করে খুশিতে বিন্দুর চোখজোড়া চকচক করে উঠলো। চোখে খুশির ঝিলিক দেখে সম্পান ও খুশি হলো। শাড়ি থেকে চোখ সরিয়ে সম্পানের দিকে তাকিয়ে বিন্দু বলল,’শাড়িটা খুব সুন্দর হইছে গো।’
-‘ব্যাগের মধ্যে আরো একখান জিনিস আছে।’

বিন্দু ব্যাগ হাতে বড় একটা সিঁদুর কৌটা বের করলো। বিষ্মিত চোখে তাকালো সম্পানের দিকে। শ্যামা কন্যা বিন্দুর মুখে তৃপ্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই পুরুষ কে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এতো নিখুঁত ভাবে একমাত্র সম্পান ই পারে ভালোবাসতে।

-‘আমি অপেক্ষা করতাছি তোরে এই সিঁদূর পরানের।’

-‘খুব তাড়াতাড়ি সেইদিন আইবো??’
-‘হ রে বিন্দু। আমি আর বেশি দেরি করমু না বিন্দু। এইবার শহরে গেলে বিয়ার সবকিছু কিইনা আনমু।’

একটু লজ্জা পেলো বিন্দু। নিজের বিয়ের কথা শুনলে সব মেয়েরাই লজ্জা পায়। তেমনি বিন্দুও পেলো। মনের ভেতর লুকিয়ে রাখা ভালোবাসা সবটুকু সে সম্পান কে দিতে চায়। আঁকতে চায় ছোট একটি সুখি পরিবারের ছবি। সেখানে একটি ছোট্ট গ্রাম আর ছোট্ট একটি পরিবার থাকবে। মনে মনে নিজের ইচ্ছেগুলো পোষন করে সম্পানের পিছু পিছু হাটা ধরে বিন্দু। কাঁচা রাস্তায় কিছুক্ষণ হাটার পর দুজন আলাদা পথ ধরে। রাস্তার পাশের ধান ক্ষেতের আইল বরাবর বিন্দু নেমে পড়ল। আর সম্পান রাস্তার পথ ধরলো। দুকদম এগিয়ে থেমে গেল বিন্দু। পেছন ফিরে গলা ছেড়ে ডাকলো সম্পান কে।
-‘বিন্দুর মাঝে কি এমন দেখলা যে তোমার বিন্দুরেই লাগবো??’

সম্পান হেসে বলে,’বিন্দুরে দেখার পর তো আর কাউরে দেখি নাই। দুনিয়ার সবচাইতে সুন্দর মাইয়ারা যদি আমার সামনে আসে তাগো মাঝে আমি এই বিন্দুরেই খুজমু। আমার খালি বিন্দু হইলেই চলবো।’

বিন্দু এ লজ্জা কোথায় লুকাবে??লাল শাড়িটি দিয়ে মুখ ঢেকে সামনের দিকে দৌড় দিলো। তবে লজ্জাবতীর লজ্জা লুকাতে পারলো কই??ধান ক্ষেতের প্রতিটা শীষ দেখে নিলো। স্বাক্ষী রইলো আকাশ, হাওয়া আর গগনে উড়ে চলা একঝাক পাখি। কিন্ত শ্যামলতা বিন্দু ভাবলো তার লজ্জা সে আড়াল করে ফেলেছে। সম্পান দূর থেকেই বিন্দুর দৌড়ানো দেখছে। কিছুদূর গিয়ে ধপ করে মাটিতে পড়ে গলো বিন্দু। উঠে আবার দৌড় লাগালো। সেই দৌড় গিয়ে থামলো জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গনে।

বন্যা শেষে জমিদার বাড়ির চেহারা পাল্টে গেছে। আগের মতো নেই। দরজার বাইরে কড়া পাহারা। ছয়জন মিলে বাইরে পাহারা দিচ্ছে। বৈঠকে ও দুজন আছে। আগের কঠোর রূপ ধারন করেছে জমিদার বাড়ি। যেখানে প্রবেশ করতে হলে আফতাবের অনুমতির প্রয়োজন। জমিদার বাড়ির বিশাল প্রাঙ্গনে গাড়ি ভিড়েছে চার খানা। তিনখানা ভ্যানগাড়ি হলেও একখানা গরুর গাড়ি। গাড়িতে মালপত্র ওঠাচ্ছে দুজন। কেমন একটা সাজ সাজ রব। অবাক নয়নে সব দেখতে দেখতে বিন্দু পা বাড়ায় বৈঠকে ঢোকার বিশাল দরজায়। লতিফের অনুমতি পেয়ে বৈঠক পেরিয়ে অন্দরে পা রাখলো বিন্দু।
কুসুম ব্যতীত আরো তিনজন কাজের মেয়ে রাখা হয়েছে। তারা এই গ্রামেরই মেয়ে। চিনতে খুব একটা অসুবিধা হলো না বিন্দুর। তবে তাদের সাথে কথা না বলে বিন্দু গেলো তার প্রিয় সখির কাছে।

পরীকে আজ নতুন নতুন লাগছে। নতুন পোশাকে তৈরি করছে নিজেকে পরী। দেখে মনে হচ্ছে কোথাও যাবে সে। বিন্দু ঘরে ঢুকেই বলল,’পরী কই যাবি তুই??জেডি তোরে যাইতে দিবো??’
ঘাড় ঘুরিয়ে প্রাণখোলা হাসি হাসে পরী। দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বিন্দুকে।
-‘পরী ছাড় আমারে। আমার কাপড় নোংরা তোর কাপড় নষ্ট হইবে তো!!’
পরী বিন্দুকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,’তোকে না বলেছি এসব কথা না বলতে? শরীরে ময়লা তো কি হয়েছে তোর মনটা তো পরিষ্কার।’

-‘নাহ,তুই কোথাও যাবি তাই কইলাম। তা যাবি কই??’
-‘রুপা আপার শ্বশুরবাড়ি। আপার ননদের বিয়ে। আমাদের যেতে বলেছে। তাই যাচ্ছি।’
-‘জেডি তোরে নিবো??’
-‘না নিয়ে যাবে কই!!আপার শ্বশুর যেভাবে বলে গেছে না গিয়ে উপায় নেই। তাই আমিও যাচ্ছি।’
-‘ওহ,পরী তোর কাছে একখান জিনিস রাখতে দিমু রাখবি??’
কথা শেষ করেই সিঁদূর কৌটোটা বাড়িয়ে দিল পরীর দিকে। বিন্দুর হাতে থাকা লাল শাড়ির দিকে এতক্ষণে চোখ পড়ল পরীর। সুন্দর শাড়িতে হাত বুলিয়ে বলে,’কে দিলো এই শাড়ি??’
বিন্দু সম্পানের দেওয়া শাড়ি আর সিঁদূর কৌটোর কথা খুলে বলল। পরী সযত্নে সিঁদূর কৌটোটা আলমারিতে তুলে রাখে। বেশি সময় নেই তার তাই সখিকে বিদায় দিলো।
কালো বোরখাটা গায়ে জড়িয়ে নেকাপ বেধে নিলো।
তারপর নিচ তলায় গেলো। মালা,জেসমিন,জুম্মান সবাই তৈরি। আবেরজান যেতে পারবে না। তার সে ক্ষমতা নেই। দুজন কাজের মেয়েকে রেখে গেলো আবেরজানের কাছে। কুসুম আর নতুন কাজের মেয়ে শেফালিকে সাথে নিলো।
গরুর গাড়ি আনা হয়েছে পরীর জন্য। কেননা গরুর গাড়ি চড়তে পরী খুব পছন্দ করে। তাই তো এ ব্যবস্থা করা হয়েছে। মালা,জেসমিন ওঠে এক গাড়িতে।আফতাব আর আখির অন্য গাড়িতে। শায়ের সহ আরও দুজন উঠেছে অপর গাড়িতে। গরুর গাড়িতে পরীর সাথে জুম্মান,কুসুম আর শেফালি। পরীকে দেখে রাখার জন্যই ওদের সাথে দিয়েছে মালা।
কাঁচা মাটির রাস্তায় হেলেদুলে চলছে গরুর গাড়ি। পরীর ভিশন ভালো লাগছে। মাটির গন্ধ আসছে নাকে। সাথে গ্রামের দৃশ্য। নেকাবের নিচে হাস্যজ্বল চোখে সব দেখছে পরী। হঠাৎই রাস্তার পাশে নাম না জানা বেগুনি রঙের ফুলে চোখ আটকে গেল পরীর। ফুলের প্রতি প্রতিটি নারীর টান অনবদ্য। পরী ফুল ছোঁয়ার লোভে গাড়ি থামিয়ে কুসুম কে পাঠালো ফুল ছিড়ে আনতে।
গাড়ি থেকে নেমে কুসুম ছুটলো সেদিকে। কিন্ত ফুলে হাত দিতেই ঘটলো অঘটন। পাশে কদম গাছের নিচে বসে থাকা সুখান পাগলকে সে খেয়াল করেনি। কুসুম ফুলে হাত দেওয়ার আগেই সুখান পাগল তার হাত টেনে ধরে। চেঁচিয়ে বলে,’তুই আমার রানীর ফুল ছিড়বি?ওই ছেমরি! তোর চুল আমি সব ছিইড়া ফালামু।’
ভয়ে কলিজা শুকিয়ে গেছে কুসুমের। পরীর আদেশে সে ভুলেই গিয়েছে যে এখানে সুখান থাকে। সুখান চুল টেনে ধরে কুসুমের। কুসুম এক চিৎকার দিলো,’পরী আপা আমারে বাঁচান।’
চমকে গাড়ির ভেতর থেকে উঁকি মারে পরী। শেফালি জুম্মান ততক্ষণে নেমে পড়েছে কিন্ত সুখানকে দেখে ওরা আগানোর সাহস পেলো না। কুসুম চিৎকার করে বলছে,’আমি তোর রানীর ফুল ছিড়মু না ছাড় আমারে।’
-‘তোরে ছাড়লে তুই আবার ফুল ছিড়বি!!’
– ‘আল্লাহ গো আমারে রক্ষা করো তাইলে আমি পাগলরে ভিক্ষা দিমু।’
লাঠি হাতে গাড়ি চালক এগিয়ে গিয়ে কুসুম কে ছাড়িয়ে আনলো। কাঁদতে কাঁদতে কুসুম গাড়িতে উঠতেই পরী বলল,’আমি বুঝিনি কুসুম যে ওখানে পাগলটা থাকে। তাহলে আমি তোকে যেতে বলতাম না।’
কুসুম রাগ করে হাটুতে মুখ গুঁজে বসে রইল। একে তো ভয় পেয়েছে তার উপর চুলের ব্যথা। সেজন্য কাঁপছে কুসুম। পরীর মন খারাপ হল তা দেখে।
জুম্মান প্রশ্ন করে বসে,’আপা রানী কেডা? ওই পাগলটা রানী কইলো কারে??’
জবাব টা পরী দিতে পারলো না। সে জানে না তবে শেফালি বলল,’সুখান পাগলার বউ রানী। আগে ও ভালাই আছিলো কিন্ত বউ মরার পর পাগল হইয়া গেছে। গ্রামের সবাই এইয়াই কয়।’
পরী অবাক হয়ে বলে,’ভালোবাসা মানুষ কে পাগল করেও দেয়??’
-‘যে সত্যি ভালোবাসে সে তো পাগল হইবোই।’

পরী আর কথা বলল না। সারা রাস্তা সুখানের কথা চিন্তা করতে করতে গেলো।
পরীদের আগেই বাকিরা পৌঁছে গেছে রুপালির শ্বশুরবাড়ি। পরীরা পৌঁছাতেই কয়েকজন মেয়ে এসে ওদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। আশেপাশে না দেখে মাথা নিচু করে পরী চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর জুম্মান এসে খবর দিলো এখানে নওশাদ ও এসেছে। সে লাঠিতে ভর দিয়ে হাটাচলা করছে। তার পা এখনো ঠিক হয়নি। পরী ভাবলো তাহলে কি নওশাদের সাথে পরীর বিয়েটা ভাঙতে চলছে???
#পরীজান
#পর্ব ১৭(শেষাংশ)
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌

দুই বিঘা জমির উপর কবিরদের বাড়িটি। চারখানা বড় বড় টিনের ঘর। চারভাই চার ঘরে থাকেন। রান্নাঘর গোসলখানা সব আলাদা। পুরো বাড়ির চারপাশে টিনের বেড়া দেওয়া। যাতে বাইরের পুরুষ ভেতরে না আসতে পারে। আম আর কাঁঠাল গাছে ভরা বাড়িতে। দুএকটা অন্য গাছও আছে। বাড়ির পেছনে শান বাধানো বড় একটা পুকুর আছে। সেখানে মাছ চাষ করা হয়। মাছ বিক্রি করে অনেক টাকা রোজগার হয় কবিরের। তাছাড়া পরীদের বাড়িতেও মাছ পাঠানো হয়। ফলমূল তো পাঠায়ই।
এছাড়াও কবিরসহ বাকি তিন ভাইয়ের ও বেশ কয়েক বিঘা জমি আছে।
বাড়িটা দেখলে যে কেউ এই বাড়িতে নিজের মেয়ে দিতে চাইবে। স্বনামধন্য পরিবারের মেয়েদের ই ঘরে তুলেছে রুপালির শ্বশুর। রুপালি এবাড়ির সেজ বউ। রুপালির বিয়ের ছ’মাস পর ওর দেওরের বিয়ে হয়।
তবে তিন জা মিলে হিংসে করে রুপালিকে। কেননা তারা রুপালির মতো অতো সুন্দর নয়। অতিরিক্ত সাজগোজ করেও রুপালির মতো সুন্দর তারা হতে পারে না। অথচ খুব সাদামাটা ভাবেই রুপালিকে কোন রাজকন্যার থেকে কম লাগে না। সবসময় রুপালির রূপে ঈর্ষান্বিত হন তারা। রুপালি সব বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে। কারণ এদের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করার কোন মানেই হয় না।

কিন্ত আজ তারা তিনজনই ছুটে এসেছে পরীকে দেখতে। কারণ এতোদিন ধরে তারা শুধু পরীর সুনামই শুনেছে কিন্ত চোখের দেখা দেখেনি। রুপালির বিয়ের পর এই প্রথম পরী এই বাড়িতে পা রাখলো। তাই ওনারা তিনজন ছুটে এলে পরীকে দেখতে।
পরী সবেমাত্র পালঙ্কের উপর বসেছে। নেকাব এখনো খোলেনি। তার মধ্যেই ওরা এসে হাজির। এসেই রুপালির বড় জা কাকলি বলে উঠল,’দেখি দেখি রুপার বোন কেমন দেখতে??’
মালা জেসমিন জলচৌকি পেতে বসে আছে পরীর কাছে। কুসুম গোমড়া মুখে জেসমিন আর মালাকে বাতাস করছে। শেফালি পরীকে বাতাস করছে। কাকলির কথা শুনে সবাই চমকে তাকালো। ততক্ষণে রুপালিও চলে এসেছে। পরীর ভাবান্তর না দেখে কাকলি আবার বলল,’কই নেকাব সরাও দেখি তোমার চাঁদবদন খানি!!’
বলেই খিলখিল করে হেসে উঠল তিনজন। পরী রুপালিকে জিজ্ঞেস করে,’আপা এখানে কোন পুরুষ আসবে না তো??’
রুপালিকে উওর দিতে না দিয়ে ওর মেজ জা পাখি বলল,’কেন গো??পুরুষ দেখলে তোমার রূপ কমে যাবে নাকি??’
হাসির ছলে অপমান করছে পরীকে তা পরী ঠিকই ধরতে পারলো। নেকাব খুলে আলতো হেসে বলল, ‘যেখানে এক নারী অন্য নারীর সৌন্দর্য দেখে হিংসা করে সেখানে পুরুষদের বিশ্বাস করি কিভাবে?? আপনাদের বর যদি আমাকে দেখে পাগল হয়ে যায় তখন তো আমাকেই দোষ দিবেন। তাই আগে থেকেই সাবধান হচ্ছি। আমার আবার কারো ঘর ভাঙ্গার ইচ্ছে নেই।’
হাসির ছলে পরী ও পাল্টা জবাব দিলো। রুপালি মুখ টিপে হাসে ওদের কান্ড দেখে।
তিন জা পরীর দিকে বিষ্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল। সত্যি অনেক সুন্দর পরী। রুপালির থেকেও বেশি সুন্দর। কাজল বর্ণ আঁখি যুগল যখন পলক ফেলে তখন কি সুন্দর ই না লাগে!!বদনে ছড়িয়ে আছে একরাশ মায়া। আল্লাহ যেন নিজ হাতে ওকে বানিয়েছে। তবে পরীর বলা তিক্ত কথাগুলো ওনাদের পছন্দ হয়নি। তাই সবার সাথে কুশলাদি করে চলে গেলেন। বোরখা খুলে মাথায় কাপড় জড়ালো পরী। একে একে মহিলারা এসে পরীকে দেখে যাচ্ছেন। আর ওর প্রসংশা করে যাচ্ছে। নূরনগর থেকে যেন এক টুকরো নূর এসেছে। পরীর বিরক্ত লাগছে এসব। মনে হচ্ছে আজ যেন ওর নিজেরই বিয়ে। মালা আছে বলে পরী চুপ করে আছে। নাহলে দুকথা শুনিয়ে বিদায় করে দিতো।
মেজাজ গরম হচ্ছে পরীর। শেফালির হাতপাখার বাতাসও ঠান্ডা হচ্ছে না পরীর মাথা। রুপালির জা রা যে একটু কটু কথা বলে তা জানে পরী। শ্বশুরবাড়ি নিয়ে অনেক গল্প করেছে রুপালি ওর কাছে। সেখান থেকেই এই বাড়ির প্রত্যেকের স্বভাব সম্পর্কে সে অবগত।
সাত মাসের পেটটা নিয়ে পরীর পাশে বসে পরী। মা আর পরীর সাথে টুকটাক কথা বলছে। আর পরী চুপ করে শুনছে।

বিয়ে খেতে এসে পরীর বিয়ের কথা তুলে বসে নওশাদের বাবা শামসুদ্দিন মাতুব্বর। তিনি চান তাড়াতাড়ি বিয়েটা সেরে ফেলতে। কিন্ত এখানে আফতাব বেঁকে বসেন। তিনি খবর পেয়েছেন নওশাদের পা নাকি কখনোই ঠিক হবে না। হাটতে পারবে কিন্ত লাঠির সাহায্য নিয়ে। তাই তিনি পরীর সাথে নওশাদের বিয়ে দেবেন না। একথা শুনে শামসুদ্দিন বলে,’আপনারা কিন্ত কথা দিয়েছেন জমিদার সাহেব। কথার খেলাপ কইরেন না।’

-‘আমি কথা দেইনি কথা দিয়েছে আমার ছোট ভাই। আর আমি আমার মেয়েকে কোথায় বিয়ে দেবো তা আমিই বুঝবো। আপনার ছেলে এখন অচল হয়ে গেছে। আমার মেয়েকে বিয়ে করার কোন যোগ্যতা তার নেই। তাছাড়া আপনার ছেলে আমার মেয়েকে সুখি রাখতে পারবে না।’

-‘আমার ছেলের এই অবস্থার জন্য তো আপনারাই দায়ী। আপনাদের বাড়িতে গিয়েই তো পা ভাঙলো।’

-‘আমরা কেউ তো আপনার ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেইনি। আপনার ছেলেই নিজেকে সামলাতে পারেনি। তবুও সমস্যা নেই,আপনার ছেলের সমস্ত ভরন পোষন এবং চিকিৎসার দায়িত্ব আমি নিলাম। তবুও আমার মেয়ে আমি বিয়ে দেবো না।’

-‘আপনি কি টাকার গরম দেখাচ্ছেন জমিদার সাহেব??আমার কি টাকা পয়সার অভাব নাকি? আপনার মেয়ের মতো অনেক মেয়ের ভরন পোষনের ক্ষমতা আমার আছে। আমাকে টাকার গরম দেখাবেন না। তাহলে ভাল হবে না।’
-‘তা কি করবেন আপনি হুম??’

পাল্টা জবাব দিল শামসুদ্দিন। দু এক কথায় কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেল। লোকজন জড়ো হয়ে ও গেলো। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলছে না। লোক জানাজানি বেশি হওয়ার আগেই শায়ের আফতাব কে সরিয়ে নিলো। আলাদা ঘরে টেনে নিয়ে বলল,’এখন মাথা গরম করবেন না। নওশাদের বাবা কিন্ত ভালো লোক নয়। তিনিও প্রভাবশালীদের একজন। প্রতিশোধ নিতে সে পাগল হয়ে যাবে। আর এই গ্রামের কেউ কিন্ত আপনাকে জমিদার মানবে না। তাই একটু শান্ত হন। হিতে বিপরীত হতে পারে।’

আফতাব একটু শান্ত হলো। ভাবতে লাগল সত্যিই তো। এখন যদি তার কোন ক্ষতি করতে চায় শামসুদ্দিন??তখন কীভাবে নিজেকে রক্ষা করবেন তিনি??এখানের কেউ তো তার হয়ে লড়াই করতে আসবে না। কবির ও তো কিছু করতে পারবে না। কারণ দুপক্ষই ওর আত্মীয়। কার হয়ে সাফাই গাইবে সে?কবিরের উপর সে ভরসা করতে পারছে না। তাছাড়া ওরা যদি রুপালির কোন ক্ষতি করে দেয়?

আখির চলে এসেছে সব শুনেছে সে। আফতাব কে উদ্দেশ্য করে আখির বলল,’ভাই ঝামেলা বাড়বে অনেক। আমি বলি কি বিয়েটা দিয়ে দেন।’

-‘আমার মেয়েকে আমার ইচ্ছাতে বিয়ে দেব। তোর কিছু বলতে হবে না। তোর জন্যই তো সব হয়েছে। আগ বাড়িয়ে কথা দিলি কেন তুই??’

আখির চুপ করে গেল। আফতাবের মাথা এখন গরম আছে। কুটুম বাড়িতে এসে যা করেছে এতে লোকজন কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। তাছাড়া এখানে আর বেশিক্ষণ থাকাটা নিরাপদ নয়। খাওয়া শেষ হতেই আফতাব,জেসমিন ও মালাকে গরুর গাড়ি ভাড়া করে দিলো শায়ের। সাথে দুজন দেহরক্ষী। আর পরী,জুম্মান,শেফালি,কুসুম গেল ওদের গাড়িতে। তবে এবার শায়ের ও ওদের সাথে গেল। কারণ যদি ওদের ক্ষতি করতে আসে তখন কি হবে?? তাই গাড়ি চালকের পাশে গিয়ে বসে সে।

শায়ের ঠিকই সন্দেহ করেছিল। গ্রামের শেষ মাথায় আসতেই সাত আট জন লোকদের লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো। তারা ওদের পথ আগলে দাঁড়িয়েছে। গাড়ি থামতেই ওদের একজন পেছনে এসে বলল,’সবাই বের হও। কথা না শুনলে টেনে নামাবো।’
সবাই নেমে পড়ল। পরী আর শায়ের বাদে সবাই ভয়ে কাঁপছে। কুসুমের তো বেহাল অবস্থা। আসার পথে এক দৌড়ানি খেয়েছে এখন যাওয়ার পথে আরেক দৌড়ানি। শেফালি জুম্মান কে ঝাপটে ধরে আছে। ভয়ে ওরাও সিটিয়ে গেছে।
শায়ের ভেবেছিল ওরা হয়তো আফতাবের গাড়ি আটকাবে তাই আগেই ওদের পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্ত ওদের গাড়ি আটকানোর কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছে না।
একজন লোক বলে উঠল,’জমিদার কন্যা পরীকে আমাদের সাথে যেতে হবে। আর বাকিদের সবাই চলে যাও।’
পরী শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,’কারণটা কি??’

-‘সেকথা আপনাকে বলতে বাধ্য নই।’

-‘আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করিনি।’ অতঃপর পরী শায়েরের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,’কি হয়েছে??’

-‘এরা নওশাদের বাবার লোক। মনে হয় আপনাকে নিয়ে নওশাদের সাথে বিয়ে দেবে এরা। বিয়ে করতে চাইলে চলে যেতে পারেন।’
-‘আমি আপনার কোন কথাই বুঝতে পারছি না।’

-‘আপনার বোঝার বয়স হয়নি।’
-‘বেশি কথা বলেন কেন??আমি যথেষ্ট বড়। সব বুঝতে পারি।’
-‘তাহলে আমার কথা বুঝলেন না কেন??’

কুসুম,শেফালি,জুম্মান ওদের ঝগড়া দেখছে। বিপদের মুখে পড়েও যে কেউ ঝগড়া করতে পারে তা এই প্রথম দেখলো ওরা। পরীর পাল্টা জবাব দেয়ার আগেই জুম্মান বলল,’আপা আমার ডর করতাছে। আর তুমি ঝগড়া করতাছো??এখন কি হইবো?’

পরীর হুশ ফিরল। সত্যি তো ওদের এখন বিপদ। আগে বিপদ থেকে মুক্ত হোক তারপর না হয় ঝগড়া করা যাবে।
এর মধ্যে একজন বলল,’না যেতে চাইলে জোর করে নিয়ে যাব। তাই বলছি ভালোয় ভালোয় চলুন।’

শায়ের শান্ত থেকেই বলল,’আচ্ছা নিয়ে যান আপনারা।’
পরী নেকাবের আড়ালে ঢাকা চোখদুটো বড় বড় করে তাকালো শায়েরের দিকে। বলল,’কি বলছেন আপনি এসব??’
শায়ের গরুর গাড়ি থেকে দুটো শক্ত লাঠি বের করলো। একটা পরীর হাতে দিয়ে বলল,’আপনি তো একদিন নিজেকে আমার কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। তো আজকে করুন। দেখি জমিদার কন্যা কেমন লাঠিয়াল!!’

হাসলো পরী। তবে সে হাসির মাধুর্য কালো নেকাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে রইল। পরী দুপা এগিয়ে যেতেই জুম্মান চিৎকার করে বলে,’আপা যাইও না।’
-‘তুই চুপ থাক জুম্মান। আমাকে দেখতে দে।’

পরী এগিয়ে যেতেই একজন দ্রুত ওর সামনে এসে বলে,’আপনার গায়ে হাত ওঠানোর হুকুম আমাদের কাছে নেই। আর আপনি পারবেন না আমাদের সাথে। তাড়াতাড়ি চলুন।’
কথা না শুনে পরী তাকে আক্রমণ করে বসে। লাঠি দিয়ে আঘাত করে লোকটার মাথায়। ওরা কেউ আশা করেনি পরী এমনটা করে বসবে। মাথায় হাত দিয়ে লোকটা মাটিতে পড়ে যেতেই তিনজন লাঠি নিয়ে দৌড়ে এলো। পরী ওদের ওপর ও আক্রমণ করে। উপায়ন্তর না দেখে তারাও লাঠি চালালো পরীর উপর। দক্ষ পরী প্রতিহত করতে লাগল শত্রুর আক্রমণ। লাঠি ঘুরিয়ে নাস্তানাবুদ করতে লাগল সবাইকে। কিন্ত এতো জনের সাথে লড়াই করা একটা মেয়ের পক্ষে অসম্ভব। তাই একটা লাঠির আঘাত এসে পড়ে পরীর বাহুতে। ছিটকে দূরে পড়ে যায় পরী।
আরেকজন এসে লাঠি চালালো পরীর গায়ে। পরী চোখ বন্ধ করে নিলো। কিন্ত আঘাত অনুভব করতে না পেরে চোখ মেলে তাকালো। শায়ের তার লাঠি দ্বারা শত্রুর লাঠি আটকে দিয়েছে। সে পরীকে উদ্দেশ্য করে বলল,’উঠে দাঁড়ান,পড়ে গেলে উঠে দাঁড়াতে হয়।’
পরী উঠে দাঁড়াল আবার। ওরা দুজন মিলে সবকটাকে কুপোকাত করে দিলো। কিন্ত সমস্যা আবার হলো। ওরা দূর থেকে দেখতে পেল এবার পুরো বাহিনী আক্রমণ করতে চলেছে। ওদের সাথে পেরে ওঠা সম্ভব নয়। শায়ের সবাইকে বলল,’বাঁচতে চাইলে দৌড়ান সবাই। আমার সাথে আসুন।’
সাথে সাথেই সবাই দৌড় দিলো। রাস্তা দিয়ে গেলে নূরনগরে পৌঁছাতে সময় লাগবে তাই ধান ক্ষেতের আইল বরাবর ওরা নেমে পড়ে। পেছনে তাকানোর সময় নেই। গাড়িওয়ালা চাচা দৌড়াতে দৌড়াতে বলল,’আমার গরু দুইডা ফালাই আইছি অহন আমার কি হইবো?’
শেফালি বলল,’নিজে বাঁচলে বাপের নাম। ভাগো তাড়াতাড়ি।’
জুম্মান হাপাতে হাপাতে বলে,’বাঁইচা ফিরলে আব্বায় গরু কিনে দিবো তোমারে। অহন পালাও’

শত্রুরাও ওদের পিছন পিছন দৌড়াচ্ছে কিন্ত পরীরা তাদের থেকে অনেক এগিয়ে। তাই ওদের ধরতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর কুসুম বলে উঠল,’পরী আপা আর পারি না। আমার কষ্ট হইতাছে।’
-‘মনে কর তোরে সুখান পাগল ধাওয়া করছে। এখন দৌড়া।’
পরীর কথায় কুসুমের শক্তি যেন বেড়ে গেল। পরনের কাপড় একটু তুলে ধরে দিলো দৌড়। শায়ের কে পিছনে ফেলে সে এগিয়ে গেলো। এই বিপদের মধ্যে থেকেও সবাই হেসে উঠল। সবাই আরো কিছুক্ষণ দৌড়ে পরবর্তী একটা গ্রামে ঢুকলো। কিন্ত ওদের পা আর চলছেই না। কোনরকমে এগিয়ে চলছে। তবে এই গ্রাম পেরোলেই নূরনগর। তবুও ওদের পা চলছে না। মনে হচ্ছে শত্রুর হাতে এবার ধরা দিতেই হবে।

কিন্ত তখনই আফতাবের লোকেরা এসে হাজির। লাঠিসোটা নিয়ে তারা ঝাপিয়ে পড়লো। শায়ের যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এবার সবাই দৌড় থামিয়ে রাস্তা ধরে হাটতে লাগলো। নূরনগরের গন্ডি পেরোতেই পরী রাস্তার ধারে বসে পড়ল। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। পরীর দেখাদেখি বাকি সবাই বসে পড়ল।
অনেক দৌড়েছে আজ। আর হাটার শক্তি নেই ওর।

বন্যা যেতে না যেতেই শুরু হয়ে গেছে মারামারি। এসব ভাল লাগে না পরীর। এর আগেও সে শুনেছে আফতাব কে কেউ মারার চেষ্টা করেছে। কিন্ত তাতে ও মাথা ঘামায়নি। এখন নিজেই দেখতে পেল সব। তবে কে বা কারা ওদের ওপর আক্রমণ করলো সেটাই বুঝতে পারছে না পরী। আক্রমণ করার কারনই কি হতে পারে??

পরী শায়েরের দিকে তাকিয় জিজ্ঞেস করল,’এবার তো বলুন ওরা কেন আমাদের তাড়া করলো??’

#চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here