#পরীজান
#পর্ব ৩১
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
নারী যখন খুব বেশি কষ্ট পায় তখন কাঁদার জন্য একটা বুক খোঁজে। যেখানে নিজের সব কষ্ট ঢেলে দিতে পারে। অশ্রু বিসর্জন দিয়ে ক্ষ্যান্ত হতে পারে।
একটা বিশ্বাসী স্নিগ্ধ মানুষের বুকে অশ্রু ঢালতে পারলেই সে নারীর কষ্ট লাঘব হয়। তেমনি পরী নির্ভয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে শায়েরের বুকে। শায়ের দুহাতে আগলে ধরেছে তার অর্ধাঙ্গিনীকে। মহিলাটির কথায় পরী কষ্ট পেয়েছে খুব। খারাপ লাগারই কথা। সবে মাত্র বিয়ে হয়েছে। এখনো সংসার পাতানো হলো না। তার আগেই ভাঙ্গার কথা বলছে। একটা সুখি সংসার কেমন হয় তা পরী সোনালীর সেই খাতায় পড়েছে। কিভাবে সোনালী রাখালের সাথে ছোট্ট সংসার গড়ে তুলবে তা ব্যক্ত করেছিল খাতায়। পরীর ধারণা ও সেখানকার। কিন্ত ওই মহিলাটি শুরুতেই সব চুরমার করার কথা বলছে!! এজন্য ব্যথিত হয়ে নয়ন জলে ভাসছে পরী। শায়ের কিছুক্ষণ পরীকে আলিঙ্গন করে নিজের দিকে ফেরালো। আপন হস্তে পরীর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,’আপনি না সাহসী?? আপনার মন না শক্ত? তাহলে এভাবে বাচ্চাদের মত কাঁদছেন কেন?’
-‘উনি কি বলে গেলেন? আমি কি সত্যিই,,,’
মুখে হাত দিয়ে কথা আটকে দিলো শায়ের। তারপর গালে আলতো করে হাত রেখে বলল,’মানুষের কথায় নিজের চরিত্রকে বিচার করবেন না। নিজের মানসিকতা দিয়ে নিজের চরিত্র কে দেখুন জানুন। পরের কথায় চোখের জল ফেলবেন না। কষ্ট পাবেন না।’
-‘উনি যদি মিথ্যা বলে থাকেন তাহলে আপনার আর আমার মাঝে কেন এতো দূরত্ব? বলুন!!সেটা তো আমার জন্যই তাই না!! আমিই পারি না কাউকে আপন করে নিতে। সেজন্যই তো উনি আমাকে এসব বলে গেছেন।’
দ্বিতীয়বারের মতো পরীকে জড়িয়ে নিলো শায়ের। তার করা ভুলটা পরী নিজের মাথায় নিয়েছে। শায়েরই ইচ্ছা করে দূরে থেকেছে। আসলে রুপালির কথাগুলো শোনার পর শায়ের ভেবেছে সত্যিই সে পরীর যোগ্য নয়। তাই সে দূরে থেকেছে। কিন্ত পরী যে তাকে অতি সন্নিকটে চায় তা শায়েরের জানা ছিল না। শায়ের বলল,’আমাকে ক্ষমা করুন পরীজান। ভুলটা আমারই। আমার থেকে আপনার দূরত্ব বাড়বে না কোনদিন। কথা দিলাম,আমি দূরে থাকলেও আমার রুহু সবসময় আপনার কাছে থাকবে।’
পরী নিজেও শক্ত করে ধরে শায়েরকে। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে,’আমি সম্পূর্ণ একা হয়ে যাব আপনি না থাকলে। আমাকে একা ফেলে কোথাও যাবেন না। আমি শুধু ছোট্ট একটা সংসার চাই। এছাড়া আর কিছু চাই না আমি।’
-‘আপনি যা চাইছেন তাই হবে। এবার কান্না বন্ধ করুন।’
পরী কান্না থামালেও শায়ের কে ছাড়লো না। আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে রাখে। পরীর এহেম কান্ড দেখে শায়ের হেসে ফেলল। বলল,’ছাড়বেন না আমাকে? আজ থেকে কাজে যেতে হবে।’
-‘আজকে যাওয়ার দরকার নেই। কাল থেকে যাইয়েন।’
-‘কেন??’
-‘আজকে আমার মন খারাপ। আপনি চলে গেলে মন আরও খারাপ হয়ে যাবে।’
আবারও হাসে শায়ের। আরেকটু গভীরতার সাথে আলিঙ্গন করে পরীকে। শায়ের কিছু বলতে যাবে তখনই খুসিনার গলার আওয়াজ ভেসে আসে। শায়ের পরী দুজনেই তড়িঘড়ি করে দুপাশে সরে দাঁড়ায়। খুসিনা ঘরে এসে বলে,’হ্যারে সেহরান তুই নতুন বউ রে লইয়া ফকিররে দিয়া ঝারা দিয়া আন।’
শায়ের গলা খাকারি দিয়ে বলে,’ফকির!!কেন?’
-‘কেউর নজর পড়ছে। দেহোস না ওই বেডি কি কইয়া গেলো? আমার ভালা ঠেকতাছে না তুই বিকালে বউরে লইয়া উসমান ফকিরের কাছে যাইস।’
-‘আচ্ছা যাবো। তুমি এখন যাও।’
-‘তুই তো আড়তে যাবি কইলি। তা যাবি না??’
-‘আজকে না কাল থেকে যাবো।’
খুসিনা মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেল। শায়ের আবার পরীর কাছে এসে বলল,’মন খারাপ যেন করতে না দেখি। বিকেলে গ্রাম ঘুরতে নিয়ে যাব। দেখবেন ভালো লাগবে।’
-‘ফুপু যে ফকিরের কথা বলল!’
-‘কুসংস্কারে আমি বিশ্বাস করি না। আমি থাকলেই আপনার উপর থেকে নজর কেটে যাবে।’
শায়ের পরীকে রেখে আড়তে যায়নি। ঘরে বসেই পায়চারি করেছে। সকালের নাস্তা সেরে তার কিছুক্ষণ পরেই খুসিনার সাথে রান্না করতে গেলো পরী। প্রতিদিন রান্না করতে করতে খুসিনা তার নিজের জীবন কাহিনী শোনায়। বিয়ের কয়েক বছর পরই তার স্বামী মারা যায়। তার ছেলের বয়স তখন চার বছর। স্বামী গৃহ থেকে বঞ্চিত হয়ে সে বড় ভাই শাখাওয়াত মানে শায়েরের বাবার কাছে আশ্রয় নেন।
বাকি তিন ভাইয়েরা বউদের কথাতে খুসিনার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা’ই বা কি করবে?অভাবের সংসার নিয়ে নিজেরাই টানাপোড়েনে আছে।
শায়ের তখন সাত বছরের বালক। দূর্ভাগ্য বশত শায়েরের মা মারা যান। এবং একই বছরে খুসিনার ছেলে পানিতে পরে মারা যায়। পুত্র শোক কাটাতে শায়ের কে তিনি নিজ সন্তানের মতো আগলে রাখেন। বড় করে তোলেন শায়ের কে। সেই থেকেই শায়ের ফুপু ভক্ত। শাখাওয়াত মারা যাওয়ার পর শায়ের নিজেই পরিবারের হাল ধরে। কাজের জন্য দূর দেশে পাড়ি জমায়। প্রতি মাসে খুসিনার খরচ পাঠালেও সে আসে না। বছরে দুই কি তিনবার আসে। তবে এখন খুসিনা ভিশন খুশি। শায়ের এখন থেকে এখানেই থাকবে। সে প্রতিদিন শায়ের কে দেখতে পাবে। এতেই তিনি খুশি।
পরী ফুপুর পাশে বসে বসে রান্না শিখছে। খুব মন দিয়ে কড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। রান্না তাকে শিখতেই হবে।
রান্না শেষ হতেই ফুপু পরীকে গোসলে যেতে বলল। সিঁদূর রঙা শাড়ি আর গামছা হাতে পরী কলপাড়ে গেল। টিন দিয়ে চারিদিক বেড়া দেওয়াতে বেশ সুবিধা হয়েছে। কলপাড়ের দরজা খুলতেই চমকে ওঠে পরী। শায়ের সবে নিজের গামছা টা দঁড়িতে রেখেছে। পরী বলে উঠল,’আমি পরে আসবো।’
-‘দাঁড়ান! আপনি আগে গোসল করুন। আমি পরে করবো।’
-‘না,আপনি আগে এসেছেন আপনিই আগে গোসল করুন।’
শায়ের পরীর হাত টেনে ভেতরে এনে বলে,’আমি বালতি ভরে দিচ্ছি। আপনি আগে গোসল করুন।’
পরী চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। শায়ের কল চেপে বালতি ভরলো। তারপর চলে গেলো। দরজা আটকে দিয়ে গোসল করে নেয় পরী। অতঃপর গায়ে শাড়ি জড়িয়ে ভেজা চুলে গামছা পেঁচিয়ে বাইরে আসে। ধোয়া শাড়িটা রোদে মেলতে গেলো। খোলা বারান্দায় বসে আছে শায়ের। সদ্য গোসল করা পরীকে দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল সে। ফর্সা শরীরে যেন লাল রঙটা একটু বেশিই শোভা পায়। পানিতে শাড়ির কিছু কিছু অংশ ভিজে গেছে। যেখানটা উন্মুক্ত দেখাচ্ছে। দৃশ্য টা সুমধুর লাগছে শায়েরের কাছে। অপলক দৃষ্টি মেলে সেদিকে তাকিয়ে আছে শায়ের। নিজের কাজ শেষ করে পরী এগোলো ঘরের দিকে। শায়ের কে এখনও বসে থাকতে দেখে বলে, ‘আপনি এখন গোসলে যান। আমার হয়ে গেছে।’
-‘কিন্ত আমার হয়নি!!’
-‘কি??’
-‘আপনাকে দেখা!!’
-‘কিইই?’
পরীর মৃদু চিৎকারে হুশ ফিরল শায়েরের। চট জলদি দাঁড়িয়ে বলল,’কিছু না আমি যাচ্ছি।’
দ্রুত পদে শায়ের প্রস্থান করে। পরী কিছু বুঝলো না চেষ্টাও করলো না কারণ নামাজের সময় পার হয়ে যাচ্ছে।
বিকেলে সূর্যের তেজ অনেকটাই কমে আসে। পশ্চিমে ডুবতে শুরু করে উত্তপ্ত দিবাকর। শীত কমতে শুরু করছে। আর কিছুদিন পর বসন্ত এসে উঁকি দিবে। গাছের পাতা ঝরে গিয়ে নতুন পাতা গজাবে। তখন প্রকৃতির আমেজটাই অন্যরকম থাকবে।
রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক দম্পতি। তারা আর কেউ নয়। শায়ের আর পরী। মন ভাল রাখার জন্য ঘুরাঘুরির প্রয়োজন। তাই পরীকে গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে শায়ের। নেকাবের আড়ালে থাকা পরীর চোখ দুটো সব দেখছে। পথে অনেকের সাথে কথা বলেছে। পরীকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। পরী নিজেও পরিচিত হয়েছে। এই প্রথম সে এভাবে গ্রাম দেখতে বের হয়েছে। আগে সে রাতের অন্ধকারে গ্রাম দেখতো। এখন দিনের আলোতে চারিদিক দেখতে বড়ই ভালো লাগছে।
সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরলো ওরা। চম্পা বারান্দায় বসেছিল। শায়ের কে পরীর হাত ধরে আসতে দেখে নড়েচড়ে বসে। ওই হাতটা চম্পার ধরার কথা ছিলো কিন্ত দূর্ভাগ্য বশত আজ পরী ধরে আছে। হেরোনা সারাদিনের কাজ শেষ করে পুকুর থেকে গোসল করে আসলো। চম্পাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে দৃষ্টি অনুসরণ করে সেও তাকালো শায়েরের দিকে। ভেজা শরীর টা যেন জ্বলে উঠল ওনার। চম্পাকে ধমক দিয়ে বললেন,’সন্ধ্যার সময় এইহানে কি করস? যা ঘরে?’
চম্পা উঠে দাঁড়িয়ে বলে,’আমার জীবন শ্যাষ কইরা দিয়া এহন কথা কও তুমি?’
-‘তোরে অনেক বড় ঘরে বিয়া দিমু। তুই সুখি হবি। ওই এতিম পোলার আছে কি আর তোরে দিবো কি?’
চম্পা চাপা রাগ নিয়ে বলে,’সুন্দর একখান মন আছে তার। কিছু না দিতে পারলেও ভালোবাসা দিতে পারতো। তুমি আগে হিংসায় জ্বলতা,এহন আমি জ্বলি।’
চম্পা রাগে ফুসতে ফুসতে ঘরের ভেতরে চলে গেল। হেরোনা মেয়েকে গালমন্দ করতে করতে কাপড় বদলাতে চলে গেলেন। বারবার মেয়ের মুখে সেহরান সেহরান শুনতে ভালো লাগে না তার। ছেলেটার এখন বিয়ে হয়েছে তবুও তার নাম জবছে মেয়ে। মনে মনে শায়ের কে কটু কথা বলতে ভুললো না সে।
সন্ধ্যার আসরে গল্প জমাচ্ছেন খুসিনা। তবে আজ তিনি পরী আর শায়েরের সাথে গল্প করছেন। একথা সেকথা বাজে বকবক করছেন। পরী গালে হাত রেখে তা শুনছে। তার ফাঁকে ফাঁকে শায়েরের দিকে তাকাচ্ছে। শায়েরের চেহারায় কেমন উদাস উদাস ভাব। দেখে বোঝা যাচ্ছে সে ফুপুর কথাতে মন বসাতে পারছে না। পরী ঠোঁট টিপে হাসলো। পাশের বাড়ির একজন মহিলা ঘরে এলো। খুসিনাকে উদ্দেশ্য করে বলল,’ও ফুপু তোমারে মায় কহন যাইতে কইছে। তুমি এহনও বইয়া আছো।’
তার পর তিনি শায়ের আর পরীর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,’তুমিও না ফুপু!! সেহরান নতুন বিয়া করছে। কই ওগো এট্টু একলা সময় দিবা তা না। আমি হইলে সন্ধ্যার পর দুইজনরে ঘরে তালা দিয়া চইলা যাইতাম।’
মহিলাটির লাগামহীন কথাবার্তা শুনে গুটিয়ে গেল পরী। লজ্জা অনুভূত হতেই মাথা নুইয়ে ফেলল। এখানকার মহিলারা নির্লজ্জ। সব কথা সরাসরি বলে দেয়। বড় ছোট দেখে না তারা। খুসিনা ধমকে বললেন,’মুখে লাগাম টান। আমার ভাইর বেডা হয়। কথা কমাইয়া কইস।’
উওরে মহিলাটি হাসলো শুধু। খুসিনা ঘর থেকে বের হতে হতে পরীকে দরজা আটকে দিতে বলল। পরী উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। আগের স্থানে এসে বসতেই শায়ের বলল,’ওখানে বসেছেন কেন? আমার পাশে এসে বসুন। আমাদের তো এখন সময় কাটাতে হবে।’
শায়েরের মুখের হাসি দেখে পরী বুঝলো সে মজা করছে। পরশু থেকে কথা বলেনি আজকে এসেছে সময় কাটাবে। পরী এসব ভাবতে ভাবতে পালঙ্কে গিয়ে বসে রুষ্ঠচিত্ত কন্ঠে বলল,’কাল সারাদিন এই কথা মনে ছিল কি? তখন তো দূরে দূরে থাকতেন। এখন এসেছেন সময় কাটাতে?’
পরীর হাত ধরে টেনে কাছে এনে দুজনের দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেলে শায়ের। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,’ক্ষমা তো চাইলাম পরীজান। আবারো চাইবো??’
-‘নাহ থাক,এতো বার ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন নেই। হাঁপিয়ে যাবেন।’
-‘আপনাকে পাওয়ার জন্য দুনিয়ার সব অন্যায় নিজের ঘাড়ে নিয়ে হাজার বার ক্ষমা চাইতে আমি প্রস্তুত।’
#পরীজান
#পর্ব ৩২
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
রাতের প্রহর যতো বাড়তে থাকে নিস্তব্ধতাও সমান তালে বাড়ে। থেমে যায় মানুষের কলরব। ঘুমন্ত গ্রামটাকে মৃত্যুপুরি মনে হয় তখন। তখন যে জেগে থাকে একমাত্র সেই টের পায় নিরবতা। শীত কমতে থাকাতে এই সময়টাতে গরম লাগছে পরীর। গায়ের কম্বল টা সরিয়ে দিলো। মাথা তুলে শায়ের কে দেখে নিলো। সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। পরী হাতে আরেকটু জোর দিয়ে জড়িয়ে ধরে শায়ের কে। স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিল সে। হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেলো পরীর। কোন স্বপ্ন দেখেনি এমনিতেই ঘুম ভেঙেছে। একই ভাবেই সারারাত ঘুমিয়ে থাকলে তো কষ্ট হবে শায়েরের। এপাশ ওপাশ ফিরতে পারবে না। তাই পরী সিদ্ধান্ত নিলো নিজের বালিশে ঘুমানোর। কিন্ত সে উঠতে পারলো না। শায়ের ততক্ষণে জেগে গেছে। চোখ বন্ধ রেখেই সে বলে উঠল,’এমন করছেন কেন পরীজান? আমাকে একটু ঘুমাতে দিন।’
বলতে বলতে হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে শায়ের।
-‘আমি আবার কি করলাম? আপনার সুবিধার জন্যই তো সরে যাচ্ছি।’
-‘আমার তো আপনাকে নিয়ে ঘুমাতে সুবিধা হচ্ছে। আপনার হচ্ছে না বুঝি?’
পরী কথা বলল না। ওভাবেই রইল। কিছুক্ষণ পর পরী বলল,’শুনেছি সত্যিকারের ভালোবাসা নাকি কাঁদায়!! ভালোবাসায় চোখের পানি না ঝরলে সেই ভালোালোবাসা পরিপূর্ণ হয় না??’
-‘আপনার কথাটা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আমার ভালোবাসা আপনাকে প্রতিদিন কাঁদাবে পরীজান। নিত্য নতুন ভালোবাসায় আপনি কাঁদতে প্রস্তুত হন।’
-‘সুখের কান্না সবাই হাসিমুখে বরণ করে। আমিও হাসি মুখে নিলাম। আমার এই কান্না যেন শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত থাকে মালি সাহেব। সেই দায়িত্ব আপনার।’
-‘যথা আজ্ঞা পরীজান।’
ভালোবাসার পরিপূর্ণ রূপ হলো চোখের জল। ভালোবাসা মানুষকে কাঁদায়। জীবন অনেকগুলো খন্ডে বিভক্ত,কোন খন্ডে জীবনে ভালোবাসা এসে জীবনকে রঙিন করে দেয়। পরে এই রঙিন স্মৃতিগুলো বিষন্নতার পসরা সাজিয়ে মানবহৃদয়কে কাঁদিয়ে দেয়। আবার কিছু খন্ডে সে সুখ পায়। তখন সুখের কান্নায় আবেগপ্লুপাত হয়। হ্যা ভালোবাসা মানুষকে কাঁদায়। কেউ পাওয়ার খুশিতে কাঁদে আর কেউ না পাওয়ার বেদনায়। তবে সবার চাওয়া একটাই থাকে,দিন শেষে যেন প্রিয় মানুষটার বুকে মাথা রেখে চোখের জল ফেলতে পারে।
সকাল সকাল আড়তে চলে গেছে শায়ের। আজকে ওর কাজের প্রথম দিন। পরী উঠোনে দেওয়া দরজা পর্যন্ত শায়ের কে এগিয়ে দিয়ে আসে। ঘরে এসে পরী শূন্যতা অনুভব করে। সেটা যে তার স্বামীর জন্য। এখন থেকে রোজ শায়েরের আসার অপেক্ষা করবে পরী। কিছু অপেক্ষা অত্যন্ত মিষ্টি। যা উপভোগ করার অনুভুতি অসাধারণ।
ফুপুর সাথে কাজে কর্মে আর গল্প করেই সারাদিন কাটাতে হবে পরীকে। নিজের কাজগুলো তাই তাড়াতাড়ি শেষ করলো পরী। দুপুরে গোসলের জন্য কলপাড়ে যেতে উদ্যত হতেই চামেলি এলো। পরীকে দেখে বলে,’নতুন ভাবি নাইতে যাও?’
পরী হেসে বলল,’হ্যা।’
-‘ওহহ। আমার লগে পুকুরে যাইবা?’
-‘নাহ পুকুরে যাওয়া মানা আমার। তোমার ভাই যেতে বারণ করেছে।’
-‘আরে নতুন ভাবি পুকুরে কেউ যায়না। আমাগো ঘরের পিছনে পুকুরটা। আমরা বাড়ির মানুষ যাই খালি। আব্বা আর কাকারা তো ক্ষেতে গেছে। আইবো সন্ধ্যার পর। আহো তুমি আর আমি যাই। মজা হইবো।’
চামেলির কথা শুনে হাসলো পরী। তারও ইচ্ছা করে পুকুরে সাঁতার কাটতে। কিন্ত শায়ের মানা করেছে তাই সে যাবে না বলে। খুসিনাও পরীকে একবার পুকুরে যেতে বলে। শ্বশুরবাড়ির কোথায় কি আছে তা দেখতে হবে না?
পরী ভাবলো শায়ের তো এখন বাড়িতে নেই। সে কোথায় গোসল করছে তা তো শায়ের দেখবে না। একদিন পুকুরে গেলে কিছু হবে না। বাড়িতে থাকতে স্বাধীনতা পায়নি। এখানে অন্তত মালার মতো কেউ বকবে না। কাপড় রেখে গামছা নিয়ে পরী চামেলির পিছন পিছন গেলো। বড় ঘোমটা টেনে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে গেল পরী। পুকুর ঘাটে গিয়ে ভালো করে চারিদিক দেখে নিলো সে। চারিদিক ঝোপঝাড়। কলাগাছ আর কলাগাছ। তাছাড়া পুকুরে আসতে হলে বাড়ির ভেতর দিয়ে ছাড়া আসার কোন কায়দা নেই।
চম্পা সবে পুকুরে গোসলে নেমেছে। পরী আর চামেলিকে দেখে অবাক হলো সে। রাগন্বিত কন্ঠে চামেলিকে বলে,’তুই নতুন ভাবিরে এইহানে আনছোস ক্যান। সেহরান ভাই মানা করছে না? নতুন ভাবিরে নিয়া বাইরে যাইতে?’
-‘আমাগো পুকুরে তো কেউ আহে না আপা। হের লাইগা নিয়া আইলাম।’
চম্পার ভালো লাগলো না চামেলির জবাব। পরী বেশ বুজতে পারলো যে চম্পা তাকে দেখে রাগ করছে। রাগ করাটাই স্বাভাবিক। তাই পরী কিছু বলে না। চম্পা দ্রতু উঠে চলে গেল। চামেলি পুকুরে নামতে নামতে বলল,’নতুন ভাবি সাবধানে নামেন। ঘাট কিন্ত পিছলা।’
পরী তাই সাবধানে নামলো। দুটো খেজুর গাছ পাশাপাশি রেখে ঘাট বানানো হয়েছে। বহুদিন পানিতে ডুবে থাকার কারণে গাছ দুটোতে শেওলা ধরে গেছে। যার ফলে পিচ্ছিল হয়ে গেছে। তাই দেখে শুনে পা ফেলছে পরী। পুকুরের পানিতে শরীর ভেজাতে বেশ লাগলো পরীর। বেশিক্ষণ সাঁতার কাটলো না সে। তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। চামেলি আগে উঠে এলো। কিন্ত পরী উঠতে গিয়ে পড়লো বিপাকে। হাত ফসকে সাবানটা পড়ে গেল পানিতে। পরী চামেলিকে ডেকে বলল,’সাবানটা পানিতে পড়ে গেছে চামেলি। এবার কি হবে?’
-‘ডুব দিয়া খোঁজো। পাইয়া যাইবা। আমার কতবার সাবান হারাইছে। হাতরাইলে পাইয়া যাইবা। ডুব দেও।’
চামেলির কথামত পরী আবার পানিতে নামলো। ডুব দিয়ে সবান খোঁজার চেষ্টা করলো। পানির নিচে কতক্ষণ আর দম আটকে থাকা যায়!!সবান না পেয়ে
পরী পানির উপরে এসে বড় করে দম ছাড়লো। তবে সাথে সাথে দম আটকে আসার উপক্রম হলো। কারণ চামেলির জায়গাতে স্বয়ং শায়ের দাঁড়িয়ে আছে। পরনে তার গেঞ্জি আর লুঙ্গি। হাটু পর্যন্ত উঠিয়ে গিট্টু দেওয়া তার লুঙ্গিটা। মনে হচ্ছে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে শায়ের। সাহসী পরী স্বামীর ভয়ে ঢোক গিললো। শায়ের পরীকে বারবার বাইরে যেতে নিষেধ
করে দিয়েছে। শায়ের বাড়িতে না থাকলে তো একেবারেই পরীর বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ। শায়েরের হাতে একটা ছোট লাঠি দেখে পরী আরও ঘাবড়ে গেল। মারবে নাকি?? শায়ের গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘আপনি পুকুরে এসেছেন কেন? আমি যাওয়ার আগে কি বলে গিয়েছিলাম মনে রাখেননি তাই না??’
-‘না মানে!!আসলে আজকেই এসেছি। আর কখনো আসবো না কথা দিচ্ছি।’
-‘আমার কথা না রেখে এখন কথা দেওয়া হচ্ছে!!’
পরী করুন স্বরে বলল,’মাফ চাইছি আর হবে না।’
-‘উঠে আসুন।’
-‘সাবান পড়ে গেছে। খুঁজে পাচ্ছি না তো। আপনি একটু দেখুন না খুঁজে!!’
পরীর অসহায় মুখ দেখে শায়ের পানিতে নামলো। ডুব দিয়ে মুহূর্তেই সাবানটা খুঁজে আনলো। সাবান দেখে পরীর মুখে হাসি ফুটল। শায়েরের থেকে সাবানটা নিয়ে বলল,’যাক অবশেষে পাওয়া গেল।’
-‘এখন আর খুশি হওয়া লাগবে না। আমাকে কথা দিন আর কখনোই পুকুরে আসবেন না। আর আমি ছাড়া কারো সাথে বাড়ির বাইরে যাবেন না।’
-‘আমাকে নিয়ে এতো ভয়ের কি আছে মালি সাহেব?’
শায়ের পরীর হাতটা ধরে কাছে টেনে নিলো বলল, ‘আমার একটি মাত্র পরীজান। আমি চাই না যে আমি ছাড়া পরীজানের দর্শন অন্য পুরুষ করুক। আপনাকে আমার কাছে খুব যত্ন করে আগলে রাখবো।’
-‘আপনার হাতে লাঠি দেখে ভাবলাম মারবেন বুঝি আমাকে!’
-‘ভালোবেসে কাঁদতে চেয়েছেন না? লাঠি দিয়ে মেরে কাঁদাবো।’
পরী মৃদু রাগ নিয়ে বলে,’কি???’
শায়ের হাসলো অতঃপর পরীকে নিজ আলিঙ্গনে নিয়ে বলে,’ভালোবেসে কুল পাইনা আবার মারবো?’
পাড় থেকে চামেলির গলা শোনা গেল,’আরে সেহরান ভাই তোমরা অহনও উঠো নাই। ঠান্ডা লাগবো যে।’
থতমত খেয়ে পরীকে ছেড়ে দিলো শায়ের। কিন্ত চামেলির ভাবান্তর নেই। বোকা মেয়েটা অতো কিছুই বুঝলো না। শায়ের ধমকে চামেলিকে বলল,’তোর মার খেয়ে হয়নি না? দাঁড়া আবার আসছি।’
দৌড়ে চলে গেল চামেলি। একটু আগে শায়ের পুকুর পাড়ে এসে চামেলিকে দু’ঘা লাগিয়েছিল পরীকে ঘাটে আনার জন্য। বাড়ি ফিরে এসে সে যখন দেখলো ঘরে পরী নেই তখন ফুপুকে জিজ্ঞেস করে। শায়ের কে রাগ করতে দেখে সমস্ত দোষ তিনি চামেলির উপর দিয়ে দেন। যার ফলস্বরূপ লাঠির বাড়ি চামেলির উপর পড়ে।
পরীকে নিয়েই বাড়ি ফিরে এলো শায়ের। আজকে ভালোয় ভালোয় বেঁচে গেছে। আর এই ভূল করা যাবে না। মালার কথা মনে পড়ল পরীর। মালা শায়ের কে বলেছিল পরীকে আগলে রাখতে। শায়ের সেই চেষ্টাই করছে।
ভেজা কাপড় বদলে ঘরে এলো পরী। সে শায়ের কে জিজ্ঞেস করল,’আপনি আজ চলে এলেন যে? বলে গেলেন তো ফিরতে সন্ধ্যা হবে।’
-‘আপনাকে দেখার আকাঙ্খা আমাকে টেনে নিয়ে এলো পরীজান। পারলাম না থাকতে। আপনি কি আমাকে একটুও মনে করেননি?’
-‘আপনাকে তো ভুলিনি তাহলে মনে পড়বে কি? একটা মানুষ কে তখনই মনে পড়ে যখন তাকে ভুলে যায়।’
শায়ের পরীর কাছের আসার চেষ্টা করতেই খুসিনা এসে ঢুকলো। মুখটা বিকৃত করে শায়ের সরে গেল।
তাকে আবার আড়তে যেতে হবে। প্রতিদিন দুপুরে সে খাওয়ার জন্য আসবে। এই চুক্তিতে সে কাজে ঢুকেছে। এখন যাবে আবার আসবে সন্ধ্যার পর। বেশিক্ষণ থাকলো না শায়ের। দুপুরের খাবার শেষ করেই সে চলে গেল।
পরী পরবর্তী সময়টুকু শায়েরের জন্য সে অপেক্ষা করতে লাগলো। অপেক্ষা করতে করতেই সন্ধ্যা নেমে এলো। ফুপু বাড়িতে নেই। অভ্যাস মতো সে পাশের বাড়িতে গেছে। দরজায় টোকা পড়তেই খুশি হলো পরী। দ্রুত দরজা খুলতে গিয়েও থেমে গেলো। শায়ের বলেছিল রাতে সে যদি না ফেরে তাহলে দরজায় আওয়াজ পেলেই যাতে সে দরজা না খোলে। তাই পরী থেমে গেলো। আগে জানা দরকার কে এসেছে?? তাই সে জিজ্ঞেস করলো,’কে??’
অপর পাশে থেকে জবাব না পেয়ে পরী বুঝে গেল যে শায়ের আসেনি। তাহলে কে এসেছে?
#পরীজান
#পর্ব ৩৩
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
দরজায় কান লাগিয়ে ওপাশে উপস্থিত মানুষটার পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে পরী। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে আর শব্দ শোনা গেল না। পরী ভাবল বোধহয় শায়েরই এসেছে। তাকে পরীক্ষা করছে। তাই সে পরীক্ষা দিতেও প্রস্তুত হলো। আবারো জিজ্ঞেস করল,’পরিচয় না দিলে দরজা খোলা যাবে না। যদি কথা না বলেন তাহলে চলে যান এখান থেকে?’
এবার জবাব এলো। মোটা কন্ঠস্বরে একজন পুরুষ বলে উঠল,’সেহরান ভাই আছে??’
চমকে গেল পরী। সত্যিই তো শায়ের আসেনি। তাহলে কে এলো?দরজা তো কিছুতেই খোলা যাবে না। কিন্ত ভয় সে পেলো না। শত্রুকে প্রতিহত করতে পরী জানে। এই একজন কে শেষ করতে কয়েক মুহূর্তই যথেষ্ট। পরী দরজা থেকে একটু পিছিয়ে গিয়ে বলে,’উনি বাড়িতে ফেরেনি আপনি চলে যান।’
গেলো না লোকটা। ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে বলে,’নতুন ভাবি আমি হইলাম পলাশ। আপনের দেবর, দরজাডা এট্টু খোলেন। আপনের লগে সাক্ষাৎ করতে আইলাম।’
পরী জানে না আদৌ কোন দেবর আছে কি না। এটাকে তো কিছুতেই ঘরে আসতে দেওয়া যাবে না। পরী বলল,’আপনি চলে যান। আপনার ভাই আসলে তখন আইসেন। আপাতত চলে যান।’
পলাশ যাইতে চাইলো না। পরীকে বারবার দরজা খোলার অনুরোধ করতে লাগল। পরী জবাব দিতে দিতে হয়রান শেষে হাল ছেড়ে পালঙ্কে বসে রইল। পলাশ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল। তার কিছুক্ষণ বাদেই আবার দরজার কড়া নাড়লো কেউ। পরী বিরক্ত হয়ে গেল। নিশ্চয়ই পলাশ নামের লোকটা আবার এসেছে। সে রেগে বলে,’এতো ঘাড়ত্যাড়া কেন আপনি? এসেছেন কেনো আবার? চলে যান!!’
তবে এবারের গলার আওয়াজ পরিচিত পরীর।
-‘আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন পরীজান?’
থতমত খেয়ে পরী দ্রুত দরজা খুলে দিলো। শায়ের কে দেখে মৃদু হাসার চেষ্টা করে ঘরে আসতে দিলো। শায়ের এখনও প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে পরীর দিকের তাকিয়ে আছে। পরী তা বুঝতে পেরে বলল,’পলাশ নামের আপনার কোন ভাই আছে?’
-‘কেন বলুনতো??’
-‘সে এসেছিলো আপনার খোঁজে। ভেতরের আসতে চেয়েছিল কিন্ত আমি আসতে দেইনি।’
শায়ের কপাল কুঁচকে এলো। চিন্তিত হয়ে বলল, ‘পলাশ বাড়ি এসেছে!!
-‘আপনি চিনেন পলাশকে?’
-‘চামেলির বড় ভাই পলাশ। ভালো ছেলে ও।’
পরী মাথা নাড়লো। শায়ের বলল,’কিন্ত ওর থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবেন।’
-‘কেন??’
-‘ভালো ছেলেদের থেকে দূরে থাকবেন আর খারাপ ছেলেদের কথা তো বাদই দিলাম।’
-‘তা আপনি কেমন ছেলে মালি সাহেব??’
-‘আমি আপনার স্বামী পরীজান। আমি যেমনই হইনা কেন আপনার বাস আমাতেই হবে।’
পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফুলগুচ্ছ বের করে পরীর হাতে দিলো। আবারও সেই বেলিফুল। সাদা রঙের এই ফুলটিতে মন মাতানো সুবাস থাকে। কেমন যেন নেশা ধরে যায় পরীর। নাকের কাছে ফুল নিয়ে ঘ্রাণ নিতেই মন ভাল হয়ে যায়।
-‘আপনি ফুলের নেশায় আসক্ত আমি পরীজানের নেশায়।’
শায়েরের চোখে চোখ রেখে পরী বলে,’মালি সাহেব যে নিজ হস্তে গড়েছে বাগান। এই ফুলের নেশায় আজীবন আসক্ত থাকতে চাই।’
-‘একজন মানুষের সবকিছু পরিবর্তন হলেও আসক্তির পরিবর্তন কখনো হয়না। আপনি আমার সেই আসক্তি যা কখনোই পরিবর্তন হবে না পরীজান।’
দীর্ঘক্ষণ দৃষ্টি বিনিময় হলো দুজনের। যে ঠোঁটের হাসির থেকে চোখ ফেরানো যায় না সে হাসি মারাত্মক সুন্দর। যা সামনের পুরুষটিকে প্রচন্ড বেগে আঘাত করে যাচ্ছে। ভালোবাসা সুন্দর হলে তার দেওয়া সবকিছুই সুন্দর।
-‘আপনার হাসি সুন্দর।’
-‘শুধুই সুন্দর??’
হাসলো শায়ের। এই প্রশ্নটা পরী আরেকবার করেছিল তাকে। শায়ের সপ্তবর্ণে সেই উত্তর দিয়েছিল। কিন্ত এবার সে আর কিছু বলল না। তবে পরী বলল,’আপনার হাসিও কম সুন্দর নয়। আপনার মতোই আপনার হাসি সুন্দর।’
-‘পুরুষ মানুষ কখন সুন্দর হয় জানেন?’
-‘কখন?’
-‘একজন পুরুষ সুন্দর তখনই যখন নারী তার কাছে সুখি।’
-‘তাহলে আপনি আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ।’
শায়েরের মতে সব পুরুষ সুন্দর হয় না। চেহারায় মাধুর্য থাকলে কি মনটাও মাধুর্যময় থাকে? নারীকে সুখি রাখার সর্বশ্রেষ্ঠ পরিপন্থা হলো পুরুষের ভালোবাসা। যাতে নেই কোন লোভ,বিদ্বেষ, হিংসা। যে পুরুষ ভালোবাসা দ্বারা একজন নারীকে সুখি রাখতে পারে একমাত্র সেই সর্বোত্তম।
সকালে পলাশ আবারো এসেছে। দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে অনবরত। তখন ঘরের দরজা বন্ধ ছিলো। পলাশ ভাবছে সে শায়ের কে ডাকবে কি না? এরই মধ্যে খুসিনা চলে আসে। চুলার ছাই ফেলার জন্য ভোরেই সে ঘুম থেকে ওঠে। রান্নাঘরের যাওয়ার সময় দেখলো পলাশ শায়েরের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন করছে। তিনি সেদিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন,’এই হতচ্ছাড়া!!তুই এই সক্কালে এইহানে কি করস??’
পলাশ চমকে ফিরে তাকালো। ফুপুকে দেখে একগাল হেসে বলল,’কাইল রাইতে আইলাম নতুন ভাবি দরজা খুলল না। হের লাইগা এহন আইলাম। হেরা মনে হয় ঘূমাইতাছে।’
-‘ঘুমাইবো না তো কি করবো? তোর মতো বলদের লাহান ঘুরবো? এইহানে আইছোস ক্যান??’
পলাশ যে চামেলির মতোই বোকাসোকা তা জানে ফুপু। কেউ কোন কথা বললে তা কিছুতেই পেটে রাখতে পারে না। গড়গড় করে সব বলে দেয়। তাই সে বলে,’মা’য় কইলো সেহরান ভাই নাকি বিয়া করছে। বউ নাকি আমাগো চম্পার থাইকা মেলা সুন্দর। হের লাইগা দেখতে আইলাম।’
-‘এই বলদ এতো বিয়ানে কেউ বউ দেখতে আহে? যা সর!!আর তোরে সেহরান ওর বউ দেখতে দিবো না।’
-‘ক্যান দিবো না। আমি কি মা’র মতো ঝগড়া করি?’
খুসিনা রেগে আরো দুকথা শুনিয়ে দিলো। দুজনের চেঁচামেচিতে শায়ের পরীর দুজনেই জেগে গেলো। শায়ের দরজা খুলে বের হতেই পলাশ সেদিকে তাকিয়ে বলে উঠল,’সেহরান ভাই উইঠা পড়ছে। নতুন ভাবি উঠছে কই দেহি।’
শায়েরের মেজাজ গরম হয়ে গেল। আরেকটু ঘুমাতে চেয়েছিল সে। কিন্ত পলাশের জন্য আর তা হলো না। সে বলল,’তুই এখন ঘরে যা।’
-‘ফুপু কইলো তোমার বউ নাকি দেখতে দিবা না? ক্যান?’
-‘সেটা তোর মা ও ভালো করেই জানে। যা গিয়ে জিজ্ঞেস কর। আর এখন এখান থেকে না গেলে কানের নিচে মারব।’
পলাশ পরিমরি করে দৌড়ে পালালো। বয়সে চম্পার ছোট সে এবং চামেলির বড়। বয়স বেশি নয়। তবে বুদ্ধি কম। যে যা বলে তাই করে। শুধু মিষ্টি খাওয়ার লোভ দেখালেই হলো। বছর খানেক আগে পলাশ নদীতে যায় গোসল করতে। ওখানকার ছেলেরা ওকে মিষ্টির লোভ দেখিয়ে বলে মেয়েরা যেখানে জামাকাপড় বদলায় সেখানে উঁকি দিতে। মিষ্টির লোভে সে তাই করে। সেদিন বেশ মার খেতে হয়েছিল পলাশকে। তার পর হেরোনা তার ভাইয়ের কাছে পলাশকে পাঠিয়ে দেয়। তারপর আর বাড়িতে আসেনি। ছেলেকে নিয়ে বেশ চিন্তিত হেরোনা। এই বোকা ছেলেটা কবে একটু ভালো মন্দ বুঝবে?
গ্রামের মাতব্বর ইলিয়াস আলী। খুবই ভালো একজন লোক। শায়ের গ্রামে খুব একটা আসতো না। তবুও শায়ের কে তিনি খুব পছন্দ করতেন। তাইতো তিনি স্বেচ্ছায় শায়ের কে কাজে নিয়েছেন। শায়েরের কাজ হলো মালপত্রের হিসাব রাখা। প্রতিদিন কতো মাল আসছে যাচ্ছে তা লিখে রাখে সে। লোকদের নানান ধরনের পরামর্শ ও দিয়ে থাকে। শায়েরের কাজে আগ্রহ দেখে ইলিয়াস আলী ভারি খুশি হন। তার ছেলে নেই দুটো মেয়ে। এই বয়সে কাজ সামলাতে হিমশিম খান তিনি। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ভেবেছিলেন জামাই তার ব্যবসা দেখবে। কিন্ত ভাগ্যক্রমে এমন জামাই তিনি পেয়েছেন যে সে ব্যবসার কিছুই বুঝে না।
অবশেষে শায়ের কে পেয়ে তিনি ভিশন খুশি। শায়ের টেবিলে বসে খাতা দেখছে। ইলিয়াস আলী ওর পাশে চেয়ার টেনে বসল। শায়ের বলল,’কেমন আছেন চাচা?’
-‘আল্লাহর রহমতে ভালোই আছি বাবা। তুমি এসে বড় উপকার করলে। আমি জেনে খুব খুশি হয়েছি যে তুমি এখন থেকে গ্রামেই থাকবে।’
-‘জ্বী চাচা,আপনাদের দোয়া আমাকে গ্রামে ফিরিয়ে এনেছে।’
ইলিয়াস আলী ইতস্তত করছে। হয়তো তিনি কিছু বলতে চান। শায়ের তা বুঝতে পেরে বলল,’চাচা আপনি কিছু বলতে চাইলে নির্ভয়ে বলতে পারেন।’
-‘আসলে সেহরান, বড়ই দুঃখে আছি। বড় জামাই তো কিছুই জানে না। ভাবতাছি ছোট মেয়েকে ভাল ছেলে দেখে বিয়ে দেবো যাতে ছোট জামাই আমার ব্যবসা দেখতে পারে।’
-‘ভালো তো। আপনি চাইলে আমিও খুঁজে দেখতে পারি।’
-‘বাবা সেহরান এলিনার মা তোমাকে পাত্র হিসেবে খুব পছন্দ করে। তোমার হাতে মেয়েকে তুলে দিতে পারলে খুশি হবে খুব।’
শায়ের চমকালো না। ও আগেই কিছুটা আন্দাজ করেছিল। তাই অত্যন্ত বিনয়ের সুরে সে বলতে লাগল,’চাচা আপনি হয়তো জানেন না। অবশ্য আমার বাড়ির আশেপাশের মানুষ ই শুধু জানে আমি বিবাহিত। সেজন্য আপনিও হয়তো জানেন না। আমাকে ক্ষমা করবেন।’
চমকে গেলেন ইলিয়াস আলী। সাথে হতাশাগ্রস্থ ও হলেন। কিছুক্ষণ মৌনতা পালন করে হাসি মুখে বললেন,’আমি তো জানতাম না বাবা। না জেনে বলে ফেলেছি তুমি কিছু মনে করো না।’
-‘আপনি আমার বাবার মতো। কিছু মনে করব কেন?’
-‘আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে নতুন বউ কে নিয়ে কাল আমাদের বাড়িতে আসবে। তোমাদের দাওয়াত রইলো। না আসলে আমি বেজার হবো।’
শায়ের হেসে সম্মতি দিলো। সে পরীকে নিয়ে যাবে ওনার বাড়িতে। ইলিয়াস চলে গেলে শায়ের নিজের কাজে মন দিলো। কাজের সময় যেন কাটে না। অথচ পরীর সাথে কাটানো সময়টা যেন দ্রুত চলে যায়।
দুপুর হতেই ফিরে এলো শায়ের। পরী তখন গোসল সেরে উঠোনে শাড়ি মেলছে। শায়ের তা কিছুক্ষণ নির্বিঘ্নে পর্যবেক্ষণ করলো। পরী পেছন ফিরে শায়ের কে দেখেই সেদিকে এগিয়ে গেলো। শায়েরের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো ঘাম ঝরছে কপাল বেয়ে। পরী নিজের আঁচল শায়েরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,’ঘাম ঝরছে আপনার। মুছে নিন।’
-‘আপনি মুছে দিলে মন্দ হয় না।’
পরী বিনা বাক্যে ঘাম মুছে দিয়ে শায়ের কে নিয়ে ঘরে আসে। হাতপাখা এনে শায়ের কে বাতাস করতে করতে বলে,’রৌদ্রের মধ্যে ছাতাটা নিয়ে গেলেই পারেন।’
-‘হুমম। আমি রোজ দুপুরে না এসেও পারতাম। কেন আসি জানেন কি?’
পরী না সূচক মাথা নাড়ায়।
-‘আপনি যখন রোজ দুপুরে গোসল করে ভেজা চুলে গামছা পেঁচিয়ে কাপড় মেলতে যান। তখন আপনাকে সবচাইতে বেশি মোহনীয় লাগে। এই দৃশ্যটা আমি প্রতিদিন দেখতে চাই। আপনি নিজেও জানেন না যে তখন কতটা স্নিগ্ধ লাগে আপনাকে।’
পাখা ঘুরানো থেমে গেল পরীর। স্থির দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইল শায়েরের পানে। শায়ের বলেছিল তার ভালোবাসা পরীকে রোজ কাঁদাবে সেজন্য কি এই মুহূর্তে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে পরীর? পরী খেয়াল করলো তার চোখ থেকে এখনি নোনাজল গড়িয়ে পড়বে। শায়ের বসা থেকে চট করে দাঁড়িয়ে আগলে নিলো পরীকে। চোখের জল পড়ার আগেই তা মুছে দিলো। গালে হাত রেখে পরম স্নেহে চুম্বন করলো পরীর গলায়। তখনই ভারি কিছু টিনের চালে পড়তেই শায়ের পরী ছিটকে দূরে সরে গেল। কি হয়েছে তা দেখার জন্য শায়ের বাইরে এলো। দেখলো উঠোনে একটা বড়সড় নারকেল পড়ে আছে। এটাই সম্ভবত চালের উপর পড়েছে। তখনই নারকেল গাছ থেকে পলাশের কন্ঠস্বর ভেসে আসে,’সেহরান ভাই সরেন। নাইলে আপনের মাথায় পড়বো।’
#চলবে,,,,,