#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_২০
আঁখি অশ্রু ভেজা চোখের পাতা তুলে চাইলো নিসান এর দিকে। চোখে চোখ পড়ে যাওয়ায় আবার নামিয়ে নিলো দৃষ্টি। ড্রয়িংরুমের সবার নজর এখন আঁখির দিকেই। আঁখি আমতা আমতা করে বললো,
“আমার দিকে সবাই এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমি কথা বলতে পারি না।”
ব্যাস! একেকজন একেক দিকে চোখ ফিরিয়ে রাখলো। শুধু নিসান তাকিয়ে রইলো একইভাবে। আঁখি হাত মুচড়াতে মুচড়াতে বললো,
“উনি বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতে চেয়েছেন বাবার কাছে। আমি সংকোচ, লজ্জা আর ভয়ে শুধু সময় নিচ্ছিলাম উনার কাছ থেকে। উনি তাড়া দিতেন আমায় রোজ। কয়েকবার এও বলেছেন, যদি আমার এই আড়ষ্টতা আর গাফিলতির জন্য কোনভাবে আমার বিয়ে অন্যকারো সাথে ঠিক হয়ে যায় তাহলে উনি কোনভাবে আমায় সাহায্য করবেন না বিয়ে ভাঙতে। সোজা বিয়ের আসরে গিয়ে বরের হাত পা ভেঙে আমায় তুলে নিয়ে আসবেন। একদিন এসব নিয়েই উনি খুব রেগে যান আমার উপর আর রাগারাগি করে ফোন বন্ধ করে রাখেন। উনার ফোন নাম্বার ছাড়া আর কোন যোগাযোগের উপায় আমার জানা ছিলো না। যেদিন রাতে রাগ করে উনি ফোন বন্ধ করলেন তার পরের দিন হুট করেই রতন নামের লোকটা কয়েকজন লোক নিয়ে আমায় দেখতে আসে আর দেখেই পাকা কথা বলে যায়। সাতদিন পর বিয়ের তারিখ ও ঠিক করে। সেই মুহুর্তে উনাকে ফোনে না পেয়ে মাঝ সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়ার অবস্থা হয় আমার। তারপর সাহস করে আমি বাবাকে বলি আমার ওই লোকটাকে পছন্দ হয়নি। অনেক কারন দর্শাই অপছন্দ হওয়ার কিন্তু কোন কিছুতেই কিছু হয় না। বাবা আমাকে বকাঝকা করে তার পছন্দের উপরে কথা বলার জন্য। মারতেও আসে কিন্তু মায়ের জন্য পারে না। শেষে কোন কূলকিনারা খুঁজে না পেয়ে উনার কথা বলে দিই সবাইকে। উনার পড়াশোনা, চাকরি, বয়স সবকিছু রতন নামের লোকটার সাথে তুলনা করে কথা বলি, তাতে বাবা আরও ক্ষেপে যায়। কেমন যেনো উন্মাদের মতো করতে থাকে। ঠাকমাও বাবাকে সঙ্গ দেয়। আমার উপর ক্ষেপে আমার গায়ে হাত তুলে দুজনে মিলে। মা ঠেকাতে এলে মাকে ধাক্কিয়ে ধাক্কিয়ে ফেলে দেয়। মা থেমে না গিয়ে বারবার আমাকে বাঁচাতে এলে মাকেও মারধর করে বাবা। মেরে মেরে অজ্ঞান ককরে ফেলে মাকে।”
এটুকু বলে কেঁদে উঠলো আঁখি। গলা আটকে আসছে দলা পাকানো কষ্টের দমকে।
আঁখির চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে পিঠে হাত রেখে ভরসা দিলো দোলা। সবাই আবেগঘন হয়ে গেছে আঁখির কথায়। রাগ হচ্ছে এমন নিষ্ঠুর কথা শুনে। আঁখি একটু স্বভাবিক হয়ে আবারও বলতে লাগলো,
“মাকে অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে রেখে আমাকে আরও মারে। তারপর ঘরবন্দী করে রেখে দেয়। পরেরদিন সকালে শুনি যে বিয়ের ডেট ছয়দিন এগিয়ে আনা হয়েছে। ওইদিনই হবে বিয়ে। আমার কান্নায় কারো মন গললো না। তারপর সন্ধ্যায় বিয়ের জন্য যখন সাজাতে এলো ওই লোকের পাঠানো পার্লারের দুজন মেয়ে তখন আমার বান্ধবী নিশা এসেছিলো সাথে। ও আর আমার মা বাথরুমে যাওয়ার নাম করে আমাকে পালাতে সাহায্য করে। ওর এক কাকার বাড়ি রাতটা থাকার ব্যাবস্থা করে দেয়। পরের দিন সকালে আমাকে কোথাও একটা নিয়ে যেতে চেয়েছিলো ও কিন্তু আমি চলে এসেছিলাম বাড়িতে। বাড়িতে আসার পর আমাকে আবারও মেরে ঘরবন্দী করে রাখে বাবা। পরে উনার ফোন আসে, তারপর তো বাবা জোট বেঁধে তৈরী হয়ে থাকে উনাকে মা’রা’র জন্য।”
আঁখি একটু থেমে আবারও বললো,
“উনাকে বারবার থামিয়ে রেখে আমি ভুল করেছি। উনাকে আরও আগে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতে দিলে এতো কিছু হতো না। আমি ক্ষমা চাইছি সে জন্য।”
দোলার স্বামী গৌরব চিন্তিত মুখে বললো,
“ব্যাস! এটুকুই? এতেই শা’লাবাবু এতো রেগে আছে?”
নিসান আঁখি কেউ জবাব দিলো না। নিসান এখনো একইভাবে চেয়ে আছে আঁখির দিকে।
দোলা বলল, “তোমাদের বাড়িতে তো পুলিশ, চেয়ারম্যান এসেছিলো। তাদের তোমার মায়ের উপর হওয়া অত্যাচারের কথা কেনো বলনি? তোমার বাবার তো উপযুক্ত শাস্তি হওয়া দরকার। আর তোমার ঠাকুমাকেও শিক্ষা দেওয়া উচিত। এই বয়সে যদি এমন করে তাহলে কয়েক বছর আগে যে তোমার মায়ের সাথে কি করেছে তা তো ধারনার বাইরে।”
“মা আমাকে দিব্যি দিয়ে এনেছিলো ঘর থেকে। যাতে মাকে নিয়ে কাউকে কিছুই না বলি। শুধু ওইদিন না, মা সবসময়ই এমন করতো। বলতো ঘরের কথা পরের কাছে বলতে নেই। ভুলেও কারও কাছে কিছু বললে মা আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিতো।”
দোলা রাগী চোখে নিসান এর দিকে চেয়ে এবার বললো,
“নিসান। মেয়েটার তো কোন দোষই দেখছি না আমি। ও বাজে একটা পরিস্থিতিতে ফেঁসে গেছিলো আর তুইও ছিলিস না তখন পাশে। কোথায় এখন অন্তত ওকে সাপোর্ট করবি তা না করে এমন কেনো করছিস? বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করেছিস আঁখিকে এভাবে অযথা কষ্ট দেওয়ার জন্য?”
নিসান কারও কথায় কান দিচ্ছে না। দৃষ্টি এখনও আঁখির দিকে। আঁখি উশখুশ করছে। নিসানের একরোখা দৃষ্টিতে গায়ে কাটা দিচ্ছে আঁখির। নিসান একটু নড়েচড়ে বসলো। আঁখিকে বললো,
“আমার দিকে তাকাও।”
আঁখি ভীতিগ্রস্ত হয়ে তাকালো। নিসান আঁখির দৃষ্টি দখল করে শান্ত কন্ঠে বললো,
“আমাকে ভালোবাসো?”
আঁখি আলগোছে সবার দিকে চাইলো। দোলা তার ননদ আর দেবরকে ইশারা করে চলে যেতে বললো। আঁখি লজ্জামিশ্রিত মুখ করে মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। নিসান আবার বললো,
“ভালোবাসলে বিশ্বাস রাখতে হয়। তুমি রাখনি।”
“আমি বিশ্বাস করি আপনাকে। নিজের থেকেও বেশি।”
“তুমি এতোক্ষণ যা যা বললে তা তো আমি বলতে বলি নি। আমি বলতে বলেছিলাম তুমি কি কি করেছো সেটা। কই তেমন কিছু তো বললে না। উল্টো আমার রাগ করার কারণ হিসেবে একটা উদ্ভট কারণ দর্শালে। এখন কি আমার আরও একটু বেশি রেগে যাওয়া উচিত?”
“আমি বুঝতে পারছি না। আপনি বলুন না আমার কোন ব্যাবহারে আপনি রাগ করেছেন। আমি আর কোনদিন তেমন কিছু করবো না।”
“সেদিন নিশার সাহায্যে পালানোর আগে ঘরে কি করছিলে তুমি?”
আঁখি ভীত হলো। হৃদকম্পন বেড়ে গেলো এক নিমিষেই। নিসান আবারও বললো,
“পালিয়ে যাওয়ার পরের দিন নিশার কাকার বাড়ি থেকে তোমাদের বাড়ি ফিরে আসার মাঝের সময়টায় কোথায় গেছিলে? বাড়ি ফিরে যাবে বলেই কি বেড়িয়ে ছিলে নিশার কাকার বাড়ি থেকে?”
আঁখি মুখে হাত দিয়ে কেঁদে উঠলো। গা কাঁপিয়ে ফুপাতে লাগলো। নিসান এতোক্ষণ শান্ত স্বরে প্রশ্ন করছিলো এবার চিৎকার করে বলে উঠলো,
“কথা বলো! এখন চুপ করে থাকলে চড়িয়ে দাঁত খুলে ফেলবো।”
গৌরব নিসানকে শান্ত করতে এলে নিসান চিল্লিয়ে বলে উঠে,
“কদম না গৌরব দা। তুমি কোন কথা বলবে না। তুমি জানো না ও কি করেছে! সেদিন নিশা আর মা যদি সময়মতো ঘরের দরজা খুলে ভেতরে না যেতো তাহলে ও বেঁচে থাকতো না আজ, মরে যেতো ও। আমি… ও কি করে… হুম! মেডাম দুঃখের চোটে গলায় দড়ি দিতে গেছিলেন!
তারপর আবার কি করেছে জানো? পরের দিন সকালে নিশার কাকার বাড়ি থেকে বের হয়েছিলো বাড়ি ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নয়, গাড়ির নিচে পড়ে মরবে বলে বেরিয়েছিলো। রাস্তায় নেহাত নিশার পরিচিত কয়েকজনের সাথে দেখা হয়ে গেছিলো তাই তাদের জন্য ফিরে গিয়েছিলো বাড়ি। নয়তো ওর শ’য়’তা’ন বাপের বাড়িতে নয় জমের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাতো। ওকে তো মরার সখ আমি ঘুচিয়ে ছাড়বো।”
নিসান আঁখির হাত ধরে টেনে নিজেদের রুম পেরিয়ে দোলার রুমে গিয়ে ঢুকলো। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে সময় নিলো না। এদিকে দোলা আর গৌতম চিন্তিত হয়ে ডাকাডাকি করতে লাগলো অবিরত। নিসান না তো কোন জবাব দিলো আর না খুললো দরজা। দুজনে চিন্তায় পায়চারি করতে লাগলো দরজার বাইরে। কে জানে ভেতরে কি হচ্ছে!
_________________________
ফোনের রিংটোনের আওয়াজ শুনে ঘুম ভাঙলো ফাল্গুনীর। ফোন হাতে নেওয়ার আগেই কেটে গেলো বলে আবার ঘুমিয়ে পরলো ফোন পাশে রেখে। জাগ্রত অফিস চলে যাওয়ার পর সবকিছু ভেবে ভেবে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়েছিলো ফাল্গুনী। সোহাগের মুখোমুখি হওয়ার কথা ভাবলেই লজ্জায় চোখ মুখ বুঁজে আসতে চাইছিলো। সোহাগ তো এখনো কিছু জানেই না। জানার শুরুটা হলো কিনা চুমু দিয়ে! কথাটা ভেবেই কেমন লজ্জা করছিলো তার। আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো একসময়।
আবারও ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। ফাল্গুনী রিসিভ করে কানে নিলে ওপাশ থেকে জাগ্রত বললো,
“এক ছোট ভাইকে পাঠিয়েছি তোমার জন্য খাবার দিয়ে। দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবে। খেয়ে নিও।”
“আপনি খেয়েছেন?”
“না এখন খাবো।”
“আনহেলদি খাবার এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবেন। আপনি যে কি খান তা তো দেখলাম সকালে। যাইহোক, আসার সময় বাজার করে নিয়ে আসবেন আর…ওইতো কলিংবেলের আওয়াজ এলো। হয়তো খাবার নিয়ে এসেছে আপনার ছোট ভাই। কিন্তু দশ মিনিট তো এখনও হয়নি। আপনি লাইনেই থাকুন। দেখি কে এসেছে।”
দরজা খুলতেই ফাল্গুনীর চোখমুখের অভিব্যক্তি পাল্টে গেলো এক মুহুর্তেই। সোহাগ দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। ফাল্গুনী কথা বলার ভাষা হারিয়ে বসলো আশ্চর্যান্বিত হয়ে। সোহাগ ফাল্গুনীকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে চলে আসলো চোখের পলকে। ওদিকে জাগ্রত দরজা খোলার আওয়াজ পাওয়ার পর ফাল্গুনীর কোনো সারা শব্দ না পেয়ে ডাকতে লাগলো অনবরত। সোহাগ ডাইনিং টেবিলের একবপাশের একটা চেয়ার টেনে বসে এক গ্লাস জল ঢেলে পান করলো শান্ত হাতে। জাগ্রত ফোন কেটে আবারও ফোন করলো ফাল্গুনীকে। ফাল্গুনী রিসিভ করবে কি করবে না ভেবে সাইলেন্ট করতে নিয়েও আবার কিছু একটা ভেবে রিসিভ করে নিলো কল। জাগ্রতকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললো সোহাগ এসেছে বাসায়। জাগ্রত আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। ফোন কাটতে মানা করলো ফাল্গুনীকে। তৎক্ষনাৎ বসের কাছে ইমার্জেন্সির কথা বলে অফিস থেকে বেড়িয়ে পড়লো বাসার উদ্দেশ্যে। ফাল্গুনী ফোন হাতে নিয়ে সোহাগের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সোহাগ নির্বিকার বসে আছে। তার দৃষ্টি বরাদ্দ টেবিলের খালি গ্লাসটায়।
“আপনি এখানে এভাবে…. কেনো? আমাকে ফোন করতেন আর আমার ঠিকানা কোথায় পেলেন আপনি?”
“তোমার প্রাক্তন স্বামী কখন আসবে ফাগুন?”
“সোহাগ! উনি আমার প্রাক্তন নন। উনার সাথে এক বছরের জন্য সেপারেশনে থাকার অনুমতি দিয়েছিলো কোর্ট। তারপর আমাদের আর ডিভোর্স হয়নি। আর আমি বলেছিলাম এই নামটায়…”
“এই নামটায় যেনো আমি না ডাকি তাইতো?”
“আপনি যেভাবে ওই নামটায়…”
“আজ সকালে ওই লোকটা তো ঠিকই তোমাকে ওই নাম ধরে ডাকলো। এই নামটা নাকি তোমার খুব কাছের কেউ ছাড়া ডাকে না। এক দিনের ব্যাবধানে কেউ এতোটা কাছের কি করে হতে পারে বলবে?”
“আপনি আমার ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করছেন। আমি কি করবো না করবো তা আমার সিদ্ধান্ত। দয়া করে আমার ব্যাক্তিগত জীবনে আপনি ঢুকবেন না।”
“তুমি বলেছিলে তুমি কখনো আর ফিরে যাবে না আগের জীবনে। বিয়ের উপর বিশ্বাস উঠে গেছে, কোন সম্পর্কেই আর বিশ্বাস করো না, এমন অনেক কথা বলেছিলে আমায়। আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলে তুমি। তাহলে তার কাছে কেনো ফিরে এলে? আমি কেনো সে সুযোগ টা পেলাম না।”
“আপনি একদিন আমার সম্মান বাঁচিয়ে ছিলেন আর মায়ের খোঁজ খবর রাখতেন প্রায়শই। তাই আপনার আমার প্রতি দুর্বলতার কথা শুনেও বন্ধুত্বের সম্পর্ক টিকিয়ে গেছি। আপনাকে তো কখনো আমাদের সম্পর্ক নিয়ে বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি কিছু হওয়ার আশা আমি দিই নি। সবচেয়ে বড় কথা আপনার তো বিয়ের কথা চলছে, আপনি তো রাজিই বিয়ের জন্য। মেয়ে ঠিক করে রেখেছেন আবার বিয়ের ডেট ও নাকি খুব তাড়াতাড়িই ঠিক হবে। তাহলে আজ এমন আচরণের কারণ কি?”
“তোমাকে সহজ করার জন্য মিথ্যে বলেছিলাম কথাটা। মাকে বলে রেখেছিলাম, তোমাকে ছাড়া অন্যকাউকে আমি বিয়ে করবো না।”
“এসব আপনার করা ভুল। আমার এসবে কোন হাত নেই। আমি আপনাকে আশা দিই নি কখনো আমাদের সম্পর্ক নিয়ে, উল্টো এড়িয়ে চলেছি আপনাকে। আপনি বুঝেও অবুঝের মতো আচরণ করে গেছেন সবসময়। আমি যেমন এটা বলেছিলাম বিয়ে থেকে আমার বিশ্বাস উঠে গেছে, আমি ফিরবো না কখনো আগের জীবনে, ঠিক তেমন এও তো বলেছি আমি জাগ্রতকে প্রতি মুহুর্তে অনুভব করি। তাকে ভোলার চেষ্টা করেও ভুলতে পারি না কখনো। বলেছিলাম তো?”
“ভালোবাস তাকে?”
“না বাসলে ফিরবো কেনো?”
“ফিরবে না সেটাও তো বলেছিলে। সেটা যদি মিথ্যে হতে পারে তাহলে ভালোবাসার কথাও মিথ্যে।’
“সোহাগ আপনি চুপ করুন। আপনার সঙ্গে আমি আমার ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে আর একটা কথাও বলতে ইচ্ছুক নই। আপনাকে শক্ত মুখে আমার বাসা থেকে বেড়িয়ে যেতে বলতে আমার ভীষণ বাঁধছে। নিজে থেকে চলে গেলে খুশি হবো। নয়তো আমাকে তেমন কিছুই করতে হবে।”
“বলতে আর বাকি কি রাখলে?”
“বুঝে থাকলে নিজ দায়িত্বে বেরিয়ে যান বাসা থেকে।”
“মামাকে দিয়ে তোমার মায়ের কাছ থেকে এতো কষ্টে আর কৌশলে ঠিকানা বের করেছি এভাবে চলে যাবো বলে? তাই মনে হয় তোমার?”
“কি চাইছেন কি আপনি?”
‘তোমার ‘সে’ এখনো আসছে না যে? আমার নাম ধরে যেভাবে বললে সোহাগ এসেছে, আগে পিছে কোন কথা নেই, তাতে তো মনে হলো তোমার ‘সে’ আমার বিষয়ে বেশ ভালোই জানে। তুমিই জানিয়েছো নিশ্চয়ই। আমি যে তোমাকে ভালোবাসি সেটাও বলেছো তাই না?”
“না। বলি নি। সে বুঝে নিয়েছে।”
“বুঝে নিয়েছে মানে কি? সে আমাকে চেনে?”
জাগ্রত বাসার সামনে ফোন কানে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছুক্ষণ যাবত। ভেতরে ঢুকেনি এসে থেকে। এবার মনে হলো এখন তার ভেতরে যাওয়া উচিত। জাগ্রত পা চালিয়ে ঢুকে গেলো বাসায়। দরজা খোলাই ছিলো তাই সোজা গিয়ে সোহাগের মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসে গেলো। হাতের বিরিয়ানির প্যাকেট টা রেখে দিলো টেবিলের মাঝখানে। সোহাগ জাগ্রতকে দেখে অবাক হলেও নির্বিকার মুখে বললো,
“বাসে দুজনের অভিনয় টা কিন্তু দারুণ ছিলো। আমাকে একটুর জন্যও কেউ বুঝতে দেননি দুজনে দুজনকে চেনেন। ফাল্গুনীর কথা বাদ দিলাম, ফেরি তে থাকতে আপনি কি করে নিজের বউকে আমার সাথে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে দোতলায় গিয়ে বসে ছিলেন বলুন তো? আমি তো পারলাম না ফাল্গুনী আপনার কাছে আছে কথাটা শোনার পর নিশ্চিন্তে বসে থাকতে।”
#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_২১
“বাসে দুজনের অভিনয় টা কিন্তু দারুণ ছিলো। আমাকে একটুর জন্যও কেউ বুঝতে দেননি দুজনে দুজনকে চেনেন। ফাল্গুনীর কথা বাদ দিলাম, ফেরি তে থাকতে আপনি কি করে নিজের বউকে আমার সাথে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে দোতলায় গিয়ে বসে ছিলেন বলুন তো? আমি তো পারলাম না ফাল্গুনী আপনার কাছে আছে কথাটা শোনার পর নিশ্চিন্তে বসে থাকতে।”
জাগ্রতর ভেতরটা রাগে টগবগ করছে। ইচ্ছে করছে এ বেটাকে হাত-পা ভেঙে তারপর বাসা থেকে রাস্তায় ফেলে আসতে। কিন্তু নতুন করে শুরু করা সংসারে ভেজাল টেনে আনতে চায় না তাই হাত দুটো কে সংযত করে কথার বান ছুড়লো অগ্নিগোলক এর ন্যায়। আত্মবিশ্বাসী মুখাবয়বে সামান্য ঠোঁট ছড়িয়ে বললো,
“কি মনে হয়? নিশ্চিন্তে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে ফাল্গুনী আজ আমার সাথে থাকতো? আসলে উজানের কৈ আমার মুখে রুচে না। তাই সময় নিয়ে মুখে মুখ লাগিয়ে ঝগড়া করে মনের সমস্ত অভিযোগের নিমিত্ত শেষ করেছি। তারপর চেয়েছি ফাল্গুনীকে। আর পেয়েও গেছি। আমার চাওয়া খাঁটি ছিলো তাই হাত-পা গুটিয়েও পেয়ে গেছি ওকে, তোমার চাওয়া খাঁটি ছিলো না তাই জোঁকের মতো গায়ে পড়ে থেকে মিষ্টি মিষ্টি কথায় ও পাওনি। আর তোমার শেষ কথা গুলো যদি মাথা পেতে মেনেও নেই সেই অনুযায়ী বলবো, ফাল্গুনী আমার নিজের বলে ভরসা ছিলো কোথাও একটা। তাই ছিলাম নিশ্চিন্তে। কিন্তু তোমার ও নিজের কেউ নয় তাই ভরসা করে থাকতে পারনি। চলে এসেছো লেজ নাড়াতে নাড়াতে।”
ফাল্গুনী বিরক্তিভাজন চেহারায় দাঁড়িয়ে থাকলেও ভেতরে ভেতরে রাগ হচ্ছে ভীষণ। সোহাগ এর দোমুখোপনা গায়ে আষ্টেপৃষ্টে রাগ ধরিয়ে দিচ্ছে। সোহাগ যেদিন বিয়ে করার কথা বলেছিলো সেদিন থেকে এক বছর নাগাদ কথা বলেনি ফাল্গুনী। মুখোমুখি হলেও চোখে চোখ পড়তে দেয়নি কখনো, কথা বলা তো দূর। একদিন দুপুর বেলায় নির্জন রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দুজন নেশাগ্রস্ত বকাটের পাল্লায় পড়েছিলো ফাল্গুনী, সেদিন কোথাথেকে ভাগ্যক্রমে সোহাগ পৌঁছে গেছিলো সঠিক সময়। দুজন ছেলের সাথে সে একা লড়াই করে মাথা ফাটিয়ে রক্তারক্তি কান্ড ঘটেছিলো। ডান হাতটাও মচকে ছিলো কায়দা মতোন। সেদিনের ঘটনার পর ফাল্গুনী আর মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারে নি। সোহাগ ও কথা দিয়েছিলো ফাল্গুনী না চাইলে সে কখনো তাদের বন্ধুত্বের মাঝে অন্যকোন সম্পর্কের রেষ টেনে আনবে না। তাই ফাল্গুনী নিজেও সোহাগের সাথে বন্ধুত্ব জমানোর চেষ্টা করতো মন থেকে। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে সোহাগের সাথে মন থেকে সহজ হতে পারতো না তাই উপরে উপরে বন্ধুত্ব টিকিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে গেছে গত এক বছর যাবত। আজ আচমকা এইভাবে সোহাগের বদল দেখে নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে এমন বিপদ ঘাড়ে তুলে রাখার জন্য। সবকিছু ভেবেচিন্তে বিরক্তিমাখা শ্বাস ফেললো ফাল্গুনী। কাউকেই আর কথা বাড়াতে দিলো না। দুজনকে থামতে বলে নিজে বলে উঠলো,
“আপনারা দুজনেই একটু থামুন। কথার কেন্দ্রবিন্দু যেহেতু আমি তাই আমাকে একটু কথা বলতে দিন। আমি দুজনকেই কিছু কথা ক্লিয়ার করতে চাই। প্রথম কথা আপনাকে বলতে চাই জাগ্রত।”
ফাল্গুনী জাগ্রতর নাম নেওয়ার সাথে সাথেই সে বলে উঠলো,
“আমি তোমাকে বিশ্বাস করি, ভরসা করি। তোমাকে নিয়ে আমার কোন অভিযোগ তো দূরে থাক প্রশ্নও নেই। এই উটকো টাকে নিয়ে তো একদমই না। আর কিছু আছে বলার?”
ফাল্গুনীর মুখের প্রশ্নগুলো কেড়ে নিয়ে জবাব দিলো জাগ্রত। ফাল্গুনী সন্তুষ্টির হাসি হাসলো নিজ মনে। মুখে কোন অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো না। মাথা নাড়িয়ে না জানালো শুধু। অর্থাৎ আর কিছু জানার নেই। তারপর সোহাগের দিকে মুখ না ফিরিয়েই নাম ধরে ডেকে বললো,
“শুনুন সোহাগ, আপনার কোন স্বভাবের জন্য আপনার স্ত্রী আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে তা আমি জানি না। তবে একটা কথা বলি শুনুন, আমি আমার স্বামীর থেকে দূরে ছিলাম চার বছর। এ চার বছরে তার প্রতি আমার অভিযোগ, অভিমান আর রাগের সঙ্গে ভালোবাসা টাও পুষে রেখেছি। কোনটাই আলগা হতে দেইনি। আমার রাগ, আর অভিযোগ গুলো মিলিয়ে গেছে তার সান্নিধ্যে। আর ভালোবাসা! তা কোনদিন ফুরোবে না। আপনি দয়া করে চলে যান এখান থেকে। আর কখনো আমাদের জীবনে চোখ ফিরিয়ে চাইবেন ও না।”
_____________________
“ছাড়ো বলছি! হাতল টা ছাড়ো! নয়তো ঠাস করে এখানেই ফেলে দিবো হাত খালি করতে। তারপর দেখবো তোমার গায়ের জোর কতো। দু-হাত বন্ধ বলে পেয়ে বসেছো না?”
আঁখির নিজের ভীতিপূর্ণ মুখের আদোলে আরও খানিক ভয় মাখালো। আরও একটু করুন কন্ঠে বললো,
“আপনি আমাকে নামিয়ে দিন, দয়া করে এমন করবেন না। আমি আর কখনো অমন ভুল আর করবো না। কোনদিনও না। আপনি শান্ত হোন, আপনার দুটো পায়ে পরি। এবারের মতো আমাকে ক্ষমা করে দিন।”
“একটা কথাও বলবে না তুমি। আজ তো তোমার ম’রা’র সখ আমি ঘুচিয়েই ছাড়বো। মানুষ বউ কোলে তুলে প্রেম করে আমি বউ কোলে নিয়ে বারান্দা ঝাপিয়ে ম’র’বো। তাও আবার দুজন একসাথে। বউ এর সখ পূর্ণ করতে হবে তো! তুমি দরজার হাতল টা ছাড়ো।”
দু’হাতে আঁকড়ে ধরা দরজার হাতল খানা ছেড়ে দিলো আঁখি। তবে হাত খালি রাখলো না। তৎক্ষনাৎ জাপটে ধরলো নিসান এর গলা। শরীরের সমস্ত শক্তি জড়িয়ে আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলো দুটো দেহ। আঁখির পাতলা গোলগাল গড়নের মুখখানা গুঁজে দিলো নিসান এর কাঁধ আর গলার মাঝামাঝিতে। নিসান এর পৌরুষ হৃদয়ে কাঁপন ধরানোর দায়িত্ব যেনো আটঘাট বেঁধে নিয়েছে আঁখির উদ্রি্ত শ্বাস প্রশ্বাস। নিসান হাতের বাঁধন ঢিলে করলো। যেনো এই বুঝি ছেড়ে দেবে তার হাত দুখানা। আঁখির কোন হেলদোল দেখা গেলো না তাতে। নিসান এবার নামিয়ে দিতে চাইছে আঁখিকে। কিন্তু আঁখি আর ছাড়ছে না। বন্ধ মুখে এক অঘোষিত যুদ্ধ শুরু হলো যেনো। নিসান এবার দুষ্টু হেসে নাক ডুবালো আঁখির গ্রীবাদেশে। আঁখি তৎক্ষনাৎ আঁতকে উঠে মাথা তুলে নিলো, হাত হয়ে গেলো আলগা। নিসান এক মুহুর্তও দেরি না করে নামিয়ে দিলো আঁখিকে কোল থেকে। তারপর গটগট করে চলে গেলো দরজার ছিটকিনি খুলে বাইরের দিকে।
নিসানকে বেড়িয়ে আসতে দেখে দোলা, গৌরব আর তার ভাই বোন সাম্য আর মিলি এগিয়ে এলো চিন্তিত মুখে। সাম্য আর মিলি নিসানের সামনে না দাঁড়িয়ে চট করে দোলার রুমে ঢুকে পড়লো আঁখির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে। এদিকে দোলা আর গৌরব নিসানকে আঁটকে কিছু জিজ্ঞেস করতে নিলে সে দাঁড়ায় না এক মুহুর্তও। কোনমতে পাশ কাটিয়ে চলে যায় বিল্ডিংয়ের বাইরে।
“আঁখি বৌমনি! তুমি এভাবে দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে আছো কেনো?”
মিলির প্রশ্নে আরও একটু গুটিয়ে গেলো আঁখি। তবে মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলো। নিজেকে একটু ঠিকঠাক দেখানোর প্রচেষ্টা করে কিছু বলতে নিলে সাম্য বাঁধ সেধে জিজ্ঞেস করে,
“নিসান দা তোমায় মেরেছে বৌমনি? নিসান দা কিন্তু হেব্বি মারপিট জানে। কতোবার যে হাত-পা আর মাথায় ব্যান্ডিজ তুলেছে তার হিসেব নেই।”
এর মধ্যে দোলা আর গৌরব চলে এসেছে রুমে। সাম্য আর মিলি কে চুপ করতে বলে আঁখিকে বললো নিজের ঘরে যেতে। নিসান এর গলার পাশে জলে ভেজা দেখেছে দুজনে। তা যে আঁখির চোখের জল তা আন্দাজ করে নিয়েছে দুজন। তার পাশাপাশি নিসান এর মত কাটখোট্টা মানুষের নত দৃষ্টি দেখে আরও একটুখানি গভীর ভাবে আন্দাজ করে নিয়েছে। তাই তো আঁখিকে না ঘাটিয়ে একলা থাকার ব্যাবস্থা করে দিলো।
________________
রঙিন টিনের বেড়া দেওয়া এক গ্রামীণ কফি-শপে বসে আছে রতন। পায়ের উপর পা তুলে এক হাতে কফির কাপ আরেক হাতে আধ খাওয়া সিগারেট ধরিয়ে সামনের দিকে মুখ লটকিয়ে বসে আছে সে। তার সামনের চেয়ারে বসা লোকটার দিকে কিছুক্ষণ তীর্যক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলে উঠলো
“এলাকার মেম্বার তো এবার আমিই হবো তাতে কোন সন্দেহ নেই। ভোটের আর চার মাস বাকি। টাকা পয়সা যা গোছ করা আছে তাতে আমাকে এবার হারাতে পারবে না ওই সবুজ রহমান। আর বাকি যারা আছে তারা তো ধারে কাছেও আসতে পারবে না। আর সুভাষ চন্দ্র, বাজারের ইজারাদার হওয়ার স্বপ্ন দেখা তুমি বাদ দাও। তোমাকে বাজারের ওই দোকান থেকে উচ্ছেদ করার দায়িত্ব এখন আমার। সেটা খুব ভালোভাবেই পালন করবো আমি। আমি তোমার মতোন নিমকহারাম নই। যে দায়িত্ব নেই তা পালন করে ছাড়ি।”
“আমার কি দোষ কও? আমি কি করলাম? আমি কি আমার মেয়ারে ভাগাইয়া দিছি? আর তাছাড়া আমি তো কইলাম একটা আবিয়াইত্তা মেয়া আমি এক সপ্তাহের মধ্যে যোগাড় কইরা দিমু। তোমার বিয়ার দায়িত্ব এহন আমার। আমি তোমার বাপের বয়সি মানুষ….”
“চুপ! একদম বাপ নিয়ে কোন কথা না। একটাও না।”
“আইচ্ছা বুঝলাম। কমু না বাপ নিয়া। কিন্তু একটা কতা না কইয়া পারতাছিনা। তুমি চাও পরির নাহাল একখান মাইয়া তাও আবার আবিয়াইত্তা। তাও আবার উঁচায় লম্বায় ফিটেস। আগের বউয়ের থিকাও বেশি নরম সরম হওয়া চাই। কিন্তু এমন মাইয়া কি আর বউ মরা এক…মানে যার একবার বিয়া হইয়া বউ মরছে তার কাছে বিয়া দিবার চায় কেউ? খুঁজতে একটু সময় লাগে তো তাই না। ওইদিকে এক ঘটকও তো লাগাইয়া রাখছো, লাভ কি হইছে? কিছুই না। তার থিকা একটা ভালা কতা কই। মেয়া একখান মাতায় আছে আমার। এক্কেরে তুমার মনের মতো। আমি হেইডা গছানোর চেষ্টা করি। তুমি না-হয় আমার ব্যাপার ডা এট্টু দেহো।”
রতন ভাবুক রইলো কিছুক্ষণ। তারপর সায় জানিয়ে চলে গেলো চশমা চোখে দিয়ে। তবে যাওয়ার আগে কফি আর সিগারেটের টাকা টা দিয়ে গেলো না। দিতে হলো সুভাষ চন্দ্রকে। টাকা দিতে দিতে দু চারটে বাংলা গালিও ছাড়লো মুখ নাড়িয়ে নাড়িয়ে।
~চলবে
~চলবে
।