পুনর্মিলন পর্ব -৩৫+৩৬

#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৩৫

“সবসময় তোমার হয়ে কথা বলে দেওয়ার জন্য উওরওয়ালা কোন জ্বীন ভাড়া করে পাঠাবে না নিশ্চয়ই? নিজের হয়ে নিজেকেই বলতে হবে। চাপায় জোর চাই; আর মনেও। কেউ নয় ছয় শোনাতে এলে তাকে চটজলদি নয় ছয়ে গুণ, ভাগ, যোগ, বিয়োগ করে ফলাফল টা দেখিয়ে দিতে হবে। সামনের মানুষটা আমি হই বা আমার ছেলে অথবা বাইরের লোক। অন্যায় না নিজে করবে আর না অন্যের টা মুখ বুজে সহ্য করবে। কাউকে ছাড় দেবে না; মনে থাকে যেন।”

আঁখি টলটলে চোখটায় হাত বুলিয়ে মুছতে মুছতে ঘাড় কাত করে সায় জানাল। চন্দনা আবারও বলে উঠলো,

“তখন নাকি ভাল করে খেতে পারনি নিসান বলল। নিসান-ও খায় নি। আমার রুমে গিয়ে বস, দুজনের জন্য খাবার নিয়ে আসছি।”

নিসান একবারও মায়ের কাছে আঁখির কথা বলেনি যে সে খেতে পারেনি। তবুও নিজের কথাটা বুঝতে না দিয়ে নিসান এর কথা বলে পাঠিয়ে দিল রুমে।

আঁখি শ্বাশুড়ী মায়ের রুমের সামনে এসে দরজা চাপানো দেখে একটু দ্বিধায় পড়ে গেল ভেতরে ঢুকবে কিনা ভেবে। অনুষ্ঠানের বাড়ী, যখন তখন যে কেউ যেকোন রুম ব্যাবহার করছে নিজের জন্য। কেউ সাজগোজ করে তো কেউ ওয়াশরুম ব্যাবহার করতে আসছে। আঁখি ভেবেচিন্তে আলতো হাতে নক করল দরজায়। বলল, “ভেতরে আসব?”
ভেতর থেকে নিসান এর আওয়াজ আসল, “আসুন মহারাণী।”

আঁখি নিসান এর গলা শুনতে পেয়ে চট করে দরজা খুলে ফেলল। দরজা গিয়ে জোরসে লাগল দেয়ালে। শব্দ হল ভাল-ই। আঁখি বোকা একটা হাসি দিয়ে আস্তেধীরে দরজাটা আবার চাপিয়ে দিল।

নিসান উপুর হয়ে শুয়ে ছিল বিছানায়। আঁখি আসার পর উঠে বসল। ইশারায় বসতে বলল পাশে। আঁখি নিসান এর পাশে না বসে একটু দূরে রাখা চেয়ারটা টেনে বসে পড়ল। নিসান মেকি হাসি হেসে বলল, “আমার পাশে বসলে কি আমি তোমায় কামড়ে দিতাম নাকি থুতু ছুঁড়ে মারতাম?”
আঁখি চেহারা কুঁচকে চোখ বন্ধ করে নিল। কোন প্রত্যুত্তর দিল না। এর মধ্যেই চন্দনা চলে এলো দুজনের জন্য দুই প্লেট খাবার নিয়ে। সাথে এসেছে নিসানের বড় মামী। চন্দনা নিজের হাতের খাবার দুজনের সামনে দিয়ে ভাই বউয়ের হাত থেকে নিয়ে বাকি খাবারের বাটিগুলো সাজিয়ে রাখল। তারপর বলল, “দুজনে খেয়ে নাও ঝটপট। রাত হয়েছে অনেক। আর একটু আচারপালন বাকি আছে সেগুলো শেষ করতে হবে।”
নিসান এর মামী পেছন থেকে নিসানকে হাত দিয়ে ইশারা করে কিছু একটা বলতে বলতে চলো গেল বাইরে। হাতের ইশারায় বোঝাল বেস্ট অফ লাক। চন্দনা খাবার বুঝিয়ে দিয়ে চলে যাবে বলে পিছু ফিরতেই নিসান খাবারের থালা সরিয়ে রেখে বলল, “আমার খিদে নেই। থাক, আমি খাব না।”
চন্দনা আবার পিছু ফিরে টেবিল থেকে জলের গ্লাস তুলে নিয়ে হাতটা ধুয়ে নিল। হাত ধুয়ে নিয়ে উচ্চশব্দে রেখে দিল জলের গ্লাসটা। আঁখি খানিক ছিঁটকে উঠল তাতে। নিসান দু-হাত ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে। চন্দনা ভাত মাখিয়ে খাবার তুলে নিল হাতে। নিসান এর মুখে খাবার তুলে দিয়ে আঁখির দিকে চেয়ে বলল, “তুমি অন্যের হাতে মাখা ভাত খাও?”
আঁখি সবে ভাত মাখাবে বলে হাত দিচ্ছিল নিজের প্লেটে। চন্দনার কথায় মাথা তুলে একবার তার দিকে চাইলো আর একবার নিসান এর দিকে চাইলো। ঘার কাত করে সায় জানিয়ে বলল, “হুম”।
চন্দনা সঙ্গে সঙ্গে ভাত মাখিয়ে তুলে দিল আঁখির মুখে। আঁখি ভাত চিবোতে চিবোতে মাথা নিচু করে হেসে দিল। মায়ের মুখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। মনে হল যেন তার মা-ই ভাত তুলে দিয়েছে তার মুখে। যেমন আগে দিত। স্কুলে যাওয়ার আগে তো এভাবেই খাইয়িয়ে দিত। ভাতের থালা হাতে নিয়ে পিছু পিছু দৌড়াতো কেমন।

আবেশ ভঙ্গ হল চন্দনার কথায়।

“কি হলো হা কর। তুমি একবারের ভাত চিবিয়ে খেতে খেতে নিসান চারবার নিয়ে নিয়েছে। ওই দেখ হা করে বসে আছে আরও একবার নেবে বলে।”

নিসান চুপচাপ মুখে কুলুপ এঁটে গিলছে আর ফোন স্ক্রল করছে। হাবভাব এমন যেন খাচ্ছে তাই বেশি, আবার মাথা তুলে চেয়ে দেখবে?

দুজনের খাওয়া শেষ হয়ে গেলে চন্দনা থালাবাটি গোছ করতে লাগল। গোছ হলে হাত ধুয়ে নিল প্লেটে। এদিকে নিসান ফোন থেকে “কাম ইন” লিখে টেক্সট করে দিল অয়ন এর নম্বরে। তৎক্ষনাৎ রুমের দরজা খুলে ভেতরে এলো চন্দনার স্বামী সুমন্ত কুমার। হাতে একটি ছোট আকারের চকোলেট কেক। একটি মোমবাতি জ্বলছে তাতে। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির বাকি সবাই। কারও হাতে আইসক্রিম এর বাটি তো কারও হাতে মিষ্টি পান এর খিলি ভরা থালা। আবার কেউ হাতে নিয়ে আছে বড় একটা থালায় সাজানো লাল পারের সাদা জামদানী শাড়ী। সবটাই নিসান কিনেছে নিজ হাতে। মায়ের পছন্দের জিনিসগুলো মায়ের পছন্দমতো-ই সাজিয়েছে। সবাই উইশ করতে লাগল চন্দনা কে।

চন্দনা নিজের পিছু ফিরে স্বামীকে কেক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠল। তার যে মনে ছিল না নিজের জন্মদিনের কথা তেমনটা নয়। মনে ছিল ঠিক-ই, প্রতিবছরই তো নভেম্বর মাস এলেই নিয়ম করে দিন গুনতো জন্ম তারিখের জন্য। যাতে ছেলে আর ছেলের বাবাকে টেক্কা দিয়ে বলতে পারে আমি কিন্তু মোটেও চমকাইনি। আমার সব মনে ছিল।
কিন্তু প্রতি বছরের মতো এ বছরও যে নিসান ওর বাবাকে দিয়ে কেক হাতে দাঁড় করিয়ে দেবে তার সামনে তা ভাবেনি। ভেবেছিল আজ এমন একটা দিন আর এত্তো এত্তো ব্যস্ততার মাঝে মনেই হয়তো থাকবে না নিসান এর। তার স্বামীর তো কোন বছরেই মনে থাকে না। মনে তো রাখে নিসান। কিন্তু আকস্মিক এমন চমকপ্রদ মুহুর্তের সম্মুখীন হয়ে হৃদয়টা যেন খুশিতে ভরে উঠল। নিসান এর বাবা বলল,

“এবার কিন্তু আমারও মনে ছিল। তোমার ছেলে একাই তার মা কে ভালোবাসে না; আমিও ভালবাসি আমার বউকে। কি বল বৌদিরা?”

নিসান এর মামীরা সবাই অট্টহাসিতে ভেঙে পড়লো নন্দাই এর কথা শুনে।

চন্দনা নিসানের দিকে ফিরল টুপটুপে খুশিভরা মুখ নিয়ে। পিছু ফিরে যেন আরও একটা চমক পেল। নিসান হাঁটু ভেঙে বসে আছে হাতে একটা বিশাল আকারের ননস্টিক কড়াই নিয়ে। চন্দনা হেসে উঠলো নিসান এর কান্ড দেখে। চন্দনার সাথে এক জোটে বাকিরাও হেঁসে উঠল। নিসান ইশারা করল কড়াইটার ঢাকনা খুলতে। চন্দনা ঢাকনা খুলতেই চকচকে সোনার একটা আংটির দেখা মিলল ভেতরে। কড়াইটা পাশে রেখে আংটি টা পরিয়ে দিল মায়ের হাতে। চন্দনা নিসান এর কানে ধরে বলল,

“আঁখির জন্য কিছু এনেছিস?”
কান থেকে মায়ের হাত ছাড়িয়ে পকেট থেকে আরও একটা একই ডিজাইনের আংটি বের করে বলল,
“এনেছি এনেছি। এই হাটবাজারে বসেই বউকে পড়াব? মানে এখন দিলে আবার ঘরে ঢুকে আচার-অনুষ্ঠানে যদি বউ ডিমান্ড করে তার গিফট কই? মানে তাকে দিয়ে যদি ডিমান্ড করানো হয় আরকি, তখন কি করব?”
নিসান কথাটা দোলার দিকে চেয়ে বলল।
পেছন থেকে দোলা এগিয়ে এসে বলল,
“পিঞ্চ মারছিস আমায়? মার, সমস্যা নেই। তবে আমি তোর জিজুর কাছে থেকে বৌভাতের দিন দু’বার ফুলসজ্জার গিফট আদায় করেছি বলে কি তোর বউয়ের সাধ্যি আছে নাকি তোর মাথায় বারি দিয়ে এক চান্সে দুটো গিফট হাসিল করা! পারবে না, নে পরিয়ে দে।”

“আমার বউ তোর মতো ডাকাত নয় রে। আর আমিও তোর বরের মতো বুড়ো গাধা নই। না আমার বউ তোর মতো গলায় ছুড়ি ধরে বলবে গিফট দাও আর না আমি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মানিব্যাগ তুলে দেব হাতে যে তোমার যা লাগে নিয়ে নাও।”

গৌরব মাঝখান থেকে বলল, “আহা শা লা বাবু, এতোদিনে কেউ আমার দুঃখ বুঝল। আর আরেকটা কথা, বিয়ের পর সব পুরুষ না রয়েল বেঙ্গল টাইগার থেকে বিড়াল বা গাধা-ই হয়ে যায়। নয়তো গায়ের লোম বা বা মাথার চুল কোনটাই টেকে না। বউ সব তুলে নেয়।”

দোলা কিছু বলতে চাইলে চন্দনা চোখ রাঙালো। ইশারা করে বলল বেশি কথা না বাড়াতে। নিসানকে বলল আংটি টা আঁখিকে পড়িয়ে দিতে।

আঁখি এতোক্ষণ হা করে সব দেখে যাচ্ছিল। প্রথম দিকে বুঝতেই পারছিল না কি হচ্ছে সব। পরে ধীরে ধীরে বুঝতে পারল সবটা। এমন একটা পরিবারের অংশ হতে পেরে নিজেকে মহা সৌভাগ্যবান মনে করতে লাগল। সবাই একে অপরকে কতোটা ভালোবাসে, কতোটা গুরুত্ব দেয় তা ভাবলেও অবাক লাগে। কোথায় তার পরিবার আর কোথায় এই পরিবার! যেন আকাশ-পাতাল ব্যবধান। এত সুখ কপালে সইবে তো?

আঁখির হাতটা টেনে নিজের হাতের তুলে নিল নিসান। পরিয়ে দিল আংটিটা।

চন্দনা কেক কাটল। সবার আগে খাইয়িয়ে দিল নিজের স্বামীকে। তারপর খাওয়ালো আঁখিকে আর তারপর খাওয়ালো নিসানকে। কেক কাটার পর্ব শেষ হলে মেয়েরা আঁখিকে টেনে নিয়ে গেল আলাদা কক্ষে। উদ্দেশ্য ওকে সাজানো। নিসান পিছন থেকে কান্তার চুল টেনে ধরে কানের কাছে গিয়ে বলল,

“যদি আমার বউটাকে তোরা সবাই মিলে ভুতনী সাজিয়েছিস না তাহলে তোদের আটা-ময়দার গাট্টি-বস্তা সব আমি গরীবদের দান করে দেব; সাথে তোদেরকেও। এক চিলতে মেক-আপ এর কণা-ও যেনো ওর মুখে না লাগে। শাড়ী তো পড়ানোই আছে। মায়ের দেওয়া সোনার গা ভর্তি গয়না গুলো-ও পড়ানো আছে। আর কি সাজাবি তোরা?”

কান্তা কোনমতে চুল ছাড়িয়ে দিল দৌড়। দৌড়ে আঁখি যে রুমে রয়েছে সেখানে গিয়ে বাকি বোনদের উদ্দেশ্য করে বলল,

“নিসান দা বলেছে বৌমনিকে মেকআপ দিয়ে সাজালে আমাদের সহ আমাদের মেকআপ গুলো গরীবদের দান করে দেবে।”

বোনেরা আশ্চর্য চেহারায় জিজ্ঞেস করলে সবটা খুলে বলল কান্তা। মিতু বলল,
“ঠিক আছে, শাড়ী থাক। মেক-আপ ও থাক। শুধু সোনার গয়নাগুলো চেঞ্জ করে ফুলের গয়নাগুলো পড়িয়ে দিই।”

আঁখিকে সাজানো হলে ওকে নিয়ে যাওয়া হলো ওর নিজের রুমে। আঁখি ফুলে সাজানো রুমটা দেখে আশ্চর্য হলো। গুনে গুনে তিনদিন ফুলে সাজানো রুমে ঘুমানোর সুযোগ। যেন লটারি জিতেছে ফুলভর্তি রুমে ঘুমানোর সুযোগটা।

আঁখিকে বিছানার মাঝে সুন্দর করে বসিয়ে দিয়ে ডাক দিল ভাইয়েদের। ভাই-বোনেরা মিলে দরজা আঁটকে দিল বাইরে থেকে। তারপর পাহারায় দাঁড়িয়ে রইলো সবাই। একজন গিয়ে খবর দিল এদিকে সব রেডি, নিসানকে এখন নিয়ে আসতে পারে রুমে। সবাই একে অপরকে বোঝাতে লাগল আজ মোটা অঙ্কের টাকা না পেলে দরজা খোলা যাবে না। কোনমতেই না।

_______________

“ভেজা কাপড়গুলো জড় করে ওয়াশরুমে রেখে দাও; আর ঝটপট তৈরী হয়ে নাও।”
“কেন?”
“আমরা বাইরে যাব তাই?”
“বাইরে যাব কেন?”
“আজ বাইরে ডিনার করবো। রাতে আর রান্না করতে হবে না আজ।”
“রান্না করাই আছে সাহেব, শুধু গরম করে নেব। বাইরে আজ যেতে হবে না। কাল নাহয় যাব।”
“তাহলে ওগুলো ফ্রিজে রেখে দাও। কাল সকালে গরম করে দিও খেয়ে নেব।”
ফাল্গুনী কিছু বলতে চাইলে জাগ্রত ধাক্কিয়ে উঠিয়ে দিয়ে বলে,
“বরের বুকে শুয়ে থাকতে আরাম লাগছে; উঠতে ইচ্ছে করছে না বুঝতে পারছি তো। সারারাত পরে আছে, সারাজীবন পরে আছে; এ বুকের মালিকানা নিয়ে দখলদারি করার জন্য। যাও ঝটপট তৈরী হয়ে নাও। নয়তো আমাকেই আসতে হবে তোমায় শাড়ী পরিয়ে দিতে। যদিও পারি না বাট ট্রাই তো করতেই পারি। আখেরে আমার-ই লাভ।”

জাগ্রতর গায়ে বালিশ ছুড়ে মেরে ফাল্গুনী আলমারির কাছে গেল শাড়ী বের করতে। শাড়ী আর বাকি প্রয়োজনীয় সব বের করে নিয়ে বিছানায় রেখে চোখ পাকিয়ে চাইল জাগ্রতর দিকে। জাগ্রত সুরসুর করে বেরিয়ে গেল রুমের বাইরে।

জাগ্রত আর ফাল্গুনী দাঁড়িয়ে আছে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে। দুজনের-ই মুখ লটকানো। যেন মহাবিশ্ব মন খারাপ দিবসটি আজ দুজনে দায়িত্ব নিয়ে পালন করছে। কেউ কার-ও থেকে কম নয়। দুজনেই মহা দায়িত্ববান।

“তুমি একটু আগে বললে এই রেস্টুরেন্টে-ই বসবে। এখন আবার বলছো এটাতে বসবে না। আবার কারণটাও বলছ না। এ রাস্তায় আশেপাশে ভাল আর কোন রেস্টুরেন্ট-ও নেই। কি হয়েছে বলবে তো নাকি?”
“ওইযে একটা বিরিয়ানি হাউজ দেখা যাচ্ছে। ওখানে চলুন।”
“ওখানে আমি কখনো খাইনি। কেমন খাবার দেবে তার ঠিক নেই। আর দোকানটা তোমাকে নিয়ে বসার মতো নয়। পরিবেশ ঠিক নেই। হয় সমস্যাটা বল নয় চুপচাপ ভেতরে চল।”
“ভেতরে প্রিয় কার-ও মুখ দেখেছেন নাকি? এত উতলা হচ্ছেন কেন ভেতরে যাওয়ার জন্য?”
“প্রিয় মুখটা তো আমার বুকের ভেতর সংরক্ষিত আছে; আছে সামনে-ও। তাই ভেতরে-বাইরে, উপরে বা নিচে কোথাও তাকে খোঁজার প্রয়োজন নেই। চল না প্লিজ।”

ফাল্গুনী ভেতরে ঢুকে গেল। পিছু পিছু জাগ্রত-ও ঢুকে গেল একটা বড় করে শ্বাস টেনে।

দুজনে খালি টেবিল দেখে বসে পড়লো এক কোনায়। ফাল্গুনীকে খাবার অর্ডার দিতে বলল জাগ্রত। ফাল্গুনীর দৃষ্টি দেখে বুঝে গেল অর্ডারটা তাকেই করতে হবে।

খাবার চলে এসেছে বেশ কিছু সময় হল। কিন্তু ফাল্গুনী হাত লাগাচ্ছে না। জাগ্রত খেয়াল করল ফাল্গুনীর দৃষ্টি তার পেছন বরাবর অনেকসময় ধরে আঁটকে আছে। ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকটায় চেয়ে দেখে তার পেছনের টেবিলটায় বসে আছে ড. আশিকুর রহমান। জাগ্রতর মায়ের চিকিৎসা তিনিই করেছিলেন। জাগ্রত ফাল্গুনীকে বলল তার কথা। তারপর পিছন ফিরে ডাক দিল আশিকুর রহমানকে। তিনি জাগ্রতকে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন বলে মনে হল ফাল্গুনীর কাছে। তবে ফাল্গুনী মোটেও ওনার দিকে চেয়ে ছিল না। ওদের থেকেও চারটে টেবিল পর একদম শেষ প্রান্তের টেবিলটায় বসে আছে ঝিমলি। একদম নিরব হয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে। এদিক ওদিক কোথাও খেয়াল নেই ঝিমলির। ওকে দেখেই প্রথমে রেস্টুরেন্টে ঢুকতে চায়নি ফাল্গুনী। অস্বস্তি নাকি অন্য কিছু জানা নেই। তবে ইচ্ছে হচ্ছিল না মুখোমুখি হতে।

জাগ্রত পরিচয় করিয়ে দিল ফাল্গুনীকে। আশিকুর রহমান খুব বেশি কথা এগোতে চাইলেন না। জাগ্রত নিজে থেকেই টুকটাক কথা বলল। ফাল্গুনী ঝিমলির থেকে মন সরিয়ে আশিকুর রহমান এর দিকে মনোনিবেশ করল। জিনিয়ার থেকে খুঁটিনাটি খুব বেশি জানতে পারে নি শ্বাশুড়ী মায়ের মৃত্যু সম্পর্কে। আজ সরাসরি শ্বাশুড়ী মায়ের ডাক্তারকে সামনে পেয়ে গেছে, আর কি চাই? মেঘ না চাইতেই জল হাজির।

আশিক সাহেব ওয়াশরুমের কথা বলে উঠে গেলেন। তার স্ত্রী আর ছোট মেয়েটার সাথে কথা বলতে লাগল জাগ্রত। মেয়েটার সাথে হসপিটালে কয়েকবার কথা হয়েছিল। তাই কথা বলতে সমস্যা হল না। এদিকে ফাল্গুনী-ও উঠে গেল ওয়াশরুমের কথা বলে। জাগ্রত সাথে আসতে চাইলো ফাল্গুনী মেকি হাসি দিয়ে বলল, “ভেতরে-ও যাবেন না-হয়। চলুন।”

জাগ্রতকে ঠিকঠাক জবাব-ও দিতে দিল না। ঝটপট পা চালিয়ে চলে গেল আশিক সাহেব যেদিকে গেছেন।

ফাল্গুনী খানিক এগিয়ে আসতেই দেখতে পেল আশিক সাহেব খানিক আড়ালে দাঁড়িয়ে স্মোকিং করছেন। ফাল্গুনী কেশে উঠে নিজের উপস্থিতির জানান দিল। সাথে সাথেই সিগারেট ফেলে দিলেন তিনি। ভদ্রতার সহিত বলে উঠলেন,
“কিছু বলবে মামনি?”
ফাল্গুনী দু সেকেন্ড সময় নিয়ে স্থির করল নিজেকে। তারপর দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“আঙ্কেল আপনাকে ঘুরিয়ে পেচিয়ে বা বাজিয়ে কথা বলার সময় আমার নেই। তাই ভীষণ রুডলি এবং স্ট্রেইটলি বলছি কিছু মনে করবেন না। আমার শ্বাশুড়ী মা অসুস্থ ছিলেন না। তিনি নিজ মুখে আমাকে হাজার বার বলতেন তিনি জাগ্রত আর আমার শ্বশুর এর সামনে সবসময় নাটক করে চলতেন সংসার আর তাদের দুজনকে হাতের মুঠোয় রাখতে। শুধু বলতেন না, করে দেখিয়েছেন-ও আমাকে। নাটক। তাহলে যে মানুষটা কখনো অসুস্থই ছিলেন না সে মানসিক অসুস্থতা থেকে মারা কিভাবে গেলেন? চিকিৎসা শুনেছি আপনিই করেছেন। জবাব টা তবে আপনিই দিন।”

আশিকুর রহমান এর চেহারায় খানিক অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে। হাবভাবে মনে হচ্ছে তার কষ্ট হচ্ছে ভীষন। ফাল্গুনী এবার কোমল কন্ঠে বলল,

“দেখুন আঙ্কেল, আপনি ভয় পাবেন না। আমি আপনাকে বিপদে ফেলব বলে এসব বলছি না। আমি শুধু সত্যিটা জানতে চাই। আংশিক আমি জানি, বাকিটা আপনি বলুন। যে অসুস্থতা ছিল নাটক তা থেকে মৃত্যু কি করে হলো? তা-ও আবার ব্রেইন স্ট্রোক।”

আশিকুর রহমান কোন জবাব না দিয়ে হুরমুরিয়ে জায়গা ত্যাগ করলেন। ফাল্গুনী পিছু গিয়েও ধরতে পারল না। হতাশ হল। সাথে নিশ্চিত হল কোন একটা ঘোটালা অবশ্যই আছে। মনস্থির করল, আর থামবে না। যেভাবেই হোক সবটা জানতেই হবে। আদোও মারা গেছেন তো তিনি? নাকি মৃত্যুটা-ও নাটক?

আশিকুর রহমান স্ত্রী আর কন্যা নিয়ে তৎক্ষনাৎ চলে গেছেন বের হয়ে। যাওয়ার আগে জাগ্রতর দিকে ফিরেও তাকাননি।

ফাল্গুনী এসে বসল জাগ্রত সাথে। খাওয়া শুরু করল দুজনে। ফাল্গুনী চুপচাপ খাচ্ছে। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে হাজারও ভাবনা। কিন্তু জাগ্রতকে চুপচাপ দেখে খানিক অবাক হল। ভাবল, সে নিজে নাহয় চুপচাপ আর চিন্তিত রয়েছে কারন বশত। কিন্তু জাগ্রত কেন এত চুপচাপ! এমনকি তাকেও কোন প্রশ্ন করছে না। আবার মনে হল মানুষটা রাগ হল নাতো? কিংবা মন খারাপ! জাগ্রতকে জিজ্ঞেস করল,
“আপনার কিছু হয়েছে? চুপচাপ আছেন যে?”
জাগ্রত সরাসরি বলল,
“তুমি এই রেস্টুরেন্টে তখন ঢুকতে চাইছিলে না কেন?”
ফাল্গুনী কি উত্তর দেবে তা ভাবতে ভাবতে জাগ্রত নিজেই বলে উঠলো, “ঝিমলি কে দেখে তো?”
ফাল্গুনী একবার শেষপ্রান্তের টেবিলটায় চোখ বুলালো। ঝিমলি এখন-ও একাই বসে আছে। এখন-ও মাথা চেপে বসে আছে দু’হাতে। ফাল্গুনী খেতে খেতে জবাব দিল, “মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছে নেই।”
“তাই নাকি অন্যকিছু?”
“অন্য কি?”
“অতীত!”
“বর্তমানে বসে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা যায়। অতীত নিয়ে ভেবে ভেবে কেন বর্তমান আর ভবিষ্যৎ দুটোই নষ্ট করবো? কেন যেন মুখোমুখি হওয়াটা মানতে পারছিলাম না। যাইহোক, ও ওর মতো আছে আমরা….

হটাৎ ফাল্গুনীর নজর কাড়লো এক দৃশ্য। কথা বন্ধ হয়ে গেল এক মুহুর্তে। স্তম্ভিত নয়ন যেন অবিশ্বাস্য কিছু দেখছে। দুজন দুই প্রান্তের মানুষ এখানে এক টেবিলে কি করছে? তা-ও আবার এতোটা ঘনিষ্ঠভাবে! ঝিমলি তবে এতোক্ষণ ধরে এই মানুষটার জন্যই অপেক্ষা করে বসেছিল!
#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৩৬

নিসান নিজের রুমের সামনে এসে দেখল সব ভাইবোনেরা মিলে ইন্ডিয়া পাকিস্তানের বর্ডার পাহারা দেওয়ার অঙ্গভঙ্গি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। বুঝল পকেট হাতানোর ধান্দায় আছে সবগুলো। সব বুঝেও না বোঝার ভান ধরে বলল,
“আমার রুমের সামনে সবাই মিলে এভাবে গরুর হাট বসিয়েছিস কেন? সর সামনে থেকে।”
সবার মাঝখান থেকে কান্তা বলল,
“ইস! কিছুই বোঝনা না? ঝটপট টাকা দাও তারপর রুমে ঢুকতে পারবে। গুণে গুণে দশ হাজার টাকা।”
নিসান ভেঙচি কেটে বলল,
“তোদের কাছ থেকে ধার নিয়েছিলাম?”
এবার মিতু বলল,
“নিসান দা একদম চালাকি করবে না বলে দিচ্ছি। অনেক কষ্ট করে আমরা সব ভাইবোনেরা মিলে ঘর সাজিয়েছি।”

মিতু এটুকু বলতেই সব ভাইয়েরা চোখ পাকিয়ে চাইলো ওর দিকে। মিতু আমতা আমতা করে বলল,

“মানে ঘর ওরা সাজিয়েছে মানে ভাইয়েরা। কিন্তু আমরাও হেল্প করেছি। আর বৌমনিকে তো আমরা-ই সাজিয়েছি। তাই মিলঝিল করে আমাদের সবার জন্য দশ হাজার টাকা দিতে হবে।”

নিসান এবার মুচকি হেসে বলল,
“যা যা দিয়ে ঘর সাজিয়েছিস তা সব খুলে নিয়ে যা। আর আঁখিকে গিয়ে স্নান করতে বল। তাহলে সাজগুলো সব ধুয়ে যাবে। তবুও টাকা পাবি না।”

সব ভাইবোনেরা হৈ-হুল্লোড় করতে লাগল টাকার জন্য। নিসানের দুঃসম্পর্কের তিনজন দিদা আর ঠাকুমা ছিল পাশে; একজন বলল,
“কিছু টেকা দিয়া দাও ভাই। ভিতরে যাইয়া কিছু নিয়ম কাম করন লাগব। রাইত মেলা হইয়া যাইতাছে।”

নিসান সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আচ্ছা যে কাজের জন্য দশ হাজার ডিমান্ড করছিস সে কাজ টা আদোও দশ টাকা পাওয়ার যোগ্য কিনা তা তো আগে দেখি নিই। যা সর ভেতরে ঢুকতে দে।”

“পরে যদি পাল্টি মারো তখন কি করব?”

“আমি তোদের মতো ঢপবাজ নই। সরবি দরজার সামনে থেকে? নাকি বারান্দার দরজা দিয়ে ঢুকবো? চাবি আমরা সাথেই আছে।”

সবাই সরে গেল সামনে থেকে। নিসান ঢুকে গেল রুমের ভেতরে। সাথে ঢুকে গেল নিয়ম কাজের উদ্দেশ্যে আসা দিদা আর ঠাকুমারা-ও। পিছু পিছু দুঃসম্পর্কের এক বৌদি-ও এলো।

নিসান আঁখিকে দেখতে পেল বিছানার মাঝখানে সুন্দর করে বসে থাকতে। মাথায় আবার বড়সড় একটা ঘোমটা টানা। রুমটাতে ফুলের অভাব নেই আর না আছে সুগন্ধের অভাব। রজনীগন্ধার সুবাসে রুমটা ছেয়ে আছে। সাজিয়েছে-ও বেশ ভাল-ই।

নিসানকে বিছানায় বসতে বলল একজন দিদা। নিসান বসতেই সেই বৌদি গিয়ে আঁখিকে উঠিয়ে দাঁড় করালো বিছানা থেকে নামিয়ে। একজন দিদা নিসানকে দেখিয়ে বলল, “স্বামীর পাউ ছুঁইয়া পরনাম কর বউ।”

আঁখি প্রণাম করার জন্য ঝুঁকতেই নিসান পা উঠিয়ে নিল। অতঃপর বলল, “প্রণাম করার দরকার নেই। অন্যান্য কি নিয়ম কাজ আছে সেগুলো শেষ করো তো দিদা।”

নিসানের কথা শুনে একজন একজন বলল, ভাই তুমি অইলা বেডা মানুষ। তুমি কি আর ইস্তিরি(স্ত্রী) আচার বুঝ? এহনো মেলা আচার রইছে। খালি পরনাম না।”

“আচ্ছা আগে শুনি, কি কি আচার অনুষ্ঠান আছে তোমাদের। বল এক এক করে। তারপর ডিসাইড করছি কোনটা করব আর কোনটা করবো না।”

নিসান এর সেই বৌদিটা ফট করে বলে উঠলো, “নিয়মগুলো একেবারে ঝাক্কাস ঠাকুরপো। আমার বেলায় তো একেবারে সব আচার অনুষ্ঠান পাই পাই করে পালন করেছিলাম। এই যেমন ধরো স্বামীর পা ধুইয়িয়ে দিয়ে তারপর বউকে নিজের চুল দিয়ে মুছিয়ে দিতে হয়। তারপর….”

“ব্যাস! বুঝেছি। ভাত-কাপড় অনুষ্ঠানের সময় যেমন বললে বউকে বেত দিয়ে পেটাতে হবে। তাও আবার কাঁচা কঞ্চি দিয়ে। এখনও ওইরকম উদ্ভট সব নিয়মগুলোই বলবে তো? তখনও করিনি, এখনও করব না। আমার এগুলো পোষায় না। স্বাভাবিক কি কি নিয়ম আছে ঝটপট সেগুলো সার। নয়তো একটাও দরকার নেই।”

চন্দনা সবাইকে আগেই বলে দিয়েছে নিসান যা করতে না করবে তা নিয়ে যেন ওকে জোর না করা হয় তাই কেউ আর দ্বিতীয় কোন কথা বলল না। একজন থালাভর্তি ক্ষীরের লাড়ু এগিয়ে নিয়ে এসে বলল, “এই সুখ লাড়ু একজন আরেকজনরে খাইয়িয়া দাও।”
নিসান হেঁসে উঠলো লাড়ুর নামকরণ শুনে। নিসান আঁখির ঘোমটা তুলে তারপর হাসতে হাসতেই খাইয়িয়ে দিল একটার অর্ধেক। আঁখিও খাইয়িয়ে দিল নিসানকে বাকি অর্ধেকটা। তারপর একে একে রুমের সবাই লাড়ুগুলো খেয়ে লাড়ুর থালা মিতুর হাত দিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দিল বাকিদের জন্য। আরও ছুটখাট কিছু নিয়ম হয়ে গেলে একে একে চলে গেল সবাই। যাওয়ার আগে বৌদিটা আঁখির কানে কানে বলে গেল কিছু একটা। নিসান দেখেও না দেখার ভান ধরে ভাই-বোনদের কাছে ডাকলো। বলল,
“গৌরব দা, দিদি ওরা কোথায়?”
“সবাই মিলে ছাঁদে আসর জমিয়েছে। গৌরব জিজু আসতে চেয়েছিল দোলা দি আসতে দেয়নি।”
“আচ্ছা বুঝলাম। এখন আমার কথা শোন। রুমের কথা বাদ দিলাম, আঁখিকে ভাল সাজিয়েছিস। তাই খুশি হয়ে কিছু দেওয়া যায় তোদের। কিন্তু আমার কাছে এখন দু হাজারের বেশি নেই। তাই গৌরব দা কে গিয়ে ধর। বলবি আমি দিতে বলেছি। যত পারিস নিয়ে নিস। ওকে? আর এই দুই হাজার রাখ।”

সবাই খুশি হয়েই বেরিয়ে গেল। কেননা গৌরবের থেকে টাকা আদায় করা কোন বেপার-ই না। দোলা একটু চিটচিট করে কিন্তু নিসান এর নাম শুনলে আর কিছু বলবে না।

সবাই চলে গেলে নিসান দরজা আঁটকে দিয়ে আঁখির সামনে এসে দাঁড়ালো। আঁখি কাচুমাচু হয়ে বিছানার এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। নিসান দু-চোখ ভরে আগে দেখে নিল আঁখিকে। কি সুন্দর লাগছে! যেন ফুলের সাজে কোন মানবি নয় আস্তো এক ফুল দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। আঁখি নতজানু হয়ে একইভাবে মুর্তিমান হয়ে রইলো। কোন নড়চড় নেই। নিসান কেশে উঠে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। আঁখি চাইলো নিসান এর দিকে। চাইতে না চাইতেই আঁখিকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিল। আঁখিকে বিছানায় বসিয়ে তারপর দিল আলো নিভিয়ে। অন্ধকার হাতড়ে আঁখির কোল চিনে নিতে একটুও অসুবিধা হলো না নিসান এর। আঁখির কোলে মুখ গুঁজে শুয়ে রইলো কিছুক্ষণ নিরবে। কিছুসময় পর আঁখিকে বলল,
“একটু ঝুঁকে আসতো বউ।”
আঁখি ভ্রূদ্বয় খানিক বাঁকা করে জিজ্ঞেস করলো, “কেন?”
নিসান চোখ পাকিয়ে বলল, “বিয়ের দু’দিন পার হতে না হতেই বরের উপর কথা বলা শিখে গেছ দেখছি। তা এইসবই কি শিখিয়ে দিয়ে গেছিল বৌদি?”
আঁখি লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে ঝুঁকে গেল। লোকটার সাথে কথা বাড়ানো মানে নিজের পায়েই কু/ড়া/ল মা/রা। এখন যদি আবার জিজ্ঞেস করে যাওয়ার আগে বৌদিটা কানে কানে কি বলে গেল তাহলে তো আরেক মুশকিল। ওসব তো সে মুখেও আনতে পারবে না। তাই যা বলে মেনে নেওয়াই ভাল।

আঁখি ঝুঁকতেই নিসান বলল, “এবার আমার পুরো মুখ জুড়ে গুণে গুণে চব্বিশটা চুমু খাবে। একই জায়গায় যেন চুমু রিপিট না হয়। মুখের আলাদা আলাদা জায়গায় চব্বিশটা চুমু খাবে। এক জায়গায় দুবার রিপিট হলে একটা করে চুমু বেড়ে যাবে।”
আঁখি চোখ দুটো বড়বড় করে এক ঝটকায় মাথা উঠিয়ে নিল। নিসান ভ্রু নাচিয়ে মেকি হাসিতে ঠোঁট এলিয়ে বলল,
“যতই কাপাকাপি আর নাচানাচি করো আজকে তোমার ছাড় নেই বউ আমার। তোমার জন্য চব্বিশ ঘন্টা টেনশনে আমার মাথা ঘেঁটে গেছে শেষ কিছুদিন। তাই চব্বিশ ঘন্টার শোধটা আমি এভাবেই তুলবো। নাও স্টার্ট কর। স্টার্টিং টা তুমি কর কন্টিনিউ আমি করবো আর ইন্ডিংটা দুজনে মিলে। চলবে?”

আঁখি দু’হাতে মুখ লুকিয়ে নিল লজ্জায়। এবার কি হবে? আজ বোধহয় প্রাণটা আর বাঁচবে না।

_______________________

“বেশিরভাগ তো ঢাকায় ডেকে নিতে। আজ গাজীপুরে কেন?”

মৃত এক প্রাণহীন শরীর থেকে যেন কেউ জোর করে কথা বের করলো। গলা দিয়ে যেন শব্দেরা দলা পাকিয়ে আন্দোলনে নেমেছে। না শরীর টানছে না মন।

ঝিমলির শুষ্ক গলায় করা প্রশ্নের জবাবে সোহাগ প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বলল,

“আজ ওসবের জন্য ডাকিনি তোমাকে। ডেকেছি অন্য কারণে। গাজীপুরে অতিব গুরুত্বপূর্ন একটা কাজ সারতে এসেছি। তাই ভাবলাম অন্যকোথাও আর কেন ডাকবো এখানেই ডেকে নেই তোমায়। আর আমি যে যাব তোমার কাছে তুমি তো তোমার ঠিকানা-ই দাও না। প্রতিবার পালিয়ে চলে যাও। শুধু ভিডিও গুলোর জন্য এখনও হাতে আছো। আচ্ছা এসব পরে বলি, তুমি আগে কি খাবে বল। অর্ডার কর, খাবার আসুক, তারপর না-হয় খেতে খেতে কথা বলা যাবে।”

“আমি এখানে এক ঘন্টা যাবত বসে আছি। এমনি এমনি তো আর বসে থাকা যায় না। যা খাওয়ার খেয়েছি, আর কিছু খাব না। তুমি বল কি বলবে?”

সোহাগ হাত কচলাতে কচলাতে বলল,
“অনেক কিছু বলার আছে। আমি সরাসরি বলছি শোন, আমরা তো এখনও স্বামী স্ত্রী। তাই না ঝিমলি? অতীতে হয়তো কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল তাই তুমি চলে গিয়েছিলে আমায় ছেড়ে। তোমার পরিবার আমি চিনতাম না তাই একবছর নাগাদ কোন খোঁজ আর পাইনি তোমার। তারপর হুট করে একদিন দেখা পেয়ে গেলাম তোমার। সেই পুরোনো জায়গাটায়। যোখানে আমরা প্রায় দেখা করতাম। তারপর তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলাম কিন্তু তুমি আর ফিরলে না। আমি যে একটু জেদি তুমি তো জানোই বল? তাই জেদ করে তোমার আমার কিছু পারসোনাল ভিডিও দেখিয়ে তোমায় মান ভাঙানোর চেষ্টা করেছি। তাতেও যখন কাজ হয়নি তখন ভেবেছিলাম তোমায় আবার কাছে টেনে নিলে হয়তো আমাদের সেই আগের সুন্দর স্মৃতিগুলো মনে পড়বে তোমার। ভালোবাসাটা জেগে উঠবে। তাই ভিডিও গুলোর সাহায্যে তোমাকে মাঝে মাঝে কাছে ডেকে নিতাম ঢাকায় অথবা অন্য কোথাও। আর ভাড়া বাবদ আরও কিছু এক্সট্রা টাকা-ও কিন্তু দিয়ে দিতাম তোমায়। বল দিতাম না? কিন্তু তুমি আমায় আর আগের মতো ভসলোবাসলে-ই না। কোনভাবেই আর পেলাম না সেই আগের ঝিমলি কে। যাইহোক, অনেক চিন্তা ভাবনার পর মনে হলো তোমার কাছে তো কখনো ক্ষমা চাওয়া হয়নি। তাই আজ তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ। ফিরে চল আমার সাথে। আমরা নতুন করে আবার সংসার শুরু করব। তুমি যেমন বলবে আমি তেমন…”

“আপনি চুপ করবেন?”

ঝিমলির চিৎকারে পাশের টেবিলের সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাল ওদের দিকে। সোহাগ চোখ বুলিয়ে দেখল সবাইকে। সোহাগকে চাইতে দেখে আলাদা কেবিনের মতো জায়গাটায় দাঁড়িয়ে থাকা জাগ্রত আর ফাল্গুনী সাবধানে আরও একটু পিছন চেপে দাঁড়াল। যাতে ওদের চোখে না পরে যায়। হাতে রাখা মোবাইটাতে ভিডিও অপশন টা চালুই আছে। ধরে রাখলো ফোনটা সাবধানে শক্ত হাতে।

সোহাগের মাথায় রাগ চেপে বসলেও নিজেকে যথাসম্ভব ঠান্ডা রেখে বলল,

“ইউ স্টিল লাভ মি ঝিমলি। ট্রাস্ট মি। এন্ড আই অলসো লাভ ইউ।”

ঝিমলি বুকে যেন বারুদ বিস্ফোরণ ঘটলো। হৃদয়ের সমস্ত কষ্ট নিগড়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,

“হাসালে সোহাগ। কতবছর পর তোমার জন্য আমার চেহারায় অশ্রুর পরিবর্তে হাসির জায়গা হলো বলতে পারো? একটু আগে যে গল্পটা শোনালে তা তো সম্পূর্ণ ভুল বললে। সঠিক টা আমি বলছি। তোমার ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে আর তোমার দেখানো স্বপ্নে মোহিত হয়ে আস্তো একটা হিরে ছেড়ে দিয়েছিলাম। অনলাইনের এক বছরের পরিচয়কে আর ভালোবাসাকে সঞ্চয় করে পারি জমিয়েছিলাম তোমার আঙিনায়। তারপর ধীরে ধীরে যখন বুঝলাম তোমার মন আর শরীর দুইয়েতে-ই বহু নারীর আঁচড় খেলে রোজ, সেদিন আমার মন ভাঙলো। হেরে গেল ভালোবাসা। তারপর কয়েকদিনের মধ্যে তোমার পুরো রুপটা-ই বেরিয়ে এলো। কথায় কথায় গায়ে হাত তুলতে লাগলে। যখন তখন যার তার সামনে অপমান করতে লাগলে, সবচেয়ে বেশি যেটা করতে লাগলে সেটা হলো সন্দেহ। আমার রূপটাকে আমার শত্রু করে ছেড়েছিলে। বাইরে যাওয়া বন্ধ, কারও সাথো মেশা বা কথা বলা বন্ধ এমনকি প্রয়োজনের বাইরে বেডরুম ছেড়ে বের হওয়াও বন্ধ।
তারপর একদিন পালিয়ে গেলাম তোমার চোখ ফাঁকি দিয়ে। দুঃস্বপ্নের মতো স্মৃতি গুলো ভুলে নতুন জীবন শুরু করতে চাইলাম তাকে নিয়ে, যাকে ফেলে রেখে গেছিলাম বিয়ের আসরে। তার মায়ের মন জয় করেও পারলাম না তার মন জয় করতে। সে এসে তো ছিল। কিন্তু আমার জন্য নয়। নিজের ভালোবাসা জাহির করতে এসেছিল সে। আমার বোনটাকে কতোটা ভালোবাসে তার হিসেব দিতে এসেছিল। তারপর আবার দেখা হলো তোমার সাথে। সেদিন তোমার মুখে সর্বপ্রথম কথা কি ছিল মনে আছে? আমি নাকি আগের থেকে আরও বেশি সুন্দর হয়েছি। তারপর মানানোর চেষ্টা করলে দুই এক কথায়। যখন দেখলে কাজ হলো না কোন, তখন চালালে মোক্ষম হাতিয়ার। তোমার আর আমার অ/ন্ত/র/ঙ্গ মুহুর্তের ভিডিও। ব্যাস! আমি নেতিয়ে পড়লাম তোমার কাছে। যেই দেখলে আমি দুর্বল হয়ে পেরেছি ওমনি বললে আমাকে বউ হয়ে যেতে হবে না। সিঙ্গেল লাইফে নাকি এক্সট্রা বেনিফিট আছে। তাই মাঝে মাঝে ডাকলে যেন খুশি করে দিয়ে যাই। সপ্তাহ পনেরো দিন পর পর ডাকতে লাগলে যেখানে সেখানে। নতুন আরও কিছু ভিডিও বানিয়ে ফেললে। তোমাকে আর পায় কে? আমিও তোমার হাতের পুতুল হয়ে নাচতে লাগলাম নিজের মুখ পোড়ানোর ভয়ে। মাঝে মাঝে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম এই বলে যে পশুটা তো আমার স্বামী-ই। শরীরটাকে নিগড়ে খাচ্ছে খাক না। সেই তুমি আজ পর্যন্ত নিংড়ে চলেছো আমার শরীর, আমার হৃদয়, আমার সত্তাটাকে! কিন্তু আর না। আজ আমি প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি। তোমাকে ধ্বংস করার প্রস্তুতি!”

এটুকু বলে মুচকি হেসে ব্যাগ থেকে একটা ছু/রি বের করে বসিয়ে দিল হাতে। পর পর তিনবার বসিয়ে দিল হাতের মাঝখানটায়। ছুড়িটাতে যেন কেউ খুব যত্নে ধার লাগিয়েছিল র/ক্ত মাখাবে বলে। বামহাতে ছুরিকাঘাতের পরপরই আঘাত করে বসল কন্ঠ নালী বরাবর। এক লহমায় সব উলটপালট। সোহাগ হতবাক। মাথা যেন পুরো খালি হয়ে গেল। ওদিকে জাগ্রত আর ফাল্গুনী-ও দৌড়ে এসেছে। কিন্তু ধরতে পারে নি ঝিমলি কে। সোহাগ ফাল্গুনী আর জাগ্রতকে দেখে যেন আরও আকুল পাথারে পরে গেল। চারিদিকে লোকসমাগম বেরেই চলতে লাগল, সাথে বাড়লো হুল্লোড়। ফাল্গুনীর চিৎকার করে কান্নায় গা ভাসালো আশেপাশের মানুষগুলোও। জাগ্রত কয়েকজনের হাতে সোহাগ কে ছেড়ে দিয়ে ঝিমলিকে কোলে তুলে নিয়ে ছুটলো রাস্তার দিকে। গলায় ছু/রি টা এখনও ঝুলে আছে। জাগ্রতর যেন মাথা ঘুরে উঠল এমন দৃশ্য দেখে। নিজেকে শক্ত করে ফাল্গুনী আর জাগ্রত দুজন ঝিমলি কে নিয়ে পৌছালো কাছাকাছি এক হসপিটালে। হসপিটালে চিকিৎসা শুরু হওয়ার দশমিনিট পর খবর এলো অতিরিক্ত র/ক্ত/ক্ষ/র/ণ হয়ে প্রা/ণ হারিয়েছে ঝিমলি। ছেড়ে গেছে নিজের সুন্দর শরীর টাকে। আচ্ছা, এ শরীর টা কি আর কাজে লাগবে না ওই ন/র/খা/দ/ক হা/য়/না/টা/র? নাকি এখন আর পুষবে না?

~চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here