#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৩০
“ছাঁদে যাবে?”
জাগ্রতর কথায় মাথা নেড়ে সায় জানালো ফাল্গুনী। জাগ্রত ফাল্গুনীর হাত পুরে নিল নিজের ডান হাতের মুঠোয়। দরজায় তালা বসিয়ে ছুট লাগালো ছাঁদে।
জাগ্রত ছাঁদে উঠেই এক লাফে রেলিং এর উপর উঠে বসলো। ফাল্গুনীকে-ও বসতে বলল তার পাশে। ফাল্গুনী বসল না। উচ্চতা আর অন্ধকারে তার বড্ড ভয়। কিন্তু তা মনেই মনেই। মুখে কখনো নিজের দুর্বলতার চিত্র তুলে ধরতে পছন্দ নয় ফাল্গুনীর। জাগ্রতও জানে না ফাল্গুনীর দুর্বলতা কি আর মনোবল কি। তবে জানতে চায়, বুঝতে চায় সে ফাল্গুনীকে।
জাগ্রত আকস্মিক বসা থেকে ধপ করে নেমে দাঁড়াল রেলিং থেকে। কয়েক পা এগিয়ে এসে দাঁড়ালো ফাল্গুনীর সামনে। ফাল্গুনী ঘাড় ফিরিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে চাইতে না চাইতেই জাগ্রত আচমকা আক্রমণ করে বসল। দু-হাতে ফাল্গুনীর কোমড় জরিয়ে উঁচু করে নিল দেড় হাত সমান উচ্চতায়। ফাল্গুনীর যেন শ্বাস টেনে তুলতেও কষ্ট হলো এক মুহুর্তের জন্য। জাগ্রত ফাল্গুনীর চোখে দৃষ্টি বহাল রেখেই এগিয়ে গেলো রেলিং এর ধারে। জাগরুক হাতে সাবধানে বসিয়ে দিল ফাল্গুনীকে রেলিং এর উপর। রেলিং এ বসতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ফাল্গুনীর। ভয়ে শক্ত হাতে ধরে ফেললো জাগ্রতর দুই বাহু।
জাগ্রত বুঝল ফাল্গুনী ভয় পাচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিলো ফাল্গুনীকে রেলিং-এ বসিয়ে তার পাশে সেও বসে পড়বে। কিন্তু ফাল্গুনীকে ভয় পেতে দেখে আর সরে গেল না ফাল্গুনীর কাছ থেকে। ফাল্গুনীর কোমরে আলগোছে রাখা হাতের বন্ধনী আরও দৃঢ় করলো। আরও একটু কাছে এসে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে থেকে ধরে রইলো বিশাল পুরুষালী দু’হাতের শক্ত বন্ধনীতে।
ফাল্গুনীর দম বন্ধ লাগছে। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে দিয়ে চিনচিনিয়ে ব্যাথা করছে। একে তো এই বুঝি পিছনে পড়ে গেল সেই ভয় তার ওপর আবার সামনে আছে জাগ্রত। খুব কাছ থেকে আঁকড়ে ধরে আছে কোমড় জরিয়ে। হৃদয় টা থেমে না যায়!
জাগ্রত ফাল্গুনীর ভীতিবিহ্বল চেহারা দেখে ওর মন ভোলাতো বলে উঠলো,
“ভেবেছিলাম তোমায় এখানে বসিয়ে দিয়ে আমিও বসে পড়বো তোমার পাশে রেলিং-এর উপর। কিন্তু তুমি তো দেখছি ছাড়ছো-ই না। একেবারে বিড়াল ছানার মতো দু’হাতে খামচে ধরে আছো। কে জানে কাল আবার কটা ইনজেকশন নিতে হয়!”
ফাল্গুনীর হাতে নখ আছে ঠিকই কিন্তু জাগ্রতর গায়ে তা এক চিলতেও লাগে নি। ফাল্গুনী মুখভঙ্গি স্বাভাবিক রেখে বলল,
“এক বিড়াল আরেক বিড়ালের আঁচড় খেলে কিচ্ছু হয় না। চিন্তা করবেন না।”
জাগ্রত মাথা কিছুটা ঝুঁকিয়ে নিয়ে কিঞ্চিৎ হাসলো। ফাল্গুনী বলল,
“রেলিং এর উপর আমার ভাল লাগে না। নিচেই ভাল। আমাকে নামিয়ে দিন।”
“আমার তো ভালো লাগছে।”
“আপনার ভালো লাগলে আপনি বসে থাকুন না, আমার ভালো লাগে না আমাকে নামিয়ে দিন।”
জাগ্রত আরও একটু কাছে এসে দাঁড়ালো ফাল্গুনীর কাছ ঘেঁষে। হাতের বন্ধনী করলো আরও দৃঢ়, আরও গভীর। অতঃপর বলল,
“এখনও ভয় লাগছে?”
দুজনের মাঝে এখন মাছি গলার ফাঁক-ও নেই। খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে জাগ্রত। ফাল্গুনীর বুকে চিনচিন করা ব্যাথা এক মুহুর্ত বেড়ে গেলো। ব্যাথার পারদ যেনো চিরচির করে শুধু বাড়ছে-ই। ফাল্গুনী অস্বচ্ছ কন্ঠে কোনমতে বলে উঠলো, “লাগছে। আমি বাসায় যাবো।”
জাগ্রত “আচ্ছা যাও” বলে দু’হাতের বাঁধন খানিক আলগা করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে হুরমুরিয়ে তার গলা জাপটে ধরলো ফাল্গুনী। জাগ্রত আবারও শক্ত হাতে জরিয়ে নিল ফাল্গুনীর কোমর। ঠিক করে বসিয়ে দিল রেলিং এর উপর। জাগ্রতর গলা ছেড়ে দিল ফাল্গুনী তৎক্ষনাৎ। জাগ্রত বলল,
“হ্যাঁ ছাড়বেই তো! আমি তো অশুচি। আমাকে ছোঁয়া যায় না।”
ফাল্গুনী পাত্তা দিলো না জাগ্রতর মন আওলে দেওয়া কথায়। মাথা নত করে বসে রইলো।
আচমকাই লোডশেডিং হলো। ছাঁদে টিমটিমিয়ে আলো ছড়ানো হলুদ রঙের বাতিটি নিভে গেলো। পুরো এলাকা মুড়িয়ে গেল অন্ধকারে। আকাশের এক চিলতে চাঁদে আজ তেমন আলোও নেই। কিছুই দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে। পিনপতন নীরবতায় লেপ্টে গেল বাতাবরণ। দুজনের শ্রবণেন্দ্রিয় ভেদ করে প্রবেশ করছে শুধু একে অপরের শ্বাস প্রশ্বাস।
ফাল্গুনী দীর্ঘশ্বাস ফেললো অন্ধকার হয়ে যাওয়ায়। ভাবলো এবার যাওয়া উচিত। অন্ধকারে কখন কোন বিপদ হয় বলা তো যায়না। নামবে করে নিজ কোমড়ে রাখা জাগ্রতর হাত সরাতে গেলেই অনুভব হলো উষ্ণ এক নরম স্পর্শ। ঠোঁট টা যেনো আর নিজ দখলে নেই। কেউ পরম আবেশে তুলে নিয়েছে যত্ন করে।
ফাল্গুনীর হৃদয় গহীন থেকে কেউ যেন রসিকতা করে বলে উঠলো, “বিপদ তবে হয়েই গেল! এমন বিপদ আজন্মকাল পিছু না ছাড়ুক।”
ফাল্গুনীর হাত এবার সত্যি সত্যিই বিড়ালের আঁচড় বসিয়ে দিয়েছে জাগ্রতর হাতে। অকস্মাৎ এমন ঝক্কি সামলাতে না পেরে ছেড়ে দিয়েছে শরীরের সমস্ত ভার। সামলে নিয়েছে জাগ্রত। পরিচিত হয়েছে নতুন এক অনুভূতির সঙ্গে।
________________________
বার কয়েক কল চেপে বাটি ভরে ঠান্ডা জল নিয়ে ঘরে ছুটলো খুশি। পুরোনো আলনা টা তে গুছানো জামা-কাপড় থেকে লাকির উড়না তুলে নিল একটা। ভাজ করে ঠান্ডা জলে ডুবিয়ে নিগড়ে নিল মোটামুটি পর্যায়ে। তারপর তা চেপে ধরলো লাকির কপাল জুড়ে। হাসির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে লাকি। গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে মেয়েটার। হাসি তার নারী ছেঁড়া ধনকে কোলে শুইয়ে রেখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ঘন কালো কুঁকড়ানো চুল গুলোয়। ঘরে এখন শুধু এই তিনজনের অস্ত্বীত্ব বিদ্যমান।
প্রায় আধ ঘন্টা যাবত সেবা শুশ্রূষা করে গেল দুই মা মিলে। কখনো মাথা ধুইয়ে গা মুছিয়ে দেওয়া তো কখনো জলপট্টি দেওয়া, এভাবেই চললো আধঘন্টা। জ্বর এবার নেমেছে। ঘাম ছেড়েছে গায়। গায়ে এখনও সেই সকালের পড়া লাল টুকটুকে শাড়ীটাই রয়ে গেছে। তবে শাড়ীটায় জায়গা করে নিয়েছে ধুলো, মাটি আর কাঁদা।
লাকি আরও আধ ঘন্টা ঘুমালো। ঘুম ভাঙলে চট করেই উঠে বসল। যেন রোজকার মতন তার সদ্য ঘুম ভেঙেছে ভোরের সূর্যকে টক্কর দিয়ে তার আগে আগেই। কোন ফারাক নেই আর পাঁচটা দিন এর মতো। যদিও সময়টা এখন রাত; দিন নয়। তবুও লাকির অঙ্গভঙ্গিতে তা প্রকাশ আর পেলো কই?
লাকি এলোমেলো চুল হাতড়িয়ে হাত খোপা করতে চুল পেঁচাতে পেঁচাতে বলল,
“খিদে পেয়েছে। ভাত খাব। গরম ভাত হলে ভাল হয়। সাথে কিছু না হলেও চলবে। একটু সরষের তেল, লবন আর দুটো পোড়া মরিচ দিও।”
একটু থেমে আবারও বলল,
“আজকে উনুন জ্বালিয়েছিলে তো?”
হাসি আর খুশি নির্বাক। দুই মা মিলে হতবাক চেয়ে আছে মেয়ের দিকে। কারও মুখে কোন রা নেই। আছে শুধু চেহারার অভিব্যক্তি। যা মোটেও স্বাভাবিক নয়।
হাসি হাত রাখল লাকির কপালে। জ্বরের ছিটেফোঁটাও রইলো কিনা তা দেখতে। লাকি নামিয়ে দিল সে হাত। ফিরেও চাইলো না। অন্যদিক ফিরে বলল,
“যে নিজের খেয়াল রাখতে পারে না সে কিনা নিচ্ছে অন্যের খেয়াল! হাস্যকর। আগে নিজের খেয়াল নিতে শিখুন তারপর অন্যের কথা ভাববেন।”
“খুশি আলতো হাতে এক গাট্টা মারলো লাকির মাথায়। চোখ বড়সড় করে ধমকও দিল একটা। হাসি ঠোঁট এলিয়ে হাসলো লাকির তেজ দেখে। ভাবলো, একদম তার স্বামী আর শ্বাশুড়ীর মতো তেজ পেয়েছে মোয়েটা। কিন্তু মনটা মোটেও খারাপ না তাদের মতো। লাকির মাথায় হাত রাখল ভাবতে ভাবতে। লাকি সরাতে গেলে বলে উঠলো,
“আমারে নিয়া তর বড্ড চিন্তা দেকতাছি। আমারে তো এমনে দেকবার-ই পারস না বিশালাক্ষী। আইজ কি হইছে?”
“যে নিজেকে দেখতে পারে না তাকে অন্যেরা কিভাবে দেখবে বলুন। আগে নিজের ভালবাসা অর্জন করুন, তারপর অন্যদেরটাও পেয়ে যাবেন। যদিও, নিজের ভালোবাসা, ভরসা আর সম্মান যদি নিজে অর্জন করে নেওয়া যায় তাহলে তখন আর প্রয়োজন পরে না অন্যদের থেকে কিছু পেতে। তবুও, প্রয়োজন না পরলে সব পাওয়া যায় জানেন তো। তাই না লাগলেও তখন ঠিক-ই পেয়ে যাবেন।”
লাকি চলে গেল কলঘরে হাতমুখ ধুতে। গা টা কেমন যেন দুর্বল লাগছে। মেজমেজ করছে শরীর আর মন দুইয়েতেই। ভাবলো একবারে স্নান করে নেওয়া যাক। ভালো লাগবে হয়তো।
ঘরের ভেতর বিস্ময়াহত প্রতিবিম্ব নিয়ে বসে আছে হাসি আর খুশি। লাকিকে কলঘরে যেতে দেখে খুশি ভাত বসিয়ে দিয়েছে চুলায়। সাথে বেগুন পোড়া দিয়েছে কাঠিতে বাজিয়ে চুলার ভেতরে। তারপর বসে আছে বোনের সাথে। এরইমধ্যে ঘরে প্রবেশ করলো প্রবীর। ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে এসে বসে পড়লো মাটিতে লেপটে। মাথাটা এলিয়ে দিল চৌকির এক কোনায়।
“থানায় কি হইলো গো লাকির বাপ? পুলিশ আর কিছু কইলো? চেয়ারম্যান আর ওই মেডাম শেষমেশ কি কইলো? আমগোর লাকিরও কি যাওন লাগবো থানায়?”
হাসি থামালো খুশি কে। ইশারায় বোঝালো এক গ্লাস জল দিতে তাকে। খুশি হুরমুরিয়ে জল নিয়ে এলো ক্লান্ত প্রবীরের জন্য। আসার আগে চুলায় বসানো ভাত দেখে এসেছে আর পোড়া বেগুন উঠিয়ে রেখে বেশি করে লাকড়িও দিয়ে এসেছে যাতে নিভে না যায় চুলা।
খুশি জল ভর্তি স্টিলের গ্লাসটা স্বামীর হাতে দিয়ে মুখিয়ে বসে রইলো তার মুখ থেকে সব শুনবে বলে। হাসির কোন তাড়া নেই। সে বড্ড নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। তবে মনটা যেন কত আকুল প্রবীরের মুখ থেকে স্বামীর ধ্বংসের কথা শুনবে বলে। যেন নিজের স্বামী নয়, নিজের আজন্ম কালীন শত্রু ধ্বংসের কাহিনী শুনবে বলে বসে আছে ছটফটে মন নিয়ে।
_______________________
“বৌমনি ওটা না এটা পড়বে।”
শান্তার হাত থেকে কালো রঙা শাড়ীটা কেড়ে নিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে মারলো কান্তা। মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
“ছোট মানুষ ছোট মানুষের মতন থাক। ফুলশয্যায় কেউ কালো শাড়ী পড়ে গাধী? পড়বে তো রঙীন কোন শাড়ী।”
“হ্যাঁ, আর সেটা চুজ করবো আমি।”
কান্তার কথার মাঝে কথা বলে উঠলো বর্ষা। সাথে সাথেই আবার ফোঁড়ন কাটলো মিতু। বলল,
“আমি তোদের সবার থেকে বয়সে বড়। তাই বৌমনিকে সাজাবো আমি। আর শাড়ী গয়না-ও চুজ করবো আমি। যা সবগুলো সর বৌমনির কাছ থেকে।”
আঁখিকে ঘিরিয়ে রাখা তিনজনেই একসাথে বলে উঠলো,
“মাত্র দু’মাসের বড়।”
“হ্যাঁ তো কি হয়েছে? বড় তো বড়ই। তোদের মধ্যে শান্তা-কান্তার থেকে আমি গুনে গুনে দু’মাসের বড়। আর ওরা দুজন বর্ষার থেকে এক বছরের বড়। তাই এখানে আমি যা বলব তাই হবে। তোরা আমাকে হেল্প করতে পারিস। কিন্তু মাতব্বরি করলে সবগুলোর নামে বিচার দিয়ে আসবো চন্দনা পিসির কাছে।”
এভাবেই হইহট্টগোল আর কাড়াকাড়ি চলছে আঁখিকে নিয়ে। আঁখি বেচারি বসে আছে মুখে কুলুপ এঁটে। একবার এর দিকে তো আরেকবার ওর দিকে। একেকবার একেকজনের দিকে গোটা গোটা চোখের দৃষ্টি ফেলছে আর তাদের কথা গিলছে নিশ্চুপ বসে। আগামীকাল পরিবারের নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজন নিয়ে ছোট পরিসরে বৌভাতের আয়োজন করা হবে। আর এমন সিদ্ধান্তের মালকিন হচ্ছে স্বয়ং চন্দনা রাণী। বিয়ে যখন হয়েছেই বৌভাত কেনো বাদ যাবে? এমন ভাবনায় চন্দনা তার স্বামীর সাথে পরামর্শ করে ভাইদের ফোন করে চলে আসতে বলেছে পুরো পরিবার নিয়ে। আরও কিছু নিকটাত্মীয়দের জানানো হয়েছে তারা চলে আসবে আগামীকাল সকালে। কর্মক্ষেত্রের ব্যস্ততার দরুন আজ দুপুরের পর আপাতত তিন ভাই তাদের বউ আর ছেলেমেয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। আগামীকাল তারা নিজেরাও চলে আসবে। নিসান এর মামিরা এসে আঁখিকে দেখে কেউ কোন কটুক্তি করে নি। তাদের কথা, ছেলে যদি সুখী হয় তবে তারা কেনো অখুশি হবেন। সবার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছে আঁখি। সবাই কতোটা খোলামেলা উদার মনের মানুষ। কেউ আঁখির পরিবার সম্পর্কে একটা প্রশ্ন পর্যন্ত করলো না। উল্টো নিসান এর কান ধরে বকাঝকা করলো লুকিয়ে-চুরিয়ে বিয়ে করার জন্য। সবার নাকি অনেক আশা ছিল নিসান এর বিয়ে নিয়ে। সবাই মিলে সন্ধ্যার পর বৌভাতের জন্য কেনাকাটা-ও করতে গিয়েছিল। এ বাড়ী থেকে কিনে দেওয়া শাড়ী গয়না ছাড়াও সবাই কিছু না কিছু কিনে দিয়েছে আঁখিকে। যা দিয়ে আগামী পাঁচ বছর অনায়াসে পার হয়ে যাবে বলে আঁখির মনে হয়।
আগামী কাল কখন কোন শাড়ী পড়বে আঁখি সেসব নিয়ে চলছে জোরদার প্রস্তুতি। প্রস্তুতি বললে ভুল হবে; এক প্রকার যুদ্ধ চলছে বোনেদের মধ্যে। এরইমধ্যে রুমে আগমন হলো নিসান এর। নিসানকে দেখে সবার ছোটজন বর্ষা এগিয়ে এসে বিচার দিল বাকি তিন বোনকে নিয়ে। তিনজন আবার একে অপরকে দোষারোপ করতে লাগলো। নিসান কিছুই বললো না। শুধু চুপচাপ শুনে গেলো। নিসান এর থেকে কোন প্রতিক্রিয়া না পেয়ে চুপ করে গেলো সবাই। আচমকা নিসান এগিয়ে গেল আলমারির কাছে। ভেতর থেকে বিছানার ঝাড়ু বের করে তাড়া মেরে ধমকে বলল, “বের হ সবগুলো।”
সবাই রুম ছেড়ে এক দৌড়ে বের হয়ে গেলো চটজলদি। আঁখি খিলখিল করে হেসে দিল ওদের কান্ড দেখে। নিসান ঝাড়ুটা ছুঁড়ে ফেলে রাখল এক পাশে। আঁখিকে বলল, “বিছানার একি হাল করে রেখেছো! সরাবে নাকি নিচে ফেলবো সব?”
“আরে ফেলবেন কেনো? নষ্ট হয়ে যাবে তো! আমি গুছিয়ে রাখছি।”
“নষ্ট হলে আমার কি? আমার এতসব জঞ্জাল মোটেও পছন্দ না। যতই শপিং হোক আর প্ল্যানিং হোক ওইসব রংচং মেখে পেত্নী তোমায় আমি সাজতে দিব না। ওসব শোকেসে সাজিয়ে রেখে শো করতে পারবে বড়জোর। তার বেশি কিছু না। শুধু শাড়ী আর গয়না গুলোই কাজে দেবে। বাকিগুলো দান করে দিও ওই শাঁকচুন্নিগুলোকে। ওরা আবার এসব ছাড়া অচল।”
আঁখি হতবিহ্বল দাঁড়িয়ে আছে। নিসান এর কথাগুলোতে তার হাসি ছাড়া আর কিছুই পেলো না। এতো এতো কসমেটিকস দেখে তো এমনিই আঁখির মাথা ঘুরে উঠেছিল প্রথমে। কোনটার ব্যবহার যে কি তা তো জানেই না সে। এসব সে কোনদিন কাজে লাগাতে পারলে তো! মনে মনে ঠিক করলো সাজগোজের জিনিসপত্রগুলো মামি আর বোনদের দিয়ে দেবে কালকেই।
আঁখির খাট গোছানো হতে না হতেই রুমের সামনে এলো চন্দনা। সাথে এলো তিন মামি। যদিও দরজাটা খোলাই তবুও ভেতরে প্রবেশ না করে বাইরে থেকেই গলা খেঁকিয়ে উঠলো চন্দনা। নিসান পিছু ফিরল তৎক্ষনাৎ। আঁখিও মাথায় ঘোমটা টেনে পিছু ফিরলো। বড় মামি বাইরে থেকেই বলল,
“আজ ভাইদের সাথে ঘুমাবি নিসান। কাল অনুষ্ঠান হয়ে গেলে তারপর থেকে এ ঘরে ঘুমাবি।”
বাকি দু’জন মামি-ও বলল,
“হ্যাঁ, যা বাবা। শুভ, দ্বীপ আর অয়ন ঘুমিয়েছে বড় বেডরুম টায়। সেখানে যা আজকের মতো।”
চন্দনা কিছু বলল না। সে শুধু সাথ দিতে এসেছে ভাই বউদের। নিসান একপলক আঁখির দিকে চেয়ে চলে গেলো চেহারার বারোটা বাজিয়ে। আঁখি পিছু ডেকে ফেলল, “দাঁড়ান” বলে।
নিসান ঘুরে দাঁড়ালে আঁখি হুট করে লজ্জা পেলো মামিদের দিকে তাকিয়ে। মাথানত করে একটি বালিশ এগিয়ে দিয়ে বলল,
“বর্ষা তখন দাদাভাইদের রুমে তিনটি বালিশ নিয়ে গেছিলো। এটা সাথে নিয়ে যান।”
নিসান আঁখির হাত থেকে বালিশ টেনে নিয়ে চলো গেলো। এদিকে মামিরা এগিয়ে এসে আঁখির সাথে গল্প জুড়ে দিল। সাথে প্রশংসা তো আছেই। সবাই মিলে ঠিক করলো তিন মামি মিলে আজ আঁখির সঙ্গে এ ঘরেই ঘুমোবে। আঁখিকে শিখিয়ে দিল তাদের মেয়েরা এলে যেন ও বলে মামিদের সাথেই আজ ঘুমোবে। চন্দনা এতোক্ষণ বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। আঁখি যেন একদিনেই মনের সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব দূর করে দিয়েছে নিজের সরলতা আর কোমল হৃদয় দিয়ে। কেনাকাটা করতে গিয়েও কতটা নির্লিপ্ত ছিল মেয়েটা ভাবতেই অবাক হয় চন্দনা। কোন চাওয়া নেই, কোনকিছুতে না নেই এমনকি এটা নয় ওটা চাই করে কোন বায়নাও নেই। শুধু সিঁদুর কৌটো টা নিজে পছন্দ করে কিনেছে। পিতল এর মাঝে সুন্দর কারুকাজ করা মাঝারি সিঁদুর কৌটোটা হাতে নিয়ে কতোবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিলো মেয়েটা। কি খুশিই না হয়েছে। একে একে সবাইকে দেখিয়েছে কৌটোটা। নিসানকে-ও ছাড়েনি। একমাত্র সিঁদুর কৌটোটা ছাড়া আর কোন কিছু একবার ছেড়ে দু’বার হাত দিয়ে দেখেনি। মামিদের সাথেও কি সুন্দর মিলে গেছে। চন্দনার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো মনে মনে এসব ভেবে। ভরা মন নিয়ে ফিরে গেলো নিজের রুমে। নিসান এর বাবার সাথে আগামীকালকের আয়োজন নিয়ে আলোচনা করতে হবে অনেক। কতো কাজ করতে হবে। সময় মাত্র একদিন। যতটুকু সম্ভব জমকালো আয়োজন করা যায় ততটুকু করার চেষ্টা করবে সবাইকে নিয়ে। ছেলে তো একটাই। সুযোগও একটাই।
~চলবে
গতকাল দিই নি তাই আজ কিন্তু বেশ বড় পর্ব দিয়েছি। যদিও রাত হয়ে গেলো অনেক। যারা এখনোও জেগে আছেন পড়ে নিন বাকিরা আগামীকাল অনলাইন হলে পড়ে নেবেন। শুভরাত্রি।