গল্পঃ পূর্ণতায় তুমি ( অষ্টম পর্ব )
হিমির বুকের বামপাশের স্তন বরাবর ছুরি দিয়ে জখম করা হয়েছিল বিভৎস রকমের, আর এখন যে খুনি অবনীর দিকে পিস্তল তাক করে আছে, সে-ও পিস্তলটা বামহাতে ধরে রেখেছে, তারমানে ইনি বামহাতি। তাহলে বিষয়টি এমন নয় তো যে এই খুনিই হিমিকেও খুন করেছিল!
মানে খুনি যেহেতু বামহাতি, খুনি এবং হিমি সামনাসামনি দাড়ালে খুনির ডানদিক হিমির হবে বামদিক, খুনি ডানহাত দিয়ে ছুরি চালালে হিমির বুকের বামপাশে ক্ষত হতো। কিন্তু পুলিশের ভাষ্যমতে ক্ষত হিমির বুকের বামপাশে, তারমানে খুনির বামহাতি হবার আশঙ্কা নব্বই পার্সেন্ট, যেকারণে সামনাসামনি ছুরি চালালেও বামহাত দিয়ে চালিয়েছে বলেই হিমির বুকের বামপাশে জখম হয়েছে।
অবনী এসব হিসাব মেলাতে মেলাতে পিস্তলধারী খুনি কখন একেবারে কাছে এসে মাথায় পিস্তলের নল ঠেকিয়েছে অবনী টেরও পায়নি।
খুনি পিস্তলের ট্রিগার চাপবে ঠিক এই মুহূর্তে অবনী খপ করে এক হাত দিয়ে খুনির হাতটা ধরে ফেলে, অন্য হাত দিয়ে চুলের পিন এনে মুহুর্তে বসিয়ে দিলো খুনির পিস্তল ধরা হাতে। ব্যথায় পিস্তলটা ছেড়ে দিয়ে খুনি নুয়ে পড়তেই অবনী খুনির মাথার চুল ধরে তলপেটে একটা লাথি মারতেই খুনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। সেই সুযোগে পিস্তলটা উঠিয়ে নিয়ে দৌড়ে পালালো অবনী।
পিস্তলে নিশ্চয়ই খুনির হাতের ছাপ রয়েছে ভেবে এবনী একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো, পরক্ষণেই মনে হলো খুনির হাতে তো হ্যান্ড-গ্লাভস পরা ছিল। সুতরাং ছাপ থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই।
যা-ই হোক, এবার যেতে হবে নবনীতা কফিশপে, ঐদিন শুভর সাথে কি ঘটেছিল, কেন কফিশপ থেকে ফিরে ঐ রতে এত জলদি ঘুমিয়ে পড়েছিল শুভ, কিছু তো একটা গন্ডগোল আছে!
কফিশপে এসে ঢুকতেই কফিশপের মালিক নবনীতা হাস্যোজ্জ্বল মুখ এগিয়ে এসে বললো,– আরে আপনি শুভর প্রথম স্ত্রী অবনী ভাবীনা?!
অবনী হেসে বললো,– হ্যাঁ আপনার ধারণা ঠিকই আছে।
নবনীতা একজন ওয়েটারকে ডেকে বললো,– একটা স্পেশাল কফি নিয়ে আসো ম্যাডামের জন্য।
অবনী হেসে নবনীতাকে বললো,– অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে, আচ্ছা একটা হেল্প করবেন!
: কি হেল্প চাচ্ছেন বলুন অবনী!
: আচ্ছা লাস্ট যেদিন শুভ এসেছিল আপনার কফিশপে, সেদিন অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করেছিলেন ওর মাঝে, আচরণে অথবা অন্য কিছুতে।
: তারিখটা বলতে পারবে অবনী!
: হ্যাঁ চোদ্দ তারিখ।
: আসলে ঐদিন আমি আমার এক বান্ধবীর বিয়েতে গিয়েছিলাম, তাই শপে আসিনি, এবং ঐদিন আমার কফিশপের সকল স্টাফদেরও রাত আটটায় ছুটি দিয়ে দিতে বলেছিলাম ম্যানেজারকে। এবং সবাইকে ছুটি দিয়ে সবকিছু গোছগাছ করে যেতে যেতে ম্যানেজার এর সবসময় একটু দেরি হয়, ওর চোখে কিছু পড়েছে কিনা সেটা ওকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে।
: প্লিজ একটু ডাকেন তাকে!
নবনীতা একজন ওয়েটারকে দিয়ে ম্যানেজার জান্নাতকে ডেকে পাঠালো।
জান্নাত এসে সালাম দিয়ে অবনীর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো,– বলুন ম্যাম কীভাবে আপনার সাহায্য করতে পারি।
“ আচ্ছা তোমরা কথা বলো, আমি একটু বেরোবো” বলে নবনীতা উঠে চলে গেল।
অবনী মিষ্টি হেসে জান্নাতকে বললো,– সেদিন লাস্ট যখন শুভ তোমাদের কফিশপে এসেছিল কফি খেতে, সেদিন ওর ভেতর অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করেছিলে জান্নাত?
জান্নাত একটু ভেবে বললো,– না তো! তেমন কিছু লক্ষ্য করিনি!
: অতিরিক্ত মানসিক চাপ অথবা এমন কিছু?
: না ম্যাডাম।
: আচ্ছা জান্নাত, ঐদিন তো স্টাফদের ছুটি দিয়ে দিয়েছিলে আটটায়, আর শুভ এসেছিল আটটার পরে, তাহলে কফি কে রেডি করে দিয়েছিল?
: ম্যাম আমিই দিয়েছিলাম, আর আপনি তো জানেন এটা লেডিস কফিশপ, শুভ স্যারকে এখানে এলাউ করা হয় একমাত্র নবনীতা ম্যাডামের জন্য। যখন নবনীতা ম্যাডাম শূন্য ছিল, পরিবারের টেনশনে দিশেহারা, তখন নাকি শুভ স্যার নবনীতা ম্যামকে এই কফিশপের পরামর্শ দেয়, এবং শুরুতে সমস্ত ব্যয় শুভ স্যার বহন করে। এসবের জন্যই নবনীতা ম্যাম শুভ স্যারের কাছে কৃতজ্ঞ এবং তাকে ভাইয়ের মতো ভালোবাসে।
: হ্যাঁ সে আমি জানি জান্নাত!
: ম্যাম আর কিছু জানতে চান? নয়তো আমার কাজ পড়ে আছে।
: ওকে তুমি যাও।
জান্নাত চলে গেল।
অবনী ফোন করে নবনীতাকে বললো,– যদি কিছু মনে না করেন তবে আমি আপনার কফিশপের ঐ রাতের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে দেখতে চাই একটু।
নবনীতা বললো,– কোনো সমস্যা নেই, দেখতে পারেন।
অবনী বসে বসে সিসিটিভি ফুটেজ চেক করতে লাগলো, সেখানে দেখা যাচ্ছেঃ কফিশপে কেবলমাত্র শুভ এবং জান্নাত, জান্নাত হাস্যোজ্জ্বল মুখে এক কাপ কফি এনে শুভর হাতে দেয়, শুভ কফি খেতে থাকে। জান্নাত সবকিছু গোছগাছ করে এয়ার-ফ্রেশনার স্প্রে করে। শুভর কফি খাওয়া শেষে জান্নাত টিসু এনে দেয়। শুভ টিসু দিয়ে মুখ মোছার সময় বেশ কয়েকবার টিসুর ঘ্রাণ নেয়!
এখানে এসে ভিডিও পজ করে দেয় অবনী, টেনে টেনে শুভর টিসুর ঘ্রাণ নেবার দৃশ্যটা কয়েকবার দেখে জান্নাতকে ডেকে ভিডিও ক্লিপ দেখিয়ে অবনী জানতে চায় ঠিক কি কারণে শুভ টিসুর ঘ্রাণ নিচ্ছিলো বারবার।
জান্নাত মিষ্টি হেসে বলে,– ম্যাম ওটা স্পেশাল টিসু, ভিয়াইপিদের জন্য, ওর ঘ্রানটা খুব সুন্দর বলেই হয়তো শুভ স্যার বারবার ঘ্রাণ নিচ্ছিলো!
“ আচ্ছা এবার তুমি যেতে পারো,” বলে জান্নাতকে যেতে বলে অবনী আবার ভিডিয়ো চেক করায় মনোযোগী হলো।
মজনুকে খুন করা সেই খুনি যে অবনীকেও খুন করতে চেয়েছিল, তার হাতে হাতমোজা পরে থাকার করণে পিস্তলটায় খুনির হাতের ছাপ না থাকলেও, অবনী যখন খুনির চুল ধরে তলপেটে লাথি মেরেছিল, তখন খুনি পড়ে যাওয়ায় খুনির কয়েকটা চুল ছিড়ে অবনীর হাতে রয়ে গিয়েছিল, সেটার ফরেনসিক তদন্ত করালেই অনন্ত খুনিকে সনাক্ত করা যাবে।
ভিডিয়োতে একটা বিষয় এতক্ষণ অবনী খেয়ালই করেনি! হঠাৎ খেয়াল করতেই অবনীর মাথায় নতুন প্রশ্নের উদয়!
দেখা যাচ্ছে জান্নাত এয়ার-ফ্রেশনার শুভ কাছাকাছি দাড়িয়ে স্প্রে করছে। ভিডিয়ো জুম করে অবনী লক্ষ্য করলো জান্নাতের হাতের এয়ার-ফ্রেশনার পরিচিত কোনো ব্র্যান্ডের মনে হচ্ছে না! আরও জুম করে দেখতেই অবনীর ধারণা সত্যি হলো। এটা কোনো এয়ার-ফ্রেশনার নয়, এটা হাই পাওয়ারি স্লিপিং-স্প্রে! যার গন্ধ নাকে গেলে কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘুম চলে আসে।
অবনীর মুখে বিজয়ের হাসি, সবকিছু ধীরে ধীরে ক্লিয়ার হচ্ছে।
কফিশপ থেকে বেরিয়ে অবনী কিছুদূর যেতেই পেছন থেকে একটা মাইক্রোবাস এসে কয়েকজন লোক নেমে একটা মুখোশ পরিয়ে অবনীকে তুলে নিয়ে চলে যায়…
চলবে…
আবীর হোসেন।