#পৌষের_কোন_এক_বিকেলে
পর্ব – ৯
অপরাজিতা অপু
পৌষের কুয়াশায় আচ্ছন্ন সকাল। ঘুম ভেঙেছে অনেক আগে কিন্তু বিছানা ছাড়তে দেরি। আমি কম্বলটা আরো ভালো করে জড়িয়ে নিলাম। এখন উঠে আমার কোন কাজ নেই। কক্সবাজার থেকে আসা প্রায় ৪ দিন হয়ে গেছে। লম্বা একটা ট্যুর দেয়ার পর সবাই টায়ার্ড। পুরো একটা দিন রেস্ট নিয়ে তারপর যে জার কাজে ফিরেছে। কিন্তু আমি এখনো আমার রোজকার রুটিনে ফিরতে পারিনি। বেশ বিদ্ধস্ত মনে হচ্ছে। ভাবী আমার ঘরের দরোজা কিঞ্চিৎ ফাঁকা করে বলল
” ঘুমাচ্ছো এখনো?”
আমি ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললাম
” না ভাবী। ভেতরে আসো।”
” তোমাকে বাবা ডাকছেন।”
ভাবী কথা শেষ করেই দ্রুত চলে গেলো। আমি একটু অবাক হলাম। আমাকে এত সকালে কেনো বাবা ডাকছে। ফ্রেশ হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। সোফায় দেখি বাবা আর ভাইয়া দুজনেই বসে গল্প করছে। ভাইয়াকে দেখে অবাক হলাম। আজ তো ছুটি নেই। ভাইয়া তো গতকাল থেকেই অফিস জয়েন করেছে। তাহলে আজ এই সময় বাসায় কি করছে। জিজ্ঞেস করতে যেয়েও করলাম না। বাবা আমাকে ডাকলেন তার পাশে বসতে। আমিও লক্ষ্মী মেয়ের মতো বসে পড়লাম। একবার বাবার দিকে চোখ তুলে দেখলাম বাবার চেহারা বেশ হাসিখুশি। কিছু না বোঝা আমি মাথা নিচু করে এক হাত আরেক হাতের মুঠোয় ধরে চুপচাপ বসে আছি। বাবা আমার মাথায় হাত রাখলেন। হাস্যজ্বল কণ্ঠে বললেন
” রুপম এর বাড়ি থেকে আজ ওর বাবা মা আসছে তোমাকে আংটি পরিয়ে দেবে। রুপম নাকি একটু সময় চেয়েছিল ভাবতে। তারপর সে তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে। আমাকে একটু আগেই ফোন করেছিলো। তুমি কি বলো?”
আমার গলা শুকিয়ে এলো। রুপম এর ব্যাপারটা মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছিলো। বারবার এমন টানা পোড়েনের মাঝে আমি অস্থির হয়ে উঠছি। কি করবো কি করবো না সেটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমি ক্লান্ত। এবার আমার মস্তিষ্ক বলছে সবকিছু ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেই। আমিও সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে বাবাকে জানিয়ে দিলাম আমার কোন আপত্তি নেই। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম এতদিনে। বাবা কিন্তু ভীষণ খুশী। সাথে সাথেই ফোন করে জানিয়ে দিলেন তাদেরকে। তারাও জানালো দুপুরের মধ্যেই চলে আসবেন। ভাইয়া কে নিয়ে বাবা বাজারে গেলেন। মা আর ভাবী রান্নার ব্যবস্থা করছে। আমি আমার ঘরে চলে এলাম। ভাবছি রুপমের কথা। সেদিনের পর থেকে তার সাথে কোন যোগাযোগ হয়নি। সেদিন তো আমাকেই ম্যানেজ করে নিতে বলেছিল। কিন্তু আমি পারিনি। আর পেরে উঠছি না এই পরিস্থিতির সাথে। তাই এখন একটু নিশ্চিন্তে থাকতে চাই। আর এতদিনে এটা বুঝে গেছি রুপম ছেলেটা খারাপ নয়। ক্লান্ত আমি গা এলিয়ে দিলাম বিছানায়। আজ ঠান্ডার দাপট মনে হচ্ছে কমবে না। আমি কম্বলের নিচে শুয়ে গান শুনছি চোখ বন্ধ করে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলেও এখনো রোদের দেখা মিলল না। ভাবী এসে আমাকে ডাকলো। আমি চোখ মেলে তাকালাম। ভাবী বিছানার উপরে আয়েশ করে বসে বলল
” তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
আমিও উঠে বসলাম। কি কথা সেটা না জানলেও কি বিষয়ে কথা জিজ্ঞেস করবে সেটা বুঝতে পারছি। এই বিয়ে নিয়েই জিজ্ঞেস করবে আমাকে। আমিও তার সব প্রশ্নের জবাব দিতে প্রস্তুত। ভাবী কিছুটা সন্দিহান কণ্ঠে বললো
” রুপম ছেলেটাকে কি তোমার পছন্দ হয়েছে?”
আমি দ্বিধান্বিত চোখে তাকালাম। এখানে পছন্দ অপছন্দের কোন প্রশ্নই নেই। বিয়ে হচ্ছে মানে মেনে নিতেই হবে। কিছুটা নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বললাম
” এখন কি আর এসব নিয়ে কথা বলার সময় আছে? আর কিছুক্ষণ পরই তো তার বাবা মা আসবেন।”
ভাবী বেশ উত্তেজিত অবস্থায় বলল
” এটা কোন কথা না। পছন্দ না হলে তুমি জোর করে কেনো বিয়ে করবে। আর আমি যা দেখেছি সেটা কিন্তু ভিন্ন কথা বলছে। তোমার কথার সাথে মিলছে না আজরা।”
আমি সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালাম। বললাম
” কি দেখেছো ভাবী?”
” কক্সবাজারে তোমাদের দুজনকে একসাথে ঘুরতে দেখেছি। তোমরা একসাথে সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে গল্প করছিলে। তারপর সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তুমি ওর সাথে দেখাও করতে গিয়েছিলে। সবই আমার চোখে পড়েছে। তখন ভেবেছিলাম যে বাসায় এসে তোমার সাথে কথা বলবো। কিন্তু তার আগেই ওদের দিক থেকে পজিটিভ কিছু জানিয়ে দেয়া হলো। ভাবলাম তোমরা কথা বলে হয়তো সব ঠিক করে ফেলেছো। কিন্তু তোমাকে ভীষণ কনফিউজ দেখাচ্ছে আজরা। কারণটা কি?”
আমি কথা খুজে পেলাম না। প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলতে বললাম
” ওই বিয়ের কথা উঠলেই মেয়েদের কেমন মন খারাপ লাগে। সেটা তো তুমি জানোই। তাই এমন হচ্ছে।”
” আমি সেটা জানি। কিন্তু তোমার বিষয়টা আলাদা। আমি সবটা জানতে চাই। বুঝতে চাই। আমাকে খুলে বলো। জানিনা তোমার মধ্যে কি চলছে। কিন্তু আমি মনে হয় তোমাকে হেল্প করতে পারবো।”
আমি চুপ হয়ে গেলাম। নিজের এই এলোমেলো চিন্তা ভাবনা কি করে ভাবীকে বোঝাবো। বললেই কি বুঝবে। ভাবী নাছোড়বান্দা। আমার মনের অবস্থা সে শুনেই ছাড়বে। আমিও নিরুপায় হয়ে বললাম
” আমি আসলে কিছু বুঝতে পারছি না ভাবী।”
” কি বুঝতে পারছো না?”
” এই বিয়ে নিয়ে আমার মনে অনেক শঙ্কা। ঠিক ডিসিশন নিতে পারছি না। আমার জন্য এই বিয়ে কতটুকু সুখ আনবে ভাবী। আমি কি পারবো অপরিচিত একজনের সাথে সারাজীবন কাটাতে। পারবো কি ভালো থাকতে। যদি না পারি তাহলে তো এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়েও আসতে পারবো না। বাবা, মা, ভাইয়া তোমরা সবাই কত খুশী। আমি কেনো তোমাদের মতো এতো খুশী হতে পারছি না। মাথায় সব সময় একটা বিষয় ঘুরছে বিয়ে হলেই কি সব সমাধান হয়ে যাবে?”
ভাবী লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল
” দেখো আজরা! আজ তোমার মনে এসব প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক। কারণ আগেও তুমি একবার ধোঁকা খেয়েছো। বিশ্বাস করেও ভেংগে গেছে। তাই নতুন করে কাউকে বিশ্বাস করার মত সাহস তোমার হচ্ছে না। ভরসা করতে পারছ না তুমি। আর ভয় পাচ্ছো রুপম যদি তোমার মন মতো না হয়। যদি আবারো কষ্ট পাও। সেটাই বা সহ্য করবে কিভাবে। এসব নিয়েই তোমার মনে দ্বিধা কাজ করছে। এটা থেকে পরিত্রান পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো ছেলেটাকে সময় দাও। তার সাথে সময় কাটাও বেশি বেশি। তাকে বুঝতে চেষ্টা করো। তোমার সাথে তার মতের মিলটা কতটুকু সেটা বুঝতে চেষ্টা করো। এমনও হতে পারে অনেক বিষয় তুমি নিজেই বোঝনা। কিন্তু সে তোমাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিবে।”
ভাবী থেমে গেলো। কি একটা ভেবে মুচকি হেসে বলল
” আমি যখন প্রথম তোমার ভাইয়ার সাথে কথা বলি তখন খুব ভয় পেয়েছিলাম। এমন একটা গম্ভীর মানুষের সাথে কিভাবে সংসার করবো। বাসায় তো না বলতেই পারিনি। আর সেভাবে সময় কাটানোর সুযোগ হয়নি। তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের পরেও তোমার ভাইয়ার সাথে কথা বলতে খুব ভয় পেতাম। কি ভাববে। কি বলবো এসব নিয়ে দ্বিধায় থাকতাম সবসময়। তোমার ভাইয়া বোধহয় আমার অবস্থাটা বুঝেছিল। তাই নিজে থেকেই সহজ করে নেয়ার চেষ্টা করেছিল। আমাকে সুযোগ দিয়েছিল কথা বলার। এখন দেখো সব কেমন ঠিক হয়ে গেছে। যেখানে কথা বলতেই ভয় পেতাম সেখানে আমি এখন রাগ দেখিয়ে কথা বলি আর তোমার ভাইয়া আমাকে ভয় পায়।”
ভাবীর কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম। ভাবীও হাসলো। অনেকদিন পর এমন হাসলাম। ভাবী হাসি থামিয়ে বলল
” আমার তেমন কথা বলার সুযোগ না থাকলেও তোমার কিন্তু আছে। তাই বলছি ছেলেটাকে একটু সুযোগ দাও। দেখবে তুমি ঠিকই বুঝতে পারছো ঠিক হচ্ছে নাকি ভুল।”
ভাবীর কথা আমার মাথায় ঢুকলো। ভাবী চলে গেলো নিজের কাজে। যাওয়ার আগে দরজায় দাড়িয়ে আরো একবার ডাকলো
” আজরা? রুপম এর সাথে কথা হয়েছে?”
আমি মাথা নাড়লাম। রুপম এর সাথে আমার কোন কথাই হয়নি। ভাবী প্রশস্ত হেসে বলল
” ছেলেটা কিন্তু ভালোই। দায়িত্ব আছে বেশ।”
ভাবীর হাসি দেখে আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
” তুমি এত কিছু কিভাবে জানলে?”
ভাবী এবার হেসে ফেলে বলল
” কক্সবাজার থেকে আসার পর ফোন করে তোমার খোঁজ খবর নিচ্ছিল। কেমন আছো; মনের অবস্থা কেমন এসব নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছিল। তারপর আবার বলল তুমি নাকি ঠিকভাবে ডিসিশন নিতে পারছো না। তাই আমাকে হেল্প করতে বলল। আর এটাও শুনে নিতে বলল তুমি তাকে পছন্দ করো কিনা।”
ভাবী আবারো হেসে উঠে চলে গেল। আমি হা করে তাকিয়ে আছি দরজার দিকে। রুপম ভাবীকে ফোন করেছিলো? এতো কিছু বলেছে? কই আমাকে তো ফোন করেনি। সেদিনের পর থেকে আমার সাথে তার কোন কথাই হয়নি অথচ সে ঠিকই ভাবীর কাছে আমার কথা জানতে চেয়েছে। মানুষটা অদ্ভুত!
চলবে
( কাল রাতে গল্প দেয়ার কথা থাকলেও কয়েকদিন শারীরিক অসুস্থতার জন্য একবারেই পুরো গল্প লিখে শেষ করতে পারছি না। কাল রাতেও শেষ করতে পারিনি। এখন বাকি অর্ধেকটা লিখে ফেললাম। আমি খুবই দুঃখিত।)#পৌষের_কোন_এক_বিকেলে
পর্ব – ১০
অপরাজিতা অপু
দুপুর হতে না হতেই রুপমের পরিবারের লোকজন চলে এসেছে। তার বাবা মা বোন সহ আরো কয়েকজন। এতো লোকজন দেখে আমার মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম। আমি ঘরেই থেকে গেলাম। সেখান থেকে বের হওয়ার সাহস পাইনি। বাইরে কাজের ধুম পড়ে গেছে। এর ফাঁকে ফাঁকেই ভাবী আমাকে এসে দেখে যাচ্ছে। দুপুরে সবার খাওয়ার আয়োজন চলছে। মা ওনাদের যত্ন করে খাওয়াচ্ছেন। এদিকে ভাবী এক প্লেট ভর্তি ভাত নিয়ে এলো ঘরে। এসেই দরজা চাপিয়ে ফিসফিস করে বললো
” এটা খেয়ে নাও। আর খাওয়ার সময় পাবে না।”
আমি মলিন মুখে বললাম
” খেতে ইচ্ছা করছে না ভাবী। পরে খুদা পেলে খাবো।”
ভাবী প্লেটটা টেবিলে রেখে আমার একদম কাছে এসে বসলো। তারপর বলল
” ঠিক আছে জোর করবো না। তবে তুমি রেডি হয়ে নাও। নিজে নিজে তো শাড়ী পড়তে পারো। তাড়াতাড়ি পরে নাও। খাওয়া শেষ হলেই তোমাকে বাইরে ডাকবে।”
আমি কোন কথা বললাম না। শুধু মাথা নাড়লাম। ভাবী আলমারি খুলে প্রতিটা শাড়ী খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে একটা খয়েরী রঙের শাড়ি এনে আমার ঘাড়ে রাখলো। একটু দূর থেকে দেখে বলল
” এটাই ঠিক আছে। এটা পরো।”
আমি দিরুক্তি করলাম না। মেনে নিলাম। ভাবী আবারো বাইরে চলে গেলো। আমি একা একা শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। হালকা সাজলাম। সাজলে নাকি মানুষের মন ভালো হয়। আমার আসলে কেনো মন খারাপ সেটা জানা নেই। তবে মন ভালো করার সব চেষ্টাই করলাম আমি। ভালো হলো কিনা বুঝলাম না। সব শেষ করে ঘরে বসে থাকলাম। বাইরের আওয়াজটা কানে এলেও স্পষ্ট কথা কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমিও গুরুত্ব দিলাম না। যখন ডাকবে তখনই যাবো। আমি বিছানায় হেলানী দিয়ে অপেক্ষা করছি। কিন্তু অনেক্ষণ হয়ে গেলো আমাকে ডাকছে না। ভাবী যে বলেছিল খাওয়া শেষ হলেই আমাকে ডাকবে। তবে কেনো আমাকে ডাকছে না এখনো। আমি স্থির হয়ে বসে আছি। বাইরে থেকে শোরগোলের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কোন ঝামেলা হলো নাতো? আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। ভেতরে বসে থেকে অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। কাউকে ডাকতেও পারছি না কি হচ্ছে। প্রায় আধ ঘন্টা পর আরো কয়েকজন লোক এলো। আমি দরজায় গিয়ে আড়ালে দাড়ালাম। বাইরে চোখ রাখতেই প্রথম চোখে পড়লো রুপমের দিকে। সে মাথা নিচু করে বসে আছে। চেহারা দেখে তার মনের অবস্থা আন্দাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। কিছুক্ষণ তাকে দেখেই আমি ভেতরে এসে আবার বসলাম। তাহলে সবাই হয়তো রুপমের জন্য অপেক্ষা করছিল। যত সময় বাড়ছে আমার বুকের ভেতরে ধুকধুকানি ততই বাড়ছে। লম্বা একটা শ্বাস টেনে স্থির হয়ে বসতেই আমার ঘরের দরজায় টোকা পড়লো। আমি কাপা কাপা কণ্ঠে বললাম
” ভাবী? ভেতরে আসো। আমি রেডি।”
ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো না। তবে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো বাবা। আমি কিছুটা অবাক হলাম। বাবাকে এই মুহূর্তে আমি একদমই এক্সপেক্ট করিনি। বাবার মাথা নিচু। আমি ভালোভাবে খেয়াল করেই বললাম
” কিছু বলবে বাবা?”
বাবা এসে আমার পাশে বসলো। মাথা নিচু রেখেই বলল
” আজ তোমাকে আংটি পরানোর কথা থাকলেও সেটা হচ্ছে না।”
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। কোন প্রশ্ন করার আগেই আবার বাবা বলল
“ওনারা চাচ্ছেন একেবারে বিয়েটা পড়িয়ে দিতে। বিয়ে পড়ালে ওনারা নিশ্চিন্ত হতে পারবেন। আর অনুষ্ঠানের ব্যাপারটা নাহয় পরে আলোচনা সাপেক্ষে করা যাবে। রুপম কে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে সে পুরোটাই তোমার উপরে ছেড়ে দিয়েছে। তুমি যা বলবে তাই হবে। তার কোন আলাদা মতামত নেই।”
আমার বুকের ভেতরটা কেপে উঠলো। আংটি পর্যন্ত ঠিক ছিলো। কিন্তু বিয়ে? ভাবী যে বলল আমার হাতে অনেক সময় আছে। রুপম এর সাথে আলোচনা করতে পারবো। কিন্তু এখন তো সেরকম কোন সুযোগ পাচ্ছি না আমি। বাবা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি কিছুই বলতে পারছি না। বাবা নরম কণ্ঠে বললেন
” ওনারা সব ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। অনেক লোক এসেছে বাইরে। শুধু তোমার একটা কথা শুনেই কাজীকে আনা হবে।”
বাবার এমন অসহায়ের মতো কথাটাও আমার বুকে বিধলো। পারলামনা না করতে। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই বাবা উৎফুল্ল হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো
” তাহলে কি আমি তাদেরকে কাজী ডাকার অনুমতি দিয়ে দেবো?”
আমি মাথা নাড়িয়ে আবার সম্মতি জানিয়ে দিলাম। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন পরম মমতায়। তার চোখের দিকে তাকানোর সাহস হলনা আমার। বেশ বুঝতে পারছি তার চোখে পানি টলমল করছে। আমারও একই অবস্থা। বাবা বাইরে যেতেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ল। আটকে রাখার চেষ্টা করলাম না। মন ভরে কাদতে চাই এখন। কে জানে পরে এই সুযোগটাও হয়তো পাবো না। কিছুক্ষণ পরেই ভাবী আর পাশের বাড়ির এক ছোট বোন এলো ঘরে। আমার লাল চোখ দেখেই ভাবী বুঝে গেলো আমি কাদছিলাম। তবুও মুখে কিছু বলল না। ভাবী আমার পাশে বসে মাথায় হাত রাখলো। আমার কান্না বাঁধ মানলো না। ফুপিয়ে কেঁদে উঠতেই ভাবীও নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। আমাকে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলো। এই অবস্থায় রুপমের বোন একটা ব্যাগ হাতে ঘরে ঢুকলো। আমাদের এই অবস্থায় দেখে কি বলবে বুঝতে না পেরে উনি দাড়িয়ে আছেন। ভাবী চোখ মুছে ওনাকে বসতে বললেন। উনি আমার পাশে বসে আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন
” শাড়ি টা চেঞ্জ করার দরকার নেই। শুধু গয়না গুলো পরিয়ে দিলেই হবে। কাজী অপেক্ষা করছেন।”
ভাবীর দিকে গয়নার ব্যাগটা এগিয়ে দিলেন। ভাবী এক এক করে সব গয়না আমাকে পরিয়ে দিলো। তারপর ভাইয়া দরজা থেকেই মাথা ঢুকিয়ে বলল
” কাজী সাহেব আসবেন। সবাই একটু রেডি হয়ে নাও।”
যে যার মতো রেডি হয়ে গেলো। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজী ভেতরে প্রবেশ করলো। নিজের আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করে আমাকে কবুল বলতে বলল। বিষয়টা যে কতটা কঠিন সেটা এই মাত্র আন্দাজ করতে পারলাম। গলা দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। সমস্ত কথা যেনো পেটের ভেতরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। বুকটা ফেটে যাচ্ছে আমার। এমন সময় পাশ থেকে মায়ের চাপা কান্নার আওয়াজ পেলাম। বুকের ভেতরটা আরো দুমড়ে মুচড়ে গেলো। চোখ দিয়ে পানি অনবরত গড়িয়ে পড়ছে। আমি কোনভাবেই সামলাতে পারছি না। এদিকে কাজী বারবার তাড়া দিচ্ছে। এক সময় হাতের মুঠো শক্ত করে চোখ বন্ধ করে বড়ো একটা নিশ্বাস নিয়ে বলে দিলাম। অবশেষে সবাই খুশী হয়ে গেলো। এবার রুপমের পালা। বাইরে কি হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না। তবে আমার মাথা ঘুরছে। আমি এই শীতেও ঘামছি। অবশেষে জানতে পারলাম রুপম নাকি কবুল বলেছে। জানিনা কেনো মনে অদ্ভুত রকমের একটা প্রশান্তি অনুভব করলাম। কেনো এমন হলো সেটা আমি বুঝতেও পারলাম না। সবাই আমাকে রেখে বাইরে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর ভাবী চুপিচুপি ঘরে এসে রজনীগন্ধার তাজা একটা মালা এনে আমার নাকের কাছে ধরে বলল
” এটা রুপম এনেছে তোমার জন্য। দেখো কি সুন্দর ঘ্রাণ।”
আমি ভাবীর দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম। ভাবী মুচকি হেসে বলল
” একবার দেখবে না। চলে যাচ্ছে তো।”
আমি কোন কথা বললাম না। ভাবী আবারো বলল
” রুপম বলেছে ওর কাজ আছে। চলে যাবে। সবাই অবশ্য থাকতে বলেছে। ও না করেছে। একবার দেখা করো।”
আমি মাথা নাড়িয়ে না বললাম। ভাবী আর কথা বাড়ালো না। আমার হাতে মালাটা দিয়ে চলে গেলো। হুট করেই আমার মনে কেনো জানি এক আকাশ সমান অভিমান জমে গেলো। কারণটা অজানা। সন্ধ্যা হতেই রুপমরা সবাই চলে গেলো। পুরো বাড়ি এখন ফাঁকা। সারাদিনের এতো ব্যস্ততার কারণে বাড়ির সবাই খুব ক্লান্ত। আর বাইরেও শীত পড়েছে জেকে। তীব্র শীতের প্রকোপে সবাই হুহু করে কাপছে। ৯ টার মধ্যেই সব খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই ঘরে ঘরে শুয়ে পড়লো। আমি জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছি। শাড়ীটা এখনো বদলাইনি। নিজেকে খুব একা একা লাগছে। জীবনটা আজ থেকে পরিবর্তন হয়ে গেলো। আরেকজনের সাথে নামটা জড়িয়ে গেলো অবশেষে। কিন্তু সেই মানুষটার কোন গুরুত্ব নেই। একবারও আমার কথা ভাবলো না। আমার সাথে দেখা করলো না একবার। অদ্ভুত একটা মানুষ। হুট করেই পাহাড় সমান অভিমানে বুক ভারী হয়ে গেলো। কান্না গুলো দলা পাকিয়ে গেলো গলার কাছটায়। হাতের চুড়ি গুলো খুলে বিছানায় ছুড়ে মারলাম। গলা ছেড়ে কাদতে মন চাইছে। অপরিচিত থেকে প্রিয় হয়ে ওঠা সেই মানুষটার উপরে এক পাহাড় সমান অভিমান নিয়ে ফোন করলাম। কয়েকবার রিং বাজতেই ফোনটা রিসিভ হলো। কোমল কণ্ঠে অতি আপনজনের মত বলল
” বলো।”
চলবে