#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্ব_৪৪
টিভির নিউজ চ্যানেলগুলোর খবর দেখে রাগে থরথর করে কাঁপছে তরী। চোখের কার্ণিশ থেকে ছিটকে জল বেয়ে পড়ছে। সব টিভি চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে যে, আরমান আহমেদ একজন সফল পলিটিক্যাল লিডার হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। পাশ থেকে হাতড়ে রিমোটটা নিয়ে টিভি বন্ধ করে দিলো তরী। বেড সাইড টেবিলের ওপর থাকা তার মায়ের ছবিটার দিকে জলসিক্ত চোখে তাকালো। কম্পিত কণ্ঠে বললো,
“আমাকে ক্ষমা করে দিও, মা। আমি হয়তো হেরে গেলাম! তোমায় দেওয়া কথাটা আমি রাখতে পারলাম না।”
ছবিতে চওড়া হাসি ঝুলানো মানুষটা শুনলো কি না কে জানে? তরী নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে মিস্টার আফনাদের ঘরে গেল। তিনি নিজের ইজি চোয়ারে গা এলিয়ে বসে আছেন। চশমাটা কপালে তুলে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আনমনে কিছু একটা ভাবছেন তিনি। তরী বাবার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসলো। বাবার কোলে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো সে।
মিস্টার আফনাদ হঠাৎ চমকে উঠলেন যেন। সোজা হয়ে বসে চোখে মোটা ফ্রেমের চশমাটা পড়লেন। তরীর মাথায় হাত রাখলেন পরম যত্নে। তরীর চোখের মোটা অশ্রুকণা গুলো ওনার হাঁটুতে পড়ছে। তিনি বুঝতে পেরে আবেগপ্রবণ গলায় বললেন,
“মা রে! তোকে যেদিন নিজের মেয়ের পরিচয় দিয়ে নিজের বুকে আগলে নিয়েছিলাম, সেদিন নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তোর জীবনে বাবা-মায়ের অভাব কখনো বুঝতে দিবো না। তোর সব চাওয়া-পাওয়া পূরণ করবো। তোর সাথে র*ক্তের সম্পর্ক না থাকলেও মায়ার একটা অদৃশ্য বন্ধনে আমি বাঁধা পড়ে গিয়েছিলাম। তোর বাবার অভাব পূরণে সফল হলেও তোর মায়ের অভাবটা সারাজীবন-ই রয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারতাম, মোহনা তোকে পছন্দ করতো না, কষ্ট দিতো। তুইও কখনো নিজের দূর্বল খোলসের নিচে থাকা কঠোর রূপটা কাউকে দেখাতে চাসনি। কিন্তু আমার নিজেকে সবসময় ব্যর্থ মনে হতো। তাই তুই আমার কাছে যা আবদার করতি, আমি সব আবদার পূরণ করতাম। তোর অন্যায় আবদার গুলোর বিরুদ্ধেও আমি তোকে কখনো কিছু বলিনি। যদিও মোহনা দেরী করে হলেও তোকে আপন করে নিয়েছে। আমার তখন মনে হচ্ছিল, তোর আসল পরিচয় আগেই ওকে বলে দেওয়া উচিত ছিল। তাহলে তোর শৈশবটা সুন্দর কাটতো। মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হতে হতো না। এখন তোকে এভাবে কাঁদতে দেখলে তোর মা কিন্তু বাড়ি মাথায় তুলে ফেলবে! এমনিতেই তোর প্রতি ওর পজেসিভনেস দিন দিন বাড়ছেই।”
মিস্টার আফনাদের কথা শুনে তরী নাক টেনে পুনরায় ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। বললো,
“আমি আসলেই ব্যর্থ! ঐ লোকটার সাথে পেরে ওঠার আর কোনো ক্ষমতা আমার রইলো না।”
মিস্টার আফনাদ এবার একটু নড়েচড়ে বসলেন। এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে তরীকে তার বোঝাতে হবে। উচিত-অনুচিত ভুলে যেই প্রতিশোধস্পৃহা তরীর মস্তিষ্ক জুড়ে ঘুরছে, সেটা দমন করার প্রকৃত সময় এখনই। এই সময়টার উত্তম ব্যবহার মিস্টার আফনাদ করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। শান্ত গলায় বললেন,
“তুই ড. আরমান আহমেদকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলি, এতে আমি কখনো তোকে বাধা দেইনি যদিও এটা অনুচিত ছিল। কারণ তোর যুক্তি ঠিক ছিল। আরমান আহমেদ এখন সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি। অসংখ্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি অনেক চ্যারিটি, আশ্রম, স্কুল-কলেজ ওনার অনুদানে চলে। তার ভালোমানুষির এই শেকড় বহু গভীর যা উপড়ে তোলার ক্ষমতা নেই কারো। ওনার বিরুদ্ধে আঙুল তোলা মানে সমাজে ওর প্রতিষ্ঠিত ভালোমানুষির বিরুদ্ধে যাওয়া। আর এখন তো সে নিজের পাকাপোক্ত অবস্থান তৈরি করেই ফেলেছে! এখন এটাই ভালো হবে যে, তুই ওকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করিস না আর। অতীতকে অতীতের জায়গায়ই রাখ! ভুলে যা অতীত। নিজের ইচ্ছেকে মাটিচাপা দিয়ে দে এবার!”
তরী অবাক হয়ে তাকালো মিস্টার আফনাদের দিকে। সে বিশ্বাস করতে পারছে না, এই মানুষটা ওকে কোনো কাজে বাধা দিচ্ছে। তাই সে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললো,
“বাবা, তুমি এ কথা বলছো? সারাজীবন আমার হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মিলিয়ে আর না-তে না মিলিয়ে এসে আজ তুমি বলছো ঐ লোকটাকে ছেড়ে দিতে?”
মিস্টার আফনাদ হতাশা মিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“আমি তোকে বলিনি ওনাকে ছেড়ে দিতে। আমি শুধু বলেছি তোর অতীতটাকে ভুলে যা। মানুষ পৃথিবীতে সবসময় ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। বাধা, প্রতিকূলতার কাছে হার মানা মানেই হেরে যাওয়া না। কিছু কিছু বিচার কুদরতের হাতেও ছেড়ে দিতে হয়। উপরওয়ালা মানুষকে তার সব কাজের যথার্থ প্রতিদান দেন। সবটা এক সাইডে রেখে তুই একবার নিজের কথা ভাব, নিজের ভবিষ্যৎকে নিয়ে ভাব। তোর এই প্রতিশোধস্পৃহার শেষ পরিণতির জন্য তোর সন্তান মাতৃহীন হবে, সারা জীবন ভুগবে। সমাজে ওকে শুনতে হবে ওর মা খু*নী ছিল। কেউ কখনো ভালোমন্দ বিচার করতে আসবে না। তারা যা দেখবে ও শুনবে, তা-ই বিশ্বাস করবে। তাই সবদিক বিবেচনা করলে আমার বলা কথাটাই যৌক্তিক।”
তরী মলিন মুখে বললো,
“আমি ছেড়ে দিলেও উনি আমাকে ছাড়বে না, বাবা। সৌহার্দ্যকেও তো বুঝতে পারছি না। ওর সাথে আমার দূরত্ব কোনোদিনই হয়তো মিটবে না।”
মিস্টার আফনাদ তরীর চোখ মুছে দিয়ে বললেন,
“অতীতটাকে সম্পূর্ণ ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দে, মা। ধরে নে, সৌহার্দ্যও তোর অতীতের একটা অংশ। এখন তোর জীবনটা শুধু-ই তোর সন্তানের জন্য। তুই বাঁচবি তোর সন্তানের জন্য। ড. আরমানের নাগালের বাইরে পাঠিয়ে দিবো তোকে আমি। তুই নিশ্চিন্ত থাক।”
মিস্টার আফনাদের কথা শুনে কেন যেন তরীর মনটা অনেকটাই হালকা হয়ে গেল! সে বাবার দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসলো। হাসিতে প্রাণ না থাকলেও নিশ্চিন্ত একটা অনুভূতি ছিল। হঠাৎ মোহনার ডাক পড়লো,
“তরী! কই গেলি? তোর জন্য আচার আনিয়েছি। দেখে যা!”
তরী বাবার দিকে এক পলক তাকিয়ে ধীর গতিতে ঘর থেকে চলে গেল। মিস্টার আফনাদ ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলেন, সামনে তার অনেক কাজ বাকি।
৪৩.
সৌহার্দ্য নিজের দু’হাতে নিজের চুল খামচে ধরে বসে আছে। অরুণী ইতস্তত করে ওর কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসলো। সৌহার্দ্য ওর দিকে তাকালো না। অরুণী ভয়ে ভয়ে বললো,
“আসলে এসব আমিই করেছি, সৌহার্দ্য! অরিত্রী কোনো খু*ন-টুন করেনি কখনো।”
সৌহার্দ্য শান্ত সুরে প্রশ্ন করলো,
“কেন করেছো এসব? সবকিছু করলেও আমার বাবার এক্সিডেন্ট কেন করিয়েছিলে তোমরা?”
অরুণী চুপ করে রইলো। আসল সত্যিটা কীভাবে সৌহার্দ্যকে বলবে ও? সৌহার্দ্য সবটা শুনলে মহাবিপদ হয়ে যাবে। অরুণী কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে বললো,
“আমি বাবার অনুমতি ছাড়া কিছু বলতে পারবো না তোমায়!”
সৌহার্দ্য কথাটা শুনে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো অরুণীর দিকে। ব্যাগটা হাতে নিয়ে উঠে দাড়িয়ে বললো,
“আসল খু*নী তুমি হলে তুমি আসলেই একটা সাইকো, অরুণী। তোমার বাবা তোমাকে এমন বানিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করছে। কিন্তু সত্য কখনো চাপা থাকে না।”
সৌহার্দ্য অরুণীর বাসা থেকে বেরিয়ে এসে নিজের গাড়িতে বসতেই দেখলো, আরমান আহমেদের গাড়ি বাড়িতে প্রবেশ করছে। সৌহার্দ্য ঘৃণিত চোখে তাকিয়ে থেকে গাড়ি স্টার্ট দিলো। হাতে থাকা ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে দেখলো একবার। সে জানে না এটার ভেতর কী এমন জিনিস আছে, যাতে ওর মনের সকল প্রশ্নের উত্তর আছে! হয়তো অজানা রহস্যের সমাধান এটার মধ্যেই আছে, যা তরীও এখনো জানে না। নয়তো এটা এতো বছর এতো যত্নে সিন্দুকে রেখেছিল কেন? আর অরুণী-ই বা এটা ওর হাতে যাওয়ার আগে সরিয়ে ফেলেছিল কেন?
সৌহার্দ্য বেরিয়ে যাওয়ার পরই অরুণী অর্ণবকে কল দিলো। ছেলেটাকে কয়েকদিন ধরে ফোন করেই চলেছে ও। কিন্তু অর্ণব ওর কল রিসিভ করছে না। অরুণীর প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে এখন অর্ণবের ওপর।
অর্ণব অফিসে বসে একটা ফাইল চেক করছিল। ফোন ভাইব্রেট হওয়ায় অরুণীর কল দেখেও রিসিভ করলো না। কিন্তু মেয়েটা কল দিয়েই যাচ্ছে। অর্ণব ফাইলটায় সাইন করে ম্যানেজারকে দিয়ে তাকে যেতে বললো৷ এরপর ফোনটা হাতে নিয়ে অরুণীকে একটা টেক্সট পাঠালো,
“Don’t ever try to communicate with me.”
অর্ণব সব জায়গা থেকে অরুণীকে ব্লক করে দিলো। অরুণী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো ফোনের স্ক্রিনের দিকে।
বিকেলের দিকে ক্লাস শেষে মধু একবার তরীর সাথে দেখা করে আসে। তরী মোটামুটি স্বাভাবিকই আছে। মনে কষ্ট চেপে রেখে মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে মেয়েটার। রিকশায় উঠে বসতেই ফোন ভাইব্রেট হলে চমকে ওঠে মধু। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে প্রহর হোয়াটসঅ্যাপে কল দিচ্ছে বারবার। রাগে গা রি রি করে ওঠে মধুর। টানা সাত বারের পর অষ্টম বারে বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করে সে। শোনা যায় প্রহরে শ্রান্ত কন্ঠ,
“ফাইনালি! তোমরা দুই-ভাইবোন একই পদার্থ দিয়ে তৈরি নাকি? একজনও ফোন রিসিভ করছো না কেন? আশ্চর্য!”
মধু প্রহরের মুখে এমন কথা শুনে স্থান-কাল-সময় ভুলে ভেতরে পুষে রাখা সকল রাগ উগলে দিলো,
“তোর ফোনের মুখে জুতা! তোর ফোন আছে? ইউজ করোস তুই ফোন? তোর মতো পাবলিকের ফোম ব্যবহারের কোনো অধিকারই নাই। দরকারের সময় তো মঙ্গল গ্রহে চলে যাস। দ্যাখ, রাগ উঠাবি না একদম! আমার হাত কিন্তু আমি সব এঙ্গেলেই চালাতে পারি। কখন দেখবি কানাডা গিয়ে তোর মুখে একটা লাগিয়ে দিয়ে আসবো, অবাক হওয়ারও চান্স পাবি না। যত্তসব!”
প্রহর মিটমিট করে হাসতে লাগলো মধুর কথা শুনে। মেয়েটার হুটহাট রাগারাগি, গালাগালি বেশ লাগে ওর। হাসি থামিয়ে আবার স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“তোমার গালিগুলো কিন্তু এতো দিন দারুন মিস করেছি।”
মধু ভ্রু কুঁচকে বললো,
“গালি আবার মিস করে নাকি কেউ? আজব পাবলিক মাইরি!”
প্রহর আবারো হাসলো। কিন্তু মধুকে বুঝতে দিলো না। মধু বললো,
“আচ্ছা, এতোদিন যা যা হয়েছে কোনো খবর রেখেছো? দেশ ছেড়ে কি একেবারেই চলে গেছো নাকি?”
“অর্থীর শরীর অনেক খারাপ ছিল। কারো সাথেই যোগাযোগ করা হয়নি তেমন। কেন? কী হয়েছে? ”
মধু প্রহরকে সবকিছু খুলে বললো তরী, সৌহার্দ্য আর অরুণীর ব্যাপার। প্রহর সব শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বললো,
“এক সপ্তাহও হলো না দেশ ছাড়লাম, আর এরই মাঝে এতো কিছু! আচ্ছা, আমি দুই-তিনদিনের মাথায় ব্যাক করছি।”
#চলবে…….
👉👉
Baki porbo gulu plz tara tari den na