#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্ব_৩২
ঘড়ির কাটায় রাত বারোটা! কুয়াশাচ্ছন্ন এই অন্ধকার রাতে বাইরের পরিবেশ অস্বাভাবিক নীরব। সেই নীরবতা ভেদ করে দ্রুত গতিতে গেইট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো আরমান সাহেবের গাড়িটি। সারাজীবন মাঝরাতে বাড়ি ফিরলেও এখন আর বেশি রাত বাইরে থাকেন না তিনি। মনের ভেতর একটা অদ্ভুত ভয় কাজ করে। কেন যেন মনে হয় তার মৃত্যু আসন্ন! তাই যত দ্রুত পারেন, বাড়ি ফেরার চেষ্টা করেন। তবুও দেরী হয়েই যায়!
ড্রয়িং রুমে বসে অরুণী পড়ছে। ইদানীং মেয়েটা নিজের পড়াশোনার বাইরেও অতিরিক্ত বই পড়ে। বিষয়টা চোখে পড়েছে আরমান সাহেবের। তিনি এ ব্যাপারে তেমন মাথা ঘামান না। মেয়েটার জীবন তো তিনি-ই নিজ দায়িত্বে শেষ করে দিয়েছেন! এখন তারা সামান্য ভালো লাগায় হস্তক্ষেপ করার ইচ্ছে নেই তার। সময়ও নেই। আরমান সাহেব নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।
“এতো রাত করে বাড়ি ফেরার কী দরকার, বাবা? এমনিতেই তো মৃত্যু পিছু পিছু তাড়া করে বেড়াচ্ছে! কে জানে? কেউ হয়তো তোমার শ*রী*রের সমস্ত র*ক্ত দিয়ে নিজের গা ধোয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে ঘুরছে। বলা তো যায় না!”
আরমান সাহেবের পা থেমে গেল মুহুর্তেই। পুরো শরীর শিরশিরিয়ে উঠলো যেন! মৃ*ত্যু! শব্দটা অদ্ভুত ভ*য়ং*ক*র। আর নিজের মেয়ের হাতে প্রাণ যাওয়াটা তো আরো বেশি মা*রা-ত্ম*ক! না, এটা ঘটতে দেওয়া যাবে না। অরুনীর দিকে তাকালেন তিনি। মেয়েটা কেমন শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! অরুণীকে তো তিনি জানাননি কিছুই! সে এখনও জানে না যে, তার মায়ের খু*নী তার-ই প্রিয় বাবা। কিন্তু এখন অরুণীর কথা গুলো আরমান সাহেবের গায়ে কা*টা দিয়ে উঠছে। তিনি কিছু মুহুর্ত ভাবলেন। নিজের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তাকে সূক্ষ্মভাবে কাজে লাগালেন। চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন,
“আমাকে ধ্বংস করা এতো সহজ না। আমার দিকে হাত বাড়ানো মানে আ*গু*নে ঝাপ দেওয়া। আর অরিত্রী সেটাই করেছে। এখন ওকে পু*ড়*তে হবে। জ্ব*লে, পু*ড়ে ছা*র-খা*র হয়ে যাবে ও।”
অরুণী শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“ও তো তোমার মেয়ে, বাবা! ওর ক্ষতি কীভাবে করবে তুমি?”
“যেভাবে ও আমাকে শেষ করার কথা ভাবছে, ঠিক সেভাবে! অরিত্রীকে ম*র*তে হবে, এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”
অরুণী অবাক চোখে তাকালো তার বাবার নি*ষ্ঠু*র সত্তার দিকে। বললো,
“নিজের মেয়েকে মে*রে ফেলবে তুমি? কীভাবে এটা করতে পারবে তুমি, বাবা?”
আরমান সাহেব অদ্ভুত হাসি দিলেন। বললেন,
“মা*র*বে তো তুমি! আমি শুধু ছক কষবো।”
অরুণীর বিস্ময় বাড়লো যেন। অবাক হয়ে বললো,
“মানে?”
“মানেটা তো খুব সিম্পেল, মাই ডিয়ার! অরিত্রীকে খু*ন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ওর সাথে লাগতে লেগে আমাদের ম*র*তে হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। ওর সাধারণ মু*খো*শে*র আড়ালে লুকিয়ে রাখা রূপটা সবার অজানা থাকলেও তুমি আর আমি সেটা জানি।”
“হ্যাঁ, সেটা জানি। আর জানার পর থেকে ওর বিরুদ্ধে কিছু করার সাহস বা ইচ্ছে আমার নেই। এতো দিন তোমার কথায় অনেক কিছু করেছি। এখন আর কিছু করে নিজের বিপদ বাড়াতে চাই না।”
“করতে হবে। যা যা করেছি, তার জন্য অরিত্রী আমাদের ছাড়বে না। নিজেদের বাঁচানোর জন্য হলেও এবার কিছু একটা করতে হবে। আর এতেই অরিত্রীকে সম্পূর্ণ ধ্বং*স করা সম্ভব! ”
অরুণী সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“কী করতে চাইছো তুমি, বলো তো!”
আরমান রহস্যময় একটা হাসি মুখে বললেন,
“বি*ষ*ধর সাপের বি*ষ দাঁত ভেঙে দিলে সে আর কারো ক্ষতি করতে পারে না। অরিত্রীর ক্ষেত্রেও সেটাই করতে হবে। ওর সবচেয়ে দূর্বল জায়গায় আ*ঘা*ত করতে হবে আমাদের যেন ও মানসিক ভাবে ম*রে যায়।”
“সেটা কীভাবে? ”
“বলবো! বলবো!! ওকে তো নিজ হাতে মে*রে ফেলতে পারবো না, যতই হোক আমার মেয়ে। কিন্তু বাচিয়ে রেখেও মৃত্যু দেওয়া যায়! সবচেয়ে কষ্টকর মৃত্যু। জীবন্মৃত বলে একটা কথা আছে না? অরিত্রীকে সেটাই দেবো আমি। ”
৩৮.
বিছানায় মাথা ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে বসে আছে প্রহর। হাতে থাকা কিছু কেসের ফাইলে নজর বুলাচ্ছে সে। কিন্তু মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা। কেন যেন সবকিছু এলোমেলো মনে হচ্ছে! ওর অভিজ্ঞ দূরদৃষ্টি বলছে, এই সুন্দর বাস্তবতার আড়ালে একটা কুৎ*সি*ত সত্য আছে। ওর সব জানা সত্যের পেছনে অজানা কিছু বাস্তবতা আছে। একটা ভ*য়ং*ক*র ঝড় ধেয়ে আসছে যেন! সবকিছুতে ধ্বংস করার জন্য এই একটা ঝড়-ই যথেষ্ট। কিন্তু প্রহর এখনো সেটা ধারণা করতে পারছে না যে, ঝড়টা আসবে ঠিক কোন দিক থেকে। মস্তিষ্ক শূন্য শূন্য লাগছে ওর।
ফোনটা ক্রমাগত বাজছে। প্রহর হাত দিয়ে ফোনটা নিয়ে দেখলো মধু কল দিয়েছে। রাত প্রায় দুটো বাজে। এতো রাতে হঠাৎ কী হলো? প্রহরের কপালে ভাজ পড়লো। কল রিসিভ করতেই মধু বললো,
“তিনবার কল করার পর রিসিভ করলে? এতোক্ষণ কোথায় ছিলে, হ্যা? নতুন কোনো প্রেমিকা জুটিয়েছো নাকি?”
প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো,
“এতো রাতে কল করেছো কেন?”
“ঘুম আসছে না এজন্য কল দিয়েছি। কেন তোমার প্রেমে বাঁধা দিয়ে দিলাম নাকি বাসরে?”
প্রহর হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“হ্যাঁ, নতুন প্রেমিকা জুটেছে একটা। প্রেমে আপাতত ভালোই বাঁধা দিয়েছো। বাসরেও দিবে, সেটায় কোনো সন্দেহ নেই!”
মধু মুখ ভেঙিয়ে বললো,
“হুম, আমি তো পুরনো! তাই এখন আমাকে ভালো লাগবে কেন?”
“পুরনো জন-ই নতুন হয়ে ফিরেছে। এজন্যই বললাম নতুন প্রেমিকা। তবে এই উপাধি বেশি দিন থাকবে না। মাধুর্য রায়হান থেকে মিসেস অভীক শাহরিয়ার হয়ে যাবে শীঘ্রই!”
মধু লাজুক ভঙ্গিতে হাসলো। প্রহর সেটা দূর থেকেই বুঝতে পেরে হেসে বললো,
“হয়েছে! তোমার আবার লজ্জাও আছে নাকি! আমার সামনে একটু লাজলজ্জা রেখো। আমি দেখে নিজের চোখ জুড়াতাম!”
“কিসের লজ্জা? তোমাকে আমি বিয়ে করলে তো! আমর বিয়ে করতে দেরী আছে!”
প্রহর অবাক হয়ে বললো,
“আচ্ছা? কত দেরী?”
“এই তো! ছয় বছরের মতো তো লাগবেই!”
“হোয়াট? এতো দিনে আমার চুল-দাড়ি পেকে যাবে। পরে লোকে তোমায় বলবে যে, তোমার বর বুড়ো।”
মধু ভাব নিয়ে বললো,
“যে বলবে, তার নাক ফাটিয়ে দিবো। তুমি তো জানোই আমি কেমন!”
প্রহর অসহায় কন্ঠে বললো,
“এতো বছর বউ ছাড়া থাকবো কীভাবে আমি? সৌহার্দ্যকে দেখেছো? ওর আর আমার বয়স সেইম। ও বিয়ে করে ফেলেছে, ওর বউ আছে। এদিকে আমি এখনও কুমার। তুমি বিয়ে না করতে পারলে সমস্যা নেই। আমি মেয়ে খুঁজছি কালকে থেকে। দাঁড়াও! আমার দ্রুত বিয়ে করতে হবে।”
মধু রাগে ফোসফোস করতে করতে বললো,
“কী বললি? মেয়ে খুঁজবি? অন্য মেয়েকে বিয়ে করবি? কালকে তোকে সামনে পাই! দেখিস কী করি!”
বলেই মধু খট করে কলটা কে*টে দিলো। প্রহর মিটমিট করে হাসছে। এই মেয়ের এতো রাগ! আজও বড় হলো না মেয়েটা। ভেবেই ছোট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রহর।
এদিকে,
তরী সবে মাত্র ঘরে ঢুকলো। এতোক্ষণ দাদী আটকে রেখেছে ওকে। কীসব অকারণ বকবক করে এতোক্ষণ বসিয়ে রাখলো ওকে ভেবেই বিরক্ত হলো তরী! তরীর মনে হয়েছে দাদী উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে ওকে আটকে রেখেছে। ঘুমে চোখ দুটো বুজে আসছে ওর।
ঘরে ঢুকতেই দেখলো পুরো ঘর অন্ধকার। সৌহার্দ্য কখনো ঘর অন্ধকার করে ঘুমায় না। তাহলে এখন অন্ধকার কেন? সৌহার্দ্য কী ঘরে নেই?
চিন্তিত ভঙ্গিতে আশেপাশে তাকালো তরী। কিন্তু কিছু দেখা যাচ্ছে না। চোখ থেকে ঘুম উড়ে গেল মুহুর্তেই। অন্ধকারে হাত দিয়ে হাতড়ে ঘরে আলো জ্বা*লা*তে যাবে এমন সময় পেছন থেকে হলুদ আলোর আভা চোখে লাগলো তরীর। কানে ভেসে এলো,
“আলো জ্বা*লিও না, চাঁদ! আজ তোমার আলোয় আলোকিত হবো আমি। শুধু তুমি, চাঁদ আর প্রকৃতি থাকবে এখানে! সাক্ষী হয়ে।”
-চলবে….
(