প্রণয়ের জলসাঘরে পর্ব -২১

#প্রণয়ের_জলসাঘরে
#পর্বঃ২১ #লেখিকা_রেহানা_পুতুল
শুভ একরাশ বিরক্তি নিয়ে উঠে চলে গেল। আলিশার অসমাপ্ত অংক পড়ে রইল। রয়ে গেল প্লেট ভর্তি নাস্তা। ফ্যালফ্যাল ভেজা আঁখিতে আলিশা শুভ’র যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো।

দুদিন বাদেই আলিশার জন্মদিন পালিত হলো । প্রতি বছরের মতো এবার ও ঘরোয়াভাবে আয়োজন করা হয়েছে। একমাত্র আদরের ছোট মেয়ে আলিশা। ছোটবেলায় সে বাবাকে হারিয়েছে। এতটুকু না করলে মায়ের মনে একরাশ অতৃপ্তি রয়েই যায়। তাই সবাই সবাইর মতো করে তাকে উপহার দিতেও আলসেমি করলোনা।

পিয়াসা উপহার দিল একটি ফ্রেমে বন্ধী ছবি। যেখানে সে ও আলিশা বোনের মতো গলাগলি করে আছে। তার বিয়ের আগে তোলা এই ছবিটা। আলিশা উৎফুল্ল হয়ে গেল তা দেখে। সুইট ভাবি বলে পিয়াসার গালে নিজের গাল ঠেকিয়ে ধরলো আদুরে ভঙ্গিতে।

তার মা নিজের হাতে মেয়ের পছন্দের কেক,পিৎজা,ফিরনি তৈরি করলেন। একমাত্র বড় ভাই আয়মান মাথায় হালকা টোকা মেরে বোনের হাতে পরিয়ে দিল সুন্দর একটি ব্রেসলেট ঘড়ি।

আলিশার এসবে যতই মন ভরুক না কেন,তার হৃদয় জুড়ে অপেক্ষা কাল বিকেলের জন্য। শুভ স্যার কি তাকে আসলেই ভালোবাসে কিনা। এটার উপযুক্ত প্রমাণ হবে কালই। কয়েকদিন আগে কথা প্রসঙ্গে শুভ স্যারকে সে খাতায় লিখে জানিয়েছিল আজ যে তার জন্মদিন ।

পরেরদিন শুভ এলো পড়াতে। তার খালি হাত দেখে আলিশার হৃদয় পাড়ে মেঘনার ঢল নামল। বেজার মুখে চুপচাপ অংক করা শেষ দিল। শুভ ট্যারা চোখে দেখল আজকের নাস্তায় রয়েছে জন্মদিনের কেক।

শুভ সব সময় পড়ানো একেবারে শেষের দিকে এলেই নাস্তা খাওয়া শুরু করে। কারণ অংকের মতো জটিল বিষয়ের সাথে খাওয়া চালানো যায়না।

তাই অংক করা শেষের দিকে এলে,
কাঁটা চামচে কিছুটা কেক গেঁথে নিল একপাশ থেকে কেটে। নরম কামড় বসিয়ে খেতে খেতে দুর্বোধ্য হাসি দিয়ে বলল,
পেষ্টি কেক আমার পছন্দ। কারো জন্মদিন ছিল আলিশা?

আলিশা ফুলে ফেঁপে উঠছে রেগে ।

সেই অভিব্যক্তি শুভ’র দৃষ্টিগোচর হতে মুহুর্ত লাগলনা। শুভ আরেকটু কেক কাঁটা চামচে গেঁথে নিল। চোরাচোখে দুপাশে দেখে নিল বাসার কেউ আছে কিনা। আলিশা মাথা ঝুঁকিয়ে অংক করেই যাচ্ছে। শুভ স্যারের দিকে তার তাকাতেই মন চাচ্ছেনা।

শুভ আলিশার ঠোঁটের সামনে কেকটা এগিয়ে ধরলো। যারই জন্মদিন হোক না কেন কেক খাও। আলিশা নিস্তেজ দৃষ্টি ফেলল শুভ’র চোখে।

শুভ জন্মদিন আলিশা মনি। নাও। হা করো। কেক খাও । আলতো হেসে দিল শুভ।

আলিশা তড়িতেই শুভ’র হাত ধরে কেক খেয়ে নিল। থ্যাংক ইউ স্যার বলে নজর কাড়া শিশুসুলভ হাসি ছড়িয়ে দিল। জিজ্ঞেস করলো আমার উপহার?

সব উপহার কি চোখে দেখা যায়? বলে শুভ পকেট থেকে নীল খামে মোড়ানো একটি চিরকুট আলিশার হাতের মুঠোয় ধরিয়ে দিল। কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।

আলিশা খুশীতে আটখানা হয়ে উঠে। বসা থেকে চেয়ারের উপর উঠে দাঁড়ায়। ব্যাঙের মতো এক লাফে চেয়ার থেকে লাফিয়ে নামে। খরগোশের ন্যায় লাফিয়ে লাফিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। খাম খুলে চিরকুটটি চোখের সামনে মেলে ধরলো। নীল কালির কয়েকটি বাক্য মাত্র। প্রতিটি শব্দ জ্বলজ্বল করে দ্যুতি ছড়াচ্ছে আলিশার মন কুঠিরে। নিবিষ্ট চিত্তে আবিষ্ট হয়ে বার কয়েক পড়ল।

” তোমার আবেগে ভেসে যাওয়ার বয়স। তাই প্রশ্রয় দিয়ে তোমার পড়াশোনার ক্ষতি করতে চাইনা। কারণ ভালোবাসি। আর চাঁদমুখটাকে তাওয়ায় ফোলা রুটি বানিয়ে রেখনা কিন্তু । ভালোথেকো। ”

আলিশা আনন্দে টগবগিয়ে উঠল। বিবশ হয়ে গেল তার টুকরো সাধের অনুভূতিগুলো। প্রতিটি শব্দের উপরে নিজের অধর বুলিয়ে নিলো মসৃণ করে। জামা ফাঁক করে বুকের ভাঁজে চিরকুটটি রেখে দিল সযতনে। নিজে নিজেই পাগলের মতো শুভকে বকতে লাগল। ভেংচি কাটতে লাগল ঠোঁট বাঁকিয়ে।

রাতে খেয়ে আলিশা তাড়াতাড়ি শুয়ে গেল। মনের ভিতর উড়ন্ত সুখের ঝাঁপি নিয়ে, ফেসবুকে গেলো।
ক্লাস ফ্রেন্ড মনিকে ফেসবুকে মেসেজ দিল।
” হাই দোস্ত। আমারতো সেরে গিয়েছে রে। ”

মনি অনলাইন ছিল। উৎসুক হয়ে রিপ্লাই দিল,

” কি সেরে গিয়েছে বান্দর মাইয়া?”

” আরেহ মনি। আমিতো বাকুম বাকুম পায়রা এখন। ট্রিট দিও সিস। কোন রক্ষা নাই। ”

” এই আইলসা? আই মিন শুভ স্যার তোর প্রেমে কুপোকাত হয়েছে? ”

” ইয়েস ডার্লিং। আই হোপ তোমাকে বেট ধরার কথাটা মনে করিয়ে দিতে হবেনা? ”

” এই চুমু খেয়েছে স্যার তোকে? প্রেমের প্রথম সোপান হলো চুমু খাওয়া। এই স্তর অতিক্রম করেছিস আইলসা?”

” ওই মনি মুক্তা। আমি কি তোর মতো লুচু মেয়ে নাকি? আমি এসব চাইনা। শুধু মন চাই মন। ”

” ওহে বালিকা। প্লেটোনিক লাভের যুগ এখন খতম। দেখব কত। এনি ওয়ে তুই ও প্রেমে সফলতা পেলি। তাই এই ইচিংবিচিং উড়াধুড়া আনন্দে এক দুপরে ফুচকা ট্রিট দিস।”

” আগে তোর প্রমিজ টা পূর্ণ হোক। দেন দেখা যাবে। আর দেখলি,
বলছিনা শুধু তুইই হাউজ টিউটরের সাথে প্রেম করতে পারিস। আর কেউ পারেনা? কেমন দিলাম। তোকে চিরকুটের ছবি দিচ্ছি দেখ। লিখল টা কি? ”

” আচ্ছা দে। দেখব। রাখি। বাই। টাটা। উম্মাহ!”

কথা শেষ হলে আলিশা প্রণয় সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে খেতে সুখ নিদ্রায় ঢলে পড়ে।

পিয়াসা আচমকা এক দুপুরে ওয়াশরুমে টাইলসের উপরে পা পিছলে পড়ে গেল। উঠে দাঁড়াতেই পারছেনা। গোঙানির শব্দ শুনে রান্নাঘর থেকে বুয়া ছুটে গেল। ধরে দাঁড় করালো পিয়াসাকে। আয়মান কলেজে। আলিশাও তার কলেজে। বুয়া খালাম্মা বলে জোরে ডাক দিলো।

আয়মানের মা ওয়াশরুমের সামনে গেল। চোখ কপালে তুলে উৎকন্ঠার স্বরে বলল,
হায় আল্লাহ! একি ঘটে গেল! আমার রুমে নিয়ে যাও। আমি বরফ পানির ব্যবস্থা করছি। বুয়ার কাঁধে ভর দিয়ে পিয়াসা চলে গেল শাশুড়ীর রুমে। কাঠের চেয়ারে বসল। তিনি বড় গামলার পানিতে বরফের টুকরো দিয়ে নিয়ে এলেন। বুয়া আলিশার পায়ের পাতাকে পানিতে চুবিয়ে ধরলো।

ব্যথায় ওমাগো বলে পিয়াসা আবারও কুঁকিয়ে উঠল। আয়মানের মা বুয়াকে হালকা মেজাজে জিজ্ঞেস করলো,
তুমি এই সপ্তাহে ওয়াশরুম ধোওনি?

খালাম্মা কি যেন কন। পরশু না বাথরুম ধুইলাম।

মা থামেন। আমি আমার ভুলেই পড়ে গিয়েছিলাম।

পায়ের পাতা তুলে ফেল এবার। পানি নরমাল হয়ে গেল। না ফুলে গেলে বুঝতে হবে হাড় ভাঙেনি বা মচকায়নি। তবে রাতে ব্যথা কিছুটা বাড়বে।

তার মা ঘড়ি দেখে আয়মানের ক্লাস শেষ হলে ফোন দিল। জানাল আসার সময় ফার্মেসি থেকে বলে যেন ব্যথা উপশমের ট্যাবলেট নিয়ে আসে।

আয়মান অস্থির হয়ে ছুটে এলো বাসায়। মায়ের রুমে চলে গেল। পিয়াসার পায়ের পাতা চেপে ধরে দেখল। পিয়াসা আঃ বলে মৃদু চিৎকার দিল।

আয়মান শাসনের সুরে বলল,

মন কই থাকে ওয়াশরুমে ঢুকলে? দেখে শুনে চলতে পারনা?

পিয়াসা ও রেগে গেল। আপনার ঔষধ নিয়ে যান। খাবনা। দুই টাকার ঔষধ না আনতেই খবরদারি শুরু হলো। কেউ ইচ্ছে করে নিজের শরীরে আঘাত করে?

আয়মান ঔষধ বুঝিয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। পিয়াসা এখন শ্বাশুড়ির সাথেই ঘুমায়। কারণ ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে শাশুড়ী সুরা পড়ে পিয়াসার পায়ের পাতায় তিনবার ফুঁক দিয়ে দেয়। পিয়াসাও আশাবাদী এতে ব্যথা উপশমে ভূমিকা রাখতে পারে বলে।

পিয়াসা এক সপ্তাহ পরে রাতে নিজের রুমে ঘুমাতে গেল। আয়মান কন্ঠে শীতলতা এনে নিরস ভঙ্গিতে বলল ,
না এলেও চলবে আমার। যেখানে ইচ্ছা সেখানেই ঘুমাতে পার তুমি।

পিয়াসা পিছন থেকে আয়মানের ঘাড়ের দুপাশে আহ্লাদীর মতো পেঁচিয়ে ধরল। টেনে টেনে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করল,
হ চলেতো। শালার মশার জন্য। নয়তো পুরো বাসায় কত জায়গায় ঘুমাতে পারি। থাকতে পারি। আবার চিন্তা করে দেখলাম,
আপনাকে নিঃসঙ্গ বনবাসের জীবন থেকে মুক্তি দেওয়া উচিত।

আয়মান ভিলেনের মতো কুটিল হাসির প্রলেপ বুলিয়ে বলল,
তাইতো আজ রাতে তোমাকে বোঝাব কত ধানে কত চাল।

একদম না বলছি। আমার পা পুরোপুরি সেরে উঠেনি। বেশী মুভ হলেই একটু ব্যথা করে উঠে।

করবেনা। কাছে আস বলছি।

হুম এলাম। কিইই?

জামাইকে কষ্ট দিয়ে কি সুখ পাচ্ছ প্রেয়সী। বলেই আয়মান পিয়াসার লম্বা চুলগুলোকে এক হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরলো। ঘাড়ে আস্তে করে কামড বসিয়ে দিল।

এই বজ্জাত। আমি ব্যথা পাইনি?

পাও। খুব ব্যথা পাও। তাতে আমার কি।
তোমার সকল ব্যথার বিনিময়ে আমি সুখের স্বর্গরাজ্যে অবগাহন করব অবলীলায়। উম্মাদনায়। এক আকাশ স্বাধীনতা নিয়ে। বাধা দেওয়ার সাধ্য আছে প্রেমিকা?

খুউব আছে বলেই পিয়াসা দ্রুত বেরিয়ে গেল রুম ছেড়েই।

আয়মান বেকুবের মতো চেয়ে রইলো দরজার দিকে। তার বাড়া ভাতে পিয়াসা যেন সুখ মনে ছাইঁ ঢেলে দিল। লেখিকা রেহানা পুতুলের গল্পের সাথে যুক্ত হউন।

আজ তিনদিন পর শুভ এলো পড়াতে। গায়ে জ্বর ছিল বিধায় আসতে পারেনি। সেটা আলিশাকে মেসেজে জানিয়েছিল।

তবুও আলিশা মুখ মলিন করে বসে রইলো। তার আবার লজ্জা ও লাগছে এখন শুভর দিকে চোখ তুলে চাইতে। তবুও আড়চোখে চেয়ে দেখল শুভকে। কেমন বিবর্ণ শুষ্ক পত্রের ন্যায় দেখাচ্ছে শুভকে। আলিশা অংকের নিচে কলমের ভাষায় জানতে চাইলো,

স্যার এখন সুস্থ বোধ করছেন? জ্বর সম্পূর্ণ সেরেছে?

আলহামদুলিল্লাহ। সেরেছে। তুমি কেমন আছ?

জানিনা।

যে নিজের বিষয়ে নিজেই উদাসীন। সে বাকি জনের প্রতি কেয়ারিং হবে কিভাবে?

সেটা সময় হলেই দেখা যাবে। যৎ বিচার তৎ সময়।

নাহ! আগেও দেখার অত্যাবশ্যক রয়েছে। এখন একবিংশ শতাব্দী। সুতরাং সবকিছু আগেই যাচাই করে নিতে হবে।

অংক করা শেষ হলে শুভ খাতা এগিয়ে দেওয়ার ছলে আলিশার হাতে মৃদু ছোঁয়া দেয় তার হাতের।

আলিশা চিনাগুড়া লাজুক হাসি হেসে দেয়। শুভ আলিশার হাসির স্রোতে ভেসে যায়। এক সমুদ্র প্রশান্তি নিয়ে বের হয়ে যায় পড়া শেষে।

রাতে আলিশার সাথে ফেসবুক মেসেঞ্জারে অনেক গল্প হয়। শেষে একটা মেসেজ দেয়,

আলিশা আমার সাথে বাইরে একটু দেখা করবে? তোমার সময় সুযোগ মতই আমিও সময় করে নিব। ইনডোর নাকি আউটডোর? কিভাবে দেখা করতে চাও জানাও।

চলবেঃ ২১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here