প্রণয়ের জলসানগরে পর্ব -২৪

#প্রণয়ের_জলসাঘরে
#পর্বঃ২৪ #লেখিকা_রেহানা_পুতুল
পিয়াসা আদুরে বিড়ালছানার মতো আলুথালু হয়ে আয়মানের বুকের ওমে ঢুকে গেল। আয়মানের প্রতি এক দরিয়া ভালোবাসা নিয়ে মিশে গেল নিবিড়ভাবে।

আয়মান ঘুমিয়ে থেকে পিয়াসাকে ভিড়িয়ে নিল আরো নিবিড় আলিঙ্গনে। পিয়াসা ওভাবেই নিদ্রা-ঘোরে ডুবে যায়। এক নিশি পার হয়ে গেলে ভোরেই দুজনের ঘুম ভাঙে।

পিয়াসা উঠে অযু করে নামাজ পড়ে নেয়। কোরান তেলওয়াত করে৷ রান্নাঘরে গিয়ে দেখে কাজে সাহায্যকারী মেয়েটা চলে আসছে। সে রুটি বানিয়ে সেঁকে নিল। পিয়াসা নিজের হাতে সবজি ভাজি করলো। মসলা চা বানিয়ে নিল। আয়মান রোজ নাস্তার পরে এক কাপ কড়া লিকারের চা খেয়েই কলেজে যায়।

নাস্তা খাওয়া শেষ হলে আয়মান বের হয়ে যায়। তার আগে পিয়াসার মাথা টেনে নিত্যদিনের মতো দুচোখের পাতা বন্ধ করতে বলল। পিয়াসা দুচোখ বন্ধ করলে আয়মান মোলায়েম করে দুটো চুমু খায় তার দুই আঁখিপল্লবে।

আপনার অভ্যেস হয়ে গিয়েছে এ কাজটায়। ভুলেও যান না একদিন ও। পিটপিট চোখে চেয়ে হেসে বলল পিয়াসা।

আস্ত তুমিটাই হলে আমার একটি অভ্যাস। তোমার হাতের চা না হলে আমার অতৃপ্তি রয়ে যায় রোজ। এটাও আমার অভ্যাস।

এই যে আমরা দায়িত্ব মনে করে যে কাজগুলো করিই রোজ। এগুলোও কিন্তু আমাদের একরকম অভ্যাস ও বলা যায়। মানুষ অভ্যাসের দাস। অভ্যাস মানুষের দাস নয়। বুঝলে চিনিবউ আমার।

হয়েছে লেকচারারের আর লেকচার শুনতে চাইনা। রান্নাঘরে কাজ আছে আমার। যান বলে পিয়াসা ঠেলাগাড়ির মতো আয়মানের পিঠে ঠেলে দেয় সামনের দিকে৷

আয়মান এগিয়ে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
চিনি বউ আজ রাতে তোমার জন্য স্পেশাল সারপ্রাইজ রয়েছে।

পিয়াসা উতুপুতু ঢংয়ে পা ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে। বলল এই এই পাজি বর। এখন না বললে হতনা এই কথাটা? রাতের সারপ্রাইজ রাতেই দিতেন। উফফস কয়েক ঘন্টা কিভাবে পার করব?

আয়মান ঠোঁটের কোনে ফিচলে হাসির প্রলেপ এঁকে বেরিয়ে যায়৷

পিয়াসা রান্না করছে আর সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করতে থাকে, কি সারপ্রাইজ হতে পারে? এটা কি কোন বস্তু? নাকি উনার নিউ কোন রোমান্টিসিজম। যেহেতু স্বর্গে যাওয়া এখনো বাকি। ভাবনার ছেদ ঘটে শ্বাশুড়ির ডাকে।

বৌমা শুনছ?

হ্যাঁ মা বলেন। রান্নাঘর থেকেই গলা বাড়িয়ে জবাব দিল পিয়াসা।

হাতে সময় থাকলে লাউপাতা দিয়ে নিরামিষ ভর্তা বানাও।

মা সময় আছে। ঝটপট পটাপট বানিয়ে নিচ্ছি। মোটে আমরা চারজন মানুষ মাত্র বাসায়। সব কাজ সেরে অবসর সময় থাকে কত৷

কেন? তোমার পড়াশোনা নেই? শুধু সংসারগিরি করলে চলবে? আমি চাই ভালো রেজাল্ট করে নিজের পায়ে দাঁড়াও৷ বলল পিয়াসার শাশুড়ী।

ওমা!সেদিন বলল দিদা হতে চায়। আজ বলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে। তার মানে সেটা কথার কথা ছিল। মনে মনে বলেই পিয়াসা মুচকি হাসে।

ফ্রিজ থেকে দশটি লাউপাতা এনে ধুয়ে নিল পিয়াসা। পাতাগুলোর আঁশ ছাড়িয়ে সরিষার তেলে ভেজে নিল গ্যাসের অল্প আঁচে। তিন কোষ বড় রসুনের কোয়া ও শুকনো মরিচ ভেজে নিল। তারপরে কাঁচা পেয়াজ কুচি ও বেশী পরিমানে টাটকা ধনিয়া পাতা কুচি দিয়ে সব উপকরণ হাতে ঢলে ভর্তা তৈরি করে নিল।

দুপুরে গরম ভাতের সাথে শাশুড়ী, ননদ খুব মজা করে খেল। আলিশা খেতে খেতে বলল,
ভাবি লাউপাতার নিরামিষ ভর্তা রেসিপি জাস্ট ওয়াও হয়েছে। ইসসস তোমার জামাই মিস করছে।

থ্যাংক ইউ। উনাকে শুক্রবারে বানিয়ে খাওয়াবো।

আচ্ছা ভাবি। তুমি আর কি কি ভর্তা রেসিপি বানাতে পারো?

অনেক রকম পারি। সিম পাতা,মরিচ পাতা,লাল শাক,হেলেঞ্চা শাক, থেকে শুরু করে,মূলা,চিচিঙ্গা, পোটল এমন বহু বহু সবজির বানাতে পারি।

কি বল? মাই গড। আমি এই প্রথম শুনলাম এসব ভর্তার নাম। আম্মু দেখলে ভর্তা বউ আমাদের ঘরে। আচ্ছা তুমি কার কাছ শিখলে?

আমরাতো গরীব ছিলাম। তাই কিছু না থাকলে মা,সৎ মা,খালা নানী,দাদী ধলাই মলাই করে এসবের ভর্তা বানিয়ে নিত। তাই কত মজা লাগতো মুখে আমাদের। কারণ কোন রকম ভাত গিলতে পারলেই হতো।

পিয়াসার সহজ সরল স্বীকারোক্তিক্তে শ্বাশুড়ি ননদ মুগ্ধ হয়ে গেল।

বিকেলে শুভ পড়াতে এলো। আলিশাকে বলল,
সামনেতো তোমার ফাস্ট ইয়ার ফাইনাল পরিক্ষা। আমি পরিক্ষার কয়দিন আসবোনা। শুধু অংকের আগের দিন এসে দেখিয়ে দিয়ে যাব। আলিশা টেবিলের উপর আঙুল নাচাতে নাচাতে বলল, একটা চাওয়া ছিল আমার।

শুভ মুখে কিছুই বললনা। খাতা টেনে নিয়ে লিখে জিজ্ঞেস করলো,
কিই বল ফাজিল বালিকা?

পরিক্ষার আগে বাইরে একদিন আপনার সাথে দেখা করবো।

দেখাতো সপ্তাহে তিনদিন হচ্ছে। আলাদা করে কেন?

আজব তো। আপনার আলাদা করে দেখা করতে ইচ্ছে করেনা আমার সাথে?

অবশ্যই করে। কিন্তু তোমার আইয়ের ফাইনাল শেষ হওয়ার আগে আমি বেশী ঘনিষ্ঠ হতে অপারগ। এটা তোমার ভালোর জন্যই করছি আলিশা। কঠিন স্বরে বলল শুভ।

মার চেয়ে মাসীর দরদ দেখাতে আসবেন না বলছি। আমার পড়াশোনা আমি বুঝিনা স্যার?

নাহ বুঝনা। তোমার জীবনটা এখন জড়িয়ে আছে আমার জীবনের সাথে। তাই তোমার বিষয়ের সব ভাবনা শুধু তোমার একার নয়। আমার ও।

আচ্ছা বুঝলাম। বিরস মুখে লিখে দিল আলিশা।

এইতো কিউট গার্ল বলে, শুভ আলিশার গালে হাতের পিঠ দিয়ে উষ্ণতা বুলিয়ে চলে গেল।

আজ রাতে সবার খাওয়া শেষে পিয়াসা হাতের সব কাজ দ্রুত শেষ করল। সন্ধ্যার পরেই অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশী আকর্ষণীয় করে তুলেছে নিজেকে। কপালের মাঝে পরলো ছোট্ট একটি কালো টিপ। টিপ পিয়াসা পরেনা। যদিও কখনো শখ করে পরে। শুধু কালো টিপটায় পরে নেয়।

সুডৌল অঙ্গে জড়িয়ে নিল গোলাপি একটি নতুন সুতী শাড়ি। সাথে ম্যাচ করা পাতলা গোলাপি ব্লাউজ। অধর রাঙিয়ে নিল পার্পেল কালারের আবরণে। শ্বাশুড়ি দেখে মনে মনে খুশীই হলো। যাক বান্দর দুইটা মিল মহব্বতেই আছে বুঝলাম।

আলিশা সরাসরি জিজ্ঞেস করে বসলো,
কিহে পমত্ত অঙ্গনা। এই রজনী হবে নাকি উতলা? হেব্বি সেক্সি লাগছে তোমাকে।

তুমি এত মুখকাটা নিলজ্জ্ব মেয়ে কেন ? গাল টিপে দিয়ে বলল পিয়াসা।

বারে। সেক্সি মানে সুন্দর। বলছি সুন্দর লাগছে।

পিয়াসা রুমে ঢুকেই আসসালামু আলাইকুম স্যার বলে, আয়মানকে সালাম দিল।

ওয়ালাইকুম আসসালাম। হঠাৎ সালামের উদ্দেশ্য কি?

ওই যে সারপ্রাইজ?

আয়মান আর কিছুই বলতে পারলোনা। আবেশিত নয়নে পিয়াসাকে দেখছে উপর নিচে চোখ বুলিয়ে। লোভাতুর চাহনি দিয়ে পিয়াসার সমস্ত রূপ সুধা লুটে নিচ্ছে।

পিয়াসা খাটের সামনে ঠেস মেরে দাঁড়াল। তিন আঙ্গুলের তুড়ি মারল আয়মানের চোখের সামনে।

আয়মান সম্বিৎ চাইলো পিয়াসার চোখের দিকে। বলল আমার মনে হয় গোলাপি রঙটা তৈরি করা হয়েছেই মেয়েদের পোশাকের উদ্দেশ্য। এত লাবন্যময় একটা রঙ। যার মাথায় এই গোলাপি রং টা আবিষ্কারের বুদ্ধি এসেছে। আমি নিশ্চিত। সে তার বউকে প্রচন্ড ভালোবাসত৷

বকবক করলে হবে কবুতরের মতো? ঘুমাবনা?

অবশ্যই ঘুমাবে। উঠে আস বিছানায় ।

পিয়াসা খাটের উপর উঠে গেল। আয়মানের বাম পাশেই চলে গেল ঘুমানোর জন্য।

আয়মান পিয়াসার কপালের টিপের উপর আঙুল ঘুরিয়ে বলল,কালো টিপ পরলে তোমাকে খুব মায়াবতী লাগে৷

কালো টিপে শাড়িতে যে কোন মেয়েকেই অনিন্দ্য লাগে। শুধু নিজের বউকে লাগেনা।

তুমি আসলে ভিজে যায় আমার গোটা শহর।

ওমাগো! কি আবোলতাবোল কথাবার্তা এসব। চোখ বন্ধ করে মুখ দুইহাতের তালু দিয়ে ঢেকে ধরে বলল পিয়াসা।

এটা একটা কবিতারা লাইন। একক্সট্রেমলি রোমান্টিক না?

জানিনা। পিয়াসা গোপনে সারপ্রাইজের জন্য মুখিয়ে আছে। মনে মনে,
শালা সারপ্রাইজ দেয়না কেন?

আয়মান বালিশের নিচ থেকে একটি সুন্দর কারুকাজ খচিত বাক্স বের করল।
আম্মু বলল, ঘরের বউয়ের কান খালি কেমন দেখায়। পারলে বউকে এক জোড়া রেডিমেড দুল কিনে দিস। যেন সবসময় পরতে পারে। বিয়ের সময় দেওয়া জোড়া ভারি। সবসময় কানে দিয়ে রাখা মানায়না।

পিয়াসা ড্যাবড্যাব চোখে উৎসুক হয়ে আয়মানের হাতের দিকে চেয়ে আছে। প্রাণখোলা হাসি দিয়ে,
আমার জন্য দুল কিনেছেন? মা বলল আর কিনলেন। কেন নিজে দেখেন নি কান যে খালি?

আগে দেখ পছন্দ হয় কিনা। পরে পরিয়ে দিচ্ছি আমি। পিয়াসার হাতে বক্সটা দিল আয়মান।

পিয়াসা বাক্সের ঢাকনা তুলে দুল জোড়া হাতে নিল। শুকনো মাটিতে আছাড় খাওয়ার মতো তাজ্জব হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে নেড়েচেড়ে বার কয়েক দুল জোড়া দেখল।

অবিকল এমন দুল আমার আগে কানে থাকতো সবসময়। আপনি মনে রেখে একইরকম কিনেছেন? নাকি কাকতালীয়ভাবে ডিজাইনটা মিলে গেল? সজল চোখে চেয়ে পিয়াসা জিজ্ঞেস করলো।

আমি কিনিনাই। এটা তোমার কানের দুল জোড়াই চিনি বউ।

ও আল্লাহ! কি বলছেন! কিভাবে সম্ভব! সেই দুল আমি বিক্রি করে দিয়েছিনা? ছলছল চোখে বলল পিয়াসা।

হুম দিয়েছ। সেই টাকা দিয়ে আমি ফের কিনে নিয়েছি বলে, আয়মান সেদিনের ঘটনা খুলে বলল পিয়াসাকে।

পিয়াসা স্তব্ধ হয়ে গেল। ফ্যালেফ্যাল করে কেঁদে ফেলল। এত বড় শ্রেষ্ঠ সারপ্রাইজ আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। যা আমি ক্ষুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারিনি।

ভালোবাসা এত মহান! এত উদার! এত জ্বলজ্বলে! এত সুন্দর! জানা ছিলনা।

খুউব ভালোবাসি। খুউওব। আমার যা আছে সবই আপনার। সব উজাড় করে বিলিয়ে দিতে চাই আপনাকে।
এটা আমার বাবা টাকা ধার করে আমাকে কিনে দিয়েছিল। বাবার শেষ একমাত্র স্মৃতিটুকু আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আজন্ম কৃতজ্ঞতা আপনার প্রতি।

শত কোটি প্রণতি জানাই সেই মাকে। যেই মা আপনার মতো পুত্র গর্ভে ধারণ করেছে। লাখো লাখো শুকরিয়া মহান স্রস্টার প্রতি। যিনি আমার বাবা মায়ের কোন পূণ্যের ফলস্বরূপ আমাকে এই অমরত্বের জীবন দান করেছে।

বলতে বলতে পিয়াসা ছোট বাচ্চার মতো এবড়োখেবড়ো ভাবে আয়মানের সারাগালে, চোখে,কপালে, ঠোঁটে, বুকে মাথা ঝুঁকিয়ে চুমুর পর চুমু খেতে লাগল। বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে বলল,
আপনি বন্ধু আপনি প্রিয়।

তুমি আজ তুমি অনেক খুশী না?

এতটা খুশী আর এতটা বাকরুদ্ধ আনন্দে আত্মহারা আমি। প্রকাশের ভাষা নেই। আমার জীবনকে ধন্য করে দিলেন আপনি।

হয়েছে। অনেক কেঁদেছ। অনেক কৃতজ্ঞতার ভাষা ব্যক্ত করেছে। এবার আমাকে ধন্য কর আমার প্রাপ্য সারপ্রাইজগুলো দিয়ে। আয়মান পিয়াসার কানে দুল জোড়া পরিয়ে দিল।

আয়মান নিজের হাতে পিয়াসার চুলের বাঁধন খুলে নিল। কুচি থেকে শাড়ি খুলে সরিয়ে রেখে দিল। পিয়াসার মুখের উপরে ঝুঁকে অধর দুটো দখল করে নিল। পিয়াসা নাকি নাকি সুরে, কি করবেন? আমার ডর করে।

কি করবো? মিঠাইর হাঁড়ি দখল করব। তারপর সব মিঠাই খেয়ে ফেলল।

চলবেঃ২৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here