#প্রণয়প্রেমিকের_নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০৫
আহিফা ঘুম থেকে জেগে চমকে উঠল। তার পাশে শায়িত আশফিকে দেখে। ভয়ের চটে নিজেকে পরোখ করে দেখে স্বস্তির শ্বাস নেই সে। ভাবল কোনো ইজ্জত হরণ হলো না তো তার! তবে ভাবনাটা নেহাৎ বোকামি! আশফির দিকে তাকায়। ছেলের আইব্রুগুলো বাদামী বর্ণের,মুখের মধ্যে চাপদাড়ি দেখতে বেশ আকৃষ্টময়। আহিফা আফিমের ন্যায় দাড়িতে স্পর্শ করে। মুখটা তার প্রায় কাছে ছিল আশফির। যখন তার আইব্রুতে হাত দেবে, পূর্বেই চট করে চোখজোড়া খুলে যায় আশফির। চকিত দৃষ্টিতে চেয়ে সরতে গিয়েও পারল না আহিফা। আশফি বাঁকা হেসে তৎক্ষণাৎ মেয়ের কোমর জড়িয়ে ওষ্ঠদ্বয় মিলিয়ে নেয়। কয়েক সেকেন্ড পর ছেড়ে দেওয়ায় আহিফা লাফ দিয়ে দু’হাত দূরে চলে যায়। জিভ দিয়ে ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে আশফি হামি দিয়ে আড়মোড়া হয়ে উঠে বসে। বিছানায় হেলান দিয়ে আহিফার দিকে তিক্ষ্ণ সূচালো দৃষ্টি রাখে।
দুষ্টু হেসে বলে,
‘থ্যাংকস প্রিটি ফর মনিং কিস!’
আহিফা মুখ ভেংচি দিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁটজোড়া ঘষতে লাগে সে। মনে কয়েক ডজন বিশ্রী গালিগালাজ করে ডিটারজেন্ট বিহীন ধুয়ে দেয় আশফিকে। ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে পেল নাশতার ট্রে। বিপরীত দিকে আশফি বসে আছে। সিঙ্গেল সোফা খালি! প্রণয়োণীকে দেখে বোকাসোকা হাসি দিয়ে ফকফকে সফেদ দাঁত কেলিয়ে হাতের ইশারায় স্বাগতম জানায়। আহিফা অদেখা করে সিঙ্গেল সোফায় বসতে নেয়। আশফি পাত্তাহীন পা দিয়ে মৃদু পিছু ঠেলে দেয় সোফাকে। ফলস্বরুপ আহিফা আয়েশে বসার ইচ্ছেতে নিচু হতেই ধপাস করে মেঝের উপর পড়ে। আশফি মুখ চেপে হাসি নিয়ন্ত্রণ করল। প্রণয়োণীর নিকট গিয়ে অজানা ভান ধরে বলে,
‘আহুপঙ্খি পড়লে কেমনে! ইশ! ব্যাকসাইড পুরো ভেঙ্গে মনে হচ্ছে। যে হারে চাপ দিয়ে রাখলা তুমি।’
আশফির কথায় চোখ বড় করে তাকিয়ে হাত সরিয়ে নেয় আহিফা। যার ফায়দা তুলে আশফি। শয়তান বুদ্ধির জোড়ে চট করে কোলে উঠিয়ে নেয় তাকে। আহিফা ভেবাচ্যাকা খেল। একদিনে এত কিছু হজম যেন তার সাতকপালের শনি!
আশফি মুখটা বাচ্চাদের মত করে আফসোস প্রকাশে বলে,
‘বলে ছিলাম সাতসকালে আমার কথা অমান্য করলে নেচারালী হার্ট হবে। দেখলে তো আল্লাহ নোউস নেক্সট ওয়াট উইল হ্যাপেন্ড উইড ইউ!’
ভয়ের দৃষ্টিকোণে আহিফা বলে,
‘আ আপনি ইচ্ছে করে ফেলছেন আমায়।’
‘নো নেভার আমি কি কখনো তোমাকে হার্ট করতে পারি!’
দোটানায় পড়ল আহিফা। দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার পরক্ষণে আশফি শুদ্ধভাবে বসিয়ে খেতে আরম্ভ করে তারা। আশফি বেশিরভাগ তার এঁটো আহিফার মুখে পুরে দিচ্ছে। যেথায় রমণীর গোপনে সুপ্ত ভালো লাগা তৈরি হলেও প্রকাশ্যে সে বিরক্তভাব দেখাচ্ছে। আশফি ভাবলেশনহীন পরোটায় মাংসের ঝোল নিয়ে নিজের মুখে নেয়। এর অর্ধভাগ জোরকৃত আহিফার মুখে ঠেলে দেয়। খাওয়া শেষে হাত ধুয়ারত দশায় কল আসল আশফির ফোনে। সুযোগটা লুপে নিতে আহিফা ছুঁ মেরে ফোনটা কানে ধরে এলোথেরাপি বকে গেল।
‘এই যে আপনাদের আক্কেল জ্ঞান নেই! ছেলেটাকে সুদূর ইংল্যাণ্ডে পাঠিয়ে দিলেন। জানেন এসেই আমার পিছু পড়ছে বেহায়া, লাজহীন ছেলে একটারে কেমনে জম্মাইলেন আপনি হে! আপনাকে তো সাতসমুদ্র তেরো নদীতে ডুব দেওয়া উচিৎ।’
আশফি হাত মুছে এসে আহিফার বকনি শুনে থ। তার ফোন মেয়ের কানে দেখে তড়িঘড়ি ফোনটা নিয়ে স্ক্রিনে দেখল ‘লাভলী বাবাই’ লিখা। কপাল চাপড়ে আহিফার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে ফোনটা কানে ধরে, আসসালামুয়ালাইকুম বাবাই’ বলে। শুনে আহিফার দৃষ্টিকোণ লজ্জায় চওড়া হলো। এক মুহুর্ত ব্যয় না করে কেটে পড়ে সেখান থেকে। ইশ! নিজের শ্বশুরবাবাকে কি হারে বকে গেল নামটাও দেখল না। এই নিয়ে নিজের বোকামিতে নিজেকে গালি দিয়ে উঠল আহিফা। আশফির সালাম শুনে আরভীক সাহেব চাপা কণ্ঠে বলে,
‘ওয়ালাইকুমাসালাম বাপ ! এই বুঝি তুই ইংল্যাণ্ডে জরুরি কাজে গিয়েছিস। ফ্রি বকনি তোর মাও শুনায়। আজ যেন হার্টবিট থেমে গেছিল। অন্য মহিলা কেমনে আমারে বকল ভেবে! ভাবলাম না পটিয়ে কোনো মহিলা বকে না। সেখানে ফোনের ওপার থেকে মহিলা পটাহীন চটে গেছে। বিনা আচারনিষ্ঠতায় আমার সন্তানের সঙ্গে আমারো ফালুদা বানিয়ে দিল।’
মিছামিছি কান্নার ভাব ধরে চোখের পানি মুছল আরভীক সাহেব। আশফি মাথা চুলকে মেকি কণ্ঠে আওড়ায়।
‘বাবাই মাম্মাকে বলিও না প্লিজ! কতবছর পর আহুপঙ্খিকে কাছে পেলাম। মাশুল তো ভোগ করতে হবে। আর তুমি তো ওয়াল্ডের বেস্ট বাবাইয়ি।’
‘হ্যা বাপ চাপাবাজি কম মারো। কাজেও ধ্যান দিও। এবার অনুমতি রইল বিয়ে করে বউ নিয়ে নাতী-নাতনীর মুখ দেখাস।’
‘ওয়াও বাবাইয়ি লাভ ইউ।’
‘লাভ ইউ মাই সান।’
‘এই আপনারা কোন মেয়ের কথা বলছেন! কার সাথে আশফির বিয়ে হবে হে।’
আরভীক ও আশফি দুজনেই থতমত খেল। আশফি ঢোক গিলে তৎক্ষণাৎ ফোনটা কেটে দেয়। আরভীক ‘বা বা’ বলতে গিয়েও থেমে যায়। সামনে জোয়ালামুখির ন্যায় ফোঁসছে আনজুমা। পেট বেড়িয়েছে সেই নারী,চুলে মৃদু পাক ধরেছে,মুখের মাঝে সংসারের টানাফোড়নে লাবণ্যতা হারিয়েছে তবুও কোথাও এক মায়া আজও ফুটে আছে সেই চেহারায়! আরভীক সাহেব স্ত্রীর দিকে চেয়েই বলে, ‘অপরুপ’। শুনে যেন আনজুমার হৃদয় দুলিয়ে গেল। সেও তার স্বামীর দিকে নিবিড়ে চাই। চুলের বেশ সংখ্যক সাদা পাক ধরেছে,মুখের মধ্যে কপালে বাধক্যের ভাঁজ সৃষ্টি হয়েছে,ঠোঁটযুগল জামবর্ণের বর্ণায় ছেয়ে গিয়েছে! ইশ লাবণ্য নেই দুজনের মাঝে, আছে খালি মায়া। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
লজ্জায় আনজুমা দৃষ্টি সরিয়ে মুচকি হাসে। আরভীক সাহেব এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘আশফি তার পছন্দের নারীকে পেয়েছে।’
কথাটি শুনে আপ্লুতপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় আনজুমা। খোশমনে বলে,
‘সত্যি আহিফাকে পেয়েছে। ইশ! মেয়েটা এত বুচি বোকা কেন! আমি তখন ছেলের দিকে পাগলপ্রায় হয়ে বলে ছিলাম বলে সেও তার চাচীমাকে ছেড়ে চলে গেল। অথচ দেখো তার যাওয়ার মাস না পেড়োতেই তাকেই খুঁজে কেঁদেকেটেছি। অবশ্য নাইফা ভাবীর সঙ্গে সম্পর্কটাও নড়বড়ে হয়ে গেল সেকারণে। আদাফাত ভাই অত্যন্ত বুঝেন। তিনি স্ত্রীকে বোঝ দিলেও দিনশেষে তাদের সন্তানকে আমিই চলে যেতে বাধ্য করেছি। যার প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য আমি দুঃখে দুঃখে অপেক্ষা করছি। ভেবেই তো রেখেছি গো আহিফা এলে তোড়জোড়ে ছেলের বউ বানিয়ে নিয়ে আসব। দুজনে আমার কারণে কষ্ট পেল। ছেলেটা তো সুস্থ হওয়ার পর টানা চারবছর কারো সঙ্গে হেসেমেতে কথা অব্দি বলেনি। আমার সঙ্গে যে পরিমাণ বান্ধবীর মত কথা বলতো তাও যেন বলেনি। কষ্টে আমিও চেষ্টা করলাম। ধীরেসুস্থে সে ঠিক হলেও আমি জানি গো সে রুম বদ্ধ করে আহিফাকে কয়ে ফেলার বেদনায় কাঁদতো। রাতবিরাতে তার রুম থেকে ফুঁপানোর শব্দে আমি জানালা দিয়ে উকিঁ মেরে দেখেছিলাম। কষ্ট কার না হয় বলুন! এমনই কষ্ট এককালীন আপনায় দিয়ে ছিলাম। যার রেশ আপনি ধরে রাখেননি। তবুও ভুলটা পুনরাবৃত্তি হলো আমার দ্বারা।’
অশ্রুসিক্ত হয়ে তড়াক করে জড়িয়ে ধরে আরভীককে। তিনিও নিঃশব্দে কাঁদতে দেয় তার স্ত্রীকে। জমানো কষ্ট ঝরিয়ে নিলে মন শান্ত হয়,তিনিও চান সব যেন হাতের নাগাল হয়। ছেলে ইংল্যাণ্ড গিয়েছে হয়ত শুভকাজ সেরে তবেই আসবে।
____
রোদ্দুর বিল্ডিংয়ের পেপার বন্ড গুছিয়ে ফাইল আকারে স্ক্যান করছিল। সেসময়ে তার ফোনে ইমু হতে কল এলো। ইমুর কল আসায় সে স্ক্যান মেশিন অন রেখে ফোনটি কানে ধরল।
‘হোয়াট’সআপ ডুড!’
‘সেভেনাপ!’
‘ডুড ডোন্ট বি এংরি ইউ নোউ না।’
‘তাই তো এংরি হতে পারছি না।’ মৃদু হেসে বলে রোদ্দুর। আশফি শুনে গম্ভীর কণ্ঠে শুধায়।
‘শোন সেখানে সব ঠিকঠাক আছে!’
কথাটি শুনে মিইয়ে গেল রোদ্দুর। বহু কষ্টে বিল্ডিংয়ের কাজটি সে সামলে রাখছে। কেননা পাঁচদিন পূর্বেই আশফি জানল তার প্রেয়সী ইংল্যান্ডের কোন শহরে অবস্থিত! জানার পর সে সময় ব্যয় না করে ফ্লাইটের টিকেট বুক করে। কাজটা সে রোদ্দুরকে দেয়। তথাপি বিশ্বস্ত বন্ধু বটে! ভার্সিটি লাইফ থেকে তারা একসঙ্গে আছে। কলিগ হলেও পূর্বপরিচিত। আশফি যাওয়ার পর থেকেই শুরু হলো এলাকার মন্ত্রীশায়িতের দলের হানা দেওয়া। কয়েকমাস পূর্বেও যে বিল্ডিং হাতিয়ে নিতে চাওয়া হয়ে ছিল। তা আশফির কারণে পেরে উঠেনি মন্ত্রীশায়িতের দল। কারণ আশফির শক্তি ও ক্ষমতার কাছে তারা ইদুঁর মাত্র। সিংহের মুখে থাবা মারলে সিংহ দাঁতের আচড়ে খেয়ে ফেলবে স্বাভাবিক!
‘ডুড হোয়াইট হ্যাপেন্ড ইজ এনিথিংক রং!’
আশফির কথায় ধ্যান ফিরে রোদ্দুরের। সে আমতা ভাব নিয়ে বলে,
‘ডুড পেটে ইদুঁর দৌড়ছে। কাজ শেষ করে কুল পাচ্ছি না। আর তুই বলছিস ঠিক আছে কিনা! অভিয়াসলি এভরিথিংক ওকে। ইউ জাস্ট হেভ এঞ্জয়।’
বিনিময়ে আশফি নিশ্চুপ রইল। রোদ্দুর গোপনে শুকনো ঢোক গিলে কারণ তার মন বলছে আশফি বিশ্বাস করেনি তার কথন। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে আশফি বলে,
‘ডুড থ্যাংকিউ সো মার্চ কয়েক মাসের মধ্যেই আমি চলে আসব। তুই সামলে নিস ডুড।’
দীর্ঘ তপ্ত শ্বাস ফেলে সায় জানায় রোদ্দুর। ফোন রেখে পিছু মোড়ে তার বসকে দেখতে পায়। যিনি বয়স্ক হলেও অধীনস্থ মানব। তিনি দুঃখী গলায় আওড়ায়।
‘বাবা মিথ্যে বলে কি ঠিক করলে! আশফি ছাড়া যদি দল এসে আক্রমণ করে। তবে প্রতিহত করার মাধ্যম পাবো না।’
‘উই উইল ট্রাই আওয়ার বেস্ট।’
অন্যদিকে,
ঠান্ডা হাওয়ার মাঝে চুলগুলো নেড়েচেড়ে উঠছে আশফির। বেলকনির মধ্যে দাঁড়িয়ে সূর্যের মুখোমুখি হয়ে কফির মগে চুমুক দেয়। তার মাথায় চিন্তাধারা ঘুরপাক খাচ্ছে। সে জানে রোদ্দুর তাকে মিথ্যে বলছে! কেননা সে এখন খুশির পথে আছে। দুঃখের পথের সীমানা সে নড়বড়ে করে দিতে চাইছে না। ভেবেই তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় আশফি। তবে সে গর্ববোধ করে এককালীন তার বাবার বন্ধুদের মত সেও এক বিশ্বস্ত বন্ধু পেয়েছে। হোক সে বন্ধুগণের মাঝে সর্বদা একজন। বাঁহাত পকেটে গুজে কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে কফিটি রাখল। রেলিং ধরে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে চৌপাশ্ব নজর বুলিয়ে ফোনটি হাতে নেয়। এক ভিডিও ক্লিপ বানাতে আরম্ভ করে। যেখানে তার মুখ নয় বরং বুক থেকে কোমর অব্দি দেখা যাচ্ছে। কার বডি পরখ করা মুশকিল। ভিডিও ক্লিপের মাঝে সে আনমনে বলে,
‘তোরা হিংস্র পশুকে জাগানোর ব্যবস্থা করছিস ফালতু মন্ত্রী কোনখান! তোদের একহাতে খতম করার ক্ষমতা রাখি। ফার্মহাউজের দুয়ার বন্ধ হওয়ায় তোরা শহীদ হতে পারছিস না বলে আফসোস করছিস নাকি! বিশ্বাস কর যদি একবার ফার্মহাউজের দুয়ার খুলে, একটাও জ্যান্ত থাকবি না। কাগজে-কলমে সই করিয়ে দিলাম।’
ভিডিও ক্লিপের সামনে সই করা কাগজটি ফোনের স্ক্রিনে চাপিয়ে ভিডিও অফ করে দেয়। মুহুর্তেই সে ভিডিওটি মন্ত্রীর নাম্বারে পাঠিয়ে দেয়।
‘আপনি কোন ফার্মহাউজের কথা বলছেন!’
কণ্ঠটি শুনে চমকে যায় আশফি। তবে সরাসরি বহিঃপ্রকাশ করল না। স্বাভাবিক, অনড় হয়ে পিছু মোড়ে। শাড়ি পরিহিত শুভ্র নারীকে দেখে যেন তার নেত্রপল্লব মুগ্ধতায় ছেয়ে গেল। পিচ্চি আহিফা ও যুবতী আহিফার মাঝে বিস্তৃত তফাৎ! সেই পেটুক রুপ নেই,লাবণ্যতা যেন মুখশ্রীতে ভেসে উঠছে,ঠোঁটযুগল গোলাপী রঙে আবেশীত,চোখের কালো রঙের মণিতে তাকে অন্য নারীর চেয়েও বেশি আকৃষ্টময়ী লাগছে,শাড়িটি পড়লেও কুচি লাগানো ছিল অশুদ্ধ! যেকোনো সময় খুলে যেতে পারে। দেখে বুঝল তার প্রণয়োণী শাড়ি পরে অভ্যস্ত নয়। গলা খাকড়ি দিয়ে আশফি দুহাত বুকের উপর গুজে বলে,
‘পুরু মাথা নষ্ট করা রুপে হাজির হলে গো! তবে মাথা ব্লাস্ট করার জন্যে তোমার উল্টো কুচিই যথেষ্ট।’
দুই বাক্যের কথার অর্থ যেন আহিফার মস্তিষ্কে বিস্ফোরণ ঘটায়। তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি নামিয়ে দেখে শাড়ির কুচি এলোমেলো হয়ে আছে। পুনঃস্মরণে এলো কোর্স ক্লাসে ক্লাসটেস্ট থাকায় শাড়ির কুচিজোড়া উদরে গুজে ছেড়ে দিয়ে ছিল। পিন বাঁধানোর কথা ভুলে যায়। স্বাভাবিক হেঁটে যাওয়ায় রাস্তাঘাটে সম্মানহানি ঘটল না ভেবেই প্রশান্তির শ্বাস ছাড়ে। কিন্তু লজ্জায় পালিয়ে যেতে নিলে তার হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আশফি। সময়ের অবিলম্বে কুচিজোড়ায় হাত চালিয়ে ভাঁজ করতে হাটুঘেরে বসল সে। শিহরিত হলো আহিফা। আশফি পরম যত্নে শাড়ির কুচিজোড়া ভাঁজ করে উদরের নিকট গিয়ে আড়চোখে আহিফার দিকে তাকায়। মেয়েটি চোখ বুজে গরম শ্বাস ছাড়ছে। যা দেখে আশফির মনশরীর উদগ্রীব উত্তেজনা অনুভব করে। তবুও সে নিজেকে কাঠিন্যরুপে নিয়ন্ত্রণ করে সজোরে উদরের মাঝে কুচিজোড়া গুজে সেফটিপিন বাঁধিয়ে দেয়। আহিফাও সরে দাঁড়ায়। আশফি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে।
‘তুমি এতক্ষণ শাড়ি সামলে ছিলে কি করে! খুলে গিয়ে ছিল!’
‘না খুলে যেতো, যদি না আমি কালো ক্লিফ না লাগাতাম।’
প্রত্যত্তরে আশফি পুনরায় মুখ ঘুরিয়ে চর্তুপাশ্ব দেখতে ব্যস্ত হলো। আহিফার মন খচখচ করছে। সে আজও জানতে চাই আশফি কি তাকে চাই নাকি সেই মেয়েটাকে চাই যাকে সে ভালোবাসে বলছিল! তবে ঐ মেয়েকে চাইলে তার পিছু কেন পড়ে আছে। না এর এক বিহীত করবে।
রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আশফিকে আবেগীয় গলায় প্রশ্ন করে।
‘এত ভালোবাসেন কেনো!’
‘ভালোবাসার মানুষ বলে তবেই বাসি।’
‘যদি একে ভালোবাসা বলে তবে সেদিন কেনো বলছিলেন যে আপনি কাউকে মনপ্রাণে চান!’
আহিফার প্রশ্নে চকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আশফি। অবাকের সহিতে জিজ্ঞেস করে।
‘মানে!’
‘মানে আমি ছয় বছর বয়সে যখন আপনাকে বলে ছিলাম আমি ইংল্যাণ্ড চলে গেলে আপনি কি কাউকে প্রপোজ করবেন! তখন আপনি একশ্বাসে হ্যা বলছিলেন। ভাবছিলেন আমার কেমন লেগেছিল! সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়ে ছিল এই ভেবে যে আমি অন্য নারীর ভালোবাসাকে ভালোবাসতে নিয়ে ছিলাম।’
আশফি নিরর্থক। মিনিট পাঁচেক দৃষ্টি নামিয়ে ফুঁপাচ্ছিল আহিফা। অতীতের কথা ভেবে যেই না চোখ তুলে আশফির পানে চাইল। ক্ষণিকের মধ্যে তার গালে সজোড়ে চড় লাগায় আশফি। চড়ের কারণে তাল সামলাতে না পেড়ে মেঝেতে পড়ল আহিফা। ব্যথার চটে ‘আহ’ করে উঠে। স্বচ্ছ অশ্রুজল সাগরের জোয়ারের ন্যায় বেড়ে গেল তার। চোয়াল শক্ত করে আশফি ত্রপাট ক্রোধে বারদুয়েক দেওয়ালে ঘুষি দেয়। হাতের গোড়ালি রক্তে জুবুথুবু হলো আশফির। আহিফা দৃশ্যটি সহ্য না করতে পেরে আশফির কাছে গিয়ে কান্নামাখা কণ্ঠে বলে,
‘কেন করলেন এমন! দেখলেন কত রক্ত ঝরছে।’
মেয়ের কান্নায় মেজাজ বিগড়ে গেল আশফির। সে তার গাল চেপে ধরে শান্ত কণ্ঠে বলে,
‘তুই আমার পুরু কথা শুনছিলি সেদিন! বল সেদিন তোকে বলতে চাইনি যে কোন মেয়েকে আমি প্রপোজ করব! বল বলিনি তোকে।’
কথাগুলো শুনে ভিজে গলায় ঢোক গিলে আহিফা মাথা উপরনিচ করে। ক্রোধে তার গলায় শক্ত চোয়াল বসিয়ে দেয় আশফি। ‘আহ্হ’ করে চিৎকার দিয়ে তাকে ঠেলে দূর করতে চাইল। কিন্তু পেরে উঠল না। চোখের অশ্রুজল যখন গলায় পৌঁছায় তখন আশফি রক্তচুষে কোমর জড়িয়ে তার কোলের উপর বসিয়ে নেয় আহিফাকে। সে চোখ নামিয়ে ব্যথার কারণে ফুঁপাচ্ছে আর হিঁচকি তুলছে। শরীরও মৃদু কাঁপছে তার। আশফি ব্যথাতুর গলায় আহিফার রক্তভেজা গলায় হাত ছুঁয়ে বলে,
‘একবারো জিজ্ঞেস করলি না কে সে মেয়ে যাকে আমি প্রপোজ করব! একবার বলে দেখতি সাত জমিনের মাঝে তোকেই আমি চাইতাম। সেই না বলা কথার রেশ ধরে তুই আমাকে এতটা কষ্ট দিলি প্রণয়োণী। তোর কি উচিৎ ছিল না আমাকে বলে দেখার! নাকি কেউ তোকে উস্কে ছিল আমার চরিত্র নিয়ে।’
কথাগুলো শুনে বিমূঢ় একরোগা দৃষ্টিকোণে চাইল আহিফা। শুদ্ধ শুভ্র পুরুষের অসহায় মুখখানির দিকে গভীর নেত্রপল্লব ফেলে। তবে আকস্মিক আশফি সরিয়ে দেয় আহিফাকে। দুজনে দাঁড়িয়ে যায় কিন্তু উপেক্ষা করে প্রস্থান করে আশফি। আহিফা থামাতে গিয়েও পারল না। এক অদৃশ্য সংকোচে সে মিইয়ে গেল। ঠোঁট চেপে নিজে ধীক্কার জানায়। হাটুমোড়ে কান্না করতে থেকে আপন মনে নিজেকে বলে,
‘এই কি করলি তুই আহিফা! নিজের প্রিয়তমকে না জেনে, না বুঝে বিচার করে ফেললি। সামান্য কথার তাগিদে আমি জার্জ করলাম। অথচ মানুষটা নিঃস্বার্থভাবে প্রণয়ে জড়িয়ে গেল প্রতিমুহূর্ত। আমি কেমনে সে মানুষের মুখোমুখি হবো! না যদি না হই তাহলে তো হারিয়ে ফেলব। বাইশটা বছর কষ্ট কেটেছে। শুধু মনে পড়েছে আশফির বাচ্চামো,পাগলামিগুলো। না তাকে বলে দেব আমিও ভালোবাসি।’
চোখের পানি মুছে সে তড়িঘড়ি ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। ফ্রেশ হয়ে সুন্দর পরিপাটি হবে তৎপরতায় যেন তার লজ্জা লাগছে। আজ সে ব্যক্ত করবে মনের অব্যক্ত কথন!
আশফি টিকেট কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছে। সে চাইলে অনলাইনে বুক করতো। তবে তার হৃদয়ের জ্বলন্ত আগুন মেটানোর প্রণয়োণী তাকে বিশ্বাস করে না জেনে যেন তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে! আত্মহত্যা যেহেতু মহাপাপ সেহেতু কষ্ট হতে বাঁচতে দূরে সরে যাওয়াটাই উচিৎ মাধ্যম।
‘স্যার ইউর টিকেট!’
আশফির ধ্যান ফেরে বাসা থেকে বেরিয়ে ছিল দীর্ঘ দুঘণ্টা হবে। টিকেট পেয়ে সে এক পার্কে গিয়ে বসে। অন্যথায় ফোন তার ডিস্টার্বনেসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফোন বের করে স্ক্রিনে ‘আহুপঙ্খি’ নামটা দেখে রিসিভ করতে গিয়েও করল না। ফোনটা সুইচড অফ করে দেয়। ঠোঁট কামড়ে কান্না নিবারণের বৃথা চেষ্টা চালায়। তথাপি পেরে উঠল না। তার কান্না নিবারণ হওয়ার উত্তম মাধ্যমও যে তার প্রণয়োণী।
আহিফা কলে না পেয়ে আশফির ড্রাইভারকে কল দেয়। তার গাড়ির ড্রাইভারের কল সে টুকে নিয়ে ছিল প্রয়োজনে কাজে আসবে ভেবে!
কল দিয়ে জানতে পারল সাউট ইস্ট পার্কে বসে আছে আশফি। আহিফাকে লোকেশন দিলে সে দ্বিধাহীন চলে যায়।
‘আপনি ইঞ্জিনিয়ার আশফি ফাওয়াজ রাইট!’
মেয়েলি বাংলা কণ্ঠের অধিকারী মানবী কে দেখে ভ্রু কুঁচকায় আশফি। মেয়েটি হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করার তাগিদে অপেক্ষা করে। কিন্তু ভদ্রতার কাতিরে হাত বাড়িয়ে পুনরায় ফিরিয়ে ভদ্র কণ্ঠে ‘আসসালামুয়ালাইকুম’ বলে আশফি। মেয়েটি মৃদু হেসে সালামের জবাব দিয়ে বলে,
‘আপনি ইংল্যাণ্ডে ইন্টারেস্টিং! এখানে কিসের জন্যে আসছেন!’
‘নান অফ ইউর বিজনেস!’
বিরক্তসূচক ভাব নিয়ে আশফি চলে যেতে নেয়। মেয়েটি মন খারাপ করে ফেলে তবুও উচ্চ আওয়াজ লাগিয়ে বলে,
‘স্যার আই ওয়ান্ট টু লাভ কানেকশন উইড ইউর ব্রাদার আজীব ফাওয়াজ। প্লিজ কন্টাক্ট নাম্বার দেন।’
থমকে যায় আশফির পা। মনে হলো সে তার কানে ভুল শুনেছে। কোনো মেয়ে তার আজীব ভাইয়ের নাম্বার চাইছে। তাও আবার প্রেমপিরিত করার জন্যে! ব্যাপারটা হাস্যকর বটে। ফিক করে সামনে মৃদু পায়ে হাঁটতে লাগল আশফি।
চলবে……