প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব -১০

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-১০

স্নিগ্ধ এক বিকেল। রোজকার মতো আজ রাস্তাজুড়ে কোলাহল নেই। শুধু রিকশায় করে প্রেম-যুগলদের নিরলস বিচরণ। হসপিটালে সৌহার্দ্যের কাজ আজকের মতো শেষ। এখন কাছের একটা হসপিটালে সেখানকার সিনিয়র কার্ডিওসার্জনের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে সে। মাঝে মাঝেই যেতে হয়। সেই হসপিটালের প্রায় সব কার্ডিও-সা*র্জারিতে সৌহার্দ্য এসিস্ট্যান্ট-সা*র্জন হিসেবে উপস্থিত থাকে। তার এখনো অনেক কিছু শেখা বাকি, জানা বাকি। পেশাগত সা*র্জন হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতে হলে আরও অনেক অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানার্জনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে তাকে।

সৌহার্দ্য গাড়ি থেকে নেমে হসপিটালে প্রবেশ করলো। এই হসপিটালে ঢুকতেই সৌহার্দ্যের ভয় হয় এখন। অরুণী এখানে ইন্টার্নশিপ করছে। যতবার এখানে এসেছে, প্রতিবার-ই হুটহাট দেখা হয়ে গেছে ওর সাথে। যদিও অরুণী কোনো কথা বলার চেষ্টা করেনি। সৌহার্দ্যও নিজের দিক থেকে এগোনোর ইচ্ছে রাখেনি। যা হয়েছে, সবটাই নিয়তি! কারো ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া যাবে না এখানে। সবাই বাস্তবতার শি*কা*র। যদিও সবটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, তবে ভবিষ্যৎমুখী চিন্তাভাবনা নিয়ে এগিয়ে গেলে কষ্টের দীর্ঘশ্বাসগুলো চাপা পড়ে যাবে।

সৌহার্দ্য সা*র্জনদের সাথে মিটিং করলো। এ সপ্তাহে দুটো সার্জা*রি আছে। সৌহার্দ্য একটাতে অ্যাটেন্ড করতে পারবে। কারণ তার নিজের হসপিটালেও ব্যস্ততা বেড়েছে। নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়ে সৌহার্দ্য বেরিয়ে এলো কেবিন থেকে। ক্লান্তি-মিশ্রিত নিঃশ্বাস ত্যাগ করতেই শ্বাস গ্রহণের গতিটা কমে গেল তার। অরুণী সৌহার্দ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। সৌহার্দ্য থমকে গেলেও মুখের স্বাভাবিকতা ঠিক রাখলো।

-“ভালো আছো?”

অরুণী খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো। সৌহার্দ্য চোখের ওপর থেকে চশমা সরিয়ে বললো,

-“বলতে পারছি না। তবে আমি খারাপ নেই, এটা নিঃসন্দেহে বলতে পারি। ”

অরুণী হাসলো। শব্দহীন হাসি! সৌহার্দ্য জিজ্ঞেস করলো,

-“তুমি তো ভালোই আছো, রাইট?”

-“হ্যাঁ, খারাপ না থাকার তো কোনো কারণ নেই! নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছি। যত যা-ই হোক, জীবনটা তো আর ছোট না! সামনে আরো অনেকগুলো দিন পড়ে আছে। যতগুলো দিন এখন পর্যন্ত পাড়ি দিয়েছি, তার থেকেও কয়েক গুন বেশি দিন সামনে পড়ে আছে।”

-“গুড! ভেরি গুড। আই উইশ তোমার আগামী দিনগুলো অসাধারণ সুন্দর হোক। কারো আগমন ভালোবাসায় ভরিয়ে তুলুক তোমার জীবন।”

সৌহার্দ্য আর দাঁড়ালো না। সে বেশ বুঝতে পারছে, অরুণী ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে। ও নিজেও চায় অরুণী সব পিছুটান ভুলে সামনে এগিয়ে যাক। তার নিজের জীবন নিয়ে সে নিজে সন্দিহান থাকলেও, অরুণী ভালো থাকুক।

-“সৌহার্দ্য, আমার তোমাকে কিছু বলার ছিল।”

সৌহার্দ্য পা থামালো। পেছন ফিরে তাকাতেই অরুনী অনুরোধের সুরে বললো,

-“আমি তরীর সাথে দেখা করতে চাই। তুমি কি অনুমতি দেবে তোমার স্ত্রীর সাথে দেখা করার?”

-“চলে এসো নিজের ডিউটি শেষ করে। বাবা ঘুমিয়ে থাকবেন এসময়। আই উইশ সমস্যা হবে না কোনো।”

সৌহার্দ্য কথাটা বলে এগিয়ে যেতে নিলে পুনরায় অরুণীর ডাক শুনতে পেলো।

-“আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাওয়া যায় না?”

অরুণীর নিঃসংকোচ আবদার শুনে সৌহার্দ্য বিব্রত বোধ করলো। অরুণীর দিকে না তাকিয়েই মুখের ওপর বলে দিলো,

-“না। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। আসছি!”

সৌহার্দ্য হনহন করে চলে গেল। একবারও পিছু ফিরে তাকালো না। যদি তাকাতো, তাহলে অরুণীর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া উষ্ণ অশ্রুকণা দেখে তার মন গলতো কি না কে জানে!

সৌহার্দ্য গাড়ি স্টার্ট দিতেই তার মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেল। রহস্যময় হাসি খেলে গেল মুখের প্রতিটা অংশ জুড়ে। গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে আপনমনে হাসতে লাগলো সে। অদ্ভুত মনস্তাত্ত্বিক তৃপ্তিবোধ যেন! এটার কোনো তুলনা-ই হয় না!! নিচু স্বরে বিরবির করে নিজেই নিজেকে বললো সে,

-“ড. সৌহার্দ্য রায়হান, নট অনলি আ গুড কার্ডিওসা*র্জন, বাট অলসো দ্য বেস্ট এক্টর ইনডিড! এতোদিন অভিনয় করে বোর হয়ে যাচ্ছিলাম। ফাইনালি, তোমার দূর্বল জায়গায় আঘাত করতে পেরেছি আমি। নাও জাস্ট ওয়েট এন্ড সি! তোমার মু*খো*শ সবার সামনে এমনভাবে উন্মোচিত হবে যে, তুমি মুখ লুকোনোর জায়গা পাবে না। হা হা হা!”

শব্দ করে পা*গ*লের মতো হাসছে সৌহার্দ্য। কিন্তু হাসি দিয়ে নিজের কান্না গুলোকে আড়াল করে রাখতে ব্যর্থ হলো সে। কারো আ*র্ত*চিৎ*কা*র, বাঁচার জন্য করুন আ*র্ত*না*দ বুকের ভেতরটাকে ক্ষ*ত*বিক্ষ*ত করে তুলছে তার। প্রিয় মানুষগুলোকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার বেদনা বুঝি এতোটাই তী*ক্ষ্ণ হয়?

গোধূলির হরিদ্রাভ আকাশ ধীরে ধীরে নিকষ কালোয় রূপ নিচ্ছে। সৌহার্দ্য বাড়ি ফিরেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। তার ভাবভঙ্গি ঠিকঠাক বোঝা যাচ্ছে না। কেমন যেন থমথমে ভাব!

সুজাতা আর সৌহার্দ্যের দাদী ড্রয়িং রুমে এসে বসলেন। মাত্রই নামাজ শেষ করেছেন তারা। ইদানীং সুজাতার সাথে তার শাশুড়ির সম্পর্ক বেশ ভালো যাচ্ছে। সুজাতা এ নিয়ে মনে মনে তরীর প্রতি কৃতজ্ঞ। মেয়েটা আসার পর থেকেই তার সংসারটা যেন আরো সুন্দর হয়ে উঠেছে।

তরী সুজাতা আর দাদীর জন্য চা বানিয়ে নিয়ে এলো। দাদী সোফায় পা তুলে আয়েশ করে বসলেন। চায়ে চুমুক দিতে দিতে তরীকে বললেন,

-“কী রে, নাতবৌ! খালি আমাদেরই চা খাওয়ালে হইবো? তোর কি কোনো জ্ঞানবুদ্ধি নাই মাথায়? এতো সুন্দর রূপ আর এতো স্বাদের চা! এই দুইটা একসাথে পাইলে তো আমার নাতি দুনিয়ার সবকিছু ভুইলা যাইবো! আর তুই? সারাক্ষণ খালি আমার নাতিটার কাছ থেইকা দূরে দূরে থাকোস!”

তরী অবাক চোখে তাকালো। সে দূরে দূরে থাকবে না তো কী করবে? ঐ ছেলেটার ধারেকাছে ঘেঁষারও ইচ্ছে তার নেই! কেউ কি স্বেচ্ছায় বাঘের সামনে ম*র*তে যায় নাকি? কি অদ্ভুত কথা!!

তরীকে এমন হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে দাদী সুজাতার দিকে তাকিয়ে গুরুতর ভঙ্গিতে বললেন,

-“দেখো, বউমা! আমি তোমারে বইলা দিতেছি। বছর ঘুরতেই যেন আমি কোনো সুসংবাদ পাই। বয়স তো কম হইলো না আমার! তুমিই কও! আমার কি ইচ্ছে করে না নাতির ঘরে একটা পুতির মুখ দেখবার? আচ্ছা, আমার চিন্তা নাহয় না করলা! নিজেদের বয়স যে হুহু করে বাড়তেছে, সেইটা তো একটু ভাববা নাকি?”

তরী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। সুজাতা হাসছেন। বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। এমনসময় কলিং বেল বাজলো। সুজাতা ভ্রু কুঁচকালেন। এই সময়ে তো কারো আসার কথা নয়! হঠাৎ সৌহার্দ্য তড়িৎ গতিতে এসে দরজা খুলে দিলো।

অরুণীকে প্রবেশ করতে দেখে সুজাতা অবাকের শেষ পর্যায়ে পৌছালেন। সৌহার্দ্যের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন,

-“ও এখানে কী করছে, সৌহার্দ্য? ওকে এই বাড়িতে প্রবেশ করার সাহস কে দিয়েছে? তোর স্পর্ধা দেখে আমি অবাক না হয়ে পারছি না।”

সৌহার্দ্য বিরক্ত হলো। মুখ দিয়ে চ্ সূচক শব্দ করে বললো,

-“উফ্, মা! সব কিছু এতো বাড়িয়ে বুঝো কেন তুমি? ওকে আমি কেন আসতে বলবো? ও জাস্ট একবার তরীকে দেখতে এসেছে। দেখেই চলে যাবে। দ্যাট’স ইট! সিম্পেল এই ইস্যুটাকে এতো কমপ্লিকেটেড কেন করছো তোমরা?”

সুজাতা অরুণীর দিকে একবার ফিরেও তাকালেন না। হনহন করে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। অরুণীর গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। তার প্রিয় এই মানুষটা তাকে এতো ঘৃণা করে আজ? সে তো ভাবতেই পারেনি! দাদী অরুণীর কান্নামাখা মুখের দিকে তাকিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। নির্বিকার ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পা ঘুরিয়ে চলে যেতে লাগলেন। অরুণী পেছন থেকে ডাকলো,

-“দাদী, আমি……”

-“আমার কোনো নাতনি নাই। ওর মুখ আর এ জীবনে বাঁইচা থাকতে দেখতে চাই না আমি। এরে কইয়া দেও, ও আমার কাছে ম*রে গেছে।”

দাদী কঠিন সুরে কথাগুলো বলে প্রস্থান করলেন। অরুণী অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। সবাই তাকে অপছন্দ করে, এটা সে জানতো। কিন্তু তাই বলে এতো অবহেলা, এতো ঘৃণা করে, সেটা তার জানা ছিল না। তার বাবা কি তাহলে ঠিকই বলে?

সৌহার্দ্য সবটা দেখে নীরব ভুমিকা পালন করলো। তার কিছুই বলার নেই এখানে। সে জানত, অরুণী এখানে এলে এরকমটাই হবে। আর এরকমটা হোক, এটাই চেয়েছিল সে। ভেবেই তপ্ত শ্বাস ফেললো সৌহার্দ্য। তরীর দিকে ইশারা করে বললো,

-“এই যে, এটাই তরী। আমার বউ। মিসেস সৌহার্দ্য রায়হান।”

পুনরায় তরীর দিকে তাকিয়ে বললো,

-“তরী, মিট উইথ অ……”

তরীর দিকে নজর পড়তেই সৌহার্দ্যের মুখ থেমে গেল। তরী কাঁপছে। সারা শরীর নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না সে। অরুণী তরীর এমন অবস্থা দেখে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্য এগিয়ে গিয়ে তরীকে ধরার আগেই সে জ্ঞান হারালো। লুটিয়ে পড়লো ফ্লোরে। সৌহার্দ্য তরীর কাছে যেতেই সবাইকে চিৎকার করে ডাকতে লাগলো। ওপর দিয়ে তরীকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও সৌহার্দ্যের মাথায় অন্য চিন্তা ঘুরছে। মনে মনে সে নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করলো,

-“অরুণীকে দেখে তরীর এমন অদ্ভুত আচরণের মানে কী?”

-চলবে…..

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here