#প্রণয়_আসক্তি
#লেখিকাঃমাহযাবীন
পর্বঃ০৫
“শুনছেন,আর্শ আর মিমির বিয়েটা এবার দিয়ে দেওয়া যায় না?”
স্বামীর মুখ পানে চেয়ে কথাটি সম্পূর্ণ করেন সানিয়া বেগম।সংবাদ পত্র হতে চোখ উঠিয়ে সানিয়া বেগমের দিকে তাকান আরহান সাহেব।ঠোঁটে একটু হাসি টেনে তিনি বলে ওঠেন,
-মিয়ামির বয়স এখনো বিয়ের জন্য উপযুক্ত নয়।
উত্তরে হতাশ কন্ঠে সানিয়া বেগম বলেন,
-আপনার ছেলের মতিগতি দেখে তো মনে হচ্ছে বেশি দেরি করলে এ বিয়ে আর হবার নয়।
স্ত্রীর কথার উত্তরে চিন্তিত কন্ঠে আরহান সাহেব বলে ওঠেন,
-ভুল বলোনি,সানিয়া।একটি বিষয় যা আমাকে ভাবাচ্ছে তা হলো,এ বিয়ের কথা উঠাবার আগে আর্শ মিয়ামির প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল ছিলো।দুজনের মাঝে একটি সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও ছিলো।কিন্তু তারপরও তাদের বিয়ের কথা উঠার পর পরই আর্শ এ বিয়ের তীব্র বিরোধিতা করলো।আর যখন দেখলো আমরা ওর বিরোধিতা করার পরও বিয়ে ভাঙছি না তখন থেকেই সে মিয়ামিকে উপেক্ষা, অবহেলার করার মাধ্যমে মিয়ামিকে দিয়েই এ বিয়ে ভাঙবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
-জ্বি,ঠিক বলছেন।এসব বিষয় আমিও লক্ষ্য করছি।
-এর কারণ হিসেবে আমার যা মনে হচ্ছে তা হলো, আর্শের হয়তো নিজের জন্যে কোনো মেয়ে পছন্দ করা আছে।
-কি বলছেন এসব!
-অসম্ভব কিছু তো নয়।আজকালকার ছেলে-মেয়ের বেলায় এসব অতি সাধারণ,নয় কি?
চিন্তিত কন্ঠে সানিয়া বেগম বলে ওঠেন,
-জ্বি।
-তুমি বরং আর্শের সাথে কথা বলে দেখ।ওর যদি কোনো পছন্দ থেকে থাকে তাহলে নাহয় আমরা সেই মেয়েকেই মেনে নিবো।
-কিন্তু আমরা মিয়ামির পরিবারে কথা দিয়েছি।সে কথার কি হবে?
-ছেলে-মেয়ের সুখ টাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এবার ব্যথিত কন্ঠে সানিয়া বেগম বলে ওঠেন,
-মিমি বড্ড ভালোবেসে ফেলেছে আমাদের আর্শকে।
স্ত্রীর কথায় একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরহান সাহেব বলে ওঠেন,
-তা আমিও বুঝি।কিন্তু এক তরফা অনুভূতি কখনোই সুখ বয়ে আনে না।আর্শকে জোর করে এ সম্পর্কে বেঁধে দিলে একই সাথে আমাদের দুই সন্তান অর্থাৎ আর্শ ও মিয়ামি উভয়ের সাথেই অন্যায় করা হবে।
আরহান সাহেবের কথা যথার্থ হবার পরও সানিয়া বেগমের হৃদয় পুরছে মিয়ামির কথা ভেবে।যদি সত্যিই আর্শ অন্য কেউকে ভালোবাসে তাহলে এই বাচ্চা মেয়েটি কিভাবে সামলাবে নিজেকে?
!!
সিলেটে ঘুরাঘুরির মধ্য দিয়ে দিনকাল বেশ ভালোই যাচ্ছে বিহানের।সাথে আর্শিরও দিনগুলো সুন্দর যাচ্ছে। বিহানের পাঠানো এতো এতো ছবি দেখার মধ্য দিয়ে সেও সিলেটের সৌন্দর্য উপভোগ করছে।সেই সাথে আফসোসও হচ্ছে তার।এই ভেবে যে,সে ও যদি বিহানের সাথে সিলেটে যাওয়ার সুযোগ পেতো!
এর সাথে সাথে আরও একটি অনুভূতিও রাত-দিন আর্শির মাঝে বাসা বেঁধে বসে আছে।আর তা হলো, দুশ্চিন্তা। “ট্যুরে আল্লাহ না করুক, বিহানের যদি কোনো সমস্যা হয়?” ঠিক এই দুশ্চিন্তার হাত দিয়েই রেহাই মিলছে না তার।
পড়ার টেবিলে বসে ফিজিক্সের কতগুলো প্রশ্নোত্তরে চোখ বুলানোর মাঝেই ফোনে ম্যাসেজ আসার “টুং” শব্দটি কানে আসে আর্শির।চটজলদি ফোনটি হাতে নিতেই দেখে বিহানই ম্যাসেজ দিয়েছে।
“জংগলের ভেতর দিকে যাচ্ছি।ওখানে নেট থাকবে না।রাতে আর ফিরবো না।তাই ম্যাসেজ দিতে পারবো না।”
এতো টুকু একটি ম্যাসেজ দেখেই আর্শির হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেলো।ছেলেটি জংগলের ভেতরে রাত কাটাবে, তার উপর নেটের জন্য একটু খোঁজ খবর টাও আর নেওয়া হয়ে উঠবে না।এসব ভেবেই ভয় ভয় লাগছে আর্শির।চেহারায় চিন্তার ছাপ ফেলে সে ম্যাসেজ দেয়,
-কি দরকার রাতে ওখানে থাকার?
-এটাতে আলাদা মজা।
-কোনো দরকার নেই।যদি কোনো সমস্যা হয়?
-সবকিছুতে এতো ভয় পাইলে জীবনে কিছুই পাবা না।
মন খারাপ হয়ে গেলো আর্শির।ভয়,দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরলো তাকে।ছেলেটিকে আটকানোর সামর্থ্য ও তার নেই।
!!
শহরে সন্ধ্যা নেমেছে।আকাশটা কালচে নীল বর্ণ ধারণ করে আছে।জানালা দিয়ে সেই আকাশ পানে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে মিয়ামি।একই দিনের এক এক প্রহরে এক এক রকম রুপ ধারণ করে আকাশ। আর তার এতো এতো রুপের মধ্যে মিয়ামি পছন্দ করে গোধূলি লগ্নের আকাশ টা এবং ধূসর সন্ধ্যের আকাশ টা।
হটাৎ ফোনে কল আসার শব্দ কানে পৌঁছাতেই আকাশ হতে দৃষ্টি সরিয়ে ফোনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মিয়ামি।ফোনের স্ক্রিনে ‘আর্শি’ নাম টা উঠে আছে।দেরি না করে কলটি রিসিভ করে সে।
-দোস্ত,জলদি নিচে আয়।(আর্শি)
ভ্রু কুঁচকে মিয়ামি বলে ওঠে,
-কেন?
-আরেহ ঘুরতে যাবো।জলদি আয় তো।
-আজ ইচ্ছে নেই আমার।তুই যা।
কিছু একটা ভেবে ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে আর্শি মন খারাপের স্বরে বলে ওঠে,
-ওহ আচ্ছা।ঠিক আছে আমি আর ভাই ই ঘুরি তাইলে।
এ কথাটা শোনা মাত্রই মিয়ামি উত্তেজিত কন্ঠে বলে ওঠে,
-উনিও আছে তোর সাথে?
এবার নিঃশব্দে হেসে আর্শি বলে ওঠে,
-হ্যা,তোর উনিও আছে সাথে।
এতোটা সময় আর্শির পাশে দাঁড়িয়ে ফোন ঘাঁটতে ব্যস্ত হয়ে ছিলো আর্শ।কিন্তু এ কথাটি কানে আসতেই আর্শির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে।
মিয়ামি ঠোঁটে হাসি টেনে উত্তেজিত কন্ঠেই বলে ওঠে,
-আচ্ছা তোরা একটু দাড়া,আমি আসতেছি।
-হো এখন তো আসবিই।
বলেই ফোনটি কেটে দিয়ে আর্শি তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
-দেখছো,মেয়েটা তোমার জন্য কি পরিমাণ পাগল? প্রথমে বললো তার মন ভালো নেই সে নাকি ঘুরতে যাবে না।কিন্তু যখনই শুনলো তুমিও সাথে আছো ব্যাস মূহুর্তেই তার মন ভালো হয়ে গেলো!
উত্তরে বিরক্ত কন্ঠে আর্শ বলে ওঠে,
-তোর এতো পাকনামি করে বলার দরকার কি ছিলো যে আমিও আছি সাথে?
আর্শের এমন কথায় মুহূর্তেই ঠোঁটের হাসি উরে যায় আর্শির।সে নিরাশ কন্ঠে বলে ওঠে,
-কবে যে বুঝবা তুমি! হারানোর পর বুঝলে কিন্তু লাভ হবে না।
উত্তরে আর্শ কিছু বলে না।তার দৃষ্টি ফোনের দিকেই।যেনো সে আর্শির উক্তি শোনেই নাই।
!!
রাস্তার পাশ ধরে মিয়ামি ও আর্শি আগে আগে হাঁটছে। তাদের পেছনেই আর্শ।উদ্দেশ্য এলাকায় নতুন একটি রেস্টুরেন্ট হয়েছে,সেখানে যাওয়া।
হাঁটতে হাঁটতে দু বান্ধবী নানান গল্পে মেতে আছে। অবশ্য গল্পের মাঝেই মিয়ামি বেশ ক’বার পেছন ফিরে আর্শকে দেখে নিয়েছে।আবারও আর্শের দিকে তাকাতেই যাবে ওমনি আর্শ এক হেঁচকা টানে মিয়ামিকে নিজের বুকে টেনে নেয়।আর ঠিক এ সময়ই মিয়ামি যে জায়গায় ছিলো সে জায়গা দিয়ে একটি রিকশা চলে যায়।অর্থাৎ একটুর জন্যে মিয়ামি সে রিকশাটির সাথে বারি খায়নি।হটাৎ কি থেকে কি হয়েছে কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে মিয়ামি চুপটি করে আর্শের বুকে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।রিকশাটি যেতেই আর্শ মিয়ামিকে নিজের বুক থেকে তুলে নিজের সামনে বরাবর দাঁড় করিয়ে রাগী কন্ঠে এক প্রকার চেচিয়ে বলে ওঠে,
-খেয়াল কই থাকে তোমার? হ্যা?রাস্তায় এখনো চলতে শেখো নাই তো রাস্তায় বের হও কেন?চোখ নাই কপালে?রাস্তা ঘাটে অভদ্রদের মতো গল্প জুড়ে দিয়ে চোখ আকাশে তুলে হাঁটতে হয়?হ্যা?রাস্তা গল্প করার জায়গা?
এতোক্ষণ মিয়ামির দিকে তাকিয়ে কথা গুলো বললেও শেষ কথাটি আর্শির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে আর্শ।রাগের ছাপ আর্শের চেহারার নিখুঁতভাবে ফুটে আছে।সেই সাথে তার রাগী কন্ঠস্বরে আর্শি ও মিয়ামি উভয়ই ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছে।আর্শ কিছুটা সময় বিরতি নিয়ে নিজের বোনের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে ওঠে,
-আর একদিনও যদি দেখছি রাস্তায় হাঁটার সময় অযথা কোনো কথা বলতে, খুব খারাপ হবে।
কথাটি বলেই রাস্তার যে পাশে গাড়ি চলাচল করছে তার বিপরীতে মিয়ামিকে দাঁড় করিয়ে মিয়ামির হাত শক্ত করে ধরে আর্শ।আর্শির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
-সাবধানে এই পাশ দিয়ে হাঁটা শুরু কর।আমি পেছন দিয়ে তোর দিকে খেয়াল রাখবো।অমনোযোগী হলে আর কখনো বাইরের মুখ দেখবি না মনে থাকে যেনো।
আর্শি উত্তরে কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।অতঃপর আর্শ মিয়ামির হাত ধরেই হাঁটতে আরম্ভ করে এবং তাদের সামনে আর্শি হাঁটছে।এবার আর কারো মুখে কোনো শব্দ নেই।কিন্তু মিয়ামির মনে যেনো গান বাজছে।প্রেমের গান! বারংবার সে আর্শ ও নিজের হাতের বন্ধনের দিকে তাকাচ্ছে এবং মুচকি মুচকি হাসছে।সেই সাথে ভাবছে ছেলেটা কত খেয়াল রাখে তার দিকে!
চলবে।