#প্রণয়
#পর্বঃ২৯
#তানিশা সুলতানা
দিনগুলো হঠাৎ করেই পরিবর্তন হয়ে গেলে। সব মানুষ গুলোর মধ্যেও চলে এসেছে পরিবর্তন। যেমন বড়মা আগের মতো তানহার সাথে কথা বলে না। সূচক বাড়ির কারো সাথে কথা বলে না। এমনকি তানহার সাথেও না। মধ্যে রাতে বাড়ি ফেরে আবার ভোর সকালের খাবার খেয়েই চলে যায়।
তানহার পাগল পাগল লাগে নিজেকে। লোকটা কেনো পাল্টে গেলো? কেনো কথা বলে না?
অনেক রাত ওবদি জেগে থেকেও তানহা সূচকের দেখা পায় না।
বড়মা আর বড় বাবার সম্পর্কটাও ঠিক যাচ্ছে না। আগের মতো কেয়ার করে না বড় মা বড়বাবার। বড় মা সূচক তোহারও খেয়াল রাখে না। কি খেয়েছে? খেয়েছে কি না কোনো দিকেই মন নেই তার। কেমন যেনো উদাসীন উদাসীন একটা ভাব। সব সময় কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করতল থাকে।
সেদিন রাস্তায় বড় মা একটা কথাও বলে নি। বাড়ি ফিরে সূচক কে শুধু বলেছে “কথা আছে রুমে এসো”
বন্ধ রুমের মাঝে বড় মা বড় বাবা আর সূচকের মধ্যে কি কথা হয়েছে কারোর জানা নেই।
কিন্তু তার পর থেকেই সব কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে।
আজকে একদম স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছে না তানহার। কিন্তু তবুও জোর করে রেডি হয়েছে। কারণ তোহা যাবেই। আর তোহা চলে গেলে তানহা একা বাড়িতে কি করবে?
তার থেকে ভালো স্কুলে গেলেই ভালো হবে। হয়ত মনটা ভালো হবে।
তাজ আজকে কোনো মতেই স্কুলে যাবে না তার পড়া হয় নি। আর স্যার বলেছে যাদের পড়া হবে না তাদের কান ধরিয়ে স্কুলের মাঠে দাঁড় করিয়ে রাখবে। মানসম্মান বাঁচানোর ভয়ে সে বাড়িতেই থাকবে।
তানহা তোহা রেডি হয়ে রুম থেকে বের হয়।
সূচক তমাল আর তাহের খাচ্ছে। দাদিমা ওদের খাবার বেরে দিচ্ছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। তানহা আর তোহা নিঃশব্দে গিয়ে দুটি চেয়ার টেনে বসে পড়ে।
তানহা সূচকের দিকে তাকায়। বুকটা ফেটে যায় তানহার। একটু কথা বললে কি হয়? কেনো কথা বলে না? এখন তাকায়ও না তানহার দিকে। এতোটাই অপছন্দের হয়ে গেছে তানহা।
চোখ দুটো ভিজে ওঠে তানহার। পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছে নেয়। খেতে একদম ইচ্ছে করছে না।
তোহার পাতে দাদিমা আলুভাজি আর রুটি তুলে দিয়েছে। এবার তানহার প্লেটে দিচ্ছে।
তানহা না করবে দিতে
“একদম চুপচাপ খাবারটা শেষ কর।
সূচক নিজের প্লেটের দিকে নজর রেখেই ধমক দিয়ে বলে। সবার খাওয়া থেমে যায়। তানহা আর সূচকের দিকে এক পলক করে তাকায়।
তানহার আর উঠার সাহস হয় না। মাথা নিচু করে চুপচাপ খেতে থাকে।
” দাদু মা কাকিমা কোথায় গো?
তোহা খেতে খেতেই জিজ্ঞেস করে।
“ব্যাংকে গেছে।
তমালের পাতে আরও একটা রুটি দিয়ে বলে মমতা বেগম।
” ব্যাংকে কেনো?
তানহা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে।
“তোর এতোকিছু জানতে হবে কেনো? চুপচাপ খেতে থাক।
সূচক পূনরায় ধমক দিয়ে বলে। তানহার এবার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। একেতে কথা বলে না তারপর যা বলবে তাতেই ধমক। এতো নেওয়া যায়?
” কথাটা তো স্বাভাবিক ভাবেও বলা যেতো।
তমাল চোখ পাকিয়ে বলে।
“হুম বলা যেতো। কিন্তু ও বুঝতো না।
আর কেউ কোনো কথা বলে না। তানহার কান্না পাচ্ছে। আর গলা দিয়ে খাবার নামবে না। তাই উঠে যায়। দুই টুকরো রুটি খেয়েছে শুধু।
ব্যাগ কাঁধে চাপিয়ে চোখ মুছতে মুছতে একদম বাড়ির বাইরে চলে যায়।
তোহা পুরো অর্ধেক রুটি মুখে পুরে পানি দিয়ে গিলে ফেলে।
” বাবা আজকে বেশি করে টাকা দাও। টিফিনে ক্যান্টিনে খাবো।
তোহা হাত ধুতে ধুতে বলে। তমালের হাতে একটা টাকাও নেই। কালকে দোকানের জন্য নতুন মাল কিনে পুরো হাত ফাঁকা। আজকে দোকানে কেনাবেচা হলেই টাকা হবে।
মেয়েকে না ও করতে পারছে না।
তাহের পকেট থেকে দুই টাকা বের করে তোহার হাতে দেয়। আর একশত টাকা সূচকের সামনে রাখে।
তোহা এক গাল হেসে চলে যায়।
সূচক টাকাটা না নিয়েই হাত ধুয়ে উঠে যায়।
🥀🥀
ইদানীং ইমন খুব জ্বালাচ্ছে তোহাকে। যেমন স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে,বাসায় ফেরার সময় পেছন পেছন ঠিক বাড়ি ওবদি চলে আসে।
আজকেও স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তবে আজকে গাড়ি নেই সাথে।
তানহা তোহাকে দেখে এক গাল হেসে এগিয়ে আসে। তানহাও মুচকি হাসে। ইমনকে বেশ লাগে ওর।
“ভাইয়া আপনার কি কোনো কাজ নেই?
তোহা দাঁত কটমট করে বলে।
” আছে তো। তোমাকে বিয়ে করা।
ইমন এক গাল হেসে বলে। তানহাও ফিক করে হেসে ফেলে।
“ভাইয়া বিয়ে পর কিন্তু কাজ করাতে হবে এই অলস টাকে দিয়ে।
তানহা বলে ওঠে।
” তা তো অবশ্যই করাবো। তুলতুলে পটি পরিষ্কার করাবো ওকে দিয়ে।
তোহা নাক সিঁটকায়। তানহা খিলখিল করে হেসে ওঠে।
“গেলাম আমি।
তোহা ইমনের দিকে কটমট চাহনিতে তাকিয়ে স্কুলের ভেতরে ঢুকে পড়ে। ইমন হাতে থাকা এক প্যাকেট তানহার হাতে ধরিয়ে দেয়।
” কি আছে এতে ভাই?
তানহা প্যাকেটটা উল্টে পাল্টে দেখে বলে।
“বিরিয়ানি। দুজনে ভাগ করে খেয়ে নিও। কেমন?
ইমন তানহার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যায়। তানহা বিরিয়ানির দিকে কিছুখন তাকিয়ে থাকে। মনটা আবার খারাপ হয়ে যায়। সূচক তো বিরিয়ানি খেতে খুব ভালোবাসে। অনেক দিন বাড়িতে রান্না করা হয় না। ইসস সূচককে যদি খাওয়াতে পারতো এই বিরিয়ানি। কিন্তু সেটা তো সম্ভব না।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তানহা।
🥀🥀
দুইশত টাকার একটা টাকাও খরচ করে না ওরা। আর ভাগ্যও খুব ভালো ছিলো তাই দোকানের প্রায় অর্ধেক মালাই বিক্রি হয়ে যায়। তমাল দারুণ খুশি। বাজার থেকে গরুর মাংস বাসমতী চাল আর প্রয়োজনীয় সব কিছু কিনে নিয়ে আসে। বাচ্চারা বিরিয়ানি খেতে দারুণ ভালোবাসে। আজকে বিরিয়ানিই হবে।
বিকেলে বাসায় ফিরে তোহা ফোন নিয়ে বসে পড়ে। তমা বেগমের শরীর খারাপ তাই সে শুয়ে আছে। তানহাকে বলেছে বড়মায়ের সাথে রান্নায় সাহায্য করতে।
সাদিয়া বেগম পেঁয়াজ কাটছে। তানহা তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলার সাহস হচ্ছে না। আচ্ছা যদি ধমক দেয়?
চোখে পানি টলমল করছে তানহার।
” বড়মা
তানহা অস্ফুরণ কন্ঠে বলে।
সাদিয়া বেগমের হাত থেমে যায়। কিন্তু তাকায় না তানহার দিকে।
তানহা এবার ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেলে। আরও একটু সাহস করে সাদিয়া বেগমকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তানহার।
“আমার সাথে কথা বলো না কেনো তুমি? জানো কতোটা কষ্ট হয় আমার? আমি কি খুব বেশি ভুল করে ফেলেছি? আমাকে শাস্তি দাও তুমি। তবুও মুখ ফিরিয়ে রেখো না আমার থেকে।
শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে তানহা। সাদিয়া বেগমের চোখেও পানি চিকচিক করছে। তানহার মাথার সাথে নিজের মাথাটা ঠেকায়, হাতের ওপর হাত রাখে।
” বাবু বলেছে তাড়াতাড়ি ফিরবে। বাবা কাকারাও চলে আসবে। মাংস ধুয়ে দে আমায়।
তানহার হাতে চুমু দিয়ে বলেন উনি। তানহার মুখে হাসি ফুটে। বড়মা ভালোবেসেছে ওকে।
“আজকে আমি রান্না করবো। তুমি শুধু বলে দিবা। কেমন?
সাদিয়া বেগম হেসে ফেলে। তানহা কোমরে ওড়না বেঁধে নেমে পড়ে রান্নায়। সাদিয়া বেগমের সাথে গল্প করতে করতে রান্না শেষ করে। পুরোটা একাই করেছে তানহা। সাদিয়া বেগম আজকে অনেকদিন পরে প্রাণ খুলে হেসেছে।
তানহার খুব সাধ জেগেছে সূচককে নিজে হাতে খাবার বেরে খাওয়াবে। দশটা বেজে গেছে। সবাই খেতে বসেছে। কিন্তু সূচক আসছে না।
দীর্ঘ এক মাস পড়ে আজকে বড় মা সবাইকে খাবার বেরে দিয়েছে।
সূচকের জন্য বিরিয়ানি তুলে রেখেছে। তানহা ভীষণ খুশি। কতোদিন পরে সূচক বিরিয়ানি খাবে। কিন্তু লোকটা এখনল আসছে না যে।
সবাই খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। দাদিমা আর তমা বেগমের খাবার রুমেই দিয়ে আসে সাদিয়া বেগম।
তাজকে নিজে হাতে খাইয়ে দিয়েছে। তোহা খাচ্ছে আর তানহার দিকে তাকাচ্ছে।
তানহা খেতে বসে নি। বলে দিয়েছে পরে খাবে।
তমাল তাহের তাজ সবাই খুব প্রশংসা করছে তানহা।
” তোহা তুই কিছু বল?
তানহা একটা ভাব নিয়ে বলে।
“এতো ভাব নেওয়ার কিছু হয় নি। হয়েছে কোনো রকম।
তোহা মুখ বাঁকিয়ে বলে। সবাই নিঃশব্দে হেসে ওঠে। তোহা কখনোই তানহার প্রশংসা করে না।
” তানহা বাবুকে খাবার বেরে দিস তুই। আমি ঘুমতে গেলাম।
সবার খাওয়া শেষে প্লেট গুছিয়ে ধুয়ে সাদিয়া বেগম তানহাকে বলে।
তানহা মাথা নারায়। একটা বই নিয়ে সূচকের রুমে চলে যায়। আজকে চোখে কস্টিপ লাগিয়ে হলেও জেগে থাকবে। সূচকের সাথেই আজকে খাবার খাবে ও। সে যত রাতই হোক আর যতই ঘুম পাক।
চলবে