#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৭ম_পর্ব
মাঠের এক কোনায় দুটো পরিচিত মুখের দর্শন পেতেই তার পা থেমে গেছে। অনল এবং মাহিকে দেখা যাচ্ছে। মাহি মাথা নিচু করে আছে। লাজুক দৃষ্টি তার। ধারা একটু এগিয়ে গেল। লুকিয়ে এক কোনায় দাঁড়ালো সে। তখন ই মাহির মৃদু স্বর কানে এলো,
“অনলভাই, আমি আপনাকে বহুদিন যাবৎ পছন্দ করি, প্রতিবার তোমাকে সাদা কাগজে মুড়েই অনুভূতিগুলো জানিয়েছি। আর প্রতিবার ই প্রত্যাখান করেছো আপনি নিষ্ঠুরভাবে। অনেক সাহস করে তাই সরাসরি ই কথাগুলো বলতে চাই। আবেগ বলুন, ছেলেমানুষী বলুন আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে৷ আপনাকে দেখলেই বুকের ভেতরটা কেমন জানে করে। আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। এই অনুভূতির জোয়ার সামলে রাখা কষ্টকর হচ্ছে। তাই সরাসরি ই বললাম। আপনি কি আমায় একটা সুযোগ দিবে আপনার জীবনে আসার?”
মাহির কথাগুলো শান্তভাবে শুনলো অনল। তার মুখশ্রী বরাবরের মতোই কঠিন, নির্বিকার। মাহির ফর্সা মুখখানা লাল হয়ে গেছে। গোল গালে রক্ত জমেছে। চোখ নামিয়ে রেখেছে সে। কন্ঠ ও জড়ানো লাগছে। অপরদিকে ধারার মনের ভেতর এক অজানা ঘূর্নিঝড় শুরু হলো। এক অস্বস্তি অনুভূতি তাকে ঘিরে ধরলো। এই অনুভূতির উৎস তার জানা নেই। তবে মাহির উপর ক্ষীন ক্ষোভ হলো, মেয়েটা এতোকাল তাকে প্রেমকবুতর বানাতো। তাকে পিয়ন বানিয়ে চিঠি পাঠাতো। অথচ অনল ভাইকে প্রণয় নিবেদনের ব্যাপারটা চেপে গেলো। কতবার তাকে শুধালো অথচ মেয়েটা কিছুই বললো না। ধারার ভালো লাগছে না। খুব অসহনীয় অনুভূতি হচ্ছে তার, কেনো জানা নেই। উপহার দেবার ইচ্ছেটা ম’রে গেলো। চুলোয় যাক উপহার। তার অনলের উত্তর জানার আগ্রহ হচ্ছে। কিন্তু পরমূহুর্তেই অন্তরাত্মা বাধ সাধলো, সে কেনো উত্তেজিত হচ্ছে! মাহি তো প্রিন্স উইলিয়ামকে পছন্দ করে। তাকে মনের কথা বলায় দোষ কি! লুকিয়ে চোরের ন্যায় তাদের কথা শোনা কি খুব দরকার! তবুও যে মনটা আকুপাকু করছে, সব যুক্তিকে হার মানাচ্ছে অবুঝ মন। এমন অনুভূতিটা এই প্রথম হচ্ছে। অনল এখনো নির্বাক সে ঘড়ির দিকে একবার দেখেই হাতদুটো পকেটে পুরলো। ধারা আরোও ভালো করে শুনতে আরেকটু এগিয়ে আসতেই শুকনো খড় শব্দ করে উঠলো। মাহি চমকে বললো,
“ওখানে কেউ আছে হয়তো!”
“বেড়াল হতে পারে, হয়তো মালিকের কাছ থেকে পালিয়ে খাবার চুরি করতে এসেছে”
নির্লিপ্ত স্বরে বলো অনল। বেড়াল, শেষমেশ বেড়াল বললো সে ধারাকে। কথাটা কানে আসতেই মন বিষিয়ে উঠলো। অজানা কারণে সকল আগ্রহ হারিয়ে গেলো। অজানা কারণেই খুব রাগ হলো অনলের উপর। সেখানে থাকার ইচ্ছে হলো না তার। হনহন করে চলে গেলো সেখান থেকে। এর মাঝে ভুলেও গেলো প্লাবণকে উপহার দেবার কথা ছিলো। এদিকে অনল এখনো শব্দ হবার জায়গায় তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটের কোনায় বিচিত্র হাসি উঁকি দিলো। মাহি অধৈর্য্য কন্ঠে বললো,
“উত্তর দিবেন না, অনল ভাই?”
******
ধারা বাড়ি ফিরলো এক রাশ চিন্তা নিয়ে। কোনো মতে একটা রিক্সা ঠিক করে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এসেছে সে। তার মস্তিষ্কে নিউরণগুলো জড়ানো লাগছে। যেনো তাদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। ঘরে প্রবেশ করতেই সুভাসিনী বেগম বললো,
“তুই একা কেনো? অনল কোথায়?”
“তোমার ছেলে খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে”
আনমনেই কথাটা বললো ধারা। ব্যাগটা সোফায় রেখেই ধপ করে বসলো সে। জমজ বি’চ্ছু টিভি দেখছিলো সেখানে। ধারার থমথমে মুখখানা দেখে এশা একটু এগিয়ে এসে বললো,
“ধারাপু তোমার কি পেট খারাপ? নাকি কোষ্ঠ্যকাঠিন্য হয়েছে?”
কথাটা শুনতেই কড়া চোখে তাকালো ধারা। তখন এশা বললো,
“না তোমার মুখটা বাবার মতো লাগছে। সকালে বাবার বাথরুম ক্লিয়ার না হলে এমন ই মুখ বাঁকিয়ে রাখে। বলো তো আশা ইসবগুলের ভুসি গুলিয়ে দিচ্ছে”
“কানের নিচে মা’র’লে মাথায় জমা সব ভূসি বেড়িয়ে যাবে। বে’য়া’দ’প কোথাকার”
বলেই হনহন করে ঘরে চলে গেলো ধারা। এশা কিছুসময় বেকুবের মতো চেয়ে রইলো। তারপর হতাশ স্বরে বললো,
“বুঝলি আশা, মানুষের ভালো করতে নেই। মূল্য ই নেই ভালো মানুষের”
“ঠিক”
আশা সহমত প্রকাশ করলো। তারপর তারা পুনরায় টিভি তেই মনোনিবেশ করলো।
ধারা রুমে পায়চারি করছে। তার চিন্তা এখনো মাঠের কোনায় অনলেই আটকে আছে। অনল ভাই কি তার বিয়ের কথাটা বলে দিয়েছে! তার ভরসা নেই, বলে দিতেই পারে। তখন মাহি তার উপর চটে যাবে, এতোবড় সত্য লুকিয়েছে ধারা। এই ব্যাপারটা ভেবে তার দুশ্চিন্তা বাড়ছে। আবার মনে হচ্ছে এমন টা তো তাও হতে পারে। এমন ও হতে পারে অনল ভাই মাহির প্রম নিবেদনে গলে গেছে। মাহি যথেষ্ট সুন্দরী। গোলগাল মুখ, ছোটখাটো ফর্সা মেয়ে। চোখগুলো কাজলকালো, গোলাপী ঠোঁট, মাজা অবধি সাপের ন্যায় বেয়ে আসা কেশ। কি মিষ্টি গায়, তার সুরেলা কন্ঠের প্রেমিক অনেক। এমন মেয়ে প্রেম নিবেদন করলে যেকোনো পুরুষ গলে যাবে। অনল ভাই ও তো পুরুষ ই। কথাটা ভাবতেই এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো ধারার। আগের চিন্তাগুলো মূহুর্তেই বাস্পায়িত হয়ে গেলো৷ নতুন চিন্তা ভর করলো মস্তিষ্কে, যদি অনল মাহির প্রেম নিবেদনে গলে যায় তবে কি হবে! অদ্ভুত বিষন্নতা ঘিরে ধরলো ধারাকে। এই বিষন্নতার কারণ সে জানে না, সত্যি জানে না_____
*****
অনল ফিরলো সন্ধ্যার পরে। অবশেষে তার ব্যস্ত দিনের অবসান হলো। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে সে ফিরলো ঘরে। জ্যামের কারণে আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে। রিক্সা বসে ছিলো প্রায় আধা ঘন্টা৷ বাড়ি ফেরার তাড়া তো সবাই ই। সারাদিনের সকল ব্যস্ততার ইতি টেনে ঘরে ফেরা। তাই এই সময়ে ইট পাথরের ঢাকায় যানের লাইন হয়। এটাই তো তার চিরচেনা অস্তিত্ব।
ঘরে ঢুকতেই দেখা গেলো পুরো পরিবার বসার ঘরে। মুড়ি পার্টি হচ্ছে। টিভি তে উত্তম কুমারের ছায়াছবি “মৌচাক” চলছে। এই সিনেমাটি জামাল সাহেবের অতিপ্রিয়। যখন ই টিভিতে হয় তিনি সুভাসিনীকে মুড়ি মাখতে বলেন। মুড়ি খেতে খেতে সিনেমাটা দেখেন তিনি। আজ তার সাথে রাজ্জাক, ইলিয়াস, রুবি এবং এশা-আশা ও যুক্ত হয়েছে। ইলিয়াস অনলকে দেখেই বললো,
“বাপ খাবি নাকি?”
“নাহ, তোমরাই খাও”
“তা খাবা ক্যান, তুমি হলে মাস্টারমশাই। তোমাকে দিতে হবে মন্ডামিঠাই। মুড়িমাখা তোমার মুখে রচবে না”
“তোমাদের ই ছেলে, কি করবো! জমিদার রক্ত”
স্মিত হেসে চাচ্চুকে উত্তর দিলো। তারপর সুভাসিনীকে বললো,
“মা পারলে এককাপ চা দিও। মাথা ধরেছে”
বলেই নিজ রুমে চলে গেলো সে। রুমে ঢুকতেই ধারা ছুটে এলো। সে এতোসময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো। অপেক্ষা করছিলো অনলের ফেরার। বিকেল তার কাটলো বিষন্ন। ফলে অনলকে দেখতেই উৎফুল্ল স্বরে বললো,
“তুমি এসে পড়েছো? এতো দেরি হলো যে!”
ধারার ব্যাস্ততায় খানিকটা ভড়কালো অনল। অবাক স্বরে বললো,
“আমার বাড়ি ফেরা নিয়ে তো ইহজীবনে তোকে এতোটা উৎসাহিত দেখি নি। মতলব কি?”
“তুমি সবসময় মতলব খুজো কেনো? একই ঘরে থাকি, চিন্তা হতে পারে না”
“বাবা রে! আমার জন্য ধারার চিন্তা। বেশ বউদের মতো কথা শিখেছিস তো!”
বলেই হাসতে হাসতে ওয়াশরুমে চলে গেলো সে। অন্যদিকে ধারার মনটা ছটফট করছে। বারবার মাহির কথাটা জিজ্ঞেস করতে মন চাইছে। কিন্তু বিব্রতবোধ ও হচ্ছে। অনল ভাই যদি বলে, “তোকে কেনো বলবো! তুই তো এই বিয়েই মানিস না তাহলে অধিকার কিসের”
তখন লজ্জায় আর মুখ দেখাতে পারবে না। মন এবং মস্তিষ্কের এই অসহনীয় দ্বন্দে আর প্রশ্নটি করা হলো না ধারার। ফলে বিকেলের মতো রাতটিও কাটলো অস্থিরতায়______
*****
সকালের সোনালী সূর্য উদিত হবার আগেই ভাঙ্গলো ধারার ঘুম। অবশ্য ঘুম হলে তো ভাঙ্গার প্রশ্ন আসে। তার ঘুম ই হয় নি। শুধু এপাশ ওপাশ করেছে। রক্তিম হয়ে আছে চোখজোড়া। কিছুসময় সিলিং এর ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থেকেই উঠে পড়লো সে। নামায পড়ে দাঁড়ালো বারান্দায়। মৃদু রোদ কোমল ছোঁয়া দিচ্ছে বারান্দায় কোনায় রাখা শিউলি ফুলের টবটিতে। গণিতের মানু্ষের গাছের প্রতি শখটা অবাককর হলেও অনলের গাছ লাগাবার শখ আছে। বারান্দায় ছোট ছোট ফুলের টব ঝুলিয়ে রাখা৷ সকালে এই মিষ্টি গন্ধ নাকে আসলেই মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠে। তবে আজ তেমনটা হলো না। বরং ধারার মাথায় মাহি সংক্রান্ত প্রশ্নই ঘুরতে লাগলো৷
ভার্সিটিতে আজও অনলের সাথেই এলো ধারা। গেট থেকে বহু দূরে থেমে গেলো। তারপর একা একা এলো ভার্সিটিতে। গেট পার হতেই কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে দেখা পেলো মাহির। তাকে অবসন্ন দেখালো। উদাস চোখ তাকিয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া গাছের ফুটন্ত রক্তিম ফুলের দিকে। ধারা ছুটে গেলো তার কাছে। তাকে দেখেই মন খারাপ হয়ে গেলো ধারার। চোখজোড়া ফুলে আছে, ভেজা চোখ, ঠোঁটজোড়া শুষ্ক। বিষন্নতা যেনো তাকে ঘিরেই। কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই বললো,
“আমি আর বেলতলার বাসিন্দা নই ধারা। হাল ছেড়ে দিয়েছি”
কথাটা শুনতেই বেশ অবাক হলো ধারা। তখন মাহি খুলে বললো গতকালের কাহিনী। অনল তার প্রেম নিবেদন বরাবরের মতোই প্রত্যাখ্যান করেছে। ভীষণ নিষ্ঠুরভাবে বলেছে,
“মাহি তোমাকে আমার ভালো লাগে না। তাই মরীচিকার পেছনে ছুটো না। আমি তোমাকে প্রহেলিকার মধ্যে রাখতে চাই না। ক্ষমা করবে এই প্রেম নিবেদন আমি গ্রহণ করতে পারবো না”
তার কন্ঠ ছিলো শান্ত, শীতল। বেশ নিপুন ভাবেই সে জানালো সে মাহিকে পছন্দ করে না। মাহি যখন তাকে পুনরায় শুধালো,
“কেনো? আমার কি সমস্যা?”
তখন স্মিত হেসে অনল বললো,
“এক হৃদয়ে দু নারীর স্থান হয় না”
বলেই সে প্রস্থান করলো। ধারা অবাক নয়নে চেয়ে রইলো। মাহির মুখে কথাগুলো শুনতেই মনের মাঝে জমে থাকা মেঘমেদুর কেটে গেলো। উঠলো প্রসন্নতায় ভরে উঠলো হৃদয়ের অন্তস্থল। আবার পরমূহুর্তেই মাহির ভঙ্গুর হৃদয়ের সমবেদনা জানালো। মাহিকে সান্ত্বনা দিলো। মাহি তাকে জড়িয়ে কাঁদলো বের কিছু সময়। তবে এসবের মাঝে একটা প্রশ্ন ও উঁকি দিলো কিশোরী ধারার মনে, জটিল প্রশ্ন। তাহলো অনল ভাই কাকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছে! প্রিন্স উইলিয়াম ও বুঝি কাউকে পছন্দ করে!
মাহির মন খারাপ ব্যাপারটা বন্ধুমহল মোটেই মানলো না। তারা সিদ্ধান্ত নিলো আজ ক্লাস বাঙ্ক দিবে। সেটাই হলো। এমন কি পড়ুয়া নীরব ও সায় নিলো। আজ তারা ক্লাস করবে না। বন্ধুমহল বাসে করে পৌছালো বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্স এ। পাঁচটা টিকিট কাটলো তারা। সারাদিন হই হুল্লোড়, সিনেমা দেখা, খাওয়া দাওয়ার মাঝেই কাটলো। ফলে আবেগে ভেসে যাওয়া মাহির মনটা কিছুটা হলেও ভালো হলো। মাঝে ধারার মোবাইল বেজেছিলো ঠিক কিন্তু ধারা পাত্তা দিলো না। বন্ধুদের সাথে আনন্দ করে বাড়িতে পৌছালো তখন সন্ধ্যে সাতটা। প্রশ্নের মুখোমুখি হবে জানা তবুও সে ভয় পেলো না। তবে সে তো জানতো না, বাড়িতে নতুন চমক তার প্রতীক্ষায় আছে। যখন প্রবেশ করলো তখন ই দেখলো বসার ঘরে প্লাবণ ভাই বসে আছে। বড়মার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। প্লাবণ ভাইকে দেখতেই গতকালের উপহারের কথা মনে পড়লো৷ সেটা এখনো ব্যাগেই আছে। মাহি আর অনলের কথা ভাবতে ভাবতে উপহারের কথাই সে ভুলে গেছে। ধারাকে দেখতেই প্লাবণ জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন আছো জলধারা?”
“এই তো ভালো, আপনি?”
“জম্পেস। আসো বসো”
ধারাও ব্যাগখানা না রেখেই বসলো। অবশ্য তার দিকে একজন কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তবে এখন তার দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলো ধারা। প্রসন্ন চিত্তে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি কতো দিন পর এলে, এখন তো তোমাকে দেখাই যায় না”
“আসলে সময় ই হয় না। আজ একটা বিশেষ কারণে এসেছি। ভালো হয়েছে তুমিও এখানে আসো”
বলেই একটা সোনালী কার্ড বের করলো ব্যাগ থেকে। সুভাসিনীকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“আগামী শুক্রবার আপনাদের দাওয়াত আন্টি। সবাই আসবেন৷ ছোট চাচ্চু, এশা আশা সবাই। আর বিশেষ করে তুমি জলধারা। সরি ভাবী, আসবে কিন্তু আমার বিয়েতে………#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৮ম_পর্ব
একটা সোনালী কার্ড বের করলো ব্যাগ থেকে প্লাবণ। সুভাসিনীকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“আগামী শুক্রবার আপনাদের দাওয়াত আন্টি। সবাই আসবেন৷ ছোট চাচ্চু, এশা আশা সবাই। আর বিশেষ করে তুমি জলধারা। সরি ভাবী, আসবে কিন্তু আমার বিয়েতে। না আসলে খুব রাগ করবো”
ধারা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো প্লাবণের দিকে। প্লাবণের মৃদু কন্ঠের “ভাবী” ডাকটা মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে অনুধাবন করতে সময় নিলো। এতো মিষ্টি ডাকটাও এতো নিষ্ঠুর হয় আগে জানা ছিলো না ধারার। সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্লাবণের দেওয়া বিয়ের কার্ডটির দিকে। সোনালী বর্ণের কার্ড, বেশ কারুকার্য শোভিত। বর্ডারে লাল রেশম কাপড়ের কারুকাজ। ভেতরটা খুলতেই দেখলো রক্তিম বর্ণে লেখা৷ কনের স্থানটায় সুন্দর ফন্টে লেখা “ইশরাত জাহান স্মৃতি”
সুভাসিনী স্মিত হেসে বললো,
“আলহামদুলিল্লাহ, তা কবে ঠিক হলো?”
“এই তো গত পরশু”
“একটু তাড়াহুড়ো হচ্ছে না?”
“আসলে স্মৃতির বাড়িতে একটু ঝামেলা চলছে, আংকেল আন্টি সামনে হজ্জের জন্য যাবেন। স্মৃতির ও জব ট্রান্সফার হয়েছে। তাই এতো তাড়াহুড়ো”
“তা বউ মা কি পরিবারের পছন্দ না তোমার?”
সুভাসিনীর প্রশ্নে লাজুক হাসি হাসলো প্লাবণ। তার ফর্সা মুখখানা রক্তিম হয়ে উঠলো। পুরুষ মানুষ ও বুঝি লজ্জা পায়। অনল তখন ঠেস মেরে বললো,
“ও কি বলবে মা, আমি বলছি। ভালো ছেলে মুখোশধারী প্লাবণ কলেজ থেকে প্রেম করে। দশ বছরের অধিক সময় হয়ে গেছে। স্মৃতির বাসা রাজী করাতে কতো পাপড় বেলেছে হিসেব নেই। আর কিছুদিন হলে পাপড়ের ফ্যাক্টরি দিতো”
অনলের কথায় লজ্জা যেনো আরোও বাড়লো প্লাবণের। সুভাসিনী হেসে বললো,
“এই ওকে খ্যাপাস না, তাও ভালো ওর বাবা মার টেনশন নেই। মেয়ে পাওয়া এই জমানায় কি কঠিন জানিস! তোর ও ভাগ্য ভালো, ধারাটাকে ধরে বেঁ’ধে আ’ট’কে রেখেছি। নয়তো সারাজীবন তোরও চিরকুমার থাকতে হতো। প্লাবণ তুমি গা মাখিও না। আমরা সবাই যাবো। আর অনল-ধারা হলুদের আগেই চলে যাবে। ভালো বন্ধুর বিয়ে বলে কথা!”
“ধন্যবাদ আন্টি”
বসার ঘরে আনন্দটা যেনো কাটার মতো লাগছে ধারার। কখন চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে টেরটিও পায় নি। দমবন্ধ লাগছে তার। প্লাবণের যে হাসি মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতো সেই হাসিটাই এখন বিষাক্ত সুই এর ন্যায় লাগছে। ধরা কন্ঠে বলে উঠলো,
“বড় মা, আমার মাথাটা ব্যাথা করছে। আমি ভেতরে ফ্রেশ হতে গেলাম”
সুভাসিনীর জবারের অপেক্ষা সে করলো না। সটান উঠে ভেতরে চলে গেলো। অনলের চোখ এড়ালো না ধারার এই আচারণ। প্লাবণের বিয়ের খবরটা শুনতেই উজ্জ্বল মুখখানায় আষাঢ়ের কালো বাদল জমেছে ব্যাপারটিতে একটু হলেও খটকা লাগলো তার।
রুমে এসেই ব্যাগটা ছুড়ে মারলো ধারার। বিষাক্ত নীল বিষাদে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে অন্তস্থল। নরম গালগুলো ভিজে যাচ্ছে সেই বিষাদসিন্ধুর ঢেউ এ। প্রচন্ড কষ্টে হৃদয়টা জ্বলছে যেনো। এতোটা কষ্ট হয় বুঝি হৃদয় ভাঙ্গনে। মাহির অবসন্ন হৃদয়টা যেনো অনুধাবণ করতে পারছে ধারা। সব কিছু ভেঙ্গে গুড়িয়ে ফেলতে মন চাচ্ছে। সেই সাথে প্রচন্ড ক্রোধ জমলো প্লাবণের প্রতি। এতো কাল যদি তার প্রেমিকাই থাকে তবে কেনো ধারার প্রতি এতো মায়া দেখাতো! কেনো তার চুল এলোমেলো করে তাকে ইকলিয়ারস দিতো। সে কি বুঝতো না বাচ্চা মেয়ের মনে আবেগের সঞ্চার হচ্ছে! সে কি সত্যিই বুঝতো না! নাকি বুঝেও অবুঝ সাজতো! প্রতি জন্মদিনে এক দু টাকা জমিয়ে পরম আবেগ মিশিয়ে উপহার কিনতো ধারা। আর সেই উপহার গুলো ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে গ্রহণ করতো এই নিষ্ঠুর মানুষটি। সে কি বুঝতো না, এই কিশোরীর মন তার প্রতি আসক্ত! উপহারের কথা মনে পড়তেই ব্যাগ থেকে এবারের উপহারটি খুললো ধারার। সাদা র্যাপিং পেপারে মোড়া একটি উপহার। গত এক বছরে খুব কষ্টে মাসিক খরচার টাকা জমিয়ে কিনেছিলো ধারা। একটি নীল ঘড়ি, বেশি দাম নয়; তবুও ঘড়িটি ধারার বহু কষ্টে জমানো টাকা দিয়ে কেনা। মূহুর্তেই মস্তিষ্কে জেদ চাপলো। নিজ হাতে ভেঙ্গে গুড়িয়ে ফেললো ঘড়িটি। বো’কা ছিলো সে, তাই তো কিশোরী আবেগের মরিচীকার পেছনে অন্ধের মতো ছুটেছে। বিবাহিত হবার পর ও সেই আবেগ যত্নে তুলে রেখেছে। কিন্তু ঘড়িটি ভেঙ্গেও হৃদয়ের বিদগ্ধ যন্ত্রণা কমলো না। দু হাত চেপে কাঁদলো ধারা। হৃদয়ের কোনায় মূর্ছা যাওয়া প্রণয় ফুলটি আজ ম’রে গেছে, ম’রে গেছে_______
*****
প্লাবণ যাবার পর ঘরে আসলো অনল। ঘরটা নিগূঢ় আঁধারে নিমজ্জিত। নিস্তব্ধতা যেনো ঘিরে রয়েছে। অনল লাইট জ্বালাতেই চমকে উঠলো, খাটের উপর কম্বল মুড়ি দিয়ে ধারা শুয়ে আছে। মেঝেতে ব্যাগটা অবহেলায় পড়ে আছে। তার সাথে পড়ে আছে একটা ভাঙ্গা ঘড়ি এবং অনেকগুলো জ্বলন্ত ছাই। অনেকগুলো কাগজ একসাথে পোড়ালে হয়তো এতো ছাই জমে। অনল কম্বল মুড়ে শুয়ে থাকা ধারার কাছে গেলো। গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“আজ ক্লাস না করে কোথায় গেছিলি?”
কিন্তু উত্তর এলো না। নিস্তব্ধতা, শুধু নিবিড় নিস্তব্ধতা। অনল মুখ গোল করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেয়েটাকে নিয়ে কি করবে সে! কিশোরী মানছে, কিন্তু তাই বলে এতো ছেলেমানুষী করবে! আর এতো কিসের আবেগ! অনল আর বসে রইলো না। উঠে টেবিলের কাছে গেলো। অনেক গুলো খাতা জমেছে, আজ ই দেখে শেষ করতে হবে। সারপ্রাইজ টেস্টের খাতাগুলো জমে আছে। অনল প্রথমে সেগুলোই বের করলো। একের পর এক খালি খাতা দেখতে দেখতে রোল পঁচিশের খাতাটা পড়লো সামনে, “ধারা আহমেদ”। সফেদ খাতার উপর বেশ কিছু কাটাকাটি খেলার ছক আকা। ইকুয়েশন টি একবার তুলে নিচে লেখা,
“শ্রদ্ধেয় অনল ভাই, এইসব ইকুয়েশনের উত্তর আমি জানি না, আমি এই অংক জীবনেও দেখি নি। তুমি যদি আমাকে ১০ মার্কে ৪ দাও আমি কৃতার্থ থাকবো, বিনিময়ে একদিন তোমার ঘর পরিস্কার রাখবো। এখন তোমার ইচ্ছা। না দিলেও কিছু যায় আসে না, ভেবো না পা ধরছি”
অনল আনমনেই হেসে দিলো। খাতার উপরে লাল কালিতে ০ দিয়ে সামনের খাতা দেখতে লাগলো সে। একবার অবশ্য ঘাড় কাত করে ধারাকে দেখলো। এখনো কম্বলমুড়ি দিয়েই শুয়ে আসে, সন্তপর্ণে একটা নিশ্বাস গোপন করলো অনল। কবে বড় হবে মেয়েটা______
*****
পর্দার ফাঁক থেকে গা গলিয়ে সোনালী রোদ রুমে প্রবেশ করতেই ঘুম ভাঙ্গলো অনলের। উঠে বসে আড়মোড়া ভাঙ্গলো। ধারা এখনো ঘুম। গতরাতে বহুবার খেতে ডেকেছিলো। উঠে নি সে। তার মাথা ব্যাথা, তাই খায় নি। অনল অবশ্য একটু চিন্তিত। সন্ধ্যায় বেশ প্রসন্ন লাগছিলো ধারাকে। তাহলে হুট করে এতোটা পরিবর্তন কেনো! কিছু একটা ভেবে ওয়াশরুমে গেলো সে। হাত মুখ ধুয়ে এসে বললো,
“উঠবি না! ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে”
“আমি যাবো না আজ, তুমি যাও”
“কাল ও তো ক্লাস করিস নি”
“ইচ্ছে করছে না অনল ভাই, ক্ষান্ত দাও”
অনল আর কথা বাড়ালো না। রেডি হয়ে বেড়িয়ে পড়লো। যাবার সময় সুভাসিনীকে বললো,
“ধারার শরীরটা ভালো নেই, একটু দেখো”
সুভাসিনী বেগম উদ্বিগ্ন হয়ে গেলেন,
“কি হয়েছে?”
“মন খারাপ হয়তো, ভার্সিটি যাবে না। তুমি দেখো, আর টেনশন নিও না। আমি আজ তাড়াতাড়ি আসবো”
অনল চলে গেলো। সুভাসিনী বেগম কিছু একটা ভাবলেন। তারপর নিজ কাজ করতে লাগলেন।
*********
ধারা উঠলো দেরি করে। মন খারাপ থাকলে ঘুম বেশি আসে তার। তাই সময়জ্ঞান হারিয়ে ঘুমালো আজ। মনটা এখন কিছুটা ভালো। কিন্তু বিষন্নতাটা সম্পূর্ণ কাটলো না। রুম থেকে বের হয়ে ডাইনিং রুমের ফ্রিজের কাছে আসতেই আশা “ও মা” বলে চিৎকার দিলো। ধারাও খানিকটা ভড়কালো। তারপর বিরক্তি নিয়ে বললো,
“চেচাচ্ছিস কেনো?”
“আরেকটু হলেই আমার পরাণ পাখি খাঁচা ছাড়া হতো! এভাবে শা’ক’চু’ন্নি সেজে কে ঘুরে শুনি। নিজেকে দেখেছো আয়নায়! আলিফ লায়লায় সারারাগুল ও ভয় পাবে। ভাগ্যিস দাদাজান ছিলেন না। নয়তো হাসপাতালে ছুটতে হতো”
ধারার ডাইনিং রুমের বেসিনের আয়নার কাছে গেলো। নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজেই চমকে গেলো। মুখখানা ফুলে গেছে, চোখগুলো রক্তিম এবং ফোলা, গতকালের মেকাপ পুরো মুখে লেপ্টে আসে। কাজল গলে চোখগুলো কালো আছে, রক্তিম চোখ বাহিরে কালো বড্ড ভয়ানক দেখাচ্ছে। চুলগুলো কাকের বাসার উপর ঝট লেগে আছে। সত্যি তাকে ভয়ানক লাগছে। যেনো কোনো হরর মুভির নায়িকা, এজন্যই হয়তো সেদিন অনল ভাইও ভয় পেয়েছিলো। আশা ধারার কাছে এসে বললো,
“তুমি নাকি অসুস্থ! কি হয়েছে তোমার ধারাপু? অনল ভাই কিছু বলেছে?”
ধারা উত্তর দিলো না, ফ্রিজ থেকে পানির বোতল নিয়ে নিজ রুমে চলে গেলো। একটু পর গরম গরম পরোটা আর ডিমভাজি নিয়ে রুমে এলো সুভাসিনী। ধারার জট বাধা চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে বললো,
“তোর কি মন খারাপ? কি হয়েছে রে মা আমাকে বল”
ধারা নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। অনুভূতির জোয়ারগুলো মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো। সুভাসিনীকে জড়িয়ে কেঁদে দিলো সে। জড়ানো স্বরে বললো,
“মার কথা মনে পড়ছে খুব”
“ধুর বোকা মেয়ে!”
সুভাসিনী জড়িয়ে ধরলো তাকে। আদর করলেন। মাদের বুকে হয়তো সুপ্ত উষ্ণতা থাকে। যত মন খারাপ ই থাকুক তাদের সংস্পর্শে উষ্ণ শান্তি পাওয়া যায়। সুভাসিনী ধারার চুল বেঁধে দিলেন, খাওয়িয়ে দিলেন। তারপর স্মিত স্বরে বললেন,
“আমাদের জীবনে অনেক কিছু হয়, যাতে আমাদের কোনো হাত থাকে না। কষ্ট হয় ঠিক ই, কিন্তু মেনে নিতে হয়। এই প্রথম তো তাই কষ্টটা বেশি। ধীরে ধীরে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে”
ধারা কথা বললো না, চুপ করে বড় মার কথাটা শুনলো। সময় সবচেয়ে বড় ঔষধ। সময়ের সাথে সাথে হয়তো সত্যি সব ঠিক হয়ে যাবে________
*******
অনল ফিরলো আজ অনেক আগে। বিকালের পূর্বেই সে বাসায় উপস্থিত। ধারার কথা সারাদিন তাকে ভাবিয়েছে। তাই ল্যাব স্যাশন শেষ হতেই আজ চলে এসেছে। বাসায় আসতেই জমজ বি’চ্ছুর দেখা পেলো। অনল তখন জিজ্ঞেস করলো,
“ধারাকে দেখেছিস”
“দেখেছি না, সকালে সারারাগুলের মতো ঘুরছিলো। একটু হলেই আমি পটল তুলতাম, তারপর বড় চাচী গেলেন মানুষের মতো সাজিয়ে গুজিয়ে এসেছেন। তবে এখনো ঘর থেকে বের হয় নি। সত্যি করে বলো তো! তুমি কি করেছো?”
অনল তাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া জরুরি মনে করলো না। ছুটে গেলো ঘরে। ধারা তখন বারান্দার কোনায় বসে ছিলো। অনল শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো,
“রেডি হ, বাহিরে যাবো আজ”
“ইচ্ছে করছে না”
“ভেবে দেখ, আইসক্রিম খাওয়াবো। শুনেছি একটা নতুন আইসক্রিম পার্লার খুলেছে। বেশ মজা নাকি। না গেলে লস তোর। এই সুযোগ সীমিত সময়ের”
ধারা বেশ ভাবলো৷ আইসক্রিম ব্যাপারটা তার দূর্বলতা। কেনো যেনো লোভ সামলাতেই পারে না। চট করেই রাজি হয়ে গেলো।
গোধূলী লগ্ন, সূর্যটা এখন পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। তেজহীন স্বর্ণালী আভা আছড়ে পড়ছে প্রকৃতিতে। দক্ষিণা আকাশে মেঘ জমেছে, কালো মেঘ। বাতাসও বইছে ক্ষণে ক্ষণে। হালকা গরম আছে বটে, কিন্তু শীতল বাতাসে গরমটা গায়ে লাগছে না। আইসক্রিম পার্লারের কথা বলে
দিয়াবাড়ির এ দিকে ধারাকে নিয়ে এসেছে অনল। যদিও এই সময়টা দিয়াবাড়ির সৌন্দর্য্য দেখা যায় না। তবুও ফাঁকা রাস্তায় নিবিড় পরিবেশে হাটতে মন্দ লাগে না। ধারার অবাধ্য খোলা চুল ঊড়ছে মৃদু মন্দা বাতাসে। সোনালী রোদে মুখটা জ্বলজ্বল করছে। ধারার হাতটা অনলের হাতের ফাঁকে। বলা তো যায় না, গাড়ির নিচে পড়ে গেলে। একটা পাঁচটা না একটা মাত্র কিশোরী বউ। স্মিত স্বরে বললো,
“বসবি?”
“হু”
একটা ফাঁকা জায়গায় বসলো তারা। সামনে ধু ধু মাঠ। বাতাস বইছে ধারা তাকিয়ে আছে পড়ন্ত সূর্যের দিকে। তখন ই অনল প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
“প্লাবণকে পছন্দ করতি?”
প্রশ্নটা শুনতেই খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ধারা। ঠোঁট চেপে চুপ করে থাকে। উত্তর দেবার ভাষা খুঁজে পায় না। খানিকটা বিব্রত ও হয়। বেশ কিছু সময় চুপ করে থেকে ধারা প্রশ্ন করে,
“তুমি বুঝলে কি করে?”
“তুই একটা খোলা বই, তোকে বোঝা যে বড্ড সরল”
ধারা আবার চুপ করে গেলো। কোনো কথা নেই দুজনের মাঝে। ধারা তাকিয়ে রইলো দূর অদূরের দিগন্তের পানে। অনল স্মিত হেসে বললো,
“কিশোর বয়সে আবেগ সবার ই হয়। কিছু আবেগ গাঢ় হয় তো কিছু আবেগ সময়ের সাথে বাষ্পের মতো উড়ে যায়। তবে জীবনটা অনেক বড়, এই আবেগগুলোর জন্য নিজেকে কষ্ট দিস না। তোর জন্য সবাই খুব ভাবে”
“তুমিও”
“যতই হোক বউ তো, ভাবতে হয়”
“তুমি পৃথিবীর প্রথম স্বামী হবে যে কিনা বউ এর আবেগ উবে যাওয়ায় তাকে ঘুরাতে নিয়ে এসেছো। আচ্ছা তোমার খারাপ লাগছে না, আমি অন্য কাউকে পছন্দ করতাম শুনে?”
অনল আবারো হাসলো। বিচিত্র হাসি। গোধূলী লগ্নে এই হাসিমুখটা যেনো সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর লাগছে। ধারা খেয়াল করলো অনল স্বাভাবিক ভাবে হাসলে খুবই সুন্দর লাগে তাকে। গোমড়া মানুষের হাসি বুঝি একারণেই সুন্দর। বা হাত দিয়ে ধারার অবাধ্য চুলগুলো গুজে দিলো সে কানের কাছে। তারপর পরম স্নেহজড়ানো কন্ঠে বললো,
“কারণ আমি জানি আমার বউটি ছেলেমানুষ”
অনলের এমন আচারণ বড্ড অবাক করলো ধারাকে। তার কন্ঠের বলা কথাটা বুকে যেয়ে লাগলো যেনো। লজ্জা এসে ভর করলো সমস্ত শরীরে। সে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। বেসামাল অনুভূতি হচ্ছে তার। অনল হাত সরিয়ে নিলো। আবারো চুপচাপ। নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলো এবার ধারা। ইতস্তত গলায় বললো,
“আচ্ছা তোমার কাউকে কখনো ভালো লাগে নি? মানে প্রেম আরকি?”
অনল উত্তর দিলো না। বরং সম্পূর্ণ এড়িয়ে বললো,
“এখানের ফুচকাটা ভালো। খাবি?”
“হু, সাথে একটা আইসক্রিম ও এনো”
অনল উঠে গেলো। ধারা তার যাবার পানে চেয়ে রইলো। পোলো টি শার্ট, নীল জিন্স এর সুঠাম দেহী মানুষটাকে পেছন থেকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। অনেকটা হুমায়ুন স্যারের বাদল চরিত্রটির মতো। ধারা আজ বুঝলো প্রিন্স উইলিয়ামের ফ্যান কেনো বেশি। ফুচকার অর্ডার দিতে একটু দূরেই এলো অনল। সে ধারার প্রশ্নের উত্তরটি হয়তো দিতে পারতো কিন্তু ইচ্ছে হলো না তার। সঠিক সময় আসলে হয়তো দেওয়া যাবে। অর্ডার দিয়ে আইসক্রিম নিয়ে গন্তব্যে যেয়ে দেখলো স্থানটি ফাঁকা, ধারা নেই…………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
চলবে
(