প্রপর্ণ পর্ব ১০+১১

#উপন্যাস_প্রপর্ণ(১০)
#কুরআতুল_আয়েন

বুরাগ আনমনে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।চুল গুলোকে পরিপাটি করছে ঠিকই কিন্তু মন তার পড়ে আছে বেলীর আচরণে।বেলীর কান্না করার কারণ টা কিছুতেই মাথায় বোধগম্য হচ্ছে না।কিছু একটা হয়েছে বেলীর তা ঠিকই আন্দাজ করতে পারছে বুরাগ কিন্তু আসলে কি হয়েছে তা ঠিক ধরতে পারছে না।এমনকি আজকে ঘুম থেকে উঠার পর একবারও বেলীর দেখা পেলো না।বুরাগ ভেবে পাচ্ছে না মেয়েটা কেনো এমন করছে।বুরাগ বেলীকে নিজের আশেপাশে দেখতে চাচ্ছে কিন্তু চোখে তার দেখা মিলছে না,তবে তার খুব রাগ হচ্ছে বেলী কেন একটিবারও আসছে না তার সামনে।আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলো।নিজেকে সব দিক দিয়ে পরিপাটি লাগছে।কিন্তু,মনটা তার ঠিকই উসখুস করছে।সারারুম জুড়ে পায়চারি করছে আর বেলীর আসার জন্য অপেক্ষা করছে।একবার দরজার সামনে গিয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখো নিলো বেলী আসছে কিনা, কিন্তু বেলীকে আসতে না দেখে বুরাগ ব্যর্থ হয়ে রাগে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।চোয়াল তার আপনাআপনিই শক্ত হয়ে গিয়েছে।একপ্রকার দ্রুত গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু সামনে মা’কে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে হাঁটার গতি কমিয়ে দিয়েছে।

আফিয়া ছেলের রুমের দিকেই যাচ্ছিলেন।বুরাগ কে সামনে দেখে আফিয়া জরুরি তলবে বলে উঠলেন,

–“আমার রুমে আয় তো বুরাগ।তোর সাথে কিছু কথা আছে।”

বুরাগকে বলেই আবারও নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরলেন আফিয়া।বুরাগ মায়ের জরুরি তলব শুনে কিছুটা সরু চোখে তাকালো মায়ের যাওয়ার পানে।পরমুহূর্তেই কালো প্যান্টের পকেটটায় হাত গুজে নিজেও হাঁটা ধরলো মায়ের রুমের উদ্দেশ্যে।

বুরাগ রুমে যেতেই আফিয়া বুরাগকে নিজের সামনাসামনি বসিয়ে দিলেন।কিছুটা আদেশের সুরে বললেন,

–“আজকে আসার সময় একটা ফোন কিনে আনবি।”

বুরাগ মাথা নেড়ে উত্তর দিলো,

–“ঠিকাছে মা!আমি নিয়ে আসবো তোমার জন্য ফোন।এখন উঠি অফিসের লেইট হয়ে যাবে।”

আফিয়া কিছুটা বিরক্ত হলেন ছেলের প্রতি।ছেলের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে কিছুটা শক্ত গলায় বললেন,

–“বাপের হোটেলে চাকরি করো তুমি।এমন না যে সময় মতো না গেলে তোমার হাতে চাকরির ছাড়পত্র ধরিয়ে দিবে।এক দন্ড বসেও তোমার সাথে কথা বলা যায় না।এতো তাড়া দেখাও কেন তুমি।আর শোন ফোন আমার জন্য কিনতে বলি নি।বেলীর জন্য বলেছি।

বুরাগ কিছুটা অবাক চাহনি নিয়ে তাকালো মা’য়ের দিকে।মা’র হুট করে রেগে যাওয়ায় কিছুটা থতমত খেয়ে গিয়েছে।আবার লাস্টের কথাটা কানে কর্ণপাত হতেই বুরাগের কপালে ভাজের রেখার সৃষ্টি হয়েছে।বুরাগ ভ্রকুটি কুঁচকে বললো,

–“বেলীর জন্য ফোন?”

এবার আফিয়া যেনো আরো একটু চটে গেলেন।রাগান্বিত গলায় বুরাগকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

–“তুমি কি কিছু বুঝ না বুরাগ!সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকো তুমি আর বেলী একা একা বাসায় বসে থাকে।হাসি,খুশি তাদের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত।আমরা বুড়ি হয়ে গিয়েছে।তুমি কি একটু ফোন দিয়ে ওর খোঁজ নিতে পারো না?একটু কথা বলতে পারো না?মেয়েটা কাল আমার থেকে ফোন চেয়ে নিয়েছে তোমার সাথে কথা বলবে বলে।তাই আজকে আসার সময় ওর জন্য একটা ফোন কিনে নিয়ে আসবে।”

মা’য়ের সম্পূর্ণ কথা বুরাগ খুব মনোযোগ সহকারে শুনেছে।সব কথা শোনার পর পরেই বুরাগের মনে পড়ে যায় গতকাল দুপুরের মায়ের ফোন আসার কথাটা।তাও বুরাগ আর একটু নিশ্চিত হওয়ার জন্য বললো,

–“বেলী কি কালকেই তোমার থেকে ফোন নিয়েছে মা?”

–“হ্যাঁ!কাল দুপুরের দিকেই।কেনো তোমার সাথে কথা হয়নি বেলীর!”

বুরাগ এবার পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে কাল বেলীই তাকে ফোন দিয়েছিলো মা’য়ের ফোন থেকে।কিন্তু,কথা বলার আগেই তো তার সাথে রায়ানের দেখা হয়ে যায়।এতোদিন পর রায়ানকে দেখে বুরাগ অনেকটাই খুশি হয়ে গিয়েছিলো যার ফলে ফোনের কথা মনেই ছিলো না তার।রিসিভ অবস্থাতেই ছিলো।কিন্তু,বুরাগের মাথায় একটা চিন্তা খেলছে রায়ান আর তার সব কথা কি বেলী শুনে নিয়েছে কিনা!এইটা কল লিস্ট দেখলেই বুঝা যাবে।বুরাগের ভিতর টা খুব অস্থিরতা করছে।জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে তাও অস্থিরতা যেনো বেড়েই যাচ্ছে।মা’কে নিজের দিকে কেমন প্রশ্নবোধকের মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা আমতাআমতা করে বলে উঠলো,

–“কথা হয়নি না মা।তখন আমি একটা মিটিংয়ে ছিলাম।”

বুরাগ খুব তাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।মা’য়ের রুম থেকে বের হয়ে দ্রুত গতিতে পকেট থেকে ফোনটা বের করে নিলো।হাঁটছে আর গতকালকের কল লিস্ট টা চেক করে যখন চোখে পড়লো ১০মিনিট ৪০সেকেন্ড তা দেখেই বুরাগ বুঝে নিয়েছে তার আর রায়ানের সব কথাই বেলীর কানে পৌঁছছে।এমনকি বুরাগের কাছে এটাও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে বেলীর কালকের কান্না করার কারণ টা।আর কিছু না ভেবেই বেলীর খোঁজ করার জন্য নিচে নেমে এলো।

বেলী গুটিগুটি পায়ে সারা রান্নাঘর জুড়ে হাঁটছে আর কাজ করছে।কখনো চুলোর কাছে যাচ্ছে আবার কখনো সিংকের কাছে।মনটা তার ঠিকই বিষন্নতায় ভরপুর।জীবনটা কেমন ছন্নছাড়া লাগছে তার।শেষ বিকালের বাতাসের মতো বিষন্নতায় ধরে রেখেছে।মনে হচ্ছে সুখ গুলো ঝরা পাতার মতো ঝরে গিয়ে নাম না জানা এক জায়গায় মচমচ করে পড়ে যাচ্ছে।ভালোবাসা এক অদ্ভুত জিনিস!ভালোবাসার মানুষটার কাছ থেকে যতই কষ্ট পায় না কেন দিনশেষে ভালোবাসার মানুষটাকে ঠিকই ভালোবেসে যায়,আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকে।আবার,কিছু কষ্ট,ক্ষত-বিক্ষত,স্মৃতি সবকিছু মিলিয়ে অনেকের জীবন বেহিসেবেই কাটিয়ে দেয়।বেলী সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে সে এইখান থেকে চলে যাবে,পুনরায় পড়াশোনা শুরু করবে।আগের মতো নিজের গতিতে এগিয়ে চলবে।শুধু তফাৎ হবে এটাই বুরাগ কে কিছুতে ভুলতে পারবে না।ভাবতেই বেলীর বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।যে দীর্ঘশ্বাসে আছে শুধু বিষন্নতার খেলামেলা।সব কিছু বাদ দিয়ে আবারও কাজে লেগে পড়লো বেলী।
বুরাগ নিচে নেমে বেলীকে দেখতে পেয়ে খুব হাসফাস করছে।যাবে কি যাবে না ভেবেই পাচ্ছে না।একবার মন বলছে যাওয়ার জন্য তো আরেকবার সেই মন উল্টো ঘুরে আগের কথার ইতি টেনে দিচ্ছে।কিন্তু,বুরাগ নিজে থেকে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না।আর গিয়ে কিই বা বলবে সে!কতক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে বুরাগ বেলীকে দেখে নিলো।বেলীর মুখের হাবভাবেই বলে দিচ্ছে তার মনের ভিতর কি ঝড় চলছে।বুরাগ কিছু না বলে,রান্নাঘর ক্রস করে দ্রুত গতিতে মেইন দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।

বেলী বুরাগের উপস্থিতি টের পেয়েছে।ভেবে নিয়েছিলো বুরাগ তার কাছে আসবে।তার সাথে কথা বলবে।কিন্তু,বুরাগ তাকে ক্রস করে চলে যাওয়ায় তার মনের কোণে বিষন্নতা গুলো যেনো আরো একটু জমা হয়েছে।সাথে অভিমানেরাও খেলছে।বেলী পিছনে ফিরে বুরাগকে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে দেখে নিজেও আস্তে পায়ে রান্নাঘরের দরজার সামনে এগিয়ে গেলো।রান্নাঘরের দেয়ালের সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে বুরাগের যাওয়ার পানে চেয়ে রইলো আর চোখের কার্ণিশ ভিজে উঠতে শুরু করলো।
————————–
–“মা!আমি আবার পড়াশোনা শুরু করতে চাই।সামনেই আমার কলেজে পরীক্ষা আছে ওই পরীক্ষা গুলো আমি দিতে চাই।”

অনেকটা ইতস্তত নিয়েই বেলী শ্বাশুড়িকে কথা গুলো বললো।কিন্তু,ভিতরে তার ঠিকই অস্থিরতার অনুভূতি হচ্ছে।এই কথার উত্তর কি আসবে তাই ভাবছে বেলী।

আফিয়ার কেন জানি নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে।সব দিকে খেয়াল রাখার পরও তিনি বেলীর পড়াশোনার দিকটাই খেয়াল রাখেন নি।নিজের সংসার,ছেলের কথা ভাবতে গিয়ে বেলীর স্বপ্ন পূরণের পথে অনেকটাই বাঁধা দিয়ে ফেলেছেন।এমনকি বেলী এই কথাটা এখন না বললে উনার এইটা কখনোই মাথায় আসতো না।
বেলী শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে আছে।কিন্তু,শ্বাশুড়ির কোনো উত্তর না পেয়ে মন টা নিমিষেই নিকষ কালোর মতো অন্ধকারে ছেয়ে গেলো।কিছু না বলে মাথাটা নিচু করে রেখেছে।সাদা ফ্লোর টায় একমনে চেয়ে আছে বেলী।

আফিয়া হাসিমুখে জবাবে বললেন,

–“ঠিকাছে!তুই সবগুলো পরীক্ষা দিবি।এখন সংসারের চিন্তা বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মন দে।”

বেলীর ভিতর থেকে নিকষ কালো অন্ধকারের প্রকোপ দূরে সরে গিয়েছে।রোদের ঝলমলানির মতো বেলীর ঠোঁটের কোণের হাসিটা চিকচিক করে উঠছে।বেলী উত্তেজিত গলায় বললো,

–“মা!আমি আজকেই বাড়ি যেতে চাই।”

আফিয়া বেলীর উত্তেজিত কন্ঠটা শুনে আর কিছু বলেন নি।বিয়ের পর মেয়েটা এই প্রথম বাড়ি যাবে।বেলীর হাসি মুখটা দেখেই আফিয়া রাজি হয়ে গেলেন।বুরাগ আসলে না হয় বুঝিয়ে বলে দিবেন।আফিয়া আর কোনো কথা না বাড়িয়ে সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বেলীকে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দিলেন।বেলী খুশি হয়েছে ঠিকই কিন্তু তার বুরাগের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে।তাও বেলীর কিছুই করার নেই।যেখানে ভালোবসা নেই সেখানে থেকেই বা কি করবে।
——————-
মাটির সরু রাস্তাটা দিয়ে অলি সাহেব সাইকেল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন।সাইকেলের পিছনে বেলী বসা।আব্বার কোমড়ের দিকটা চেপে ধরে রেখেছে।ট্রেনে করে বেলী একাই এসেছে।একা চলাফেরা করতে চায় বেলী।এতে শ্বাশুড়ি আফিয়া অনেক দ্বিমত করেছিলেন কিন্তু বেলী একপ্রকার জোর করেই একা ট্রেনে করে এসেছে।আর,আসার আগে ফুপির ফোন দিয়ে আব্বাকে ফোন করে বলে দিয়েছিলো স্টেশনে থাকার জন্য।গ্রামের চারপাশ টায় চোখ বুলাচ্ছে বেলী।রোদের প্রকোপে চোখ,মুখ কুঁচকে রেখেছে কিন্তু মুখে ঠিকই হাসি ফুটে উঠেছে।গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে অলি সাহেব খুব সাবধানতার সাথে সাইকেল টা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।শালি ধানের মাঝখানে সরু মাটির রাস্তাটার বুকে গভীর ক্ষত।যে ক্ষত গুলো সাইকেলটাকে ব্যালেন্স হারাতে অনেকটাই সাহায্য করছে।অলি সাহেবও কম না খুব সাবধান ভাবে রাস্তার বুকের গভীর খাঁজ,ক্ষত গুলো পেরিয়ে নিজের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে আসছেন।ফেলে আসা পিছু রাস্তা আর ফেলে আসা এই রাস্তার সাথে স্মৃতি জড়ানো কাহিনিগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে বেলীর।স্কুল টা এই রাস্তা পেরিয়ে না করলেও কলেজের প্রথম বর্ষ টা ঠিকই এই রাস্তা পেরিয়ে করেছে।এমনকি সামনে কলাপাতা,আর লতাপাতায় মোড়ানো একটা বাড়ি পড়ে যেখানে বেলী সহ গ্রামের আরো অনেকেই পানি খাওয়ার উৎস হিসেবে বেছে নিয়েছিলো।কড়া রোদের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়া সবার জন্যই খুবই দুষ্কর ছিলো।শহরের জমকালো নাগরিকের উন্মাদনা দূর করে মেঠো আলের সবুজ প্রাণের মধ্য দিয়ে চেনাজানা সেই বাড়ির কিছুটা আগেই চলে এসেছে।বলতে গেলে আর কয়েক মিনিটের পরেই বেলীদের বাড়ি আশাকুঞ্জ নিবাস।

জাবেদা বাড়ির উঠোন জুড়ে ঝাড়ু দিচ্ছেন।উঠোন টা পরিষ্কার করে রাখতে হয়।উঠোন ভর্তি করে ধান রোদে দিতে হয়।ধান কাটার লোকেদের দিয়ে তো আর উঠোন পরিষ্কার করানো যায় না।তাই,নিজেই এই দায়িত্ব টা নিয়েছেন।আরো,একটা কারণ আছে বেলীর জন্য অপেক্ষা করা।কতোদিন বাদে বেলীকে দেখবেন তিনি।কয়েকদিন আগে বুনি এসে ঘুরে গিয়েছিলো আক্কাসের সাথে।তখন বেলীকেও খুব করে দেখতে চেয়েছিলেন।কিন্তু,সাহস করে কাউকে বলতে পারেন নি।বেলীর বিয়েটা তো একদম অন্যরকম ভাবে হয়েছে তাই কাউকে বলার সাহস টুকু জুগান নি।তবে অপেক্ষা করে থেকেছেন বেলীকে একপলক দেখার।আজকের জাবেদার অপেক্ষার প্রহর ফুরাচ্ছে।

বেলী বাড়ির সামনে এগিয়ে গেলো।দূর থেকে আম্মকে উঠোনে কাজ করতে দেখে দৌড়ে গিয়ে জাপটে ধরলো।জাবেদা সবেমাত্র ঝাড়ু দিয়ে শেষ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।আচমকাই এইভাবে জাপটে ধরায় জাবেদার বুঝতে বাকি রইলো না কে তাঁকে জড়িয়ে ধরেছে।সামনে ফিরে বেলীকে দেখে যেনো প্রাণ ফিরে পেয়েছেন।কতক্ষণ বেলীর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলেন।মেয়েটা যে তাঁর আগের থেকে খুব সুন্দর হয়ে গিয়েছে,অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছে।বেলী টলমল চোখে জাবেদার দিকে তাকিয়ে জোরে কেঁদে উঠলো।ভিতরের কষ্ট গুলো যেনো মুষলধারের বৃষ্টি মতো ঝরতে শুরু করলো।জাবেদা বেলীকে নিজের বুকে পরমযত্নে জড়িয়ে ধরলেন।

খুব তাড়াহুড়ো করেই আজকে অফিস থেকে বের হয়েছিলো বুরাগ।অফিসে আজকে সারাদিন অস্থিরতায় কেটেছে তার।বার বার মনে করেছে শুধু বেলীর কথা আর সেই সাথে মনের গহীনে অস্থিরতার খেলা।তাই,খুব তাড়াতাড়ি করেই বের হয়েছিলো অফিস থেকে কিন্তু,মাঝপথে জ্যামে এসে আটকে আছে।এতে যেনো বুরাগ আর একটু নেতিয়ে গিয়েছে।যতো দ্রুত বাসায় যেতে চাচ্ছে ততই পথ আগাচ্ছে না।বুরাগ শুনেছিলো বিপদের সময় পথের গতি আগায় না মনে হয় আরো দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে।এমনটাই এখন মনে হচ্ছে বুরাগের।এই সামান্য রাস্তাটাকে তার অনেক বেশি মনে হচ্ছে তার উপর এখন আবার জ্যাম।সব মিলিয়েই একটা হ,য,ব,র,ল লেগে গিয়েছে।অবশ্য,ফোন টা কিনা হয়ে গিয়েছিলো বলে অনেকটাই শান্ত আছে বুরাগের মন।আজকে,বেলীর সাথে স্নিগ্ধার পুরো ব্যাপার টা নিয়ে কথা বলবে।বুরাগের মন বলছে বেলীকে স্নিগ্ধার ব্যাপারে সব বললে বেলীর আর কষ্ট পাবে না।এমনকি বেলী শুনতে না চাইলেও আজকে বুরাগ বেলীকে বাধ্য করবে সব শোনার জন্য।কেন,বা কী কারণে স্নিগ্ধার সাথে বুরাগের সম্পর্কের ইতি টেনেছে তা আজকেই বেলীকে বলে সব মীমাংসা করে নিবে।এখন শুধু একটারই অপেক্ষা কখন জ্যাম নামক এই বিরক্ত জিনিস টা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।
————-
তাড়াহুড়ো করে বের হয়েও লাভ হয়নি বুরাগের।সেই ১২ টাই বেজে গিয়েছে।মেজাজ টা এমনেই বিগড়ে আছে।দুই সিঁড়ি পার করে উপরে উঠতে লাগলো।একপ্রকার ঝড়ের গতিতেই এগিয়ে যেতে লাগলো।কিন্তু মা’র আওয়াজ পেয়ে থেমে গিয়েছে বুরাগ।এতো রাতে মা’র আওয়াজ টা খুবই ভাবাচ্ছে তাকে।মা’কে রাত জাগতে খুব কমই দেখেছে বুরাগ।বুরাগ পিছনে ফিরে মা’র কাছে এগিয়ে গেলো।

আফিয়া অনেকক্ষণ ধরে বুরাগের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।বেলীর কয়েকদিনের জন্য বাড়ি যাওয়া, আবার পড়াশোনা শুরু করার কথাটা সামনাসামনিই বলতে চান।ফোনে বললে যে ছেলের রিয়েকশন অন্যরকম হতো তা নিতান্তই উনার জানা।বলতে গেলে রাগের দিক দিয়ে বাপ ছেলে একই।কেউ কারোর থেকে কম না।আফিয়া লম্বা একটা হাই তোললেন।বুরাগের কাছে এগিয়ে গিয়ে বুরাগের কাঁধে হাত রেখে বললেন,

–“বেলী কিছুদিনের জন্য বাড়ি গিয়েছে।আসতে দেরি হতে পারে।বেলী আবারও পড়াশোনা করতে চায়।কলেজের সামনের এক্সাম গুলো দিতে চায়।আর আমিও চাই বেলী নিজের স্বপ্ন গুলো পূরণ করুক।সংসারের হাল তাকে এখনই ধরতে হবে না।তুই ফ্রেশ হয়ে আয় আমি খাবার দিচ্ছি তোকে।”

মা’র কথা শুনে বুরাগের চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছে।এইরকম একটা কথা শোনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখে নি।যার ফলে কপালের নীল রগ গুলো ফুটে উঠেছে।চামড়া ভেদ করে মনে হচ্ছে বেরিয়ে আসবে।করিডোরের হালকা আলোয় আফিয়া বুরাগের দিকে তাকালেও বুরাগের চেহারার দিকে খেয়াল করেন নি।আফিয়া আরেকটা হাই তোললেন।বুরাগকে কিছু বলতে না দেখে পুনরায় তাড়া দিয়ে বলে উঠলেন,

–“কি এমন রবোটের মতো দাঁড়িয়ে আছিস।যা!তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়।”

বুরাগ চোয়াল শক্ত অবস্থায় বললো,

–“খাবো না আমি।”

আর কিছু বলার সুযোগ দেয় নি মা’কে।গটগট করে নিজের রুমের কাছে এগিয়ে গিয়ে দরজা টা জোরে শব্দ করে লাগিয়ে দিলো।এতে আফিয়া কিছুটা চমকে উঠলেন।মনে মনে ভাবতে লাগলেন,বেলী চলে যাওয়াই কি বুরাগ রাগ করেছে।কথাটা ভাবতেই উনার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।আবার বিরবির করে বলতে লাগলেন,ছেলের রাগ দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।

বুরাগ রুমে এসে রাগে হাতে থাকা নতুন ফোনের প্যাকেট টা ঠাস করে ফ্লোরে ফেলে দেয়।ব্লেজার টাও বিছানার উপর ফেলে দিয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো।বারান্দার গ্রিল ভেদ করে দূরের দিকে তাকিয়ে আছে।আর,কপালের চারপাশে রগ গুলো যেনো আরো ফুলে উঠছে।মনে মনে বিরবির করতে লাগলো,’এতো রাগ তোমার বেলী!যাওয়ার আগে একবারো আমার কাছে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করো নি।আমি জানি বেলী তুমি ইচ্ছা করে চলে গিয়েছো।আমার মনের কথা গুলো শোনার আগেই তুমি চলে গিয়েছো।ভেবেছিলাম আজ,সব কিছু তোমাকে খোলসা করে বলে আবারও নতুন করে সব ঠিক করে নিবো।কিন্তু,তার আগেই তুমি একটা ভুল সিন্ধান্ত নিয়ে নিলে।’
বুরাগ অভিমানের সুরে আবারও বিরবির করে বলতে লাগলো,’আমিও যাবো না তোমার কাছে।দেখি কতদিন তুমি আমার থেকে দূরে থাকো!’

এলোমেলো পায়ে বারান্দা ছেড়ে বিছানায় এসে বসলো বুরাগ।বিছানায় মাথাটা হেলান দিয়ে রেখেছে।এক পা ফ্লোরে রাখা আরেক পা বিছানায়।বিছানার পাশে রাখা সাইড বক্স টা খোলে সিগারেটের নতুন প্যাকেট টা বের করে নিলো।প্রায় অনেকদিন পর সিগারেটের ধোঁয়া উড়াবে।ভিতর টা কেমন শূন্য শূন্য অনুভব করছে বুরাগ।বিছানার পাশে তাকিয়ে বেলীর অনুপস্থিতি তার ভিতরের জ্বালা অনুভব টাকে যেনো আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
————————–
সকালে খুব তাড়াহুড়ো করে রেডি হচ্ছে বেলী।গন্তব্য কলেজ।জাবেদা ঘরে ঢুকে বেলীকে রেডি হতে দেখে বলতে লাগলেন,

–“কোথাও যাবি বেলী?”

বেলী ঝটপট উত্তর দিলো,

–“হ্যাঁ!আম্মা কলেজ যাবো।”

জাবেদা কিছু বলেন না চুপ করে বেলীর দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছেন।তবে ভয় হচ্ছে খুব,তাঁর মতো পড়াশোনা করতে গিয়ে বেলীর আবার ডিভোর্স হয়ে যাবে না তো!নিজের প্রথম স্বামী তো এ-কারণেই তাঁকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছিলো।
#উপন্যাস_প্রপর্ণ(১১)
#কুরআতুল_আয়েন

চারদিকে বিস্তৃত মাঠ।সামনের দূরের গাছপালা গুলোকে শিউলির কাছে সবুজ দ্বীপের মতোন লাগছে।শিউলি এককোণায় বসে আছে।অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে করিমের জন্য কিন্তু করিমের এখনো কোনো দেখা মেলেনি।স্কুল অনেকক্ষণ আগেই ছুটি হয়ে গিয়েছে।খেলার কথা বলে শিউলি সবুজকে অনেকটা ইনিয়েবিনিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে।সবুজও আজকে নাছোড়বান্দার মতো আচরণ করেছে।বাড়ি গেলে সে শিউলির সাথেই যাবে নয়তো একা যাবে না।শিউলি সবুজের নাছোড়বান্দা ব্যবহার দেখেই বুঝে নিয়েছে এইসব আম্মার কাজ।আম্মায় তাকে চোখে চোখে রাখার জন্য সবুজকে বলে দিয়েছে।আম্মা যে তাকে সন্দেহ করছে তা শিউলির জানা।কিন্তু,শিউলিই বা কি করবে সে তো করিমের সাথে সময় না কাটিয়ে একমুহূর্তও থাকতে পারে না।দিন দিন যেনো করিমের প্রতি আরো আসক্তি হয়ে পড়ছে।যা কাটিয়ে উঠা খুবই দুষ্কর।শিউলির ছোট মনটা করিমের ভালোবাসার দহনে অনেক আগেই পুড়েছে।শিউলির ভালোবাসার বাতায়নে সবসময় করিমের মুখটাই ভেসে উঠে।কিন্তু শিউলি এখনো সেই মানুষটির দেখা পাচ্ছে না।এইরকম দেরি কখনো করে না করিম।এমনকি অন্যদিন শিউলি আসার আগেই করিম এসে বসে থাকে।আর,আজকে ঠিক তার উল্টো টা হচ্ছে।শিউলির হৃদয়ের মনের গহীনে অভিমানের রেশ জমা হচ্ছে।দু’চোখ ভরে পানি বন্যা হয়ে আসছে।কিছুই তার ভালো লাগছে না।থুঁতনিটা হাঁটুর উপর ভর করে রেখেছে আর সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।তার কিছুটা সামনেই দুই তিনটা গরু আপনমনে ঘাস খেয়ে যাচ্ছে।সুন্দর একটা মনোমুগ্ধকর পরিবেশ বিরাজ করছে চারপাশে।গাছপালা,লতাপাতা,ধানক্ষেত পেরিয়ে আসা মৃদু বাতাস টা শিউলির মনকে উতলা করে তুলছে।এমন একটা পরিবেশে শিউলি তার পাশে করিমের উপস্থিতি চাচ্ছে।অনেকক্ষণ বসে থাকার পর করিমের দেখা না পেয়ে শিউলি উঠে পড়লো।মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় আসতেই সামনের দিকে করিমকে আসতে দেখে পুনরায় আগের জায়গায় এসে চুপটি করে বসে পড়লো।মনে মনে ভেবে নিয়েছে শিউলি কোনোমতেই করিমের সাথে কথা বলবে না।বরং,করিমকে দেখে শিউলির অভিমান টা যেনো দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে।

করিম খুব দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে।মাঠের কোণার দিকটায় শিউলিকে বসে থাকতে দেখে করিমের ভিতর থেকে তপ্ত একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।আস্তে পায়ে এগিয়ে গিয়ে শিউলির শরীর ঘেঁষে বসে পড়লো।শিউলির মধ্যে কোনো ভাবান্তর এলো না।আগেয় ন্যায় চুপটি করে বসে আছে।করিম শিউলির মুখপানে চেয়ে কিছুটা নিম্ন গলায় বললো,

–“আমার আইতে দেরি হইছে দেইখা তুমি মন খারাপ কইরা বইসা আছো শিউলি ফুল!”

শিউলি করিমের কথায় কোনো প্রত্যুত্তর করলো না।মাঠের ঘাসগুলো একটা একটা করে ছিড়ে পাশে রাখছে।কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না মৃদু বাতাস টায় ঘাসগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ে যাচ্ছে।ঘাসের উড়ে যাওয়া দেখে শিউলি বিরবির করে বলতে লাগলো,মৃদু বাতাসের তেজ আছে বলতে হবে।

–“কি গো!কথা কইবা না আমার সাথে।”

শিউলি তাও কিছু বলে না।করিমের কথার উত্তর না দিলেও তার কথা গুলো ঠিকই কর্ণপাত করছে।শিউলির মতিগতি পর্যবেক্ষণ করে করিমের চোখ দুটো কুঁচকে গিয়েছে সেই সাথে চোয়াল ও শক্ত হয়ে গিয়েছে।শিউলির খাপছাড়া স্বভাব টা করিমের কাছে অসম্ভব রকমের বিরক্তি লাগছে।তাও,নিজেকে যতোটা সম্ভব ঠিক করে নিয়ে আবারও বললো,

–“হুনলাম বেলী আইছে নাকি।তোমগোর পাশের বাড়ি রোকসানা আছে না হের কাছ থাইকা হুনছি।এইডাও হুনছি বেলী নাকি আগের তে আরো সুন্দর হইয়া গেছে।অবশ্য,বেলী তো আগের থাইকা পরীর লাহান সুন্দর ছিলো।”

শিউলি মাথা নিচু করেই করিমকে উদ্দেশ্য করে বললো,

–“এইজন্য কি আপনার আসতে এতো দেরি হয়েছে।”

–“হ!রাস্তার সামনে রোকসানার লগে দেহা হইলো পরে হুনলাম বেলী আইছে।তার পরে আরকি টুকটাক কথা হইলো।”

শিউলি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।তার ছোট মনটায় করিমের এই কথাগুলোই যথেষ্ট কষ্টের ছন্দে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।শিউলি উঠে দাঁড়াতেই করিম ভ্রু কুঁচকে শিউলির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।শিউলি বহু কষ্টে কান্নাটাকে দমিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় বললো,

–“জানেন করিম ভাই!ভালোবাসার মানুষটার মুখে অন্যকারোর নাম শুনলে সেটা সহ্য করা খুব কষ্টের হয়ে যায়।পৃথিবীর সব কষ্টে যেমন কাঁদা যায় না তেমনি সব সুখেও হাসা যায় না।আপনার মুখে অন্যকারোর নাম শুনে আমার হৃদয়ে আগুন না জ্বললেও ঠিকই পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।কারণ,ভালোবাসার কষ্ট টা এমনই।যে কষ্টে আগুন জ্বলবে না ঠিকই কিন্তু পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।”

শিউলি আর দাঁড়ায় না।করিমের দিকে একপলক তাকিয়ে দৌড়ে জায়গা ত্যাগ করলো।মাঠির আঁকাবাঁকা রাস্তাটা দিয়ে বাড়ির পথে এগিয়ে যাচ্ছে।চোখের পানি গুলো এখন বাঁধা মানছে না।করিমের সামনে দমিয়ে রাখলেও এখন কিছুতে দমানো যাচ্ছে না।শিউলির কাছে বেলীকে এখন খুব অসহ্য লাগছে।করিম তো বেলীর জন্য খুব পাগল ছিলো।এমনকি করিম প্রায় সময় বেলীকে একপলক দেখার জন্য হলেও তাদের বাড়ি এসে বসে থাকতো।তার উপর বিয়ে করার জন্য অনেকবারও তার আম্মার কাছে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছে।শিউলি এলোমেলো পায়ে হাঁটছে আর ক্রন্দনরত গলায় বিরবির করছে,’কেনো এলে তুমি আপা!তোমাকে তো আমার কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না।’

করিম শিউলির কথাগুলো মিনিট দশেক সময় নিয়ে ভাবলো।আজকে করিমের কাছে শিউলিকে খুব বড় লাগছে।মনে হচ্ছে মেয়েটা কিশোরী থেকে একমুহূর্তের মধ্যেই যুবতী হয়ে গিয়েছে।পরমুহূর্তেই মাঠের ঘাসের উপর হাত ভাজ করে শুয়ে পড়লো।মাথার উপর বিশাল বড় রেন্ডিকড়ই গাছটার পাতাগুলোর ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো।মুখে একটা বিষাদ ময় হাসি টেনে বলতে লাগলো,

–“ঠিকই কইছো শিউলি ভালোবাসার মানুষটার মুখে যেমন অন্যকারোর নাম হুনলে কষ্ট হয় তার থেকে বেশি কষ্ট হয় সেই মানুষটা যদি অন্য কারোর লগে ঘর বাঁধে।যহন মনে পড়ে বেলী অন্যকারোর তহন,আমারও তো ভিতর টা পুইড়া ছাই হইয়া যায়।”
————————–
বড় বারান্দার পাশেই মাঝারি সাইজের একটা চৌকি রাখা।চৌকি টায় খুব আয়েসি ভঙিমা করে আমেনা বেগম বসে আছেন।মুখে দুটো পান একসাথে নিয়ে চিবাচ্ছেন।আমেনা বেগমের পাশে বসা বেলী খুব যত্ন সহকারে পান তৈরি করছে।সুপারি,চুন,জর্দা সব কিছু ঠিকঠাক দিয়ে দাদির জন্য এই নিয়ে ছয় নাম্বার পান বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।আমেনা বেগম পান চিবানোর পর তেতো পানের ফিক টা চৌকির কিছুটা সামনেই ফেলে দেন।আমেনা বেগমের কাছে বেলীর তৈরি করা পান টা খুব মনে ধরে।লম্বা বারান্দার আরেক কোণায় জাবেদা বসে সবজি কুটছেন।তার পাশেই রান্নাঘর।রান্নাঘরে রেহানা আর সুমনা রাতের খাবারের তোরজোর করে রাখছেন।জাবেদা সবজি কুটলেও উনি খুব চিন্তায় আছেন।সবুজের থেকে যখন শুনেছেন শিউলি আরো পরে আসবে তখনই উনি ভেবে নিয়েছেন আজকে শিউলিকে অনেক কড়া কথা শুনাবেন।মেয়েদের সাথে জাবেদা এতো কঠিন হতে চান না।তবে শিউলির মতিগতি উনার কাছে অনেক আগে থেকেই সুবিধার মনে হচ্ছে না।অবশ্য,শিউলির কিশোরীর বয়সটাকেও দোষ দেন জাবেদা।এই বয়সে তো অনেক কিছুই হয়ে থাকে।এমনকি,পতনের মূলও হলো এই কিশোরী বয়স টা।

বাড়ির ভিতরে ঢুকে বারান্দার চৌকিতে বসা বেলীকে দেখে শিউলির খুব রাগ হয়।ধপাধপ্ পায়ে এগিয়ে গেলো বাড়ির দরজার সামনে।জাবেদা দূর থেকে শিউলির দিকে কতক্ষণ সরু চোখে তাকিয়ে পরোক্ষ করে নিলেন।শিউলি দরজা দিয়ে ভেদ করে ঘরে ঢুকতে নিলেই বেলী পান তৈরি করতে করতে বললো,

–“এতো দেরি করে আসলি কেন শিউলি?স্কুল তো এতো দেরিতে ছুটি হয় না তোদের।সবুজ তো কখন চলে এসেছে।”

এমনেতেই শিউলির মনে আগুন জ্বলে ছিলো।বেলীর কথায় যেনো শিউলির মনে আগুন টা আরো দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো,কিছুটা চেঁচিয়ে বললো,

–“তাতে তোমার কি আপা!আমার যখন মন চায় আমি তখন আসবো।পারলে আমি বাড়িই আসবো না।বাহিরে রাত কাটাবো।তোমার কোনো সমস্যা আছে এতে।শুধু তুমি আমার ব্যাপারে কোনো কথা বলতে আসবে না আপা।”

বেলী আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছে শিউলির দিকে।কতক্ষণ অবাক চোখে শিউলির আপাতমস্তক পর্যবেক্ষণ করে নিলো।বোনটা কে চিনতে তার খুব কষ্ট হচ্ছে।যে বোনটা তার জন্য এতো পাগল ছিলো আজকে তাকেই এমন অযৌক্তিক কথা শোনাচ্ছে।বেলী শিউলিকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই শিউলির দু’গালে জাবেদা চড় বসিয়ে দিলেন।শিউলি ছলছল চোখে তাকালো আম্মার দিকে।জাবেদার শরীর রাগে কাঁপছে।বেলী বিস্ময় নিয়ে তাকালো আম্মার দিকে।আম্মাকে এইরকম রাগতে দেখে অনেকটাই হকচকিয়ে গিয়েছে সে।বেলী তার আম্মাকে এমন রাগতে কখনো দেখে নি।সবসময় চুপচাপ থাকতেন।অবশ্য,কথায় আছে চুপচাপ মানুষেরা রাগলে তাদেরকে খুব ভয়ংকর লাগে।ঠিক এমনই লাগছে বেলীর কাছে তার আম্মাকে।

জাবেদা কিছুটা মিহি গলায় চেঁচিয়ে বললেন,

–“দিন দিন এতো অবাধ্য হয়ে যাচ্ছিস তুই,বড়দের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় জানিস না।এতো অবাধ্য হবি জানলে জন্মের পরেই তোর গলা টিপে মেরে ফেলতাম।পড়াশোনা শিখে এমন আচরণ শিখেছিস তুই!দরকার নেই তোর পড়াশোনার করার।আর কি বললি তুই বাহিরে রাত কাটাবি!বাহিরে রাত কাটানোর অর্থ বুছিস তো!পড়াশোনা করে যদি বাহিরে রাত কাটানো শিখিস তাহলে সেই পড়াশোনা করার কোনো মানেই হয় না।কাল থেকে তোর স্কুল যাওয়া বন্ধ।বাড়িতে বসে বসে আমার সাথে কাজ করবি।”

শিউলির বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।স্কুলেই তো তার একমাত্র সম্বল করিমের সাথে দেখা করার।আর সেই রাস্তাটা যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে তো তার টিকে থাকতে কষ্ট হবে।কান্নারত গলায় আম্মাকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই জাবেদা শিউলির দিকে গরম চোখে তাকালেন।তা দেখে শিউলি আর কিছু বলার সাহস পায় নি।কান্না করতে করতে চলে যায় ভিতরে।শিউলি চলে যেতেই আমেনা বেগম দাঁতের চিপায় পান রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগলেন,

–“তোমার সাহস তো কম না ছোড বউ।আমার নাতনীডারে এমনে কইলা।ছোড মানুষ কি থাইকা কি কইয়া ফেলছে এর লাইগা এমন মাইর ধরাইবা। আইজকা আমার ছোড পোলা বাড়িত আসুক তারপর তোমার খবর আছে।”

জাবেদা শ্বাশুড়ির কথা মনোযোগ সহকারে কর্ণপাত করছেন,সেই সাথে পুনরায় পিঁড়িত বসে সবজি কুটায় মনোযোগ দিলেন।বেলী কেমন একটা রবোটের মতো বসে আছে।তার মনে শুধু একটা কথাই আওড়াচ্ছে,সে চলে যাওয়ার পর সবকিছু এতো পাল্টে গেলো!এমনকি শিউলিও!
————————–
ব্রিজের কার্ণিশের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বুরাগ আর রায়ান।কিছুটা সামনেই বুরাগের গাড়িটা দাঁড় করানো।মৃদু মৃদু ভাবে গাড়ির লাইটের আলোটা জ্বলছে আর নিভছে।সাথে ল্যাম্পপোস্টের হালকা আলো।আকাশে মাঝেমধ্যে মেঘেরা গর্জন করে উঠছে।মনে হচ্ছে যেকোনো সময় ঝুম বৃষ্টি নামতে পারে।রায়ান কিছুটা অসহায় গলায় বললো,

–“আমি যদি তখন তোর উপর ঝাঁপিয়ে না পড়তাম তাহলে আজকে ভাবি এইসব কথা শুনে কষ্ট পেতো না।এমনকি বাসা ছেড়ে চলেও যেতো না।আমার কেমন জানি একটা গিলটি ফিল হচ্ছে।আচ্ছা বুরাগ তুই কি সিউর ভাবি ইচ্ছা করে চলে গিয়েছে!না মানে,একটু আগেই তো তুই বললি পরীক্ষা দিয়ে গিয়েছে।”

বুরাগ রায়ানের কথায় কোনো উত্তর দিলো না।চুপ করে ব্রিজের পানিটার দিকে তাকিয়ে আছে।নিচে অন্ধকার থাকায় ব্রিজের পানির গভীরতা কতটুকু হবে তা বুঝতে পারছে না।তবে পাড়ে নৌকা গুলো থেকে ভেসে আসা হারিকেনের আলোগুলো দূর থেকে তারার মতো লাগছে।রায়ান বুরাগের মুখের দিকে চেয়ে আছে উত্তরের আশায়।বুরাগ চোখ ফিরিয়ে রায়ানের দিকে শান্ত চোখে তাকালো।গম্ভীর গলায় বললো,

–“ইচ্ছা করেই চলে গিয়েছে ও।পরীক্ষা শুধু একটা বাহানা।”

রায়ান মাথা নাড়িয়ে বললো,

–“বুঝলাম!তোর কি কষ্ট হচ্ছে নাকি?”

বুরাগ তেড়ে এসে রায়ানের গলা চেপে ধরলো।এতে রায়ান কিছুটা পিছিয়ে গেলো।বুরাগ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–“কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে আসছোস শালারপুত।অসহ্য কষ্ট আর যন্ত্রণার মধ্যে তুই আবার তিরস্কার করতে আসছোস।তোর মতো বন্ধু থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।”

রায়ান আকুতিভরা গলায় বললো,

–“বাপ!ছাড় আমার গলা।মইরা যামু তো।ভাবির দুঃখে তুই তো আমারে মাইরা ফেলবি।”

বুরাগ কিছুক্ষণ কটমট চোখে তাকিয়ে রইলো রায়ানের দিকে।পরক্ষণেই ছেড়ে দিয়ে আগের ন্যায় ব্রিজের কার্ণিশের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো।

বুরাগ ছাড়তেই রায়ান নিজেকে ঠিক করে নিলো।বুরাগের দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে বললো,

–“বাহ্!ভালোই ভাবির জন্য তাহলে কষ্ট হচ্ছে তোর।এইটা ভালোবাসার পূর্বলক্ষণ।”

–“জানি না তবে ভিতর টা খুব শূন্য শূন্য লাগছে।বাসায় গিয়ে একদন্ডও শান্তি পাই না।শুধু বেলীকে অনুভব করি।”

–“তোহ!নিয়ে আয় ভাবিকে তোর কাছে।”

বুরাগ কিছুটা অভিমানিনী গলায় বললো,

–“নাহ্!আমি কিছুতেই আনতে যাবো না।দেখি কতদিন থাকতে পারে।আমাকে কিছু না বলেই চলে গেলো।রাগ,অভিমান কি শুধু তারই আছে আমার নেই।অনেক বড় ভুল করে ফেলেছে বেলী।

রায়ান বুরাগের বাচ্চামো দেখে হেসে ফেললো।পরমুহূর্তেই হাসি টা থামিয়ে বুরাগের কাছে এগিয়ে গেলো।বুরাগের পাশে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো,

–“যাকে আপন ভাবা যায়,ভালোবাসা যায় ঠিক তার উপরেই অভিমান করা যায়।আর একটা কথা কি জানিস রাগ,অভিমানের পাশে ক্ষমা করাটাও শিখতে হয় তাহলে তো সম্পর্ক গুলো আরো সুন্দর ভাবে টিকে থাকে।ভাঙন ধরার কোনো সুযোগেই আসে না।ঠিক তেমনেই!তুইও ভাবিকে ক্ষমা করে দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আয়।মানলাম ভাবি তোর সাথে কথা না বলে,তোর মনের সম্পূর্ণ কথা গুলো শোনার আগেই চলে গিয়েছে।এইটা ভাবির ভুল হয়েছে ঠিক কিন্তু,তুই যদি ভাবিকে ক্ষমা করে আবার কাছে নিয়ে আসিস তাহলে তোদের মান-অভিমানের পাল্লা শেষ হয়ে যাবে খুব দ্রুত।না হলে সম্পর্কের ফাটল গুলো তীব্র থেকে তীব্রতর হবে।তবে আর একটা কথা বলছি তোকে বুরাগ!তুই ভাবিকে ভালোবাসিস কিন্তু সেটা তুই নিজেও বুঝতে পারছিস না।হয়তোবা তোর সেই অনুভূতি গুলো কোনো কিছুর নিচে চাপা পড়ে গিয়েছে।”

বুরাগ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে রায়ানের দিকে।রায়ান বুরাগের তাকানো দেখে মুখে একটা মিষ্টি হাসি টেনে বললো,

–“হ্যাঁ বন্ধু!তুমি ভাবিরে ভালোবাসো।ভালোবাসো বলেই তো ছটফট করছো।ভালোবাসার চিপায় পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছো।”

বুরাগ শুধু মুচকি হাসলো।আর,চোখের সামনের বেলীর চেহারাটা মনে করতে লাগলো।
————————–
দক্ষিণের জানালাটার দিকটায় চুল গুলো খুলে দাঁড়িয়ে আছে বেলী।বুরাগের প্রতিচ্ছবি টা নিজের মনের ক্যানভাসে বার বার আঁকার চেষ্টা করছে।এইখানে এসে বুরাগের অনুপস্থিতি তাকে আরো কষ্ট বাড়িয়ে দিচ্ছে।বেলীর নিজেকে এই পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় প্রাণী লাগছে।নিজের রাগ,অভিমান গুলো কাউকে দেখাতে পাচ্ছে না,দুঃখবিলাস করার জন্য কাউকে পাচ্ছে না।এমনকি চিৎকার করে কাঁদতে গিয়েও বাঁধা খাচ্ছে।শুধু মৃদু হাসির আড়ালে চোখের পানি গুলো লুকিয়ে রেখেছে।বেলীর কাছে ভালোবাসা মানে!কচুপাতার উপর পড়া বৃষ্টির ফোঁটার মতো।যত্ন বা আগলে না রাখলে ঠিকই গড়িয়ে পড়ে যায়।বেলী বিরবির করে বলতে লাগলো,
‘সময়ের সাথে অভিমান,কষ্ট গুলো ঠিকই কমে যাবে কিন্তু আঘাত গুলো একদম সুপার গ্লুর মতো লেগে থাকবে।’

শিউলির ভিতরটায় খুব অস্থিরতা কাজ করছে।কালকে স্কুলে যেতে পারবে কি পারবে না তা নিয়েই একদফা চোখের পানি বিসর্জন দিয়েছে।তবে,তাকে যেকোনো মূল্যেই স্কুলে যেতে হবে।শিউলি বেলীকে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেলীর দিকেই গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো।বেলীর কিছুটা অদূরে দাঁড়িয়ে হাত কচলাতে কচলাতে বললো,

–“আপা!তখনকার কথাগুলোর জন্য আমাকে ক্ষমা করে দাও।”

শিউলির কন্ঠের আওয়াজ পেয়ে বেলী চট করে পিছনে তাকালো।শিউলি কে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেলী মুখে একটা শুষ্ক হাসি টেনে বললো,

–“আমি কিছু মনে করি নি তোর কথায়।তুই না বুঝে বলে ফেলেছিস তা আমি বুঝতে পেরেছি।”

শিউলির বেলীর কাছে গিয়ে বেলীর হাত দুটো জড়িয়ে ধরলো।খুব উত্তজিত গলায় বললো,

–“আপা!তুমি একটু আম্মাকে বুঝিয়ে বলো না আমাকে যেনো স্কুলে যেতে দেয়।আর,আমি তো তোমার কাছে থেকে ক্ষমার চেয়ে নিয়েছি,এখন তুমি আম্মাকে বললেই আমি নিশ্চিত আম্মা তোমার কথা শুনবে।”

শিউলির মতিগতি বেলী কিছুক্ষণ পরোক্ষ করে নিলো।তার কাছেও শিউলির আচরণ গুলো অন্যরকম লাগছে।তাও শান্ত গলায় বলে উঠলো,

–“ঠিকাছে!আমি আম্মাকে বলবো।”

শিউলি বেলীকে জড়িয়ে ধরলো।বেলী আলতো করে শিউলির পিঠে হাত রাখলো।তবে তার মুখে কোনো হাসি নেই।আগের মতো দু’বোনের সম্পর্ক টাও মনে হয় নেই।শিউলি মনে মনে খুব খুশি হয়েছে।তার,বুদ্ধি টা কাজে দিয়েছে।সে জানতো আপা আম্মা কে বুঝিয়ে বললেই তাকে স্কুলে যেতে দিবে।

চলবে..
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here