“প্রমত্ততা তুই পর্ব ১৬

#প্রমত্ততা_তুই
#আফসানা_মিমি
||১৬তম পর্ব ||

দিনটা ছিলো শনিবার। রিসেপশনের সেই দিনের পর থেকে জারিফ আয়নার সান্নিধ্যে বেশি আসে না। সকালে ক্যাম্পাসে চলে যায় আর আসে গভীর রাতে। এদিকে আয়নারও সেমিস্টার পরীক্ষা শুরু তাই পড়াশোনায় ব্যস্ত তাই বলে যে আয়না জারিফকে জ্বালাতন করেনা তা না।
এই তো আজকের সকালের ঘটনা,
জারিফ রোজকার ন্যায় ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে আয়না হাজির মাথার চুলে বিনুনি করে দেয়ার জন্য।

– জামাই সাহেব, মাথার চুলে বিনুনি করে দিন।

– আমার এমন ফালতু কাজ করার সময় নেই।
জারিফের বিরক্তিমাখা উওর।

– বিনুনি তো আপনার আমাকে করে দিতেই হবে যেভাবেই হোক।

আয়নার কথার প্রত্যুওরে জারিফ বলল।
– যদি না করে দেই তো!
– তাহলে আর কি এই যে আমার হাতের মুঠোফোনের ভিডিওটা মাকে দেখিয়ে দিবো।
জারিফ তাকিয়ে দেখে গতরাতে আয়নাকে শাসিয়েছিল কাছে না আসার জন্য। তার পুরো ভিডিও করে রেখেছে আয়না।
– কাজটা ঠিক করছো না বোম্বাইমরিচ।
– ঠিক বেঠিক আয়না হিসেব করে না। আয়না যা চায় তা আদায় করেই ছাড়ে। এখন ঝটপট চুলে বিনুনি করে দিন। আজ বাচ্চা সাজতে শখ জেগেছে।

জারিফ রাগান্বিত পায়ে হেঁটে আয়নার কাছে চলে আসে। সাজিয়াকে ছোট বেলায় বিনুনি করে দিতো বিধায় কষ্ট হয়নি জারিফের। খুব যত্ন সহকারে আয়নার মাথা বেঁধে দেয়।

– জারিফ?
আয়নার মুখে এমন আদুরে ডাকে শক্ত হৃদয়ের জারিফ নরম হয়ে যায়। আনমনে উওর দেয়।

– বলো বোম্বাইমরিচ।

জারিফের প্রত্যুত্তরে আয়না মুচকি হাসে। মানুষটা যে আয়নার প্রতি দুর্বল তা আয়না পরোখ করত পারে।

– মনে করেন, আপনার বোম্বাইমরিচ কখনও দূরে চলে গেলো। এতটাই দূর যেখান থেকে ফেরা সম্ভব না। তখন আপনি কি করবেন?

জারিফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে উওর দেয়।

– আমি খুশি হবো। অন্ততপক্ষে তোমার মত সাইকো তো আমর পিছু ছাড়বে?

প্রত্যুওরে আয়না কিছু না বলে ঘুরে জারিফের বক্ষে মুখ গুঁজে। জারিফ হতভম্ব হয়ে রইলো আয়নার কাজে কিন্তু আয়নাকে ধরল না বরঞ্চ শক্ত হয়ে বসে রইলো আগের ন্যায়।
– আমাকে একটু শক্ত করে ধরুন তো! কেন যেন মনে হচ্ছে আজ আপনার সাথে আমার শেষ দেখা।

আয়নার এহেন কথায় জারিফ গলে গেলো মোমের ন্যায়। গভীরভাবে জরিয়ে নেয় আয়নাকে বক্ষগহ্বরে।

——
বর্তমানে,

ফোনের রিংটোনের আওয়াজে জারিফ অতীত থেকে ফিরে আসে।

– হ্যালো।
– ,,,,,

– আমি আসছি। ঐ কু** বাচ্চা আমার হাত থেকে আজ রেহাই পাবে না। আমার বোম্বাইমরিচকে আমার থেকে দূরে রাখার শাস্তি রকির পেতেই হবে।

পরিধানের বস্ত্র পাল্টে টি-শার্ট আর আর একটি ব্যাগে কিছু কাপড় আর শুকনো লাল গোলাপ ভরে বের হয়ে গেল জারিফ। পথিমধ্যে জারিফের মা অনেকবার ডেকেও ছেলেকে ফেরাতে পারলেন না। হতাশ হয়ে চলে গেলেন সাজিয়ার কক্ষে যেখানে সাজিয়া আহত হয়ে বিছানায় পড়ে আছে আর তার পাশে সদা আয়নার ভাই দর্পণ সেবায় রত রয়েছে।

পুরো কামড়া জুড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার। শহরের কোলাহল এর রেশ মাত্র নেই এখানে। অদূরে শুধু কয়েকটা বন্য কুকুর আর পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে।

রকি অনবরত ড্রিংক্স করেই যাচ্ছে। সামনে বিছানায় নিস্তেজ অবস্থায় পড়ে আছে আয়না। আজ দুই মাস দুই দিন হল আয়নাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে কিন্তু এই দুই মাস দুই দিনে দুই ঘণ্টার বেশি আয়না সজাগ থাকেনি। রকিকে দেখলেই এক প্রকার ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যায় তাই রকি ভীষণ রেগে আছে। যার জন্য এত কিছু করে এখন পর্যন্ত আসা আজ সেই কিনা এভাবে পড়ে আছে তা মানতে পারছে না রকি।এসব ভেবে একের পর এক নেশার্ত দ্রব্য পান করে যাচ্ছে সে। জারিন কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে আসে আয়নার কক্ষে। জারিনের শরীরের বলটুকুও নেই আয়নার মত সেও বন্দি রকির এই অন্ধকার রাজ্যে। এই দুইমাস যতবার আয়নার কাছে রকি যেতে নিয়েছিল ততবার আয়না ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে ফলস্বরূপ রকি আয়নার উপর করা অত্যাচার জারিনের উপর প্রয়োগ করেছে।

– আমাকে যেতে দাও রকি। প্রমিস করলাম কাউকে কিছু বলবো না। আমি দেশ ছেড়ে চলে যাবো।

জারিনের কথা শুনে রকি লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জারিনের পানে।

– চলে যেতে বললেই তো আর যাওয়া সম্ভব না তাই না জানেমান। তোমার কাছে অনেক সুখ পেয়েছি আরো কিছুদিন আমার অন্ধকার রাজ্যে রক্ষিতা হয়ে থাকো তারপর না হয় আমিই তোমাকে তোমার আসল ঠিকানায় পৌছে দিয়ে আসবো! এখন চলোতো, আমাকে আমার কাজ করতে দাও।

জারিনকে টানতে টানতে পাশের কামড়ায় নিয়ে যাচ্ছে রকি। জারিনের আর্তনাদ চার দেয়ালের মাঝেই সীমাবদ্ধ।

পায়ে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে জারিফ গন্তব্য সামনের চৌমাথা। যেখান থেকে জারিফ সহ আরও কয়েকজন গাড়িতে উঠবে আয়নার খোঁজ পেয়েছে সেখানে যাবার জন্য।

– আস্সালামু আলাইকুম ভাই। আমার বড়ো ভাই মারুফ। আপনাকে সিলেটে সাহায্য করবে ম্যাডামকে খুঁজতে। আমরা আপনাদের সাথে আরো কয়েকজনকে পাঠাচ্ছি চিন্তা করবেন না ম্যাডামের কোন ক্ষতি হবে না।

পুলিশ অফিসারের কথা শুনে জারিফ কিছু বলল না। আপাতত তার নজর রাস্তার অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কাপলদের উপর। যারা খুনসুটি করে রাস্তায় চলাচল করছে। গাড়িতে বসে জারিফ আবারো ডুব দিলো সেই কালো দিনটায় যেদিন তার বোম্বাইমরিচ দূরে চলে গিয়েছিল।

অতীত,

জারিফ আয়নার জন্য নিচে অপেক্ষা করছিল ঠিক তখনই জারিফের মুঠোফোন বেজে উঠে।

– কি মিস্টার তাযিন জারিফ, খুব মনোযোগ সহকারে সংসার করছেন দেখা যাচ্ছে। তা বোনের প্রতি কি একটু মায়া দয়া বলতে নেই যে দুই দিনের বৌ এর জন্য এত দরদ দেখাচ্ছন? আয়নাকে রিসিপশনের দিন ছেড়ে দিবেন কিন্তু তা তো করলেন না। সেদিন আপনার বোনের কে ছেড়ে দিয়েছিলাম বলে ভাববেন না আজও ছেড়ে দেবো। আপনার বোন এখন আমার হাতে বন্দি দেখি কি করতে পারেন। আপনার বোনের বয়স কত হবে ষোলো কি সতেরো। এই বয়সে যদি শরীরে কলঙ্কের দাগ লাগে তবে সহ্য করতে পারবেন? আপনার মা কি সহ্য করতে পারবে? এখন আপনি জানেন কি করবেন।

– আপনি কে? কি চান আমা বোনকে ছেড়ে দিন। আয়নার সাথে আপনার কি সম্পর্ক কিসের জন্য আয়নার পিছনে পড়ে আছেন? আমার স্ত্রীকে আমি খুবই ভালোবাসি ঠিক তেমনভাবে আমার বোনকেও। আমি দুজনের একজনেরও কোন ক্ষতি হতে দেবো না আপনি যত চেষ্টা করুন না কেন আমি আসছি আমার বোনকে বাঁচাতে।

– হাহাহা বোকাটা, আপনি ভুলে যাবেন না আপনার বোন আমার কবলে সুতরাং যা করবেন ভেবে চিন্তা করবেন।

জারিফ আর কিছু বলতে পারল না এর আগেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

– জারিফ।

আয়নার আওয়াজ আওয়াজ পেয়ে জারিফ ঠিকঠাক হয়ে পেছনে ফিরে। আয়না একদম স্বাভাবিক দেখে জারিফ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। জারিফ চায়না সাজিয়ার খবর পেয়ে আয়না আহত হোক।

– চলুন যাওয়া যাক আজ আমার ক্লাস তাড়াতাড়ি শেষ হবে। আপনার?

প্রত্যুত্তরে জরিফ কিছু বলল না। মলিন হাসি দিয়ে চলল ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।

রকি আর জারিফ মুখোমুখি অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। রকির হাতে সাজিয়ে হাত। সাজিয়া রক্তাক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে ঢুলছে। কপাল ফেটে রক্ত বের হচ্ছে শরীর দেখে বুঝা যাচ্ছে শরীরে আঘাত করা হয়েছে।
সাজিয়ার এমন মার্মন্টিক অবস্থা দেখে জারিফ সহ্য করতে পারেনি তাই দৌঁড়ে রাকির কাছে গিয়ে কলার ধরে অনবরত নাকে ঘুসি দিতে থাকে।
রকির চেলারা বাহির থেকে রকির আর্তনাদ শুনে ভেতরে এসে রকির থেকে জারিফকে আলাদা করে নেয়।

– তোকে আজকে মেরে ফেলবো। আমার বোনকে কষ্ট দেওয়ার শাস্তি তোকে পেতে হবে।
বলে আবার রোগীর কাছে তিনি পাল্টা আক্রমণ শুরু করে।

– বলেছিলাম না আয়নাকে আমার হাতে তুলে দিতে সেটা করিসনি। এবার মর সাথে তোর বোনকে নিয়ে।
কথাগুলো বলে জারিফ পেটে বুকে অনবরত আঘাত করতে থাকে।

জারিফকে আঘাত করা সময়ে কেউ এসে রকিকে মাথার পেছনের অংশে আঘাত করে। সাজিয়া দুর্বল শরীরা ভাবি বলে জমিনে লুটিয়ে পড়ে।

– তুমি এখান কি করতে এসেছো?
– আমার পরিবারের বিপদ আর আমি আসবো না? আমার ধারণাই ঠিক, আপনি সকালে এর সাথেই কথা বলেছেন।

আয়নার আগমনে জারিফ আরো বেশি ভয় পাচ্ছে। আয়নার রকি নামক লোকটিকে দেখলে এখনই অসুস্থ হয়ে পড়বে যা গতবার ডাক্তার বলেছিল। জারিফ কাঁপা কাঁপা গলায় আয়নাকে বলল।

– বোম্বাইমরিচ, তুমি আমার কাছে এসো। পিছনে ফিরবে না একদম। আমার বোম্বাইমরিচের কিছু হবে না।
– কি আবল তাবল বকছেন। দেখি কে আমার জানকে মারতে আসে? আয় সামনে।

আয়না চিল্লিয়ে সবাইকে ডাকছে যারা এখানে শামিল ছিলো রকির সাথে। আয়না এখন পর্যন্ত রকির চেহারা দেখেনি কেননা রকি ব্যথা পেয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে গিয়েছে।
আয়না জারিফের দিকে তাকিয়ে দেখে আঘাত পেয়ে নেতিয়ে পড়েছে তাই জারিফের কাছে এসে ধরে পাশের এক চেয়ারে বসিয়ে দেয়।

– খুব কষ্ট হচ্ছে জারিফ?
জারিফ পেটে হাত ধরে উওর দেয়।
– উহু, আমার বোম্বাইমরিচ যেখানে আছে সেখানে এই কষ্ট কিছু না।
– ভালোবাসেন আমায়।
আয়নার কথায় জারাফ এবার টলমল চোখে উওর দেয়।

– অনেক।
– বন্দি হবেন তো আমার প্রতিবিম্বে?

জারিফ এবার হাসিমুখে মাথা উপর থেকে নিচে নামায় যার অর্থ হ্যাঁ।
জারিফের কথায় আয়না অনেক খুশি হয়। ছোট বাচ্চাদের মত বসে জারিফের হাঁটুতে কান্না করে বলতে থাকে।

– আপনি অনেক পঁচা জামাইসাহেব। বাসর রাতে একা একা আদর করেছেন। প্রতিদিন আমি ঘুমের রাজ্যে থাকলে আদর দিন কিন্তু সারাদিন আপনার থেকে আদর পাবার বাহানা খুঁজি তখন দূরে সরে থাকুন। আপনার সাথে কথা নেই।

আয়নার বাচ্চামো কথায় জারিফ হাসে। অতি সমর্পণে চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে অধর ছুঁয়ে দেয়।
– ভালোবাসি বউ। দূরে চলে যেয়ো না আমাকে ছেড়ে। বাঁচবো না তোমায় ছাড়া।

জারিফ আর কিছু বলতে পারল না। এর আগেই শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করে জারিফের মাথায় ফলস্বরূপ জারিফ জমিনে লুটিয়ে পড়ে। আর এদিকে আয়নার ঘারে ইনজেকশন পুশ করে দেয়। আয়না পেছনে ফিরে দেখে রকি। অস্ফুট স্বরে আয়না রকি বলেই জ্ঞান হারায়।
আর এদিকে জারিফের মাথায় আঘাত করায় জারিফ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। চোখের সামনে তার বোম্বাইমরিচকে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে রকি কিন্তু সে কিছুই করতে পারছে না। চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। জারিফ আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করে ফেলছে। এই বুঝি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে জারিফ।

বর্তমান,

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here