#প্রমত্ত_অঙ্গনা
#লেখিকা_আরোহী_নুর
(২২)
আদ্রিশকে দেখেও না দেখার ভান করে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল আঁখি যাতে তার মনের পীড়া বেড়ে দ্বিগুণ হলো।আদৃত আদ্রিশের উপর তাচ্ছিল্য ভরা এক দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে নিজেও পাশ কেটে চলে যেতে নিলে আদ্রিশ তাকে পিছু ডাক দিলো।
দাঁড়ান ডা.আদৃত।
আদ্রিশের ডাকে আদৃত থমকে দাঁড়াল, এবার আদ্রিশ ধমকানো স্বরে বলল।
″আঁখির কাছ থেকে দূরে থাকবেন আশা করি।″
″কেনো?″
″কারণ আঁখি শুধুই আমার। ″
″তোমার ছিল কিন্তু তুমি তার মর্ম দিয়ে ওঠতে পারো নি।তাই ও কারো হোক বা না হোক তোমার তো একদমই না।″
″ভুলে যাবেন না আঁখি তখনও আমার ছিলো।″
″মনে তো তোমার রাখা উচিৎ যে আঁখি তখন তোমার ছিলো না,ওকে আমি ভিক্ষে স্বরুপ দিয়েছি তোমায়।″
কথাটা কানে যেতেই ক্ষি*প্ত হয়ে আদ্রিশ আদৃতের কলার চেঁপে ধরল,দাঁত কটমট করে বলল।
″আঁখি শুধুই আমার কথাটা ভুলে যাবেন না ডা.আদৃত, নইলে আমি আমার সীমালঙ্গন করতে বাধ্য হবো,আঁখির দিকে তোলা চোখ আমি উপরে ফেলতেও দ্বিধা করব না।″
আদৃত এবার বেশ জো*র ধাক্কা দিয়ে আদ্রিশকে সরিয়ে দিলো নিজের কাছ থেকে,আদ্রিশ অনেকটা পিছিয়ে গেল এতে,আদৃত এবার ঝাঁঝালো গলায় বলল।
সেদিনের মা*র মনে থাকলে তুমি আজ এই স্পর্ধা করতে না আদ্রিশ,আমার কলার ধরার মতো ভুলের মাশুল টা এখনি সুধে আসলে নিয়ে নিতে সক্ষম আমি তুমি তা ভালো করেই জানো,কিন্তু হাসপাতালে আমি সিনক্রিয়েট করতে চাইছি না,তাছাড়া আমার আঁখির এভাবে এসব ভালো নাও লাগতে পারে,আর আমি ওকে কোনোরকম পীড়া দান করার কথা ভাবতেও পারি না,আর যেখানে রইল কথা আঁখিকে নিয়ে,আঁখি আমার ছিল,আমার আছে আর আমারই থাকবে।মধ্যেখানে তুমি তো ছিলে শুধু ওর মনের ভুল,আঁখির জীবনের তিক্ততম অধ্যায় যা শেষ হয়ে গেছে,এখন আঁখির ভবিষ্যত জুরে শুধু আমারই অবস্থান হবে,ওকে আমি নিজের করে নিব,আগলে নিব নিজের ভালোবাসার পবিত্র বন্ধনে, পারলে ঠেকিয়ে নিও।
কথাগুলো বলে আদৃত কলার ঠিক করতে করতে চলে গেলো,আদ্রিশ অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইল তার যাওয়ার দিকে।
সার্জারির উদ্দেশ্যে যাবে আঁখি আদৃত তখনি জিসান তাদের পথ আটকালো।
″দাঁড়ান ডা.আঁখি।″
″জি, বলুন ইন্সপেক্টর জিসান?″
″আমরা আপনার বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজ চেক করেছি কাল রাত ৪ টের সময় কিন্তু আপনাকে পাওয়া যায় নি,আপনি কোথায় ছিলেন তখন?″
″এক্সকিউজ মি, ইন্সপেক্টর।আপনি একজন পুলিশ অফিসার,সব রকম যৌক্তিক জ্ঞান আপনার থাকা প্রয়োজন,এমন কোনো লোক নেই হয়ত যারা বেড রুমে সিসিটিভি ক্যামরা লাগায়,এট লাস্ট আমি এমন কাজ করার কথা কখনও ভাবতেও পারি না।আপনি সিসিটিভি ফুটেজ ভালো করে দেখেছেন নিশ্চয়ই?আমি কাল রাত প্রায় সাড়ে তিনটের দিকে আমার বেডরুমে প্রবেশ করেছিলাম সেখানে পরিষ্কারভাবেই আপনি তা দেখেছেন আশা করছি,আর তারপর আমি বেডরুম থেকে হয়ত সকাল ৭ টার দিকে বেড়িয়েছি ,এর আগে কক্ষ থেকে বেড়ুনোর কোনো ফুটেজ আপনি দেখেছেন বলে আমার মনে হয় না।দেখুন আমি এক কথা বার বার বলতে মজা পাই না,তাও আপনাকে বলছি প্রমাণ ছাড়া আঁখিকে হেনস্তা করতে আসবেন না, নইলে পরিণাম ভালো হবে না।
″আমাকে থ্রেট দিচ্ছেন!″
″আমি সোজা কথা বলেছি, আপনি থ্রেট মনে করলে করতে পারেন,আঁখির কোনো আসে যায় না।″
কথাটা জানিয়ে আঁখি চলে গেলো ওটি রুমের দিকে,আদৃত একপলক জিসানের দিকে তাকিয়ে আবার হাঁটা ধরল।″
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রিদিকা,বেশ সাজগোছ করছে,আদ্রিশের মন ভালো থাকবে না আজ সে জানে।প্রাণ প্রিয় বন্দু তার আজ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে মন মানসিকতা ভালো থাকার তো কোনো কথা না,তাই আজ সে আদ্রিশের পছন্দের খাবার রান্না করেছে নিজ হাতে,তার দেওয়া শাড়ী পরে হালকা সাজগোজ করে নিয়েছে,এবার চুল আচড়ানোর পালা,চুল আচড়াচ্ছিল হঠাৎ একগুচ্ছ চুল এমনিতেই তার হাতে চলে আসলো,স্বাভাবিক ভাবে একসাথে এতো চুল আসার কথা নয়,রিদিকার চুল এমনিতে অনেক কম পরে কিন্তু আজকে হঠাৎ এমনটা হওয়া মনে পেরেশানির যোগান দিয়ে গেল তার।
সার্জারি শেষ করে এসে আঁখি তার কেবিনে বসে আছে,আদৃত সেই রোগীর কিছু রিপোর্ট নিয়ে এলো আঁখির সাথে আলোচনা করতে।এদিকে আঁখি ডিভোর্স পেপারটা হাতে নিয়ে চোখের জল ফেলছিল,তিন বছরে গড়া সম্পর্ক,যতই তিক্তটা থাকুক না কেনো তার ভেঙে যাওয়া মেনে নেওয়ার সক্ষমতা যে কেউই সহজে আয়ত্ত্ব করে ওঠতে পারে না।আঁখির অবস্থাও যে সেই একই রকম,আদ্রিশের বা বাকি সবার সামনে নিজেকে দূর্বল পরতে না দিলেও নিজের কাছে নিজের দূর্বলতা কি দিয়ে ঢাকবে আঁখি?কেমনে দিবে মনে শান্তনা?তখন আঁখির কেবিনের দরজা একটু খোলা অবস্থায় থাকলে আদৃত তাকে কান্নারত অবস্থায় বাহির থেকেই দেখতে পায় অনেকখানি,যাতে বুকের ভিতরখানা তার মুহুর্তেই ব্যথাময় হয়ে গেলো,বুকের পীড়া দমিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে দরজায় নক করল।যাতে আঁখি হকচকিয়ে ওঠে ডিভোর্স পেপারটা সরিয়ে চোখ মুছে নিল,মুখে মিথ্যে হাসি কোনোরুপ টাঙিয়ে আদৃতকে ভিতরে আসতে বলল।
″আসলে মিসেস রেহানার রিপোর্টগুলো নিয়ে এসেছিলাম,তোমার সাথে এ নিয়ে কিছু কথা ছিল।″
″আরে আপনি কেনো এলেন,আমাকে ডাকিয়ে নিলে পারতেন!″
″তোমার যাওয়া আর আমার আসা একই ই তো।″
″আচ্ছা বসুন,দেখি রিপোর্টগুলো।″
আদৃত বসে গেলে আঁখি তার কাছ থেকে রিপোর্টগুলো নিয়ে দেখতে লাগল,আদৃত বেশ সময় তার পানে অপলকে তাকিয়ে এবার বলে ওঠল।
চাইলেও আমার সাথে সব তিক্ততা ভাগ করে নিতে পারো আঁখি,তুমিই তো বলতে তিক্ততা মনে লুকিয়ে না রেখে ভাগ করে নেওয়া উচিৎ মনের ভালোর জন্যই।
আদৃতের কথায় বেশ অবাকত্ব নিয়ে আঁখি বলল।
″আপনি কি বলতে চাইছেন পরিষ্কার করে বলবেন?″
″আমি পরিষ্কার করেই বলছি আঁখি তুমি বোঝেও না বোঝার ভান করলে তো কথা চাঁপা পরেই থাকবে।আড়ালে চোখের জল ফেলে সবকিছুর সমাধান পাওয়া যায় না আঁখি।ব্যথা লুকোলেই লুকোয় না।″
″আপন কেউ রয়ে গেলে তো শোক ভাগ করে বলে বেড়াবো।″
″কেনো?আমি কি এতই পর হয়ে গেলাম?″
″আপন কখন ছিলেন? কোনোদিনও না?তখনও পর ছিলেন আর এখনও তাই।সবাই সবকিছু, সব অনুভুতি বুঝে ওঠতে সক্ষম হয় না ডা.আদৃত।″
″হয়তবা সক্ষম ব্যক্তিকেই অক্ষম ভাবছ তুমি।″
″অক্ষম তো আমি নিজেই হলাম মানুষ চিনতে আর কতো ভুল পথে পা বাড়ানোর সাহস পাব?আমার সে ক্ষমতা যে আর নেই।″
″হ্যাঁ ভুল তো সবসময় আমিই ছিলাম,দেখো না তুমি ঠিকই জীবনে কতটা এগিয়ে গেলে আর আমি সেই শুরুতেই পরে রইলাম।চাইলেই কি কাউকে কারো জায়গা দিয়ে দেওয়া যায় জীবনে আঁখি?″
″জীবনে এগিয়ে যাওয়া টা অস্বাভাবিক কিছু না,চাইলেই জীবনকে দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া যায় কিন্তু সে প্রথম ব্যক্তির স্থান কাউকেই দেওয়া সম্ভবপর হয়ে ওঠে না ডা.আদৃত, হয়ত আপনি কখনোই সে ব্যাথার পরিমাণটা অনুভব করে ওঠতে পারবেন না।″
কথাটা আঁখি আদৃতকে ধিক্কার দিয়ে বলেছে বুঝতে পারল আদৃত,তবে আঁখি কেনো তাকে ধিক্কার দিবে এমনভাবে,আদৃত তো আঁখির জন্যই তাকে ছেড়ে গেল,কারণ আঁখি তো শুদুই আদ্রিশকে ভালোবাসত!″
আঁখি আবার বলল।
″রিপোর্টগুলো ঠিক আছে দেখছি,আপনি রোগীর ওষুধগুলো লিখে দিন আমি আজকেও ছুটি নিয়েছি, কারণ রাতে এমারজেন্সি দেখতে গিয়ে ঘুমোতে পারি নি,শরীরটা খারাপ লাগছে।চলি…″
″আমি পৌঁছে দেই।″
″লাগবে না,এমনিতেই একা নিজেকে সামলে নিতে পেরে গেছি আর কাউকে প্রয়োজন নেই।″
আদৃত তখন আঁখির চোখে ছলছল করে ওঠা জল স্পষ্ট দেখতে পেলো যা হয়ত সে গড়িয়ে পরতে না দেওয়ার সম্পূর্ণ চেষ্টা করে গেছে।
চলে গেলো আঁখি আদৃত পাথরের ন্যায় সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।
জিসান প্রমত্ত অঙ্গনা সম্পর্কে বেশ সন্ধান সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে।
এস আই সুমন উৎসুক স্বরে জিজ্ঞেস করল।
″স্যার আপনার মনে হয় না এই প্রমত্ত অঙ্গনা কোনো ছেলে?
হয়তোবা পুলিশকে বিভ্রান্ত করার জন্য নিজেকে নারী বলে দাবি করছে।″
″না, এই প্রমত্ত অঙ্গনা একজন নারীই,আর এরা একজন না দু’জন।একজন আসল আরেকজন নকল,আসল প্রমত্ত অঙ্গনার আবির্ভাব ১৩ বছর আগ থেকে হয়েছে আর নকল জনের ৪ বছর আগে।প্রমত্ত অঙ্গনা সম্পর্কে আমরা যে বিস্তারিত খবর গুলো পেয়েছি তা মোতাবেক সে আজ অব্দি যতটা খুন করেছে তাদের সবাই হয়ত পর*কীয়া কারী ছিল,নয়ত ধ*র্ষ*ক,নয়ত এমন নারীরা যারা অন্যের স্বামীকে নিজের করে পেতে চেয়েছে।আর সে সকল লা*শে*র পাশে তাদের মৃ*ত্যু*র কারণও লিখে দিয়ে গেছে,সে খুনগুলো খুব বিচক্ষণতার সাথে করে থাকে,প্রথমে শিকারকে মাথায় আঘাত করে তাকে দূর্বল করে তারপর তার উপর ছু*রি দিয়ে প্রহার করে।″
″আপনি এতো নিশ্চিত হয়ে কিভাবে বলতে পারেন প্রমত্ত অঙ্গনা দু’জন। ″
″কারণ প্রমত্ত অঙ্গনা আজ অব্দি যতটা খুন করেছে সবাই এক ধরনের অপরাধী ছিলো,সমাজের পতনের সাথে জড়িত কিছু ব্যক্তিত্ব,যাদের লা*শে*র পাশে তার নামের সাথে তাদের খু*নে*র কারণও লিখা ছিল,কিন্তু গত চার বছর আগের দুইটা খু*ন এদিকে এখন কলি আর লিজানের খুনগুলো প্রমত্ত অঙ্গনা করে নি,বরং নকল প্রমত্ত অঙ্গনা করেছে কারণ তাদের লা*শে*র পাশে নাম ব্যতীত কিছু লিখা ছিল না,যেখানে প্রমত্ত অঙ্গনা কখনও খু*নে*র কারণ লিখতে ভুল করে না।রিয়াদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী তার এক্সিডেন্টের আগে তার শরীরে ছু*রি*ঘা*ত করা হয়েছিল,আর রিয়াদ আর ইশানার খু*ন আসল প্রমত্ত অঙ্গনাই করেছে।কারণ তাদের লাশের পাশে খু*নে*র কারণ দেওয়া ছিল।
১৩ বছর আগ থেকে যখন প্রমত্ত অঙ্গনা খু*ন*গু*লো করা শুরু করেছিল তখন পুলিশের তদন্ত অনুযায়ী তার খু*ন করার ধরণ খবরের কাগজ,টিভি বা গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল,হয়তবা সেসব খবর থেকে তার খু*ন করার ধরণ আয়ত্ব করে কেউ ব্যক্তিগত শত্রুতা মিটিয়ে নিয়ে খু*ন করে প্রমত্ত অঙ্গনার নাম ব্যবহার করে বেঁচে যাওয়ার চেষ্টা করছে।এই নকল জন মাত্র ৪ টে খু*ন করেছে,কিন্তু প্রমত্ত অঙ্গনা পুরো ত্রিশটের উপর।″
″ত্রিশটের উপর! কী বলছেন স্যার?″
″হ্যাঁ সুমন,এই মাত্র আমি খোঁজ পেলাম যে গত ১৩ বছর আগ থেকে প্রমত্ত অঙ্গনা খুন করে আসছে,ইন্সপেক্টর ইশতিয়াক ছয় বছর খোঁজ করার পরও না ওকে পেতে সক্ষম হয়েছেন আর না তো ওকে দমাতে।এরপর এই পুলিশ স্টেশনে আমার আগমণ ঘটে,গত ছয় বছরে এই শহরে প্রমত্ত অঙ্গনা ধারা দু’টি খু*ন হলেও,বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে আরও ১৭ টির মতো খু*ন এখন অব্দি গণনা করা গেছে যদের খু*ন প্রমত্ত অঙ্গনা করেছে,খোঁজ নিলে হয়ত এর থেকেও বেশি খোঁজে পাওয়া যাবে,একে নিয়ে সকল পুলিশ কর্মকর্তারা নিরাশতায় ভোগছেন,কিন্তু প্রমত্ত অঙ্গনা সব থেকে বেশি খুন আমাদের ঢাকাতেই করেছে,তাই আমার যতদূর মনে হয় ওর বাসস্থান ঢাকাতেই। ওকে খোঁজে বের করার চাপটা আমার উপরই পরেছে এখন,আর আমি ওকে খোঁজে বের করবই,আমরা এই প্রমত্ত অঙ্গনাকে যতটা হালকাতে নিচ্ছি ততটা সোজা না ওকে খোঁজে বের করা,ও এক শান্ত মস্তিষ্কের সাইকো কি*লা*র,সব ধরনের যোগ্যতা ও দক্ষতা সম্পন্ন,বুদ্ধিমত্তাও প্রচুর তার।তাই ওকে খোঁজে বের করতে হলে আমাদের সেই নকল প্রমত্ত অঙ্গনা অব্দি আগে পৌঁছাতে হবে,হয়তবা ওকে ধরতে পারলে আসল জন অব্দি পৌঁছা যেতে পারে।″
চলবে…