#পর্ব_২০
#প্রহর_শেষে_আলোয়_রাঙা
লেখিকাঃ #নুুরুন্নাহার_তিথী
কিয়া ও রেদোয়ানকে নিচে বসার ঘরে বসতে বলে সে শিতল আলোকে একটা ইন*জেকশন পুশ করে দিয়ে যায় যা সকালে দিতে ভুলে গিয়েছিল। সারাদিন শেষে দুপুরের খাবারের পর রেদোয়ান ও কিয়ার যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। রেদোয়ান আর সুযোগ পায়নি আলোর ক্ষতি করার। রঞ্জনা খালা আলোর সাথে সাথেই ছিলেন তাছাড়া পিকু ও রিওও ছিল। পিকু তো রেদোয়ানকে তক্কেতক্কে রেখেছে যেনো এখনি কা*ম*ড়ে আ*হত-নি*হত করে ফেলবে! রেদোয়ান মনে ক্ষোভ নিয়েই প্রস্থান করে।
এদিকে আরমান শেখের মেডিকেল টেস্টের রিপোর্ট এসেছে। উনার ব্রেনের কিছু সেল ড্যামেজ হয়ে গেছে। ডাক্তারের ভাষ্যমতে, আরমান শেখকে দীর্ঘদিন ইলেক্ট্রিক শক দেওয়া হয়েছিল যার দরুণ তিনি কথা বলার সামার্থ্য হারিয়েছেন। সেটা সাময়িক নাকি দীর্ঘস্থায়ী তা সঠিক বলেননি। নিউরনের কিছু কোষের ড্যামেজ হয়েছে। তার স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে গেছে। তাকে কোনোকিছু নিয়ে চাপ না দেওয়াই ভালো। চাপ দেওয়া হলে তিনি পা*গলও হয়ে যেতে পারেন।
এসব শোনার পর প্রহর বাহ্যিক ভাবে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করে চলেছে। তার তো ভেঙে পরলে চলবে না। এই সময়টা তার পরীক্ষার। মানসিক পরীক্ষা। সবকিছুকে সামলে উঠতে হবে। সে যদি ভেঙে পরে তবে আড়ালের শ*ত্রু এই সুযোগটাই নিবে। সুদীপ্ত এসে প্রহরের কাঁধে হাত রেখে বলে,
“তোমাদের ফেরার ব্যাবস্থা হয়ে গেছে। আর কখনও দেখা হবে কীনা জানিনা। সময়টা খুব ভালো কেটেছে। তোমার জন্য শুভ কামনা রইল। ভেঙে পরো না। সবকিছু ঠিক হবে। তোমার জীবনেও প্রহর শেষে আলোতে রাঙবে।”
প্রহর আলতো হাসে।
“আশা করি আবারও দেখা হবে। ধন্যবাদ আপনার সুন্দর আতিথ্যের জন্য। দোয়া রাখবেন।”
বন্ধুত্বপূর্ণ ধন্যবাদ জানিয়ে সবাইকে বিদায় বলে আরমান শেখকে নিয়ে দুপুরের মধ্যে দেশে ফেরার জন্য রওনা হয়। কাঠমান্ডু পৌঁছে বিমানে ঢাকা আসবে তারপর ঢাকা থেকে সিলেট।
____________
“রেদোয়ান শাহ! হাহা। পারলে না তো নিজেকে আড়াল রাখতে। সেই তো ধরা পরলেই! নিজের রাগ, ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে অসমর্থই তোমার পরাজয়ের সূচনা। খুব শিঘ্রই তোমাতে মত্ত তোমার ভোলাভালা প্রিয়তমা! উপস, প্রিয়তমা তো একজনই হয়। তাই না? তোমার তো আবার একের অধিক! তিনজন! রাইট? খুব আফসোস হয় মেয়েগুলোর জন্য। একজনকে ভালোবেসে জীবনসঙ্গিনী করলে কিন্তু সে রইল তোমার কুৎসিত অন্তরের ধোঁ*কায়। তার থেকে পেয়েই গেলে অফুরন্ত ভালোবাসা কিন্তু বিনিময়ে সে পেলো ধোঁ*কা। হিংসার বশবর্তী হয়ে আরেকজনের থেকে জোর করে ভালোবাসা আদায় করতে গিয়ে তাকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে বাধ্য করলে। আর আরেকজন! যাকে আমি ভি*কটিম বলব নাকি কা*লপ্রিট তা নিয়েই কনফিউজড। সে তো নিজের বিবেক নিজেই বিসর্জন দিয়েছে। সেই প্রথম থেকে নিজের বান্ধুবীকে ঠকিয়ে আসছে কিন্তু তাতে সে নিজেও অবশ্য ঠকেছে। তোমার জন্য সব করেছে। যা বলেছ তাই করেছে। বিনিময়ে সে তোমার ভালোবাসা চেয়েছে যা অন্যায় কিন্তু তার নষ্ট বিবেক ও স্বভাবের কারণে পথভ্রষ্ট। অবশ্য কার মেয়ে দেখতে হবে তো! আর তুমিও তোমার ফায়দা করে গেলে। উদাহারণ তার এ*বরশন এন্ড মি*সক্যারেজ অতঃপর মে*রে ফেলার চেষ্টা। হ্যাঁ চেষ্টা! কারণ তাকে তুমি নিঃশেষ করতে পারোনি। সে আছে এবং খুব শিঘ্রই তোমার মু’খোশ খুলবে তোমার স্ত্রীর সামনে। কিয়াকে ঠকানোর প্রমান তো চয়নিকা। তাকেও পথ থেকে সরাতে চেয়েছিলে। কিন্তু নিয়তি যে নিষ্ঠুর! তুমি সত্যি যাকে ভালোবেসেছ তাকেই তুমি দিনের পর দিন ঠকিয়েছ। প্রকৃতি প্রতিশোধ পছন্দ করে রেদওয়ান শাহ। কিয়ার ঘৃণার পাত্র হতে তৈরি হও। অবশ্য সত্যি বলতে তোমার জন্য বেস্ট পার্টনার চয়নিকাই। ‘রতনে রতন চেনে’ প্রবাদ আছে না? তোমার ও চয়নিকার ক্ষেত্রেও তাই। তোমার বাবা এক ধোঁ*কাবাজ ও স্বার্থান্বেষী লোক। ধোঁ*কা করেছে তোমার মায়ের সাথে। নিজের মায়ের সান্নিধ্যে বড়ো হয়েও স্বভাব ও চরিত্র পেলে তোমার বাবার। নিজের মায়ের দুঃখও বুঝলে না। যাইহোক, তোমার ভবিষ্যতের জন্য শুভ কামনা। খুব জলদিই নিজের কর্মফল দেখতে পারবে।
~ডার্ক বাটারফ্লাই”
রেদোয়ান এই বেনামি চিঠিটা পড়ে ধপ করে সোফায় বসে পরে। চিঠিটা মুচড়ে লাইটার দিয়ে আ*গুন জ্বা*লিয়ে ভ*স্ম করে দেয়। দরদর করে অনবরত ঘামছে সে। নিজের অন্ধকার দিক সে সবার আড়ালে রেখেছে। কাউকে জানতে দেয়নি। আর চয়নিকা বেঁচে আছে! কিন্তু কিভাবে? কোথায়? এসব প্রশ্নে নিজের উপরেই তার রাগ হচ্ছে। আর রইল রিদ্ধিমা! দশ বছর আগে ধুলো পরা সেই কালো অধ্যায়। যাকে প্রহরের জীবন থেকে ছিনিয়ে নিতে ধ*র্ষ-ণ শেষে শ্বাসরো*ধ করে হ*ত্যা করেছিল সে। মেয়েটা তো তাকে ভালোবাসতে অস্বিকার করেছিল এই যা। সেই দৃশ্য দেখে ফেলায় চয়নিকার অন্তরে দা*ফন করা অনুভূতিকে জাগ্রত করে নিজের কাল অধ্যায় লুকিয়েছে। দুনিয়ার সবার সামনে সে একজন, ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, লয়াল হাজবেন্ড, সফল বিজনেসম্যান ও রিসার্চার। আজ এতো বছর পর সবকিছু নিজের সামনে ভাসছে। অজ্ঞাত সবজান্তা কে সে? এমন কেউ যে তাকে খুব ভালো করে চিনেও অভিনয় করে চলেছে দিনের পর দিন। কিন্তু সে ওই ব্যাক্তির নিঃখুত অভিনয় ধরতে পারছে না। নিজেকে এখন পাগল পাগল লাগছে তার। টেবিলের উপর থাকা কাঁচের গ্লাসটা আ*ছরে ভেঙে সেটা নিজের ডান হাতে চেপে ধরে। কিন্তু কোনো রা নেই। র*ক্তের ধারা গড়াচ্ছে তবুও সে নির্লিপ্ত। কিয়া রেদোয়ানের এই অবস্থা দেখে দৌঁড়ে এসে ডেস্ক থেকে ফার্স্টএইড বক্স নিয়ে স্যাভলন লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করতে থাকে।
স্যাভলন লাগানোতে জ্বা*লাপো*ড়ার উদ্রেক হলে হুঁশ ফিরে। এক দৃষ্টিকে কিয়ার বেদনাতুর মুখশ্রী দেখে মায়া হয়। তার মায়া, ভালোবাসা কাজ করেই তো তার সামনে বসা তার দীর্ঘসময়ের ভালোবাসার নারীটির প্রতি। বারো বছর! যখন সামনে বসা মেয়েটি পনেরো বছরের বাড়ন্ত কিশোরী তখন সে সদ্য উনিশ বছরে পদার্পণ করা তরুণ। তপ্তরোদে প্রথম সাক্ষাত অতঃপর প্রণয়। এতো মায়াবী মেয়েটির মায়ার বাঁধন ছিঁড়তে না পারলেও নিজের মনের প্রতিহিং*সা নিজের বিবেককে খোকলা করে দিয়েছে। সেখান থেকে সে ফিরতে পারবে না। তার উদ্দেশ্য সে হাসিল করবেই।
কিয়া কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,
“কি হয়েছে তোমার? এতো রাগ কেনো? মনে হচ্ছে কেউ তোমার প্রিয় কিছু ছিনিয়ে নিতে চাইছে! তুমি তো অযথা উ*গ্র আচরণ করো না। তবে আজ কেনো? দেখেছ? কতখানি কে*টেছে। র*ক্তের পরিমান দেখেছ?”
রেদোয়ান জবাব দেয় না। নিজের হার সে মানতে পারছে না। এই মেয়েটাকে হারানোর ভয় তো সাথে আছেই।
কিয়া আবার বলে,
“এখন তো তোমার রাগ-ক্ষোভ দেখা ও সামলানোর জন্য আমি আছি। কিন্তু যখন আমিও থাকব না তখন? কে সামলাবে তোমায়। নিজের যত্ন নাও রেদ।”
আচমকা কিয়ার মুখ নিঃসৃত বুলিতে রেদোয়ান ভ্রুঁকুটি করে। সন্দিহান কণ্ঠে সুধায়,
“কোথায় যাবে তুমি? হঠাৎ এরকম কথা কেনো বললে? বলো।”
“ও’মা! আমি কি চিরস্থায়ী নাকি?
‘প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।’ এটা (সূরা আল ইমরান-১৮৫, সূরা আম্বিয়া-৩৫, সূরা নিসা-৭৮, সূরা বাকারা-২৪৩, সূরা আল জুমুআহ-৮) আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনে বিভিন্নভাবে বর্ণিত আছে।
তাছাড়া মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতাটা জানো নিশ্চয়ই?
‘জন্মিলে মরিতে হবে,
অমর কে কোথা কবে,
চিরস্থির কবে নীর, হায় রে, জীবন-নদে?’
বুঝেছ? আমি আপাততো মায়ের সাথে যাব। দেখো বহুদিন যেতে দাওনি। এবার তো যাবোই। না দিলে আমি একটা দানাও খাব না।”
রেদোয়ান বিমর্ষ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ইশারায় যাওয়ার অনুমতি দেয়। কিয়া ভিষণ খুশি হয় তাতে।
_________
পরেরদিন সন্ধ্যার সময় প্রহর বাড়ি ফিরে। আরমান শেখকে নিয়ে আলোর ঘরে যায়। আলোকে নিথর ভাবে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে প্রহর ওর পাশে বসে হাত জোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। চোখ বন্ধ করে আলোর নেতিয়ে পরা হাতের উলটো পিঠে উষ্ণ চুম্বনে অশ্রুসিক্ত নয়নে নিজের হতাশা দূর করার প্রয়াস করে চলেছে। আরমান শেখ নির্লিপ্ত দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি মূলত ঠাওর করতে পারছেন না। নিয়াজ, শিতল ও রঞ্জনা খালা দরজার কাছে ভেজা নয়নে চেয়ে দেখছেন। আলোর হাত নামিয়ে রেখে প্রহর উঠে আরমান শেখের কাছে আসে। বলে,
“স্যার, ওই যে দেখুন। আপনার আলো। আপনার মেয়ে। দেখেছেন? কীভাবে নিষ্ঠুরের মতো নিথর হয়ে ঘুমিয়ে আছে। আপনার মেয়ে আমাকে একটুও ভালোবাসে না। ভালোবাসলে আমার ডাকে সাড়া দিতো। তাই না বলুন? আপনি তো ওর বাবা। আপনি ওকে উঠতে বলুন না।”
হুট করে প্রহরের প্রলাপ! নিয়াজ ওর কাছে এসে ওকে পাশ থেকে আগলে নেয় শান্তনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। আরমান শেখও প্রহরের মাথায় হাত রাখলেন।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
দুই-তিনদিন ধরে রাত সাড়ে আটটার পর বাসায় আসছি। সিনিয়রদের বিদায় ও অর্গানাইজার ব্যাচ হিসেবে এই ব্যাস্ততা। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।