#প্রহেলিকা
#পর্ব_১৫
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ।)
———————–
জেহের সেখানকার সবচেয়ে দামী হোটেলে উঠে। তবে রাফিদের খোঁজ এখনো পায়নি সে। চারিদিকে গার্ড লাগিয়ে দিয়েছে। আর শহরের সকল হোটেলগুলো চেক করতে বলেছে।
রাতের বেলায় ইনশিতা বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার কিছুই ভালো লাগছে না। মনটা কেমন কু ডাকছে। মনে হচ্ছে সামনে তার খুব বড় বিপদ। ভয়ঙ্কর বিপদ। রাফিদ খাবার হাতে প্রবেশ করে দেখে ইনশিতা রুমে নেই। খাবার রেখে সব জায়গায় খুঁজে বারান্দায় গেলে দেখতে পায় ইনশিতা বিষণ্ণ মনে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। রাফিদ যে এসেছে সে খেয়াল নেই তার। রাফিদ কিছু একটা ভেবে রুমে গিয়ে আবার ফিরে আসে। ইনশিতার সামনের চেয়ারে বসে আলতো হাতে ইনশিতার মাথায় হাত বুলায়। ইনশিতা চমকে উঠে।
-“ভাইয়া! তুমি!”
-“ভাইয়া ডাকতে বারণ করেছিলাম।”
-“সরি। আসলে মুখ ফসকে…আর হবে না।”
-“হুম। এখন বলো, তোমার ফেভারিট গান কোনটা।”
ইনশিতা এতক্ষণে লক্ষ্য করল রাফিদের হাতে গিটার। তার মানে ইনশিতার মন ভালো করার জন্যই রাফিদ গানের প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে?
-“তোমার যেটা ভালো লাগে সেটাই।”
-“আমার তো অজস্র ভালো লাগার গান আছে।”
-“সেখান থেকেই একটা গাও।”
-“আচ্ছা। হিন্দি চলবে?”
-“তোমার ইচ্ছা।”
রাফিদ খুব ভালো গান গায়। শুনলে একদম মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। ইনশিতা চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে শুনতে লাগল তার গান। রাফিদ গভীর আবেগ মেশানো গলায় গাইতে শুরু করল…
Pal ek pal, mein hi tham sa gaya
Tu haath mein haat jo de gaya
Chalun main jaha jaye tu
Dayein main tere bayein tu
Hoon rut mein hawayein tu, saathiya
Hasoon main jaab gaaye tu
Roun main murjhaye tu,
Bheegun main barsaaye tu, saathiya…
হালকা বাতাস বইছে। গা শীতল করিয়ে দেওয়া বাতাস। সেই বাতাসে ইনশিতার সামনের দিকের চুলগুলো উড়ছে, চোখ বন্ধ করে গানটা অনুভব করছিল সে। তখনই, একদম হঠাৎ করে, তার চোখে জেহেরের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে। জেহেরের রাগী চোখে তাকানো, বাচ্চাদের মতো আবদার, তার করা সব পাগলামি চোখের সামনে ভেসে উঠে। দ্রুত চোখ খুলে ইনশিতা। সে কি দেখল! জেহেরকে তো সে দূরে ঠেলে দিতে চায়। সবকিছু থেকেই। অথচ যত দূরেই ঠেলুক না কেন অবচেতন মনে বারবার জেহেরের মুখ ভেসে উঠে। ইনশিতা উঠে রুমের ভেতর চলে গেল। ইনশিতাকে চলে যেতে দেখে রাফিদ গান থামিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। যার জন্য সে গান গাইল, সে-ই যদি গান না শোনে তাহলে গান গেয়েই বা কি লাভ! রাফিদও চলল ভেতরে। ইনশিতা খাটে চাদর মুড়িয়ে শুয়ে পড়ল। রাফিদ ইনশিতার কপালে হাত দিয়ে বলল,
-“কি হয়েছে ইতু? শরীর খারাপ করলো না কি?”
ইনশিতা বিরক্তি নিয়ে রাফিদের হাত সরিয়ে দিলো। বিরক্তি ঝরানো কন্ঠেই বলল,
-“প্লিজ রাফিদ ভাই, যাও তো একটু। অনেক ঘুম পাচ্ছে আমার। ঘুমোবো আমি।”
রাফিদ অবাক হওয়ার পাশাপাশি কিছুটা ব্যথিত হলো। হঠাৎ করেই ইনশিতার এই আচরণ মেনে নিতে পারছে না সে। চাদর সরিয়ে ইনশিতার হাত ধরে টেনে তুলল। দুহাতে ইনশিতার গাল ধরে বলল,
-“কী হয়েছে ইতু? কোনো কারণে মন খারাপ? বল না ইতু। আমি কী তোকে কোনোভাবে কষ্ট দিলাম।”
ইনশিতার মেজাজ গরম হয়ে গেল। রাফিদের বুকে দুহাতে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলল,
-“তোমরা সবাই এমন কেন? হুম? সুযোগ পেলেই টাচ করার ধান্ধায় থাকো।”
-“ইতু, আমি তো শুধু গালেই…খারাপভাবে কিছু…”
-“তুমি যাবে প্লিজ। ভাল্লাগছে না আমার।”
-“ইতু…”
-“প্লিইইজ যাও।”
ইনশিতা মাথা নত করে হাত জোড় করে মাথায় ঠেকাল। রাফিদের কষ্ট লাগল কিছুটা। হঠাৎ করেই বা কী হলো ইনশিতার? কিছু না বলেই এক বুক মন খারাপ নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল রাফিদ। ইনশিতা দরজা আটকে আবার শুয়ে পড়ল। মনের ভেতরে জেহেরের আনাগোনা চলছে। সে যতই চাইছে জেহেরকে সরিয়ে দিতে ততই যেন জেহের আরো এগিয়ে আসছে। উঠে বসে মাথা চেপে ধরল ইনশিতা। জেহেরের কথা এত মনে পড়ছে কেন তার? জেহেরের কারণেই সে রাফিদের সাথে খারাপ ব্যবহার করল। বেচারার তো কোনো দোষ নেই। তাহলে হঠাৎ কী এমন হলো যে সে রাফিদের সাথে খারাপ আচরণ করে ফেলেছে? কারণটা জেহের নয়ত? জেহেরের কথা ভাবতে গিয়েই হয়ত রাফিদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে সে? রাফিদ কী খুব কষ্ট পেল? কালকে সকালেই সরি বলতে হবে। ইনশিতা মাথা চেপে আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করল। কিন্তু জেহেরের চিন্তা ভাবনা অচেতন মনেই চলে আসে। শেষমেষ মনের সাথে যুদ্ধ করে জেহেরের চিন্তা ভাবনা করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়ল।
.
.
নিকষ কালো আঁধারে ঢাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে জেহের তারা খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। নাহ, একটা তারাও নেই। আকাশটা যেন আজ কুচকুচে কালো শাড়ী পরে আছে। যাতে না আছে কোনো দাগ। বারান্দার রকিং চেয়ারে সে বসে আছে। হেলান দিয়ে বসে এক হাত হাতলের উপর ঠেকিয়ে হাতের উপর থুতনি রাখা আরেকহাতে চেয়ারের অন্য হাতলের উপর নাচাচ্ছে। জেহের শান্ত দৃষ্টিতে আকাশের পানে তাকিয়ে আছে। অথচ একমাত্র সে-ই জানে তার মন কতটা অশান্ত। মনের ভেতর তোলপাড় সৃষ্টি হওয়া ঝড়ের প্রকোপ ধীরে ধীরে বাড়ছে। রোজকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তার। ছবিতে না, একদম সরাসরি। যেখানে সে একটু করে ছুঁয়ে দিবে তার রোজকে। তাকে দেখলেই মনের ঝড় এক নিমিষেই শান্ত হয়ে যাবে। আচ্ছা! তার রোজ এখন কী করছে? তাকে কী একটু মনে করছে? তার ভালোবাসার কথা কী একটুও মনে পড়ে না রোজের? মনে না পড়ুক, তার কাছে আসলে মনে করিয়ে দেবে ভালোবাসার কথা। আর যদি ইচ্ছে করে মনে করতে না চায় তাহলে রোজকে সে কঠিন শাস্তি দেবে। ভালোবাসাময় কঠিন শাস্তি। ঐ রাফিদের সাথে তার রোজ থাকছে। রাফিদ তার রোজকে কোনোভাবে স্পর্শ করছে না তো? যদি করে তাহলে রাফিদের হাত আর হাত থাকবে না। তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে রাফিদকে মারবে সে। যেমনটা এখন সে তিলে তিলে মরছে রোজকে না পেয়ে। রোজ কী রাফিদের সাথে ইচ্ছে করেই থাকছে? ইচ্ছে করেই সে জেহেরের কাছে আসছে না? রোজ কী তাকে ভালোবাসে না? ঐ রাফিদকেই ভালোবাসবে সে? কথাটা ভাবতেই চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল জেহেরের। হাতের সামনের গ্লাসটা আছড়ে ফেলে দিলো।
উঠে দাঁড়িয়ে নিজের চুল টানতে লাগল। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। রোজ যদি রাফিদকে ভালোবাসে তাহলে রোজকে সে কি করবে নিজেই জানে না। জেহেরের কাছে আসতে না চাইলে জোর করে আটকে রাখবে তাকে। জেহেরের একা ভালোবাসাই যথেষ্ট। রোজের ভালোবাসা লাগবে না। শুধুমাত্র তার রোজ তার সামনে থাকলেই হবে। সবসময় তার চোখের সামনে। ল্যাপটপ নিয়ে আবারও বসে পড়ল সে। গার্ডসদের আশায় বসে থাকলে হবে না। সে নিজেও তার রোজকে খোঁজার প্রয়াস চালাবে। রক্তলাল চোখ নিয়ে বসে পড়ল ল্যাপটপ নিয়ে।
.
.
ইনশিতা খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখল। সে সমুদ্র পাড়ে খালি পায়ে হেঁটে চলছে। চারপাশে বালির বদলে গোলাপের পাপড়ির ছড়াছড়ি। নীল পানির উপরেও গোলাপের পাপড়ি ভেসে বেড়াচ্ছে। মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। তার পরনে লাল শাড়ি। টুকটুকে বউয়ের মতো লাগছে তাকে। একটু সামনেই দেখতে পেল তার বাবা মা আর নয়নিকা তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে এগিয়ে দাঁড়াল তাদের সামনে। তখনই তার হাতে কারো হাতের অস্তিত্ব অনুভব করল। দেখল পাশে কালো শার্ট প্যান্ট পরা হাসিমুখে জেহের দাঁড়িয়ে আছে। জেহের সকলের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে ইনশিতাকে নিয়ে চলল। সকলে হাসিমুখে হাত নাড়িয়ে বিদায় দিচ্ছে। দূরে আসতেই সে দেখল জেহেরের মুখে হাসি নেই। চোখ লাল করে মুখ গম্ভীর করে আছে। ভয়ঙ্কর লাগছে দেখতে। ইনশিতা পেছনে ফিরে দেখল বাবা মা আর নয়নিকা সেই আগের ভঙ্গিতেই হাত নাড়িয়ে তাকে বিদায় দিচ্ছে। তাদের চোখের পানি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ইনশিতা। তাদের কান্না দেখে ইনশিতা দৌড়ে চলে আসতে চাইল। তিন কি চার কদম পা ফেলেছে ফিরে যাওয়ার জন্য আর তখনই জেহের পেছন থেকে একহাতে ইনশিতার মুখ চেপে ধরল আরেকহাতে তার পেট ছাড়িয়ে দু’হাত শক্ত করে চেপে ধরল। বন্দী করে নিলো নিজ বাহুডোরে। ইনশিতার দম নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। জেহের তার কানের কাছে ভয়ঙ্কর সুরে বলল,
-“তোমার ঠাঁই তো আমার কাছে, আমার এই বুকে। তাহলে কোথায় যাচ্ছ তুমি রোজ? আমি ছাড়া আর তোমার কেউ নেই এই পৃথিবীতে। তোমার সবকিছু আমি। এই জেহের।”
বলতে বলতে ইনশিতার মুখ আরও শক্ত করে চেপে ধরল। সে দেখল তার পরনের লাল শাড়ি ক্রমশ কুচকুচে কালো রঙে পরিণত হলো। বাবা মা নয়নিকাকে দেখাই যাচ্ছে না। চারপাশের গোলাপের পাপড়ি কালো হয়ে গেল। আকাশ ঘন মেঘে ছেয়ে গেল। সমুদ্রের পানি গর্জন করে বড় বড় ঢেউ তুলতে লাগল। চারপাশের সবকিছুই তার কালো লাগল। একসময় তার নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়েই গেল।
ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠল ইনশিতা। তার পুরো শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার। রুমে এসি থাকা সত্ত্বেও ঘামে জবজবা হয়ে গেছে। ইনশিতা দ্রুত ঢকঢক করে পানি পান করল। এটা তো সুন্দর স্বপ্ন না। ভয়ঙ্কর স্বপ্ন। ইনশিতা ওড়না দিয়ে ঘাড় গলা মুছে নিলো। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। রাতের অন্ধকার কাটিয়ে ভোরের আলো ফুটবে ফুটবে করছে তখন। তবে এখনো ভালো করে আলো ফোটেনি। এমন ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখার মানে কী? কোনো বিপদের আগমন নয়ত? জেহেরের মতো বড় বিপদ আর কোনটা আছে না কি? জেহের তার জীবনে অশুভ সেটা বোঝায়নি তো স্বপ্নের দ্বারা? কিন্তু আসলেই তো জেহের একটা অশুভ। যত ঝামেলায় পড়েছে সে সব ঝামেলা জেহেরের কারণেই। এই স্বপ্নে স্পষ্ট বুঝিয়েছে জেহের ইনশিতাকে সবসময় বন্দী রাখবে। ভেবেই নিজের মাথা নিজে চাপড়াল ইনশিতা। জেহেরের কাছে আর সে কখনোই তো বন্দী হবে না। জেহের তো কখনোই খুঁজে পাবে না তাকে। সে তো এখন নতুন জীবন গড়বে রাফিদের সাথে। তার স্বপ্নের জীবন। তখন জেহেরকে নিয়ে বেশি বেশি ভাবায় জেহেরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে সে। ধুর! স্বপ্ন আবার সত্যি হয় না কি? সে নিজেই বেশি বেশি ভাবছে।
ইনশিতা স্বপ্নের ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেরে ফেলতে চাইল। কিন্তু কিছুতেই মাথা থেকে নামছে না। স্বপ্ন ভুলতে সে অন্য একটা ব্যাপার মাথায় আনল। তার মনের মতো সংসার। যেখানে অফুরন্ত ভালোবাসা থাকবে। সে তার তার প্রিয় মানুষটি একসাথে হাতে হাত ধরে রাস্তার পাশে হাঁটবে। কখনো কখনো ক্লান্ত হয়ে টঙে বসে চা খাবে। নদীর পারে হাঁটতে যাবে, আরো কত কী যে করবে! কিংবা রাতের বেলায় ঘুম থেকে তুলে ফিসফিস করে ভালোবাসি বলবে। হুট করেই তার প্রিয় মানুষটিকে ছোট ছোট সারপ্রাইজ দিবে। সে কী খুশি হবে? তাকেও কী আবার সে সারপ্রাইজ দিবে? এসব ভাবতে ভাবতে ইনশিতার মনে হলো তার প্রিয় মানুষ তো হবে রাফিদ। আসলেই কী? রাফিদের সাথে তার জমানো সব কল্পনা বাস্তবে রুপ নিবে। সবকিছুই রাফিদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে করবে। রাফিদের কথা মনে হতেই গতরাতের ঘটনাটা মনে পড়ে গেল তার। কী খারাপ ব্যবহারটাই না করেছে সে! রাফিদ তো তাকে উল্টো বাঁচিয়ে ছিল জেহেরের হাত থেকে। আর সে কিনা! তার ক্ষমা চাওয়া উচিত রাফিদের কাছে।
সকালে জুনের সাহায্যে রাফিদের রুম খুঁজে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল ইনিশতা। সে কি ভেতরে ঢুকবে? দোনোমনো করতে করতে দরজায় টোকা দিয়েই ফেলল। কয়েক মিনিট যেতেই দরজা খুলল রাফিদ। ইনশিতা কীভাবে সরি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। আমতা আমতা করতে করতে বলল,
-“আসলে, গতকাল, মানে… আমি সরি। গতকাল মনটা ভালো ছিল না তাই তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি। আমি সত্যিই সরি।”
রাফিদ হাসিমুখে বলল,
-“সমস্যা নেই ইতু। আমিও বুঝেছিলাম কালকে হয়তো কোনোকারণে তোমার মন খারাপ ছিল। অত ভেব না। কিছু মনে করিনি।”
ইনশিতা মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। রাফিদের সাথে অমন আচরণের কারণে তার নিজেরও খারাপ লেগেছিল। এত সহজে রাফিদ ব্যাপারটা মানিয়ে নিবে ভাবতেই পারেনি সে। রাফিদ আর ইনশিতা মিলে নাশতা করল। নাশতা শেষে রাফিদ ইনশিতাকে নিয়ে বের হল।
-“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
-“এমনিতেই এদিক ওদিক। রুমে বসে বোর হবা, তাই ঘুরে টুরে আসলে মন ভালো থাকবে।”
ইনশিতার ইচ্ছে ছিল না যাওয়ার। তার মনটা কু ডাকছে। তবুও রাফিদের জোরাজুরিতে গেল। দুজনে একসাথে হাঁটতে বের হয়েছে। রাফিদ ইনশিতার হাত ধরলে ইনশিতা হাত সরিয়ে নিলো। তার কেমন অস্বস্তি লাগছিল রাফিদ হাত ধরাতে। এমনকি রাফিদের পাশ ঘেঁষে হাঁটতেও। পুরো দুপুর পর্যন্ত এদিক সেদিক ঘুরেফিরে মার্কেটে গিয়ে পৌঁছল। রাস্তার দুপাশে সারি সারি মার্কেট। ইনশিতা মার্কেটের জিনিসগুলো ছুঁয়ে দেখছে। রাফিদ বলল,
-“তোমার যা ইচ্ছা কিনতে পারো ইতু। টাকা নিয়ে ভেবো না। যেটা পছন্দ হয় আমাকে বলবে শুধু।”
ইনশিতা পছন্দ মতো জিনিস দেখছে আর রাফিদ ফোনে কথা বলতে বলতে ইনশিতার পাশাপাশি হাঁটছে। মার্কেটের ভেতরে ঢুকে খেয়াল করল রাফিদ তার পাশে নেই। আশেপাশেও কোথাও নেই। ইনশিতা ভয় পেয়ে গেল। তখনই রাফিদ তার পাশে এসে দাঁড়াল। ইনশিতা হাফ ছেড়ে বাঁচল। ভয়ার্ত কন্ঠে বল,
-“কোথায় গিয়েছিলে তুমি? কত ভয় পেয়েছিলাম জানো?”
রাফিদ ফোনটা কান থেকে সরিয়ে বলল,
-“রিল্যাক্স ইতু। আমি আশেপাশেই ছিলাম। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তুমি ঘোরাঘুরি করো আমি তোমায় চোখে চোখেই রাখব যাতে হারিয়ে না যাও।”
ইনশিতা আবারও মার্কেট ঘুরতে লাগল। স্টিলের সাজ করা কিছু চুড়ি রাফিদের পছন্দ হলো। সে কিনে ইনশিতার হাত ধরে পড়িয়ে দিলো। সাথে কয়েকটা আইসক্রিম কিনে দিলো। ইনশিতা হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা দুরে এসে পড়ল। তার খেয়ালই ছিল না যে রাফিদ তার সাথে আছে। মনে হয়েছে রাফিদ তো তাকে চোখে চোখেই রাখছে।
ইতিমধ্যে সন্ধ্যা নেমে এলো। মার্কেটের শেষ মাথায় এসে গেল সে। এখানেও ভীড় কম না। আইসক্রিম খেতে খেতেই চারপাশের সুদীর্ঘ বিল্ডিংয়ে চোখ বুলিয়ে কোন রাস্তায় এসে গেল সে নিজেই জানল না। কয়েকটা গাড়ি এসে শাঁ শাঁ করে পাশ কেটে চলে যাচ্ছে। আলো ঝলমল করছে পুরো রাস্তায়। চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে একবার পেছন ফিরল। আচমকা তার মনে পড়ল সে একা। তার বুকটা ধ্বক করে উঠে। একা একা কোথায় চলে এসেছে সে নিজেই জানে না। পেছনের রাস্তাটাও গোলমালে লাগছে। তিন তিনটা রাস্তার কোনদিক দিয়ে সে এসেছিল ভুলেই গিয়েছে। মস্তিষ্ক চলাচল যেন বন্ধ করে দিলো হঠাৎ। ইনশিতা ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকাল। এখানকার রাস্তাটা পুরোটাই নির্জন। সে যাবে কীভাবে? রাফিদ কোথায়? রাফিদ তো বলেছিল তাকে চোখে চোখে রাখবে। জোরে জোরে চেঁচাল ইনশিতা।
-“রাফিদ! রাফিদ! কোথায় তুমি? রাফিদ।”
আরো কয়েকবার চেঁচিয়ে সে তিন রাস্তার এক রাস্তায় চলে গেল। সব জায়গায় আলো এমন ভাবে ঝলমল করছে মনে হচ্ছে সে বারবার একই জায়গায় ফিরে আসছে। ইনশিতার ঘাম ছুটতে লাগল। আইসক্রিম গলে তার হাতে মাখামাখি হয়ে গেল। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই ইনশিতার। এমন অচেনা একটা শহরে একা একা হারিয়ে গেল সে, ফিরবে কীভাবে?
চারপাশে হাঁটতে হাঁটতে কিছু লোকের দেখা পেল। তবুও সাহস করে কিছু বলতে পারল না সে। যদি লোকগুলো খারাপ হয়? যদি কিছু করে ফেলে? সে দৌড়াতে লাগল রাস্তায়। যদি কোনোভাবে কোনো মার্কেটের দেখা মেলে! একসময় ক্লান্ত হয়ে দৌড়ানো বন্ধ করল। সন্ধ্যা আরো গাঢ় হয়ে এলো। ইনশিতার মনে হলো কেউ তার পিছু নিচ্ছে। আর তীক্ষ্ণ নজরে দেখছে। অথচ পেছনে কেউ নেই। ইনশিতার আরো ভয় হতে লাগল। দ্রুত পা চালাল যেদিকে চোখ যায় সেদিকে। তবুও যেন শকুনের মতো কারো তীক্ষ্ণ নজর তার উপরেই রয়েছে, এমন লাগছে তার। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। একবার এই রাস্তা তো আরেকবার ঐ রাস্তায় হেঁটে চলছে সে। তবুও দেখা মিলছে না ভরসা পাওয়ার মতো কাউকে।
একসময় ক্লান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল ইনশিতা। কোমড়ে হাত দিয়ে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে আর চোখ বুলাচ্ছে সামনের দিকটায়। সামনে ফাঁকা রাস্তা ছাড়া আর কিছুই নেই। রাস্তা হারিয়ে এখন পথে বসে কান্না করা ছাড়া আর উপায় নেই। তখনই পেছন থেকে খুউব চেনা কারো গম্ভীর কন্ঠস্বরের ঝংকার তোলা আওয়াজ শুনতে পেল সে। ভয়ে ইনশিতার রগে রগে শিহরণ বয়ে গেল সেই ঝংকার তোলা ভারী কন্ঠের আওয়াজ কানে আসতেই।
-“Are you lost baby girl?”
#প্রহেলিকা
#পর্ব_১৬
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ।)
———————–
ইনশিতা ভয়ে ভয়ে পেছন ফিরল। ভুত দেখার মত চমকে উঠল সে। ওর হার্ট বের হওয়ার উপক্রম প্রায়। ব্ল্যাক হুডি, ব্ল্যাক জিন্স, ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট স্নিকারস, এক হাত জিন্সের পকেটে ঢুকানো, আরেকহাতে কপালের মসৃণ চুলগুলো পেছনে ঠেলছে, ঠোঁটে ঘায়েল করা বাঁকা হাসি, হাতে ব্ল্যাক ওয়াচ, চোখে হারিয়ে যাওয়া জিনিস খুঁজে পাওয়ার আনন্দ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জেহের। ইনশিতার অবচেতন মন এক সেকেন্ডের জন্য বলতে চাইল, ‘হ্যাঁ রে পাগল, আমি হারিয়েছি তো, তোর ঘায়েল করা রূপে হারিয়েছি আমি।’ কিন্তু তৎক্ষণাৎই ইনশিতার হুশ ফিরল। সে কী স্বপ্ন দেখছে না কি? জেহের এখানে কীভাবে আসবে? জেহের তো জানেই না যে সে এখানে। চোখ ভালো করে একবার কঁচলে নিলো ইনশিতা। এটা নিশ্চয়ই ভ্রম! কিন্তু সত্যিই তো জেহের তার সামনে দাঁড়িয়ে। আর একটু একটু করে এগিয়ে আসছে তার দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার হাত টান লাগল। জেহের এক হাত ধরে টানছে। ইনশিতা জোরে একটা চিৎকার দিলো। জেহের কানে হাত দিয়ে চেহারায় বিরক্তি ফুটিয়ে বলল,
-“ওহ, রোজ। এত চেঁচাচ্ছ কেন সোনা? আমি জানি তোমায় কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছে ঐ বাস্টার্ড রাফিদ। এখন তোমার চিন্তা নেই। তোমার জেহের এসে গেছে না।”
ইনশিতা ভয়ে ভয়ে বলল,
-“আমি যাবো না কোথাও।”
-“কেন? ঐ রাফিদ তো তোমাকে জোর করে এনেছে। তুমি তো ওর কাছে থাকতে চাও না। ওর ব্যবস্থা পরে করব। আগে তোমায় নিয়ে ফিরি।”
-“আমি রাফিদের কাছে যাব। ও আমাকে জোর করে আনেনি।”
জেহের চোয়াল শক্ত রেখে বলল,
-“ও, তার মানে তুমি ইচ্ছে করেই ঐ রাফিদের কাছে থাকতে চাও? আমার সাথে যেতে চাও না?”
-“না। ছাড়ুন আমায়। আমি আপনার সাথে কোথাও যাবো না।”
জেহের ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,
-“রোজ! তুমি এটা নিশ্চয় ভুলে যাওনি যে জেহের বেঁচে থাকতে রোজ কারো হতে পারে না? চলো চলো, আমাদের এখনি ফিরতে হবে। আবার বিয়ের আয়োজন করতে হবে না? তোমার কারণেই দেরী হয়ে গেছে; আর দেরী করতে চাই না। আজই ফিরে গিয়ে বিয়ে করবো। তারপর…”
ঠোঁট কামড়ে হাসল জেহের। থেমে বলল,
-“আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু বি লেইট এনিমোর। লেট’স গো মাই লাভ।”
ইনশিতা মূর্তির মতোই দাঁড়িয়ে আছে। সে বিশ্বাসই করতে পারছে না জেহের এটা। কিন্তু জেহের তার হাত ধরে তাকে টানছে তার মানে এটা ভ্রম না। সত্যি সত্যি জেহের চলে এসেছে তার কাছে। ইনশিতা হাত ছাড়াতে চেয়েও পারল না। লোহার মতো শক্ত হাতের শক্তির কাছে তার নরম হাতের শক্তি তুচ্ছ। জেহের টেনে হিঁচড়ে তাকে গাড়ির কাছে নিয়ে যাচ্ছে। ইনশিতার মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধির উদয় ঘটল। তাড়াহুড়া করে বলতে লাগল,
-“জেহের, দেখুন দেখুন।”
জেহের ভ্রু কুঁচকে যেই না পেছন ফিরল তখনই ইনশিতা ইনশিতা হাতে থাকা আইসক্রিম জেহের মুখে ছুঁড়ে মারল। রেগে উঠল জেহের,
-“হোয়াট দ্যা..!”
জেহেরের পুরো মুখে ছড়িয়ে আছে আইসক্রিম। যার কারণে জেহের হাত ছেড়ে নিজের মুখের আইসক্রিম সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এই সুযোগে ইনশিতা নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে জেহেরের বুকে জোরে ধাক্কা মারল। জেহের ছিটকে পড়ল রাস্তায়। চোখেমুখে আইসক্রিমের জন্য কিছুই ঠাওর করতে পারল না। ইনশিতা দিলো ভো দৌড়। যেখানেই চোখ যায় সেখানেই ছুটতে লাগল। তার একটাই কথা, যে করেই হোক, জেহেরের থেকে দুরে পালাতে হবে। ছুটতে ছুটতে কারো সাথে ধাক্কা খেল ইনশিতা। দেখল রাফিদ দাঁড়িয়ে আছে। চোখমুখে আতঙ্ক ইনশিতাকে খুঁজে না পাওয়ায়। রাফিদ হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগল,
-“কোথায় গিয়েছিলে তুমি? কত জায়গায় খুঁজেছি তোমায়।”
ইনশিতা সেই জবাব না দিয়ে বলল,
-“আমি-আমি, ঐ জেহের, এখানে…”
-“কী বলছো ইতু?”
ইনশিতার সব কথা এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল। কিছুই গুছিয়ে বলতে পারল না।
-“বলো, কোথায় গিয়েছিলে? পুরো মার্কেট খুঁজলাম তোমায়, পেলাম না। কোথায় গিয়েছিলে?”
-“আমি হাঁটতে হাঁটতে কোথায় এসে পড়েছিলাম জানি না। তবে রাফিদ, আমি জেহেরকে…”
-“ওয়েট। রাফিদ বললে! যাক বাবা, শেষ পর্যন্ত ভাই ডাক বন্ধ করতে পেরেছি তাহলে।”
ইনশিতা ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,
-“আমি জেহেরকে দেখেছি। একটু আগে, উনি আমার হাত ধরে নিয়ে যেতে চাইছিল। উনি খোঁজ পেয়ে গেছেন আমার।”
রাফিদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে হো হো করে হেসে উঠল। যেন ইনশিতা পৃথিবীর সবচেয়ে মজার জোকস বলেছে। হাসতে হাসতে চোখে পানিও এসে গেছে। হাসি থামিয়ে কোনোরকম পেট চেপে বলল,
-“তুমি মজা করছো ইতু? জেহের এখানে কোথা থেকে আসবে? তুমি কাকে দেখতে কাকে দেখে ফেলেছ…”
-“আমি সত্যি বলছি রাফিদ। জেহের এখানেই আছে। বিশ্বাস করো। উনি…উনি আমায় আবার নিয়ে যাবে… আমাকে বন্দী করে রাখবে।”
বলতে বলতে কেঁদেই ফেলল ইনশিতা। রাফিদের খারাপ লাগল। ইনশিতা হয়ত পথ হারানোর ভয় থেকে এখনো বেরোতে পারেনি। আর জেহেরের ভয় মন থেকে কাটেনি, তাই হয়ত মনের ভুলে বকছে। রাফিদ শান্তনা স্বরে বলল,
-“ইতু, দেখো, জেহের নেই এখানে। ওটা তোমার মনের ভুল জাস্ট। আর কিছুই না। জেহেরের কখনো জানতেও পারবে না আমরা এখানে। ইট’স ইম্পসিবল ফর হিম।”
-“তাই নাকি মি. রাফিদ? ইজ ইট রিয়েলি ইম্পসিবল? দ্যান লেট মি ক্লিয়ার ইউ, নাথিং ইজ ইম্পসিবল ফর জেহের চৌধুরী।”
ইনশিতা আর রাফিদ চমকে পেছনে তাকাল। দেখল জেহের দুই পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে বাঁকা হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এবার রাফিদও নিজেও বেশ চমকাল। দু চোখ যেন বের হয়ে যাবে এমন। জেহের এক হাত বের করে চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বলল,
-“‘পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে’দ্যা প্রভার্ব ফিটস ইউ পারফেক্টলি মি. রাফিদ।”
বলেই ঘায়েল করা বাঁকা হাসি হাসল আবার। রাফিদ ইনশিতার এক হাত শক্ত করে ধরলে যেই দৌড়াতে যাবে তখনই চারপাশ ঘিরে ধরল কালো পোশাক পরিহিত গার্ড। রাফিদের নিজেরও অসহায় লাগতে লাগল। যেখানে জেহের একা তাকে মেরে ফেলতে পারে সেখানে এতগুলো গার্ডের মার খেলে এক সেকেন্ডও লাগবে না ওপারে চলে যেতে।
ইনশিতার পা থরথরিয়ে কাঁপছে। যেকোনো মুহূর্তে পরে যেতে পারে সে। ইনশিতা শক্ত করে ধরল রাফিদের শার্ট। অথচ ও জানেই না, এই ধরার জন্য রাফিদকে চরম মূল্য দিতে হবে। জেহের এগিয়ে আসল ইনশিতার সামনে। একদম কাছাকাছি। জেহেরের মুখমন্ডল ভেজা। বোধহয় ধুয়েছে। চুল বেয়ে গড়িয়ে পানি পড়ছে গোলাপী ঠোঁটে। ইশ! ঘোর লাগানো দৃশ্য। জেহের এক ঝটকায় ইনশিতাকে কাঁধে তুলে নিলো। যার কারণে ইনশিতা পেটে কিছুটা ব্যথা পেল। গার্ডসদের ইশারা করে ইনশিতাকে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দিলো।
ইনশিতাকে ফ্রন্ট সিটে বসিয়ে নিজেও যেই বসতে যাবে তখন ইনশিতা দরজা খুলে আবারও ভো দৌড়। তবে এবার রাফিদের কাছে দৌড়ে গেল। গন্ডারের মতো দেখতে গার্ডসরা রাফিদকে মারতে আসছে। একজনের একটা ঘুষি খেলেই তো হ্যাংলা পাতলা রাফিদ পগারপার। ইনশিতা রাফিদের কাছে পৌঁছতেই জেহের দৌড়ে এক হাতে কোমড় পেঁচিয়ে ধরে উঠিয়ে নিলো ইনশিতাকে। এক হাতে উঠিয়েই গাড়িতে ঢুকিয়ে এবার ব্যাক সীটে ছুঁড়ে মারল জেহের। নরম গদির কারণে একটুও ব্যথা পায়নি ইনশিতা। ইনশিতা উঠতে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখল গাড়ি অলরেডি চলতে শুরু করেছে।
ইনশিতার বুদ্ধি যে একেবারেই কম তা না। রাস্তাঘাটে হাঁটতে চলতে কীভাবে নিজেকে বাঁচাতে হয় সেটা কিছুটা হলেও জানে সে। যেভাবে তখন জেহেরের মুখে আইসক্রিম ছুঁড়ে হাত থেকে পালিয়েছিল সেভাবেই এখন পালাবে। এবার যা করবে সেটা ভাবতে ইনশিতা বেশ কয়েকবার ঢোক গিলল। জেহের লুকিং গ্লাসে ইনশিতাকে দেখছে আর গাড়ি চালাচ্ছে। রাস্তা ফাঁকা হওয়ায় গাড়ি চালাতে অসুবিধা হচ্ছে না তার। ইনশিতা একবার হাতের দিকে তাকায় আরেকবার জেহেরের দিকে। হাতের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল ইনশিতা।
-“আল্লাহ দেখুন আমার হাতে কী?”
বলে ইনশিতা দুই হাত জেহেরের মুখের সামনে নিয়ে গেল। জেহের দেখতে যাবে কী আছে হাতে সেই মুহুর্তে ইনশিতা নিজের মিডিয়াম সাইজের নখ দিয়ে জেহেরের দুগাল চেপে ধরতে চাইল। উদ্দেশ্য জেহেরকে খামচিয়ে গাড়ি থামানো। কিন্তু এবার আর সফল হতে পারল না ইনশিতা। খামচি দেওয়ার আগেই জেহের দুহাতে ইনশিতার হাত ধরে ফেলল। ইনশিতার এবার ভয় হতে লাগল। জেহের বিরক্তি নিয়ে গাড়ি থামিয়ে ব্যাক সীটে আসল। ইনশিতার ওড়না খুলে জোর করে হাত বেঁধে দিলো। ক্রুদ্ধ হয়ে বলল,
-“আমি আগেই জানতাম তুমি কিছু একটা করবে। কিন্তু এমন বোকার মতো কাজ করবে সে ভাবতে পারিনি। নেক্সট টাইম এসব মাথায়ও এনো না। রেজাল্ট খারাপ আসবে।”
ইনশিতার মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
-“ফুল গার্ল।”
জেহের গাড়ি চালানো শুরু করল। ইনশিতার বলার আর কিছুই নেই। সীটে চুপচাপ বসে ভাবছে আগামী দিনের কথা। এবার তো জেহের তাকে বিয়ে করেই ছাড়বে। তারপর সে হবে জেহেরের বন্দিনী। সব কিছু জেহেরের আদেশ মতো করতে হবে। ভাবতে ভাবতে ইনশিতার চোখের কার্ণিশ গড়িয়ে নোনাজল পড়ল।
.
রাফিদ বেধড়ক মার খেয়ে পড়ে আছে। আধমরা হয়ে আছে সে। বাকিটা জেহের মারবে। তাই একজন গার্ড রাফিদের হাত ধরে টেনে গাড়িতে উঠায়। পুরো হাত মুখ, পা রাস্তার সাথে লেগে ছিলে গেছে। গালের এক সাইড গড়িয়ে তাজা লাল রক্ত পড়ছে। গাড়ি ছুটল গন্তব্যে। গার্ডসরা আফসোস করতে লাগল রাফিদের অবস্থা কী হবে ভেবে। একজন বলল,
-“হুদাও স্যারের সাথে লাগতে গেছিলি ক্যান? প্রাণের ডর ভয় নাই? স্যার যা চায় তা এমনি এমনি নেয় না, কাইড়া নেয়। সাত বছর ধইরা আছি। চিনি তো স্যারেরে। একবার এক মেহমান আইছিল স্যারের বাসায়। তার চৌদ্দ বছরের ছেলে ভুলে স্যারের প্রিয় একখান শোপিস ভাইঙ্গা ফেলাইছিল। স্যারের সে কী রাগ! ভাইরে ভাই! মেহমানের সামনেই তার পোলারে দু’হাত বাইধা পুলে ফালায় দিছিল। কেউ আটকাইতে পারছিল না। পোলারে শাস্তি দিতে পাইরা স্যারের চোখেমুখে কেমন ভয়ংকর হাসি! পরে ঐ পোলারে আল্লাহ রহমতে বাঁচান গেছিল। তয় হাসপাতালে থাকতে হইছিল অনেকদিন। ঐ মেহমান তো আর ভুলেও এই বাড়ির দিকে আর চোখ উডায় নাই। আর তুই তো স্যারের জানরে কাইড়া নিতি চাইছিলি। এবার স্যার যে তোর কী করবো, আল্লাহ মালুম।”
বলে মুখ দিয়ে আফসোসোর আওয়াজ করল। কিন্তু রাফিদ কী আর সেসব শুনেছে? সে তো অজ্ঞান হয়ে আধমরা।
.
.
জেহের ইনশিতাকে সেই আগের মতোই কাঁধে তুলে হোটেলের রুমে নিয়ে আসে। ইনশিতাকে খাটে শুইয়ে হাতের ঘড়ি খুলতে লাগে। তারপর গায়ের হুডিটা খুলে দূরে ছুঁড়ে ফেলে। ইনশিতা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। জেহের কী করতে চলেছে সে কিছুটা মাত্র আন্দাজ করতে পারলেও পুরোপুরি নয়। জেহের ক্রমাগ্রহ হিংস্র হয়ে উঠছে। চোখমুখ রক্তিম। যেন এতক্ষণ ধরে রাগটা নিজের ভেতর চেপে রেখেছিল, আর এখন সুযোগ পেয়েছে রাগ ঝাড়ার। ইনশিতার হাতের বাঁধন খুলতে ইনশিতাকে খাটে উল্টে ফেলল। হাতের বাঁধন খুলে ইনশিতাকে সোজা করল। ইনশিতার এবার আর বুঝতে বাকি রইল না জেহের কী করবে? চোখে আবার অশ্রু জমতে লাগল। জেহেরের থেকে দূরে যাবার জন্য সরতে জেহের দুহাত দুদিকে রাখল। উপরে জেহের, নিচে খাট, দুপাশে হাত, বন্দী হয়ে গেল ইনশিতা। জেহের দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
-“খুব শখ না ঐ রাফিদের কাছে যাওয়ার? ওর হাত জড়িয়ে ধরার? তাহলে চলো, আজ সেই শখ মিটিয়ে দেব তোমায়।”
বলেই একদম শরীরের ভার ছেড়ে দিলো ইনশিতার উপর। ইনশিতা ব্যথাতুর আওয়াজ তুলে জেহেরকে সরতে বলল। জেহের তো সরবেই না। এত ভারী মনে হচ্ছে তাকে পাথরে চাপা দেয়া হয়েছে। জেহের ইনশিতার চুল হাতে নিয়ে শুকতে লাগল। আরেকহাতে ইনশিতার গলায় হাত বুলাতে লাগল। ইনশিতা ভয়ে কেঁদে ফেলল। কান্নাকাটি করে আকুতি মিনতি করতে লাগল জেহেরের কাছে,
-“প-প্লিজ জেহের। দোহাই লাগে, আমায় ছেড়ে দিন। আ-আমি আর কোত্থাও যাবো না। আমি-আমি, এখন আপনার কাছেই থাকব, তবুও এমন ক্ষতি করবেন না আমার। প্লিজ…”
জেহের রক্তবর্ণ চোখ তুলে তাকাল।
-“তুমি পুরো একটা দিন রাফিদের সাথে থেকেছ, এর শাস্তি আগে তো তোমায় দিয়ে নিই।”
ইনশিতার ঘাড়ে মুখ গুঁজল জেহের। ইনশিতার কান্না বেড়েই চলেছে। এ কোন বিপদে পড়ল সে? শেষ সম্বলটুকুই এখন না জানি হারাতে হয়! জেহের ইনশিতার কাঁধে খুব জোরে কামড় দিলো একটা। ইনশিতা চিৎকার করে উঠল। কান্নার চোটে কিছুই বলতে পারছে না সে। এমন করে আরো কয়েকটা কামড় দিয়ে জোরে জড়িয়ে ধরল ইনশিতাকে। কান্নার কারণে এমনিতেই ইনশিতার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল তার উপর জেহেরের জড়িয়ে ধরায় যেন দম বন্ধ হয়ে যাবে এমন অবস্থা। জেহের একনাগাড়ে বলতে থাকল,
-“তুমি চলে আসার পর জানো আমার কত কষ্ট হয়েছিল? আমাকে রেখে কী করে পারলে ঐ ছেলেটার সাথে চলে যেতে? আমার কী কমতি আছে? হু? টাকা পয়সা, ভালোবাসা, সব সব আছে আমার। তাও কেন আমার থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাও তুমি? আমি যদি মরে যাই না, তাহলে তোমাকে মেরে মরব। আমি মরে গেলে তুমি অন্য কারো হবে এটা তো আমি হতে দিতে পারি না। তুমি-তুমি শুধু আমার রোজ। আমি ছাড়া তোমায় আর কেউ ভালোবাসতে পারবে না।…”
এরকম হাজারো কথা বলছিলো জেহের। সেসব কিছুই ইনশিতার কানে ঢুকছে না। সে জেহেরের থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ব্যস্ত। তখন জেহের ইনশিতাকে কোলে উঠিয়ে নিলো। বাথরুমের শাওয়ারের নিচে দাঁড় করিয়ে বলল,
-“তোমায় ঐ রাফিদ টাচ করেছে? তাই না?”
ইনশিতা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-বিশ্বাস করুন, রাফিদ আমাকে স্পর্শ করেনি।
জেহের অগ্নিদৃষ্টি মেলে বলল,
-“আমাকে মিথ্যে একদম বলবে না। আমি দেখেছি তো, ও তোমার হাত ধরেছে, তুমিও ওর হাত ধরেছ। ও তোমাকে জড়িয়েও ধরেছে। আমি তো ওকে ছাড়বোই না। তার আগে ওই ইডিয়টের স্পর্শ তোমার শরীর থেকে উঠিয়ে নেব আমি।”
শাওয়ার ছেড়ে দিলো জেহের। দুজনেই ভিজতে লাগল। ইনশিতা কান্না করছে আর জেহের ইনশিতার গলা, পিঠ বাহু ধরে জোরে জোরে ঘষতে লাগল যেন প্রচুর পরিমাণে আবর্জনা লেগে আছে। ঘষতে ঘষতে ইনশিতার জামার হাতা ছিঁড়ে ফেলল, নখের আঁচড় বসে গিয়ে লাল হয়ে গেল তবুও ইনশিতাকে ছাড়ল না জেহের। জেহের পাগল হয়ে গেছে তখন ইনশিতাকে রাফিদের বাহুডোরে দেখে। তার রোজের শরীরে অন্য কারোর ছোঁয়া মেনে নিতে পারছে না সে। ইনশিতা কাঁদতে কাঁদতে জেহের পা জড়িয়ে ধরে বসে পড়ল।
-“ছেড়ে দিন জেহের। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। প্লিজ।”
জেহের ইনশিতাকে ধরে উঠিয়ে দেয়ালে চেপে ধরে বলল। ইনশিতার বাহুতে অস্থির হয়ে চুমু দিতে দিতে বলল,
-“তোমার এই হাতে শুধু আমার ছোঁয়া থাকবে। আর কারো না। আর কেউ তোমার দিকে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করলে তার হাত কেটে ফেলব আমি। তোমার উপর একমাত্র আমার অধিকার আছে। শুধু আমার।”
জেহেরের এত জোরাজুরি, ঠান্ডা পানি সহ্য হচ্ছিল না ইনশিতার। ঢলে পড়ল জেহেরের বুকে। জেহেরের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তার রোজের শরীর থেকে অন্য কারো স্পর্শ ধুয়ে ফেলার চেষ্টায় আছে।
.
.
চলবে…