প্রহেলিকা পর্ব ১৩+১৪

#প্রহেলিকা
#পর্ব_১৩
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ।)
———————–

জেহেরের সামনে চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় বসে আছে তিনজন মহিলা। যারা মেকআপ রুমে ইনশিতাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। জেহের ইনশিতাকে খোঁজখুঁজি করার পরও যখন পায়নি তখন তার মনে পড়ল সিসি ক্যামেরার কথা। সিসি ক্যামেরা মেইন গেটের সামনে রয়েছিল। সেখানে তার লোকেরা দেখতে পেল তিনজন বোরকা পড়া মহিলা যারা ইনশিতাকে তুলে নিয়েছিল। আর দুর্ভাগ্যবশত ইনশিতাকে গাড়ি উঠিয়ে দেয়ার পর সেই মহিলারা নিকাব খুলে ফেলেছিল যার কারণে জেহেরের লোকদের সেই মহিলাদের খুঁজতে বেশি সময় লাগেনি।

মহিলারা ভয়ে কাঁপছে। না জানি এখন তাদের কি শাস্তি পেতে হয়! জেহেরের হাতে স্ট্রেইটনার। জেহের শান্ত গলায় বলল,

-“রোজকে কেন উঠিয়ে নিয়েছিস তোরা?”

মহিলারা খুব ভালো করেই জানে মিথ্যে বলে কোনো কাজ হবে না। তাই সত্যি বলল সবাই।

-“স্যার আমাদের টাকা দিয়েছিল। মেয়েটাকে উঠিয়ে গাড়িতে উঠালে আমাদের হিউজ অ্যামাউন্টের টাকা দিবে বলেছিল।”

জেহের ঘাড় কাত করে তাকাল। উঠে এসে যেই মহিলা কথা বলল তার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর গরম স্ট্রেইটনারটা কানের মধ্যে লাগিয়ে দিলো। গগন বিদারী চিৎকার করে উঠল মহিলাটি। জেহেরের ইশারায় একজন লোক এসে মুখ চেপে ধরল। জেহের মহিলাটির উদ্দ্যেশ্যে হিসহিস করে বলল,

-“মেয়েটি কী হ্যাঁ? ম্যাম বল ম্যাম। আমার রোজকে মেয়েটি বলার সাহস কি করে পাস? কল হার ম্যাম।”

জেহের স্ট্রেইটনার সরিয়ে নিলো। মহিলার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে আর কাঁটা মুরগীর মতো ছটফট করছে। তা দেখে পাশে বসে থাকা দুজন মহিলার পা কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেল। জেহের এবার দুজনের উদ্দ্যেশ্যেই বলল,

-“তোদের স্যার কে? কার আদেশে এমনটা করেছিস?”

-“আ-আমরা জানি না। স্যারকে আমরা দেখিওনি। স্যার শুধু মোবাইলে আমাদের কাজ বুঝিয়ে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিল।”

-“গিভ মি দ্যা নাম্বার।”

মহিলাটি মোবাইল বের করে নাম্বার দিলো জেহেরকে। জেহের কল করে দেখে নাম্বার বন্ধ দেখাচ্ছে। শিট বলে ছুঁড়ে ফেলল মহিলাটির মোবাইল। সিসি ক্যামেরায় গাড়ির এরিয়াটা কভার করেনি বিধায় গাড়িটাকে দেখতে পেল না সে। উঠে দাঁড়িয়ে গার্ডদের ইশারা করে চলে গেল। সে চলে যেতেই ভেতর থেকে মহিলাদের আকাশ কাঁপানো চিৎকার ভেসে আসে।

জেহের ইনশিতার বাবার কাছে এসে বলে,
-“আপনার ভাগ্য ভালো শশুরমশাই যে এ কাজে আপনার কোনো হাত নেই। তবে যে এই কাজ করেছে তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ একটাও থাকবে কি না সন্দেহ।”

বলেই হনহন করে চলে গেল। ইনশিতার মা আর বাবাও দুশ্চিন্তা নিয়ে কমিউনিটি সেন্টার থেকে বাড়ি চলে এলো। জেসমিন আর আফজাল নিজেদের গাড়ি করে রওয়ানা দিলো নিজ বাড়িতে।

ইনশিতাকে খোঁজার চেষ্টা কোনো চেষ্টাই বাদ রাখছে না জেহের। এয়ার লাইন, রেল স্টেশন সব জায়গায় লোক লাগিয়েছে। কিন্তু কোনো খবর পায় নি। তবুও জেহের হাল ছাড়েনি। তাকে যে করেই হোক তার রোজকে পেতেই হবে।

জেহের গাড়ি চালাচ্ছে আর ভাবছে রোজের কথা। পরনের শেরওয়ানীর উপরের দিকে পুরোটাই খোলা যার কারণে লোমহীন ফর্সা উদোম বুক দেখা যাচ্ছে। মসৃণ চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হাতের রগগুলো ভেসে যেন দৃষ্টিগোচর হয়েছে। জেহের একহাতে কপালে থাকা চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে কটমট করে বলল,

-“আমার রোজকে আমার থেকে দুরে সরানোর সাহস কার হয়েছে? কার এমন বুকের পাটা আছে? একবার জাস্ট সামনে পাই তোকে। কেটে কুকুরকে খাওয়াবো।”

বলেই ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিতে লাগল। রাগে তার শরীর রি রি করছে। তার রোজ এখন কী করছে? কোথায় আছে? কিছু খেয়েছে কি না? এসব ভেবে ভেবে মাথাটা আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে জেহেরের। বাড়িতে না গিয়ে সোজা ফার্মহাউজে চলে গেল সে। যেখানে মাঝে মধ্যে গিয়ে নিজেকে রিল্যাক্স করে আসে সে, তবে আজ কিছুতেই রিল্যাক্স হতে পারছে না জেহের। ঘরে ঢুকে সবকিছু এদিক ওদিক ছুঁড়ে ফেলতে লাগল। সোফা টেবিল উল্টিয়ে পাল্টিয়ে ভাঙতে লাগল। যখন সব ভাঙা শেষ হলো তখন ভেতরের রুমে চলে গিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিলো। মোবাইল বের করে রোজের ছবিতে হাত বুলাতে লাগল আর বিড়বিড় করতে করতে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ল।

.

.

বড্ড পিপাসায় ইনশিতার গলা কাঠ হয়ে এলো যেন। চোখ দুটো মেলে রাখতেও কষ্ট হচ্ছে। তবুও তৃষ্ণা মেটাতে খুব কষ্টে উঠে বসল। পাশের টেবিলে রাখা পানির গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করে নিলো। এবার কিছুটা শান্তি লাগছে। যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে সে। খাট থেকে নামলে আচমকা তার মাথায় আসে গতকালকের কথা। চোখ দুটো ভালোভাবে কচলে চারিদিকটা ভালো করে দেখে নিলো। মাঝারি আকারের একটি রুম। রুমে আসবাবপত্র খুবই কম। গোল সাইজের একটি খাটে বসে আছে সে। তার পাশেই ছোট্ট একটি টেবিল। আর দরজার পাশে লাগোয়া আলমারি আর একটি ড্রেসিং টেবিল। দেখে মনে হচ্ছে কোনো হোটেলের রুম। ইনশিতা নিজের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। কালকের সেই বিয়ের সাজেই রয়েছে সে। হাত পা বাঁধামুক্ত। ইনশিতা উঠে দাঁড়িয়ে রুমের বারান্দায় চলে গেল। শীত শীত লাগছে। চারপাশে কেমন উঁচু উঁচু বিল্ডিং। একেকটা বিল্ডিংয়ের সাজ বাহির থেকেই চোখ ধাঁধানোর মতো। নিচের রাস্তা একদম পরিষ্কার। মানুষগুলোকেও বাঙালি বাঙালি মনে হচ্ছে না। অদূরে একটি নদীর অংশবিশেষ চোখে পড়ছে। তাই তো এত বাতাস আসছে। এটা তো বাংলাদেশ না। তাহলে কি বিদেশে নিয়ে এসেছে জিহাদ তাকে? ভাবনার জগৎ ভঙ্গ হলো কোনো মেয়েলী কন্ঠের আওয়াজে। পেছন ফিরে দেখল ফ্যাকাশে রঙের একজন বিদেশী মেয়ে। হাতে খাবারের ট্রে। ইনশিতা ভ্রু কুঁচকালো। মেয়েটি শুদ্ধ ইংরেজিতে বলল,

-“হেয়ার ইজ ইওর ব্রেকফাস্ট ম্যাম। প্লিজ, হেভ ইট।”

ইনশিতা মেয়েটিকে বলল,
-“আচ্ছা, এটা কোন দেশ?”

মেয়েটি বুঝতে পারল না। ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে ইনশিতার দিকে। ইনশিতা বুঝতে পেরে নিজের কপাল নিজেই চাপড়াল। সেও তো ভুলে গিয়েছে এই ধলা মেয়েটি ইংলিশ ছাড়া বাংলা বুঝে না। সে বলল,
-“হুইচ কান্ট্রি ইজ ইট?”

-“ইটস থাইল্যান্ড ম্যাম।”

বলেই খাবার টেবিলে রেখে চলে গেল। ইনশিতা মাথায় হাত দিয়ে বেডে বসে পড়ল।
-“আল্লাহ! গতকালই না আমি বাড়িতে ছিলাম আর আজ থাইল্যান্ড?”

ইনশিতা দরজা খুলতে গিয়ে দেখল দরজা বাহির থেকে আটকানো। বিরক্তি নিয়ে আবার বসে পড়ে খাটে। খাবারগুলো দেখে নিয়ে খেতে শুরু করে। প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়েছে তার। খাবার প্রায় শেষ তখন দরজা খোলার ক্ষীণ আওয়াজ আসে। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে একটু আগের সেই মেয়েটি।

-“স্যার ইজ কলিং ইউ। কাম উইথ মি ম্যাম।”

ইনশিতা খাবার রেখে দ্রুত উঠে পড়ল। জিহাদের সাথে একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে সে। সাহস কত ছেলেটার! আজকে ছেলেটাকে নিজ হাতে কিছু শাস্তি দিবে। তাই লুকিয়ে ফলের ছুঁড়িটা নিয়ে নিল আঁচলে। মেয়েটির পেছন পেছন গিয়ে লিফটে উঠল ইনশিতা। মেয়েটি তার থেকেও অনেক লম্বা। ফিগারটাও দেখার মতো। ইনশিতা বলল,

-“হোয়াট’স ইওর নেম?”

-“জুন।”

.

.

জেহেরের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে ফোনের তীব্র আওয়াজে। ফোনটা তার বুকেই ছিল। উঠিয়ে দেখে আননোন নাম্বার। জেহের বিরক্তি নিয়ে বলল,

-“হু দ্যা হেল আর ইউ?”

ওপাশ থেকে একটি মেয়ের কন্ঠ ভেসে আসে,
-“মি. জেহের! আপনি আপনার রোজের খবর পেয়েছেন তো?”

জেহের এবার উঠে বসে,
-“হু আর ইউ?”

-“আমি কে সেটা জেনে আপনার লাভ নেই। তবে আপনার রোজের খবর আমি দিতে পারি মিষ্টার।”

জেহের শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,
-“কোথায় আছে আমার রোজ? কার কাছে?”

-“আমি আপনাকে বলব, তবে আমার একটা শর্ত আছে।”

-“যত টাকা লাগবে সব দেব। ব্ল্যাংক চেকও দিয়ে দেব, তাও বলো আমার রোজ কোথায়?”

ওপাশ থেকে মেয়েটির অট্টহাসির শব্দ শোনা গেল। বিরক্ত হলো জেহের। মোবাইলটা আছড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে। তবুও নিজেকে শান্ত রাখল। মেয়েটি হাসি থামিয়ে বলল,

-“এসব টাকা ফাকা আমার কিছুই লাগবে না মিষ্টার। আমার অন্য কিছু চাই। অন্য একটা শর্ত আছে।”

জেহেরের কপালের মধ্যভাগ কুঞ্চিত হলো।
-“কী শর্ত?”

.
ইনশিতাকে নিয়ে মেয়েটি অর্থাৎ জুন ছাদে চলে আসলো। হোটেলের ছাদটা বিশাল। একপাশে ছোট ছোট চেয়ার টেবিল বসানো। আরেকপাশে ফুলের বাগান। সব নাম না জানা ফুল। জুন ছাদের বিপরীত প্রান্তে নিয়ে চলল ইনশিতাকে। ইনশিতা আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে গেল। এবার হয়ত জিহাদকে খুনই করে দিতে পারে। বড্ড বাড় বেড়েছে জিহাদ। তারা কাছে যেতেই দেখল শেষ মাথার চেয়ারে একটা লোক বেশ আরাম করে বসে আছে। জুন ইনশিতাকে পেছনের একটি চেয়ারে বসতে দিয়ে চলে গেল। ইনশিতাও একটু আরাম করে বসল। একটু ঊনিশ বিশ হলে জিহাদকে মেরে দিতেও তার হাত কাঁপবে না। ইনশিতা নিজেই কথা বলা আরম্ভ করল,

-“মি. জিহাদ! নিজেকে কী ভাবেন আপনি? কিং?আপনি যা চাইবেন সব পেয়ে যাবেন? সব পেলেও পেতে পারেন বাট আমাকে না। জানেন তো! আপনারা দুই ভাই-ই এক। কোনোটাই কোনোটার চেয়ে কম না। কি হলো? চুপ করে আছেন যে? মুখে কি কুলুপ এঁটেছেন না কি?”

এই কথার শেষেই লোকটি দাঁড়িয়ে ইনশিতার দিকে ফিরল। সামনের লোকটিকে দেখে ইনশিতা সবিস্ময়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। লুকিয়ে রাখা ছুঁড়ি হাত থেকে পড়ে গেল। মুখ আপনাআপনি হা হয়ে গেল তার। তার সাথে এসব কী হচ্ছে? সবকিছু এমন ধাঁধা ধাঁধা লাগছে কেন? প্রহেলিকায় পড়ল না কি সে? সবকিছুতেই এত প্রহেলিকা কেন? মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে একটা নামই বেরিয়ে আসলো তার,

-“রাফিদ ভাইয়া!”

.#প্রহেলিকা
#পর্ব_১৪
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ।)
———————–

জেহের নিজের পার্সোনাল হেলিকপ্টারে উঠে বসল। ব্ল্যাক স্যুটের সাথে হোয়াইট শার্ট। শার্টের ওপরের বোতাম দুটো খোলা। সানগ্লাস আটকে রাখা আছে শার্টে। চুলগুলো সেই আগের অবস্থানের মতোই কপালে ঠাঁই নিয়েছে। হাতে রিস্ট ওয়াচ। চোখে মুখে গম্ভীর ভাব তবে চোখ দুটো অসম্ভব লাল, যেন কাউকে সামনে পেলে লাল চোখ দ্বারাই উড়িয়ে দেবে। উড়ে চলল হেলিকপ্টার তার গন্তব্যের দিকে।

.
ইনশিতা এখনো হা করেই আছে। রাফিদ হেসে ইনশিতার সামনে দুই আঙুল দিয়ে তুড়ি বাজাল। ধ্যান ভেঙে গেল ইনশিতার। সে বিস্মিত গলায় বলল,
-“রাফিদ ভাইয়া! তুমি?”

রাফিদ ভ্রু কুঁচকালো,
-“তো কার আশা করছিলে তুমি? জেহের নাকি জিহাদ?”

ইনশিতা উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
-“তুমি এখানে কেন নিয়ে এসেছ আমায়? আর এভাবে নিয়ে আসার মানেটা কী?”

-“সবুর করো ইতু। সব জানতে পারবে। আগে ফ্রেশ হয়ে আসো তো। রুমের আলমারিতে ড্রেস রাখা আছে, চেঞ্জ করে আসো। এত ভারি সাজে থাকতে কষ্ট হবে।”

-“এতক্ষণ যেভাবে ছিলাম সেভাবেই থাকব। আগে তুমি বলো।”

-“বললাম না চেঞ্জ করে আসো।”

-“তুমি না বলা পর্যন্ত আমি এক পাও নড়ব না।”

রাফিদ হাল ছেড়ে দিলো। সে জানে ইনশিতা এখন না জেনে কোত্থাও যাবে না। তাই নিজে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে সামনের চেয়ারে ইনশিতাকে বসতে ইশারা করল।

-“তুমি নিশ্চয়ই জানো যে তোমার সাথে একজনের বিয়ে ঠিক হওয়া ছিল আগের থেকেই?”

-“হ্যাঁ। কিছুদিন আগে বাবার কাছ থেকে জানলাম। কিন্তু এই প্রশ্ন কেন?”

-“যার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল সেই ছেলেটা আমি।”

ইনশিতা দ্বিতীয়বারের মতো বিস্ময়ে আবারও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। রাফিদ বিরক্তি নিয়ে বলল,
-“বারবার দাঁড়াচ্ছ কেন? স্থির হয়ে বসে থাকতে পারো না?”

ইনশিতা স্ট্যাচুর মতোই দাঁড়িয়ে আছে।
-“কিন্তু তুমি তো আমার ভাই হও।”

রাফিদের বিরক্তির সাথে সাথে রাগও উঠে গেল। নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে ইনশিতার বাহু ধরে ঝাঁকাল। রাগী গলায় বলল,

-“আমি তোমার কোন কালের ভাই হু? তুমি আমার মায়ের পেটের বোন না কি আমি তোমার মায়ের পেটের ভাই? সবসময় খালি ভাইয়া ভাইয়া করতেই থাকো। একদিনও আমি তোমার সাথে ভাইয়ের মতো আচরণ করেছি?”

-“তুমি তো আমার সাথে প্রেমিকের মতও আচরণ করো নাই।”

রাফিদের বিরক্ত নিয়ে আশেপাশে চোখ বুলাল। মেজাজ ঠান্ডা করতে হবে। বড় একটা শ্বাস নিয়ে বলল,
-“আমি তোমাকে সবসময় তুমি করে বলি সেটা কী প্রেমিকের মতো আচরণ না?”

-“আশ্চর্য! আমিও তো তোমাকে তুমি করে বলি। আর ভাইরাও তো বোনকে তুমি করে বলে।”

রাফিদ শক্ত করে ইনশিতার বাহু ধরে বলল,

-“যাই হোক, ভাই বোন চুলোয় যাক। শুধু এটা জেনে রেখো আমি তোমাকে কখনো বোনের চোখে দেখিনি। যখন থেকে শুনেছি তোমাকে আমার বউ করা হবে তখন থেকেই তোমার প্রতি অন্যরকম অনুভূতি অনুভব করেছি। ভালোবাসতে শুরু করেছি।”

ইনশিতা চোখ দুটো বড় করে গোলগোল করে তাকিয়ে আছে। রাফিদ বলা থামালো না।

-“ঐ সাইকো জেহের আমাকে মারার পর অনেকদিন বেড রেস্টে ছিলাম। যখন সুস্থ হই তখন জানতে পারি তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে ঐ শালা জেহেরের সাথেই। তারপর থেকে প্ল্যান শুরু করি আমি। তুমি যখন কলেজ যাও তখনো একা পাইনি তোমায়। চারপাশে লেডি গার্ডসরা তোমার উপর নজর রাখতো। তবুও প্রতিদিন লুকিয়ে দেখতাম তোমায়। তোমার বাসায়ও নজর রাখতাম। একদিন দেখি জিহাদ তোমার বারান্দায় গিয়ে তোমার সাথে মিসবিহেভ করছিল। আমি যখন আটকাতে যাব তখনই তুমি জিহাদকে ছাড়িয়ে ভেতরে চলে গিয়েছিলে। জিহাদ চলে যাওয়ার পর তুমি ঐ বারান্দাতেই বসে কাটিয়েছিলে। সারারাত দাঁড়িয়ে থেকে পাহারা দিয়েছিলাম যাতে ঐ জিহাদের বাচ্চা আর না আসে। হলুদের রাতে বারান্দায় তোমায় আর জেহেরকে একসাথে দেখে খুব রেগে গিয়েছিলাম। তাই ঢিল ছুঁড়ে মারি। আমার প্ল্যান ছিল বিয়ের দিনই তোমাকে উঠিয়ে থাইল্যান্ড নিয়ে আসব। সব বন্দোবস্ত আগে থেকেই করে রেখেছিলাম। আমি কিছু করার আগেই দেখি কিছু মহিলা তোমাকে জোর করে তুলে দিয়েছে একটা মাইক্রোতে। আমি গাড়িটি ধরার আগেই গাড়ি ছেড়ে দেয়। সেই গাড়ির পেছন পেছন বাইক নিয়ে আসি। কিছুক্ষণ বাদেই গাড়িটি থেমে ড্রাইভার নেমে গিয়ে জিহাদ উঠে যায়। বুঝতে পারি যে এসব জিহাদেরই প্ল্যান। আমি বাইক নিয়েই গাড়িটির সামনে দাঁড়ালে জিহাদ গাড়ি থামিয়ে বেরিয়ে আসে। আমার মাথায় হেলমেট ছিল তাই জিহাদ আমাকে চিনতে পারেনি। আমিও এগিয়ে গিয়ে ক্লোরোফর্ম মাখানো রুমাল জিহাদের মুখে চেপে ধরি। জিহাদ অজ্ঞান হয়ে গেলে আমি আমার বাইক রেখে গাড়িতে এসে বসে পড়ি। কাঙ্খিত জায়গায় পৌঁছে তোমায় কাঁধে তুলে হেলিকপ্টারে নিয়ে রাখি অ্যান্ড অ্যাট লাস্ট আমার প্ল্যান সাক্সেসফুল। থ্যাংকস টু জিহাদ অর্ধেক কাজ করে আমারই হেল্প করেছে।”

এতক্ষণ ইনশিতা অবাক হয়ে শুনছিল রাফিদের কথা। এত এত প্ল্যান শুধুমাত্র তাকে পাওয়ার জন্য! ইনশিতা ঝটকানি দিয়ে রাফিদের হাত বাহু থেকে ছাড়িয়ে নিল। ঝাঁঝাল গলায় বলল,

-“তাহলে আপনাদের তিনজনের মধ্যে তো কোনো পার্থক্যই দেখছি না। সবগুলাই একই জলের মাছ।”

রাফিদ ইনশিতার দুটো হাত একসাথে ধরে সামনে আনল,
-“দেখো ইতু। তোমার সাথে আমার বিয়ে হলে কিন্তু কোনো ঝামেলাই হতো না। আর আমি ঐ দুই ভাইয়ের মতো না। আমাকে একদম ওদের সাথে মেলাবে না। একজন তো তোমাকে নিজের কাছে বন্দী রাখতে চায়, আরেকজন সেই বন্দী থেকে মুক্ত করে নিজের কাছে এনে আবার বন্দী রাখতে চায়। কিন্তু আমি এসব কিছুই চাই না। আমি চাই তুমি তোমার মতো থাকো। আমার কাছে থেকেই তুমি তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করো। আমার আর তোমার একটা ছোট্ট সংসার হবে। আমার মা-বাবা, আমি আর তুমি মিলে একটা সংসার। তোমার ইচ্ছা হলে তুমি চাকরি করবে। আমাদের পুচকু হলে আমি চাকরি ছেড়ে পুচকুদের দেখাশোনা করবো যাতে তোমার প্রফেশনাল লাইফে কোনো ক্ষতি না হয়। একটা টোনাটুনির সংসার করার বড্ড ইচ্ছা আছে তোমার সাথে।”

ইনশিতা মুখ ফিরিয়ে নিলো। তার অনেক কষ্ট হচ্ছে। তারও তো এমন একটা সংসার করার ইচ্ছা আছে। জেহেরের সাথে যদি জীবনেও দেখা না হতো তাহলে সে নিশ্চয় রাফিদের সাথে নিজের স্বপ্নের সংসার গড়তে পারতো। কিন্তু এসব যে আর কখনো সম্ভব হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত জেহের আছে।

রাফিদ ইনশিতার মুখ নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো। দুহাতে ইনশিতার চোখ মুছে গালে হাত রাখল। বলল,
-“ইতু, তুমি কী চাও না এমন একটা সংসার করতে যেখানে শুধুই ভালোবাসা আর স্বাধীনতা রয়েছে?”

ইনশিতা অস্ফুট স্বরে সম্মতি দিলো।

-“তাহলে আমার সাথে এরকম একটা সংসার গড়তে সমস্যা কোথায়?”

-“সেটা কখনোই সম্ভব না।”

-“তুমি কি জেহেরের ভয় পাচ্ছ?”

ইনশিতা মাথা নিচু করে ফেলল।

-“সব ভুলে যাও ইতু। ভয় পেলে তো চলবে না। জেহের কিইবা করবে আর। ও তো জানেই না আমরা এখানে রয়েছি। দরকার হলে এখানেই আমরা বিয়েশাদী করে কয়েকবছর পর দেশে যাবো। তখন দেখবে, জেহের কেন, জেহেরের চৌদ্দগোষ্ঠীও কিছু করতে পারবে না।”

ইনশিতা চমকে তাকাল,
-“বিয়ে!!”

-“হ্যাঁ, তোমার আর আমার বিয়ে। সমস্যা না হলে আমরা আরও কিছুদিন পর বিয়ে করবো। চিন্তা করবে না, জেহের কখনোই জানতে পারবে না যে আমরা এখানে আছি। আর তোমার বাবার সাথেও কথা হয়েছে আমার।”

-“কী! বাবা জানে?”

-“তুমি যখন ঘুমে ছিলে তখনই সব জানিয়েছি। আর এটাও বলেছি তোমার সাথে আমার বিয়ে হবে, এখানে কিংবা দেশে। তোমার বাবাও এটা চেয়েছিল। ওয়ান সেকেন্ড, কথা বলে নাও তুমি।”

রাফিদ ইনশিতার বাবাকে ফোন করে ইনশিতার কানে দিলো।

-“হ্যালো বাবা।”

-“কেমন আছিস ইতু?”

-“ভালো আছি বাবা, তুমি কেমন আছো? মা কেমন আছে? খাবার খেয়েছ তো?”

-“গতকাল পর্যন্তও খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। এখন ঠিক আছি।”

-“তার মানে তুমি সত্যি রাজি।”

-“কিসের ব্যাপারে?”

-“আমার আর রাফিদ ভাইয়ের বিয়ের ব্যাপারে।”

-“হ্যাঁ ইতু। আমি অনেক ভেবে দেখেছি। আর রাফিদের সাথেই তোর বিয়ে ঠিক করেছিলাম প্রথমে। এখন যখন রাফিদের সাথেই বিয়ে হচ্ছে তাতে না করার কোনো কারণ নেই।”

-“হু।”

ইনশিতা একটু একপাশে গিয়ে বলল,
-“বাবা, জিহাদের কি অবস্থা?”

-“শুনেছি গতকাল ও কে নাকি মাঝ রাস্তায় পাওয়া গেছে। আফজাল সাহেব খবর পাওয়ার পর বাড়িতে নিয়ে গিয়েছেন।”

বাবা-মেয়ের কথোপকথন শেষ হলে রাফিদ বলে,
-“কী? এবার রাজি আছো তো?”

ইনশিতা একবার মুখ উঠিয়ে তাকাল। চোখেমুখে এখনো রাজ্যের ভয়। রাফিদ বুঝতে পারল। আশ্বস্ত করে বলল,

-“সহজ হও ইতু।”

ইনশিতা জোর করে হাসল। রাফিদ ও কে ফ্রেশ হওয়ার জন্য নিচে নিয়ে গেল। ফ্রেশ হয়ে ইনশিতা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। রাফিদ নিজেও পাশে এসে দাঁড়াল। ইনশিতা বলল,

-“রাফিদ ভাইয়া! সত্যি কী এবার আমার স্বপ্নের মতো সংসার হতে যাচ্ছে?”

-“এখনো বিশ্বাস করতে পারছ না?”

-“না মানে…”

-“বুঝেছি, চিন্তা করো না। তোমার ইচ্ছেতেই সব হবে। আর হ্যাঁ, দয়া করে এবার আর ভাইয়া ডেকো না। রাফিদ বলেই ডেকো।”

-“ক-কীভাবে? মানে…”

-“ধীরে ধীরে অভ্যেস করে ফেলো। অভ্যেসে সব হয়।”

-“হু।”

-“জেহেরের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও। ভাবো যে ওটা একটা দুঃস্বপ্ন অতীত ছিলো। অতীত মাথায় রেখে বর্তমান আর ভবিষ্যত নষ্ট করতে নেই। আর এখন জেহের কিচ্ছু করতে পারবে না।”

রাফিদ ইনশিতার হাত ধরে এনে চেয়ারটিতে বসে নিজেও পাশের চেয়ারে বসল। ইনশিতার চুলগুলো বাতাসে উড়োউড়ি করছিল। রাফিদ নিজ হাতে ইনশিতার চুলগুলো বেঁধে দিলো। ইনশিতার খুব ভালো লাগলো এই ভেবে যে, রাফিদ কোনো সুযোগ নিচ্ছে না। আর জেহের হলে তো জড়িয়ে ধরা শুরু করে আর কি কি যে করতো! বাপরে বাপ!

.

.

জেহের থাইল্যান্ডের মাটিতে পা রাখল। বডি গার্ডরা তার লাগেজ হাতে পেছন পেছন আসতে লাগল। হেলিকপ্টারের বাতাসে জেহেরের চুল কপালের একসাইডে গিয়ে উড়োউড়ি করছে। জেহের শার্টের বুক থেকে সানগ্লাস নিয়ে চোখে পড়ল। ঠোঁটে বাঁকা হাসি। হাতঘড়িতে একবার সময় দেখে নিলো। বাঁকা হাসি মুখে রেখে নিজেই নিজেকে বলল,

-“জেহের চাইলেই সবকিছু করতে পারে। আর নিজের ভালোবাসার জন্য তো কোনো কিছুরই পরোয়া করবে না জেহের। নেভার অ্যান্ড এভার। আমার কাছ থেকে আমার রোজকে নিয়ে লুকিয়ে যাবি ভেবেছিস? যদি ভেবে থাকিস তাহলে এটাও ভেবে রাখ যে তোর মৃত্যু আসন্ন। বনের রাজা সিংহের সাথে বনের ক্ষুদ্র প্রাণী যেমন পেরে উঠে না, তেমনই তুইও আমার সাথে পেরে উঠবি না। তোর হাতে সময় খুব কম। সো, কাউন্ট ডাউন স্টার্ট মি. রাফিদ হাসান।”

.
.
চলবে…

[গত পর্বে একটা মিস্টেক হয়েছিল। শেষে দিয়ে ‘রাফিদ ভাইয়া’ লিখতে গিয়ে শুধু ‘রাফিদ’ লিখে ফেলেছিলাম। আমার মনে ছিলো না যে ইনশিতা রাফিদকে ভাই বলে ডাকে। এডিট করে দিয়েছি। আর ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here