প্রহেলিকা পর্ব ১১+১২

#প্রহেলিকা
#পর্ব_১১
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ।)
———————–

[প্রথমেই বলে রাখছি, আজকের পর্বে জেহের অতিরিক্ত পাগলামি করবে যেটা হয়ত অনেকেরই ভালো লাগবে না, বিরক্ত লাগতে পারে, তারা দয়া করে স্কিপ করতে পারেন। জেহেরের চরিত্রের দিক থেকে সে যা করে সেটা ঠিক, আর নিজেদের পয়েন্ট অফ ভিউ দিয়ে ভাবলে কখনোই ঠিক লাগবে না, তাই চরিত্রের মাঝে ঢুকে ভাবার চেষ্টা করবেন।]

-“হ্যালো জিহাদ!”

-“হ্যাঁ মম, বলো।”

ওপাশ থেকে জেসমিন চৌধুরী অস্থির হয়ে বললেন,

-“জেহেরের কি যেন হয়েছে। সন্ধ্যা থেকে ভাঙচুর করেছিল পুরো ঘরটায়। এখন মাথা চেপে বসে আছে আর জোরে জোরে চিৎকার করছে।”

জিহাদ বিরক্তি নিয়ে বলল,
-“রেগে আছে তো তাই এমন করছে। তুমি তো জানোই মম ভাই রেগে গেলে ঠিক থাকে না।”

-“আমার এমন কিছু মনে হয় না। মাথা চেপে চিৎকার করছে। মনে হচ্ছে ওর মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।”

জেসমিন চৌধুরীর এই কথাটি শোনার পর জিহাদের টনক নড়ল যে জেহের গতকাল আর আজ জেহের ঔষধ নেয়নি। জেহেরকে তার অজান্তে ঔষধ দেয়া হয় বিধায় জেহের তার অসুস্থতা সম্পর্কে অবগত নয়। জিহাদ গাড়ি নিয়ে দ্রুত চলল চৌধুরী ম্যানশনে। কিছুক্ষণ বাদেই জিহাদ পৌঁছে গেল বাড়িতে। জেহেরের রুমের দরজার সামনে জেবা আর পরিচারিকাগণ দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে আফজাল চৌধুরী আর জেসমিন চৌধুরী রয়েছে। তবে জেহেরের সামনে আসার সাহস পাচ্ছেন না। জেহেরকে এ অবস্থায় দেখে জেসমিন চৌধুরীর বুক ফেটে যাচ্ছে। নিঃশব্দে কাঁদছেন তিনি। জিহাদ গিয়ে জেসমিন চৌধুরী আর আফজাল চৌধুরীকে বেরিয়ে যেতে বলে। বাহিরের সকলকেও বেরিয়ে যেতে বলে। সকলে বেরিয়ে গেলে জিহাদ কিছুক্ষন ভ্রূকুটি করে তাকিয়ে থাকে জেহেরের দিকে। জেহের মাথা চেপে ধরে বিড়বিড় করছে।

জিহাদ গিয়ে জেহেরের সামনে দাঁড়াল। জেহেরের মাথায় হাত দিয়ে বলল,
-“ভাই, মাথা কি বেশি যন্ত্রণা করছে?”

জেহের বিরক্তি নিয়ে ঝটকা দিয়ে জিহাদের হাত সরিয়ে দিল। কিছুই বলছে না সে। তার মাথা প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে। মনে হচ্ছে ভেতরে কেউ জোরে জোরে হাতুড়ি পেটাচ্ছে। উফ! মাথাটা যদি কেটে ফেলা যেত! তার মাঝে জিহাদ অগোচরে জেহেরকে ইনজেকশন পুশ করে দিল। কিছুক্ষণ বাদেই জেহের মাথা থেকে হাত নামাল। ব্যথা পুরোপুরি গায়েব যেন! হালকা লাগছে খুব। জিহাদ চিন্তিত কন্ঠে বলল,

-“মাথা ব্যথা কমেছে ভাই?”

জেহের চোখ বন্ধ থেকেই মাথা নাড়াল। ইশারায় জিহাদকে ঘর ছেড়ে চলে যেতে বলল। জিহাদ চলে গেলে জেহের বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।

জিহাদ বাহিরে আসতেই জেসমিন চৌধুরী তড়িঘড়ি করে আসলেন।
-“কী হয়েছে জেহেরের? এখন ঠিক আছে তো? বল জিহাদ!”

জিহাদ এক পলক মায়ের দিকে তাকিয়ে মাথা দুলালো।
-“কাল আর আজ ঔষধ দেয়া হয়নি ভাইকে। আর আমিও ভুলে গিয়েছিলাম। তারই ইফেক্ট পড়েছিল। এখন ঘুমোচ্ছে।”

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল জেসমিন চৌধুরী। জেহেরের দরজার সামনে গিয়ে জেহেরকে একবার দেখে নিজ রুমে পা বাড়াল। মায়ের ছলছল করা চোখ জিহাদের নজর এড়ালো না। জিহাদের চোখেও হঠাৎ করে অশ্রুকণা এসে ভিড় জমাল। নিচে পড়ার আগেই হাতের উল্টোপিঠ দ্বারা থামিয়ে দিল জিহাদ।

.

.

খটখট শব্দের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়াতে ইনশিতার কাঁচা ঘুম ভেঙে গেল। উঠে বসে আগে নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করল সে। ঘড়ির কাটায় চোখ পড়তে ঘড়ি টিকটিক করে জানান দিচ্ছে রাত বারোটা বাজে। একটু আগেই না সে ঘুমাল। আর এত তাড়াতাড়ি বারোটাও বেজে গেল! অদ্ভুত! ভাবনার জাল ছিঁড়ল দ্বিতীয়বার খটখটানির আওয়াজে। আগের চেয়ে শব্দটা বেশ জোরালো। শব্দটা ব্যালকনির দরজা থেকে আসছে। তার ব্যালকনিতে গ্রিল নেই। তাই সে ব্যালকনির দরজা আটকে ঘুমায়। এত রাতে কোনো চোরটোর আসেনি তো! আর আসলেই বা এত জোরে জোরে বারি মারছে কেন? তার মধ্যে কারো গম্ভীর গলার ক্ষীণ আওয়াজ শোনা গেল। তাকে ডাকছে কেউ। কিন্তু কে? কৌতুহল দমাতে পা দুটোকে না চাইতেও দরজার দিকে এগিয়ে নিলো সে।

.
খুব সকালে মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙে ইনশিতার। ঘুম ঘুম ভাব নিয়েই অলসতা কাটাতে উঠে পড়ে সে। তবে ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি। নিজেকে ব্যালকনির চেয়ারে বসা অবস্থায় দেখে অবাক হলো সে। নিমিষেই মনে পড়ল গতকাল রাতের ঘটনা। কালকের ঘটনাটা মনে পড়তেই ইনশিতার সারা শরীরে কাঁপন ধরে যায়। ঘটনাটা কি আদৌ সত্যি ছিল? নাকি শুধুই স্বপ্ন! স্বপ্ন হলে তো সে ব্যালকনিতে থাকত না। তার মানে এটা সত্যি! আবারও মায়ের ডাক কানে ভেসে আসে। উঠে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে চলে যায় সে। তবে মাথায় রাতের ঘটনাটা ভনভন করে ঘুরছে।

.
হলুদের রাত। জেহেরের পরিবার কমিউনিটি সেন্টারে আগেই পৌঁছে গিয়েছে। চারিদিকে হৈ হুল্লোড়ে মজে আছে। আত্মীয়, অফিস কলিগ, সকলকেই ইনভাইট করেছেন আফজাল চৌধুরী। জেসমিন চৌধুরী আর জেবা হলুদের সব জিনিস ঠিক করতে ব্যস্ত। জিহাদ আর আফজাল চৌধুরী মেহমানদের যত্নআত্তিতে ব্যস্ত। বেশ আয়োজন করেছে। চারিদিকে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া ডেকোরেশন। টপ বিজনেসম্যানের বিয়ে বলে কথা!

তবে এসব কিছুতেই জেহেরের ভ্রুক্ষেপ নেই। তার মন ভার হয়ে আছে। এতসব মানুষদের মাঝে তার মাথা ধরে গেছে। বিশ্রাম নিতে উপরের তলায় বুকিং করা তার রুমে গিয়ে বসল। সে চিন্তা করছে তার রোজকে সকলের নজর থেকে কীভাবে বাঁচাবে। সকলের সামনে এনে রোজকে বসাবে, সকলে দৃষ্টি থাকবে তার রোজের দিকে, হলুদ ছোঁয়াতে গিয়ে তার রোজকে টাচ করবে, এই চিন্তায় তার মন ভার হয়ে আছে। সে এসব কিছুই চাইছিল না। ঘরোয়াভাবে বিয়ে করতে চেয়েছিল যাতে তার রোজকে সকলে না দেখে। রোজকে দেখার অধিকার মাত্র তার। আর কারোর না। আর এখানে সকলে তাকে দেখবে। এই কথাটা ভাবতেই তার মাথা গরম হয়ে যায়। মুখে হাত দিয়ে কপাল থেকে ঠোঁট পর্যন্ত মুছে নেয়। চিন্তায় মাথা ধরে যাচ্ছে। তার উপর তার রুমের দরজার সামনে ঘুরঘুর করছে মেয়েরা। তাকে এক ঝলক দেখার জন্য। সকলে তার অস্বাভাবিকতা সম্পর্কে জানলেও জেহেরের সৌন্দর্য দেখার অদম্য ইচ্ছা ধামাচাপা দিতে পারে না। যতই হোক, জেহের তো সকল মেয়ের হার্টথ্রব। জেহেরের ইচ্ছা করছে বাহিরে গিয়ে কারো মাথাটা ফাটিয়ে দিতে। এতে অন্তত মেয়েরা কাছে আসবে না। কিন্তু ইনশিতা আগেই বলে রেখেছে, কোনোরকম গন্ডগোল যাতে সে না করে। আর সে কারণেই এতসব কিছু মুখ বুজে সহ্য করে নিচ্ছে।

অবশেষে ইনশিতারাও এসে পৌঁছল। ইনশিতা আসছে শুনে জেহের দ্রুত গতিতে ছুটে চলে ইনশিতার কাছে। নিজেই ইনশিতার হাত ধরে ভিতরে নিয়ে আসলে। এতে সকলে অবাক হলেও কিছু বলার সাহস পেল না, ইনশিতাও না। কয়েকজন মিটিমিটি হাসছে।

হলুদ ছোঁয়ানোর সময় জেহের আর ইনশিতাকে পাশাপাশি বসানো হলো। যখন জেহেরকে হলুদ ছোঁয়াতে যাবে তখন সে চোখ মুখ কুঁচকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। বিরক্তি মাখা গলায় বলল,

-“এসব ডিসগাস্টিং জিনিস আমার মুখে লাগাবে না।”

এটা শোনার পর ইনশিতা অগোচরে জেহেরের হাত চেপে চোখ রাঙানি দিলো। ফিসফিসিয়ে বলল,
-“আপনি কিন্তু কথা দিয়েছেন আমায়। সকল নিয়ম মেনে চলবেন।”

-“তাই বলে সকলে আমার গাল কপাল ছোঁবে? নেভার। আই জাস্ট হেইট দিস।”

-“ঘৃণা করলেও কিছু করার নেই। আপনি চুপচাপ বসে থাকুন। হুশ! আর একটা কথাও নয়।”

জেহের মুখ গম্ভীর রেখেই বসে থাকল। জেসমিন চৌধুরী এসব দেখে হাসলেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আফজালকে বললেন,
-“আমি বলেছিলাম না, ইনশিতাই আমাদের জেহেরকে ঠিক করতে পারবে? দেখো, কী সুন্দর ইনশিতার সব কথা মানছে জেহের।”

আফজাল চৌধুরীও সায় জানালেন তাতে। আল্লাহর কাছে লাখ শুকরিয়া আদায় করলেন ইনশিতাকে জেহেরের ভাগ্যে জোটানোর জন্য।

ইনশিতাকে হলুদ ছোঁয়ানোর সময় জেহের এক অকল্পনীয় কাজ করে বসল। সে নিজেই হলুদ নিয়ে সবার আগে ইনশিতার গালে ছুঁয়ে দিলো। ইনশিতার তখন লজ্জায় মরিমরি অবস্থা। চারদিকের ক্যামেরা, মানুষজনের চোখ তখন তাদের দিকে। এর মাঝে জেহেরের এই কাজে ইনশিতা পারে না দৌড়ে পৃথিবীর বাইরে চলে যায়। ইনশিতাকে যখন সকলে হলুদ ছোঁয়াবে তখন জেহের একদম ঘুরে বসেছিল ইনশিতার দিকে। জেহেরের এমন কাজে সকলে হাসে, ইনশিতার জান যায় তখন, কেমন বেহায়ার মতো তার দিকে ফিরে আছে! তবে জেহের কাউকে পরোয়া করে না। সে যারা যারা হলুদ দেয়, তাদের সকলের আঙুলের দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে থাকে। ইনশিতার গালে মাত্র একটি আঙুল দিয়ে হলুদ ছোঁয়ানোর আদেশ দেয় সে। শুধুমাত্র একবার করে এক আঙুল দিয়ে যাতে হলুদ ছোঁয়ায় সেটাই লক্ষ্য রাখছে জেহের। তবে ইনশিতার বাবা ছাড়া আর কোনো পুরুষদের ইনশিতাকে হলুদ ছোঁয়াতে দেয় না সে, এমনকি ছোট বাচ্চাদেরকেও না। সকলের আঙুল ইনশিতার গালে লাগলেই জেহের ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে যায়। যার কারণে তার মুখমন্ডল পুরো লাল হয়ে আছে। তবুও কিছু বলছে না।

হলুদ পর্ব শেষ হলে ইনশিতা একটা রুমে চলে যায়। নয়নিকা ইনশিতার সাথেই রুমে ঢুকে। নয়নিকাকে রেগে যেতে দেখে ইনশিতা জিজ্ঞেস করে,

-“কি রে? তুই এমন রেগে আছিস ক্যান? কেউ কিছু বলছে নাকি?”

নয়নিকা রাগে ফেটে পড়ে,
-“তোর ঐ বালের জেহেরের জন্য আমার সব ইচ্ছা শেষ হয়ে গেছে। শালার বাচ্চা শালায় এমন ক্যান? আমার তোর বিয়ে নিয়ে অনেক ইচ্ছা ছিল। ভাবছিলাম, হলুদের সময় তোর পুরা চেহারা মেখে হলুদ লাগামু। তোরে নিয়া ডান্স দিমু। কিন্তু তোর ঐ পেয়ারের সোয়ামী তো এইসব কিছুই করতে দিতেছিল না। তোরে এক আঙুল দিয়া হলুদ ছোঁয়াইতে হইছে, তাও আবার একবার এক গালে দিতে বলছে, নাচ গানে তোরে যাইতে দেয় নাই। এইটা কোনো কথা? কী বালের একটা সোয়ামী পাইছস তুই।”

-“উফ, গালি দিস না তো। আমি আর কি করবো? এমনেই যেটুকু করছে সেটাও অনেক কষ্টে রাজি করায়া করাইছি। আমারও তো অনেক ইচ্ছা ছিল, নিজের হলুদে সেই নাচমু। সকলরেও হলুদে মাখিয়া ফেলমু। কিন্তু এসব আর হলোই বা কই?” ইনশিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। যেথায় মিশে আছে দুঃখ অবসাদ আর কষ্ট।

নয়নিকা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল।
-“দেখিস, ঐ জেহের তোর জীবনটারে জাহান্নাম বানায় দিবো। হলফ করে বলতে পারি।”

ইনশিতার চোখ মুহুর্তেই ছলছল হয়ে গেল। নয়নিকা তা দেখে দমে গেল। আশ্বস্ত করতে বলল,
-“আরে এমন সিরিয়াসলি নেস ক্যান? এগুলা কিছুই হবে না। আমি তো দুষ্টামি করলাম।”

ইনশিতা চোখের পানি মুছে বিষাদের হাসি হাসল।
-“এটা একদম সত্যি। বাবাও বলেছে এই কথাটা। জেহের আসলেই জাহান্নাম বানিয়ে দিবে আমার জীবনটা। এটা আমি নিজেও জানি। কিন্তু কিছু করার নেই আর। ও হুমকি দিয়েছে আমার বাবাকে, আমার সাথে বিয়ে না দিলে জেহের বাবাকে মেরে ফেলবে বলেছে।”

নয়নিকা বিস্ফোরিত চোখে তাকালো।
-“কি বলিস?”

-“হুম। সত্যিই এটা বলেছে।”

তাদের কথাবার্তার মাঝেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ আসলো। ইনশিতা গিয়ে দরজা খুলতেই ওর দুরসম্পর্কের কিছু কাজিন ঘরে ঢুকল। তাদের সাথে খোশগল্পে মেতে উঠল সে। এক কাজিনের ছোট্ট একটা মেয়ে আছে। তোয়া নাম। আড়াই বছরের। মেয়েটি এত কিউট, গুলুমুলু, ইনশিতার খুব ভালো লাগল মেয়েটিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তোয়া আর ইনশিতার মধ্যে ভাব জমে গেল। তোয়ার আধো আধো গলায় কথা বলা শুনে ইনশিতা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে।

তোয়া ইনশিতার গলা জড়িয়ে বলে,
-“তুমি অনেত তুন্দল।”

ইনশিতা হেসে নিজেও ওর মতো করে বলে,
-“থত্যি?”

-“থত্যি। আমাল তেকেও তুন্দল।”

ইনশিতা আলতো হাতে গাল টেনে ধরল। আদুরে গলায় বলল,
-“ওলে আমাল গুলুমুলুরে।”

বলেই সারামুখে চুমু দিতে লাগল। তার দেখাদেখি তোয়াও নিজের ছোট ছোট হাতে ইনশিতার মুখ ধরে চুমু দিতে লাগল। বলতে গেলে লালায় ভরিয়ে দিচ্ছিল মুখটা। তবুও কিছু বলল না ইনশিতা। উল্টো হাসতে লাগল।

এই দৃশ্য দেখে সবাই হাসলেও অদূরে কেউ একজন ঘাড় কাত করে রাগে ফুঁসছে। সেটা আর কেউ নয়। জেহের! সে মাত্রই এসেছিল ইনশিতার কাছে। আর এসেই দেখল। যেখানে সে বাচ্চাদেরকেও দুরে রেখেছিল হলুদের সময়, সেখানে একটা বাচ্চা তাকে চুমু খাচ্ছে?

জেহের গিয়ে প্রথমেই সবাইকে বলল চলে যেতে। রাগী কন্ঠের আওয়াজে সকলেই সুরসুর করে চলে গেল একমাত্র নয়নিকা আর তোয়া বাদে। জেহের একবার শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল নয়নিকার দিকে। সেই দৃষ্টি দেখেই নয়নিকা এক দৌড়ে রুমের বাইরে। জেহের এবার রোজের কোলে থাকা তোয়ার দিকে তাকাল। তোয়া ইনশিতার ঘাড়ে মাথা দিয়ে চুল নিয়ে খেলছে। জেহের হালকা হেসে তোয়ার হাত ধরল,

-“আপনাকে কি কোলে করে দিয়ে আসতে হবে ম্যাডাম?”

ইনশিতা নিজেই বলল,
-“ও কোত্থাও যাবে না। এখন আমার সাথেই থাকবে।”

জেহের একবার ইনশিতার দিকে তাকাল। এখনো গায়ে হলুদের সাজে রয়েছে সে। জেহের ভালো করে উপর থেকে নিচে একবার চোখ বুলাল। তা দেখে ইনশিতা বিব্রতবোধ করল। বিব্রত পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে জেহেরের কোলে তোয়াকে দিয়ে দিল ইনশিতা।

-“আমি গিয়ে চেঞ্জ করে আসছি, আপনি ওকে একটু রাখুন।”

বলেই দ্রুত জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। জেহের ইনশিতার যাওয়ার পানে একবার তাকিয়ে তোয়ার দিকে তাকাল। বলল,
-“তোমার নাম কী বেবি?”

তোয়া চোখমুখ কুঁচকে আছে। বোধহয় অচেনা কারো কোলে উঠতে ভালো লাগে না তার। উত্তর না দিয়ে বলল,
-“আমি ঐ আন্তিল কাতে দাবো।”

-“ঐ আন্টি তো এখন ব্যস্ত আছে বাবু। আমি তোমার আংকেল। আংকেলের কাছে থাকতে প্রবলেম কোথায়?”

বলেই তোয়ার গালে আস্তে চিমটি দিল। এরকম কথা বলতে বলতে জেহের তোয়ার গালে আরো অনেক চিমটি কাটল। তাও আস্তে। তারপর শেষবার খুব জোরে চিমটি দিয়ে ফেলল। ইচ্ছে করেই দিয়েছে জেহের। মেয়েটা তখন তার রোজকে চুমু দেয়ার ফল এটা। কিন্তু এই জেহেরকে কে বুঝাবে যে বাচ্চারা কিছুই জেনে বুঝে করে না, তারা যা করে সব অনুকরণ। তবে জেহের সেগুলো বুঝতে চায় না, বুঝবেই বা কীভাবে? পাগলেরা কী অতকিছু বোঝে নাকি? চোখমুখ লাল হয়ে গেছে জেহেরের। ইচ্ছে করছে মেয়েটিকে ছুঁড়ে কয়েকটা আছাড় দেয়। সেটা না পেরেই চিমটি দিল অনেক। ব্যথা পেয়ে তোয়া কেঁদে উঠল। হাসল জেহের। শাস্তি দিতে পারার তৃপ্তির হাসি।

ইনশিতা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখল ঘরে জেহের আর তোয়া নেই। ব্যালকনিতেও নেই। চিন্তা হতে লাগল ইনশিতার। কোথায় গেল হঠাৎ? তখনই জেহের তোয়াকে কোলে নিয়ে রুমে ঢুকে। ইনশিতা দেখল তোয়ার হাতে বড় চকলেট, অথচ চোখমুখ দেখে মনে হয় কেঁদেছে অনেক। জেহের হাসি হাসি মুখ করে ইনশিতার দিকে আগালো। ইনশিতার কাছে আসতেই তোয়া ইনশিতার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

ইনশিতা বলল,
-“তোয়া কেঁদেছে কেন?”

জেহের অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। সে তো তোয়ার মুখ ধুইয়ে এনেছিল। তাও ইনশিতা বুঝে গেল! আমতা আমতা করেই বলল,
-“আসলে বাচ্চাটা কেঁদেছিল চকলেট খাওয়ার জন্য। তাই নিচে নিয়ে গিয়েছিলাম চকলেট কিনে দিতে।”

-“ওহ।”

জেহেরের ফোন আসায় সে ব্যালকনিতে চলে গেল। ইনশিতাও তোয়াকে নিয়ে বেডে বসল। ইনশিতা খেয়াল করল তোয়ার দুই গাল অসম্ভব রকমের লাল হয়ে আছে।
-“একি তোয়া। তোমার গাল লাল হয়ে আছে কেন?”

তোয়া তখন চকলেট খেতে ব্যস্ত। কাঁদার পর জেহের চকলেট কিনে দিয়েছিল যাতে আর কান্না না করে। বাচ্চা মানুষ চকলেট পেয়ে কান্না থামিয়ে দিয়েছিল। তোয়া আধো আধো গলায় বলল,

-“আনতেল তিমতি দিতে আমালে।”

-“কেন?”

তোয়া ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল। হয়ত উত্তর খুঁজছে। সে তো নিজেই জানেনা কেন সে জেহেরের ক্রোধের শিকার হয়েছিল। ইনশিতা ভাবল, আদর করে চিমটি দিলে কখনো এমন লাল হওয়ার কথা না। আর নখের আঁচ কিছুটা বোঝা যাচ্ছে। জেহের তো কখনো কাউকে কারণ ছাড়া কষ্ট দেয় না। নয়নিকা আর রাফিদকে টাচ করার জন্য শাস্তি দিয়েছে। তাহলে এই বাচ্চাটিকে? আর জেহের বাচ্চাদেরকেও ইনশিতার কাছে আসতে দেয় না। ইনশিতা ভাবতে লাগল তোয়ার উপর কেন রাগল জেহের। এটা যে জেহেরের ইচ্ছাকৃত কাজ সেটা সে ভালো করেই বুঝল।

জেহের ব্যালকনি থেকে এসে একদম ইনশিতার কাছে চলে আসে। ইনশিতার গলায়, ঠোঁটে পানির ছিটে। তা দেখে জেহেরের নেশা ধরে গেল। জেহের পেছনে একহাত নিয়ে ইনশিতাকে দাঁড় করিয়ে কোমড় চেপে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। ঠোঁটে হাত দিতে যাবে তখন ইনশিতা কঠোর স্বরে বলল,

-“আপনি তোয়াকে চিমটি কেটেছেন কেন? বাচ্চাটির কী অপরাধ ছিল?”

জেহেরের মেজাজ গরম হয়ে গেল। এ কে তো রোমান্টিক মুড নষ্ট করায়, আর দ্বিতীয়ত কোথাকার কোন বাচ্চার জন্য তার কাছ থেকে কৈফিয়ৎ চাওয়ায়। তবুও শান্ত স্বরে বলল,
-“ওটা জাস্ট আদর করে চিমটি কেটেছি।”

-“কোনটায় আদর মেশানো আর কোনটায় রাগ মেশানো সেটা আমাকে বোঝাতে আসবেন না।” ইনশিতার কাট কাট জবাব।

-“আমি বললাম তো…”

ইনশিতা চেঁচিয়ে বলল,
-“জবাব দিন শুধু। আপনি ওর উপর রেগেই এমন করেছেন তাই না?”

জেহের ঘাড় কাত করল। চোখে অগ্নি বর্ষণ হচ্ছে যেন। বাঁকা হেসে ইনশিতাকে ঘুরিয়ে ইনশিতার কাঁধে থুতনি রাখল। ইনশিতা ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই আর জোরে চেপে ধরল। ইনশিতার কাঁধে মাথা হেলিয়ে শান্ত স্বরে বলে,

-“এই জন্যই তোমাকে এত এত ভালোবাসি। কী সুন্দর ধরে ফেললে। তোমার ব্রেইন ভালো বলতে হয়। সবকিছু বুঝে যাও। কিন্তু রোজ, সবসময় এত বেশি বোঝা ভালো না। কিছু কিছু সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চুপ থাকতে হয়। কিন্তু তুমি তো তুমিই।”

-“একদম ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলবেন না।”

-“ওকে ওকে, রাগ করে না সোনা। আমি এই বাচ্চাটার উপর কেন রেগে আছি জানো? কজ শী কিসড ইউ। আর আমি ছাড়া তোমাকে কিস তো দুরে থাক, আমার অনুমতি ছাড়া টাচ করলেই হাত গুড়িয়ে দেব।”

ইনশিতা বিস্মিত হয়ে রাগী গলায় বলল,
-“ও একটা বাচ্চা জেহের। একটা বাচ্চার উপর এমন আচরণ অন্তত আপনার থেকে প্রত্যাশা করিনি। বাচ্চারা তো কত কিছুই করে। আর ওরা তো আর জেনে বুঝে কিছুই করে না তাই না? আপনার বোঝা উচিত ছিল।”

জেহের ইনশিতাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে ধরল। চোয়াল শক্ত করে কঠিন গলায় বলল,
-“সে বাচ্চা হোক আর যাই হোক। তোমাকে কেউ টাচ করলেই আমার খুব রাগ লাগে।”

ইনশিতা বিড়বিড় করে বলল,
-“আপনার মত ম্যাড আমি আমার জীবনে প্রথম দেখছি। তাও আবার সে আমার পোড়া কপালেই জুটল!”

জেহের ইনশিতাকে ছেড়ে বিছানায় খেলতে থাকা তোয়াকে কোলে উঠিয়ে নিলো। ইনশিতা তোয়াকে নিজের কোলে নেওয়ার জন্য জোরাজুরি করতে করতে বলল,
-“ওকে নিয়ে আবার কোথায় যাচ্ছেন? আপনার উপর বিশ্বাস নেই। দিন ওকে।”

জেহের ইনশিতার ঠোঁটে আঙুল চেপে বলল,
-“আমার আর তোমার মাঝে কোনো থার্ড পারসন আমি অ্যালাউ করব না। বাচ্চাটাকে বাহিরে রেখে আসছি।”

তারপর তোয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আর কোনোদিন যাতে তোমাকে এই আন্টির আশেপাশে না দেখি বাবু। নাহলে খারাপ কিছু হয়ে যাবে। কেমন?”

তোয়া কি আর এসব বুঝে? সে তো খেলনা নিয়ে খেলতে ব্যস্ত।

-“বাহিরে রেখে আসতে হবে না, আমি ওর আম্মুকে আসতে বলছি।”

তোয়া চলে যাওয়ার পর জেহের দরজা বন্ধ করে দেয়। তা দেখে ভয় পেয়ে যায় ইনশিতা। কিছু করবে না তো? যতই সাহসী দেখায় না কেন শেষে তো সে একজন মেয়ে। আর পুরুষের শক্তির সাথে সে তো কখনো পেরে উঠবে না। জেহের ইনশিতাকে আচমকা কোলে তুলে নেয়। ইনশিতা হতবাক হলেও পরে চেঁচামেচি করে নামানোর জন্য। জেহের কড়া চোখে তাকিয়ে বলে,

-“ডোন্ট শাউট রোজ।”

তবুও চেঁচামেচি থামায় না ইনশিতা। বারান্দায় গিয়ে জেহের একটা চেয়ারে বসে ইনশিতাকে নিজের কোলে বসিয়ে দেয়। জেহেরের থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য সে মোচড়ামুচড়ি করা শুরু করে দেয়। জেহের হিসহিসিয়ে বলে,

-“আমার থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা এ জীবনেও করবে না। এটা তোমাকে আগেও বলেছি। সবসময় আমার থেকে দুরে থাকার চিন্তা। না? শুনে রাখো, যতই উড়োউড়ি করো না কেন, শেষ পর্যন্ত তো এই জেহেরের ভালোবাসার খাঁচায়ই বন্দী হতে হবে।”

জেহেরের এমন কন্ঠ শুনে কেঁপে উঠে ইনশিতা। এত কাছে জেহের যে তার নিঃশ্বাস ইনশিতার পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। চোখ বন্ধ করে আছে সে। জেহের হুট করে ইনশিতার গলার ওড়না টান মেরে নিয়ে নেয়। চমকে গিয়ে নিজের দু’হাত দিয়ে আড়াআড়িভাবে গলায় চেপে ধরে ইনশিতা। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,

-“আ-আমি আপনাকে আগেও ব-বলেছি আমার এসব ভালো লাগে না। ও-ওড়নাটা দিন বলছি।”

জেহের ওড়নাটা নিজের একহাতে পেঁচিয়ে রাখে। চোখে তার মাদক চাহনি। যা ইনশিতার গলায় আবদ্ধ। নেশা জাগানিয়া কন্ঠে বলে,

-“এত ভয় পাও কেন হু? আমি তো তোমার স্বামী তাই না?”

-“এখনো হননি। হবু স্বামী।”

-“হোয়াটএভার। স্বামী না হয়েও তোমার ওপর অধিকার ফলাতে পারি আমি। দেখাব নাকি?”

-“না-না, না।”

জেহের উচ্চকন্ঠে হেসে উঠল। হাসি থামিয়ে বলে,
-“তোমার ঐ গলার তিলটা আজকে অনেক বড় ভুল করেছে। একদম বেহায়ার মত সবাইকে দেখিয়েছে নিজেকে। তার শাস্তি তো পেতেই হবে।”

জেহেরের কথায় রাগের আভাস পায় ইনশিতা। তোতলিয়ে বল,
-“ম-মানে?”

-“গলার তিলটা সবাইকে দেখানোর প্রয়োজন ছিল? ঢেকে রাখলে না কেন?”

ইনশিতা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। জেহের গলার তিলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

-“গেট রেডি ফর পানিশমেন্ট।”

বলেই একদম তিল বরাবর চুমু খেতে লাগল। ইনশিতা এখনো হতভম্ব। হতভম্ব ভাব কাটতেই জেহেরকে ঠেলে সরিয়ে দিতে লাগল।

-“জেহের প্লিজ। ছাড়ুন আমায়।”

জেহেরের কর্ণকুহরে কিছুই ঢুকছে না। সে গলায় চুমু দিতে দিতে পুরো গলা ভিজিয়ে দিল। ইনশিতা না পেরে জেহেরের চুল শক্ত করে টেনে ধরে সরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ইনশিতা শক্ত হয়ে চোখ খিঁচে রইল। কিছুক্ষন বাদে ইনশিতা সূক্ষ্ম আওয়াজে কুকিয়ে উঠল। জেহের চুমুর পাশাপাশি কামড়ও দিচ্ছে। খুব জোরেও না, আবার আস্তেও না। জেহেরের হাত পেটে চলে গিয়েছে। জামার উপর দিয়েই হাত বিচরণ করছে। জেহের যখনই জামাটা উঠিয়ে নিবে তখন ইনশিতা হুট করে হাতে জোরে খামচি বসিয়ে দিলো। জেহের ব্যথাতুর আওয়াজ তুলে গলা থেকে মুখ উঠাল। ইনশিতা ভেবেছিল জেহের হয়ত এখন তাকে আবার কোনো পানিশমেন্ট দিবে। কিন্তু তা না করে জেহের ইনশিতার হাতের দিকে তাকিয়ে হাতেই চুমু খেতে লাগল। ইনশিতা আশেপাশে তাকিয়ে পাশের টবটা হাতে নিয়ে জোরে আছড়ে ফেলে ফ্লোরে। হঠাৎ এমন আওয়াজে জেহের চমকে গিয়ে রাগান্বিত দৃষ্টিতে ইনশিতার দিকে তাকায়। ইনশিতা জেহেরের কোল থেকে উঠে দাঁড়ায়। জেহের নিজেও উঠে ইনশিতার দিকে এগোয়। আবারও ইনশিতাকে ধরবে তার আগেই জানালা বরাবর ঢিল ছুঁড়ে কেউ। একদম জেহেরের কানের কাছ দিয়ে ঢিল দেওয়া হয়েছে। যেন জেহেরকে সাবধান করে দিচ্ছে ইনশিতার কাছে না যাওয়ার। জেহের একবার নিচে চোখ বুলায়। দেখে কেউ নেই। তবে সে বুঝে গেছে কেউ একজন ইচ্ছে করে এমন করেছে। তীক্ষ্ণ নজরে একবার তাকিয়ে রোজকে নিয়ে রুমে চলে গেল। রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রোজের কপালে চুমু দিয়ে বলল,

-“কালকের পর তুমি পুরোটাই আমার হয়ে যাবে। তখন কি করে আটকাবে? হু?”

বলেই বাঁকা হেসে চোখ মেরে চলে গেল। আর ইনশিতা হা করে তাকিয়ে রইল।
#প্রহেলিকা
#পর্ব_১২
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

———————–

ইনশিতা হাত, মুখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে গাড়িতে। পরনে বিয়ের সাজ। সন্ধ্যা নেমে এসেছে প্রায়। গাড়িতেও আলো নেই। যার কারনে ইনশিতা গাড়িতে কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না। তবে বুঝতে পারছে ড্রাইভার সীট ছাড়া আর কোথাও কেউ নেই। বিকেলের আগেই তাকে মেকআপ রুম থেকে কয়েকজন বোরকা পরিহিত মহিলা জোর করে হাত মুখ বেঁধে সকলের আড়ালে এই গাড়িতে ধরে বেঁধে উঠিয়ে দিয়েছে। চিৎকার চেঁচামেচির কোনো সুযোগই পেল না সে। এতক্ষণ ধরেই সে গাড়িতে। গাড়ি কোথায় যাচ্ছে সেটাও বুঝতে পারছে না। ওদিকে জেহের কোনো হাঙ্গামা সৃষ্টি করেছে কি না কে জানে?

ইনশিতার হুট করেই ঐ দিন রাতের কথা মনে পড়ল। সেদিন যখন সে ব্যালকনির দরজা খুলছিল তখন কেউ একজন হাত ধরে হেচকা টানে দেয়ালে চেপে ধরে। চিৎকার দিতে গেলে লোকটি মুখ চেপে ধরে। রাস্তার ক্ষীণ আলোয় দেখতে পেল জেহেরকে। একদম তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে আছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে জেহের। যেন ভয়ানক রেগে আছে। ভয় ঝেঁকে ধরল তাকে। এত রাতে কীজন্য এসেছে জেহের?

-“বিয়েটা একদম করতেই হতো তোমাকে? একবার না করলে না কেন? তুমি জানো এই বিয়েটা করলে তোমার লাইফ হেল হয়ে যাবে?”

জেহেরের রাগী কন্ঠ শুনে ইনশিতা যারপরনাই অবাক হয়। যেখানে জেহের নিজেই বিয়ে করার জন্য পাগল সেখানে সে এই কথা বলছে? তবে জেহেরের ভয়েসটা কিছুটা অন্যরকম লাগছে। ইনশিতা একবার ভালো করে তাকাল। একি! এটাতো জিহাদ! জিহাদ চশমা পড়েনি তাই তখন তাকে জেহের ভেবেছিল। কিন্তু কুচকুচে কালো চোখের মনি দেখে বুঝে গেছে এটা জিহাদ। জিহাদ হঠাৎ এমন আচরণ করছে কেন সেটা ইনশিতার বোধগম্য হচ্ছে না। শুধুমাত্র জেহের নামক এক পাগলকে বিয়ে করার জন্যই না কি?

ইনশিতা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে সরে দাঁড়াল।

-“এত রাতে একটা মেয়ের বাড়িতে চলে আসার মানে কি? আর জেহের জানলে কি হবে ভেবে দেখেছেন?”

জিহাদ ইনশিতার হাত চেপে ধরে কার্ণিশের সাথে চেপে ধরল। ইনশিতার হাত জিহাদের দু’হাত দ্বারা এক প্রকার বন্দী করে নিলো।

-“ভাই ঘুমোচ্ছে। আর তুমি আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। কেন বিয়েতে রাজি হয়েছ?”

ইনশিতা একবার পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল জিহাদের দিকে। জিহাদের চোখে রাজ্যের অসহায়ত্ব। চোখ দুটো যেন খুব কষ্টে মেলে রেখেছে। ঘোলাটে চোখে মনে হয় কত রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। কেমন উদভ্রান্তের মতো লাগছে দেখতে। ইনশিতা চোখ সরিয়ে নিল।

-“জেহেরকে তো আপনি আমার চেয়েও ভালো চিনেন। উনি যেটা সেটা জোর করে হলেও আদায় করে নেয়। আমি যদি বিয়েতে রাজি হই তাহলে উনি বাবাকে মেরে ফেলবেন বলেছিল। আর এমনিতেও ওনার সাথে বিয়ে হলে তো সব সমস্যা মিটেই যাবে। উনি সুখী থাকবেন আর ঝামেলাও পাকাবেন না, তাতে সকলেই সুখী থাকবে।”

-“তুমি সুখী থাকবে তো?”

এই একটা প্রশ্ন যেন ইনশিতার ভেতরতা নাড়া দিলো। চোখে টলমল করে উঠল জল। সে কি আসলেই সুখী থাকবে? হয়ত না। মেকি হাসি দিয়ে বলল,

-“সুখী না থাকার কি আছে? সবাই সুখী তো আমিও সুখী।”

জিহাদ কিছুই বলছে না। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ইনশিতার দিকে। ইনশিতার কেমন যেন লাগল। সে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করল। কিন্তু জিহাদ এত শক্ত করে ধরে আছে যে চাইলেও সরাতে পারছে না। ইনশিতা অস্বস্তি ভরা কন্ঠে বলল,

-“আপনি দূরে সরে দাঁড়ান। ভালো লাগছে না?”

-“জেহের কাছে আসলে খুব ভালো লাগে বুঝি? ওর ছোঁয়া খুব উপভোগ করো তাই না?”

জিহাদের এমন কথায় ইনশিতার মনে ঘৃণার সৃষ্টি হলো। ছিঃ! জিহাদ এই ধরনের কথা বলছে কেন? ঝাঁঝাল গলায় বলল,

-“মুখ সামলে কথা বলুন।”

-“আরে আরে, সুইটহার্ট দেখছি রেগে যাচ্ছে। ওর ছোঁয়া আর আমার ছোঁয়ায় পার্থক্য আছে? আমি ছুঁয়ে দিলেও তোমার ভালো লাগবে। দেখো,”

বলেই নিজের নাকটা ইনশিতার গালের কাছে নিয়ে গেল। ইনশিতা মুখ ফিরিয়ে নিলো। গা ঘিনঘিন করে উঠছে তার। এটা বুঝতে পারল যে জিহাদও তাকে কোনো না কোনো ভাবে পছন্দ করে। দুই ভাইই এক। যখন তখন সুযোগ খুঁজে কাছে আসার। এখানে থাকাও ঠিক হবে না। ইনশিতা জোরে পা দিয়ে জিহাদের পায়ে লাথি দিলো। হাত আলগা হতেই ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল জিহাদকে। জিহাদ টাল সামলাতে না পেরে পিছু হটল। সেই ফাঁকে ইনশিতা ভিতরে ঢুকে ব্যালকনির দরজা বন্ধ করে দিলো। আর কিছুক্ষণ থাকলে বোধহয় খারাপ কিছু হয়ে যেত। জিহাদ দরজায় ক্রমাগত আঘাত করে যাচ্ছে। ইনশিতার ভয় হলো, যদি বাবা মা শুনে নেয়! তবে আওয়াজ আর শোনা গেল না। জিহাদ রুম আর ব্যালকনির জানালায় হাত রেখে চোখ লাল করে শাসালো,

-“তোমাকে আমি আমার করেই ছাড়বো। বিয়ে হলেও তুলে আনবো। এমনকি দশ বাচ্চার মা হলেও।”

জিহাদ কিছুক্ষন অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ইনশিতার দিকে। ইনশিতা তখন বাথরুমে ঢুকে গিয়েছিল এমন দৃষ্টি হতে বাঁচার জন্য। আধ ঘন্টা পর দেখল জিহাদ আর নেই। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে সে ব্যালকনির দরজা খুলে বসে রইল। শিরশির করা বাতাস গায়ে লাগিয়ে সেখানে ঘুমিয়ে গেল।

.

.

ইনশিতার ভাবনার জাল ছিঁড়ল যখন দেখল কেউ একজন তাকে কাঁধে করে তুলে নিচ্ছে। তবে তার আগে ইনশিতার চোখ বেঁধে দিলো লোকটি। ইনশিতা নিশ্চিত হলো এটা জিহাদ। কারণ জিহাদ সেদিন তাকে হুমকি গিয়েছিল। আর এরকমটা একমাত্র জিহাদই করতে পারে। জিহাদ কি করতে যাচ্ছে আর কি করবে সেটা ভাবতে পারে না ইনশিতা। এখন জেহের-জিহাদ দুই ভাই-ই তার চোখের বিষ। দুই ভাইকেই দেখতে পারে না সে। একজন পাগল তো আরেকজন ছাগল।

ইনশিতা অনুভব করল তাকে কোথাও বসানো হয়েছে। কিছু দিয়ে তাকে সেই বসার জায়গায় আটকে রাখা হয়েছে। আর একটু বাদেই অদ্ভুত শব্দ কানে আসল। তার মনে হয় সে দুলছে। সে কি উড়ছে না কি?

.
ইনশিতার বাবা মা বসে আছে জেহেরের সামনের সোফায়। জেহের পায়ের উপর পা তুলে কপালে হাত দিয়ে বসে আছে আর বিড়বিড় করছে। বিয়ের জন্য যখন ইনশিতাকে সাজাতে নেওয়া হয় তখন থেকেই ইনশিতাকে পাওয়া যাচ্ছে না। জেহের অনেক খুঁজেও ইনশিতাকে পায়নি। ইনশিতাকে না পেয়ে জেহের পাগল হয়ে গিয়েছিল প্রায়। বিয়ের ডেকোরেশন পুরো তছনছ করে দিয়েছিল। চেয়ার টেবিল, খাওয়া দাওয়ার জিনিস সব উল্টে পাল্টে ভেঙে দিয়েছিল। কয়েকজন থামাতে এলে তাদেরকেও রক্তাক্ত করতে বাদ রাখেনি। জেহেরের হিংস্রতা প্রায় সবাই দেখে নিয়েছিল তখন। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে সবাই এক কোণে ঠক ঠক করে কাঁপছিল। জেহেরের তখন চোখ যায় ইনশিতার বাবার দিকে। তার মনে হয় ইনশিতার বাবা-ই তার রোজকে পালাতে সাহায্য করেছে। কারণ ইনশিতার বাবা শেষ মুহূর্তে বিয়েটা ভাঙতে বলেছিল। তাই ইনশিতার বাবাকে ধরে এনে সামনে বসিয়ে রেখেছে। ইনশিতার বাবা নিজেই তো জানে না তার মেয়ে কোথায়। তিনি নিজেও চিন্তা করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তার উপর জেহেরের সন্দেহের শিকার হয়েছেন। জেহের যে তাকে সহজে ছেড়ে দেবে না সেটা তিনি ভালোই বুঝতে পারছেন। জেহের চোখ বন্ধ রেখেই গম্ভীর গলায় বলে,

-“রোজ কোথায়? কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন ও কে?”

ইনশিতার বাবা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত গলায় বলেন,
-“আমি নিজেও জানি না বাবা ইতু কোথায় আছে।”

জেহের এবার চোখ খুলে তাকাল। চিৎকার করে বলে উঠে,

-“নিজে পালাতে সাহায্য করে এখন নিজেই বলছেন জানেন না? আমাকে বোকা পেয়েছেন আপনি?”

বলেই পাশে থাকা গ্লাস ছুঁড়ে মারে একদম ইনশিতার বাবার কপাল বরাবর। ইনশিতার বাবা কপালে হাত চেপে বসে পড়েন। হাতের আঙুলের ফাঁক গলে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ইনশিতার মা আঁতকে উঠে ইনশিতার বাবাকে ধরেন। জেসমিন চৌধুরী আর আফজাল সাহেবও এগিয়ে আসেন।

জেহের সবাইকে সরিয়ে ইনশিতার বাবার পাঞ্জাবির কলার তুলে টেনে ধরেন। চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে তার। ঘাড়, হাত আর কপালের রগ ফুলে উঠেছে। গলা আর পুরো মুখ লাল হয়ে আছে। জেহের আর কিছু করবে তার আগেই তার মোবাইল বেজে উঠে। ফোন তুলতেই ওপাশ থেকে কেউ কিছু একটা বলল। তা শুনে জেহেরের ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। ঘাড় কাত করে ইনশিতার বাবার দিকে তাকিয়ে ইনশিতার বাবার কলার ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,

-“ডিয়ার ফাদার-ইন-ল। আমি আর একটু পরই আসছি। আসল ঘটনাটা শুনে তো আসি আগে। যদি শুনি রোজের পালানোর ব্যাপারে আপনার হাত আছে তাহলে আজকের দিনটা আপনার জন্য শেষ দিন হবে। আমি না আসা পর্যন্ত যা করার করে নিন।”

বলেই জেহের একবার ইনশিতার বাবার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেল। ইনশিতার বাবা বসে পড়লেন। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।

.

.

ইনশিতাকে কেউ কোলে করে নিয়ে হেঁটে চলছে। তারপর ইনশিতাকে তার কোলেই বসিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে নিলো। চারিদিক রাতের অন্ধকারে ছেয়ে আছে। ইনশিতার কেমন ঘুমঘুম লাগছে। তৃষ্ণায় গলা কাঠ হয়ে গেছে। মুখ বাঁধা থাকায় কিছুই বলতে পারল না। কিছু না খেয়ে থাকায় শরীরটাও ছেড়ে দিচ্ছে কেমন। কোলে রাখা ব্যক্তির বুকেই মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সে। আর ব্যক্তিটি একধ্যানে ইনশিতার দিকে তাকিয়ে ইনশিতার চুল কানের পাশে গুঁজে দিয়ে কপালে চুমু দিলো। ইনশিতার শীত লাগায় লোকটির কোলে আরো গুটিশুটি মেরে ঘুমালো। লোকটি হালকা হেসে গাড়ির জানালা তুলে দিল। একটি চাদর বের করে ইনশিতার গায়ে জড়িয়ে দিলো। নিজেও ইনশিতাকে শক্ত করে চেপে ধরল। উষ্ণতায় ইনশিতা আরো গভীর ঘুমে চলে গেল।

.
.
চলবে…

[হঠাৎ করেই গল্পের প্লটটা এলোমেলো হয়ে গেছে। জানি না কেন। তবে আজকে লিখতে গিয়ে এমন মনে হলো, যেমনভাবে লিখতে চেয়েছিলাম তেমনভাবে হচ্ছে না। আর এমনিতেও আমি প্লট ভালো করে সাজাতে পারি না। আমার প্রথম পর্ব আকারে গল্প এটা। জানি না প্লট কেমন হচ্ছে। আজকের পর্বে কীভাবে কী থেকে কী লেখেছি নিজেও জানি না-_-]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here