#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ১৭
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
একটা বিশাল পোর্টরেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন একজন বৃদ্ধ।বয়স তার পঁচাত্তরের উর্ধ্বে।সফেদ পাঞ্জাবী আর শুভ্র দাঁড়িতে তাকে শুভ্র আকাশ মনে হচ্ছে।গোলাপী ফর্সা মুখটাতে এখনো যৌবনের জৌলুশ উঁকি দিচ্ছে।পেছনের দিকে এক হাতের পাঞ্জার উপর আরেক হাতের পাঞ্জা রেখে দৃঢ় হয়ে অপলক চেয়ে আছেন সেই পোর্টরেটের মানব-মানবীর দিকে।প্রায় ডজন খানেক মানুষের প্রতিচ্ছবি।একটা শীতল দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে রাজন শিকদারের বুক চিরে।পোর্টরেটের সামনে থেকে সরে এসে বিশাল ঘরটার এইপ্রান্ত থেকে ওইপ্রান্তে বারকয়েক পায়চারী করেন তিনি।পঁচিশ বাই বাইশ দৈর্ঘ্য-প্রস্থের কক্ষের বিশাল জানালায় উড়ছে শুভ্র রঙের পাতলা ফিনফিনে পর্দা।
নরম রোদের মিষ্টি আলো ঝুলে আছে গ্রীলে।তা চুইয়ে চুইয়ে ভেতরে আসছে।সেই সাথে মৃদু সমীরণে উড়ছে সেই পর্দা।জানালার পাশে রাখা আরাম কেদারায় বসলেন রাজন শিকদার।পুরু সফেদ রঙের ভ্রুয়ের নিচে দুটো জ্বলজ্বলে চোখ।যাতে রয়েছে তেজস্বিতা।নিমীলিত চোখে ছোট্ট শ্বাস ফেললেন রাজন শিকদার।আরাম কেদারা দুলে উঠলো।রাজন শিকদার জানালা দিয়ে আসা স্নিগ্ধ সমীরণে শ্বাস নিতে লাগলেন।প্রশান্তিতে তার পুরু অধরে বিস্তৃত হলো হাসি।অমিলীত চোখে চাইলেন সামনের ব্যক্তিটির দিকে।চমৎকার হাসলেন তিনি।সামনের ব্যক্তি অনুগত সহচারীর মতো মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করলেন।বিগলিত গলায় বললেন—
“সুপ্রভাত,জনাব।”
রাজন শিকদার অমায়িক হেসে বললেন–
“সুপ্রভাত।কেমন আছো রাশেদ?
রাশেদ চোখে হাসলেন।অতলস্পর্শী মায়ায় বললেন—
“ভালো।আপনি কেমন আছেন?
রাজন শিকদার একটু উঁচু হয়ে বসলেন।জানালার দিকে চোখ ফেলতেই দেখলেন কদম গাছটায় থোকায় থোকায় কদম ধরে আছে।রাতের বৃষ্টির ছোঁয়া এখনো প্রতিটি পাতায় পাতায় তার ছাপ রেখে গেছে।রাজন শিকদার চোখের ভারী চশমাটা পাশের টুল থেকে নিয়ে চোখে গলালেন।রাশেদের দিকে চেয়ে বললেন—
“ভালো।”
মৌনতা নেমে এলো তারপর।রাজন শিকদার আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরে চোখ ফেললেন।এখান থেকে যতদূর দেখা যায় তার একমাত্র অধিপতি তিনি।এবং তার অবর্তমানে তার একমাত্র নাতি নিষ্প্রাণ মুনতাসির।যে এখন পর্যন্ত জীবিত।
রাজন শিকদার চক্ষু মুদন করে আরাম কেদারায় পিঠ ঠেকালেন।নিজেকে ঢলে দিলেন তার উপর।মুদিত চোখেই স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করলেন—
“নিষ্প্রাণ কেমন আছে?
রাশেদ মৃদু গলায় প্রত্যুত্তর করে—
“ভালো।তিনি এখন ব্যস্ত আছেন।”
গুমোট শ্বাস ফেললেন রাজন শিকদার।ম্লান গলায় বললেন—
“তার দিকে খেয়াল রাখবে।সে যেনো কোনো অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড না ঘটায়।ডক্টর সার্জিও কী বলেছেন?নিষ্প্রাণ এখন ঠিক আছে তো?
রাশেদ অনুরক্তির সুরে বললো—
“জ্বী জনাব।তিনি বলেছেন,লাস্ট টাইম তার সকল রিপোর্ট পজেটিভ ছিলো।সে নিজেকে কন্ট্রোল করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছেন।ডক্টর সার্জিও এও বলেছেন,তিনি মেন্টালি এখন ফিট।নাথিং টু ওয়ারি।”
রাজন শিকদার চোখ খুললেন।অদ্ভুতভাবে তাকালেন রাশেদের দিকে।রাশেদ চোখ লুকালেন।রাজন শিকদার প্রশ্বস্ত গলায় নরম সুরে বললেন—
“বলো কী বলতে চাও।”
রাশেদ অভয় নিয়ে বললেন—
“তাদের বন্ধুমহলে নতুন একজন এসেছে।মেয়েটির প্রতি তার উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া চোখে পড়েনি আমার।”
রাজন শিকদার অধৈর্য হলেন।তড়াক করে উঠলো তার মস্তিষ্ক।তাড়া দিয়ে বললো—
“কী বলতে চাও ক্লিয়ার করে বলো।”
“জনাব,ক্ষমা করবেন।মেয়েটির নাম আয়েন্দ্রি।বাবা একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে।মা সাধারণ গৃহিণী।ছোট ভাই নিউ টেনের স্টুডেন্ট আর বোন অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া।খুবই সাদামাটা জীবনধারা তাদের।মেয়েটি তার ডিপার্টমেন্টেই অধ্যয়নরত।”
রাজন শিকদার উৎকন্ঠিত হয়ে বললেন—
“তুমি তাকে দেখেছো?কোনো স্পেশালিটিস?
“না জনাব।অত্যন্ত সাধারণ মেয়েটি।”
রাজন শিকদার উঠে দাঁড়ালেন।জানালার গ্রীলের ফাঁকে চোখ গলিয়ে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন—
“সে যেনো আর কোনো ভুল না করে।ডক্টরের সাথে পূনরায় যোগাযোগ করো।তাকে বলবে সে যেনো আবার স্ট্যাডি করে নিষ্প্রাণকে।সে কী আসলেই সুস্থ?
প্রভুভক্ত ভৃত্যের মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন রাশেদ।
“জ্বী জনাব।”
রাজন শিকদার বৃষ্টিস্নাত আকাশ দেখতে লাগলেন।সারারাতের বৃষ্টিতে আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার।শুভ্র মেঘের উড়াউড়ি।নীলাভ আকাশের বুক চিরে তার রাজত্ব।
,
,
,
শহীদ মিনারের সিঁড়ির উপর ক্ষুণ্ণ মনে বসে আছে আয়েন্দ্রি।আশেপাশের কোলাহল তার কর্ণরন্ধ্রে কোনো কিছুর প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করলো না।টুক করেই তার পাশে এসে বসে সীমান্ত।গটগট করে হেসে বললো—
“কিরে আন্দি?এনে বইসা আছোস কেন?
ভ্রু ক্রুটি করে আয়েন্দ্রি।নিষ্প্রভ গলায় বললো–
“কিছু না।প্রাবিশ কোথায়?
“আলাপ মারতাছে বৌদির লগে।তুই এমন মুখটারে লইট্যা মাছের মতো কইরা রাখছোচ ক্যান?
আয়েন্দ্রি দ্বিধান্বিত।তার মনের উচাটন সে বুঝতে পারছে না।তৎক্ষণাত উদয় হয় প্রাবিশের।আয়েন্দ্রির পাশ ঘেঁষে বসে বললো—
“কী হয়েছে তোর?
আয়েন্দ্রি একটু ধাতস্থ হলো।স্বাভাবিক হয়ে বললো–
“তোদের একটা কথা বলবো।”
সীমান্ত ঠ্যাটানো গলায় বললো–
“কবি তো কবি।এতো ঢঙ করার কী আছে!তোগো মাইয়া মানুষের এই রঙ ঢঙ আমার এক্কেরে ভাল্লাগে না।”
আয়েন্দ্রি ভ্রু উঁচু করে চাইতেই প্রাবিশ বললো—
“চুপ কর।বল কী বলবি।”
আয়েন্দ্রি দ্বিধা নিয়ে রয়ে সয়ে বললো—
“প্রাণ আজকাল কেমন অদ্ভুত ব্যবহার করছে।তুই জানিস ও আমাকে,,,,।”
আয়েন্দ্রির কথা শেষ হওয়ার আগেই হু হা করে বাতাস কাঁপিয়ে হেসে উঠে সীমান্ত।প্রাবিশ মুচকি হাসে।আয়েন্দ্রি ভীত চোখে তাকিয়ে বললো—
“হাসছিস কেন তোরা?
সীমান্ত হো হো করে হেসে বললো—-
“ওরে কেউ আমারে মাইরালা।আন্দি ভাবছে নিষ্প্রাইন্না ওরে প্রেমের প্রস্তাব দিছে।তোরা মাইয়ারা পারোসও।পোলারা একটু প্রেমের কথা কইলেই গইলা যাচ!কোনো পার্সোনালিটি নাই তোগো।এর লাইগা আই হেট তোগো মতো মাইয়া।”
আয়েন্দ্রি তপ্ত চোখে তাকায়।রাগান্বিত গলায় বললো—
“কী বলছিস তুই?
“হ্যাপি বার্থডে।”
নিষ্প্রাণের মিষ্টি কন্ঠে উঠে দাঁড়ায় আয়েন্দ্রি।হৃদয় গলানো হাসে নিষ্প্রাণ।অবাক চোখে তাকায় আয়েন্দ্রি।পাশ থেকে তার সব বন্ধুরা স্বমস্বরে বলে উঠে—
“হ্যাপি বার্থডে আয়েন্দ্রি।”
আয়েন্দ্রি বিস্মিত নয়নে সবাইকে দেখে।আজ তার জন্মদিন তা ভুলে বসে আছে সে।খলখলিয়ে হেসে উঠে আয়েন্দ্রি।বন্ধুদের সাথে উষ্ণ আলিঙ্গন করে।প্রাবিশ কুটকুট করে হেসে বললো—
“ডোন্ট ওয়ারি আয়ু বেবি।ওইটা নিষ্প্রাণের জন্য ডেয়ার ছিলো।নাথিং এলস।”
প্রাবিশের কথায় সবাই সম্মতি দেয়।আয়েন্দ্রি চূড়ান্ত অবাক হয়।সীমান্ত খটখটিয়ে বললো—
“হ রে আন্দি।কান্দিস না তুই।কী ভাবছিলি আর কী অইলো!নিষ্প্রাইন্নারে ডেয়ার দিসিলাম।তোরে প্রেমছন্দ শুনাইতে।আন্দির ঘরে আন্দি।দুইটা লাইন না কইতেই তুই তো শেষ।তোর রাইতের ঘুম হারাম।”
আয়েন্দ্রি একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো–
“বেয়াদব ছেলে কোথাকার!
দুম দুম করে সীমান্তর পিঠের উপর কয়েকটা তাল পড়লো।মুচকি হাসে নিষ্প্রাণ।আয়েন্দ্রির হাতের কয়েকটা জোরালো কিল খেয়ে হাঁপিয়ে উঠে সীমান্ত।হাঁপানো গলায় বললো—
“অনেক মারছোস আন্দি।আজ তোর পয়দা দিবস।ট্রিট দে এইবার।”
ভূত দেখার মতো চমকে উঠে আয়েন্দ্রি।সেরেছে!তার তো মনে নেই আজ তার জন্মদিন।আর সীমান্ত ছাড়ার পাত্র নেই।টাকাও আনা হয়নি।অনেক গড়িমসি করেও সীমান্তের ছোঁড়া তীর থেকে বাঁচতে পারলো না আয়েন্দ্রি।আত্মসমর্পণ করে বললো—
“ওকে।তোরা দাঁড়া আমি আসছি।”
তৃণাকে নিয়ে ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টের দিকে হাঁটা ধরে আয়েন্দ্রি।দরজার মুখে তাকে দেখেই নির্লিপ্ত হাসে সারক।আয়েন্দ্রিকে দেখে উঠে আসে সে।কমন রুমে বসেছিলো অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে সারক।তৃণার মোবাইল বেজে উঠতেই সে সরে দাঁড়ায়।ইতস্তত করে আয়েন্দ্রি।তবুও বন্ধু মহলে সম্মান রক্ষার্থে নিজের সমস্যার কথা সারককে জানায়।সারকের অধরে ঝোলে মোলায়েম হাসি।ওয়ালেট থেকে হাজার টাকার দুটো নোট বের করে আয়েন্দ্রিকে দেয়।আয়েন্দ্রি মিষ্টি হাসে।কাল তাকে ধারকৃত টাকা ফেরত দিবে বলে প্রতিজ্ঞা করে।সারক সরস হেসে বললো—
“তোমার গান কিন্তু শোনা হয়নি।সেটা কিন্তু বাকি রয়ে গেলো।”
লজ্জামিশ্রিত হাসে আয়েন্দ্রি।শান্ত গলায় বললো—
“বেঁচে থাকলে শোনাবো।আসি স্যার।ওরা সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
“ওকে।টেক কেয়ার।”
টাকা নিয়ে ফিরতেই বন্ধু মহলে উন্মাদনার সৃষ্টি হয়।কিন্তু হাসি নেই নিষ্প্রাণের কোমল মুখটায়।সীমান্তের করা প্রশ্নে জানতে পারে আয়েন্দ্রি টাকা ধার করে এনেছে সারকের কাছ থেকে।তা নিয়েও হাসি ঠাট্টার রোল পড়ে যায়।আয়েন্দ্রির নীরবতা নিষ্প্রাণের চোখে,মুখে অগ্নিকুন্ড জ্বালিয়ে দেয়।সীমান্ত একটা ধাড়াস কিল মেরে বললো—
“চল নিষ্প্রাইন্না,আজ আন্দির পয়দা দিবস।তোরে পেট ভইরা আপন কফি হাউজের সাত রঙা চা খাওয়ামু।”
নিষ্প্রাণ আয়েন্দ্রির চোখের দিকে নিমেষহীন চেয়ে বজ্র গলায় বললো—
“না।তোরা যা।আমি বাসায় যাচ্ছি।”
নিষ্প্রাণ কাউকে সুযোগ দিলো।লম্বা লম্বা পা ফেলে চলতে শুরু করে।তার মস্তিষ্কে যন্ত্রণা শুরু হয়েছে।হাতের রগ ফুলে উঠতে শুরু করেছে।রাগে দু’চোখে জমেছে জল।দাঁতের উপর দাঁত চেপে ধরে পা দুটো চালাচ্ছে সে।পাঁচ জোড়া কৌতূহলী চোখ চেয়ে আছে নিরবধি নিষ্প্রাণের যাওয়ার পানে।
#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ১৮
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
অবিচ্ছিন্নভাবে চোখে,মুখে পানি ছিটাচ্ছে নিষ্প্রাণ।জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ায় ভয়ংকর শব্দের সৃষ্টি হচ্ছে।নিজেকে তার কোনো হিংস্র দানব মনে হচ্ছে।ইচ্ছে করছে সমস্ত পৃথিবীকে গুড়িয়ে দিতে।যেমনটা সে তার দশ বছর বয়সে করেছে।সেই আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলন্ত মানুষের আহাজারি আজও নিষ্প্রাণের কানে বাজে।সেই পোড়া গন্ধ আজও তার ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে ধাক্কা মারে।বালতির দুই পাশে হাত ঠেকিয়ে উপুর হয়ে পানির দিকে চেয়ে থাকে নিষ্প্রাণ।টলটলে,স্বচ্ছ পানিতে তার ভেজা মুখটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সে।নাকের ঢগা,কপাল চুঁইয়ে আর অধর থেকে ঝুলন্ত পানির টুপটুপ নিঃসরণ।নিষ্প্রাণ গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার নিজ চোখের প্রতিবিম্বতে।মুখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তেই তা এলোথেলো হয়ে যায়।আবার শান্ত হয়।নিষ্পলক চেয়ে আছে নিষ্প্রাণ।দরজায় করাঘাত পড়তেই সপ্রতিভ হয় সে।ককর্শ আওয়াজ শোনা যায়।
“ভেতরে ক্যাডা?এতো সময় লাগে ক্যান?
নিষ্প্রাণ নিজের সুপ্ত রাগকে প্রশমিত করে।স্বাভাবিক হয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে সৌজন্য সূচক হেসে বললো–
“ক্ষমা করবেন।”
বৃদ্ধ লোকটি অদ্ভুতভাবে তাকালো।খিচতি মেরে বললো–
“এতো সময় ধইরা কী করো মিয়া?
নিষ্প্রাণ জবাব দিলো না।নির্বিঘ্নচিত্তে সরে আসে।এই মেসে অনেক মানুষের বাস।বৈচিত্র্য রয়েছে ভাষায়,ব্যবহার আর ধর্মে।দেশের শেষ সীমান্ত থেকেও অনেকে কাজের খোঁজে আসে এই ইট,পাথরের শহরে।তাদের ঠাই হয় হাজার টাকার এই মেসে।একগাদা মানুষের সাথে ঠেসাঠেসি,চোখাচোখি এমনকি মারামারি করেও টিকে থাকতে হয় এই শহরে।
ঘরে এসে ঘামে ভেজা শার্টটা খুলে পড়ার টেবিলের কার্ণিশে ছড়িয়ে দেয় নিষ্প্রাণ।কপালের দুই পাশে প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে।হাতের থাকা গ্লাসটা বিছানার একপাশে রেখে লম্বালম্বি শুয়ে পড়ে।চোখের পাতা বুজে নেয় নিষ্প্রাণ।নিমীলিত আঁখিতে তার ভাসা ভাসা সেই হাসি।সেই ঠোঁট,সেই লাল তিল।আর সেই কন্ঠ,”বিয়ে করবি আমায়?
নিষ্প্রাণের দেহ অচেতন হয়ে পড়ে।হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।খানিক পরেই মোবাইলের অস্বস্তিকর ভাইব্রেশনের শব্দ।অমিলীলিত চোখে তাকাতেই দেখে সীমান্তের নামটা মোটা অক্ষরে দৃশ্যমান।নিষ্প্রাণ কল রিসিভ করেই সাথে সাথে কথা বললো না।সীমান্ত চওড়া গলায় বলে উঠে—
“নিষ্প্রাইন্না,এতো ভাব লস ক্যান?নাম নিচে।”
নিষ্প্রান ফিকে গলায় বললো—
“কেন?
“আন্দির বাসায় যামু।তোর লাইগা শালা ট্রিট মিস হইয়া গেলো।”
নিষ্প্রাণের ভ্রু জোড়া ক্ষণপলেই কুঞ্চিত হয়।কপালের মাঝ বরাবর দুটো সরু ভাঁজ উবে উঠে।সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে—
“কেন?ওর বাসায় যাবি কেন?
সীমান্ত চরম বিরক্তি নিয়ে বললো–
“এক ঠাটাইয়া চড় মারমু গালের দুই আঙুল নিচে।এতো প্রশ্ন করোস ক্যান?নামতে কইছি নাম।নাইলে তোর তোর ওই গুপ্ত ঘরে ঢুইকা পড়মু কইতাছি।”
নিষ্প্রাণ কখনো তার বন্ধুদের নিজের মেসে আনে না।ভার্সিটি আসার প্রথম সপ্তাহেই ভালো বন্ধুত্ব হয় সীমান্তের সাথে।সীমান্তের লাগামছাড়া কথাবার্তায় মাঝে মাঝে বিরক্ত হলেও তার ভেতরকার সরল মনের মানুষটিকে আপন মনে হয় নিষ্প্রাণের।প্রাবিশের সাথে কথা হয় মাস তিনেক পরে।তাদের রেজিষ্ট্রেশন ফি জমা দিতে প্রায় ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে নিষ্প্রাণ।প্রাবিশের সহায়তায় সেদিনকার মতো এই অপেক্ষা থেকে নিষ্কৃতি পায় সে।এভাবেই শুরু হয় তাদের বন্ধুত্বের সুরের তাল।প্রাবিশ আর সীমান্তের সাথে ডিপার্টমেন্টের অন্য স্টুডেন্টদের একটা অমায়িক সম্পর্ক থাকলেও নিষ্প্রাণের সাথে সেই সম্পর্ক তারকাটার মতো।সবসময় তাকে বিঁধে যায়।
নিচে নেমে এসে নড়বড়ে গেইটটার সামনে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণ।সীমান্ত আর প্রাবিশ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।নিষ্প্রাণ বুকে একটা ধাক্কা কিল মেরে গর্জে উঠে সীমান্ত।
“শালা ঢঙ করোস! আইয়া পড়লি কেন এমনে?
নিষ্প্রাণ স্বাভাবিক গলায় উত্তর দেয়।
“ভালো লাগছিলো না।তোরা কেন এসছিস?
” আন্দির মা সবাইরে যাইতে কইছি।চল।”
নিষ্প্রাণ সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললো–
“কেন?
“এতো কথা কইতে পারুম না।চল।”
,
,
,
আয়েন্দ্রির মা ঝুমা মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে তার বন্ধুদের খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।সীমান্ত চিল মুডে খেয়ে যাচ্ছে।খাওয়া দাওয়ায় তার বাছ-বিচার নেই।প্রাবিশের জন্য আলাদা রান্না করেছেন ঝুমা।কষা মুরগির মাংস আর সরষে ইলিশ।ভূনা গরুর মাংস পেয়ে আর কিছু দেখলো না সীমান্ত।নিষ্প্রাণের খাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে আরিশা।খাওয়াতে অনীহা না থাকলেও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না তার।আরিশা ফিচেল গলায় বললো–
“নিষ্প্রাণ ভাইয়া আপনার কী কোনো সমস্যা?রান্না কিন্তু আপু করেনি।মা করেছে।নির্দ্বিধায় খেতে পারেন।পেট,মন দুটোই শান্তি পাবে।”
চোখে হাসে নিষ্প্রাণ।আয়েন্দ্রি রাগ দেখিয়ে বললো—
“এক চড় মেরে দাঁত ফেলে দেবো।যা এখান থেকে।”
খিলখিলিয়ে হাসে আরিশা।তার কথায় চাপা হাসে তৃণা,কুসম।আয়েন্দ্রি রান্না ঘরে গিয়ে তার বাবার কথা জিঙ্গেস করতেই জানতে পারে সে এখনো বাইরে।আয়েন্দ্রির চোখে,মুখে বিষাদ ছেয়ে যায়।আজও তাকে বাইরে থাকতে হবে?নিজের মোবাইল নিয়ে কল করতে গেলে টুক করে তা শাটডাউন হয়ে যায়।আয়েন্দ্রি বিপাকে পড়ে।ড্রয়িং রুমে এসে সীমান্তের কাছে মোবাইল চাইতেই সে বলে ব্যালেন্স নেই।আয়েন্দ্রি আগ্রহী চোখে তাকায় নিষ্প্রাণের দিকে।তার থেকে মোবাইল নিয়ে স্ক্রিনে তাকাতেই আচম্বিত হয় আয়েন্দ্রি।পুরো স্ক্রিন জুড়ে এক অদ্ভুত ওয়ালপেপার।আয়েন্দ্রির কেমন অস্বস্তি হলো।মনে হলো এইটা তারই পরিচিত কিছু।আয়েন্দ্রির হাত চলে যায় তার ওষ্ঠাধরে।তার গাঢ় লাল তিলের এক স্পষ্টত ছবি যা নিষ্প্রাণের মোবাইলের স্ক্রিন জুড়ে।আয়েন্দ্রি ত্রস্তে তাকায় নিষ্প্রাণের দিকে।নিষ্প্রাণের অধরে খেলে যাচ্ছে মিষ্টি হাসি।সেই হাসিতে প্রাণহাণি মায়া,চোখে রয়েছে খুন হয়ে যাওয়ার তীব্র অভীপ্সা।চট করেই আয়েন্দ্রির মস্তিষ্কের নিউরণে খেলে যায় গোলযোগ।নিষ্প্রাণের কললিস্ট চেক করতেই জ্বলজ্বলে চোখে দেখতে পায় ধ্রুবতারা নাম দিয়েই সেভ করা তার নাম্বার।আয়েন্দ্রি ভীত চোখে তাকায়।শুষ্ক ঢোক গিলে গ্যালারিতে যেতেই দেখে তা লক করা।আয়েন্দ্রির গলা শুকিয়ে আসে।চমকে উঠে সে।
“কী খুঁজছিস?
আয়েন্দ্রি জড়ানো গলায় বললো—
“কীককক কিছু না।তোর মোবাইল নে।”
নিষ্প্রাণ স্বাভাবিক হাসে।মোবাইলটা নিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে বিনা সংকোচে।আয়েন্দ্রির উদ্বিগ্ন চাহনি।কোমল হাসে নিষ্প্রাণ।হাতের মুঠ উন্মোচন করে দৃঢ় দৃষ্টিপাত করে আয়েন্দ্রির ঠোঁটে।সরল কন্ঠে বললো—
“এইটা তোর জন্য।হ্যাপি বার্থডে।”
নিষ্প্রাণের হাতে ঝুলে আছে এন্টিক রঙয়ের একটা চেইন।চেইনের সাথে একটা তারকাকৃতির লকেট যার মধ্যখানে সফেদ রঙের পাথর।আয়েন্দ্রি হাতে নিয়ে বিস্মিত চোখে দেখে।অনুরাগী গলায় বলে উঠে নিষ্প্রাণ—
“গলায় পরে দেখ।ভালো লাগবে তোকে।”
আয়েন্দ্রি নিস্পৃহ গলায় বললো—
“পরে।”
“এখনই গলায় পরে নে।আমি দেখি কেমন লাগছে তোকে।”
নিষ্প্রাণের আঁখুটে কন্ঠ আয়েন্দ্রির মনে ভয়ের উদ্বেগ ঘটায়।খাওয়া শেষ করে প্রাবিশ এসে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণের পাশে।তার কাঁধে হাত রেখে বললো—
“এতো করে যখন বলছে গলায় পরে নে।”
আয়েন্দ্রি শুষ্ক চোখে তাকিয়ে চেইনটা গলায় পরে নেয়।প্রসন্ন হাসে নিষ্প্রাণ।লকেটের মাঝের সেই সফেদ পাথরের নিচে লাগানো একটা মাইক্রোচিপ।যার মাধ্যমে আয়েন্দ্রির সশব্দে ফেলা নিঃশ্বাসও পৌঁছে যাবে নিষ্প্রাণের কর্ণরন্ধ্রে।যে আয়েন্দ্রিকে প্রতিটি ক্ষণ নিষ্প্রাণের প্রাণস্পন্দন করে রাখবে।
চলবে,,,
চলবে,,,