#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৫৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
মৃদু মলয়ে উঠেছে কাঁপন। সেই সাথে কাঁপছে নিষ্প্রাণের দীর্ঘ আঁখিপল্লব। পলক ফেলতে ভুলে গিয়েছে সে। উদ্ভাসিত চোখে তাকিয়ে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল—
“তুমি কী করে জানলে আমার ছেলে হবে?”
নয়নতারা ভুবন ভোলানো হাসল। চোখের পাল্লা নাচিয়ে অন্তরিন্দ্রিয়ের সুপ্ত খুশি ব্যক্ত করল। প্রসন্ন গলায় বলল—
“আমি তো সব জানি।”
নিষ্প্রাণের পাশে এসে বসল নয়নতারা। নিষ্প্রাণের চোখ খুশিতে টলটল করছে। আজ এতদিন পর তারা আবার তার সামনে এসেছে। কথা বলছে। আয়েন্দ্রির সাথে বিয়ের পর তারাকে দেখার দৃষ্টিভ্রম আর হয়নি নিষ্প্রাণের। নিষ্প্রাণ সরল চোখে কৌতূহল নিয়ে চেয়ে রইল। বলল—
“আর কী জানো তুমি?”
নয়নতারা ঝুমঝুময়ি হাসল। তার হাসিতে ঝরতে লাগল পর্বত শৃঙ্গের বুক ফেড়ে আসা শীতল, স্বচ্ছ প্রস্রবন। নিষ্প্রাণের সেই প্রস্রবনে নিজেকে সিক্ত করতে ইচ্ছে হলো। নয়নতারা নিঃশব্দে নিষ্প্রাণের পাশে বসল। সবজান্তার মতো আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল—
” এই যে তোর ধ্রুবতারা তোকে সত্যিই ভালোবাসে, এটাও আমি জানি।”
নিষ্প্রাণের অন্তঃকরণে উত্তাল ঢেউ ওঠে। নয়নতারার সামনে গিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে ভর দিয়ে বসে। নয়নতারার দুই হাত নিজের মুষ্ঠিতে নিয়ে আবেগপূর্ণ গলায় বলল—
“তুমি সত্যি বলছ? ধ্রুবতারা আমাকে ভালোবাসে?”
সজীব হাসল নয়নতারা। চোখে উচ্ছ্বাসের তূরন্ত টান। অধর বিস্তৃত করে বলল—
“হ্যাঁ। তোর ধ্রুবতারা তোকে খুব ভালোবাসে। ওকে তোর কাছেই রাখিস। ওকে তোর থেকে দূর করিস না।”
“করব না। প্রমিজ, ওকে আমি কোথাও যেতে দেবো না।”
চোখে হাসল নয়নতারা। মোহবিষ্ট গলায় বলল—
“আমাকে যেতে হবে প্রাণ।”
“তুমি চলে যাবে? কেন চলে যাবে? আমার ছেলেকে তুমি দেখবে না?”
“কেন দেখব না? ওই যে আকাশ দেখছিস! ওখান থেকে দেখব। তোকে, তোর ধ্রুবতারাকে আর তোর ছেলেকে।”
“তুমি সত্যিই আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? আর কখনো আসবে না?”
“না। এখন থেকে তোর ধ্রুবতারা তোর সাথে থাকবে। আগলে রাখিস ওকে। বুকের পাঁজরে রাখিস। আর খুব ভালোবাসবি। যতটা আমি তোকে ভালোবেসেছি।”
“বাসব। খুব ভালোবাসব ওকে। কিন্তু তুমি যেওনা প্লিজ।”
নয়নতারা ছোট্ট করে হাসল। বিগলিত গলায় বলল—
“তা হয় না প্রাণ। আমাকে যেতে হবে।”
সাশ্রুনেত্রে চেয়ে আছে নিষ্প্রাণ। নয়নতারা তার হাত গলিয়ে দেয় নিষ্প্রাণের চুলে। কপট রাগ দেখিয়ে বলল—
“গলুমলু প্রাণ, মন খারাপ করে না। আমি সবসময় চেয়েছি তুই ভালো থাক। এখন তো তোর পূর্ণতার সময়। তোর ধ্রুবতারা তোর কাছে, তুই বাবা হবি। ছোট্ট প্রাণ বাবা হবে।”
নয়তারা খলখলিয়ে হাসে। নিষ্প্রাণ অপলকে সেই হাসি দেখে। হাসি থামিয়ে নয়নতারা বলল—
“আমি আমার এই হাসি তোকে দিয়ে যাচ্ছি। যত্নে রাখিস। তোর ছেলের নাম।”
নয়নতারা নিষ্প্রাণের কানে ফিসফিসিয়ে কিছু একটা বলে। সোজা হয়ে চোখে হাসে। নিষ্প্রাণ আলতো গলায় প্রশ্ন করে—
“এর মানে কী?”
“শেষ হাসি। আমার শেষ হাসি। আমি আসি প্রাণ। ভালো থাকিস। আমি সবসময় তোকে ওই আকাশ থেকে দেখব। তোর ছেলের হাসি হয়ে হাসব। তোর ধ্রুবতারা চোখের তারায় থাকব। ভালো থাকিস।”
লুপ্ত হতে থাকে নয়নতারা। কাতর হতে থাকে নিষ্প্রাণের অক্ষিকোটর। জলসিক্ত চোখে চেঁচিয়ে ওঠে—
“তারা!”
ওঠে বসে নিষ্প্রাণ। সে স্বপ্ন দেখছিল। ভয়ংকর স্বপ্ন।
,
,
,
নিষ্প্রাণ হুলস্থুল হয়ে কক্ষে আসে। আয়েন্দ্রি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সাদা, তুলোর মতো মেঘের অভয়ারণ্য। ধূসর আকাশের পরতে পরতে তা ভাসছে আপন ভঙ্গিমায়। প্রভাকরের তরল আভায় মেদিনীর বুকে আবছায়ার সৃষ্টি হচ্ছে। নিষ্প্রাণ ঝপ করে এসেই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আয়েন্দ্রিকে। আয়েন্দ্রি চকিত হয়। ফিরে তাকাতেই নিষ্প্রাণ দুই হাতের বলয়ে আবদ্ধ করে আয়েন্দ্রিকে। সে হতভম্ব। কিছুই বুঝতে পারছে না। তবে তার মস্তিষ্কে প্রতীত হচ্ছে নিষ্প্রাণের জোরালো বাঁধন যেকোনো সময় তার শ্বাস রুদ্ধ করে দেবে। নিষ্প্রাণ না পারছে আয়েন্দ্রিকে তার বক্ষস্থলে ঢুকিয়ে ফেলতে। আয়েন্দ্রি বিধুর গলায় বলল—
“প্রাণ, ছাড় আমাকে।”
নিষ্প্রাণ পিষে ধরল আয়েন্দ্রিকে। তার উচ্ছ্বাস ঝকঝকে নীল আকাশে স্পষ্ট হওয়া রংধনুর মতো সারা শরীরে আলোড়ন তুলল। বুকের হৃদপ্রকোষ্ঠে শীতল সমীরণে উদ্দাম হতে লাগল শ্বাসক্রিয়া। এক আকাশ উচ্ছলতায় মাতোয়ারা হয়ে নিষ্প্রাণের আবেগি স্বর—
“আমাদের ছেলে হবে ধ্রুবতারা। আমাদের ছেলে হবে। তারা ওর শেষ হাসি দিয়ে গেছে আমাদের।”
আয়েন্দ্রির শরীর তেঁতে উঠল। আর শুনতে পারল না সে। ক্ষুব্ধ হয়ে বলল—
“কী পাগলের মতো বলছিস! তারা নেই প্রাণ। নয়নতারা মৃত। মৃত মানুষ কখনো ফিরে আসে না। এইটা শুধুই তোর ভ্রম।”
নিষ্প্রাণ অপ্রশস্ত চোখে চেয়ে বলল—
“আমার তারা আছে ধ্রুবতারা। ও বলেছে আমাদের ছেলে হবে। ও আমাদের ছেলের নামও বলেছে। তুই কেন বিশ্বাস করিস না?”
“করব না। পাগল নই আমি। তুই পাগল। এক মৃত মানুষকে তুই জীবিত ভাবছিস। তোর চিকিৎসা প্রয়োজন প্রাণ। তুই সুস্থ নস।”
নিষ্প্রাণ কড়া চোখে তাকাল। তেড়ে এসে আয়েন্দ্রির চোয়াল চেপে ধরে তীব্র আক্রোশে। গনগনে শ্বাস ফেলে বলল—
“আমার তারা মিথ্যে বলে না। আমাদের ছেলেই হবে। তুই দেখে নিস। আমার ছেলের যেন কিছু না হয় ধ্রবতারা। ও আমার তারার শেষ হাসি। ওই হাসি আমি কিছুতেই হারাতে দেবো না।”
নিষ্প্রাণকে ধাক্কা মেরে সরায় আয়েন্দ্রি। তাপিত গলায় বলল—
“তারা, তারা, তারা! তারা নেই। তারা মরে গেছে। ও আর কোনোদিনও ফিরে আসবে না। কেন এক মৃত মানুষকে মনে করে নিজেকে অসুস্থ করে তুলছিস তুই? কেন অন্যের জীবন কেড়ে নিচ্ছিস? শাস্তি দেওয়ার জন্য আইন আছে, উপরওয়ালা আছে। তুই কাউকে শাস্তি দেওয়ার কে? তারার কথা ভেবে একের পর এক অন্যায় করে যাচ্ছিস তুই? তোকে কে শাস্তি দেবে তোর অপরাধের? ভুলে যা তারাকে। ”
নিষ্প্রাণ অদ্ভুত শান্ত গলায় বলল—
“ভুলে যাব তারাকে? যে তারা আমাকে আগলে রেখেছে ওকে ভুলে যাব? যে আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছে ওকে ভুলে যাব? যে আমাকে সত্য দেখিয়েছে, তোকে আমার জীবন পাঠিয়েছে তাকে ভুলে যাব? পারব না আমি। পারব না। এই পৃথিবী ওকে ভুলে গেলেও আমি ভুলব না। তারারা মরে না। ওরা সারাজীবন ওই আকাশে থাকে, এই চোখের আলোতে থাকে। আমার তারাও থাকবে।”
আয়েন্দ্রি দগদগে গলায় বলল—
“তুই অসুস্থ! অসুস্থ তুই!”
নিষ্প্রাণ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। হাসতে হাসতে বলল—
“অসুস্থ! হ্যাঁ অসুস্থ। এই পৃথিবীর সব মানুষই অসুস্থ। যারা বাঁচতে চায় তাদের অসুস্থ হয়েই বাঁচতে হয়। সুস্থ হয়ে তারা বাঁচতে পারে না। এই সমাজ দেয় না তাদের বাঁচতে। কীসের শাস্তির কথা বলছিস তুই? আমি যাদের মেরেছি তারা কেউ শুদ্ধ নয়। একজন রেপড ভিক্টিমের শেষ পরিণতি কী জানিস? হয় নিজে মরবে, না হয় এই সমাজ তাকে মেরে দেবে। রাতের আঁধারে সব পুরুষেরই রাস্তায় চলার অধিকার আছে। তাহলে একজন নারীর নেই কেন? কাপড়ের দোষ, শালীনতা? তাহলে দুই বছরের শিশু কেন রেপড হয়? মায়ের বয়সী নারীকে কেন ছেলের বয়সী পুরুষের কাছে নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়? ভীড় বাসে কেন একজন মেয়েকে তার বিনা অনুমতিতে নোংরা স্পর্শের স্বীকার হতে হয়? কেন মুখ বুঝে সহ্য করতে হয় পুরুষ শাষিত সমাজের নোংরা কথা? বোরখা পড়া মেয়েদেরও ধর্ষিত হতে হয়। স্বামীর সামনেও আজকাল স্ত্রী ধর্ষণ হয়। তখন কোথায় থাকে তোদের আইন? বল?”
আয়েন্দ্রি কেঁপে ওঠে নিষ্প্রাণের ভয়াল স্বরে। ঘনঘন শ্বাস ফেলছে সে। নিষ্প্রাণ রোবটের মতো বলতে থাকে—
“নিজের মাকে আমি রেপড হতে দেখেছি। তারাকে দেখেছি। তবুও আমি বেঁচে আছি। কেন জানিস? কারণ আমি অসুস্থ। সুস্থ হলে আমি বাঁচতে পারব না। একজন মানুষ যখন মানসিক রোগে আক্রান্ত হয় তার আগে তাকে কতটা নিগ্রহ, নিপীড়িত, যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়ে তার ধারণা আছে তোর? নেই। তাহলে তুই বল, যদি সে মানুষটা আবার সুস্থ হয় তাহলে তাকে আবার সেই যন্ত্রণা কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে। তাহলে তার সুস্থ হয়ে লাভ কী? অসুস্থ থাকাই তার শ্রেয়। কোনো যন্ত্রণা তাকে ছুঁতে পারবে না, কোনো তাপ তাকে গলাতে পারবে না। সে দৃঢ়, দুর্বোধ্য সে। ”
আয়েন্দ্রির মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। তার চোখের পাল্লা লাগামহীন কাঁপছে।
নিষ্প্রাণ সতেজ গলায় বলল—
“আমি সুস্থ হয়ে কী করব? সুস্থ হয়ে তারার মৃত্য দেখেছি। মায়ের মৃত্যু দেখেছি। আর অসুস্থ হয়ে সেই নরপশুদের শাস্তি দিয়েছি। যারা মেয়েদের শুধু ভোগের বস্তুই মনে করে। কাজের লোক বলে কী তারা আর মেরুনরা মানুষ নয়? ওদের সাথে হওয়া অন্যায়ের সাজা কে দিবে ওদের?”
আয়েন্দ্রি নৈঃশব্দে হেঁচকি তুলে যাচ্ছে। সমাহিত চোখে চেয়ে আছে সে। নিষ্প্রাণ বক্রোক্তি করে বলল—
“আমার তারা নেই। ওরা ওকে বাঁচতে দেইনি। আমার ধ্রুবতারা তো আছে। তার গায়ে আমি আঁচড়ও লাগতে দেবো না। কারো দৃষ্টিসীমায় আসবে না সে।”
সুপারি গাছের ডগার ন্যায় থরথর করে কাঁপছে আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণের লাল বর্ণ চোখে কল্পনাতীত নেশা। যেন খুন করে ফেলবে যে কাউকে। নিষ্প্রাণ আয়েন্দ্রির কাছে এসে দাঁড়ায়। মধুর গলায় বলল—
“আমি সুস্থ হলে তোকে ভালোবাসব কী করে? আমি তোকে সুস্থ মানুষের মতো ভালোবাসতে পারব না। তোকে সারাজীবন এই অসুস্থ মানুষের সাথে কাটাতে হবে। যতদিন আমার শ্বাস আছে আমার প্রাণস্পন্দন হয়েই থাকতে হবে। কোথাও যেতে দেবো না তোকে আমি। ”
নিষ্প্রাণ হাঁটু মুড়ে নিচে বসে। আয়েন্দ্রির কোমড়ে কাছে জড়িয়ে ধরে তার উদরে কান পেতে বলল—
” আমি তোকে ভালোবাসি। এক আকাশসম ভালোবাসি, অতলান্তিক অম্ভোনিধির অগাধ জলরাশির প্রতিটি তরঙ্গমালার ন্যায় ভালোবাসি, অভ্রভেদী মেদিনীধরের শিখরসম ভালোবাসি, উত্তপ্ত ঊষরের বুকে চাতকের এক পশলা বৃষ্টির আহ্বানের মতো ভালোবাসি, নিবিড় কাননের সদ্যোজাত মহীরুহের ন্যায় ভালোবাসি, তমসাচ্ছন্ন নিশীথিনীর বিভাসিত বিধুর চন্দ্রাতপ হয়ে ভালোবাসি। আমার হৃদকুঠিরের একমাত্র সম্রাজ্ঞী তুই। আমার অন্তরিন্দ্রিয়তে ব্যাত্যা তোলা একনিষ্ঠ যোষিতা তুই। আমার দীর্ঘ বিষাদ জীবনের শোভিত সারাংশ তুই। ভালোবাসি তোকে আমি। ভালোবাসি।”
আয়েন্দ্রির টলটলে চোখের বান ছুটেছে। নিষ্প্রাণের নরম চুলে হাত গলিয়ে তার ছোট্ট মস্তিষ্কের কোণায় কোণায় এক অনিশ্চিত অনিবার্য ঘটনার পরিস্ফুটন হচ্ছে। যদি সত্যিই তাদের ছেলে হয়? তাহলে? নিষ্প্রাণ সত্যিই ভেবে নেবে তার তারা আছে। সে আছে।
আচমকা এক তপ্ত বাতাসে শিউরে ওঠে আয়েন্দ্রির স্থির দেহ!
#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৫৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
রাজন শিকদারের পায়ের সাথে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে আয়েন্দ্রি। তার শান্ত দুই চোখের পক্ষ্মচ্ছায়া সিক্ত হয়ে গড়িয়ে পড়ছে স্বচ্ছ, শীতল নহর। রাজন শিকদার নির্বিকার। তার টলটলে দুই আঁখিযুগলে হাজারো অব্যক্ত কথার ছড়াছড়ি। কিন্তু স্বরনালি সায় দিচ্ছে না। আয়েন্দ্রি মাথাটা উঠিয়ে ভেজা গলায় বলল —
“আপনিই বলুন না দাদু, কী করে থাকব এমন একটা মানুষের সাথে আমি? বলুন না দাদু।”
রাজন শিকদার পলক ঝাঁকালেন। আয়েন্দ্রির অসহায় কণ্ঠের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য বিদীর্ণ করে দিচ্ছে রাজন শিকদারকে।
আয়েন্দ্রির চোখের জলে সয়লাব তার কপোল, চিবুক। নাকের ডগায় জমেছে শ্বাস। নাক টেনে টেনে, ক্ষীণ শ্বাস ফেলে বলল—
“ও তারাকে কিছুতেই ভুলতে পারছে না। ওর মন, মস্তিষ্কে তারা এমনভাবে গেঁথে আছে তার সামনে ও কিছুই অনুভব করতে পারে না। আর এ সবকিছুর জন্য আমিই দায়ী। আমার ওর জীবনে আসা উচিত হয়নি।”
আয়েন্দ্রি ঝমঝমিয়ে কাঁদে। তার কান্নায় ভেসে যায় বুকের পাটা। রাজন শিকদার তার স্থির নয়নযুগলের জলে প্লাবিত করলেন তার সুশ্রী আনন। আয়েন্দ্রি কেঁপে ওঠে। কম্পিত গলায় বিড়বিড় করে বলল—
“আমি সত্যিই ওকে ভালোবাসি দাদু। আমার সব কিছু উজাড় করে ওকে ভালোবেসেছি। ওর সন্তানকে আমার গর্ভে ধারণ করেছি। কিন্তু ওকে আমার ভয় হয়। যে সন্তানের জন্য ও আজ মরিয়া হয়ে উঠছে, ওর রাগ সে সন্তানকেও বাঁচতে দেবে না। প্রাণ রাগলে কী করে তা ও নিজেও জানে না। এমন পরিবেশে আমি কী করে আমার সন্তানকে জন্ম দেই?”
আয়েন্দ্রি বাতাস কাঁপিয়ে বিলাপ করে। চাপা চিৎকারে তার কণ্ঠনালী ফেটে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। গরগর করে বলল—
“ওর কোনো ক্ষতি আমি চাই না দাদু। কিন্তু ওর সাথে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এভাবে বাঁচা যায় না দাদু। আমি থাকতে পারব না ওর সাথে। আমি থাকলে প্রাণ কখনো সুস্থ হবে না। কখনো না।”
,
,
,
নিষ্কম্প আয়েন্দ্রি গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। কাপড়-চোপড় এক হাতেই গুঁছিয়ে নিয়েছে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি সরল গলায় বলল—
” আমরা ঢাকা কবে যাব?”
“কাল।”
আয়েন্দ্রি আর কথা বলল না। খোলস আবৃত কচ্ছপের ন্যায় বসে রইল। নিষ্প্রাণ কাপড়ের ব্যাগগুলো একপাশে রেখে শাওয়ারে ঢোকে। কিছুসময় পর বের হয়ে দেখে আয়েন্দ্রি এখনো আগের জায়গায় নীরব হয়ে বসে আছে। ভেজা চুলের পানি মুছে নিল নিষ্প্রাণ। হলুদ রঙের টিশার্টটা গায়ে গলিয়ে নিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা ফাইল বের করে। আয়েন্দ্রি সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে নিষ্প্রাণের প্রতিটি অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করছে। এক ভয়ংকর, প্রকুপিত মানুষকে এখন শান্ত আর স্নিগ্ধ মনে হচ্ছে। নিষ্প্রাণ ফাইলটা নিয়ে কক্ষ থেকে বের হতেই তড়িঘড়ি করে নড়ে ওঠে আয়েন্দ্রি। শশব্যস্ত হয়ে ড্রয়ার হাতড়ে খাতা-কলম বের করে। দ্রুতহস্তে কিছু একটা লিখে পাতাটি মুড়ে ফেলে। পরপর আরও কয়েকটা খাতার পাতা ছিড়ে লেখা ওয়ালা পাতাটা তার মধ্যে দিয়ে বল আকৃতির সৃষ্টি করে।
,
,
,
রাজন শিকদার হুইল চেয়ারে বসে আছেন। হাসমুল তার বিছানা ঠিক করছে। নিষ্প্রাণ কক্ষে ঢুকেই দৃঢ় গলায় বলল—
“বাইরে যাও হাসমুল।”
হাসমুল দ্বিরূক্তি করল না। সে চটপট বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। নিষ্প্রাণ ধীর পায়ে এসে এক হাঁটু ভেঙে রাজন শিকদারের সামনে বসল। রাজন শিকদার ভরাট চোখে চাইল। নিষ্প্রাণের অধরে সোনাগলা হাসি। রাজন শিকদারের প্রাণ আন্দোলিত হয়। বিভীষিকাময় অতীত তার সবকিছু কেড়ে নিল। ছোট্ট নিষ্প্রাণ ভয়ংকর পুরুষে পরিণত হলো। রাজন শিকদারের মনষ্কোণে এখনো প্রশ্নেরা উঁকিঝুঁকি মারে, ” নিষ্প্রাণ সত্যিই প্রাণহীন?”
নিষ্প্রাণ তার হাতের ফাইলটা খুলে একের পর একের টিপসই নিতে লাগল। রাজন শিকদার কিছুই বুঝতে পারলেন না। হতভম্ব তিনি। ঠাস করে ফাইলটা বন্ধ করে শ্যেনদৃষ্টিতে তাকাল। ক্রুর হেসে বলল—
“আর কোনো রিস্ক নিতে চাই না আমি। কে জানে, আপনারা ছেলেরা কোথায় কী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে। কখন আবার আমার উপর এসে তেড়ে বসে। তাই এই ব্যবস্থা। আর এমনিতেও এসব আমারই। গোবরে পদ্মফুল বলে কথা! কাজের মেয়ের গর্ভে আমার জন্ম হলেও রক্ত তো আপনাদের মতো উঁচু অবস্থানের মানুষের।
আমি বাবা হবো। শুনেছেন নিশ্চয়ই? আমার ধ্রুবতারা মা হবে। আমার সন্তানের মা। চিন্তা করবেন না। ওকে আমি আমার মতো বানাব না। কারণ, এমন কোনো পরিস্থিতি আমি ওর সামনে আসতেই দেবো না। সেই খুশিতে আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিলাম। আজ থেকে আপনি মুক্ত। হয়তো এটাই আপনার আর আমার শেষ দেখা। আমি আর কখনো এখানে আসব না। এই বাড়িতে এসে আমার অনেক ক্ষতি হয়েছে। ধ্রুবতারার গায়ে হাত তুলতে হয়েছে আমার। তারা চলে গেছে। তবে এ সবকিছুর মাঝে আমি আমার সন্তানকে পেয়েছি। তাই ওদেরকেও আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। তা নাহলে ওই সারক আর মিশকাত যা শুরু করেছে, আই এম ফেডআপ ইয়ার! আসলে এরা কেউ আমাকে শান্ত থাকতে দিতেই চায় না। এখানে আমার কী দোষ বলুন? যাক গে সে কথা। ওদের সাথে এখনো অনেক হিসেব বাকি আমার। ওটা আমি ডিল করে নেবো। আসি দাদু। ভালো থাকবেন।”
রাজন শিকদারের বুকটা ফেটে যাচ্ছে। মৃত্যুর আগে আর হয়তো সে নিষ্প্রাণকে দেখতে পাবে না। এই ছেলে যা বলেছে তাই ই করবে। ছোট্ট নিষ্প্রাণকে রোজ নিজের সাথে মসজিদে নিয়ে যেতেন রাজন শিকদার, রোজ তাকে নিয়ে আকাশ দেখতেন। তিনি চাইতেন যেন নিষ্প্রাণের জীবনটাও ওই নীলাভ, স্বচ্ছ, নির্মেঘ আকাশের মতো হয়। কিন্তু হয়েছে তার উলটো। সেই আকাশ ঢেকে গেছে কালো কাদম্বিনীর দোলাচলে, চলে মেঘে মেঘে ঘনঘটা। হঠাৎ বর্ষণে প্লাবিত হয় সব, অকস্মাৎ থেমে গিয়ে ঝলসে দেয় প্রখর সূর্যের তেজস্বী।
নিষ্প্রাণ ওঠে দাঁড়াল। দরজার কাছে গিয়ে আবার ফিরে আসলো। ঝুঁকে গিয়ে রাজন শিকদারে কপালে আলতো চুমু খেয়ে বলল—
“চিন্তা করবেন না দাদু। আপনার কবরে মাটি দিতে আমি অবশ্যই আসব। আমার ছেলের জন্য দোআ করবেন। আমার ছেলেই হবে। তারা বলেছে। আর তারা কখনো মিথ্যে বলে না।”
নিষ্প্রাণ চোখে হাসল। রাজন শিকদারের শ্বাস আটকে আসলো সেই হাসিতে।
,
,
,
নিষ্প্রাণ নিজের কক্ষে এসে আয়েন্দ্রিকে দেখল না। তার সতেজ চোখে অশিথিল ভাবনার উদয় হলো। বিছানায় পড়ে আছে একটা কলম। তৎক্ষণাৎ কক্ষে প্রবেশ করে আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণ কপাল কুঁচকে বলল—
“কোথায় গিয়েছিলি?”
আয়েন্দ্রি ছোট্ট দম ফেলে মিইয়ে গলায় বলল—
“নিইইচে গেছিলাম। জগের পানি শেষ।”
আয়েন্দ্রির দিকে সন্দিহান চোখে তাকাল নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি হাতে থাকা পানির জগ বেডসাইড টেবিলে রাখতেই বিছানায় পড়ে থাকা কলমটা পকেটে ঢুকিয়ে নেয় নিষ্প্রাণ। হাতের ফাইলটা ড্রয়ার বন্ধি করে চাবি নিয়ে নিল পকেটে। আয়েন্দ্রি সপ্রতিভ হাসে।
মধ্য দুপুর। একটু পরেই খাওয়ার অধিবেশন শুরু হবে। আয়েন্দ্রি শাওয়ারের উদ্দেশ্যে ওয়াশরুমে ঢোকে। নিষ্প্রাণ বাইরে এসে করিডোরে দাঁড়ায়। নির্মল বাতাস বইছে। তাতে প্রাণ জুড়ানো শীতলতা। একটা অদ্ভুত মিষ্টি ঘ্রাণ! প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপ্রতিবন্ধ বিচরণ। সূর্যের প্রখর রোদেও ঠাঁয় চেয়ে আছে মহীরুহ ওই আকাশ পানে। নিষ্প্রাণ রাশেদকে কল করল। তাকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলতে শুরু করে—
“আপনাকে কী বলেছি মনে আছে? কালকেই ঢাকা ফিরছি আমি। সকল প্রপার্টির পেপার চাই আমার। আপনি আমার সাথে অতি সত্বর দেখা করবেন।”
রাশেদ ব্যস্ত গলায় বলল—
“জি, জি স্যার।”
“এখন থেকে সপ্তাহে দু’দিন এসে দাদুকে দেখে যাবেন। আর আমাকে ইনফ্রম করবেন।”
“জি স্যার।”
“রাখি।”
“জি।”
নিষ্প্রাণ ক্লান্ত শ্বাস ফেলে। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে। শিমুলকে একটা মেসেজ করে কক্ষে প্রবেশ করে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি শাওয়ার নিয়ে বের হয়েছে। তার সদ্যস্নাত দেহে মুক্তোর মতো পানির ফোঁটা। চুল মোছা তোয়ালেটা হাতে নিয়ে ভেজা চুলগুলো একপাশে নিয়ে আসে। চুলের ডগা বেয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। নিষ্প্রাণ বিমোহিত চিত্তে চেয়ে আছে। আয়েন্দ্রির মায়াভরা কণ্ঠে ধ্যাণ ছুটে নিষ্প্রাণের।
“মোবাইলটা একটু দিবি? মায়ের সাথে কথা বলব।”
“হুম।”
কুণ্ঠিত হলো না নিষ্প্রাণ। জানালার দ্বার ঘেঁষে দাঁড়ায় আয়েন্দ্রি। হেসে হেসে কথা বলছে সে। নিষ্প্রাণ প্রশস্ত চোখে চেয়ে আছে। স্বগতোক্তি করে বলল,” তুই যা করছিস ঠিক করছিস না ধ্রুবতারা। আমি তোকে কোথাও যেতে দেবো না। কোথাও না।”
,
,
,
ক্লান্ত বিকেল। প্রভাকরের দীপ্ততা লুকিয়েছে মেঘের ভাঁজে। বিটপীর পল্লব দুলছে আপন ভঙ্গিতে। পশ্চিমাদেশের ধূসর আকাশ নিমগ্ন হচ্ছে রঞ্জিত আভায়। একটু পরেই মিলিয়ে যাবে সূর্য। তমসার রহস্যে হারিয়ে যাবে ধরিত্রী।
রোজকার মতো আজও ব্যবহার্য জিনিসের উচ্ছিষ্টাংশ বাড়ির পেছনে ফেলেছে তালাব। অরণ্যে হরিণ খোঁজার মতো সেসব হাতড়ে যাচ্ছে মিশকাত। আয়েন্দ্রির সেই মোড়ানো কাগজ হাত লাগে মিশকাতের। ধীরেসুস্থে তা খুলে মেজাজ চড়া হয় তার। দাঁত-মুখ খিঁচে বলল,” আহ্ শিট! নিজেকে এখন পুলিশ নয়, উবারের ড্রাইভার মনে হচ্ছে!”
,
,
,
এক ঘনালো তিমির নক্তের শেষে জেগে উঠেছে বসুমতি। কুঞ্জন উঠেছে পবনে। মিলিছে আঁধার দিনের রোশনাইতে। পত্রীরা গাইছে গান নির্মল, সিক্ত, আচ্ছন্ন প্রকৃতিতে।
উবু হয়ে শুয়ে আছে নিষ্প্রাণ। জানালার গ্রিল গলিয়ে মিষ্টি নরম রোদের সাথে ফিনফিনে বাতাস। নড়ে ওঠে নিষ্প্রাণ। এলোথেলো বিছানা হাতড়াতে আয়েন্দ্রির নাগাল পেল না সে। চকিতে ওঠে বসে। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় মুহূর্তেই তড়াক করে ওঠে। নিষ্প্রাণ তটস্থ পায়ে বিছানা থেকে নেমে আসে। ব্যগ্র হয়ে সমস্ত ঘরে চোখ বোলায়। কোথাও আয়েন্দ্রি নেই। নিষ্প্রাণ হলরুমে আসে। তালাব ভয়চকিত চোখে চেয়ে আছে। ফোঁস ফোঁস করছে নিষ্প্রাণ। তার শ্বাসের সাথে বুকে উথালপাথাল ঢেউ। সারা বাড়ির কোথাও আয়েন্দ্রির অস্তিত্ব নেই।
নিষ্প্রাণ নিজের কক্ষে ফিরে আসে। তার মোবাইল খুঁজতে থাকে। কিন্তু পেল না। আয়েন্দ্রির সেটাও সাথে করে নিয়ে গেছে। ফুঁসে ওঠে নিষ্প্রাণ। প্রকুপিত গলায় বলল—
“তুই ঠিক করিসনি ধ্রুবতারা, একদম ঠিক করিসনি।”
রাজন শিকদার শুয়ে আছেন বিছানায়। মৃত্যুর প্রহর গুনছেন তিনি। হাসমুল দৌড়ে এসে তার কানের কাছে অনর্গল বলতে থাকে—
“ছোডো সাহেব চ্যাতছে! আইজ খবর আছে। নয়া বউ পালাইছে বাড়িত তে। আল্লাই জানে, এহন কি হইবো!”
রাজন শিকদারের শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। তারপর চোখ দুটো বুজে নিলেন তিনি। তার চোখের কোণ ঘেঁষে গড়িয়ে পড়ল দীর্ঘসময় আটকে রাখা স্বস্তির জলস্রোত।
চলবে,,,