#প্রাণ_ভোমরা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩০)
স্বামীর সাথে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে হঠাৎ হেসে ফেললেন শরীফা খন্দকার। স্ত্রীর এমন অভাবিত কাণ্ডে থতমত খেলেন মীর খন্দকার। রাগান্বিত স্বরে বললেন,
“বোকার মতো হাসছ কেন?”
শরীফা খন্দকার কুটিল চাহনি আঁকলেন। হাসি ধরে রেখে বললেন,
“সৃষ্টিকর্তার লীলাখেলা দেখে।”
মীর খন্দকারের ভ্রূর মাঝে ঘন ভাঁজ পড়ল। আগ্রহ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“মানে?”
শরীফা খন্দকার ঠোঁট থেকে হাসি মুছলেন। স্বামীর একটু নিকটে এসে বললেন,
“তোমার চোখে,মুখে ভয়াবহ তৃষ্ণা দেখা যাচ্ছেে। বাবা ডাক শোনার হাহাকার! আমার মেয়ে যেমন তোমাকে একটি বার বাবা ডাকার জন্য ব্যাকুল হয়ে ছটফট করেছে। যন্ত্রণায় পুড়েছে। ঠিক তেমনি তুমিও সেই একই যন্ত্রণায় পুড়ছ,ছটফট করছ। পার্থক্য এটাই সে সয়ে ফেলেছে কিন্তু তুমি পারছ না। পারবে কী করে? তোমার যন্ত্রণা তো মাত্র শুরু! যার শেষ একমাত্র মৃত্যু। একটি আফসোসময় মৃত্যু!”
শেষ লাইনটা বড্ড ব্যথিত ও অস্পষ্ট শোনায়। স্বামীর সম্মুখে মৃত্যু শব্দটা উচ্চারণ করতেই অন্তর কেঁপে ওঠে। অন্তর কি তার একাই কেঁপেছে? নাকি মীর খন্দকারেরও কাঁপল। এ কোন দুশ্চিন্তা তার চোখে? কোন ভয়েরা আচ্ছন্ন করে নিচ্ছে নিশ্বাসগুলো?
শরীফা খন্দকার স্বামীর কাছ থেকে সরে এলেন। উদাসী স্বরে বললেন,
“তুমি যে দ্বিতীয় বিয়ে করেছ তা জানতে আমার শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার প্রয়োজন নেই। গোপন তথ্যেরও প্রয়োজন নেই। বছরের বিশেষ তিন দিন তুমি এখানে আসো। সেই তিন দিন যে বছর দুই দিন হয়েছিল সেবছরেই সন্দেহ করেছিলাম। তারপর তোমার আচরণেই নিশ্চিত হই। তুমি লুকাতে ব্যর্থ হলেও আমি হইনি। কখনও জানতে দেইনি তোমার দ্বিতীয় বিয়ে সম্পর্কে আমি জানি। ভবিষ্যতেও দিতাম না। আজ ভাগ্যের ফেরে দিতে হলো।”
শরীফা খন্দকার স্বামীর দিকে ঘুরলেন। দীপ্ত চোখে বললেন,
“তোমার দ্বিতীয় বিয়ের কথা জেনে আমি যেমন কষ্ট পেয়েছি তেমন খুশিও হয়েছি। মনে মনে দোয়া করেছি এই বউয়ের দ্বারা অন্তত তোমার মায়ের আশা পূরণ হোক। কিন্তু কে জানত আল্লাহ তাকে এভাবে নিরাশ করবে? বেছে আনা পুত্রবধূ পুত্র সন্তান তো দূর কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার ভাগ্যও করতে পারবে না!”
হঠাৎ হোঁচট খেয়েছে এমন ভঙ্গিমায় পড়ে যাচ্ছিলেন মীর খন্দকার। চেয়ারটা ধরে নিজেকে সামলালেন। বিস্ময়াবিষ্ট চোখ দুটো স্ত্রীর দিকে বিঁধানো। বিশ্বাসই করতে পারছেন না এভাবে স্ত্রীর কাছে হেরে গেছেন। শূন্য ঝুলি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এসব কি তার পাওনা? মীর খন্দকারের ইচ্ছে হলো নিজের মাকে এখানে হাজির করতে। পুত্রের এই নিদারুন,করুণ,শোচনীয় অবস্থা দেখাতে। মনের ইচ্ছা ধামাচাপা দিয়ে রুষ্টস্বরে জানতে চাইলেন,
“তার মানে তুমি আমার মেয়েকে দেখতে দিবে না?”
“না।”
“ভেবে বলছ?”
শরীফা খন্দকার আঁচল শক্ত করে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে রুদ্ধশ্বাসে বললেন,
“হ্যাঁ।”
____________
আপুর ঘরে ভ্রমরকে দেখে বেশ চমকাল হৃদ্য। কাছে এসে বলল,
“বাসায় যাসনি?”
জবাবে ভ্রমর মুখ ঘুরিয়ে নিল। বিরক্তও হলো। একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে ভাবল এই ছেলের সাথে একটা কথাও বলবে না। ভাবতে ভাবতেও বলে ফেলল,
“না। আজ রিধি আপুর সাথে থাকব।”
হৃদ্য ভ্রমরের পাশে এসে বসতে সে উঠে পড়ল। খাটের অন্য কিনারে বসে বলল,
“আমি এখন ঘুমাব।”
হৃদ্য বাঁকা চোখে তাকাল। নীঃশব্দে উঠে চলে যেতে গিয়ে দরজায় দাঁড়াল। বলল,
“দুই দিন ধরে আলু-চা পাচ্ছি না। ব্যাপার কি?”
ভ্রমর উত্তর দিল না। সামান্যতম নড়লও না। হৃদ্য কাছে এসে বলল,
“রিতা ভাবির স্বামী কি তোকে কথা বলতে নিষেধ করছে? বাব্বাহ! এত প্রেম।”
ভ্রমর কটমট চোখে তাকালে হৃদ্য হেসে ফেলল। ভ্রমরের বাহু চেপে ধরে জোর করে দরজার কাছে নিয়ে বলল,
“চায়ের তেষ্টা পেয়েছে। যা এক কাপ চা করে নিয়ে আয়।”
ভ্রমর হৃদ্যের হাত সরিয়ে পূর্বের জায়গায় ফিরে এসে বলল,
“রিতা ভাবির স্বামী আমাকে চা বানাতে নিষেধ করেছেন।”
হৃদ্যের চোখ বড় হয়ে আসতে ভ্রমর মিষ্টি হেসে বলল,
“আমাদের অনেক প্রেম কিনা তাই নিষেধ অমান্য করতে পারছি না।”
কথাটা শেষ করেই বাতি নিভিয়ে দিল ভ্রমর। অন্ধকারে ডুবে ভীষণ মিষ্টি করে বলল,
“রিতা ভাবির স্বামী রাত জাগতেও নিষেধ করেছেন।”
হৃদ্য অন্ধকারেও অনুভব করল ভ্রমর ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। তাহলে কি আজ সত্যি সত্যি চা পাবে না?
হৃদ্য বিষন্ন মুখে বালিশে মাথা রাখল। চোখ দুটো বন্ধ করতে কারও উপস্থিত টের পেল। নাকে পরিচিত গন্ধটা ছুঁয়ে দিতে সটান উঠে বসল। যা ভেবেছিল তাই। ভ্রমর চা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে বোধ হয় চুপি চুপি চা রেখে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। পরিকল্পনায় ব্যাঘাত ঘটতে খানিকটা ঘাবড়ে গিয়েছে। টেবিলের উপর চা রেখে ছুটে পালাতে হৃদ্য পথরোধ করে বলল,
“এত প্রেম হুট করে নড়বড়ে হয়ে গেল?”
ভ্রমর অস্থির হয়ে হৃদ্যকে পাশ কাটাতে চাইলে হৃদ্য আচমকা বলল,
“ঘুরতে যাবি,ভ্রমর?”
ভ্রমর স্থির হলো। কৌতুহলে বলল,
“কোথায়?”
হৃদ্য ভ্রমরের পথ ছেড়ে দিল। একটা বালিশ কোলে নিয়ে খাটের উপর বসল। সাহেবি ভঙ্গিতে চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
“রাঙামাটি। ক্যাম্পাস থেকে নিচ্ছে। তিন রাত দুই দিনের দীর্ঘ সফর।”
ভ্রমর হৃদ্যের কাছে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
“সত্যি? কিন্তু আমি তো শুনলাম না। এ মাসে একদিনও কামাই দেইনি।”
হৃদ্য মৃদু হাসল। বলল,
“তোদের নিবে না। তাই বলেনি।”
“কেন নিবে না?”
“তোরা যে পিচ্চি তাই।”
কথাটা বলেই দাঁত বের করে হাসল হৃদ্য। ভ্রমর নাক ফুলিয়ে বলল,
“তাহলে আমাকে সাধলে কেন?”
হৃদ্য সাথে সাথে কিছু বলল না। গভীর চিন্তায় ডুবে পরপর কয়েক বার চায়ে চুমুক দিল। অতঃপর বলল,
“তুই যেতে চাইলে আমি ব্যবস্থা করব। একটু কষ্ট হবে। কিন্তু হবে ইনশাআল্লাহ।”
ভ্রমর হৃদ্যের হাত থেকে চায়ের কাপ কেড়ে নিয়ে বলল,
“রিতা ভাবির স্বামীর সাথে আলাপ করে জানাব। আমাদের এত প্রেম! তাকে ছাড়া তো হুট করে হ্যাঁ বলতে পারি না।”
ভ্রমর চোখের পলকে রুম ত্যাগ করতে হৃদ্য আপনমনে ভাবল,’মেয়েটা কি বেশি পেকে গেছে? বোঁটা নরম হয়ে ঝরার আগে পেড়ে ফেলতে হবে।’
__________
রিধি শ্রাবণের মুখের সামনে স্যুপ এগিয়ে নিলে সে দুর্বল স্বরে সুধাল,
“কেন করছেন এসব?”
“কী করছি?”
“এই যে নিজের যত্ন ছেড়ে আমার যত্ন করছেন। আপনি তো আমাকে ভালোবাসেন না। পছন্দও করেন না।”
এতক্ষণে শ্রাবণের কথাটা ধরতে পারে রিধি। স্যুপের বাটিটা সরিয়ে নিয়ে বলল,
“রাস্তায় কোনো অচেনা মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লেও কেউ না কেউ এগিয়ে আসে। সাহায্য করে। হসপিটালে নিয়ে যায়। তার জন্য ভালোবাসার প্রয়োজন নেই। পছন্দেরও প্রয়োজন নেই। শুধু একটু মনুষত্বের প্রয়োজন।”
“আমি অচেনা কেউ?”
শ্রাবণের কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ে একটু অভিমান আরেকটু রাগ। রিধি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বলল,
“শরীরে বল নেই তাও মুখ থেকে কথা সরছে না। নিন হাঁ করুন।”
শ্রাবণ হাঁ করল না। অন্যপাশ হয়ে শুয়ে বলল,
“আমি পথচারীর হাতে কিছু খাই না। খাবারে যদি কিছুমিছু মিশিয়ে দিয়ে আমাকে অজ্ঞান করে দেয়?”
____________
ভ্রমর ছুটি শেষে বাইরে দৌড়ে এলো। আশেপাশে হৃদ্যকে না পেয়ে কলেজের গেইট ছেড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। ব্যগ্র নয়নে রাস্তার এপাশ ছেড়ে ওপাশে চোখ ঘুরিয়ে আনতে কেউ বলে উঠল,
“কাকে খুঁজছিস? রিতা ভাবির স্বামীকে?”
ভ্রমর ছিটকে ওঠে। হৃদ্যের জায়গায় অন্য কেউ হলে হয় তো দমটা বেরিয়েই যেত! হৃদ্য আরেকটু ঘেষে এসে বলল,
“রিতা ভাবির স্বামী এখনও এসে পৌঁছোয়নি? তোদের এত প্রেমের এখনই ঢিলেমী শুরু হয়ে গেছে? বাকি জীবন পার করবি কিভাবে?”
ভ্রমর দাঁত কিড়মিড়িয়ে তাকাল। বিনা উত্তরে খালি রিক্সায় চাপল। হৃদ্য লাফিয়ে উঠে বলল,
“আহারে! রিতা ভাবির স্বামী থাকতেও একা একা বাসায় ফিরতে হচ্ছে। তুই তো ভারি দুঃখী। বুকে আয় একটু সান্ত্বনা দেই।”
ভ্রমর আগুন চোখে তাকাল। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে হৃদ্যকে ধাক্কা মেরে রিক্সা থেকে ফেলে দিবে। ভ্রমর অবশ্য তেমন কিছু করল না। ঠোঁট কামড়ে সহ্য করে নিল।
রিক্সা মোড়ে আসতে একটা দোকানের দিকে তাকিয়ে হৃদ্য বলল,
“রিতা ভাবির স্বামীর সাথে দেখা না করেই চলে যাবি? আহারে! বেচারা দোকানে কাজ করতে করতে ঘেমে নেয়ে ফেলেছে। জামার ওড়নাটা দিয়ে একটু মুছে দিয়ে আয়।”
ভ্রমর সত্যি সত্যি রিক্সা থেকে নামল। দোকানের উদ্দেশ্যে হাঁটাও শুরু করল। কী ভেবে পেছন দৌড়ে আসে। হৃদ্যের শার্ট খামচে ধরে বলল,
“আমি কি ইচ্ছে করে প্রেমে পড়েছি? উনিই তো ফেললেন।”
“উনি ফেলেছেন?”
“তা নয় তো কী? আমি বলেছিলাম আমার দিকে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকাতে? ধরা পড়লে মিষ্টি করে হাসতে? হাতে ধরে আঙুলে নেইলপলিশ পড়াতে? একটা কিনলে আরেকটা ফ্রি দিতে?”
ভ্রমর আরও কিছু বলতে চেয়েছিল সুযোগ পেল না। তার আগেই হৃদ্য জিজ্ঞেস করল,
“উনি তোর হাত ধরেছে?”
ভ্রমর মাথাটা দ্রুত উপরনিচ নাড়িয়ে কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তার আগেই হৃদ্য হাওয়া বেগে কসমেটিকসের দোকানে ছুটে গেল। ভ্রমর নির্বোধ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকাতে কেউ একজন বলল,
“তুমি ভ্রমর না?”
ভ্রমর চট করে পেছন ঘুরল। হসপিটালে রেখে আসা সেই আংকেলটি গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বের করে তার দিকে চেয়ে আছে। ভ্রমর মৃদু হেসে বলল,
“জি। আপনি কেমন আছেন?”
মীর খন্দকার জবাবের বিপরীতে প্রশ্ন ছুড়লেন,
“কোথায় যাচ্ছো?”
“বাড়িতে।”
মীর খন্দকার নিজ সিটে বসেই অন্য পাশের দরজা খুলে বললেন,
“এসো ছেড়ে দিচ্ছি।”
ভ্রমর বলতে চাইল আমার বাসা কাছেই গাড়ি লাগবে না হেঁটে যাব। কিন্তু বলতে পারল না। নির্দ্বিধায় মীর খন্দকারের পাশের সিটটি দখল করল। তার সাথে হৃদ্য ছিল সে কথা বেমালুম ভুলে গেল!#প্রাণ_ভোমরা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩১)
রিধি সিঁড়িতে মৃদু ছন্দ তুলে তেতলায় উঠতে সামান্য ধাক্কা খেল। সিঁড়ির শেষ ধাপটা পার হলো অত্যন্ত মন্থর গতিতে। চোখ দুটো স্তব্ধ দরজার পাশে শ্রাবণের মুখে। নাজুক শরীরে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে বসে আছে। চোখ দুটো বন্ধ। একটু দূরে একটি কালো রঙের ভারী স্যুটকেস উল্টে পড়ে আছে। পাশে সাদা রঙের তোয়ালেটা যেটা দিয়ে শ্রাবণ ভেজা শরীর মুছে নিয়মিত। রিধি আতঙ্কে ফেটে পড়ে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি বাইরে কী করছেন?”
শ্রাবণ নড়চড়ে চোখ মেলল। রিধি আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দ্রুত জিজ্ঞেস করল,
“এসব কী? ঘরের জিনিস এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কেন?”
শ্রাবণ দেয়াল ছেড়ে সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করে বলল,
“একটা রিক্সা ডেকে দিতে পারবেন?”
শ্রাবণের নিস্তেজ স্বরে রিধি চমকে তাকাল। চটপটে জানতে চাইল,
“রিক্সা দিয়ে কী করবেন?”
“বাড়ি যাব।”
“বাড়ি! এই শরীরে?”
প্রশ্নটা করতে করতে শ্রাবণের কপাল ছুঁলো। তারপর বলল,
“জ্বরটা আবার বেড়েছে! বসতেই পারছেন না৷ এই অবস্থায় এখানে পড়ে আছেন কেন? কী সমস্যা? আমি তো বলে গিয়েছিলাম বিছানা না ছাড়তে!”
শ্রাবণ কিছু বলার আগেই কেউ একজন বলে উঠল,
“ও ছাড়েনি। আমরা ছাড়িয়েছি।”
রিধি ডানপাশে তাকায়। বাবা দরজা ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন। পেছনে মা। রিধি শ্রাবণের কাছ থেকে উঠে আসে। আশ্চর্য গলায় জিজ্ঞেস করল,
“তোমরা ছাড়িয়েছ? কেন?”
আজিজুল হক বেশ স্বাভাবিক গলায় বললেন,
“এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই,রিধি। তোকে তো আগেই জানিয়েছিলাম এই ছেলেকে বের করে দিব। একটা বাইরের ছেলে অযথা আমার ঘর দখল করে থাকবে কেন? থাকতে দিব কেন? মাস শেষে ভাড়ার টাকাটা তো আমাকেই গুণতে হয় তাই না?”
রিধি আরেক কদম এগিয়ে এসে বলল,
“ভাড়ায় থাকো বলে একটা অসুস্থ ছেলেকে বাসা থেকে বের করে দিবে,বাবা?”
“অবশ্যই। নিজ টাকাই পরকে কেন রাখব? তাছাড়া নিজের বাড়ি হলেও থাকতে দিতাম না। সে কি আমার আত্মীয় হয়? এখন তো আত্মীয়স্বজন দিয়েও বিশ্বাস নেই। কখন মাটি খুঁড়ে সব নিয়ে পালাবে!”
রিধির শান্ত স্বর মুহূর্তেই ক্রোধপূর্ণ হলো। তেতপুড়ে বলল,
“তুমি কি বলতে চাচ্ছো উনি ডাকাত? চোর? তোমার সব চুরি করে নিয়ে যাবে? উনাকে দেখে তাই মনে হয়?”
আজিজুল হক থমকালেন। দমে গেলেন না। পূর্বের স্বরেই বললেন,
“এখনকার চোররা খুব চালাক। বেশভূষ দেখে বুঝাই যায় না কে চোর কে ভদ্রলোক।”
রিধি অপমানে নীল হয়ে গেল। চোখে টলমলে জল! ভাব দেখে মনে হচ্ছে শ্রাবণকে নয় অপমান তাকে করেছে। এত খারাপ লাগছে! কোথাও একটা যন্ত্রণা হচ্ছে৷ ইচ্ছে করছে সব কিছু ধ্বংস করে বাবাকে বলতে,’এই কথাটা তুমি বলতে পারলে,বাবা? আমার বাবা হয়ে বলতে পারলে?’ কিন্তু বলা হলো না। বাবার দিকে তাকিয়ে দৃঢ় স্বরে বলল,’উনি আমার সাথে থাকবেন। আশা করি এতে তোমার অসুবিধা হবে না। নাকি আমার ঘরটাও খালি করে দিতে হবে?”
আজিজুল হক কিছু বললেন না। স্ত্রীকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। মৌনতাকে সম্মতির প্রকাশ ভেবে শ্রাবণের একটা হাত টেনে ধরে নরম স্বরে বলল,
“একটু হাঁটার চেষ্টা করুন।”
শ্রাবণকে নিজের বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে একে একে সব কিছু নিজের ঘরে আনল। কাপড়গুলো নিজের কাপড়ের সাথে সাজিয়ে রাখতে রাখতে বলল,
“আমার রুমে থাকতে আপনার অসুবিধা হবে না তো?”
শ্রাবণ চুপ করে থাকল। রিধি গোছগাছে এতই ব্যস্ত ছিল যে এক জোড়া মুগ্ধ ও তৃপ্ত দৃষ্টি টের পেল না।
____________
শরীফা খন্দকার প্রতিদিনের মতো আজও ‘বুটিক হাউজ’ থেকে ফিরলেন বেশ রাত করে। কলিং বেল বাজাতে পপি দরজা মেলে দাঁড়াল। শরীফা খন্দকার বিরক্ত নিয়ে বললেন,
“এমন দরজা দখল করে আছিস কেন? ভেতরে ঢুকতে দিবি না?”
পপি মাথা ঝুকিয়ে সরে দাঁড়ালে শরীফা খন্দকার ভেতরে পা রাখলেন। এক পা সামনে ফেলে সহসা ঘাড় বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোর চোখ,মুখ এমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে কেন? কী হয়েছে?”
পপি উত্তর দেওয়ার জন্য ঠোঁট দুটো ফাঁক করলেও কণ্ঠ স্বর ভেসে আসল অন্য কারও,
“ভেতরে এসো,শরীফা। তোমার অপেক্ষায় ছিলাম।”
শরীফা চট করে সামনে তাকায়। মীর খন্দকারের পাশে ভ্রমরকে দেখামাত্র রূহ কেঁপে ওঠে। চোখ দুটো অস্বাভাবিক পরিমাণে বড় হয়ে যায়। স্থির দাঁড়িয়ে থাকে নিজের জায়গায়। এক ভারি আশঙ্কা বুকে ভর করে। সেই সময় পপি ফিসফিস করে বলল,
“ভ্রমর আপা মনে হয় জানে না ইনিই তার বাবা। শুরু থেইকাই দেখতাছি আংকেল কইয়া ডাকতাছে।”
পপির কথায় শরীফা খন্দকারের ভয় কাটল না,মনের আতঙ্ক দূর হলো না। এতক্ষণ জানেনি এখন নিশ্চয় জানবে। সে ভীত পায়ে সামনে এগিয়ে ভ্রমরকে ধমকে উঠল,
“তোর পড়া নেই? এখানে কী করছিস? ভেতরে গিয়ে পড়তে বস। আমি উনার সাথে কথা বলে আসছি।”
কথার মাঝেই ভ্রমরের ডান হাতটা চেপে ধরেন শরীফা খন্দকার। হেঁচকা টানে মেয়েকে সরিয়ে আনতে চাইলে ভ্রমরের বাম হাতটা চেপে ধরেন মীর খন্দকার। মেয়েকে নিজের দিকে টেনে বললেন,
“আমাদের কথা বলার মূলেই তো ভ্রমর। ও চলে গেলে কিভাবে হবে?”
ভ্রমর ভারি বিভ্রান্তে পড়ল। বোকার মতো নিজের দুই হাতের দিকে তাকিয়ে থাকল। শরীফা খন্দকার স্বামীর দিকে কঠিন দৃষ্টি ছুড়লে তিনি চৌকস হেসে বললেন,
“প্রকৃতি আমাদের দেখা করিয়েছে। ভাগ্য মিলতে বলছে। আর ভাগ্য তো স্বয়ং আল্লাহর ইচ্ছেতে লেখা হয়। শরীফা,তুমি কি সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছের বিরোধীতা করতে চাচ্ছো? বুক কাঁপছে না?”
শরীফা জ্বলন্ত চোখে কিছু একটা বলতে চাইল। সুযোগ পেল না তার আগেই ভ্রমরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলেন মীর খন্দকার। মেয়ের দুটি হাত চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমার বাবার কথা মনে পড়ে?”
হঠাৎ বাবার প্রসঙ্গ চলে আসায় ভ্রমরের মুখ ও মন মেঘাচ্ছন্ন হয়। চোখ দুটি জলে থৈ থৈ! মীর খন্দকার একটু সময় নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন,
“বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করে?”
ভ্রমর মায়ের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে। মীর খন্দকার তৃতীয় বারের মতো জিজ্ঞেস করলেন,
“বাবার আদর খেতে ইচ্ছে করে? প্রাণ ভরে বাবা ডাকতে ইচ্ছে করে?”
এই পর্যায়ে ভ্রমরের চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলল,
“হুম। করে তো! কিন্তু..”
“তাহলে ডাকো।”
মুহূর্তেই ভ্রমরের কান্নার দমক থেমে যায়। ভেজা চোখে পূর্ণ দৃষ্টিতে মীর খন্দকারের দিকে তাকায়। চোখে,মুখে আকাশ মাপের বিস্ময়! তিনি মৃদু হাসলেন। ভ্রমরের কপালে ছোট্ট চুমু খেয়ে কানে কানে বললেন,
“বাবা,তোমায় কেমন সারপ্রাইজ দিল?”
বাবা! কে বাবা? ইনি কাকে বাবা বলে সম্বোধন করছেন? এই মানুষটি বাদে তো আর কোনো পুরুষ মানুষ নেই। তাহলে কি ইনিই তার বাবা? ভাবনা পথেই ভ্রমরের চোখ দুটো গোল হয়ে আসল। মায়ের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকল কতক্ষণ। মীর খন্দকার কান থেকে মুখ সরিয়ে সামান্য অভিমান নিয়ে বললেন,
“এত বড় সারপ্রাইজ দিলাম। তার বিনিময়ে একটা জাপটিও পাব না?”
ভ্রমর সংকোচ নিয়ে জড়িয়ে ধরার উদ্যত হতে মীর খন্দকার মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। গাঢ় আলিঙ্গনের মুহূর্তে আবদার করে বসলেন,
“একবার বাবা বলে ডাকবি না?”
ভ্রমরের ঠোঁট কেঁপে উঠল। ‘বাবা’ শব্দটি উচ্চারণ করার পূর্বে মায়ের দিকে তাকাল। মায়ের অনুমতি প্রার্থনা করছে!
মেয়ের চোখে,মুখের দিকে ভালো করে তাকাতেই তার কঠিন মন নরম হয়ে আসল। এক মুহূর্তের জন্য সব ভুলে মৃদু হাসলেন। চোখের পলক ফেলতেই ভ্রমর বুকের খুব গভীর থেকে উচ্চারণ করল,
“বাজান!”
সাথে সাথে তিন জোড়া চোখে অশ্রুর বর্ষণ শুরু হলো।
________________
মেয়েকে আদর ভালোবাসা ভরিয়ে দিয়ে সজল চোখে বিদায় নিয়ে মীর খন্দকার গাড়িতে চড়লেন। কথা দিলেন কাল সকালেই চলে আসবেন। থাকবেন অনেক দিন। জরুরী কাজ আছে বিধায় এখন ফিরতে হচ্ছে। ভ্রমরের দিকে চোখ রেখে ইঞ্জিন চালু করতে আচমকা ভয়ানক শব্দ হলো। দুজনেই ছিটকে উঠলেন। মীর খন্দকার তাৎক্ষনিক গাড়ি থেকে নেমে পেছনে চলে আসলেন। সাথে সাথে লটকে থাকা ভাঙা কাঁচগুলো নিচে ঝরে পড়ল। সেই সময় ভ্রমর চেঁচিয়ে উঠল,
“হৃদ্য ভাইয়া,তুমি ঢিল মেরেছ?”
ভ্রমর দৌড়ে হৃদ্যের কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। ভীষণ রাগ নিয়ে বলল,
“তুমি বাবার গাড়ির কাঁচ ভাঙলে কেন?”
ভ্রমরের কোনো প্রশ্নেরই জবাব দিল না হৃদ্য। চোখ নাড়িয়ে তাকাল না পর্যন্ত। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মীর খন্দকারের চোখ দুটোতে স্থির!
চলবে
চলবে