#প্রিয়ন্তিকা
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |৯|
প্রিয়ন্তি সবে বাসায় ফিরেছে। নিজের জন্যে বরাদ্দকৃত ঘরে এসে ব্যাগ টেবিলের উপর রেখে বাথরুমে ঢুকল। লম্বা গোসল নিয়ে বের হয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। টাওয়ালে চুল ঝাড়ছে। তখন মায়ের ঘর থেকে চেচানোর শব্দ শুনে চমকে উঠে প্রিয়ন্তি। টাওয়াল বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলে দৌঁড়ে এগিয়ে যায় মায়ের ঘরের দিকে।
বিছানার উপর শুয়ে প্রিয়ন্তির বাবা কেমন করছেন। দাতে দাত লেগে যাচ্ছে। কেপে যাচ্ছেন ক্রমাগত। তার কাপুনির সঙ্গে বিছানাও কাপছে। প্রিয়ন্তির মা স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে বারবার ডেকে যাচ্ছেন তাকে। কি হয়েছে স্বামীর, বুঝতে পারছেন না বলে আরো বেশি ভয় হচ্ছে তার। প্রিয়ন্তি বাবার এসব অবস্থা দেখে ভয়ে শিউরে উঠল। দ্রুত বাবার পাশে বিছানায় এসে বসে। প্রিয়ন্তিকে দেখে প্রিয়ন্তির মা কেঁদে উঠেন শব্দ করে। স্বামীর বুকে হাত রেখে প্রিয়ন্তিকে বলেন,
‘ এই প্রিয়ন্তি? কি হয়েছে তোর বাবার? এমন অস্থির হচ্ছে কেন? ‘
প্রিয়ন্তি বাবার অবস্থা দেখে বুঝতে পারছে, উনার খিচুনি উঠেছে। খুব দ্রুত তাকে হাসপাতালে না নিয়ে গেলে দুর্ঘটনা ঘটতে সময় নিবে না। প্রিয়ন্তি এক হাতে বাবার হাত চেপে ধরল। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তার হাত। প্রিয়ন্তি আঁতকে উঠল। দ্রুত বসা থেকে উঠে বলল,
‘ মা, তুমি তৈরি হও। বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে। আমি অ্যাম্বুলেন্স ডাকছি। ‘
প্রিয়ন্তির মা আর এক মুহূর্ত দেরি করলেন না। দ্রুত বোরকা গায়ে জড়িয়ে নিলেন। অ্যাম্বুলেন্স চলে এল আধা ঘন্টার মধ্যে। প্রিয়ন্তি অ্যাম্বুলেন্সের লোকেদের সহযোগিতায় বাবাকে নিয়ে গাড়িতে উঠল। প্রিয়ন্তির মা ঘরের চাবি হাতে নিয়ে বিসমিল্লাহ বলে বেরিয়ে গেলেন। বুকের ভেতর তার অস্থির বোধ হচ্ছে। কপাল বেয়ে ঘাম ছুটে যাচ্ছে। বোধ হচ্ছে, আস্ত এক পাঁচ মণ পাথর তার বুকে কেউ চেপে ধরে রেখেছে। প্রিয়ন্তির মা মনেমনে কালিমা পড়তে লাগলেন। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষটার হুট করে কি থেকে কি হয়ে গেল?
______
প্রিয়ন্তির বাবাকে ডাক্তার দেখেছে। ডাক্তার কিছু পরীক্ষা করানোর জন্যে বলেছে। প্রিয়ন্তি ব্যাগে থাকা টাকার পরিমাণ দেখল। আজ মাত্রই টিউশনির বেতন দিয়েছে। প্রিয়ন্তি ভেবেছিল, এই টাকা দিয়ে চাকরির বই কিনবে। তবে চাকরি থেকে এখন বেশি গুরুত্তপূর্ণ বাবার চিকিৎসা। তাই প্রিয়ন্তি আর কিছু চিন্তা করল না। ব্যাগ থেকে টাকা নিয়ে ডাক্তারের কথামত পরীক্ষা করানোর জন্যে চলে গেল।
প্রিয়ন্তির বাবাকে পরীক্ষা করানোর জন্যে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রিয়ন্তি বাইরে একটা চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছে। হঠাৎ দুটো স্ট্রেচারে করে রোগী নিয়ে যাচ্ছে দেখে প্রিয়ন্তি চোখ খুলে তাকাল। রোগীদের নিয়ে হাসপাতালে হট্টগোল লেগে গেছে। প্রিয়ন্তি অলস দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করল রোগীদের রক্তে মাখা মুখ। সঙ্গেসঙ্গে চমকে উঠল প্রিয়ন্তি। ওয়াহিদ এবং মাহতিম শুয়ে আছে স্ট্রেচারে। ওয়াহিদের মুখে রক্ত নেই। তবে অজ্ঞান হয়ে আছে সে। আর মাহতিমের সম্পূর্ন মুখ রক্তে মাখামাখি। জ্ঞান আছে, তবে বারবার চিৎকার করছে। ব্যথায় চোখ মুখ খিচে রেখেছে। দুজনের এসব অবস্থা দেখে আতঙ্কে প্রিয়ন্তির গায়ের লোম সোজা হয়ে গেল। প্রিয়ন্তি দৌঁড়ে গেল স্ট্রেচারের পেছন পেছন। মাহতিম, ওয়াহিদ এদের কাউকেই প্রিয়ন্তি পছন্দ করে না। তবে আজ এদের রক্তে মাখা দেহ দেখে প্রিয়ন্তির ভীষন কষ্ট হচ্ছে। না জানি কত কষ্ট ও ব্যথা ভুগছে তারা। স্ট্রেচারগুলো দ্রুত একটা কেবিনে ঢুকে গেল। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বেরিয়ে এক সেই কেবিন থেকে। প্রিয়ন্তি দ্রুত এগিয়ে গেল।
‘ রোগীদের অবস্থা কেমন, ডাক্তার? ‘
ডাক্তার নাকের উপর থেকে মাস্ক খুলে থুতনিতে ঝুলিয়ে রাখলেন। কপাল চুলকে বেশ চিন্তায় স্বরে বললেন,
‘ মেজর কোনো সমস্যা হয়নি। তবে মাথায় আঘাত পেয়েছে একজন। মাথায় ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। একজন পায়ে বেশ আঘাত পেয়েছে। ব্যান্ডেজ দেওয়া হয়েছে। আপাতত দুইজনকেই কমপ্লিট বেড রেস্টে থাকতে হবে। ড্রেসিং করাতে হবে প্রতিমাসে প্রায় তিন থেকে চারবার। আশা করা যায়, মাস খানেক নিয়মমাফিক চলাফেরা ও ট্রিটমেন্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে। ‘
ডাক্তারের কথা শুনে প্রিয়ন্তিকে আশ্বস্ত হতে দেখা গেল। প্রিয়ন্তি মৃদু স্বরে বলল,
‘ ধন্যবাদ। ‘
‘ নট এট অল। ইটস ম্যাই ডিউটি। ‘
ডাক্তার ব্যস্ত পায়ে চলে গেলেন। প্রিয়ন্তি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। বুকটা বেশ ভার ভার লাগছে। কেন লাগছে জানে না। সহানুভূতিশীলতার কারণে বোধহয়। একটা পাগল জুটেছে জীবনে। জীবনটা তছনছ করে দিচ্ছে। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে গেল প্রিয়ন্তির। প্রিয়ন্তি পেছনে ফেরে বাবার কাছে গেল। এখনও পরীক্ষা চলছে বাবার। দরজার বাইরে বসে থাকা নার্সকে জিজ্ঞেস করল প্রিয়ন্তি,
‘ বাবার পরীক্ষা শেষ হতে কতক্ষণ লাগবে আর? ‘
নার্স খাতায় ইংলিশে কিছু একটা লিখছে। ঔষুধের নাম সম্ভবত। নার্স লেখার মধ্যে উত্তর দিল,
‘ আরো আধা ঘণ্টা লাগবে। চেয়ারে বসে অপেক্ষা করুন। ‘
প্রিয়ন্তি চেয়ারে বসল না। মনটা বড্ড খচখচ করছে। একবার দেখে আসতে ইচ্ছে হচ্ছে দুজনকে। কি করবে, কি করবে, ভেবে পাচ্ছে না প্রিয়ন্তি। দেখতে গেলে যদি আরো আশকারা পেয়ে বসে? এরপর মাহতিম যা ঠোঁটকাটা। প্রিয়ন্তির সামান্য মানবতাবোধকে কতশত ভেবে বসবে। এতসব বাঁধা প্রিয়ন্তিকে আটকাতে পারল না বোধহয়। তাই প্রিয়ন্তি ছুঁটে গেল মাহতিমের কেবিনের দিকে।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল প্রিয়ন্তি। মাহতিম, ওয়াহিদ দুজনেই শুয়ে আছে। মাহতিমের চোখ বুঁজে রাখা। মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ। ব্যান্ডেজের উপর ছোপ ছোপ লাল রক্তের দাগ। ওয়াহিদের পা দড়ির সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা। ইশ, কি মর্মান্তিক দৃশ্য। প্রিয়ন্তি এসে বসে মাহতিমের পাশে। চেয়ারের আওয়াজ শুনে মাহতিমের ঘুম ভেঙে যায়। মাহতিম মাথা হালকা কাত করতেই ব্যথায় মৃদু স্বরে চিৎকার করে। তবে প্রিয়ন্তিকে পাশে দেখে সে চিৎকারও ভাটা পরে সুখের তীব্রতায়। মাহতিম ঠোঁট টেনে হাসে। হাসতেও পারছে না সে। ঠোঁটে কাটা। মাহতিম মৃদু স্বরে ডাকে,
‘ প্রি-প্রিয়ন্তিকা? ‘
মাহতিমের কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে।প্রিয়ন্তি হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়ল। বলল,
‘ অ্যাক্সিডেন্ট কিভাবে করলে? আমার মত আরেকটা মেয়ের পেছনে ছুটেছিল? ‘
মাহতিম হাসল। অযথা হাসি। বড্ড সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। অসুস্থ অবস্থায়ও কাউকে সুন্দর দেখাতে পারে প্রিয়ন্তির জানা ছিল না। মাহতিম বলল,
‘ তোমাকেই পেলাম না আবার অন্য মেয়ে! না, বাসায় যাবার পথে বাইক অ্যাক্সিডেন্ট। ‘
মাহতিমের কণ্ঠে কষ্টের সমুদ্র বইছে। যেন প্রিয়ন্তিকে না পাওয়া তার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। আচ্ছা, ভালোবাসলেই কি ভালোবাসা পাওয়া যায়? এই যে মাহতিম প্রিয়ন্তিকে পাগলের মত ভালোবাসে, কিন্তু প্রিয়ন্তি চাইলেও মাহতিমকে ভালোবাসতে পারছে না। মাহতিমের কথা মনে কি বুকের ভেতরটা অস্থির করতে পারে না, মাহতিমের পাগলামিগুলো মনে করে অযথা হাসতে পারে না। কেন পারে না? কারণ প্রিয়ন্তি মাহতিমকে ভালোবাসে না। মাহতিম ভালোবাসে বলেই প্রিয়ন্তির সকল রাগ, অপমান, তুচ্ছতা তার কাছে মধুর মনে হয়। প্রিয়ন্তি মাঝেমধ্যে ভাবে, একবার নকল ভালোবেসে দেখুক না এই ছেলেকে। সারাজীবন কাটাতে হলে ভালোবাসতে হবে কেন? বন্ধুত্ব থাকলেই চলে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে, এতে মাহতিমকে ঠকানো হবে। মাহতিমের পাগল করে ভালোবাসার বদলে প্রিয়ন্তির উচিৎ তাকে ভালোবাসা দেওয়া। ঠকানো নয়। কিন্তু এই ভালোবাসাটাই তো মন থেকে আসে না প্রিয়ন্তির। মন থেকে না আসলে, জোড় করে কি আদৌ ভালোবাসা যায়?
প্রিয়ন্তি একবার ওয়াহিদকে দেখল। মাহতিমকে জিজ্ঞেস করল,
‘ সেও কি তোমার বাইকে ছিল? ‘
মাহতিম হ্যাঁ-বোধক মাথা হেলাল। প্রিয়ন্তি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। প্রিয়ন্তি বলল,
‘ দুজনের বাবা মাকে খবর দিয়েছ? ওরা আসছেন? ‘
‘ হ্যাঁ, রাস্তায়। ‘
প্রিয়ন্তি বা হাতে পরে থাকা ঘড়ির দিকে তাকাল। আধা ঘন্টা হয়ে আসছে। প্রিয়ন্তি ব্যস্ত পায়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়াল। মাহতিম জিজ্ঞেস করল,
‘ চলে যাচ্ছ? আরেকটু থাকো না, প্রিয়ন্তিকা? ‘
ইশ, এমন আদুরে আবদার কি তুচ্ছ করে যায়? যে নারীর মন কোমল, সে পারবে না এমন আবদার তুচ্ছ করতে। কিন্তু প্রিয়ন্তির মন কোমল নয়। বরং পাষাণ, নিষ্ঠুর। তাই সে বলল,
‘ বাবাকে হসপিটাল নিয়ে এসেছি। এখানে বসে থাকলে চলবে না। ‘
মাহতিমের মুখ এটুকু হয়ে গেল। সে চুপ থাকল। মাথাটা আবার ব্যথা করছে। প্রিয়ন্তী চলে যাচ্ছে। মাহতিম পেছন থেকে আবার ডাকল,
‘ প্রিয়ন্তিকা? ‘
প্রিয়ন্তি পেছন ফেরে তাকাল। মাহতিম মৃদু হেসে বলল,
‘ তোমার পেছনে পাগলের মত ঘুরে আর কিছু পাই না পাই, এই যে আজ আমার অসুস্থতায় তোমার চিন্তার কারণ হতে পেরেছি, এই বা কম কিসের! আজকে তোমার চিন্তিত চেহারা, বিরক্তিতে কুচকে রাখা ভ্রু, নিঃশ্বাসের আনাগোনা আমার সারাজীবন মনে থাকবে, প্রিয়ন্তিকা। এই চেহারা দেখার জন্যে হলেও আমি বারবার মাথা ফা’টাতে রাজি। ‘
প্রিয়ন্তি কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল মাহতিমের দিকে। মাহতিমের ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাস। যে বিশ্ব জয় করেছে সে। প্রিয়ন্তি আর দাড়াল না। চলে গেল কেবিন থেকে।
#চলবে