প্রিয়ন্তিকা পর্ব -১০

#প্রিয়ন্তিকা
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |১০|

শুক্রবার দিন বোধহয় বৃষ্টিদের নামে লেখা। সেদিন আকাশ ভেঙে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। ভেজা মাটির স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, শীতল বাতাস, নেশায় আচ্ছন্ন করে ফেলার ন্যায় সুন্দর পরিবেশ। প্রিয়ন্তির বাবা এখন আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ। বুকের ব্যথা হঠাৎ বেড়ে যায়, খিচুনি উঠে মাঝেমধ্যে। তবে ডাক্তারের পরামর্শ মতে ঔষুধ সেবন করলে সব আবার ঠিক হয়ে যায়। সেদিনের পর অনেক দিন কেটে যায়। প্রিয়ন্তির রেজাল্ট দিয়েছে। বরাবরের মত ভালো সিজিপিএ। চাকরি পরীক্ষায় জন্যে পড়াশোনা করছে। এ কদিন বাবার অসুখ এবং পড়াশোনার কারণে মাহতিমের আর খোঁজ নেওয়া হয় নি প্রিয়ন্তির। মনেমনে হয়ত প্রিয়ন্তি চায় নি খোঁজ নিতে। প্রিয়ন্তি মাহতিমের দিকে এক পা এগিয়ে গেলে, মাহতিম গলা ডুবিয়ে বসে থাকে। প্রিয়ন্তি চায় না মাহতিমকে খামোকা প্রশ্রয় দিতে। মাহতিম জানুক, প্রিয়ন্তি তাকে কখনোই ভালোবাসবে না। সে যেন নিজ থেকেই প্রিয়ন্তির পিছু ছেড়ে দেয়। মাহতিমের ন্যায় পাগলাটে প্রেমিক একজন ভালো মেয়েই পাওয়া উচিৎ। প্রিয়ন্তির ন্যায় কঠোর এবং পাষাণ স্বভাবের মেয়ে অবশ্যই নয়।
সকালে রান্নাবান্না শেষ করে প্রিয়ন্তি চা বসায়। মায়ের চুলোর আগুনে গা জ্বলে। এলার্জির সমস্যা মায়ের। তাই প্রিয়ন্তি চুলোর কাজ সব নিজে করে। চা নিয়ে নিজের ঘরে আসে। মোটা পাতার বই খুলে পড়তে বসে। বাবা নামাজে গেছেন। জুম্মার নামাজ বাবা বরাবরই মসজিদে আদায় করেন। বাকি নামাজও মসজিদে পড়েন। তবে যেদিন অসুস্থ বেশি থাকেন, প্রিয়ন্তি বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে ঘরে নামাজ পড়ায়।
বইয়ের দু পাতা পড়ার পর কলিং বেলের শব্দ শুনে প্রিয়ন্তি। বাবা এসেছে বোধ করে প্রিয়ন্তি চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার দিকে এগুয়। দরজার খিল খুললে প্রিয়ন্তি রীতিমত চমকে যায়। বাবার সঙ্গে দাড়িয়ে আছে স্বয়ং মাহতিম। হাতে ভেজা ছাতা, ছাতা থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি গড়িয়ে পরছে। মাহতিম ছাতা ঝেড়ে সুন্দর হেসে প্রিয়ন্তিকে চোখ টিপে দেয়। বাবার সামনে মাহতিমের এহেন আচরণ দেখে থতমত খেয়ে যায় প্রিয়ন্তি। মাহতিম অচেনা লোকের ন্যায় প্রিয়ন্তিকে বলে,

‘ আসসালামুয়ালাইকুম। ‘

প্রিয়ন্তি দাতে দাঁত চেপে সালামের উত্তর দেয়। কেমন খারাপ ছেলে। এতদিন বাসার নিচে অব্দি এসে থেমেছে। এখন সোজা বাসায় চলে এসেছে। তাও কি না বাবার সঙ্গে। প্রিয়ন্তি বাবাকে ধরে। বাবার শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি খানিক ভেজা। বাবাকে ধরে ভেতরে নিয়ে যাবার সময় মাহতিমের দিকে চেয়ে ভদ্রতার খাতিরে প্রিয়ন্তি বলে,

‘ ভেতরে আসুন ভাইয়া। ‘

‘ভাইয়া’ সম্বোধন শুনে মাহতিমের কপাল কুঁচকে যায়। মাথা নত করে বিড়বিড় করে কিছু একটা আওড়ায়। প্রিয়ন্তি শুনতে পায় না। অতঃপর মাহতিম মাথা তুলে ভীষন বিরক্তিকর মুখে ভেতরে ঢুকে। মাহতিমের রাগ রাগ মুখ দেখে হাসি আসে প্রিয়ন্তির। প্রিয়ন্তি বাবাকে ধরে সোফায় বসায়। প্রিয়ন্তির মা দুজনের জন্যে লেবু পানি করে আনেন। বাবা লেবু পানি খেয়ে সোফায় হেলান দিয়ে হাপাতে থাকেন। নামাজ পড়ে এটুকু পথ আসতে তার ভীষন কষ্ট হয়েছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না যেন। প্রিয়ন্তি বাবার পিঠে মালিশ করে দেয়। প্রিয়ন্তির বাবা কিছুটা শান্ত হন। প্রিয়ন্তিকে বলেন,

‘ আর লাগবে না। পাশে এসে বয়। ‘

প্রিয়ন্তি বাবার পাশে বসে। প্রিয়ন্তির বাবা মাহতিমকে ইশারা করে বলেন,
‘ ছেলেটাকে চা দে। ভীষন ভালো ছেলে। বৃষ্টিতে রাস্তায় ভিজতে দেখে নিজে ছাতা মাথায় ধরে বাসা অব্দি নিয়ে এল। এমন ভালো ছেলে আজকাল পাওয়া যায় না রে। তোমার নাম কি? ‘

মাহতিম সোজা হয়ে বসল। অতি ভদ্রতার সহিত উত্তর দিল,

‘ মাহতিম ইয়ান, চাচা। ‘

প্রিয়ন্তির বাবা মাহতিমের ব্যবহারে বোধ হল প্রসন্ন হলেন। প্রিয়ন্তিকে বললেন,

‘ যা, দু কাপ চা বসা। ছেলেটাকেও চা দে। সারারাস্তা ছেলেটা আমার হাত একবারও ছাড়ে নি। ভীষন ভালো ছেলে। ‘

ভালো না অন্য, সেটা প্রিয়ন্তির চেয়ে ভালো আর কেউ বলতে পারবে না। বাবাকে সে নিজের স্বার্থে সাহায্য করেছে, যেন বাবার হাত ধরে বাসা অব্দি পৌঁছে যেতে পারে। এই পাগল ছেলের জ্বালা আর সহ্য হচ্ছে না। রাগ উঠছে। রাগে মাহতিমের ফাটানো মাথা আবার ফাটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। প্রিয়ন্তি মাহতিমের দিকে একপল চায়। মাহতিমের কপালে ব্যান্ডেজ নেই। শুধু কপালের বাম পাশে লম্বা এক কাটার দাগ। হয়ত এখানেই সেলাই লেগেছে। শুনেছে, মানুষের মুখে কাটাছেঁড়ার মত কোনো ত্রুটির দাগ থাকলে তাকে সুন্দর লাগে না। কিন্তু এখানে মাহতিমের কপালে কাটা দাগের জন্যেই তাকে আরো বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে। হ্যাঁ, ওই চেহারাই যা সুন্দর। বাকি আচরণ তো লাগামহীন, বেহায়া। প্রিয়ন্তি সোফা থেকে উঠে রান্নাঘরে যায়। দুকাপ চা বসিয়ে বিড়বিড় করে মাহতিমের গুষ্টি উদ্ধার করতে বসে। প্রিয়ন্তি রান্নাঘর থেকে বসার ঘরে তাকায়। মাহতিমের চোখ রান্নাঘরেই। চোখ বড়বড় করে প্রিয়ন্তিকে দেখছে। যেন রান্না করা প্রিয়ন্তিকে দেখে সে বড্ড আশ্চর্য্য হয়েছে। প্রিয়ন্তি চোখ পাকায়। মাহতিম তবুও চেয়ে আছে। চোখ সরানোর নাম গন্ধ নেই। প্রিয়ন্তি রাগে রান্নাঘরের দরজা ভিড়িয়ে দেয়। মাহতিম মুখ ভার করে পূনরায় সোজা হয়ে বসে। কোমরে ওড়না বেধে প্রিয়ন্তি যখন রান্না করছিল, মাহতিম রীতিমত আতকে উঠেছিল। সারা অঙ্গ শিরশির করছিল। প্রিয়ন্তিকে বউ বউ লাগছিল তখন। দিনদিন প্রিয়ন্তির একেকটা রূপ মাহতিমকে ঘায়েল করে দিচ্ছে বারবার। না জানি আরো কত রূপ আছে মেয়েটার। কবে দেখবে সেসব রূপ? বিয়ে কবে হবে তাদের? মাহতিমের ইচ্ছে করছে এক্ষুনি তুলে বিয়ে প্রিয়ন্তিকে বিয়ে করে ফেলতে। ইশ! মাহতিম বুকে হাত চেপে সোফায় হেলান দিয়ে বসে। বুকের ভেতর প্রচন্ড অস্থির লাগছে। সারাক্ষন অতিমাত্রায় ধুকপুক-ধুকপুক করছে। মেয়েটা একদিন মেরেই ফেলবে মাহতিমকে।

প্রিয়ন্তি দুকাপ চা নিয়ে বসার ঘরে আসে। বসার ঘরে কেউ নেই। বাবার ঘর থেকে আওয়াজ আসছে। নিশ্চয়ই বাবা কাপড় ছাড়ছেন। প্রিয়ন্তি থমথমে চেহারা নিয়ে চায়ের কাপ এগিয়ে দেয় মাহতিমকে। মাহতিম ফিসফিস করে বলে,

‘ রান্না করা অবস্থায় তোমাকে দারুন লাগে, প্রিয়ন্তিকা। একদম বউ বউ। দরজা আটকালে কেন তুমি? আমি দেখছিলাম তোমায়। ‘

প্রিয়ন্তি আবারও চোখ পাকায়। বলে,

‘ বাবাকে নিজের স্বার্থের জন্য কেন সাহায্য করলে? বাসায় আসার জন্যে এই মিথ্যা সাহায্যের নাটক না করলে চলে নি তোমার? ‘

মাহতিম ভ্রু কুঁচকে চায়। ভীষন স্পষ্ট কণ্ঠে বলে,

‘ আমি মোটেও নিজের স্বার্থের জন্যে উনাকে সাহায্য করিনি। উনি রাস্তায় আটকে গেছিল। তাই নিয়ে এসেছি বাসায়। এখানে স্বার্থ কোথায় দেখলে? ‘

প্রিয়ন্তি চোখ তুলে চায়। ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,

‘ চা খেয়ে এক মিনিট দেরি না করে বিদায় হবে। মনে থাকে যেন! ‘

মাহতিম বলল,

‘ তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল। ফোন দিচ্ছি, ধরো নি। মেসেজও সিন করে রেখে দিয়েছ। একবার দেখা করবে? ভীষন জরুরী কথা। বলতে না পারলে দম বন্ধ হয়ে মরে যাব নির্ঘাত। প্লিজ! ‘

মাহতিম ভীষন কাকুতি মিনতি করছে। প্রিয়ন্তি না বলতে চাইছিল। কিন্তু কি মনে করে পরে হ্যাঁ বলে দিল, কি জানি। প্রিয়ন্তি বলল,

‘ আগামীকাল দুপুরে লাইব্রেরীতে চাকরির বই কিনতে যাব। বই কিনতে যতক্ষণ লাগে, ততক্ষণ কথা বলার সময় পাবে। ‘

‘ ওয়াও। ঠিকাছে, ঠিকাছে। এতটুকু সময়ই যথেষ্ট। এর বেশি চাইতে গেলে তো আর দেবে না। তুমি তো আবার বিজি মেয়ে। আচ্ছা, কোথাও মন্ত্রীত্ব টন্ত্রীত্ব করো নাকি? না মানে, এত বিজি থাক সারাক্ষ…’

এই শুরু হল আভার লাগামছাড়া কথাবার্তা। প্রিয়ন্তি মাহতিমের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকায়। মাহতিম চুপ হয়ে যায়। আর কথা বলে না। প্রিয়ন্তির বাবার আসার শব্দ শুনে প্রিয়ন্তি নিজের ঘরে চলে আসে। সেদিনের মত মাহতিম চা খেয়ে চলে যায় প্রিয়ন্তিদের ঘর থেকে। তবে মনেমনে সে বেশ খুশী। যে প্ল্যান করছে, সে প্ল্যান অনুযায়ী এগিয়ে গেলে প্রিয়ন্তি তাকে ভালোবাসবেই। বাসতে বাধ্য। কাল দেখা হবে প্রিয়ন্তির সঙ্গে। ভাবলে খুশিতে উড়ে বেড়াতে ইচ্ছে করছে মাহতিমের।

#চলবে
/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here