প্রিয়ন্তিকা পর্ব -২৯+৩০

#প্রিয়ন্তিকা
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |২৯|

রাতের গভীরতা হইহই করে বাড়ছে। তীব্র বাতাসের দাপটে গায়ের চামড়া শীতে কুকড়ে যাচ্ছে। প্রিয়ন্তি গায়ে শাল জড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। যেদিকে চোখ যায় শুধু গহীন অন্ধকার! রাস্তায় এক দুটো কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটু দূরে বালুর উপর একটা বিড়াল শীতে কাচুমাচু হয়ে ঘুমোচ্ছে। প্রিয়ন্তি বিবশ নয়নে সব দেখে যায়। হাতে সেলফোন তুলে। আঙ্গুলের ডগা সেলফোনে রেখে মাহতিমের নাম্বার ডায়াল করে। কল করবে কি করবে না, সেটাই আপাতত দ্বিধার প্রশ্ন। অনেকবার কল অপশনে আঙ্গুল নিয়েও কি মনে করে ফিরে এসেছে। নাম্বার কেটে দিয়ে আবার ডায়াল করেছে। একপ্রকার যুদ্ধ করছে নিজের মনের সঙ্গে। এই প্রথমবার প্রিয়ন্তির বড্ড অস্থির বোধ হচ্ছে। জীবনের এই তুমুল সংকটে এসে সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। কি সিদ্ধান্ত নিবে ঠাহর করতে পারছে না। প্রিয়ন্তি ঢোক গিলে। শেষবারের মত মাহতিমের নাম্বার ডায়াল করে চোখ বন্ধ করে দ্রুত কল অপশনে চাপে। রিং বাজছে। সঙ্গে কম্পিত হচ্ছে প্রিয়ন্তির অস্থির হৃদয়। সেকেন্ডের ভেতর মাহতিমের কন্ঠ শুনতে পেল। ওপাশ থেকে মাহতিম হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে বলছে,

‘ আমার কথা মনে পরল বুঝি? ‘

প্রিয়ন্তি ঢোক গিলে। কিছুক্ষণ চুপ থাকে। মাহতিম প্রিয়ন্তির নিরবতা বুঝতে পেরে কথা বাড়ায় না। চুপ করে প্রিয়ন্তির নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে যায়। কি সুন্দর করে নিঃশ্বাস নেয় প্রিয়ন্তিকা। প্রিয়ন্তির আলতো করে নিঃশ্বাস টানার শব্দে মাতাল হয়ে যায় মাহতিম। চোখ বুঁজে ঘনঘন নিঃশ্বাস নেয়। আবার কান পেতে শুনে প্রিয়ন্তির অস্থির নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। প্রিয়ন্তি খানিক পর শুধায়,

‘ আমার জন্যে তোমার কাছে কিছু সময় হবে? ‘

মাহতিম অবাক হয়। এই প্রথম প্রিয়ন্তি ভীষন নম্র কণ্ঠে মাহতিমের সঙ্গে কথা বলল। মাহতিম নিজের বিষ্ময় কাটিয়ে উঠে সুন্দর হেসে বলে,

‘ আমার কাছে সময় নয় প্রিয়ন্তিকা। আমার জীবন, আমার হৃদয়, আমার শূন্যতা, আমার ভালোবাসা চাও। আমি পুরোটাই তোমার। ‘

প্রিয়ন্তি শুনে। তারপর আবার চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর থেমে থেমে প্রশ্ন করে সে,

‘ তোমার কাছে আমি কেমন মেয়ে, মাহতিম? আমাকে এত কেন ভালোবাসো? আমি সবসময় তোমাকে অবহেলা করেছি। অপমান করেছি। কিন্তু এতকিছুর পরও কেন এতটা ভালোবাসো আমায়? ভালোবাসার বদলে ভালোবাসা পাওয়া উচিত। লা/ঞ্ছনা, অ/পমান, দুঃ/খ নয়। ‘

মাহতিম পূর্ন মনোযোগ দিয়ে শুনে কথাটা। তারপর অবাঞ্ছিত ভাবনায় না জড়িয়ে সঙ্গেসঙ্গে উত্তর দেয়,

‘ কারণ আমি ভালোবাসার বদলে কিছু পাব বলে তোমায় ভালোবাসি নি। তোমাকে ভালোবাসতে আমার ভালো লাগে, আনন্দ লাগে, সুখ লাগে। তাই ভালোবাসি। আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি নি। সেইসঙ্গে ভালোবেসেছি তোমার রাগ, তোমার দুঃখ, তোমার অপমান, তোমার লাঞ্ছনা, তোমার ওই বাঁকা চোখের চাহনি, রাগী নয়নের তীক্ষ্মতা। তুমি আপাদমস্তক মানুষটাকেই আমি প্রচন্ড ভালোবাসি, প্রিয়ন্তিকা। কারণ জিজ্ঞেস করবে না। কারণের ঝুলি আমার কাছে নেহাৎ শূন্যই। ঠিক যেমন শূন্য তোমার মনে আমার জায়গাটা। ‘

প্রিয়ন্তির মনে হয়, তার বুকে কেউ আগুন জ্বা/লিয়ে দিয়েছে। বুকের ভেতরটা কেমন পু/ড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। এ কোন দ্বিধায় সে জড়িয়ে গেল। মাহতিমের কথায় কিছু একটা ছিল। হয়ত এতদিন নিজের মনে পুষে রাখা কষ্টের তী/র সে সময় সুযোগ বুঝে ছুঁড়ে দিয়েছে প্রিয়ন্তির দিকে। তী/রের সূক্ষ সূঁ/চ বিঁ/ধেছে সোজা প্রিয়ন্তির বুকের মধ্যখানে। প্রিয়ন্তি লম্বা করে নিঃশ্বাস টেনে নেয়। মাহতিম হেসে বলে,

‘ নিঃশ্বাসটাও কি সুন্দর করে নেও, প্রিয়ন্তিকা। ‘

প্রিয়ন্তি শুনে এই পাগল ছেলের কথা। শুনে পাগল ছেলের হাজার রকম পাগলামির কথা। অবশেষে একটা সিদ্ধান্ত নেয়। কঠিন সিদ্ধান্ত। প্রিয়ন্তি মাহতিমকে বিয়ে করবে। একটাবার ঠকে যাবার ঝুঁকি নিয়ে মাহতিমের হাতে হাত রেখে কবুল বলে স্বামি স্ত্রী হবে। জ্ঞানত প্রিয়ন্তি কখনো কারো সঙ্গে কটু আচরণ করেনি। আল্লাহ নিশ্চয়ই প্রিয়ন্তির কপালে জনমভর দুঃখ রাখবেন না। প্রিয়ন্তি ছোট্ট করে বলে,

‘ রাখছি। কালকে দেখা হচ্ছে। শুভ রাত্রি। ‘

কথা বলে প্রিয়ন্তি সঙ্গেসঙ্গে কল কেটে দেয়। মাহতিম কল কাটার শব্দ শুনতেই পাইনি। সে হতভম্ব হয়ে ফোন কানে নিয়ে সামনে তাকিয়ে আছে। তার বুক কাঁপছে। থরথর করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে শরীরের সমস্ত পশম। এ কি বলেছে প্রিয়ন্তিকা। কালকে তো তাদের গায়ে হলুদ। কাল মাহতিমের পুরো পরিবার এবং প্রিয়ন্তিকার পরিবার একসঙ্গে একটা কমিউনিটি সেন্টারে গায়ে হলুদ করবে। এটা অবশ্য মাহতিমের ইচ্ছে। দুই পরিবার একসঙ্গে গায়ে হলুদ করলে অনুষ্ঠানের আনন্দ আরো দ্বিগুণ হবে। প্রিয়ন্তিকা কালকে দেখা করবে মাহতিমের সঙ্গে। অর্থাৎ প্রিয়ন্তিকা গায়ে হলুদে যাবে। নিজের ইচ্ছেই যাবে। তার মানে প্রিয়ন্তিকা মাহতিমকে বিয়ে করার জন্যে রাজি। মাহতিমের মাথায় যতক্ষনে কথাটা এলো, মাহতিম সঙ্গেসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল। মাথার ঘন চুল আঙ্গুল চালিয়ে খা/মচে ধরল মাথার চুল। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। একটু পর এক হাত মুষ্টিবদ্ধ করে পা উঁচু করে ‘হুররে’ বলে লাফিয়ে উঠল। ফোন বের করে প্রিয়ন্তির অগোচরে তোলা সব ছবি চুমুতে ভরিয়ে ফেলল। চোখের কোণায় জল জমেছে মাহতিমের। প্রিয়ন্তি ছবিতে এক আঙ্গুল বুলিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,

‘ আমার জান! তোমার এই বিয়েতে রাজি হওয়ায় আমার কাছে অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু তুমি বিয়েতে রাজি হয়েছ। আল্লাহ আমাকে এর চেয়ে বড় উপহার বোধহয় আর কিছু দিত পারতেন না। আমার তাহাজ্জুদের নামাজের দোয়া অবশেষে কবুল হল প্রিয়ন্তিকা। আই লাভ ইউ। আই লাভ ইউ সো সো সো মাচ। ‘

মাহতিম কথাটা বলে আবার চুমু খেল প্রিয়ন্তির ছবিতে। সারারাত মাহতিম আর এক ফোঁটা ঘুমাতে পারল না। অস্থির হয়ে বসে ছিল। একবার সোফায়, একবার বিছানা, একবার বারান্দায় পায়চারি করেই রাত্রি কাটিয়ে দিল। বুকের ভেতরে সুখের ঝ/ড় বইছে তার। এই অকল্পনীয় সুখ তার কেন যেন সহ্য হচ্ছে না। চারপাশ কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। অস্থির অস্থির বোধ হচ্ছে। প্রিয়ন্তিকা বিয়েতে রাজি হয়েছে। মাহতিমকে বিয়ে করবে বলে রাজি হয়েছে। এত সুখ মাহতিম কোথায় রাখবে? বুকের ভেতর শক্ত করে পুরে রাখবে যে!
______________________
অনুরাগ বাবা-মা সহ গাড়ি নিয়ে প্রিয়ন্তির বাসার সামনে এসে থামল। চোখের রোদচশমা খুলে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। পরপর পেছন থেকে অনুরাগের বোন মা বাবা নেমে দাঁড়াল। অনুরাগ গাড়ির দরজা বন্ধ করে মাথা তুলে পাঁচ তলা তলা ঘরের দিকে চেয়ে মৃদু হাসল। বিড়বিড় করে আওড়াল,

‘ এক বিস্ময়কর রমণীকে জিতে নেবার জন্যে আমি এসে গেছি, প্রিয়ন্তি! ‘

অনুরাগ প্যান্টের পকেটে হাত রেখে রাজাদের মত এগিয়ে গেল বিল্ডিংয়ের দিকে। দারোয়ান দরজার সামনে ঘুমাচ্ছে। অনুরাগ কেশে উঠল। দারোয়ান কাশির শব্দে হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে গেল। ইতি-অতি চেয়ে অনুরাগের দিকে নজর গেল। অনুরাগ জিজ্ঞেস করল,

‘ প্রিয়ন্তিদের বাসায় যাব। কয় তলায়? ‘

দারোয়ান মাথা চুলকে বলল,

‘ দুই তলায় ডান পাশের বাসা। ‘

অনুরাগ মুচকি হেসে বলল, ‘ ধন্যবাদ। আমরা কি ভেতরে যেতে পারি? ‘

দারোয়ান হতভম্ব হয়ে বলল, ‘ চেনা জানা নেই। আপনারে ক্যান ভিতরে ঢুকতে দিমু। আর তাছাড়া, ওরা বাসায় নাই। গায়ে হলুদ করতে সেন্টারে গেছে। ‘

অনুরাগের ভ্রু দৃশ্যমান রূপে কুঁচকে গেল। জিজ্ঞেস করল, ‘ কার গায়ে হলুদ? ‘

‘ প্রিয়ন্তি আপার। ‘

প্রিয়ন্তির গায়ে হলুদ কথাটা শুনে অনুরাগের মাথায় যেন আকাশ ভে/ঙে পরে। অনুরাগ চোখে ঝাপসা দেখে। মাথায় যেন কেউ দশ মণ পাথর চেপে দিয়েছে। অনুরাগ তপ্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করে,

‘ কার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে? ‘

দারোয়ান হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে বলল, ‘ মাহতিম ভাইয়ের লগে। মেলা ভালো পোলা। আমারে রোজ পান কিন্না দেয় তো। কি যে মায়া করে, কি বলমু। আইচ্ছা, আপনি আমারে ইতা জিগান কেনে? ‘

অনুরাগ দ্রুত রোদচশমা চোখে পরে নেয়। সবাইকে নিয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে পেছনের দারোয়ানকে উত্তর দেয়,

‘ আমার অর্জনকে যে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তার সম্পর্কে একটু কি খবর রাখব না। ইনফোগুলোর জন্যে ধন্যবাদ। আসি! ‘

অনুরাগের কথা কিছুই দারোয়ানের বোধগম্য হয়না। সে ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকে শো করে ধোঁয়া উড়িয়ে চলে যাওয়া গাড়ির দিকে।
#প্রিয়ন্তিকা
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |৩০|

কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি পরে প্রিয়ন্তি বসে আছে মাহতিমের ঠিক সামনে। দুজনের মাঝখানে পাতলা স্বচ্ছ পর্দা টানানো। মাহতিমের গায়ে জড়ানো সবুজ এবং হলুদের মিশ্রণের পাঞ্জাবি। বুকের কাছে সোনালী রঙের ব্রোঞ্জ আটকানো। ঘন চুল জেল লাগিয়ে সোজা করে রাখা। সর্বদা সুদর্শন ছেলেকে গায়ে হলুদের সাজে এবার ভীষন চোখে লাগছে। মাহতিমের ঘোলা চোখ প্রিয়ন্তির দিকে তাক করা। প্রিয়ন্তির মুখে মেয়েরা হলুদ লাগাচ্ছে। প্রিয়ন্তি চোখ বন্ধ করে খিলখিল করে হাসছে একেকজনের আচরণে। সেই হাসির শব্দ মাহতিমের কানে প্রবেশ করা মাত্রই মাহতিম অন্য জগতে হারিয়ে যাচ্ছে। কানের মধ্যে কেউ যেন জাদু করছে। মাহতিমের ইচ্ছে করছে প্রিয়ন্তির পাশে গিয়ে বসতে। হাতে হাত রেখে ভালোবাসার কথা বলতে। প্রিয়ন্তির কানে কানে আদর মেখে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে,

‘ মেয়ে, তোমার ঝনকার তোলার হাসির তরে আমার হৃদয় চুরমার হোক। হৃদয়ের রাণী, তোমায় ভালোবেসে আমি নিঃস্ব হই, ফতুর হয়ে যাই, কুরবান হই। ‘

মাহতিমকে হলুদ মাখাতে ওয়াহিদ এলো। মাহতিমকে চোখ টিপে কানে কানে বলল,

‘ ভাই, জিতসস। অবশেষে যার হাতে উঠতে বসতে থাপ্পড় খেলি, তারেই বিয়ে করতেছিস। কি মামু, কেমন ফিল হচ্ছে? ‘

মাহতিম ওয়াহিদের মত করে টিপ্পনী কেটে বলে,

‘ বাসর বাসর ফিল হচ্ছে মামু। জলদি এই বিয়ের প্যারা শেষ করে বাসরে ঢুকা আমাদের। ‘

ওয়াহিদ হকচকিয়ে যায়। চোখ রাঙিয়ে মাহতিমের কাধে থাপ্পড় বসিয়ে বলে, ‘ শালা লুচ্চার ঘরের লুচ্চা। প্রিয়ন্তি যেন তোরে কোনোদিন ছুঁইতে না দেয়। বিড়াল মারার আগেই যেন তোর শক্তি শেষ হয়ে যায়। ‘

মাহতিম হাসে। বলে, ‘ আমার শক্তির উপর নো প্রশ্ন, মামা। শক্তি তোর উপর একবার পরীক্ষা করে দেখব নি? ‘

ওয়াহিদ চকিতে সরে আসে মাহতিমের থেকে। ভয়ার্ত গলায় বলে,

‘ শালা, দূরে থাক। আমার গার্লফ্রেন্ড আছে। ‘

‘ থাক না। আমি নাহয় তোর বেড পার্টনার বয়ফ্রেন্ড হব। সমস্যা? ‘

ওয়াহিদ বুঝতে পারে, খুশির চোটে মাহতিম পাগল হয়ে গেছে। একে এখন ঘাটানো মানে লজ্জা শরমের জলাঞ্জলি দিয়ে নিজের ইজ্জত খোয়ানো। ওয়াহিদ দ্রুত মাহতিমের মুখে হলুদ লাগিয়ে সরে আসে। এখন থেকে ওয়াহিদ মাহতিমের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেই চলছে। কখন যে মাহতিম প্রিয়ন্তি ভেবে তার উপর ঝাঁপিয়ে পরে ঠিক নেই।

মাহতিম অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে প্রিয়ন্তিকে মেসেজ করে। প্রিয়ন্তি তখন সবে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। মেহমান সবাই এখন নাচ গানে ব্যস্ত। প্রিয়ন্তি সেলফোন হাতে নেয়। মাহতিমের মেসেজ পড়ে,

‘ আমার পাশে এসে বসবে, প্রিয়ন্তিকা? আমার খুব একা একা লাগছে। ‘

প্রিয়ন্তি ভ্রু কুঁচকে তাকায় মাহতিমের দিকে। মাহতিম অসহায় চোখে প্রিয়ন্তির দিকে তাকায়। প্রিয়ন্তি চোখ রাঙায়। পাল্টা মেসেজ করে,

‘ এত মানুষের মাঝে কেন একা একা লাগবে? চুপচাপ বসে থাকো। ‘

মাহতিম মেসেজ পড়ে মুচকি হেসে উঠে। মেসেজ করে আবারও,

‘ তুমি আমার পাশে এসে বসল, আমি চুপ করে বসে থাকব। প্রমিজ।’

প্রিয়ন্তি বিরক্ত হয়। লিখে,

‘ অসভ্যতা করা কি বন্ধ করবে? ‘

মাহতিম লিখে,

‘ অসভ্য হয়েছি আমি তোমারই প্রেমে। কাছে আসো না, আরো কাছে আসো না। ‘

প্রিয়ন্তি তাজ্জব বনে যায় মেসেজটা পরে। নাক মুখ কুঁচকে লিখে,

‘ ছিঃ, অসভ্য ছেলে। আর একটা অসভ্য মেসেজ পাঠালে, দেখবে আমি কি করি! চুপ করে বসে থাকো। ‘

মাহতিম প্রিয়ন্তির মেসেজ পরে প্রিয়ন্তির দিকে তাকায়। মাথা চুলকে ঘাড় হালকা কাত করে মৃদু হেসে উঠে। প্রিয়ন্তির চোখ পরে মাহতিমের ঠোঁটে লেগে থাকা সে হাসির পানে। প্রিয়ন্তি থমকে যায় আচমকা। হৃদয়ে কিছু একটা হয়ে যায়। সঙ্গেসঙ্গে প্রিয়ন্তি চোখ সরিয়ে নেয়। প্রিয়ন্তি ভাবে, এই ছেলেটা মারাত্মক আকর্ষন করতে জানে সবাইকে। পাগল হবার সঙ্গেসঙ্গে মাহতিমের মধ্যে পাগল করা সৌন্দর্য্যও লেগে আছে। এতসব কি করে এড়িয়ে যাবে প্রিয়ন্তি?
প্রিয়ন্তি ঢোক গলাধঃকরণ করে।
________________________
অবশেষে মাহতিমের ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। গায়ে হলুদের একদম শেষ পর্যায়ে ছবি তোলার জন্যে ফটোগ্রাফার প্রিয়ন্তি এবং মাহতিমকে পাশাপাশি এনে বসিয়েছে। মাহতিমের খুশি এবার যেন বাঁধ ভেঙেছে। সে বারবার ছবি তোলা ছেড়ে প্রিয়ন্তির দিকে তাকাচ্ছে। প্রিয়ন্তি মুখে বিরক্তি দেখালেও, মনেমনে সে ততটা বিরক্তও হচ্ছে না। একপ্রকার উপভোগ করছে বললে ভালো হবে। ফটোগ্রাফার বলল,

‘ ভাই, কনের কোমরে ধরে সামনে তাকান। ভাবি, ভাইয়ের একটু পাশে এসে বসেন। ক্লোজ না হলে ছবি ভালো আসছে না। ‘

মাহতিম তো এই কথা শোনার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। সে প্রিয়ন্তির দিকে তাকায়। ফিসফিস করে অনুমতি চায়,

‘ মে আই? ‘

প্রিয়ন্তি চোখ বুঁজে নিঃশ্বাস ছাড়ে। তারপর বলে,

‘ হালকা করে ধরবে। আমার অস্বস্থি যেন না হয়। ‘

মাহতিম শুনে। প্রিয়ন্তি মনেমনে চাইছে না মাহতিম প্রিয়ন্তির কোমর স্পর্শ করুক। প্রিয়ন্তি যেটা চাইছে না, সেটা মাহতিম কি করে চায়? তাই মাহতিম ফটোগ্রাফারের দিকে চেয়ে বলে,

‘ ভাই, ধরাধরি ছাড়া ছবি তুলেন। ক্লোজ হওয়া ছাড়াও সুন্দর ছবি তোলা যায়। ফটোগ্রাফার হয়ে সব অ্যাঙ্গেলে সুন্দর ছবি তোলা জানা উচিত আপনার। ‘

ফটোগ্রাফার মাথা চুলকে আওড়ায়, ‘ সরি, ভাই। সরি ভাবি। ‘

মাহতিম বলে, ‘ সরি বলার দরকার নেই। ছবি তুলেন। ‘

ফটোগ্রাফার ছবি তুলতে থাকে। মাহতিম প্রিয়ন্তির পিঠে হাত নিয়ে তাকে না ছুঁয়ে সুন্দর পোজ দেয়। ফটোগ্রাফার ছবি তুলে সেটা। ছবি দেখে মনে হচ্ছে মাহতিম প্রিয়ন্তির গা ছুঁয়ে ছবি তুলেছে। আসলে তা না। মাহতিম গা ছুঁয়ে ছবি তোলার শুধু ভান করছে। একে একে ফটোগ্রাফার সুন্দর সুন্দর ছবি তুললো দুজনের। বাকি মেহমানরা এসে বর কনের সঙ্গে ছবি তুলল। এতসব ভেজালের মধ্যে প্রিয়ন্তি হাপিয়ে উঠল। গা ব্যথায় চিরবিরিয়ে উঠছে। মাহতিম প্রিয়ন্তির অবস্থা বুঝে বলল,

‘ কষ্ট হচ্ছে? অনুষ্ঠান শেষ করে দেই? ‘

প্রিয়ন্তি নড়েচড়ে বসে। বলে, ‘ সবাই কি মনে করবে? ‘

মাহতিম শক্ত গলায় বলে, ‘ সবার কথা বুঝতে শিখে গেলে, নিজের কথাই ভুলে যাবে প্রিয়ন্তিকা। তুমি সুস্থ না থাকলে এত কষ্ট করে বিয়ে করার মানেই হয়না। সিম্পল ভাবে বিয়ে সেরে নিলেই হবে। ‘

মাহতিমের কথা শুনে প্রিয়ন্তি ঘোরে চলে যায়। একটা মানুষ কি করে এতটা ভালোবাসতে পারে কাউকে। প্রিয়ন্তি ভালোবাসার মত কোনো মেয়েই নয়। প্রিয়ন্তির মত রাগি, বদমেজাজি মেয়েদের কপালে ভালোবাসার মানুষ জুটে না। জুটে তার মতই আরেক বদমেজাজি পুরুষ। প্রিয়ন্তি মনেমনে দ্বিধায় জড়ায়। মুখে বলে,

‘ আমি ঠিক আছি। টেনশন নিও না। ‘

মাহতিম তীক্ষ্ম চোখে প্রিয়ন্তির দিকে তাকায়। প্রিয়ন্তির চেহারার হাল দেখেই মনে হচ্ছে, প্রিয়ন্তি ঠিক নেই। ব্যস! আর কিছু শোনার দরকার নেই মাহতিমের। সে তার বাবাকে ডেকে বলে,

‘ অনুষ্ঠানের সব কাজ শেষ, বাবা? ‘

মাহতিমের বাবা উত্তর দেন, ‘ হ্যাঁ, মেহমানদের খাওয়া দাওয়া শেষ। তোমাদের ছবি তোলা শেষ? ‘

মাহতিম উত্তর দেয়, ‘ শেষ। আজ আর না। এবার বাসায় যাওয়া উচিত বাবা। বড্ড টায়ার্ড লাগছে। ‘

মাহতিমের বাবাও তার কথায় সায় দেন। মাহতিমের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে স্টেজ থেকে নিচে নেমে সবাইকে বাসায় যাওয়ার কথা বলেন। একে একে মেহমান শূন্য হয়ে যায় সেন্টার। কনেপক্ষ এবং বরপক্ষ তৈরি হয় বাসার যাওয়ার জন্য। প্রিয়ন্তিকে যখন মাহতিম গাড়িতে তুলে দিচ্ছিল। তখন প্রিয়ন্তির কানের কাছে মাহতিম কয়েকটা কথা আওড়ায়,

‘ আর মাত্র একটা দিন প্রিয়ন্তিকা। তারপরই তুমি পুরোদস্তুর আমার হয়ে যাবে। আমি খুব খুশি প্রিয়ন্তিকা। তুমি খুশি তো? ‘

প্রিয়ন্তি শেষের কথার উত্তর দেয় না। মাহতিমের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলে,

‘ সাবধানে বাসায় যেও। কালকে দেখা হচ্ছে। ‘
______________________________
অনুরাগ যতক্ষণে সেন্টারে এসেছে ততক্ষণে বর কনের গাড়ি সেন্টার ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। অনুরাগ সেন্টারে এস পুরো সেন্টার খালি দেখতে পেয়েছে। সেন্টারের কর্মচারী সেন্টার পরিষ্কার করার কাজে লেগে আছে। অনুরাগ বুঝতে পারে, সে বড্ড দেরি করে ফেলেছে। তার আরো আগে এখানে পৌঁছা উচিত ছিল। অনুরাগ এগিয়ে আসে। সেন্টারের একটা লোককে জিজ্ঞেস করে,

‘ এখানে একটু আগে একটা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হয়েছে না? ওরা কখন চলে গেছে? ‘

সেন্টারের কর্মচারী উত্তর দেয়, ‘ এইতো একটু আগেই গেল। আপনি কে? এখন দাওয়াতে এসেছেন নাকি? ‘

অনুরাগ এই কথার উত্তর দেয় না। কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করে,

‘ আচ্ছা, এই বর কনের বিয়ে কি এই সেন্টারেই হবে? আপনি কিছু জানেন? ‘

‘ না, এই সেন্টারে না। সবার মুখে শুনলাম, তাদের বিয়ে হিল ভিউ সেন্টারে হবে। ‘

অনুরাগের মন প্রসন্ন হয়। সে মুচকি হেসে ধন্যবাদ জানায় কর্মচারীকে। তারপরই দ্রুতগতিতে বেরিয়ে যায় সেন্টার থেকে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here