প্রিয়ন্তিকা পর্ব -২৭+২৮

#প্রিয়ন্তিকা
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |২৭|

হাবিব বসার ঘরে এলেন। পাঞ্জাবি গুটিয়ে সোফায় বসলেন। মাহতিম একবার প্রিয়ন্তির ঘরের দিকে চেয়ে আবার হাবিবের দিকে চাইল। বুকের ভেতরটা ধরফর করছে তার। প্রিয়ন্তিকা কি রাজি হয়েছে? হাবিব স্যার কি বলেছেন প্রিয়ন্তিকাকে? জীবনের এই দ্বিতীয়বার মাহতিমের নিজেকে বড্ড এলোমেলো লাগছে। নার্ভাস হচ্ছে প্রচন্ড। প্রথমবার হয়েছিল যেদিন প্রিয়ন্তিকে প্রপোজ করেছিল। বদলে থা*প্পড় খেয়ে ফিরে আসলেও, পরবর্তীতে যতবার প্রিয়ন্তির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক আজকের মত মাহতিমের নার্ভাস লেগেছে। এলোমেলো লেগেছে নিজেকে। হাবিব সবার দিকে চেয়ে বললেন,

‘ আমি এবং আমার মেয়ে দুইজনেই বিয়েতে রাজি। আমরা কথা এগুতে পারি এখন। ‘

মাহতিম হাবিব স্যারের কথা শুনে চোখ বড়বড় করে চাইল। খুশির চোটে তার চোখের কোণে পানি জমে গেল। এতদিনের স্বপ্ন….এতদিনের স্বপ্ন এখন মাহতিমের সামনে সত্য হয়ে ধরা দিয়েছে। মাহতিমের বাবা বললেন,

‘ আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে আমরা আগামী বুধবার বিয়ের দিন ধার্য্য করি? তার আগের দিন হলুদ আর মেহেদী। কি বলেন? ‘

হাবিব চমকে উঠে বলেন, ‘ আগামী বুধবার মানে তো পরশুর পরের দিন। এত দ্রুত সবকিছু…’

মাহতিম স্যারের অগোচরে বাবার পিঠে হাত রাখে। মাহতিমের বাবা চোখের ইশারায় ছেলেকে আশ্বস্ত করেন। হাবিবের দিকে চেয়ে বলেন,

‘ মাহতিমের দাদুর ইচ্ছে এটাই। নাতির বিয়ে দ্রুত দেখে যেতে চান। বুঝেনই তো, বয়স্ক মানুষ। কখন কোন বিপদ হয়ে যায়, আল্লাহ তায়ালা ভালো জানেন। ‘

হাবিবের মনের ভেতরের খচখচানি তবুও থামে না। তিনি চিন্তিত স্বরে বলেন, ‘ তাই বলে এত দ্রুত? আমার মন মানছে না। ‘

মাহতিম এবার কথা বলে। হাবিবের হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুড়ে মৃদু স্বরে বলে, ‘ স্যার, আমি আপনার মেয়েকে দুনিয়ার সবকিছু থেকে বেশি পছন্দ করি। ভবিষ্যতে কোনও দুর্ঘটনা ঘটার আগেই আমি বিয়ের কাজ শেষ করতে চাইছি। তাছাড়া কদিন আগে, ভার্সিটিতে প্রিয়ন্তিকাকে রে*ইপ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। আমি সময়মত এসে বাঁচিয়েছিলাম বলে, প্রিয়ন্তিকা এতবড় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে। নাহলে…’

মাহতিম চোখ বুজে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। তারপর আবার বলতে শুরু করে,

‘ আমি খবর পেয়েছি, প্রিয়ন্তিকার পেছনে সেই ছেলেটাই অনুরাগ নামে কাউকে লাগিয়ে দিয়েছে। প্রিয়ন্তিকার ক্ষ*তি করানোর জন্যে তারা উঠেপড়ে লেগেছে। একবার আমি বাঁচাতে পেরেছি। তাই বলে, বারবার ভাগ্য আমাদের সহায় হবে না। তাই আমি একটাই অনুরোধ করব, প্রিয়ন্তিকাকে এ কদিন আপনি বাড়ির বাইরে যেতে দেবেন না। বিয়ে অব্দি সে ঘরেই যেন থাকে। বিয়ের পর আমি আমাদের বাসায় একেবারে নিয়ে যাব। প্লিজ স্যার। ট্রাই টু অ্যান্ডারসট্যান্ড। এটা প্রিয়ন্তিকার জীবনের প্রশ্ন। ‘

হাবিব এসব কথা শুনে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেন। সত্য বলতে, তার মেয়ে যে ভার্সিটি পড়তে গিয়ে এতগুলো বিপদের সম্মুখীন হয়েছে সেটা তিনি ঘুর্নাক্ষরেও টের পাননি। মেয়ে চাপা স্বভাবের হওয়ায় নিজের সঙ্গে হওয়া এসব দুর্ঘটনা বরাবরেই লুকিয়ে এসেছে। মেয়ের কাছে তিনি এটা একদমই আশা করেননি। আজ মাহতিম না থাকলে…আঁতকে উঠেন হাবিব।

মাহতিম হাবিবের মুখের অভিব্যক্তি পটু দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে। টোটকা কাজে দিয়েছে ভাবতেই মনটা খুশিতে এলোমেলো হয়ে যায়। মাহতিমের দিকে চেয়ে হাবিব ভেজা কণ্ঠে বলেন,

‘ তোমার শুকরিয়া আমি কিভাবে আদায় করব ইয়ান, আমার মাথা কাজ করছে না। প্রিয়ন্তি একা একাই চলাফেরা করে সবসময়। তাই
আমি মেয়ের সুরক্ষার বিষয়টা বেশি গুরুত্ত দেইনি। সেদিন তুমি ছিলে বলে। নাহলে.. ‘

হাবিব আর কথা বলতে পারেন না। অত্যন্ত চিন্তায় কেপে উঠে সর্বাঙ্গ। মাহতিম মৃদু হেসে বলে,

‘ আমি এসে গেছি এবার, স্যার। আপনার মেয়েকে নিয়ে আপনার আর কোনো চিন্তা করতে হবে না। আপনার মেয়ের রক্ষাকবজ হব আমি। ডোন্ট ওরি। ‘

হাবিব আশ্বস্ত হোন খানিক। মাহতিনের বাবা কথা তুলেন,

‘ স্যার, আপনি চাইলে আমরা বিয়ের কথা পাকা হবার চিহ্ন স্বরূপ প্রিয়ন্তি মাকে আমাদের খানদানি আংটি পরিয়ে যেতে চাই। যদি আপনি কিছু মনে না করেন, তবেই এই কাজ করা হবে।’

হাবিব খুশি হোন। খুশিতে ঝলমল হয়ে বলেন,

‘ অবশ্যই। আমি মেয়েকে ডেকে আনছি। ‘

হাবিব পুনরায় ভেতরে যান। প্রিয়ন্তি তখন নিজের মায়ের সঙ্গে তুমুল ঝ*গড়া করছে। ঝ*গড়ার মূল কারণ, মাহতিমের সঙ্গে বিয়ে। সে কিছুতেই এই বিয়ে করবে না। বলা নেই, কথা নেই। বাবা হুট করে একজনের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন। এটা কেমন ধরনের আজব কথা? বাবা কেন তার বিষয়টা বুঝছেন না?
হাবিব এদিকে আসছেন দেখে, প্রিয়ন্তির মা উঠে গিয়ে মেয়ের মুখ চেপে ধরেন। সতর্ক কণ্ঠে বলেন,

‘ দোহাই লাগে, চুপ কর এবার। তোর বাপ আসছে। এসব চিল্লাপাল্লা শুনলে তোরেসহ আমাকেও কথা শুনাবে। ‘

প্রিয়ন্তি চোখ রাঙিয়েই থেমে গেল। শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যত হোক। প্রিয়ন্তি হাবিবকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করে। ভয়ও পায় একটু। বাবার সামনে গলা উঁচু করা তার স্বভাবের বিপরীত। তাই প্রিয়ন্তি দমে যায়। হাবিব আসেন। প্রিয়ন্তির মায়ের দিকে চেয়ে বলেন,

‘ শুনো, ওকে দশ মিনিটে শাড়ি পরিয়ে তৈরি করো। ওরা চাইছে আংটি পরিয়ে রাখতে। ‘

প্রিয়ন্তির মা অসহায় চোখে মেয়ের দিকে তাকান। প্রিয়ন্তির রাগ এবার আকাশচুম্বী হয়ে উঠে। ধপ করে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে। বাবার কথা শুনে রাগে চোখের কোণায় জলও জমে গেছে। প্রিয়ন্তির মা আর কিইবা বলবেন। স্বামির কথা অনুসারে বললেন,

‘ দিচ্ছি। তুমি ওদের কাছে গিয়ে বসো। ‘

হাবিব খুশিমনে মেয়ের মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে চোখের জল মুছে আবার বসার ঘরের দিকে যান। বাবা চলে যেতেই প্রিয়ন্তি ধপ করে বিছানায় বসে পরে। দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠে। প্রিয়ন্তির মা মেয়ের পাশে এসে বসেন। প্রিয়ন্তির কাধে হাত রেখে বলেন,

‘ মাহতিম ছেলেটা এতটাও খারাপ না, প্রিয়ন্তি। তাকে বিয়ে করতে তুই এত বিশ্রী অনুভব কেন করছিস? ‘

প্রিয়ন্তি মুখ ঢেকে আগের ন্যায় অশ্রুভেজা কণ্ঠে বলে,

‘ জানিনা না। তাকে বিয়ে করতে আমার মন সায় দিচ্ছে না। আমি বাকি জীবনটা পস্তাতে চাইনা।’

প্রিয়ন্তির মা বলেন,

‘ তোর বাবা বড়মুখ করে ওদের কথা দিয়েছেন। এখন ওদের সামনে না গেলে তার মুখ ছোট হয়ে যাবে। তোর বাবার এমনিতেই শরীর ভালো না। তোর এসব ধকল সে সহ্য করতে পারবে না। বুঝ প্রিয়ন্তি।’

‘ তাহলে কি বাবার জন্যে আমি আমার জীবন বলিদান দিয়ে দেব? এটা বলতে চাইছ তুমি, মা? ‘

প্রিয়ন্তির মা আঁতকে উঠেন। সঙ্গেসঙ্গে বললেন,

‘ বলিদান কেন হবে? আজ ওদের সামনে যা। ওরা চলে গেলে তারপর শান্ত মাথায় তুই তোর বাবার সঙ্গে কথা বলবি। তোর বাবাকে বুঝানোর চেষ্টা করবি। তারপর দেখ উনি কি বলে। শুধু লক্ষ্মী মেয়ের মত এখন ওদের সামনে যা। সোনা মা আমার। ‘

অতঃপর প্রিয়ন্তিকে বুঝিয়ে শুনিয়ে তৈরি করে দিলেন প্রিয়ন্তির মা। সাধারণ সুতির শাড়ি, সঙ্গে গলায় একটা চিকন চেইন, ঠোঁটে মিষ্টি রঙের এক লিপস্টিক। প্রিয়ন্তি তৈরি হয়ে ওদের সামনে গেল। প্রিয়ন্তিকে আসতে দেখে মাহতিম সবার অগোচরে প্রিয়ন্তিকে চোখ টিপে দিল। প্রিয়ন্তির রাগ মাথায় চড়ে বসল। চোখ রাঙালো। মাহতিমের মা প্রিয়ন্তিকে দেখে হাত বাড়িয়ে বললেন,

‘ আসো, মা। আমার পাশে এসে বসো। ‘

প্রিয়ন্তি ভদ্রতা বজায় রাখতে মাহতিমের মায়ের পাশে এসে বসল। মাহতিমের মা প্রিয়ন্তির মুখের দিকে চেয়ে চমৎকার কণ্ঠে বললেন,

‘ মেয়ে তো মা শা আল্লাহ। অনেক সুন্দর। পরীর মত মুখখান। আলহামদুলিল্লাহ। ‘

প্রিয়ন্তি এসব প্রশংসা মুখ বুজে শুনে যায় শুধু। একটু দূরেই মাহতিম তার ভাইয়ের সঙ্গে বসে আছে। মাহতিমের বেহায়া দৃষ্টি প্রিয়ন্তির চোখে-মুখে ঘুরছে। ঠোঁটে লেগে আছে অদ্ভুত এক বাঁকা হাসি। যেন প্রিয়ন্তিকে অর্ধেক পেয়েই সে দুনিয়া উদ্ধার করে নিয়েছে। জয়ী হবার হাসি লেগে আছে তার ঠোঁটের সর্বত্র। প্রিয়ন্তির মাহতিমের এই চাওনি দেখে রাগে গা জ্ব*লে-পুড়ে যাচ্ছে। ছেলেটা কতটা বেহায়া হলে প্রিয়ন্তির বারবার মানা করার পরও তাকে নিয়ে বিয়ের স্বপ্ন দেখতে দেখতে এতদূর এসে যেতে পারে। মাহতিমের বাবা বললেন,

‘ মাহতিম, প্রিয়ন্তি মায়ের পাশে এসে বসো। আসার সময় তোমার মা একটা আংটি দিয়েছে না তোমাকে। ওটা বের করে পরিয়ে দাও তাকে। ‘

মাহতিম বলার সঙ্গে সঙ্গে উঠে প্রিয়ন্তির পাশে এসে বসে যায়। পকেট থেকে আংটির বাক্স বের করে। বাক্স থেকে আংটি বের করা হাতে নেয়। প্রিয়ন্তির দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,

‘ হাতটা? ‘

প্রিয়ন্তি এই কেঁদে দেবে যেন। এমন পরিস্থিতিতে সে কখনোই পরেনি। তাই এই পরিস্থিতিতে সে কি করবে কিছুই ঠাহর করতে পারছে না। প্রিয়ন্তির বাবা মেয়ের হাত তুলে দিলেন মাহতিমে দিকে। মাহতিম প্রিয়ন্তির হাত শক্ত করে ধরে। এত শক্ত করে হাত ধরার ফলে প্রিয়ন্তির মনে হচ্ছে মাহতিম তার হাত ভে*ঙে ফেলতে চাইছে। হাত ইতিমধ্যে ব্য*থা করা শুরু করে দিয়েছে। মাহতিম কি এতদিনের পেছনে ঘুরার প্রতিশোধ এভাবেই নিতে চাইছে? মাহতিম প্রিয়ন্তির আঙ্গুলে আংটি পরিয়ে দেয়। আংটি পরানোর পরও হাত ছাড়ে না। সবার অগোচরে একটা কাগজ প্রিয়ন্তির হাতের মুঠোয় পুড়ে দেয়। প্রিয়ন্তি কাগজ হাতে নিয়ে সঙ্গেসঙ্গে মাহতিমের থেকে হাত ছাড়িয়ে নেয়। ছোট কাগজ থাকায় প্রিয়ন্তি আঙ্গুলের ডগায় কাগজ খুলে দেখে। সেখানে খুব ছোট ছোট অক্ষরে লেখা,

‘ তোমার দিকে আরো একধাপ এগিয়ে গেলাম। চ্যালেঞ্জ করলাম, এই বিয়েটা রুখে দেখাও। অল দ্য বেস্ট, প্রিয়ন্তিকা।

প্রিয়ন্তি সঙ্গেসঙ্গে চোখ গরম করে তাকায় মাহতিমের দিকে। মাহতিম সঙ্গেসঙ্গে চোখ টিপে দেয় প্রিয়ন্তিকে।

#চলবে #প্রিয়ন্তিকা
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |২৮|

প্রিয়ন্তি বাবার পাশে এসে বসেছে। হাবিব তখন ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত। পরশু গায়ে হলুদের ব্যাপারটাই মিটমাট করছেন। কাছের আত্মীয়রা গায়ে হলুদ সহ বিয়েতে আসবেন। দূরের সবাইকে শুধু বিয়েতে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। ছোটখাটো মেহেদী অনুষ্ঠান বাসায় করারও চিন্তা করে রেখেছেন। প্রিয়ন্তি পাশে বসে রইল কিছুক্ষণ। হাবিবের ফোনে কথা বলা শেষ হলে তবেই ও নিজের কথা তুলবে। হাবিব মেয়েকে দেখে অল্পক্ষণের মধ্যেই ফোন কেটে পকেটে রাখেন। মেয়ের অস্থির চেহারার চোখ রেখে মুহূর্তেই বড্ড আবেগপ্রবণ হয়ে যান। হাবিব অগোচরে আবেগে ভেসে যাওয়া মনকে প্রবোধ দিয়ে প্রশ্ন করেন,

‘ কিছু বলবে? ‘

প্রিয়ন্তি চুপ করে বসে থাকে। হাতের উপর হাত রেখে চোখ পিটপিট করে যাচ্ছে। হাত ঘামছে অবিরত। কোথা থেকে কথা তুলবে তাই ভাবছে। হাবিব মেয়ের গতিবিধি সূক্ষ চোখে পরখ করেন। মেয়ের অশান্তি বুঝতে পেরেও নিজে থেকে কথা তুলেন না। সময় দেন প্রিয়ন্তিকে। কিছুক্ষণ পর প্রিয়ন্তি দম ছেড়ে বলে,

‘ বাবা, আমি এই বিয়ে করতে পারব না। ‘

হাবিব অবাক হন না। চুপ করে শুনেন। ঢিলে হয়ে যাওয়া চশমা নাকের উপর তুলে বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,

‘ কেন? মাহতিম খারাপ ছেলে? পরিবার খারাপ? ‘

প্রিয়ন্তি অস্থির কণ্ঠে আওড়ায়,

‘ তেমন নয় ব্যাপারটা। ‘

‘ তাহলে কেমন ব্যাপার? বিয়েতে মানা করার কারণ আসলে কি? ‘

প্রিয়ন্তি সিদ্ধান্ত নেয় বাবাকে সব কথা খুলে বলবে ও। সেসব কথা বলতে যত লজ্জা লাগুক না কেন, প্রিয়ন্তি সব লজ্জাকে পাশ কাটিয়ে বাবাকে সবই বলে দেবে। প্রিয়ন্তি উত্তর দেয়,

‘ মাহতিম ভালো ছেলে বাবা। কিন্তু তাকে আমি মন থেকে পছন্দ করি না। মাহতিম প্রায় সাড়ে তিন বছর থেকে আমাকে ভালোবাসে। প্রথম প্রথম অন্য দশটা ছেলের ন্যায় আমি ওকে মানা করে দেই। কিন্তু ধীরে ধীরে ওর ভালোবাসা, ওর পাগলামি আমাকে অতিষ্ট করে তুলেছে। ওর এসব পাগলামি দেখে আমি অনেক চেষ্টা করেছি ওকে মেনে নেবার। কিন্তু দিনশেষে ওর করা একেকটা ভয়ংকর পাগলামি দেখে আমি ওকে মানতে পারিনি। ইভেন এখনো পারছি না। ওর সঙ্গে বিয়ের কথাটা আমি কল্পনাও করতে পারি না বাবা। ‘

হাবিব সব শুনেন। তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন,

‘ কিরকম পাগলামি করেছে সে? ‘

প্রিয়ন্তি উত্তর দেয়,

‘ অনেক রকমের পাগলামি বাবা। আমার জন্যে কলেজের নেতাদের সঙ্গে মারধর করা। আমার পেছনে স্পাই লাগানো। আমাকে কোনো স্যার বকাঝকা করলে সেই স্যারকে হ্যারেজ করা, কোনো ছেলে আমার দিকে চোখ তুলে তাকালে, তাকে একা রাস্তায় পিটিয়ে ভয় দেখানো। তার এসব বাচ্চা ছেলের মত পাগলামি আমাকে নানা বিপদের মুখে ফেলে দিয়েছে। আমি নানাভাবে অনেক বড়বড় বিপদে পড়েছি শুধু তার এই পাগলামিগুলোর কারণে। এমন বড় বিপদ, যা মুখে বলতেও আমার বুক কাপছে। আমি অনেকবার তাকে বলেছি, এসব না করতে। কিন্তু দিনশেষে সে আমার ব্যাপারে এতটাই পজেসিভ ছিল যে, আমার হাজার বারণ সে কানে নেয় নি। বারবার লোক পেটানো, আমার জন্যে অন্যকে হ্যারেজ করা, এসব যেন তার হাতের ময়লা হয়ে গেছিল। সে সব বুঝত। কিন্তু এসব পাগলামির কারণে আমার ক্ষতি হওয়া সে কখনও বুঝতে চাইত না। আমার ভার্সিটি জীবন হেল করে দিয়েছিল সে। আমি এই পাগল ছেলেকে কিছুতেই বিয়ে করতে চাইনা বাবা। এটা আমার জন্যে অসম্ভব। ‘

হাবিব সব শুনেন। ডান হাত থুতনিতে ঠেকিয়ে গম্ভীর মুখে বসে থাকেন চেয়ারে। প্রিয়ন্তি উত্তরের আশায় বাবার মুখের দিকে চেয়ে আছে। কিছু সময় কেটে যাবার পর হাবিব কথা বলেন,

‘ সে কি করেছে না করেছে, এসব নিয়ে পরে কথা বলছি। আগে এটা আমাকে বলো। ইয়ান কি তোমায় সত্যি মন থেকে ভালোবাসে, নাকি তার ভালোবাসা তোমার কাছে কখনো মিথ্যা মনে হয়েছে? ‘

প্রিয়ন্তি মুহূর্তেই দমে যায়। বাবার হুট করে এমন কথা বলে বসবেন, সেটা প্রিয়ন্তি বুঝতে পারেনি। মাহতিমের ভালোবাসার উপর প্রিয়ন্তি কখনোই প্রশ্ন তুলতে পারেনি। আসলে সে সুযোগ মাহতিম প্রিয়ন্তিকে দেয়নি। মাহতিম সর্বদা প্রিয়ন্তি বলতে উন্মাদ ছিল। প্রিয়ন্তি নত হয়। নম্র কণ্ঠে উত্তর দেয়,

‘ না, মনে হয়নি। ‘

‘ ভালো। এবার আমাকে বলো। তার চরিত্রে সমস্যা আছে? আজকাল ছেলেদের যেসব অশ্লীল জিনিসে ঝোঁক থাকে, তার সেসব আছে? ‘

প্রিয়ন্তি সঙ্গেসঙ্গে উত্তর দেয়,

‘ না, নেই। ‘

‘ এটাও নেই? আচ্ছা। এবার আমাকে বলো। সে কখনো তুমিসহ অন্য কোনো মেয়েকে তার কথা বা কাজ দ্বারা অসম্মান করেছে? ‘

প্রিয়ন্তি কিছুক্ষণ ভাবে। একে একে মনে করার চেষ্টা করে সব। ভার্সিটিতে মাহতিম বরাবরই জনপ্রিয় মুখ ছিল। সুদর্শন এবং চঞ্চল ছেলে হওয়ায় মেয়েরা প্রায়শই ওর কাছ ঘেঁষতে পছন্দ করত। কিন্তু এতসব মেয়ের ভিড়ে মাহতিমের চোখ থাকত শুধুমাত্র প্রিয়ন্তির দিকে। একবার একটা কলেজ বার্ষিক অনুষ্ঠানে মাহতিম স্টেজে উঠে সবার সামনে মাইক হাতে প্রিয়ন্তিকে ভালোবাসি বলেছিল। তারপর থেকে মেয়েরা নিজে থেকে সরে গেছে মাহতিমের থেকে। মাহতিম সেদিন হেসে হেসে প্রিয়ন্তিকে বলেছিল,

‘ দেখেছ তোমার সতীনদের কিভাবে তাড়িয়ে দিলাম? একেই বলে ট্রু লাভ! এই খুশিতে একটা ঝটপট চুমু খেয়ে নাও তো প্রিয়ন্তিকা! বেশি গভীর করে দিও না আবার। তাহলে আমার আবার কিছুমিছু হয়ে যাবে। বি এলার্ট, ওকে? ‘

প্রিয়ন্তি চোখ বুজে মৃদু নিঃশ্বাস নেয়। তারপর উত্তর দেয়,

‘ না, সে কোনো মেয়েকে অসম্মান করেনি। ‘

‘ এটাও না? আচ্ছা, এবার বলো। সে তোমার সঙ্গে কেমন আচরণ করে? তোমার সঙ্গে কখনো খারাপ আচরন করেছে আজ অব্দি? যে আচরণ তোমার আত্মসম্মানে আঘাত হেনেছে? কিংবা সে কখনো কি তোমায় ছোট করে, অপমান করে কথা বলেছে? ‘

প্রিয়ন্তি চুপ থাকে। আবার ভাবতে বসে। অনুরাগকে নিয়ে মাহতিম প্রিয়ন্তির সঙ্গে উচু গলায় কথা বলেছে ঠিকই। কিন্তু রাগের মাথায় সে প্রিয়ন্তিকে ছোট করে বা অপমান করে কিছুই বলেনি। প্রিয়ন্তির রাগ, প্রিয়ন্তির আত্মসম্মানের প্রতি সর্বদা মাহতিমের নজর ছিল। প্রিয়ন্তির শরীরে সামান্য কাটার আঘাত লাগলেও, যায় বুকে ঝড় উঠে যায়। সে মানুষটা নিজে থেকে কখনোই আঘাত করেনি প্রিয়ন্তিকে। প্রিয়ন্তি শান্ত হয় এবার। বুকের মধ্যে বয়ে চলা ঝড় শান্ত হয়ে যায়। আস্তে করে বলে,

‘ সে আমাকে অপমান করেনি কখনো। ‘

হাবিব মৃদু হাসেন এবার। চশমা খুলে ভাঁজ করে টেবিলের উপর রাখেন। তারপর বলেন,

‘ একটা ছেলের প্রকৃত স্বামি হবার জন্যে সব গুন ইয়ানের মধ্যে আছে। এটা আমার মুখের কথা নয়। তুমি নিজেই এটা স্বীকার করেছ। ইয়ানের মধ্যে বখে যাবার কোনো বদ গুন নেই। তোমাকে সে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে ভালোবাসে। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমার, সে নিজের বৃদ্ধ বয়সেও তোমার হাত ছেড়ে দেবে না। এটা আমার বিশ্বাস। তুমি নিজেকে সময় দাও। চিন্তা করো ওকে নিয়ে। সে তোমাকে সুখে রাখবে। আমার বিশ্বাস, ইয়ানের চেয়ে আর কেউ তোমাকে ততটা ভালোবাসতে পারবে না। ভালোবাসা বিহীন একজন পুরুষের সঙ্গে আজীবন সংসার করা যায়। কিন্তু যে পুরুষের মনে তোমার প্রতি সম্মান নেই, সেই পুরুষের সঙ্গে এক মুহুর্ত থাকা জাহান্নামের মত মনে হয়। ইয়ান তোমাকে ভালোবাসে। তারচেয়ে বড় কথা, সে তোমাকে সম্মান করে। এই দুই গুন তুমি সব পুরুষের মধ্যে খুঁজে পাবে না। যার মধ্যে পাবে, তাকে সময় থাকতে আগলে নাও। দেরি হয়ে যাবার আগে, তাকে নিজের আঁচলে পুড়ে নাও। এটাই বুদ্ধিমতীর কাজ। আর আমি জানি, আমার মেয়ের বুদ্ধির কখনো তুলনা হয়না। ‘

প্রিয়ন্তি নিশ্চুপ হয়ে রয়। হাবিব চেয়ার থেকে উঠে পড়েন। কক্ষ থেকে যাবার আগে প্রিয়ন্তির মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু স্বরে বললেন,

‘ আশা করছি, তুমি সঠিক সিদ্ধান্তই নেবে। মনে রাখবে, এই একটা সিদ্ধান্তের উপর তোমার সারাজীবনের সুখ নির্ভর করছে। ‘

হাবিব চলে যান। প্রিয়ন্তি ঠায় বসে থাকে চেয়ারে। চোখ আবার পিটপিট করছে। কি বলে গেলেন বাবা? বাবা বিচক্ষণ মানুষ। শিক্ষক হওয়ায় সবার মুখ সহজেই পড়ে ফেলতে পারেন। বাবা বলছেন, মাহতিম প্রিয়ন্তির জন্যে সেরা পছন্দ! তাহলে? বাবার কথা ফেলে দেবার মত নয়। একটা মানুষ সব দিক থেকে পারফেক্ট হয়না। খুঁতহীন মানুষ ফেরেশতার সমান। আর মানুষ কখনো ফেরেশতা হয়না। প্রিয়ন্তি কি করবে এখন? একবার ভেবে দেখবে কি? মাহতিমকে একবার শেষ সুযোগ দেবে কি? কিন্তু যদি এই সুযোগ দেবার কারনে প্রিয়ন্তিকে পস্তাতে হয়,তখন? উফ! প্রিয়ন্তি পাগল হয়ে যাবে। এই মাহতিম নিজেও পাগল হয়েছে, এখন নিজের পাগলামি দ্বারা প্রিয়ন্তিকেও পাগল বানিয়ে ছাড়ছে।

#চলবে
/929533097975216

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here