#প্রিয়ন্তিকা
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |৩৪|
‘ নাতবউ! আমার পাশে আইয়া বহ। ‘
প্রিয়ন্তি মাহতিমের দাদীর কথা শুনে নম্রভাবে মাথা দুলিয়ে তার পাশে এসে বসে। দাদির নজর সবার প্রথমে প্রিয়ন্তির ভেজা চুলে পরে। তিনি প্রিয়ন্তির ভেজা চুল দেখে মনেমনে কিছুটা স্বস্তি পান। তিনি শুরুতে শুনেছেন বটে। তার নাতি কতটা পাগল এই মেয়ের জন্য। দিনরাত ঘুরে বেড়াত এই মেয়ের পেছনে, এই খবরও তিনি পেয়েছেন। বাড়িতে অশান্তি সৃষ্টি করে এই মেয়েকে তার নাতি বিয়ে করেছে শুনে কিছুটা অসন্তুষ্ট ছিলেন তিনি। যতটুকু বর্ণনা শুনেছেন, তাতে তার মনে হয়েছে মাহতিম বোধহয় একাই এই মেয়ের জন্যে পাগল। মেয়েটা বোধহয় মাহতিমকে পছন্দ করে না। কিন্তু আজকে বিয়ের পরদিন সকালে প্রিয়ন্তির ভেজা চুল দেখে তার সমস্ত অসন্তুষ্টি মিটে গেল। দুজনের মনের মিল হয়েছে সেটা দেখে তিনি কিছুটা তৃপ্তি পেলেন। দাদি প্রিয়ন্তির হাত ধরে নিজের কোলে রাখলেন। প্রিয়ন্তির খুব নার্ভাস লাগছে। দাদি নিজের কোমরের বাঁধা ব্যাগ থেকে এক জোড়া স্বর্ণের বালা বের করে প্রিয়ন্তির হাতে পরিয়ে দিলেন। প্রিয়ন্তি চোখ নামিয়ে ফেলল। দাদি আঙ্গুলের ডগা দিয়ে প্রিয়ন্তির থুতনি ধরে মুখ উচু করলেন। আদর কণ্ঠে বললেন,
‘ আমার বিয়ের সময় আমি শুধু দুইখান বালা’ই পাইসিলাম। পরে বিয়ের পর যখন তোমার দাদু শ্বশুরের টাকা পয়সা হইল তহন তাইন আমারে আরো বালা বানাই দিসিলেন। আমি তার মধ্যে থেকে এক জোড়া বালা নয়নারে দিসি যহন ওই পয়লা বিয়া হইয়া এই ঘরে আইসিল। কিন্তু আইজ আমি তোমারে আমার বিয়ের বালা জোড়াই দিলাম। কারণ তুমি যার বউ হইয়া আইস, হে আমার পরদ্দান নাতি। আমারে সবার থেকে হেই বেশি মায়া করে। বাকিরাও করে। কিন্তু হে আমি বলতেই পাগল। তোমার থেকে হে কিন্তু আমার লাইগা বেশি পাগল। তুমি কিন্তু হের পাগলামি আমার থাইকা কাইরা নিবা না। তাইলে কিন্তু বললাম বালা ওইব না। বুঝবার পারস? ‘
কি সুন্দর অভিমানী আবদার। প্রিয়ন্তি মৃদু হাসে। নম্র কণ্ঠে বলে,
‘ কেড়ে নেব না, দাদি। আপনি তার প্রথম পাগলামো সবসময়ই থাকবেন। ‘
দাদি শুনে খুশি হলেন। তবে মুখে সেটা খুব একটা প্রকাশ করলেন না। বরং আড়ালেই রাখলেন। তারপর প্রিয়ন্তির ঘোমটা চুল থেকে একটু সরিয়ে আবার জায়গায় রেখে দিলেন। প্রিয়ন্তি এতে কিছুর অবাক হল। দাদি প্রিয়ন্তির কানের কাছে এসে বললেন,
‘ ঔষুধ টুওশুধ খাইস নাকি? ঔষুধ টুওশুধ খাইও না কইলাম। বিয়ের পরপরই বাচ্চা হইয়া যাওয়া বালা। স্বামীর ভালোবাসা আরো বাইরা যায়। বুঝবার পারস?’
প্রিয়ন্তি এবার অস্বস্তিতে রীতিমত জমে যায়। মাথা নত করে মনেমনে দোয়া করতে থাকে এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার জন্যে। প্রিয়ন্তি এবার খুঁজতে লাগল মাহতিমকে। দেখা গেল পরমুহূর্তেই মাহতিম চট করে কোথা থেকে দাদির কোলে মাথা রেখে মাটিতে হাঁটু মুড়িয়ে বসে গেল। দাদি আচমকা মাহতিমের আগমনে চমকে উঠলেন। মাহতিমের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ কি ব্যাপার দাদুভাই? আমাগো মাঝখানে তুমি ক্যান আইলা? কথা বলতেছিলাম না আমরা? ‘
মাহতিম মাথা একটু তুলে দাদির মুখের দিকে তাকাল। মিষ্টি হেসে বলল,
‘ সেটাই তো শুনতে আসছি। বিয়ে তো ও একা করে নাই। আমিও করেছি। তাই সকল টিপস অ্যান্ড ট্রিকস ও একা কেন জানবে? আমাকেও জানাও। ওর একা অভিজ্ঞতা বেড়ে কি হবে? আমারও বাড়ুক। ‘
দাদি মাহতিমের একটুখানি অপেক্ষায় অধৈর্য্য হওয়া বুঝতে পেরে হেসে উঠলেন। মাহতিমের চুল টেনে দিয়ে বললেন,
‘ কিছু লাগবে? সোজাসুজি বইলা দাও। ঘুরাইও না এত। আমি সব বুঝি। ‘
মাহতিন দাদির কোলে মাথা রেখে প্রিয়ন্তির দিকে তাকায়। লজ্জায় তখন প্রিয়ন্তির মরিমরি অবস্থা। এতগুলো কথা শুনে প্রিয়ন্তি ঠিক কোথায় মুখ লুকাবে বুঝতে পারছে না। মাহতিম আসলেই ঠিক বলেছিল। বিয়ের পরদিন অনেক কথা সহ্য করতে হয় নতুন বউদের। তাছাড়া মাহতিমের দাদি শুধুমাত্র প্রিয়ন্তির ভেজা চুল দেখেই তাকে পছন্দ করে বালা দিয়েছেন। নাহলে দেখা যেত, তিনি হয়ত ভেবে বসতেন তার নাতির সঙ্গে প্রিয়ন্তির কিছুই ঠিক নেই। মাহতিম তাকে এই যাত্রায় বাঁচিয়ে দিয়েছে। মাহতিম প্রিয়ন্তির মুখ দেখে বুঝে ফেলেছে, প্রিয়ন্তিকে ইতিমধ্যেই লজ্জাজনক কথা বলা হয়ে গেছে। সেটা জেনেই মাহতিম দ্রুত এসে তাদের কথা থামিয়েছে। দাদি চুল টেনে দিচ্ছেন মাহতিমের। মাহতিম দাদির কোল থেকে মাথা তুলে ঘাড় কাত করে খুব নিষ্পাপ কণ্ঠে বলল,
‘ ওকে একটু লাগবে। নিয়ে যাই? ‘
দাদি ভ্রু কুঁচকে মাহতিমের দিকে তাকালেন। মাহতিম তখনো ভীষন নিষ্পাপ চোখে চেয়ে আছে দাদির দিকে। প্রিয় নাতির এমন নিষ্পাপ মুখখানা দেখে হেসে ফেললেন তিনি। প্রিয়ন্তি হাত টেনে মাহতিমের হাতের উপর রেখে বললেন,
‘ যা, নিয়ে যা। ‘
মাহতিম হেসে ফেলে। দাদির মুখ দুহাতে ধরে উনার কপালে চুমু খায়। ধন্যবাদ জানিয়ে প্রিয়ন্তিকে নিয়ে সেখান থেকে নিজের ঘরে চলে আসে।
নিজেদের ঘরে এসে মাহতিম দরজা হালকা ভিড়িয়ে দেয়। একেবারেই লক করে না। ভরদুপুরে বউকে নিয়ে দরজা বন্ধ কর বসে থাকা মাহতিম-প্রিয়ন্তি দুইজনের জন্যে লজ্জাজনক। প্রিয়ন্তি বিছানায় বসে আছে। নিঃশ্বাস ফেলছে ক্রমাগত। মাহতিম প্রিয়ন্তিকে অস্থির হতে দেখে প্রিয়ন্তির পাশে এসে বসে। কিছুক্ষণ প্রিয়ন্তিকে সূক্ষ চোখে পর্যবেক্ষণ করে। তারপর মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করে,
‘ দাদি কি বলছে তোমাকে? ‘
প্রিয়ন্তি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে বলে,
‘ তেমন কিছু না। ঐ তো সংসার জীবনের টুকিটাকি বোঝাচ্ছিলেন। ‘
মাহতিম বুঝতে পারল, প্রিয়ন্তি কথা এড়িয়ে গেছে। আচ্ছা, যাক। লজ্জা পেলে বলার দরকার নেই। মাহতিম জোর করবে না প্রিয়ন্তিকে। মাহতিম জিজ্ঞেস করে,
‘ খেয়েছ কিছু? ‘
প্রিয়ন্তি উত্তর দেয়, ‘ হ্যাঁ। পোলাও আর গরুর মাংস। ‘
মাহতিম বলল,’ আমি জানি আজকে সকালে কি রান্না হয়েছে। জিজ্ঞেস করছি, তুমি খেয়েছ কি না। সত্যি বলবে। ‘
প্রিয়ন্তি মিনমিন করে বলে, ‘ খুব একটা খেতে পারিনি। সবার সামনে বসে খেতে কেমন অস্বস্তি লেগেছিল। ভাবি আর তুমি ব্যতীত কাউকে তেমন একটা জানিনা। বিয়ের ভেজালের কারণে তোমার আম্মুর সঙ্গেও কথা হয়নি ভালো করে। তাই অপরিচিত পরিবেশে খেতে পারিনি ভালো করে। ‘
মাহতিম শুনে। প্রিয়ন্তির পাশ থেকে উঠে যায়। রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে প্রিয়ন্তিকে বলে যায়, এই ঘরে চুপচাপ বসে থাকার জন্যে, মাহতিম খাবার নিয়ে আসছে।
একটু পরই মাহতিম খাবার প্লেটে করে নিয়ে ঘরে ঢুকে। পানি ভর্তি গ্লাস আর প্লেট টি টেবিলে রেখে বাথরুম থেকে হাত ধুয়ে আসে। তারপর প্লেট নিয়ে প্রিয়ন্তির র পাশে বসে। মাহতিমকে নিজের হাত দিয়ে ভাত মাখাতে দেখে প্রিয়ন্তির দ্রুত বলে উঠে,
‘ আমি নিজের হাতে খেতে পারব। ‘
মাহতিম এক লোকমা ভাত প্রিয়ন্তির মুখের সামনে ধরে বলে,
‘ হা করো, খাইয়ে দিচ্ছি। ‘
প্রিয়ন্তি বিস্মিত মুখে চেয়ে থেকে হা করে। মাহতিম একের পর এক লোকমা তুলে দিতে থাকে প্রিয়ন্তির দিকে।
এই একটা মানুষের ধৈর্য্য আর ভালোবাসার পরিমাপ করে প্রিয়ন্তি কখনও শেষ করতে পারে না। মাহতিমকে গত চারটা বছর প্রিয়ন্তি নানাভাবে অপমান করেছে। প্রিয়ন্তি ভেবেছিল, মাহতিমকে অপমান করলে হয়ত মাহতিম প্রিয়ন্তির পিছু ছেড়ে দেবে। অথচ প্রিয়ন্তি ভুল ছিল। মাহতিম তার ধৈর্য্য ক্ষমতা দিয়ে শেষ অব্দি প্রিয়ন্তিকে ঠিকই জয় করে নিয়েছে। কিভাবে পারে মাহতিম একটা মেয়েকে এতটা, এতটা ভালোবাসতে? ক্লান্ত হয়ে যায় না সে? প্রিয়ন্তি কি কখনো মাহতিমকে ঠিক মাহতিমের মতই অফুরন্ত ভালোবাসতে পারবে? এটা কি সম্ভব হবে কখনো? প্রিয়ন্তি জানে না। সত্যি জানে না।
#চলবে#প্রিয়ন্তিকা
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব -|৩৫|
মাহতিম-প্রিয়ন্তির বিয়ের আজ প্রায় এক মাস। এই এক মাস তাদের দুজনের মধ্যে সেভাবে কোনো অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠে নি। এই ব্যাপারে মাহতিমের মধ্যে কোনো মাথাব্যাথা নেই। যেখানে প্রিয়ন্তিকে বউ হিসেবে পাওয়াটাই অসম্ভব ছিল, সেখানে আজকে প্রিয়ন্তি তার বউ হিসেবে তার সঙ্গে থাকছে। এর চেয়ে বেশি মাহতিমের কোনো আশা নেই। প্রিয়ন্তিকে বিয়ে করার জন্যে মাহতিম প্রিয়ন্তির অনুমতির অপেক্ষা করেনি। করা প্রয়োজনবোধ করেনি সেসময়। একটাই কথা তখন মাথায় চেপেছিল, সেটা হচ্ছে প্রিয়ন্তিকে যেকোনো মূল্যে অনুরাগের থেকে বাঁচিয়ে নিজের করে নেওয়া। নিজের জেদ পূরণ করেছে মাহতিম। কিন্তু বিয়ের পর মাহতিম সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই শেষ। আর কোনো কিছুই মাহতিম প্রিয়ন্তির মতের বিরুদ্ধে করবে না। মাহতিমের নিজের উপর যে পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ আছে, তাতে প্রিয়ন্তিকে না ছুয়ে দিব্বি কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু কথায় বলে না, পুরুষ মানুষের সবচেয়ে দূর্বল জায়গা হল নারী। সবথেকে শক্তির জায়গাটাও নারীর দখলে। তাই মাঝেমধ্যে মাহতিমের ইচ্ছে করে তাদের সম্পর্ককে পরিণতি দিতে। মাঝেমধ্যে প্রিয়ন্তিকে খুব করে কাছে টানতে ইচ্ছে করে। এগিয়েও যায় দু কদম। কিন্তু পরপরই ফিরে আসে। সামলায় নিজেকে। পুরুষ হলেও মাহতিম কোনো কাপুরুষ নয়। ভালোবাসা না পেয়ে জোর করে ভালোবাসা অর্জন মাহতিমের বৈশিষ্ট্যে নেই। তাই তো ইদানিং প্রিয়ন্তির দিকে একটু কমই নজর দিচ্ছে সে। যতই ভাবে, প্রিয়ন্তির মতের বিরুদ্ধে কিছু করবে না। ততই প্রিয়ন্তির বউরূপে নানাভাবে দেখে সেই ভাবনা ধুলিস্মাৎ হতে সময় নেয়না। মাহতিমের মাঝেমধ্যে নিজেকে খুব অসহায় লাগে। প্রিয়ন্তিকে এই পৃথিবীর সবকিছু থেকে সে খুব বেশি ভালোবাসে। অথচ তার ভালোবাসার মানুষ তাকে ভালোবাসে না। এর চেয়ে যন্ত্রণাকর কোনো কিছু বোধহয় বিধাতা মাহতিমকে দিতে পারতেন না। হয়ত ছোটবেলায় নিজে অজান্তেই মাহতিম খুব কড়া এক অন্যায় করেছে। তার শাস্তি এখন নিজে অনুভূতিকে দুমড়ে মুচড়ে দিতে হচ্ছে মাহতিমের।
মাহতিম প্রিয়ন্তিকে আগের ন্যায় দেখছে না, ভালোবাসছে না, পেছনে ঘুরঘুর করছে না। বিষয়টা প্রিয়ন্তিকে না চাইতেও পুড়াচ্ছে। দুদিনেই ভালোবাসা ফুরিয়ে গেল, ভাবতেই চোখের জল উপচে গড়াতে চাইছে। প্রিয়ন্তি ক্রমশ অশান্তিতে ভুগতে লাগল। খেতে ভালো লাগে না, ঘুমুতে ইচ্ছে করে না, রাতের বেলায় আকাশে চাঁদ দেখতে ইচ্ছে করে না, এমন অনেক শখের কাজ প্রিয়ন্তির ইচ্ছে করে না। প্রিয়ন্তি সর্বদা মাহতিমের ভালোবাসা দেখে আসছে। কিন্তু আজ এই অবহেলা, অবজ্ঞা সম্পূর্ন নতুন তার কাছে। মাহতিমের দুইদিন অবহেলায় প্রিয়ন্তির পুরো দুনিয়া তেতো লাগতে শুরু করল। তখন প্রিয়ন্তির মনে পরে, ঠিক এইভাবেই প্রিয়ন্তি নিজেও মাহতিমকে অবহেলা করেছিল। প্রিয়ন্তি মাহতিমকে ভালো না বাসলেও তার সামান্য অবহেলায় বিষিয়ে উঠছে প্রিয়ন্তির হৃদয়। অথচ তার ভালোবাসা অন্ধ হয়ে যাওয়া মাহতিম একদিন এইভাবেই দিনের পর দিন কষ্ট পেয়ে গেছে। আজকাল এসব কথা মনে পরলেই প্রিয়ন্তির বুকের ভেতর দাউদাউ করে জ্বলে উঠে। ইচ্ছে করে, পুরনো সময় ফিরে গিয়ে আবার সব ঠিক করে দিতে। কষিয়ে থাপ্পড় বসাতে পুরোনো প্রিয়ন্তিকে। কিন্তু সেটা তো অসম্ভব। তাই শুধু ভেতর ভেতর গুমড়ে মরছে প্রিয়ন্তি। না পারছে মাহতিমকে ভালোবেসে কাছে টানতে, আর নাইবা পারছে মাহতিমের এই অবহেলার বিরুদ্ধে প্রশ্ন করতে।
আজ বাসায় মেহমান আসবে। মাহতিমের পুরনো এক বন্ধু। আমেরিকা থেকে আসছে। ওয়াহিদের পরে সে মাহতিমের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। বন্ধু নাকি বান্ধুবি আপাতত সেটা জানে না প্রিয়ন্তি। বুকের ভেতর খচখচানিটাকে দামাচাপা দেবার চেষ্টা করে রান্নায় হাত লাগাচ্ছে প্রিয়ন্তি। নয়না আর প্রিয়ন্তি মিলে রান্না কিছুটা গুছিয়ে নিল। প্রিয়ন্তির শাশুড়ি এসে রোস্ট বসালেন। দুই বউয়ের দিকে চেয়ে বললেন,
‘ গোসল নিয়ে নাও তোমরা। ওরা এসে যাবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। বাড়ির বউ সুন্দর পরিপাটি হয়ে থাকা ভালো। ‘
নয়না ও প্রিয়ন্তির দুইজনেই মাথা দুলিয়ে যার যার রুমে আসে। প্রিয়ন্তি যখন রুমে ঢুকে মাহতিম তখন সবে গোসল থেকে বেরিয়েছে। প্রিয়ন্তিকে একঝলক দেখেই সে আলমারির দিকে এগিয়ে যায়। প্রিয়ন্তি আড়চোখে দেখে সব। মাহতিম আলমারি কিছুক্ষণ ঘাটে। কাঙ্ক্ষিত জিনিস না পেয়ে প্রিয়ন্তিকে জিজ্ঞেস করে,
‘ আমার নেভি ব্লু শার্টটা দেখেছ? ব্র্যান্ডের যেই শার্ট সেদিন কিনলাম, সেটা। ‘
প্রিয়ন্তি ভ্রু কুঁচকে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,
‘ ব্র্যান্ডের শার্ট দিয়ে তুমি কি করবে? নরমাল শার্ট তো আছেই। এগুলা পড়ো। ‘
মাহতিম মাথা দোলায়। পরপরই বলে,
‘ ইশা এতদিন পর আসছে। আমি ওর সামনে কমদামী শার্ট পরে যাব? আমার প্রেস্টিজ আছে না? ‘
প্রিয়ন্তি অবাক হয়। মাহতিমের প্রায় সকল শার্টই ব্র্যান্ডের। সবগুলোর দাম প্রায় ৩০০০ এর উপরে। এসব দামী শার্ট পরবে না সে। পরবে সেদিন ৫০০০ দিয়ে আনা শার্ট। আর যে আসছে সে মাহতিমের মেয়ে ফ্রেন্ড। বাহ্! তাহলে এই চলছে। মেয়ে ফ্রেন্ডের আসবে, সেইজন্যে জনাব এট সাজগোজ করছেন? প্রিয়ন্তির ইচ্ছে করল মাহতিমের মাথার চুল সব টেনে ছিঁড়ে ফেলতে। কতবড় সাহস। বিয়ের দুইদিন পরই অন্য মেয়েকে ইমপ্রেস করবে বলে দামী দামী শার্ট পড়ার ইচ্ছে জাগছে? প্রিয়ন্তি নিজের রাগ দমানোর চেষ্টা করল। তারপর এগিয়ে গিয়ে আলমারির একদম কর্নার থেকে শার্টের প্যাকেট থেকে শার্ট বের করে একপ্রকার ছুঁড়ে ফেলল মাহতিমের দিকে। মাহতিম শার্ট সঙ্গেসঙ্গে ক্যাচ করে আহাম্মকের মত প্রিয়ন্তির দিকে চেয়ে রইল। প্রিয়ন্তি রাগে গজরাতে গজরাতে শাড়ি নিয়ে বাথরুমে চলে গেল।
মাহতিম বুঝতে পারল, প্রিয়ন্তি রেগে আছে। তাই সে রেডি হয়ে রুমেই বসে থাকল প্রিয়ন্তিকে এই নিয়ে জিজ্ঞেস করবে কিছু। প্রিয়ন্তি বেশ সময় নিয়ে গোসল থেকে বেরিয়ে এল। লম্বা, ঘন চুলে গামছা প্যাঁচানো। কানের পাশে তিন চারটা চুল ভিজে লেপ্টে আছে। নাকের নাকফুলে পানির ফোঁটা জমে আছে। বিউটি বোনের উপরও জমেছে পানির বিন্দু। গায়ের শাড়ি বেশ ভেজা। প্রিয়ন্তিকে এরকম আবেদনময়ী অবস্থায় দেখে মাহতিমের শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠল। গলা প্রায় শুকিয়ে গেল। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে রইল প্রিয়ন্তির দিকে। বিয়ের পর ইদানিং প্রিয়ন্তির প্রতি মাহতিমের ভালোবাসা আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। প্রিয়ন্তির সব রূপেই এখন মাহতিম কি মুগ্ধই না হয়। প্রিয়ন্তি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঝাড়ছে। চুলের পানি ছিটকে এসে মাহতিমের চোখে মুখে পরছে। এতেই কেমন শিউরে উঠছে মাহতিম। মাহতিম সম্মোহনের ন্যায় দু কদম এগিয়ে গেল। কিন্তু পরপরই থেমে গেল তার পা জোড়া। হুশ ফিরেছে এমন ভাব করে চোখ বন্ধ করে মাথা দ্রুত ঝাঁকাল। পরপরই ব্যস্ত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। প্রিয়ন্তি এবার খুব কষ্ট পেল। ভেবেছিল মাহতিম প্রিয়ন্তির রাগ ভাঙাতে আসবে। গোসল থেকে বেরিয়ে রুমে এখনো মাহতিমকে দেখে প্রিয়ন্তি মনেমনে খুশিই হয়েছিল। মাহতিম বদলে যায়নি, ভাবতেই খুশির সমুদ্রে যেন সাঁতারে বেড়াচ্ছিল। অথচ প্রিয়ন্তির সকল খুশিকে হাতের মুঠোয় গলা চেপে ধরে মাহতিম এভাবে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে পারল? না চাইতেও প্রিয়ন্তির চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরল। সঙ্গেসঙ্গে প্রিয়ন্তি মুছে ফেলল সেই জল।
_____________________________
ইশা বাড়িতে আসতেই রীতিমত হৈ হুল্লোর লেগে গেল মাহতিমদের মধ্যে। মাহতিম এতদিন পর বেস্ট ফ্রেন্ডকে কাছে পেয়ে মাথায় তুলবে না কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। মাহতিম ইশাকে প্রিয়ন্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। ইশা প্রিয়ন্তিকে আগাগোড়া দেখে জড়িয়ে ধরল। পাশ ফেরে মাহতিমকে টিপ্পনী কেটে বলল,
‘ কলেজ থাকতে খুব বলতি কে কচি মেয়ে দেখে বিয়ে করবি। এই তোর কচি মেয়ের নমুনা? তোরা তো বোধহয় সেইম এইজ। ‘
মাহতিম আড়চোখে প্রিয়ন্তির দিকে তাকাল। প্রিয়ন্তি রাগে কেমন ফুসছে। নাক কাপছে তার। মাহতিম ইশার কাধ চেপে ধরে বলল,
‘ আমার বউ আমার কাছে বুড়ো হয়ে গেলেও কচিই থাকবে। এখন এসব বলে আমার বউর মাথা খাস না। নাহলে আজকে আর বেডে জায়গা হবে না। চুপ থাক। ‘
ইশা মাহতিমের কানের কাছে এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘ এই তো শুরু বস। আরো কত কিছু যে তোর বউর কাছে ফাঁস করব। জাস্ট দেখে যা। ‘
মাহতিম নিজেও ফিসফিস করে বলল,
‘ তোর বয়ফ্রেন্ডের নাম্বারের লাস্ট চারটা ডিজিট কিন্তু ৯৯৮৭! সো…’
ইশা কানে ধরে হেসে বলল, ‘ আর বলিস না। আমি বুঝে গেছি। ‘
মাহতিম চোখ দিয়ে শাসিয়ে বলে, ‘ মনে থাকে যেন। ‘
ইশা হেসে উঠে সশব্দে। ইশার হাসির দিকে চেয়ে মাহতিম নিজেও হেসে উঠে। তাদের দুজনের ফিসফিস করে কথা বলা কিছুই প্রিয়ন্তি শুনেনি। শুধু দেখে গেছে তার বর ঘেঁষাঘেঁষি করছে আরেকটা মেয়ের সঙ্গে। এটা দেখেই প্রিয়ন্তির মাথার রক্ত গরম হয়ে গেল। তবুও ভদ্রতা বজায় রাখতে বেশি হেসে হেসেই ইশার সঙ্গে কথা বলল প্রিয়ন্তি।
সারা দুপুর, এমনকি রাত বারোটা অব্দি মাহতিমকে কাছে পেল না প্রিয়ন্তি। মাহতিম ও ইশা দুইজন মিলে গল্প আর হাসাহাসি করতে করতে পুরো ঘর মাথায় তুলে ফেলছে। প্রিয়ন্তি একবার না পেরে গিয়ে মাহতিমকে জিজ্ঞেস করেছে ঘুমানোর কথা। মাহতিম যেন এই কথা কানেই তুললো না। ইশাকে পেয়ে দিন দুনিয়া যেন ভুলে খেয়ে ফেলেছে সে। প্রিয়ন্তি রুমে এসে রাগে দুঃখে রীতিমত কেঁদে ফেলেছে। চুল খামচে ধরে বিছানার উপর বসে আছে। প্রিয়ন্তির এই জ্বলন প্রিয়ন্তিকে বুঝিয়ে দিয়ে গেল, প্রিয়ন্তি না চাইতেও ভালোবেসে ফেলেছে এই বেয়াদব, পাগলাটে মাহতিমকে। এখন ভালোবেসেই বা কি লাভ? মাহতিমের ভালোবাসা তো ফুরিয়ে গেছে। প্রিয়ন্তির সবকিছু কেমন অসহ্য লাগতে শুরু হল। ইচ্ছে করছে, এক্ষুনি ইশার থেকে মাহতিম টেনে এনে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে ফেলতে। কিন্তু এটা অভদ্রতা হয়। তাই প্রিয়ন্তি দাতে দাঁত চেপে রুম থেকে দুজনের হাসাহাসির শব্দে রাগে ফাটতে লাগল।
#প্রিয়ন্তিকা
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#শেষ_পর্ব
রাত তখন প্রায় একটা। ইশাকে শুয়ে পরতে বলে মাহতিম নিজের রুমের দিকে এগুয়। তার চোখেও ঘুম। অনেক আগেই মাহতিম চেয়েছিল নিজের রুমে চলে আসতে। কিন্তু ইচ্ছে করেই আসেনি। তার কারণ একমাত্র প্রিয়ন্তি। প্রিয়ন্তির সংস্পর্শ আজকাল মাহতিমের চরিত্র নষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগেছে। নানাবাহানায় প্রিয়ন্তিকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে তার। বিয়ের আগে বৈধতার বাহানা দেখিয়ে প্রিয়ন্তিকে স্পর্শ করত না। কিন্তু এখন প্রিয়ন্তি তার জন্যে বৈধ, সে প্রিয়ন্তির জন্যে বৈধ। এই বৈধতাই যেন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে মাহতিমের জন্য। নিজেকে অনেক কষ্ট করে মাহতিম সংযত করে রেখেছে।
মাহতিম নিজের ঘরে এসে দেখে প্রিয়ন্তি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। বারবার হাত উঁচু করে চোখের জল মুছছে। ঠান্ডায় পিঠ কাপছে। মেয়েটার কি আদৌ কখনো বুদ্ধি হবে না? এই কনকনে ঠান্ডায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাতাস খাচ্ছে। এতটা কাণ্ডজ্ঞানহীন কবে থেকে হয়ে গেল তার বুঝদার প্রিয়ন্তিকা। মাহতিম আলমারি থেকে একটা শাল বের করে বারান্দায় গেল। পেছন থেকে প্রিয়ন্তির গায়ে শাল জড়িয়ে দিতেই প্রিয়ন্তি চমকে উঠল। পেছন ফেরে মাহতিমের দিকে তাকাল। প্রিয়ন্তির ভেজা চোখ দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল মাহতিম। কেঁদেকেঁদে এ কি অবস্থা করেছে নিজের চেহারার? মাহতিম দ্রুত এগিয়ে যায়। প্রিয়ন্তির নরম গাল দুহাতের আজলায় তুলে নিয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে বলে,
‘ আল্লাহ! কী হয়েছে প্রিয়ন্তিকা? এমনভাবে কাদছ কেন? কেউ কিছু বলেছে? তোমার চোখ দেখে তো আমারই ভয় লাগছে! কী হয়েছে বলো আমাকে। ‘
প্রিয়ন্তি নিজের গাল মাহতিমের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। আবারো সামনে ফেরে দায়ছাড়া ভাবে বলে,
‘ কিচ্ছু হয়নি। আর কিচ্ছু হবেও না। আমি কালকেই বাবার বাড়ি চলে যাব। থাকব না আর এখানে। আমার ভালো লাগছে না। একটুও ভালো লাগছে না এখানে থাকতে। সবকিছু অসহ্য লাগছে। ‘
মাহতিম এসব কথা শোনার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। হঠাৎ করে আজকে প্রিয়ন্তির এমন অদ্ভুত ব্যবহারের সঙ্গে সে একটুও পরিচিত নয়। মাহতিন প্রিয়ন্তির হাত ধর হেচকা টান দেয়। প্রিয়ন্তি টাল সামলাতে না পেরে সোজা মাহতিমের বুকের উপর এসে পরে। প্রিয়ন্তির ঘন চুল ছড়িয়ে লেপ্টে যায় মাহতিমের বুকের উপর। মাহতিম খুব আলগোছে প্রিয়ন্তির চুল গুছিয়ে দিয়ে গলার স্বর নরম করে জিজ্ঞেস করে,
‘ কেউ কিছু বলেছে আমার প্রিয়ন্তিকাকে? আম্মা কিছু বলেছে? বা আব্বু? ওরা কিছু বলে থাকলে ওদের হয়ে আমি মাফ চাইছি। তবুও বাবার বাড়ি যাবার কথা বলো না। এ কদিন তুমি আমার অভ্যাস হয়ে গেছো, জানো না? ‘
প্রিয়ন্তি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারে না। মাহতিমের বুকের উপর মাথা রেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। মাহতিম আচমকা এমন শব্দ কান্নায় হকচকিয়ে যায়। আজ এই প্রথমবার প্রিয়ন্তিকে এমনভাবে কাদতে দেখছে মাহতিম। প্রিয়ন্তি মাহতিমের বুকের শার্ট দুই আঙ্গুলের মুঠোয় পুড়ে নিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। থামছে না একদম। মাহতিম কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। আর নাইবা প্রিয়ন্তি নিজে থেকে কিছু বলছে।
মাহতিম কাপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘ তুমি এভাবে কাদছ কেন প্রিয়ন্তিকা? আমার তোমার কান্না দেখে বুকের ভেতর কেমন যেন লাগছে। এভাবে কেঁদো না প্লিজ। থামো এবার। ‘
প্রিয়ন্তি এবার কিছুটা সরে দাঁড়ায়। দুহাতে চোখ মুছে। আবারো ভরে যায় চোখের ভেতর। মাহতিম এখনো অবাক চোখে চেয়ে আছে প্রিয়ন্তির দিকে। প্রিয়ন্তির এমন কান্না দেখে সে নিজেও বিচলিত। প্রিয়ন্তি কিছুক্ষণ মাহতিমকে দেখে। তারপর হঠাৎ করেই প্রিয়ন্তি মাহতিমের কলার চেপে ধরে তাকে নিজের দিকে টেনে নিল। মাহতিমের চোখে বিস্ময়। প্রিয়ন্তি নত হয়ে আবারও নিশব্দে কেঁদে উঠে। মাহতিম হতভম্ব হয় প্রিয়ন্তির কান্নায়। প্রিয়ন্তি আচমকা পায়ের পাতার উপর ভর করে মাহতিমের গলা জড়িয়ে তার কাধে মুখ গুঁজে দেয়। এখনো কেঁদেই যাচ্ছে। কাদতে কাদতে হাপাচ্ছে সে। মাহতিম এখন অবাকে কথা বলাই ভুলে গেছে। এ কি করছে প্রিয়ন্তিকা? মাহতিমের লোমে লোমে যে কাপন ধরিয়ে দিল। এবার কি করে সামলাবে মাহতিম নিজেকে। প্রিয়ন্তি এখনো তার গায়ের সঙ্গে লেপ্টে মিশে। প্রিয়ন্তি মাহতিমকে আরো একটু জোড়ে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ আমি তোমাকে ভালবাসিনি বলে ওই মেয়ের কাছে চলে যাবে? খারাপ লোক। এতদিন আমার পেছনে ভালোবাসি ভালোবাসি বলে ঘুরঘুর করেছ। আর এখন আমি তোমাকে ভালো….! ‘
প্রিয়ন্তি আবারও লম্বা করে নিঃশ্বাস নেয়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও বলে,
‘ ওই মেয়ে কেউ না তোমার। আমি তোমার সব, সব আমি। ওই মেয়ে তোমার কাছে কেন ঘেঁষবে? আমার বরের কাছে রাতভর ঘেঁষাঘেঁষি করার অনুমতি আমি তাকে মোটেও দেইনি। তুমি..তুমি যদি আর ওই মেয়ের কাছে গেছো, আমি তোমার বুক কেটে কুচিকুচি করে ফেলব।’
মাহতিম এবার মৃদু হাসে। সে যা শুনতে চাইছে প্রিয়ন্তি তাই বলছে আজ। সুখের আকাশে মাহতিম যেন উড়ে বেড়াচ্ছে। মাহতিম প্রিয়ন্তির কোমরে হাত রেখে ওকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলল। প্রিয়ন্তি আরো গভীরভাবে লেপ্টে গেল মাহতিমের দেহের সঙ্গে। মাহতিম ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে
‘ ভালোবাসো আমায়? যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তবে ওর কাছে আর যাব না, প্রমিজ। ‘
প্রিয়ন্তি মাথা তুলে একবার মাহতিমের দিকে তাকায়। চোখ পিটপিট করে মাহতিমকে দেখে। ঢোক গিলে আবারও মাহতিমের ঘাড়ে মুখ গুঁজে দেয়। হাপিয়ে উঠে বলে,
‘ ভালো না বাসলে আজ ওই মেয়ের কাছে যাওয়া নিয়ে এতোটা পুড়তাম না। নিজে জোর করে প্রেমে ফেলে এখন আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছ। খারাপ লোক। আজ সারাদিন আমি অপেক্ষায় ছিলাম তোমার জন্য। অথচ ওই মেয়ে ছাড়া আজকাল তোমার চোখে তো কিছুই পরে না। ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে, না? ‘
মাহতিম হাসে। হাসতে হাসতে তার চোখ পানি চলে আসে। নিজের হাসি সামলে প্রিয়ন্তিকে আরো জোড়ে জড়িয়ে ধরে। প্রিয়ন্তির ঘাড়ে চুমু খেয়ে বলে,
‘ ভালোবাসা ফুরায় নি। শুধু ভালোবাসাটা যেন তোমার মনে ক্ষত তৈরি না করে সেইজন্যেই দূরে দূরে ছিলাম। ‘
প্রিয়ন্তি বুঝতে পারে না মাহতিমের কথা। ঘাড় থেকে মুখ তুলে মাহতিমের দিকে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,
‘ ক্ষত বলতে? ‘
মাহতিম প্রিয়ন্তির ডান গালে হাত রেখে নরম কণ্ঠে বলে,
‘ ভালোবাসাটা প্রথমে মনের দিক থেকে শুরু হলেও, ধীরে ধীরে সেটা শরীরের সঙ্গেও জড়িয়ে যায়। এটাই বাস্তব। কেউ অস্বীকার করতে পারবে না এটা। বিয়ের আগে নিজেকে বাঁধা দিলেও, বিয়ের পর আর সেই বাঁধা মন মানতে চায়না। তোমাকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলতে মন চাইত মাঝেমধ্যে। কিন্তু তুমি তো ভালোবাসো নি আমায়। তোমার মন না পেয়ে শরীর পাওয়ার স্পর্ধা কি করে করতাম? তাই তোমার মনে ক্ষত তৈরি না করার আগেই সরে গেলাম। সামান্য দুরত্ব যদি তোমাকে আমার করে দেয়, বিশ্বাস করো প্রিয়ন্তিকা এমন দুরত্ব আমি সারাজীবন চাইব। ‘
প্রিয়ন্তি মাহতিমের কথা শুনে মুগ্ধ হয়। একটা মানুষের মনের ভাবনা এতোটা পবিত্র কি করে হতে পারে? প্রিয়ন্তি মৃদু হাসে। মাহতিম প্রিয়ন্তির কপালে চুমু খায়। অনেক সময় ধরে ঠোঁট চেপে রাখে প্রিয়ন্তির কপালে। যেন হাজার বছরের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে মাহতিম। প্রিয়ন্তি মাহতিমের স্পর্শ উপভোগ করে। চোখ বুঁজে খামচে ধরে মাহতিমের কাধের টিশার্ট। মাহতিম সরে আসে। প্রিয়ন্তির দিকে চেয়ে বলে,
‘ ঘুমাবে না? ‘
প্রিয়ন্তি এখনো চোখ বুজে আছে। মাহতিমের কথা শুনে প্রিয়ন্তি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়। পরপরই লজ্জায় হাসফাস করে উঠে। প্রিয়ন্তি মাহতিমের ঘাড়ের দিকে চোখ রেখে মৃদু স্বরে বলে,
‘ শ-শুনো, স-স্পর্ধাটা করে ফ-ফেললে আমি এখন মোটেও কষ্ট পাব না। ‘
মাহতিম চমকে উঠে। প্রিয়ন্তির দিকে বিষ্ময় নিয়ে তাকায়। কম্পিত কণ্ঠে বলে,
‘ আ-আর ই-ইউ শ-শিউর, প্রিয়ন্তিকা?
প্রিয়ন্তি চোখ বুজে মাথা দুলায়। লজ্জায় আর চোখ তুলে তাকাতে পারে না। মাহতিম এই প্রথম প্রিয়ন্তির লজ্জা পাওয়া মুখ দেখে নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে পরে। ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় প্রিয়ন্তির দিকে। মাহতিমের নেশা দৃষ্টি প্রিয়ন্তির তিরতির করে কাপা ঠোঁটের দিকে। প্রিয়ন্তি মাহতিমকে এগুতে দেখে আগেই চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। মাহতিম এবার নিজেকে আর আটকাতে পারে না। ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে
প্রিয়ন্তির কোমড় চেপে নিজের সঙ্গে আরও গভীর ভাবে মিশিয়ে ফেলল।
বেশ সময় নিয়ে শান্ত হয় মাহতিম। প্রিয়ন্তিকে ছেড়ে এক ঝটকায় ওকে কোলে তুলে নেয়। প্রিয়ন্তির চোখ মাহতিমের চোখের দিকে। মাহতিম সম্মোহনের ন্যায় প্রিয়ন্তির দিকে চেয়ে আছে। প্রিয়ন্তিকে ধীরে বিছানায় শুইয়ে দেয়। প্রিয়ন্তির কপালে আবারও চুমু খায় মাহতিম। তারপর পুরো মুখে চুমু খেয়ে নিজে এতদিনের তৃষ্ণা মেটায়। অতঃপর নেমে আসে গলায়। প্রিয়ন্তির গলায় অসংখ্য চুমুতে ভরিয়ে দেয়। প্রিয়ন্তি বেপরোয়া মাহতিমের বেপরোয়া ভালোবাসা অনুভব করে শিউরে উঠে। খামচে ধরে মাহতিমের ঘাড়। বাতি নিভে যায়। শাড়ির আঁচল সরে যায়। জানালার পর্দা ডিঙিয়ে শীতল বাতাস ছুঁইয়ে যায় এই যুগলের দেহ। প্রথমবারের মত মাহতিম উন্মাদের মত উপভোগ করে প্রিয়ন্তির দেহের উষ্ণতা, দেহের আনাচে কানাচে থাকা ভাঁজ। নিজেকে এই মুহূর্তে সবচেয়ে ভাগ্যবান পুরুষ মনে হচ্ছে মাহতিমের।
___________________________
ভালোবাসা-বাসিতে কেটে যায় আরো কটা দিন। দুজনের মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন আরো শক্ত হয়েছে। ধীরে ধীরে মাহতিম আরো গভীরভাবে প্রিয়ন্তিকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়েছে। এখন প্রিয়ন্তি চাইলেও মাহতিমকে ছেড়ে যেতে পারবে না। দুজন যেন দুজনের অস্তিত্বে পরিনত হয়েছে।
মাহতিম সবে অফিস থেকে ফিরেছে। ছেলেটা বিয়ের পর যেন আরো দায়িত্ত্বশীল হয়ে উঠেছে। দক্ষ হাতে সংসার সামলে বাইরেরটাও সামলায়। কে বলবে একদিন এই বেপরোয়া মাহতিমকে নিয়ে প্রিয়ন্তি কি অবাস্তব চিন্তাই না করেছে। এখন এসব ভাবলে হাসি পায় প্রিয়ন্তির। আজকে প্রিয়ন্তি একটা খুশির খবর পেয়েছে। এতেই মেয়েটা ক্ষণে ক্ষণে কেমন খুশিতে ঝলমল করে উঠছে। মাহতিম বাসায় আসতেই তাকে নয়না খাইয়ে দিয়ে রুমে পাঠিয়ে দিল। প্রিয়ন্তিকে আসার পর থেকে এখনো চোখের দেখা দেখেনি মাহতিম। সে এইজন্যে মনেমনে কিছুটা রেগে আছে। কতবার বলেছে সে প্রিয়ন্তিকে, বাসায় এলে যেন সবার আগে প্রিয়ন্তি তার সামনে এসে দাঁড়ায়। পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। এতদিন তাই করে এসেছে প্রিয়ন্তি। কিন্তু আজকে আসার পর থেকে প্রিয়ন্তিকে দূরবীন দিয়েও খুঁজে পাচ্ছে না মাহতিম। এই মেয়ে একদিন পাগল করে দেবে মাহতিমকে।
মাহতিম ঘরে আসতেই চমকে যায়। ঘরের মধ্যে অসংখ্য মোমবাতি জ্বালানো। এনার্জি বাতি নেভানো ঘরে মোমবাতির আলো বড্ড আকর্ষণীয় লাগছে। মাহতিম সম্মোহনের ন্যায় এগিয়ে যায়। অফিসের ব্যাগ কাধ থেকে নামিয়ে ড্রয়ারের উপর রাখে। চারপাশে খুঁজে নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষকে। পেয়েও যায় বারান্দায়। সে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে যায় সেদিকে। শাড়ি পড়া প্রিয়ন্তিকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরে মাহতিম। প্রিয়ন্তি একটুও অবাক হয়না। খুব করে চেনে প্রিয় মানুষের স্পর্শ। প্রিয়ন্তি পেটের উপর থাকা মাহতিমের হাতের উপর হাত রাখে। মাহতিমের বুকের উপর মাথা হেলিয়ে বলে,
‘ একটা সুখবর, আরেকটা খারাপ খবর আছে। কোনটা শুনবে? ‘
মাহতিম প্রিয়ন্তির ঘাড়ের মধ্য ঠোঁটের স্পর্শ দিতে দিতে বলে,
‘ সুখবরটা আগে বলো। ‘
প্রিয়ন্তি পেটের উপর থাকা মাহতিমের হাত পেটের উপর আরেকটু চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে বলে,
‘ বাবা হচ্ছ, মিস্টার বেপরোয়া মাহতিম ইয়ান। ‘
মাহতিম চমকে যায়। ঝট করে সরে যায় প্রিয়ন্তির থেকে। হা করে চেয়ে থাকে প্রিয়ন্তির পেটের দিকে। প্রিয়ন্তি খিলখিল করে হেসে উঠে মাহতিমের এমন চেহারা দেখে। মাহতিম এখনো হা হয়ে আছে। একটু পর নিজেকে সামলে মাহতিম জিজ্ঞেস করে,
‘ ম-মজা করছ? নাকি সত্যি সত্যি? ‘
প্রিয়ন্তি কিছু বলে না। রুমের দিকে এগিয়ে যায়। আলমারি থেকে প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট বের করে মাহতিমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
‘ নিজেই দেখে নাও, সত্যি নাকি মিথ্যা। ‘
মাহতিম রিপোর্ট আগাগোড়া দেখে। প্রিয়ন্তি লক্ষ্য করে, মাহতিমের হাত কাপছে। বুকের উঠানামা বেড়ে গেছে তার। প্রিয়ন্তি মৃদু হাসে। মাহতিম রিপোর্ট পড়ে এবার যেন কথা বলাই বন্ধ করে ফেলে। প্রিয়ন্তির দিকে আনমনে চেয়ে থাকে। অতঃপর হঠাৎ করে দ্রুত এগিয়ে এসে প্রিয়ন্তিকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মুখ গুঁজে দেয়। প্রিয়ন্তি আচমকা আক্রমনে দু কদম পিছিয়ে যায়। পরপরই নিজেকে সামলে মাহতিমের পিঠের উপর হাত রাখে। হঠাৎ প্রিয়ন্তি অনুভব করে নিজে ঘাড়ে গরম জলের স্পর্শ। প্রিয়ন্তি বুঝতে পারে, অতি সুখে মাহতিম কাদছে। প্রিয়ন্তি হেসে উঠে। পাগল একটা!
মাহতিম সরে আসে বেশ সময় পর। চোখের জল মুছে জিজ্ঞেস করে,
‘ ক মাস হল সে এসেছে? ‘
প্রিয়ন্তি আঙুল দিয়ে দেখায়, ‘ দুই মাস। ‘
মাহতিম ভেজা চোখে হেসে ফেলে। প্রিয়ন্তির কপালে চুমু দিয়ে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘ থ্যাংক ইউ, জান। থ্যাংক ইউ সো মাচ। খুব খুশি আমি। খুব বেশি খুশি আজকে আমি। ‘
প্রিয়ন্তি রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে মাহতিম জড়িয়ে রেখেছে তাকে। দুজন বাইরের শীতল বাতাস উপভোগ করছে। মাহতিম একসময় বলল,
‘ সেদিন অনুরাগকে তোমাকে কেড়ে নেবার ভয় না দেখালে, হয়ত আমার ভেতর কখনোই তোমাকে নিজের করার জেদ চাপত না। তুমি সারাজীবন আমাকে এভাবেই অবহেলা করতে। আর আমি এভাবেই তোমার পিছু ঘুরঘুর করে বেড়াতাম। অন্যরকম হত তখন আমাদের জীবন, তাইনা? ‘
প্রিয়ন্তি মৃদু হাসে। মাহতিমের বুকে উপর মাথা চেপে হেলায়। শান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
‘ আমার কপালে তুমি ছিলেই। তাই এত বাধা পেরিয়েও আজ আমরা একসঙ্গে। এটা হবারই ছিল। আমাদের ভাগ্যে এটাই লেখা ছিল। ‘
মাহতিম একসময় বলে,
‘ অনুরাগের খবর জানো? ‘
প্রিয়ন্তি দায়ছাড়া ভাবে উত্তর দেয়,
‘ না, আমার জানার কথা নাকি? ‘
মাহতিম টিপ্পনী কেটে বলল,
‘ যেভাবে আগে সারাক্ষণ অনুরাগ অনুরাগ করতে। এখন ও কোথায় জানো না? ‘
প্রিয়ন্তি রেগে যায়। মাহতিমের বুকের শার্ট খামচে ধরে হিড়হিড় করে বলে,
‘ মেরে ফেলব কিন্তু। কোনো খোঁচা দিয়ে কথা বলবে না। ও আমার লাইফে কখনো ছিলোই না। আমার লাইফে একমাত্র সত্য, তুমি আর আমাদের অনাগত সন্তান। আর কিচ্ছু না। ‘
মাহতিম হো হো করে হেসে উঠে। প্রিয়ন্তির কপালে চুমু খেয়ে মিষ্টি হেসে বলে,
‘ জানি আমি। ভালোবাসি, খুব খুব খুব বেশি। ‘
প্রিয়ন্তি মাহতিমের বুকে মাথা রেখে মৃদু স্বরে বলে,
‘ আমিও। ‘
‘ কি আমিও? ‘
‘ ভালোবাসি। তোমার মত নয়। তবে একটু আকটু। ‘
‘ একটু আকটু? ‘
প্রিয়ন্তি লজ্জা পেয়ে যায়। মাহতিমের বুকের মধ্যে মুখ ঘষে বলে,
‘ একটু আকটু থেকেও বেশি, অনেক বেশি। ‘
মাহতিম হেসে উঠে। আরো গভীর ভাবে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নেয় তার প্রিয়ন্তিকাকে। তার প্রিয়ন্তিকা, শখের প্রিয়ন্তিকা, হাজার বছরের সাধনার প্রিয়ন্তিকা, অনেক কষ্টের ফল প্রিয়ন্তিকা, তার একমাত্র দোয়া প্রিয়ন্তিকা।
#সমাপ্ত