প্রিয় তুই পর্ব -১১

#প্রিয়_তুই
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_১১

”কে করেছে, তুই?”
-”উহুম, ভোর নিজেই।”
-”তুই কিভাবে জানলি? তারমানে তুইও এর সঙ্গে জড়িত?”
-”না হয়ে আর উপায় আছে? ভালোবাসার মানুষের আবদার বলে কথা।”

আয়মানের কথা শুনে তিতাস শব্দ করে হেসে উঠল। হাসির চোটে কয়েক মিনিট কথায় বলতে পারল না। এমনকি তার হাতের আইসক্রিমটাও মাটিতে পড়ে লুটোপুটি খেলো। অন্য এক হাত কোমরে রেখে সে শরীর দুলিয়ে হাসছে। ওর হাসির শব্দে কয়েকজন পথচারীও যেতে যেতে তাকাচ্ছে। আয়মান ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে বিরক্ত মুখে ওর হাসি দেখছে। ছেলেটাকে এজন্যই ওর এত অপছন্দ। এভাবে হাসার মানে হয়, হাসির কথা বলে নি নিশ্চয়ই! তখন তিতাস বাম হাতের উল্টো পিঠে মুখ মুছে পুনরায় হাসতে লাগল। কেন জানি হাসি থামাতেই পারছে না সে। আয়মানের দিকে তাকালে ওর হাসির মাত্রা
দ্বিগুন বেড়ে যাচ্ছে। তবুও অনেক কষ্ট হাসি থামিয়ে বলল,

-”তুই ভোরের উপর নজর রাখিস আড়ালে লুকিয়ে থেকে। আর আমি সর্বদা, সর্বক্ষণ, তার সঙ্গে থেকে খেয়াল রাখি।
সত্যি বলতে, ভোরের আপাদমস্তক পড়া আমার শেষ। তার দৌড় কতদূর আমার অজানা নয়। তাই ভাওতাবাজির গল্প অন্য কাউকে গিয়ে শোনা। তবে হ্যাঁ, যদি আমি জানতে পারি এসবের পেছনের তুই আছিস। তখন খেল কাকে বলে তাইই দেখবি।”

-”ওরে বাবা তাই নাকি? ভয় পাচ্ছি, কেউ বাঁচাও আমাকে।”

আয়মান অভিনয় করে একথা বলে স্বজোরে হেসে উঠল।
পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার কারণে একটু রাগও হলো। তবে ভোরের প্রতি তিতাসের অগাধ বিশ্বাস দেখে মজায় লাগল।
এমন বিশ্বাস ভাংতে তার ভালোই লাগবে। তিতাসকে এভাবে কাবু করতে না পেরে আয়মান অন্য কথার সুর টানল। বাঁকা হেসে অবজ্ঞার সুরে বলল,

-”তুই তো সারার ছোট ভাই তাই না? যে প্রায় সময় ছেলেদের সঙ্গে বেড শেয়ার করে ফূ/র্তি করে বেড়ায়।”
-”না আমার কোনো বোন নেই। আমরা দুই ভাই পিয়াস আর তিতাস।”
-”হা হা হা, তোদের মরে যাওয়া উচিত। এই মুখ নিয়ে সমাজে চলিস লজ্জা লাগে না?”
-”উহুম, লজ্জা লাগবে কেন? বরং গর্বে বুক ফুলে উঠে। ”
-”গন্ডারের চামড়া হলে যা হয় আর কি।”
-”ভেবে কথা বলিস নয়তো পেরে পস্তাবে হবে।”
-”ওহো তাই বুঝি? তবে যার বোন বে** তার মুখে এসব কথা মানায় না। গায়ে মানে না আপনি মোড়ল, হা হা।”

একথা শুনে তিতাসের মুখভঙ্গি বদলে গেল। রাগে ওর শরীর শিরশির করে উঠল। মস্তিষ্ক সায় দিলো কিছু একটা করার।
তিতাস আয়মানকে স্বজোরে ঘুষি মারার সংকল্প করল,ঠিক তখনই ভোরের ডাক শোনা গেল। তিতাস ফিরে দেখে জ্যাম ছুটে গেছে।গাড়িগুলো নিজস্ব পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। ভোর হাত বাড়িয়ে ওদেরকে ডাকছে। আর ওর গাড়িটার পেছনের গাড়িগুলো হর্ণ বাজিয়ে গাড়ি সরাতে বলছে। ট্রাফিক পুলিশ বাঁশি বাজাচ্ছেন একে একে যাওয়ার জন্য। তিতাস আর না দাঁড়িয়ে দৌড়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও পুনরায় সে ফিরে এলো। তারপর ঝটপট আয়মানকে জড়িয়ে ধরে তার পিঠে
স্বজোরে এক কিল বসিয়ে দিলো। অতঃপর মুখভর্তি হাসি নিয়ে ভালো থাকতে বলে দৌড়ে চলে গেল। ঘটনা তড়িঘড়ি ঘটাতে আয়মান কিছুই বুঝল না। তবে পরক্ষণেই পিঠে ব্যথা অনুভব করাতে নাকটা চেপে নিঃশ্বাস আঁটকে দাঁড়িয়ে রইল। প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছে সে।তিতাস গিয়ে বসলে ড্রাইভার বাসার পথ ধরে গাড়ি এগোলেন। শাঁ শাঁ শব্দে গাড়িও চলতে থাকল আপন গতিতে। বাইরের ঠান্ডা বাতাসে শরীরখানাও জুড়িয়ে
এলো। দেহের একরাশ ক্লান্তি লেজ গুটিয়ে পালালো। একটু
পর, ভোর তিতাসের দিকে তাকিয়ে দেখে তিতাসের নির্লিপ্ত দৃষ্টি বাইরের দিকে। মলিন মুখ। ভোর বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।

তিতাস তখনো ভাবনায় মগ্ন। ওর ঠোঁটে নেই দুষ্টু হাসির রেশ।
যার বোন এত নোং/রা তার মুখে হাসি না থাকায় স্বাভাবিক। পিয়াস মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছে। অথচ সে বেঁচে থেকে একটু একটু করে প্রতিনিয়ত ম/র/ছে। তার এ মৃ/ত্যু/র আয়োজন নেই এজন্যই কেউ বোঝে না, দেখে না। শুধু আয়মানই নয়, তাকে আল্লাহর ত্রিশটা দিনই কেউ না কেউ সারার নামে এই কথা বলবেই বলবে। মানুষের আর দোষ কী, সে যেসব করে মানুষ তো তাইই বলে।পূর্বের নম্র ভদ্র সারা এখন প/তি/তা/।
যাকে টাকার বিনিময়ে দেহের খায়েস মিটাতে ব্যবহার করা হয়।একপ্রকার জেদ ধরেই সারা নিজের জীবন নষ্ট করেছে। উচ্চবিত্ত পরিবারে বিয়ে হয়েছিল তার। তবে বিয়ের ছয়মাস পরেই জানা যায়, তার স্বামী তাকে জোরপূর্বক অন্যের বেডে যাওয়ার জন্য মা/র/ধো/র করে। নানান ভাবে অ/ত্যা/চা/র করে। শুধুমাত্র নিজের ব্যবসার লাভের স্বার্থে। সারা আর না সহ্য করতে পেরে সবাইকে জানিয়ে দেয়।তারপর জানাজানি হলে পিয়াস কোনোভাবেই তাকে শশুড়বাড়ি যেতে দেয় না। নিজ দায়িত্বে তার ডিবোর্স করায়। এবং সারার সকল দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিয়ে জুবায়ের নামে কেস ফাইল করে। তাতে
সারার স্বামী জুবায়ের প্রচন্ড রেগেও যায়। এবং সারার সঙ্গে অন্যের অ/ন্ত/র/ঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও সোস্যাল সাইটের ছেড়ে দেয়। মিনিটেই সেটা ভাইরাল হয়ে যায়। পাড়া-পড়শীরাসহ ওদের নিকট আত্মীয়রাও কথা শোনাতে থাকে। নানানভাবে কুৎসা রটাতে থাকে। যা ঘটে নি তাই নিয়েও বদনাম করতে থাকে। তারপর থেকে সারা কোথাও বের হতো না, এমনকি অসুস্থতার কারণে হসপিটালেও না। যদি বের হতোও, কেউ না কেউ কথা বলার অজুহাতে নোং/রা প্রস্তাব দিয়েই বসত।
এসব ঘটনার মধ্যে দিন কাটতে লাগল তবুও সুফল পাওয়া গেল না। ততদিনে সারার মনে জেদ চাপল, খারাপ না হয়ে যেহেতু তাকে সবাই খারাপ বানাচ্ছে। এবার সে খারাপ হয়ে দেখাবে। যে কাজের জন্য তাকে এবং তার পরিবারকে এত অপমান হতে হয়, এবার সেই কাজই করবে। তারপর হঠাৎ’ই সে বাসা থেকে চলে যায়। কোনোভাবেই তার হদিস মিলে না।
প্রায় ছয় মাস পর, তার খোঁজ হয় এবং ওর প/তি/তা বৃত্তির কাজ সর্ব সম্মুখে আসে।উচ্চবিত্ত শ্রেণীর লোকদের সঙ্গে ওর
উঠাবসা। নামীদামী হোটেলে প্রতিনিয়ত রাত্রি যাপনও করে।
নিজস্ব বিশাল বহুল বাড়িও বানিয়েছে। চলন বলনে ঠিঁকরে পড়ে আভিজাত্যের ছোঁয়া। আজকে প্রায় আটটা বছর হতে চলছে, সারার সঙ্গে ওদের কারোর যোগাযোগ নেই। দেখাও হয় না কতকাল। বাবা-মা তাকে মৃত ঘোষণা করেছেন। ধীরে ধীরে সারার সমস্ত জিনিস বাসা থেকে মুছেও ফেলা হয়েছে। ওর মা বাবা একটাই কথা, উনাদের মাত্র দুটো ছেলে। একটা মেয়ে ছিল, মারা গেছে।

তিতাস এসব ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে ভোরের পানে তাকাল।
মেয়েটা নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। বাবার মৃত্যুতে অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। তখন আয়মান ইচ্ছে করে তাদের মধ্যে নীরব যুদ্ধ বাঁধাতে চাচ্ছিল। যেন একে অপরের প্রতি সন্দেহ করে।
অথচ তাদের বিয়ের বয়স মাত্র একদিন। এর মধ্যে অশান্তির ডানা বাঁধাতে অনেকেই উঠে পড়ে লেগেছে। তিতাস ওর দৃষ্টি সরিয়ে পুনরায় বাইরে তাকাল। এই সমাজ কতটা নিষ্ঠুর,,সে সারার মাধ্যমে দেখেছে। নতুন সারার জন্ম হতে দিতে চায়নি সে। সারাও প্রথমে অবলা নারীই ছিল, ঠিক ভোরেরই মতো।
অথচ পরিস্থিতি সারা এবং তার চালচলনে ব্যাপক পরিবর্তন এনে দিলো। তার একটা ভুল সিদ্ধান্তই তাকে সকলের থেকে দূরে সরিয়ে দিলো। সে এখন সকলর চোখে প/তি/তা। অথচ
সে অস্বীকার করলেও, সারা তার বোন, একমাত্র বড় বোন।
সারার কথা ভেবে তিতাস ভোরকে বিধবা থাকতে দিতে চায় নি। নিকৃষ্ট কিছু হায়েনা তাকে ভালো থাকতে দিতোও না। সে
মানসিক ভারসাম্য হারাত নয়তো আ/ত্ম/হ/ত্যা/র পথ বেঁছে নিতো। যেটা সে একবার করেও দেখিয়েছে। এরচেয়ে যেটা করেছে, এটাও উত্তম। অন্তত সন্মান নিয়ে বেঁচে তো থাকুক।
তখন তিতাস আচমকা ভোরের কাঁধে মাথা রেখে বলল,

-”ভোর, শুনছেন?”
-”বল।”
-”আমি না কখনো চাইব না আমাদের মেয়ে হোক। আপনিও চায়বেন না, ঠিক আছে?”
-”কেন?”
-”মেয়েদেরকে আমার ভালো লাগে না।”
-”একটা মেয়ের কাঁধে মাথা রেখে একথা বলতে লজ্জা লাগছে না?”
-”আমি তো আমার সিনিয়র বউয়ের কাঁধে মাথা রেখেছি।”
-”তোর সিনিয়র বউ কী মেয়ে নয়?”
-”ওহ তাই তো।”

তিতাস জিহ্বাতে কামড় বসিয়ে বোকামার্কা হাসি দিলো। সে কথাটা এভাবে বলতে চায় নি। যেহেতু ভুল করে ফেলেছে সে কান ধরে সরি বলল। ভোর জবাবে কিছু বলল না। শুধু দৃষ্টি ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকাল। তখন তাদের গাড়ি বাসার গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। দু’জন বাসায় পৌঁছে সবার সঙ্গে কথা বলে ফ্রেশ হতে চলে গেল। তিতাস তড়িঘড়ি করে ফ্রেশ হয়ে নিজে ঝটপট কিছু খেয়ে ভোরের পেছনে লাগল। প্রচন্ড জ্বালাতন করে বকবক চালিয়ো ভোরকে অল্প কিছু খাইয়ে ছাড়ল। ভোর মুখে খাবার নিয়ে যখন নীরবে কাঁদছিল তখন তিতাস বলল,

-”আমরা দু’জন ছোট্র একটা বাসা বানাব। বাসার নাম দিবো সুখরাজ্য। তারপর আপনি আর আমি একটু একটু করে সুখ কুড়িয়ে সেখানে জমা রাখব। দু’জনে মিলে খুনসুটি, ঝগড়া,
মায়া, আর বিশ্বাস দিয়ে সুখরাজ্যটা শক্তকরে আবৃত করব।
তারপর আমাদের একটা ছেলে হবে। ঠিক আমার ভাইয়ার মতো।তখন নিয়ে আমরা সুখরাজ্যে সুখ বিলাশ করব, ঠিক আছে? এর আগে বা পরে আপনাকে ছাড়ছি না, ছাড়ব না।
এটাই আমার ওয়াদা, বুঝলেন?”

To be continue………….!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here