#প্রিয়_তুই
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_১৫
-“ইয়েস, আই এম।”
তিতাসের শান্ত কন্ঠে বলা কথাটা শুনে ভোর আর নিজেকে সামলাতে পারল না। শরীর কাঁপতে কাঁপতে সেখানেই বসে পড়ল। ওর মনে হচ্ছিল তিতাস মজা করছে। নয়তো জ্বরের ঘোরে ভুলভাল বকেছে। কিন্তু না সবটা সত্যি! সত্যি সত্যি সে মানুষ মেরেছে তাও নৃ/শং/স/ভাবে। এর দ্বারা স্পষ্ট হয়েছে,
নাহিদ এমন কিছুতে জড়িত যার জন্য তিতাস এই পদক্ষেপ নিয়েছে। নতুবা সে বা এমন করতে যাবে? তিতাস প্রান্তবন্ত ও চঞ্চল হলেও বিবেকহীন নয়। একারণে অনেকের কাছেই প্রিয় ব্যক্তি সে। এখন খুঁজে বের করতে হবে, কেন এমনটা করেছে সে?ভোর ঠান্ডা মস্তিষ্কে কিছু ভেবে নাহিদদের বাসায় প্রবেশ করল। নাহিদের মা ছেলের খাঁ/টি/য়া/র পাশে বসে চিৎকার করে কাঁদছেন।কেউ যেন উনার কলিজা ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। সন্তানটা তার বাবা-মায়ের কলিজায় হয়।এজন্য বুঝি
সন্তানের কিছু হলে বাবা-মা এতটা ব্যথিত হয়, ছটফট করে।ভোর তার দৃষ্টি সরিয়ে নাহিদের লা/শে/র দিকে তাকাল। ওর র/ক্ত/শূন্য দেহখানা সাদা কাপড়ে মুড়ানো। সে পূর্বের নাহিদ নেই, তার নামকরণ হচ্ছে লা/শ নামে। ভোর এখানে আসার পরে কানাঘুষায় শুনেছে, “তার শরীরে কোনো আঘাত নেই। শুধু কলিজা বের করে নিয়েছে। না জানি কোন পাষাণ্ড এই কাজ করেছে।”
শুধুমাত্র ভোর জানে কে এই কাজটা করেছে। আর করে সে নিজেও দেখতে এসেছে। কতটা নির্দয় হলে কেউ এমন কাজ করতে পারে। তবে এর হিসাব তাকে দিতেই হবে। ভোর আর একটু এগিয়ে দেখে, পিয়াসের বাকি বন্ধুরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে নীরবে অশ্রু ঝরাচ্ছে। প্রিয় বন্ধুর শোকে তারা কাতর। এখানে সবাই আছে শুধু পিয়াস আর নাহিদ অনুপস্থিত।ওরা আর ফিরবে না, আড্ডাও দিবে না। আর না হবে মজামাস্তির টূর। আর ভোর এদের সবাইকে চিনে, বিয়ের আসরে পিয়াস ওদের সবার সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। কত্ত মজা করেছিল সেদিন। ঠাট্টার ভিড়ে লজ্জায় গুটিয়েও ফেলেছিল নিজেকে। অথচ আজ সব এলোমেলো, অগোছালো।পিয়াস
নেই, তার সঙ্গে এখন স্বস্ত্বিও বিলীন। ওর বন্ধুদের মন ভালো নেই। আর আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যাওয়ার অবস্থাও তার নেই। মূলত তিতাস সেই অবস্থায় রাখে নি। এসব ভেবে যখন বাইরের দিকে পা বাড়াবে তখন এক পুরুষালি কন্ঠে একজন বলে উঠল,
-”দাঁড়ান ভাবি। আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।”
একথা শুনে ভোর পেছনে ফিরে দেখে পিয়াসের আরেক বন্ধু শাওন দাঁড়িয়ে। এখানে কেউ নেই। বাকিরা নিজ নিজ স্থানে বসে। তাই ভোর সালাম দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কি বলবে বুঝতে পারছে না সে। শাওন তখন দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে গলার স্বর নামিয়ে বলল,
-”তিতাসকে বোঝান ভাবি। ছেলেটা যা শুরু করেছে এমন চলতে থাকে আমিও তাকে বাঁচাতে পারব না। তিতাস রাগের বশে নাহিদকে এত নিষ্ঠুরভাবে মেরেছে। কেউ জানুক বা না
জানুক আমি জানি, নাহিদ পিয়াসের সঙ্গে অন্যায় করেছে।
তার আবদার ছিল নোংরা মনমানসিকতার।তারমানে এই না তিতাস তাকে মেরে ফেলবে। পাপের আরো অনেক সমাধান
আছে। ছেলেটা জেদ ধরে ইচ্ছে করে ক্যারিয়ার নষ্ট করছে। স্বেচ্ছায় অ/প/রা/ধীর তকমা শরীরে লেপ্টাতে চাচ্ছে। এমন করলে কীভাবে হবে? সে না ভাবছে নিজের কথা আর তার বাবা-মায়ের। আপনার কথা নাহয় বাদই দিলাম। তিতাসের সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যত। প্লিজ তাকে বোঝান ভাবি।”
-”নাহিদ পিয়াসের সঙ্গে কি অন্যায় করেছে?”
-”আপনাদের বিয়ের দিন রা..!”
ঠিক তখন তিতাস দুই পকেটে হাত গুঁজে শাওনের মুখোমুখি দাঁড়াল। চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর ঠোঁটের কোণে ফিচেল হাসি।
শাওন থেমে গেল। বাকি কথাটুকু শোনার জন্য ভোর উতলা হয়ে শাওনকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করল,
-”বলুন ভাইয়া, প্লিজ বলুন, এত লুকোচুরি ভালো লাগছে না।
আমি নিজেও স্বস্তি পাচ্ছি না। আসলে বিয়ের দিন কি এমন ঘটেছিল? বলুন, আমি জানতে চাই?”
-”আসলে আপনাদের জন্য সাজানো ফুলের বিছানায়..,।”
তিতাস এবার শাওনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াল। অর্থাৎ না জানাতে। সেটা দেখে ভোর প্রচন্ড রেগে গেল। তিতাসকে সরিয়ে শাওনকে অনুরোধ করতে লাগল সত্যিটা জানানোর।
তখন জা/না/যা/র জন্য পুরুষদের একত্রিত হওয়ার তাড়া দিলেন, নাহিদের চাচা। একে একে অনেকেই এগিয়ে যাচ্ছেন ক/ব/র স্থানের দিকে। শাওন হতাশার শ্বাস ফেলে কথা না বাড়িয়ে স্থান ত্যাগ করল। ভোরের হাকডাক শুনেও অগ্রাহ্য করল অতি সন্তর্পণে। বাসাভর্তি মানুষের কান্না রোলও বেড়ে গেল। সকল মায়া কাটিয়ে নাহিদকে নিয়ে যাওয়ার হলো ক/ব/র/স্থানের দারে। তিতাস ওর আম্মুর দিকে তাকিয়ে আছে।
উনি এমনভাবে কাঁদছেন যেন পিয়াসের পরে আজ তিতাসই
মারা গেছে। অথচ জানতেও পারলেন না যার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন, উনার ছোট ছেলেটাই এসবের জন্য দায়ী।
যদিও উনার কান্নার কারণ আছে। হয়তো পুরনো তিক্ত ব্যথা জাগ্রত হয়েছে। কষ্টেরা দলবদ্ধ হয়ে বুকে চেপে বসেছে। উনি মা, এই দিন উনাকেও দেখতে হয়েছে, নীরবে সহ্য করে নিতে হয়েছে। আর মা হয়ে সন্তানের মৃ/ত মুখ দেখার কষ্ট পৃথিবীর সব কষ্টকে বোধহয় হার মানায়। যেটা উনি বেশ গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। ধীরে ধীরে বাসা ফাঁকা হতে দেখে ভোর গিয়ে গাড়িতে উঠে বসল, ওর দেখে তিতাসও বসল। তারপর দু’জনে গাড়ি নিয়ে ছুটল অজানা পথের বাঁকে। নীরবতাকে সঙ্গী করে মৌনতা চলল দু’জনের মাঝে। গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে দূরন্ত গতিতে চলছে তাদের শুভ্র রংয়ের গাড়িটি। ভোর খুব ভেবে চিন্তেই বেরিয়ে এসেছে। সে ভেবে পাচ্ছে না, এটাই কী তার চেনা তিতাস? যাকে সে ইচ্ছে মতো পঁচাতো, রাগাত, হাসাত। আজ কেন তাকে এত অচেনা লাগছে? মনে হচ্ছে এ তিতাস অপরিচিত। যাকে সে কখনো চিনতো না, জানত না।
তিতাস পাশের সিটে বসে মনের সুখের শিষ বাজাচ্ছে। বউ ড্রাইভ করে নিয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা তার কাছে বেশ লাগছে।
কেমন বর বর অনুভূতি হচ্ছে তার। ভোর অনেক দূরে গিয়ে একটা বিলের পাশে গাড়িটা দাঁড় করাল। জায়গা খুব র্নিজন তবে বাতাস দেহ ও মন জুড়িয়ে দিচ্ছে। ভোর বেরিয়ে বিলের ধারে গিয়ে বসল। তিতাসও এসে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ওর শরীর ঘেষে বসে মুখভর্তি হাসি নিয়ে বলল,
-”বাহ্, জায়গাটা দারুণ তো, প্রেম করার জন্য পার্ফেক্ট। এই আমরা এখানে প্রেম করতে এসেছি?”
-” তোকে দশ মিনিট সময় দিলাম, এর মধ্যেই পুরো ঘটনাটা আমাকে বলবি। নয়তো আজ ভোরকে চিরতরে হারাবি।”
-”হারাতে দিলে তো হারাবেন, হা হা হা।”
-”আমার জীবন নিয়ে খেলার অধিকার তোর নেই। তাই ভেবে চিন্তে জবাব দে। এরপর হয়তো তোর সঙ্গে দেখাও হবে না কথা তো দূর।”
-”আপনার জীবন নিয়ে খেলছি না ভোর। আমি সবসময় আপনাকে বাঁচাতে চেয়েছি, চাচ্ছি।”
ভোর এবার তিতাসের চোখে চোখ রেখে অতি শান্ত কন্ঠে বলেছিল,
-”এটাকে বাঁচানো বলে? কিভাবে বলে, তুই বোঝা আমাকে? বোঝা! একজন মরে গিয়ে আমাকে আধমরা করে গিয়েছে।পুনরায় বিয়ে করে তুই আমাকে একেবারেই মারতে চাচ্ছিস,
প্রতিনিয়ত মানসিক চাপ সৃষ্টি করছিস। একটার পর একটা মিথ্যা সাজিয়ে বানোয়াট গল্প শুনাচ্ছিস। সংসার করবি না বলেই এমন রুপ দেখাচ্ছি? এখন ভালো লাগছেনা আমায়? নাকি বয়সে বড় বিধায় মহৎত্ব জাহির করা শেষে এখন ঘাড় থেকে নামাতে চাচ্ছিস? বল! জবাব দে!”
-”বা*, আবারো সেই একই কথা। বলেছি না এমন কথা না বলতে।”
তিতাসের জবাবে ভোর রেগে গেল। নিজেকে সামলে দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলো। তার রাগের মাত্রা এখন অত্যাধিক। ঠিক মনিহারা ফণীর ন্যায় ফসফস করছে সে। যেন এক্ষুণি দংশন করল বলে। যেটা তিতাসকে খুব মজা দিচ্ছে। তিতাস এমন সিরিয়াস মুহূর্তে হেসে তার ফর্সা গালে চুমু আঁকল। তারপর ভোরের নাকটা আলতো করে টেনে বলল,
-”সিনিয়র বউদের এত রাগতে নেই। কেন জানেন? কারণ বউদের রাগ দেখে জুনিয়র বররা কাজের তাল হারায়।তারা বউয়ের প্রতি পুনরায় প্রেমে পড়ে, মুগ্ধ হয়। যেমন এই আমি পূর্বেও হয়েছি, এখনো হচ্ছি।”
-”আম্মুদের নিয়ে বাসায় ফিরে যাস। আমি আমার পথ বেঁছে নিলাম। বেশি অপেক্ষা করাব না যত দ্রুত সম্ভব তালাকনামা পাঠিয়ে দিবো।”
একথা বলে ভোর চলে যেতে উদ্যত হলো। তখন তিতাস ওর বাহু ধরে টেনে ঘুরিয়ে গাল শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
-”এবার বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে ভোর।”
-”বাড়াবাড়ি হচ্ছে না, হবে। ছাড় আমাকে, তোর সঙ্গে আমি সংসার করব না।”
-”সংসার করলেন কবে হুম? হুমকি ধামকি আর মেরেই তো দিন পার করলেন। না স্পর্শ করতে দিয়েছেন না কাছে টেনে নিয়েছেন। যা বললেন পুনরায় উচ্চারণ করলে কিন্তু খবর আছে।”
-”যা পারিস করে নে। এটাই ফাইনাল আমি সংসার করব না, মানে করব না।”
-”ভোর প্লিজ আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙবেন না, নয়তো এর ফল ভুগতে হবে বলে দিলাম।”
-”ভুগতে রাজি তবুও সত্যিতা বল। নয়তো আমি সত্যি সত্যি যা বলেছি তাই করব।”
তিতাস ভোরকে ছেড়ে মাথাটা নাড়িয়ে এদিক ওদিক ঘুরাল।
না, এই মেয়ে মেজাজ রাখতে দিচ্ছে না। সে রাগতে সামলে রাখতে না পেরে বলেই ফেলল,
-”মন চাচ্ছে ওই লোভনীয় ঠোঁটজোড়া কামড়ে খেয়ে ফেলি। যেন ফালতু কথাবার্তা বলতে না পারেন। খুব জানার ইচ্ছে তাই না? ওকে, তবে আমাকে রাগানোর জন্য শাস্তি পেতেই হবে, রাজি আপনি?”
-”রাজি।”
এবার সে ভোরের চোখে চোখ রেখে আগুন ঝরা কন্ঠে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-”ওকে তবে তাই হোক। আমার মুখ খুলালেন তো ভুগতে তো হবেই। তাহলে মন, মস্তিক, কান, সজাগ রেখে শুনুন, বিয়ের দিন আপনার এবং ভাইয়ার জন্য ফুলে সাজানো রুমে ছোট ছোট আটটা ক্যামেরা লাগানো হয়েছিল। যাতে আপনাদের
অ/ন্ত/র/ঙ্গ মুহূর্তটা ক্যামেরায় ধারণ করা যায়। এখন কথা হচ্ছে, আপনারা সেদিনই ঘ/নি/ষ্ঠ হতেন এর গ্যারান্টি কী? ওর ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। জুসের বোতলে কড়া ডোজের মেডিসিন ব্যবহার করা হয়েছিল। যেটা রুমে ঢুকার আগেই আপনাদের খাওয়ানো হতো। দুঃভাগ্যবশত,সেটা আপনি বা ভাইয়া খাওয়ার আগে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আমি খেয়েছি। নাচানাচি হইহই করে তৃষ্ণার্ত আমি বুঝিনি ওটা ছিলো কারো পাঁতা ফাঁদ। ঢকঢক করে পুরো বোতল খালি করে আবারো মত্ত হয়েছিলাম নাচানাচিতে। এর কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারি আমার শরীরে নিষিদ্ধ অনুভূতির জানান দিচ্ছে। আর ধীরে ধীরে সেটা আমার কনট্রোলের বাইরে চলে যাচ্ছে। তারপর আমি যখন নিজে রুমে গিয়ে চোখ মুখে পানির ছিঁটা দিতে যায়, তখন শুনতে পায় কান্নার শব্দ। ততক্ষণে গান বাজনা থেমে নীরব চারিপাশ। ব্যাপারখানা খটকা লাগায় বেরিয়ে দেখি সবাই ভাইয়ার রুমে দৌড়ে যাচ্ছে, তাদের দেখে আমি
নিজেও গিয়েছিলাম। কে জানত, সেখানে আমার জীবনের সবচেয়ে চমকটা অপেক্ষা করছে। তারপর ডাক্তার পরীক্ষা করে জানাল, না ভাইয়া আর নেই। তখনো আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। আমার মস্তিষ্ক কাজ করছিল না। আর না ভালো মন্দের বোধ আমার মধ্যে ছিল। তবে লজ্জাজনক ব্যাপার কি জানেন? সবাই যখন ভাইয়াকে নিয়ে ব্যস্ত তখন আমার সর্বাঙ্গে বইছিল কাম তাড়না। শরীর চাচ্ছিল কোনো এক নারীদেহ। নিজেকে তখন বড্ড পাগল পাগল লাগছিল আমার। হুশ ছিল না, সেই মুহূর্তে কি করা উচিত, কাকেই বা জানাব এই সমস্যার কথা। যাকে বয়ঃসন্ধির সমস্যাগুলোও শেয়ার করেছিলাম, তার নিথর দেহখানা পড়ে আছে চোখের সামনে। গোপন কথা জানানোর মানুষটাও যে আর নেই।”
চলবে…..!!
★গল্প এত দেরিতে দেন কেন?
= আমার লিখা বই আসছে ২০২৩ শের বইমেলায়। এজন্য ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। রানিং গল্প তাড়াহুড়োয় লিখে নষ্ট করতে চাচ্ছি না, তাই সময় নিয়ে লিখছি।”