#প্রিয়_তুই
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_১৯
-”তবুও বলি, আপনার বড় ভাই মিশান কসম দিয়েছিল যেন আপনাকে না জানায়। কারণ উনি চাচ্ছিলেন না উনার আম্মুকে আপনি দেখেন।”
তিতাসের কথা শুনে ভোর মৃদু হাসল। মিশান এখনো তাকে আপন ভাবতে পারে নি। হয়তো এখানেও তার দোষ। এখন অবধি যা কিছু ঘটেছে বা ঘটছে সবকিছুর সঙ্গে সে জড়িত।
হোক সেটা স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায়।
আর মিশানের মা ওর বাবার প্রথম স্ত্রী। যিনি মিশানকে জন্ম দিতে গিয়েই মারা গেছেন। এরপরে, ভোরের মাকে তার বাবা বিয়ে করেছিলেন। দিনকালও ভালোই কেটেছে। তবে ওর মা কখনো তিন সন্তানকে আলাদাভাবে দেখেন নি। বরং তাদের তুলনায় মিশান সর্বদা সবকিছু বেশি পেয়েছে। সেটা জেদের বশে হোক বা অন্য কোনোভাবে।হাজার দোষ করলেও তাকে মাফ করে দেওয়া হয়েছে।কারণ সে হচ্ছে বাসায় বড় সন্তান।
তাছাড়া মিশানও তার মাকে সত্যি খুব ভালোবাসত, এখনো বাসে। সে কেন জানি ভয় পেতো, ভোর বা নিশান বুঝি নতুন মাকেও ওর থেকে কেড়ে নিবে। পূর্বের মতোই মা ওকে ছেড়ে চলে যাবে। এজন্য প্রায় সময় মাকে জড়িয়ে ধরে বলত ‘মা, ওহ মা, তুমি শুধু আমার মা।’
মিশান খুব সহজে মাকে মেনে নিলেও তাকে আর নিশানকে এখনো মেনে নিতে পারে নি। তাদের মধ্যে অদৃশ্য দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। তার মানে এই না, ওদের সঙ্গে কথা বলে না অথবা খুব খারাপ ব্যবহার করে। সে সবই করে তবে লিমিট রেখে। একচুল কমও না বেশিও না।সৌজন্যে রক্ষার্থে এই আর কি।
মায়ের মৃ/ত্যু/তে কষ্ট পেয়েই হয়তো মাকে শেষবার দেখতেও
দিতে চায়নি। বোধহয় এটা ভেবেছিল, ভোর ওর মাকে মেরে ফেলেছে। তবে সে দেখেছে, দূর থেকে। ওর মা মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একজন নার্স তাকে কল করেছিল। হসপিটালের সব খবরা-খবর তাকে জানিয়েছিল। এসব শুনে হঠাৎ ওকে কাঁদতে দেখে তিতাসের বাবা সবটা জানতে চান, সে বলেও।
দারোয়ান তখনো ভোরকে বের হতে দেয় না। পরে তিতাসের বাবা পেছনের দরজা দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।যেন তার মনে আফসোস না থাকে।যেহেতু চোখের দেখাটা দেখতে পেয়েছে
তাই সে মিশানের সঙ্গে তর্কে জড়ায় নি। আর সে অবস্থা ওর ছিল না। তাই নিখুঁতভাবে ব্যাপারটা চেপে গিয়েছে। ঝামেলা করে তো আর মাকে ফিরে পাবে না। তাই এই ব্যাপারে ভোর কথা বাড়াতে চায়ল না। যা হয়ে গেছে তা নিয়ে বাক-বিতর্ক করাও বোকামি। তাই তিতাসকে পড়তে বসতে বলে সে গেল রান্নাঘরে। আজ কারোই মন ভালো নেই, তাই নিজেই নিলো দুপুরের রান্নার দায়িত্ব। সে আপনমনে কাজ করতে করতে হঠাৎ খেয়াল করল পাশে কারো উপস্থিতি। কিঞ্চিৎ বাম ঘাড়
ঘুরিয়ে দেখে রোজা হুইল চেয়ারে মন ভার করে বসে আছে। হয়তো আবার মায়ের বকা খেয়েছে। ভোর ওর মন খারাপের কারণ জানতে না চেয়ে রোজার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলো। আর
রোজাও মন খারাপের রেশ ছুঁড়ে ভোরের সঙ্গে গল্পে মেতে উঠল।
টানা কয়েক ঘন্টা পড়ে তিতাস খুব বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। ঘাড়টা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ড্রেসিংটেবিলে নিজেকে দেখে নিলো। অকারণে চুল ঠিকঠাক করে শরীরে পারফিউম স্প্রে করল। তারপর ভোরের সাজগোছের জিনিস ঘাটাঘাটি করে এলোমেলো করে রাখল। পুরো রুম পরিপাটি দেখে মেজাজ খারাপ হলো তার। তাই উঠে সব এলোমেলো করে খুশি মনে বসতেই, তখন ভোর গোসল সেরে বের হলো। তার চুলে শুভ্র তোয়ালে জড়ানো আর হাতে ভেজা কাপড়। মুখজুড়ে পানির
বিন্দু বিন্দু ফোঁটা। পরনের গোলাপি কামিজ হালকা ভেজা।
তখন তিতাস তার পথ আগলে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
-‘এ্যাই শুনুন।”
-”বল।”
-”আমি আর কতদিন বিবাহিত ব্যাচেলর থাকব?”
-”যতদিন না বড় হচ্ছিস।”
-”তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাচ্ছিলাম বলে, ক্লাস ফাইভে থাকতে বাবা আমার খা/ৎ/না করিয়েছেন। আর এখন আমি হাইটে পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চির একজন হবু ডাক্তার। তবুও এই কথা!”
-”তুই কি মানুষ হবি না?”
-”হয়ে কি হবে? একদিন তো মরেই যাব।”
-”বে/য়া/দ/ব সর সামনে থেকে।'”
একথা বলে ভোর তিতাসকে সরিয়ে বেলকনিতে চলে গেল। নয়তো এই পাগল ওর মাথা খারাপ করে দিবে। ভোর ভেজা কাপড় মেলে রুম এসে দেখে তিতাস নেই। তবে রুমের করুণ অবস্থা। সে বিরক্ত হয়ে সব ঠিকঠাক করে বাইরে গেল।খেয়ে
ভাতঘুম দিতে হবে। এমন অলস দুপুরে না ঘুমালেই নয়।ঠিক
তখন ড্রয়িংরুম থেকে তিতাসের চেঁচামেচি শোনা গেল। রেগে কাউকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা বলছে।ভোর দ্রুত পায়ে গিয়ে
দেখে অতীব সুন্দরী একটা মেয়ে সোফায় বসে আছে। সাজ পোশাকে আভিজাত্যের ছোঁয়া। তবে তিতাস যে তাকে এত বাজেভাবে অপমান করছে তবুও তার মাঝে হেলদোল নেই। সে হাসিমুখে তিতাসের মুখ পানে তাকিয়ে আছে। যেন এসব কথাগুলো তার কাছে মিষ্টি লাগছে। এজন্য গোগ্রাসে গিলে যাচ্ছে। এত চেঁচামেচি শুনে বাকিরাও সেখানে উপস্থিত হয়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ভোর সকলের মুখভঙ্গি পরখ করে সেও মেয়েটার কান্ড দেখতে লাগল।মেয়েটার ফেসকাট কিছুটা পিয়াসের মতো। তবে চোখ দু’টো তিতাসের মতো। এ চোখে যেন অদ্ভুত মায়া মেশানো। মেয়েটাকে দেখে তিতাসের বাবাও রেগে গেলেন, তেড়ে গেলেন মারতে। তবে তিতাসের মা মেয়েটার মুখ পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।যেন উনি কতকালের তৃষ্ণা মিটাচ্ছেন। উনার চোখ দিয়ে ঝরছে বারি ধারা। তখন রোজা হুইল চেয়ার ঠেলে মেয়েটার কাছে ঘেষে বসে বলল,
-”তোমাকে ছোট মিয়া বকছে কেন সারা আপু?”
-”আরে লিলিপুট যে, কেমন আছিস পাখিটা?”
-”ভালো। তুমি কি আবার চলে যাবে আপু?”
-”এখানে থাকার অনুমতি নেই আমার, যেতে তো হবেই।”
-”যেও না। আমি আর তুমি আমার রুমে থাকব।”
-”হা হা হা, আমি এখন সবার কাছে অর্ধমৃ/ত। আর অর্ধমৃ/ত মানুষরা সভ্য সমাজে বাস করতে পারে না।”
সারার কঠিন কথাগুলো রোজা বুঝতে পারল না। তাই চুপ করে শুনে গেল। তখন রোজার মা এসে রোজাকে নিয়ে চলে গেলেন। বড়দের কথার মাঝে ওর না থাকায় শ্রেয়। উপরের রুমে রোজাকে রেখে উনি পুনরায় নিচে এলেন। হঠাৎ সারার আগমন উনাকে খুব বেশি ভাবাচ্ছে। না জানি আবার কোন প্যাঁচ কষছে মেয়েটা। তখন সারা উঠে তিতাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
-”তোর বাসায় খেতে আসি নি, থাকতেও আসিনি। শুধু কিছু কথা জানাতে এসেছি।”
-”আমি আপনার মুখে একটা শব্দ শুনতেও ইচ্ছুক নয়। সদর দরজা খোলা আছে, বিদায় হন।”
তিতাসের ঘৃণাভরা দৃষ্টি দেখে সারা মলিন হাসল। তারপর ওর মায়ের সামনে গিয়ে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ছলছল চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে গেল ক্ষণিকেই।প্রিয় মাকে একবার
ছোঁয়ার জন্য হাত বাড়িয়েও গুটিয়ে নিলো। এই অধিকার সে হারিয়েছে অনেক আগেই। অতঃপর নিজেকে সামলে সারা ওর মায়ের পায়ের কাছে বসল। ওর অপবিত্র শরীরের ছোঁয়া যেন ওর মাকে স্পর্শ না করে এমনভাবে। তারপর কান্নারত কন্ঠে বলল,
-”আম্মু, তুমি নিজের এবং বাবার প্রতি খেয়াল রেখো। খুব
খুব ভালো থেকো তোমরা। আমার সময় শেষ, আমাকে যে এবার যেতে হবে।”
ওর আম্মু নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে জবাব দিলেন,
-”আচ্ছা। ”
-”যেখান থেকে এসেছি সেখানকার কথা বলছি না।”
-“তবে?”
-”ক’ ব’ রে।”
তিতাস এবার আরো রেগে গেল। সারার মন ভোলানো কথা ওর সহ্য হলো না। ওদের মান সন্মান ধূলোয় মিশিয়ে এখন এসেছে ভালো সাজতে। সে সারাকে দাঁড় করিয়ে দরজার কাছ অবধি নিয়ে গেল। তখন তাকে সাধল ভোর। তিতাসের হাত ছুটিয়ে সোজাসাপটা সারাকে বলল,
-”এই মানুষগুলো নামেই শুধু বেঁচে আছে। হাতজোড় করছি এসব বন্ধ করুন। উনাদের আর ছোট করবেন না, প্লিজ। না রেখেছেন মানসন্মান আর না দিয়েছেন শান্তি। আর কতবার ছোট করবে উনাদের? বন্ধ করুন এসব, প্লিজ বন্ধ করুন।”
সারা এবার ওর হাত ছুটিয়ে হ্যান্ডব্যাগ থেকে দু’টো খাম বের করে ভোরের দিকে এগিয়ে দিলো। ভোর তাতে দৃষ্টি বুলিয়ে হতভম্ব। কারণ সেটা মেডিকেল রিপোর্ট। যেখানে স্পষ্টভাবে লিখা সারা এইডসে আক্রান্ত।আর এই রিপোর্ট গতকালকের আর অন্য খামেরটা দশ বছরের আগের। কাগজ দেখে মনে হচ্ছে অনেক পুরনো। এবার ভোরকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে সারা বলতে লাগল,
জুবায়ের (প্রাক্তন স্বামী) প্রথমে যার সঙ্গে মিলিত হতে বাধ্য করেছিল। সেই ছিলেন এইডসে আক্রান্ত। এ কথা ওই ব্যক্তি নিজেও জানতেন না।আর উনার সঙ্গেই একাধিবার মিলিত হতে বাধ্য করেছিল জুবায়ের। কারণ উনি ছিলেন বিদেশি
বিসনেস পার্টনার। উনাকে পটালেই ওর বিজনেস শীর্ষস্থানে।
ফলস্বরূপ সারা ধীরে ধীরে এইডসে আক্রান্ত হয়। পরে এসব কথা জানাজানি হলে সে পিয়াসের সঙ্গে বাসায় চলে আসে। এখানে এসে দিন দিন শরীরের পরিবর্তন লক্ষ্য করে একটা টেষ্ট করায়। যদিও সে ভেবেছি প্রেগনেন্ট হয়তো। কিন্ত তার ধারণা ছিল সম্পূর্ণ ভুল। কারণ সেদিনই জানতে পেরেছিল, সে এইডসে আক্রান্ত। এরপর অনেক ভেবেই সিদ্ধান্ত নেয়,
ম/র/তে যখন হবেই তখন এমন কয়েকটা বিশ্বাসঘাতকের শরীরে ম/র/ণ ব্যাধি ছড়িয়েই তারপর মরবে। বিশেষ করে, যারা বউ বাচ্চা রেখে অন্যের শরীরে সুখ খুঁজতে যায়। পণ্য ভাবে মেয়েদের। তাদের আর যায় হোক ভালো মানুষ বলা যায় না। সে তো কখনো বলবে না। কারণ ওরা বিশ্বাসঘাতক, বেইমান। তারা প্রিয় মানুষের বিশ্বাস ভঙ্গ করা বহুরুপী কীট।
এরপর বাসায় ছেড়ে বেরিয়ে উদ্দেশ্যে সফল করতে থাকে।
আর এই অবধি যারা স্বেচ্ছায় তার কাছে এসেছিল, এখন তারা সবাই এইডসে আক্রান্ত। অনেকে মারাও গেছে। খুশির খবর হচ্ছে জুবায়ের নিজেও এই ব্যাধিতে ধুঁকে মরছে। তার জারিজুরি শেষ। প্রথম থেকেই সে বড় বড় বিসনেসম্যানদের টার্গেট করেছিল বিধায় প/তি/তা/ল/য়ে কখনো যেতে হয় নি। বরং তাকেই কতজন ফ্ল্যাট গিফট করেছে। ক্যাশটাকা, গয়না থেকে শুরু বাড়ি গাড়ির কোনো কিছুর অভাব নেই।
শুধু অভাব থেকে গেছে সুখ আর শান্তির। যেটা এ জীবনে সে পেলো না। অসুস্থতার কারণে আজ তার ভারি মেকাবের আড়ালে নিজস্ব রুপহীন চেহারা ঢেকে আছে। কত নির্ঘুম রাতের সাক্ষী চোখের নিচে পড়া বিশ্রী কালিগুলো। এতদিন কেউ তাকে সেভাবে দেখে নি, বুঝে নি, আর জানেও নি ওর ভেতরের হাহাকার। তাই আজ এসেছে সব সত্যি জানাতে, কারণ তার হাতে বেশি সময় নেই। তাকে এবার যেতে হবে না ফেরার দেশে।
To be continue………..!!