#প্রিয়ংবদা
#অষ্টদশ_পর্ব
#লেখনীতেঃমৌশ্রী_রায়
স্নিগ্ধ বিকেল!প্রখর তেজা অরুণ তখন ক্রমশ হেলে পড়ছে পশ্চিম দিগন্তে!সমস্ত নীলাম্বরে পেঁজা পেঁজা মেঘ ভেসে বেরাচ্ছে তুলোর মতো!
বৃদ্ধাশ্রম যাবার পথের রাধাচূড়া গাছটা অপরাহ্নের আলতো হাওয়ায় হেলে দুলে উঠছে বারবার!তবে তাতে আর ফুল নেই!
হৃদিতা একবার সেদিকে তাকালো!দিদার কথা খুব করে একবার মনে পড়লো তখনই!কতদিন হলো, মানুষটার সাথে দেখা হয়না!চার-পাঁচদিন হবে না?হবে তো!
ইশশ!কিন্তু সেই বা কি করতো?সামনেই উচ্চ মাধ্যমিক। দু’মাস বাদেই টেস্ট এক্সাম।
পড়ার এত চাপ,চাইলেও আর আসা হয়ে ওঠেনা রোজ রোজ!
হৃদিতা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে।
আদৃত ততক্ষণে এগিয়ে গেছে বেশ খানিকটা পথ। হৃদিতার স্লথ গতি দেখে সে ঘাড় ফিরিয়ে পিছে ঘুরে ডেকে ওঠে,
“হৃদ?থামলেন কেন?শরীর খারাপ লাগছে কি?দাঁড়ান একটা রিক্সা নিই।বললাম আপনাকে,আপনি তো শোনেন না!”
হৃদিতা হালকা হাসে। পা চালিয়ে আদৃতের পাশাপাশি দাঁড়াতেই তার দিকে তাকায় আদৃত। হৃদিতাও চোখে চোখ রাখে!হাসিমুখে বলে ওঠে,
“শরীর টরীর সব ঠিক আছে!আপনিও না। এত চিন্তা করেন কেন?আশ্চর্য! বাচ্চা নাকি আমি? ”
আদৃত হাসে। দুষ্টুমি মেশানো কন্ঠে স্বগোতক্তি করে ওঠে,
“উঁহু!বাচ্চা কেন হবেন?আপনি তো আমার বাচ্চার মা!”
হৃদিতা ভ্রু কুচকে তাকায়!কিয়ৎক্ষণ আদৃতের বলা বাক্যের অর্থোদ্ধারের প্রয়াসে ভাবনার সুতো বোনে। আর যখন বুঝে ওঠে আদৃতের কথার মর্মসার তখনই লজ্জায় নুঁইয়ে পড়ে লাজুক বদন!
আদৃত হাসে। তারপর প্রিয়তমার লাজুক আভা কাটিয়ে দিতেই তাড়া দিয়ে বলে,
“চলুন।আর লজ্জা পেতে হবে না। দিদার কাছে যাবেন তো!দেরি হয়ে যাচ্ছে। আসুন!”
হৃদিতা নত মুখেই মাথা নাড়ে। আদৃত এগিয়ে যায় সামনে, হৃদিতা তার পিছু পিছু!
মিনিট দশেকের ব্যবধানেই পৌঁছে যায় গন্তব্যে! বৃদ্ধাশ্রমের মূল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আদৃত একটিবার কেমন আড়ষ্টতায় ভোগে।
মনে পড়ে, তিন বছর আগে সেই তার ঠাম্মিকে এই আশ্রমের বাইরে অবধি রেখে গেছিল।তারপর আর কখনো ঢোকেনি ভেতরে। অনেকবারই ঠাম্মির খোঁজ নিতে আসতো এদিকে, তবে ঐ দিনের পর ঠাম্মির মুখোমুখি হবার মতো সাহস হয়নি তার।মায়ের করা কৃতকর্মের দায়ভার কি তার নয়!নিশ্চয়ই!
আজ আবার সেই জায়গায় ঠাম্মির সাথে কথা বলতে এসে, দেখা করতে এসে নিজেই কেমন যেন চাপা সঙ্কোচে মিঁইয়ে গেল!
হৃদিতা খেয়াল করলো!আদৃতকে মিষ্টি সুরে ডাকলো,
“আদৃতবাবু!”
আদৃত তাকালো!হৃদিতার ঠোঁটে হাসি!আদৃতও প্রসারিত করলো ঠোঁটের কোণ!হৃদিতা মিষ্টি হেসেই বলে উঠল,
“এত দ্বিধা কিসের?আমি আছি তো!”
আদৃতের ঠোঁটের প্রসারণ খানিক দীর্ঘ হলো। হৃদিতা হাতের ইশারায় প্রবেশ করতে বললো ভেতরে!আদৃত আর ভাবলো না। মোটা লোহার গেটটা ঠেলে দিয়ে পা রাখলো ভেতরে।
হৃদিতা এবারে সোজা এগিয়ে গেল কাদম্বিনী দেবীর ঘরের দিকে!আদৃতও পিছু নিল!
ভেজানো দরজাটা দুহাতে হালকা ঠেলতেই কড়কড় আওয়াজে তা খুলে গেল মুহুর্তেই!
কাদম্বিনী দেবী কপালে হাত ঠেকিয়ে শুয়ে ছিলেন। দরজার আওয়াজে হাত সরিয়ে তাকালেন তিনি!
হৃদিতাকে দেখতে পেয়ে উঠে বসলেন উৎফুল্ল চিত্তে!তবে হৃদিতার ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে থাকা তার অতি আদরের ধন, তার আদৃতকে দেখতে পেয়ে বিহ্বল নয়নে তাকালেন তিনি!
আদৃত এখানে এসছে, তার সাথে দেখা করতে,এ কথাটা বিশ্বাসই করা যাচ্ছিল না যেন।
তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি ভেতরে ডাকলেন দুজনকেই।
হৃদিতা-আদৃত ভেতরে গেল। কাদম্বিনী দেবী বিছানার এককোণে একটু সরে বসে হাত বুলিয়ে জায়গা করে দিলেন দুজনকেই। চোখের ইশারায় বোঝালেন,
“বোসো!’
হৃদিতা বসে পড়লো,তবে আদৃত তখনো দাঁড়িয়েই!কাদম্বিনী দেবী মৃদু হেসে বলে উঠলেন,
” বসবি না দাদুভাই?”
এই যে এই একটা ডাক,”দাদুভাই”, এটাই যেন সুনামীর মতো আদৃতের বুকের ভেতরটার সব কষ্ট,কান্না উথলে তুললো চোখে!শক্ত আঁখিপটে দেখা মিলল সিক্ত ধারার!
কাদম্বিনী দেবী ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ালেন। নাতির ঠিক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দু কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“কাঁদিস কেন ভাই?কাঁদে না!তোর তো কোন দোষ ছিল না!হয়তো,দোষটা আমারই। তোর এই কালো ঠাম্মিটা হয়তো সত্যিই তোদের সমাজের যোগ্য না!কাঁদিস না!”
আদৃত আর সামলাতে পারেনা। জাপটে ধরে ঠাম্মিকে। তারপরে, বাঁধনছেড়া কান্নায় ফেটে পড়ে আচমকাই!
কাদম্বিনী দেবী বাঁধা দেন না।
ছেলেটা তো কাঁদেনা,কাঁদতে পারেনা। কেঁদে যদি একটু হালকা হয়,তবে কাঁদুক।
আদৃত,কান্নাভেজা কন্ঠে বলে ওঠে,
“তুমি একদম এসব বলবেনা ঠাম্মি!তোমার সংসার ওটা। ওখানে থাকার সবরকমের যোগ্যতা আছে তোমার।
তুমি কেন হবে না আমাদের সমাজের যোগ্য! আর কিসের সমাজ?যে সো কল্ড সমাজ আমার ঠাম্মির মনটার বদলে তার বাইরের আবরণটা দিয়ে তার বিচার করে, আই জাস্ট হেইট দিস সোসাইটি!
দোষ তো আমার ছিল ঠাম্মি। তোমাকে সেদিন অত অপমান করার পরও, আমি প্রোটেস্ট করতে পারিনি!তোমাকে অত বাজে কথা শোনানোর পরও আমি চুপ থেকেছিলাম। আর তারপর, তারপর এই নিজে,তোমাকে নিজের বাড়ি থেকে এনে দিয়ে গেলাম এই বৃদ্ধাশ্রমে, ছেলে,স্বামী সব থাকার পরও তোমাকে নিজের ঘর ছেড়ে আসতে হল।
আমি খুব খারাপ ঠাম্মি!প্রচন্ড খারাপ!আমার কোন যোগ্যতাই নেই তোমার নাতি হবার!”
কাদম্বিনী দেবীর চোখ ছলছল করছে।তিনি উত্তর দেন না।
চুপচাপ নিজের সাথে আগলে রাখেন নাতিকে।
হৃদিতা ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেদিকে!কিছু বুঝতে পারেনা ঠিক মতো!
বেশ কিছুক্ষণ পরে আদৃত সোজা হয়ে দাঁড়ায়! হাতের উল্টো পিঠে মুছে নেয়, চোখ গড়ানো জল। কাদম্বিনী দেবী নাতির মাথায় হাত বোলান। স্নেহময় হাসি হেসে বলেন,
“পাগল!তোর কোন দোষ ছিল না। পরিস্থিতিটাই এমন ছিল,কারো কিছু করার ছিল না!”
আদৃত ম্লান হাসে। চোখ পড়ে হৃদিতার দিকে। তার চোখে এখনো অবুঝ চাহুনি! আদৃত সেদিকে এগিয়ে যায়।
হৃদিতার হাতজোড়া নিজের হাতের মুঠোয় ধরে হাটু মুড়ে বসে পড়ে তার সামনে!তারপর মলিন দৃষ্টি মেলে প্রশ্ন করে,
“আপনি জানতে চেয়েছিলেন না হৃদ, কেন আপনাকে সত্যিটা বলিনি?আজ বলবো!বলবো বলেই নিয়ে এসছি ঠাম্মির সামনে!আপনি শুনবেন?”
হৃদিতা বোকা বোকা চোখে মাথা নেড়ে সায় জানায়!আদৃত আবারো ম্লান হেসে বলতে শুরু করে,
“আমার বাইশ তম জন্মদিন ছিল সেদিন!সারাবাড়ি সেজেছিল তারই আয়োজনে। ফুল,বেলুন,প্রদীপ সবকিছু দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছিল “মেঘকুঞ্জ”!প্রতি বছরই হত। বাবার বড় ছেলে, দাদুর বড় নাতি বলেই হয়তো!তবে সেবারে আয়োজনটা হল আরও একটু বড়।গোটা বাড়ি আত্মীয় স্বজনের উপচে পড়া ভীড়ে গমগম করে উঠলো!
সেইবারই প্রথম আমাদের বাড়িতে আসেন, আমার মায়ের পিসিমা!উনি থাকেন ভারতে!সেজন্য মায়ের বিয়েতেও হাজার চেষ্টা করেও আসতে পারেন নি দেশে, ভিসা স্যাঙ্কশন হয়নি ঠিক সময়ে শুনেছিলাম।
তারপরে সেই মায়ের বিয়ের ২৩ বছর পরেই প্রথম আসেন আমাদের বাড়িতে!
আমার সেই পিসিদিদুন আবার ছিলেন, রুপে বেজায় সুন্দরী, বয়সের ছাপ পড়া বৃদ্ধ দেহটাতেও সৌন্দর্য উপচে পড়তো ওনার।
সেটাই ছিল ওনার অহংকার!
আমাদের বাড়িতে আসার পরেই ঠাম্মির সাথে প্রথম দেখা হয় ওনার। আমার ঠাম্মি বরাবরই ভীষণ সাদাসিধে মানুষ! ভীষণ সহজ জীবনযাপনই তার পছন্দ। সেজন্যই হয়তো বা অত বড়লোক বাড়ির বউ হবার পরেও ঠাম্মির সাজগোজ ছিল নিতান্তই সাধারণ,খুব আড়ম্বরহীন!
পিসিদিদুন আমার ঠাম্মি, পুরো মেঘকুঞ্জের একমাত্র সম্রাজ্ঞীকেই ভেবে নিলেন আমাদের বাড়ির সার্ভেন্ট!
বাইরের রুপটা বিচার করলেন যে!
ঠাম্মি যখন ওনাকে জিজ্ঞেস করলেন,
” বেয়ান কেমন আছেন?আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো!”
তখন উনি ঐ ভরা বাড়িতেই সিন ক্রিয়েট করে চেঁচিয়ে বলে ওঠেন,
“এই কাজের লোকটা আমাকে বেয়ান বলে কোন সাহসে।”
ঘটনার আকস্মিকতায় ঠাম্মি হতভম্ব হয়ে যায়। মা-বাবা দৌঁড়ে আসে, কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই পিসিদিদুন মাকে বলে,
“তোর বাড়িতে এসে একটা কাজের লোক আমাকে জিজ্ঞেস করে আমার ভালোমন্দ, বেয়ান বলে সম্বোধন করে!এসব কি মল্লিকা!”
মা চমকিত চোখে তাকায়!পরিস্থিতি সামাল দিতে খুব দ্রুত চাপা রাগ নিয়ে বলে,
“আহ্!পিসি!না জেনেশুনে অযথা চিৎকার করার স্বভারটা তোমার গেলনা!উনি আমার শাশুড়ি মা। তোমার বেয়ান হবে না তো কি হবে তুমি এসো তো ভেতরে এসো!”
পিসিদিদুন আর কথা বাড়ায় না।তবে একবার তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঠাম্মির দিকে।তারপরে মায়ের সাথে চলে যায় ভেতরে।
সারাদিন তো সব ঠিকই চলছিল। বিপত্তি বাধে রাতে, যখন অনুষ্ঠান শেষে সব আত্মীয় স্বজন চলে গিয়েছিল ও বাড়ি থেকে।
রাতের খাবার খেতে আমরা সকলেই বসে পড়ি ডায়নিং টেবিলে।
হঠাৎ পিসিদিদুন মাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
“মল্লিকা!তুই এত সুন্দরী! তোর শাশুড়ী কিনা এমন কালো,কুৎসিত দেখতে!আমার তো অনুষ্ঠানের সময় ওনাকে নিজের বেয়ান বলে পরিচয় দিতে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল!তোরা আলাদা কেন থাকিস না বলতো!এমন মানুষ কি তোদের সমাজে মেলে বলতো!তেল জল কিন্তু কখনো মিশ খায় না মল্লিকা। মনে রাখিস!”
পিসিদিদুনের কথা গুলো শুনে ঠাম্মি ছলছল নয়ন জোড়া নামিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। দাদু কিছু বলতেই যাবে তার আগেই দাদুকে ইশারা করে থামিয়ে দেয়! তারপরে যখন আমি কিছু বলতে যাব,তখনো ঠাম্মিই চুপ করতে বলে।
বড়দের মাঝে কিছু বলাটা সত্যিই ঠিক হবে না ভেবে আমি চুপ করে থাকি!
তখন বাবা রাগী কন্ঠে বলে,
“দেখুন পিসিমা!আপনি এ বাড়ির অতিথি! অতিথির মতোই থাকুন!আমার মা এ বাড়ির কত্রী!সে কোথায় থাকবে, আমাদের সাথে থাকবে কিনা সেসব কি আপনি ঠিক করে দেবেন?নিশ্চই না?তাই নিজের সীমায় থাকলেই খুশি হব। আমার মাকে এভাবে অপমান করার অধিকার কিন্তু আপনার নেই!”
পিসিদিদুন এবারে শুরু করল আরো অশান্তি। কান্নাকাটি করে আমার মায়ের সামনে বলতে থাকলো,
“দেখলি মল্লিকা!তোর বরের কথা শুনলি?আমাকে কিভাবে কথা শোনালো দেখলি তো?আমার ভুলটা কি বলতো?তোর শাশুড়ির মতো অমন লো স্ট্যান্ডার্ড মহিলার কি তোদের সাথে থাকা মানায়। দুদিন পরে ছেলে মেয়ের বিয়ে দিবি।
এখন তো আমি বলছি,তখন বাইরের সকলে বলবে।কে বলতে পারে ওনার জন্য তোর বাচ্চাদের সম্বন্ধ ভেস্তে যাবে কি না!
আর তোর বর আমাকে কি না কি শোনালো!
এটা কি শুধু তোর শাশুড়িরই বাড়ি!তোর এ বাড়িতে কোন অধিকার নেই!তোর সামনে আমাকে এতগুলো কথা শোনাতে পারলো?”
আমার মায়ের সাথে আমার ঠাম্মির সম্পর্ক বরাবরই খুব ভালো,একদম বন্ধুর মতো। সেদিনও আমি ভেবেছিলাম বাবার মতো আমার মাও ঠাম্মির হয়েই কথা বলবে!কিন্তু তা হলো না। আমার,আমাদের সকলের ভাবনা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আমার মা পিসিদিদুনের অন্যায়ের পক্ষই নিল।
প্রচুর রাগে বলে বসলো,
“আমার এ বাড়িতে সত্যিই কি কোন অধিকার নেই?আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার পিসিকে কোন হিসেবে এমন অপমান করা হয়?পিসিমা তো কিছু ভুল বলেন নি!যা বলেছেন ঠিক বলেছেন। মার জন্য যদি পরে আমার ছেলে-মেয়ের জীবনে কোন অশান্তি হয়!তখন?”
বাবা আবার কিছু বলতে যাবে তার আগেই এবারটায় ঠাম্মি আটকে দেয় বাবাকে। তারপর বিষন্ন হেসে মাকে জিজ্ঞেস করে,
“তাহলে তুমি কি চাও মা?কি করলে তোমার ছেলে-মেয়ের জীবনে কোন অশান্তি হবে না?বলো!ওরা তো আমারো নাতি-নাতনী!তুমি যা বলবে,ওদের ভালোর জন্য আমি তাই করবো!”
আমার মা আমাদের সবাইকে আবারো অবাক করে দিয়ে বলে ওঠে,
“আমি আমার বাচ্চাদের নিয়ে আলাদা থাকবো মা। আমি এ বাড়িতে আপনার সাথে থাকতে পারবো না। কিছুতেই না। আপনার জন্য আমার পিসি, যে মানুষটা এতবছর পরে দেশে ফিরলো,তাকে আপনার ছেলে যা না তা বলে অপমান করলো!আর না!আমি কালই এ বাড়ি থেকে চলে যাব!”
আমার ঠাম্মি হাসলো। তারপরে আমার মাকে বললো,
“তুমি এ বাড়ির বউ মা, এ ঘরের লক্ষী!আমি নিজের হাতে এ বাড়িতে তোমাকে বরণ করে এনেছি!সেই তোমাকে কি কোন ভাবে আমি এ বাড়ি থেকে যেতে দিতে পারি?কখনোই না!আমি আমার সংসারকে লক্ষ্মীহারা করতে পারিনা তো!
তুমি তোমার সংসার,স্বামী,সন্তান নিয়ে এ বাড়িতেই থাকো মা। আমিই চলে যাব।
বাপের বাড়িতে তো যেতে পারবো না। আমি তোমার শশুড়মশাই যে বৃদ্ধাশ্রমটায় মাসে মাসে অনুদান দেন, তাতে গিয়েই উঠবো!
তারপর ঠাম্মি চলে গেল সেখান থেকে।
পিছু পিছু আমি,দাদু,ছুটকি গিয়ে দেখলাম ঠাম্মি নিজের জামা-কাপড় গোছাচ্ছেন।
আমি,দাদু,বোঝালাম,বাঁধা দেবার চেষ্টা করলাম,ঠাম্মি শুনলো না। মানলো না।
ওনার এক কথা, বাড়ির বউকে তিনি আলাদা হতে দেবেন না। সংসারে ভাগ তিনি চান না! দাদু,আর আমাকে বলে বসলো, যদি আমরা ওনার ইচ্ছের সম্মান করি, তবে যেন ওনাকে না আটকাই।
তারপরে আর কিছু করার থাকলো না।
দাদুও আর কথা বাড়ালো না।চুপচাপ বসে রইলো। ভোরের দিকে আমি ঠাম্মিকে নিয়ে বেরোলাম।বাবা আসলো না আর সামনে।মা বসেই ছিল সোফায়, ঠাম্মিকে যেতে দেখেও কিছু বললো না।আটকালো না! আমার কাছে আমার জন্মদাত্রী মাকেই খুব অচেনা ঠেকলো!ছুটকি কাঁদছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।আর এতকিছুর যে মূল মাথা,সেই পিসিদিদুন,মায়ের বসে খুশি মনে পান চিবুচ্ছিলেন।প্রচন্ড রাগ হলো ওনার ওপরে। তবে ঠাম্মির সামনে কিছু বললাম না।দাদু যাবার আগে একবার খুব কাতর স্বরে শুধালো,
“তুমি কি আর কখনোই ফিরবে না কৃষ্ণকায়া?”
ঠাম্মি সেদিকে না ফিরেই উত্তর দিল,
“কেন ফিরবো না?নিশ্চয়ই ফিরবো!বাড়ির লক্ষ্মী,আমার বউমা যেদিন নিজে থেকে ফিরিয়ে আনবে, সেদিন!”
মা শুনলো, তবুও কিছু বললো না। এবারে মায়ের ওপরেও জন্মালো তীব্র অভিমান।
ঠাম্মিকে নিয়ে এলাম এখানে।
বাড়ি ফিরলাম যখন তখন দেখি ছুটকি ব্যাগ গুছিয়ে তৈরী।জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যাচ্ছে। ও বললো হোস্টেলে।
তারপরে আমার বোনটাও চলে গেল বাড়ি ছেড়ে।
যাবার আগে বলে গেল,
“যতদিন না অবধি আমার ঠাম্মি এবাড়িতে আবার সসম্মানে ফিরে আসে,ততদিন আমিও থাকবো না এ বাড়িতে!”
ওকে আর আটকালাম না আমিও!মা আটকানোর চেষ্টা করেছিল তবে পারেনি!ও শোনেনি!
সেদিনের পরে বাবাও খুব কম থাকতো আমাদের বাড়িতে। বেশির ভাগ সময় অফিসের কাজের নাম করে বাইরেই থেকে যেত। যেদিন বাড়ি ফিরত সেদিনও থাকতো না মায়ের সাথে। গেস্টরুমে গিয়ে শুত!
আমাদের গোটা বাড়িটা,সাজানো, সংসারটার সব হাসি,সব খুশি এক নিমেষেই হারিয়ে গেল।
সবার সাথে বেড়ে গেল দূরত্ব।
বাইরে থেকে দেখা ঝা চকচকে আরিশান বাড়িটার ভেতরটা হয়ে রইলো, রঙহীন,ফ্যাকাশে!
সেদিনের পর থেকে মায়ের সাথে আর কখনো কথা বলিনি আমি,ইভেন বাবা,ছুটকি কেউ না।
দাদু বলতো মাঝে মাঝে,এখনো বলে!আসলে মা ঠাম্মির বড় আদরের কিনা!
আর দাদু ঠাম্মির প্রিয় কোন কিছুকেই অবহেলা করেনা বলেই হয়তো, আমার মাকেও করেননি।
তবে মা নিজের ভুলটা দুদিন পরেই বুঝতে পেরেছিল। নিজের পিসির কথায় চালিত হয়ে যে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করেছিল তাও বুঝেছিল!
আর বুঝতে পেরেই পিসিদিদুনকে নিজের মুখে কড়া কড়া কথা শুনিয়ে চলে যেতে বলেছিল বাড়ি থেকে।
তবে তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। আমার ঠাম্মি তার নিজের বাড়ি ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই নিয়েছে।
আসলে মুখ থেকে বেরোনো কথা ফেরত নেয়া যায়না তো,তাইই হয়তো!
মা নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেও ঠাম্মিকে ফেরাতে আসেনি।
হয়তো ঠাম্মির সামনে এসে দাঁড়ানোর সাহস হয়নি।তীব্র আত্মগ্লাণীর বশে বহুবার আমাকে এসে বলেছে ঠাম্মীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।
তবে আমি আসিনি। মা যতদিন নিজে না আসবে ততদিন তো আমি চাইলেও ঠাম্মি ফিরতো না।
ঠাম্মি যেদিন প্রথম বৃদ্ধাশ্রমে আসে তখন আমাকে বারণ করে দিয়েছিল যেন কেউ না জানে ঠাম্মি, আমার ঠাম্মি!
এত বড় বাড়ির বউ বৃদ্ধাশ্রমে আছে জানলে সবাই কম কথা তো বলবে না। ঠাম্মি চায়নি আমার দাদুকে নিয়ে কেউ কিছু বলুক,কেউ আমাদের পরিবারের কাউকে অসম্মান করুক,পরিবারের দিকে আঙুল তুলুক!
এটাই কারণ আমি আপনাকে সত্যিটা বলতে পারিনি হৃদ!বলা বারণ ছিল।ঠাম্মির কথার নড়চড় করা যে আমার পক্ষে সম্ভব না!
জানেন হৃদ!মা বহুবার চেয়েছেন এখানে আসতে, ঠাম্মীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে ওনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে,কিন্তু কোন একটা কারণে পারেননি। হয়তো মায়ের মতো শাশুড়িমাকে বাজেভাবে অপমান করার লজ্জায়।
তিনটে বছর তো কম না হৃদ। তবুও আমার মা আজও পারেনি। ঠাম্মিও ফেরেনি।
বাবা আজও বাড়ির বাইরেই কাটায় বেশিরভাগ সময়!আর আমার বোনটা,আজও বাড়ির থেকে দুরে হোস্টেল পড়ে থাকে মাসের পর মাস।
আমাদের সংসারটা ছন্নছাড়া হয়ে গেছে হৃদ।
এ সংসারটা আবারো সাজিয়ে, গুছিয়ে আগের মতো করে নেবার দায়িত্ব নেবেন হৃদ?
আমার জীবনটা আবারো তিন বছর আগের মতো হাসি,আনন্দে ভরিয়ে নেবার জন্য হলেও আমার আপনাকে চাই হৃদ। আপনাকে চাইই!
আপনি কি আমার হবেন হৃদ। আমার হারানো আনন্দঘন পরিবারটা ফিরিয়ে দিতে পারবেন হৃদ?”
আদৃতের কন্ঠ কেঁপে ওঠে।ভাসা ভাসা আঁখিজোড়া ছলকে ওঠে জলে।
পিছনে দাঁড়িয়ে কেঁদে যায় কাদম্বিনী দেবীও।
তিনবছর আগের সেই দমবন্ধ করা স্মৃতিটার কথা মনে পড়তেই অঝোর ধারা বেয়ে পড়ে চোখের কার্নিশ বেয়ে।
তবে হৃদিতার চোখমুখ স্থির শান্ত। সে খুব শান্ত কন্ঠে জবাব দেয়,
“আমি পারবো আদৃতবাবু। দিদার সাজানো সংসার আবার আগের মতো করে দেব আমি। আপনার পরিবারকে আবার এক সুতোয় বেঁধে আপনার জীবনের হারানো সব হাসি,সব আনন্দ ফিরিয়ে দেব।
ঠিক দেব আদৃতবাবু,ঠিক দেব!”
আদৃত হাসে। হারিয়ে যাওয়া গুপ্তধন ফিরে পাবার মতো আনন্দে জড়িয়ে নেয় প্রিয়তমাকে। হৃদিতা আলতো করে হাত রাখে পিঠে!
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে,
“আপনার সব হারানো খুশি, দিদার সব অধিকার আমি আবারো ফিরিয়ে দেব। আপনার সব খুশির উৎস এনে হাজির করবো আপনার সামনে। ভেঙে যাওয়া মেঘকুঞ্জকে আবারো গমগমে খুশির আসরে পরিণত করবো আমি। করবোই!”
#চলবে!