প্রিয় অন্তিম পর্ব

“প্রিয়”

৩.
পিহু নিজেদের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে দেখলো ইমন মেয়েকে কোলে নিয়ে হাটছে। চোখে-মুখে হাজারও ক্লান্তি। বারবার নেতিয়ে আসছে। কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই ঘুমাচ্ছে না। পিহু তাড়াতাড়ি রুমের ভেতরে গিয়ে ইশপিকে কোলে নিয়ে বললো,

— “ইশপিকে আমি রাখছি। আপনি একটু ঘুমান।”
— “তুমি না ঘুমিয়ে এখানে কি করছো? আর এখানে এসেছো মা দেখেনি?”
— “মা ঘুমিয়ে ছিলো। লুকিয়ে বেরিয়েছি।”
— “তুমি ঘুমাবেনা?”
— “সারাদিনে অনেক ঘুমিয়েছি। এখন একটু জাগলে কিছু হবে না। আপনি ঘুমান।”

ইমন চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পরলো। আধবোজা চোখে পিহুর দিকে তাকিয়ে আছে। অনেকদিন পর মেয়েকে কাছে পাওয়ায় বুকে জড়িয়ে রেখেছে। মেয়েটাও কেমন শান্ত আর চুপ হয়ে গেছে। ইমনের খারাপ লাগলো দৃশ্যটা দেখে। নিজের ফ্যান্টাসি জগতে এতোই ডুবে গেছিলো যে মেয়েটাকে পর্যন্ত সময় দেয়নি। নিজের মেয়েকে-ও অবহেলা করেছে। ক্লান্ত থাকায় ইমনের চোখে তন্দ্রা নেমে এলো। সেই সাথে বেশকিছু স্বপ্ন সাজাতে শুরু করলো তার পিহুরাণী এবং মেয়েকে নিয়ে।

ইমন ঘুমিয়ে যাওয়ার একটু পরেই ইশপিও ঘুমিয়ে গেলো। ইশপিকে ইমনের পাশে শুইয়ে দিতেই ইমন ঘুমের ঘোরে ইশপিকে কাছে টেনে নিলো। পিহু বেশ অবাক হলো। গত পাঁচদিনে ইমনের অভ্যাস হয়ে গেছে। ঘুমের ঘোরেই ইশপিকে খোঁজে। ইমনের মাঝে আগের সবকিছু ফিরে এসেছে দেখে পিহু মৃদু হাসলো। উঠে এসে ইমনের পাশে বসলো। চুলে হাত বুলিয়ে দিতেই ইমন নড়েচড়ে আরো গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। পিহু ইমনের দিকে একনজরে তাকিয়ে আছে। এই কয়েকদিনেই লোকটার ত্বক কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। পিহুর এটা মোটেও ভালো লাগেনা। ইমনের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে দেখলো হাতের নখ বড় হয়েছে এবং ময়লা জমেছে। সেই সাথে আঙুলের মাথায় কালো দাগ, কাটা দাগ, পোড়া দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

পিহু কিছু একটা ভেবে উঠে রান্নাঘরে গেলো চুপিচুপি। দশ মিনিট পর মুখে হাসি নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। রুমে এসে ইমনের পাশে বসে একটু হাসলো তারপর ব্রাশের সাহায্যে ফেসপ্যাক লাগিয়ে দিলো মুখে। ইমনের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলো পিহু। ইমনের ঘুম অনেক ভারী। সহজে উঠবে না পিহু জানে। তাই এসব করছে। ড্রয়ার থেকে নেইল কাটার নিয়ে হাতের নখ কেটে দিলো। পায়ের কাছে বসে পায়ের নখ কেটে দিয়ে উঠে দাড়ালো। মুচকি হেসে রুমাল ভিজিয়ে এনে শুকিয়ে যাওয়া ফেসপ্যাক মুছে নিলো। ড্রেসিংটেবিলর উপর থেকে সানস্ক্রিন, নাইট ক্রিম এবং ভেসলিন নিয়ে ইমনের পাশে বসলো। ইমনকে বেশ জ্বালিয়ে এসব কিনেছে পিহু। নিজের জন্য নয়। প্রিয় মানুষটার জন্য। প্রেগন্যান্সির সময় রাতে পিহুর তেমন ঘুম আসতো না। তাই বসে বসে ইমনের ত্বকের ঘষামাজা করেতো। মাঝে মাঝে তো মেয়েদের মতো সাজিয়ে দিতো। সকালে উঠে ইমন এসব দেখেই সে কি রাগ দেখাতো। নাক ফুলিয়ে রাখতো। আর এদিকে পিহু মিটিমিটি হাসতো। শেষ পর্যন্ত ইমন আর না পেরে নিজেও হু-হা করে হেসে দিতো। সেসব দিনের কথা ভেবে পিহু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সবকাজ শেষে ইমনের দিকে তাকিয়ে দেখলো এখন মানুষটাকে স্নিগ্ধ লাগছে। পিহু ঝুকে এলো ইমনের মুখে উপর।

.
সকালবেলা আটটার দিকে ইমনের ঘুম ভাঙলো। সময় দেখে বেশ আতকে উঠলো। এতো সময় কিভাবে ঘুমালো সে? তাছাড়া ইশপি তো প্রতিদিন পাঁচটা অথবা সাড়ে পাঁচটার সময় কেঁদে উঠে। আজ এতো নিরবতা দেখে খানিকটা অবাক হলো। তড়িঘড়ি করে পাশে তাকিয়ে দেখলো ইশপি নেই। অনেক ঘাবড়ে গেছে ইমন। লাফ দিয়ে নামলো খাট থেকে। এই কয়েকদিন ইশপিকে নিজের কাছে রাখায় মায়া অনেক বেড়ে গেছে মেয়ের প্রতি। ইশপিকে তো এখন চোখে হারায়। ইমন বিছানার অপরপাশে মেঝেতে দেখলো মেয়ে পরে গেছে কিনা। সেখানও নেই। বুকটা কেঁপে উঠে। ভুলেই গেলো বাড়িতে আরো দুজন মানুষ আছে। দোলনায় চেক করে দেখলো ইশপি দোলনায় ঘুমাচ্ছে। ইমন স্বস্তি পেলো। কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে পুরো মুখে চুমু দিলো। হৃদপিন্ড এখনো ধকধক করছে।

সকালের নাস্তা এখনো বানানো হয়নি মনে হতেই ইশপিকে রেখে কোনোরকমে হাত-মুখ ধুয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। রান্নাঘরে গিয়ে আরেকদফা অবাক হলো। সব রান্না করা আছে। ইমন বুঝে গেলো এটা পিহুর কাজ। সে কষ্ট পাক এটা মোটেও সহ্য করতে পারেনা পিহু। ইমন বেশ অনুতপ্ত হলো সাথে বিষন্ন হলো মন। সে মেয়েটাকে কত কষ্ট দিয়েছে। যা-তা ব্যবহার করেছে। দিনের পর দিন ইগনোর করেছে। অথচ মেয়েটা একটুও রাগ করেনি। না করেছে অভিমান। ইমন সিদ্ধান্ত নিলো আজকেই সে তার পিহুরাণীর কাছে ক্ষমা চাইবে।

________________________
এখন স্নিগ্ধ বিকেল। চারপাশে পাখির কিচিরমিচির ডাক শুনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মৃদু হাওয়া বইছে। ইমন মেয়েকে নিয়ে ছাদে এসেছে প্রকৃতি উপভোগ করতে। এই কয়েকদিনে সে আয়না দেখা তো দূরে থাক খাওয়া-দাওয়া করতে হয়েছে দৌড়ের উপর। এতকাজ এই ছোট্ট সংসারটায়। আর সে কিনা দিনরাত পিহুকে কথা শুনিয়েছে। সেসব ভেবে ফের মন খারাপ হলো। ছাদের দরজার দিকে ফিরলো পিহু এসেছে কিনা দেখার জন্য।

পাঁচ মিনিট পরেই পিহু ছাদে এসে উপস্থিত হলো। আনোয়ারা বেগম জিজ্ঞেস করেছিলো কোথায় যাচ্ছে। পিহু ইনিয়ে বিনিয়ে ছাদে আসার কথা বললো। যদিও তিনি জানেন সব। পিহু ইমনের পাশে দাঁড়িয়ে লম্বা শ্বাস নিয়ে বললো,

— “বাপ-মেয়ে দুটো কি করছেন?”
— “প্রকৃতি দেখছি আর হাওয়া খাচ্ছি। তুমি খেতে চাইলে হা করে থাকো।” ইমন মুচকি হেসে বললো।

পিহু ভীষণ খুশি হলো ইমনের পরিবর্তন দেখে। তবে সেটা ভেতরে চেপে রেখে মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বললো,
— “আপনারা দুজন তো হা করে হাওয়া খাচ্ছেন না। আমি কেনো হা করে খাবো।”
— “প্রকৃতির সাথে আমাদের ভাব হয়ে গেছে। তাই সে আমাদের অন্য ভাবে হাওয়া খাইয়ে দিচ্ছে। তোমার তো ভাব হয়নি।”
— “হুহ ঘোড়ার ডিম।”

কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা চললো। ইমন বুঝতে পারছে না কিভাবে শুরু করবে। পিহু হঠাৎ মনে পরে যাওয়ার মতো করেই বললো,

— “আচ্ছা আপনার আর মায়ের কি হয়েছে বলুন তো? মা কেনো এতোদিন আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে? আমাকে কেনো আপনার সাথে রাখেনি,? আর কেনোই বা আপনাকে দিয়ে ঘরের কাজ করিয়েছে?”

ইমন পিহুর দিকে তাকিয়ে রইলো। কোনমুখে তার কৃতকর্মের কথা বলবে বুঝতে পারছে না। হাসফাস লাগছে। পিহু ফের বললো,

— “বলুন না।”
ইমন লম্বা শ্বাস ফেলে বললো,
— “আসলে তোমাকে অনেক কিছুই বলার আছে।”
— “বলুন।”
— “আমার অফিসের একজোড়া দম্পতি আছে যারা অনেক হ্যাপি। সবসময় ঘুড়তে যাওয়া, একে অন্যকে গিফট দেয়া, ফেসবুকে ছবি দেয়া সবই করতো। সেসব দেখে আমার মনে হয়েছিলো আমি অনেক অসুখি। তাছাড়া বিয়ের আগে আমার অনেক ফ্যান্টাসি ছিলো যা পূরণ হয়নি। আমি চাইতাম আমার স্ত্রী শাড়ি পরবে, খোপায় ফুলের মালা থাকবে তারপর দুজন একসাথে ঘুড়তে যাবো। একসাথে নদীর পাড়ে ঘুরবো। কিন্তু সেসব কিছু না হওয়ায় তাই ক্ষোভ জমেছিলো তোমার প্রতি। বারবার মনে হতো তুমি আমাকে সুখী করতে পারোনি। তাই পরিবর্তন এসেছিলো। ধীরে ধীরে তোমার প্রতি বিরক্তি কাজ করে। অফিসের ফিমেইল কলিগদের কথাবার্তা, চলাফেরা এসব দেখে বাসায় এসে তোমার এলোমেলো চুল, পরনের অগোছালো কাপড় দেখলে বিরক্ত লাগতো। এতসবের পরেও আমি সময় চাইছিলাম তোমার কাছে কিন্তু তুমি কাজে ব্যস্ত হয়ে যেতে বারবার তাই সেইসব ভেবেই দ্বিতীয় বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।”

এতোটুকু বলে থামলো ইমন। পিহুর দিকে তাকালো। মেয়েটা কেমন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইমন পিহুর দিকে এগোলেই পিহু কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে বললো,

— “তারপর বলুন।”
— “এই কয়েকদিনে আমি অনেককিছু উপলব্ধি করেছি পিহু। আমি তোমাকে কখনোই বুঝতে চাইনি। তোমাকে আমিই সময় দেইনি। সবসময় বিরক্তি প্রকাশ করেছি। আমাদের সংসারে অশান্তির কারণ আমিই। আমার পরিবর্তন। আমি বাস্তবতা থেকে ছিটকে পরে ফ্যানটাসিতে ডুবে গিয়েছিলাম। আল্লাহর দ্বীন থেকে সরে গেছিলাম। ভুলে গেছিলাম আমার দায়িত্ব। পিহু আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমিই সত্যিই অনুতপ্ত।”

ইমন থেমে গেলো। পিহু অন্যদিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরপর শরীর কেঁপে উঠছে। ইমন বুঝলো মেয়েটা কাদছে। তার হৃদয়েও ভাঙন হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে গত আটদিন আগের ঘটনার জন্য। লিজা কোনো এককাজে ফোন করেছিলো তাকে। ফোনে কথা বলার সময় পিহু পেছন থেকে জড়িয়ে ধরায় মোবাইল মেঝেতে পরে ভেঙে যায়। রাগের বসে চড় মেরে দিয়েছিলো পিহুকে। সেদিন মেয়েটা টুশব্দও করেনি। চুপচাপ প্রস্থান করেছিলো। সেই মুহুর্তের কথা মনে হলে হৃদয়ে সূচ ফুটানোর মতো যন্ত্রণা হয় ইমনের। এই মুহুর্তে ইমনের ইচ্ছে করছে পিহু জড়িয়ে ধরে শান্তনা দিতে।

বেশ কিছুক্ষণ সময় পর পিহু ইমনের দিকে ফিরলো। চোখ-মুখ ফুলে গেছে এই অল্প সময়ের মধ্যেই। পিহু ইমনকে বললো,

— “আপনি জানেন জান্নাতের দরজায় কি লিখা আছে? ‘আদ দায়ূস্যুই লা ইয়াদ খুলুল জান্নাহ’। অর্থাৎ ‘দাইয়ূস’ কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আর শুনুন ভালোবাসা সেটা নয় যেটা জনে জনে দেখিয়ে বেড়ানো হয়। ভালোবাসা দেখানোর জিনিস নয় অনুভব করার জিনিস। আমি আপনাকে ভালোবাসি ইমন। আর আমি কখনোই চাইবো না আমার ভালোবাসার মানুষ আমার কারণে জাহান্নামী হোক। আচ্ছা বলুন তো আপনার কাছে কোন ব্যাপারটা বেশি ভালো লাগবে। আপনার স্ত্রীর দেহের সাইজ রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে সবাই দেখছে আর উপভোগ করছে সেটা? নাকি আপনার স্ত্রীর নখের কোনা আপনি ছাড়া আর কোনো পুরুষ দেখেনি সেটা?”

পিহু আর দাড়ালো না। দ্রুত নিচে নেমে এলো। ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার। রুমে এসে চুপচাপ বারান্দায় বসে রইলো। আনোয়ারা বেগম পিহুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে অবাক হলেন। তিনি জানেন পিহু ইমনের সাথেই ছিলো। হঠাৎ এমন কি হলো দুজনের মাঝে বুঝতে পারছেন না৷ সকাল থেকেই তো হাসিখুশি ছিলো মেয়েটা। আনোয়ারা বেগম উঠে ইমনের রুমে গেলেন। দেখলেন ইমন মনমরা হয়ে বসে আছে। তিনি ইমনের পাশে বসে নরম কণ্ঠে বললেন,

— “কি হয়েছে তোমাদের? পিহু কাদছিলো কেনো?”
— “আমি পিহুকে সব সত্য বলে দিয়েছি মা। এবং ক্ষমাও চেয়েছি। জানিনা পিহু আমাকে ক্ষমা করবে কিনা।”

আনোয়ারা বেগম লম্বা নিশ্বাস ফেলে বললেন,
— “শোনো তোমায় কিছু কথা বলি। পিহু সারাদিন রান্নাঘরে গরমে পুরে কাজ করে, তার কোমড়ে কালো দাগ থাকবে স্বাভাবিক। রাত জেগে তোমার মেয়েকে পাহারা দেয়, তার চোখের নিচে কালি, মুখে ব্রণ থাকবেই। তোমাকে বাবা ডাক শুনানোর জন্য নিজের স্বাস্থ্যের কথা ভাবেনি। সেই মেয়েটার পেটের মেদ বাড়বেই, শরীরের সৌন্দর্য্য নষ্ট হবেই। এগুলো স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা তোমার ফ্যান্টাসি জগতের ডিজনি ওয়ার্ল্ড নয় যে, নায়িকাদের মতো ত্বকের চামড়া টানটান থাকবে, মুখে কোনো ব্রণ থাকবে না, গায়ে কোনো দাগ থাকবে না, বাচ্চা হওয়ার পরেও স্বাস্থ্যের কোনো পরিবর্তন হবেনা।

তুমি যেসব মেয়েদের দেখে তাদের সাথে পিহুর তুলনা করেছো মিলিয়ে দেখো তারা পিহুর কাছে ঘেষার মতো যোগ্যতা রাখেনা। তারা সারাদিন রুপচর্চা নিয়ে পরে থাকে। তোমার স্ত্রী সারাদিন রুপচর্চায় ব্যস্ত থাকে না। তোমার জন্য রান্না করে। তোমার বাচ্চা সামলায়। তোমার মায়ের সেবা করে। তোমার কাপড় ধোয়, তোমার বাচ্চার হাগু,মুতের কাপড় ধোয়। তোমার মায়ের কাপড় ধোয়। নিজের হাতেই এসব করে। এতোকিছুর পরেও অভিযোগ করেনা। কোনোদিন বলেনি একটা কাজের মেয়ে রাখুন। এসবের ফাঁকে আবার তোমার সেবাও করে। রাতে তোমার মনোরঞ্জন করে। তোমার চামড়ার ত্বক এতো উজ্জ্বল কেনো কখনো ভেবেছো? মেয়েটার ঘষামাজার ফল। তোমার সাথে ঝগড়া করে কত ক্রিম আনলো। কখনো দেখেছো নিজে ব্যবহার করেছে? তোমার জন্যই এনেছে সে।

ছুটির দিনে কখনো মেয়েটার কি খেতে ইচ্ছে করে জানতে চেয়েছো? কখনো দশ টাকা ব্যয় করে মেয়েটার জন্য চকলেট এনেছো? বাসায় ফেরার সময় দশ, বিশ টাকা ব্যয় করে একটা ফুলের মালা অথবা আলতা এনে হাতে দিয়ে বলছো আজ একটু সাজো। কখনো কাজল কিনে দিয়েছো? কখনো মেয়েটাকে নিয়ে চন্দ্রবিলাশ করেছো? বৃষ্টির দিনে একসাথে ভিজেছো? বাসায় ফিরে এলোমেলো চুলের মেয়েটার চুল নিজ হাতে আঁচড়ে দিয়েছো? কখনো মাথায় তেল দিয়ে দিয়েছো? কখনো বাসায় ফিরে বলেছো আজ একটু শাড়ি পরো। সেসব কিছুই করোনি। তবুও তুমি চাও সে তোমার ফ্যান্টাসি জগতের মেয়েদের মতো হোক? ওর কি চাওয়া-পাওয়া নেই? ওর কি খারাপ লাগা, ক্লান্ত লাগা নেই? ওর কি যত্ন পেয়ে ইচ্ছে করেনা? সবসময় শুধু দিয়েই যাবে? বিনিময়ে ওই মেয়েটা তোমার কাছ থেকে কি কিছুই আশা করতে পারবেনা?

ওকে একটু ভালোবাসা দিয়েই দেখো। তোমার দুনিয়ায় সুখের রঙে রাঙিয়ে দিবে। একটা কথা মনে রেখো, সংসার জীবনে রুপ-রঙ চোখ জুড়ায় মন জুড়ায় না। আজকে তুমি আরেকটা বিয়ে করলে কিছুদিন পরেই ফ্যান্টাসি কেটে যেতো। এরপর সেই বিবাহ তোমার গলায় ফাঁস হয়ে আটকে যেতো। না ধরতে পারতে না ছাড়তে পারতে। সবশেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুটো কথা বলি। ‘তোমাদের মধ্যে সেই সবচেয়ে বেশি উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম। পৃথীবির সব দামী সম্পদের চেয়েও একজন পুরুষের কাছে সবচেয়ে দামী হলো দ্বীনদার আদর্শ স্ত্রী।’ হিরা পেয়েছো তুমি। সময় থাকতেই মূল্য দাও।”

____________________________
আজ পুরো একদিন হয়ে গেলো পিহু ইমনের সাথে কথা বলেনা। এমনকি মায়ের রুম থেকেও বের হয়না। খাবার সময় মায়ের সাথে এসে খেয়ে চলে যায়। ইমনের দিকে ফিরেও তাকায়না। পিহুর একদিনের অবহেলায় ইমনের মন যেনো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। আর সে তো প্রায় ছয়মাসের বেশি সময় মেয়েটাকে অবহেলা করেছে। কেমন লেগেছে মেয়েটার তখন? এসব ভেবেই চোখ বন্ধ করে নিলো ইমন। চোখের কর্ণিশ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পরলো।

ইশপি বাবার বুকের উপর বসে খেলছে। আধো আধো স্বরে ‘বাব বা’ বলে ডাকছে। ইমন সেটা খেয়াল করেই উঠে বসলো। মেয়েকে দুই হাতের মাঝে নিয়ে বললো,

— “আবার বলো তো মা।”
— “বাব বা…বাব বা।”

মেয়ের মুখে বাবা ডাক শুনে খুশিতে জড়িয়ে ধরলো। মেয়েকে সামনে এনে পুরো মুখে চুমু দিলো। সামনে বসিয়ে বললো,

— “মা বলতো।”
— “মা..মা।”

ইমন মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হঠাৎই ডুকরে কেঁদে উঠে। আজ পিহুকে খুব মিস করছে। খুব মানে খুব। সে কিভাবে পারলো তার পিহুরাণীকে কষ্ট দিতে। কিভাবে পারলো? বাবার কান্না দেখে ইশমি আবার বললো, ‘বাব বা।’ কাধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে ইমন মাথা তুলে সেদিকে তাকালো। পিহুকে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রথমে অবাক হলো। পরক্ষণেই ঝাপটে ধরে বললো,

— “পিহু আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি অনুতপ্ত। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। প্লিজ মাফ করে দাও।”
— “আজ কি আমরা একটা সুন্দর মুহুর্ত কাটাতে পারি?”
— “তুমি চাইলে প্রতিদিন আমরা সুন্দর মুহুর্ত কাটাবো।”
পিহু মুখ টিপে হেসে বললো,
— “প্রতিদিন আমি ক্লান্ত-ও থাকতে পারি।”

ইমন পিহুর চোখের দিকে তাকালো। মেয়েটার চোখে-মুখে দুষ্টামির রেখা। কিছুক্ষণ টাইম লাগলো পিহুর কথার অর্থ ধরতে। যখন বুঝতে পারলো লাফিয়ে নামলো খাট থেকে। মুহুর্তেই কোলে তুলে ঘুড়তে শুরু করেছে ইমন। পিহুও খিলখিল করে হাসছে। সেই সাথে হাসছে তাদের পিচ্চি মেয়েটা। হাত তালি দিচ্ছে বাবা-মায়ের আনন্দ দেখে। পিহুকে নামিয়ে ইমন ফের পিহুকে আলিঙ্গন করে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। বললো,

— “আমাকে ক্ষমা করেছো তুমি?”
— “হুম করেছি করেছি। এখন আর বাচ্চাদের মতো কাঁদবেন না তো।”

পিহুর কথায় ইমন কান্না থামিয়ে পিহুর দিকে তাকালো। চোখাচোখি হতেই দুজনে ফিক করে হেসে দিলো। ইমন মেয়েকে কোলে নিয়ে পিহুর সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
— “মা বলোতো আম্মু।”
ইশপি হাত তালি দিয়ে বললো,
— “মা…মা। বাব বা..বাব বা।”

দুজনে আবারও হাসতে শুরু করেছে। এরমধ্যেই ইশপি ইমনের গায়ে প্রশ্রাব করে দিয়েছে। ইমন বোকার মতো তাকালো পিহুর দিকে৷ তারপরেই আবার হেসে উঠলো দুজন।

____________________________
আজকের নাস্তা ইমন এবং পিহু দুজনে মিলেই বানিয়েছে। ইশমি তার দাদির সাথে গাড়ি দিয়ে খেলছে বসার ঘরে। দুজনে নাস্তা বানাতে গিয়ে আটা মাখিয়েছে নিজেদের গালে, হাতে। দুষ্টামি করে নাস্তা বানিয়ে টেবিলে রাখতেই ইমনের ফোন বেজে উঠলো। অফিসের কল দেখে রিসিভ করলো। আনোয়ারা বেগম বললেন,

— “কে ফোন করেছে?”
— “অফিস থেকে। আজকেই যেতে বলছে।”
— “ঠিকাছে যা। অনেকদিন তো বন্ধ দিলি।”
— “আচ্ছা। আসো নাস্তা খেয়ে নেই।”

নাস্তা শেষে ইমন রুমে এলো। পিছনে পিহুও এলো। ইমনের কাপড়-চোপড় বের করে দিয়ে চলে যেতে চাইলেই ইমন দুষ্টু হেসে পিহুর পথ রোধ করলো। পিহু বোকার মতো তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছিলো। তার আগেই হেচকা টানে পিহুকে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো ইমন।

.
ইমন অফিসের উদ্দেশ্য বেরিয়ে গেলো। পিহু ইমনের যাওয়া দেখলো। মনটা একটু ছটফট করছে পিহুর। যখন থেকে অফিসের ফোন এসেছিলো তখন থেকেই এমন হচ্ছে। রবের কাছে দোয়া করলো যাতে ইমনের কিছু না হয়। সে যেনো সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসে বাসায়।

এদিকে অফিসে এসে ইমন জানতে পারলো লিজাকে এমডি করা হয়েছে। ইমন আলতো হেসে পাশ কাটিয়ে চলে এলো। এসবে তার কিছু যায় আসেনা। আজকে মেয়ে কলিগদের কিছুটা এড়িয়ে চলেছে। দুপুরের দিকে ক্যান্টিনে খাবার খাওয়ার সময় লিজা ইমনের সামনে এসে বসেছিলো কথা বলার জন্য। ইমন সৌজন্যতার হাসি দিয়ে মোবাইলে ব্যস্ত হয়ে গেলো। খেতে খেতে পিহুর সাথে কথা বলেছে, মেয়ের সাথে কথা বলেছে। অন্যদিনের তুলনায় আজ নিজেকে খুব ফুরফুরা লাগছে ইমনের।

অফিস শেষে নিচে নেমে হাটতে লাগলো ইমন। সামনের টঙ দোকানের সামনে তাদের অফিসের বিখ্যাত সেই কাপেলকে দেখতে পেলো। তবে আজ তারা জোড়া নেই। ইমন সেদিকে এগিয়ে যেতেই লোকটা বললো,

— “আরে ইমন ভাই যে কেমন আছেন?”
— “আছি আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি? তাছাড়া আপনি আজ অফিস এলেন না যে?”
— “অফিস ছেড়ে দিয়েছি। আর বলছেন ভালো থাকার কথা। জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে ওই কালনাগিনী।”
— “মানে? আপনারা তো অনেক হ্যাপি কাপেল ছিলেন তাইনা?”
— “এগুলো সবই লোক দেখানো ছিলো। বস্তুত আমি কখনোই সুখ পাইনি ওর সাথে থেকে৷ সবসময় শুধু আমার টাকা উড়িয়েছে। আব্বা-আম্মার সাথে যা-তা ব্যবহার করেছে। আমাকে বলেছে আমি আমার বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতাম। কত ঠাট বেডির চিন্তা করছেন? তাই বললাম আমার আব্বা-আম্মা যাবে কেন? যাইতে হইলে তুই যা। কিছুদিন আগেই চলে গেলো। পুরুষ মানুষ কখনোই তার স্ত্রীকে অন্য পুরুষের সাথে সহ্য করতে পারেনা। আর সে সারাদিন তার ছেলে বন্ধুদের গা ঘেঁষে চলতো। এসব আর সহ্য হচ্ছিলো না। তাই ছেড়ে দিয়েছি।”

ইমন কোনোরকম আসছি বলে হাটা ধরলো। তাদেরকে দেখে সে নিজেকে অসুখী ভাবছিলো। আর এখন দেখা গেলো তারা নিজেরাই সুখী না। পিহুকে কতটা কষ্ট দিয়েছে সে। সেসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আসার পথে ফুলের দোকান দেখে দাঁড়িয়ে গেলো ইমন। পনেরো টাকা দিয়ে একটা লাল গোলাপ কিনে নিলো। বাসায় এসে কলিংবেল চাপতেই পিহু দরজা খুলে হাসিমুখে দাড়ালো। ইমন কিছু না বলেই ফুলটা বাড়িয়ে দিলো পিহুর দিকে। বিষ্ময়ে পিহু একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেছে৷ ইমনের কাশির শব্দে বাস্তবে ফিরলো। ফুলটা নিয়ে ইমনকে রুমে ঢুকার জায়গা করে দিলো। পিহু যেনো একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলো। এর আগে এতো খুশি আর কখনো হয়নি পিহু। আনন্দে পিহুর ভেতরটা বারবার লাফিয়ে উঠছে।

রুমে এসে বুঝলো ইমন ওয়াশরুমে গেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ফুলটা কানের পাশে গুজে ক্লিপ দিয়ে আটকে দিলো। রাতের খাবার দিলো ইমনকে। খেতে বসে বারবার পিহুর দিকে আড়চোখে তাকিয়েছে ইমন। মেয়েটা বারবার গোলাপটা ছুঁয়ে দিচ্ছে আর মৃদু হাসছে। পিহুর আনন্দ দেখে ইমনের মনেও ভালোলাগায় ছেয়ে গেলো।

______________________________
পরেরদিন ইমন অফিস যাওয়ার পর পিহুর আবার সেই একই ফিলিংস হচ্ছে৷ ইমনের সুস্থতার দোয়া চাইলো পিহু। রুমে গিয়ে গতকালের শুকনো ফুলটা হাতে তুলে নিলো। সেটাই নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলো।

অফিসে আসার পর আজকে লিজা একটু বেশিই গায়ে পরে কথা বলতে চাইছে। যা ইমনের মোটেও ভালো লাগছে না। সেদিন প্রপোজের পর সে হ্যাঁ বা না কিছুই বলেনি। এমনকি লিজাকে কোনো পজিটিভ ইঙ্গিত-ও দেয়নি। তবুও কেন এমন করছে বুঝতে পারছে না ইমন। মনে মনে ভাবলো এই চাকরিটা ছেড়ে দিবে। এরমধ্যেই পিয়ন এসে বলে গেলো এমডি ম্যাম ইমনকে ডেকে পাঠিয়েছি। ইমন একটু অবাক হলো। পরক্ষণেই বিরক্তিতে কপাল কুচকে এলো। বিরক্ত হয়েই এগিয়ে গেলো সেদিকে। রুমে নক করে ঢুকলো। লিজা সামনের চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললো।

এমন বদ্ধ রুমে লিজার সামনে বসে থাকতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছে ইমনের। তারউপর লিজার হাবভাব সুবিধার লাগছে না। লিজা ল্যাপটপ এগিয়ে দিয়ে একটা প্রজেক্ট দেখতে বললো। ইমন সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। এই ফাকে লিজা উপরের কোট খুলে বসলো। ইমন ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে বললো,

— “এটা আমি বুঝেছি ম্যাম।”

লিজার দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো। পাতলা ফিনফিনে শার্টের উপর দিয়ে ভেতরের আন্ডার গার্মেন্টস স্পষ্ট। ইমন তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে বললো,
— “আমি আসছি। পিয়নকে দিয়ে এটা পাঠয়ে দিবেন আমার কাছে।”
— “কুল মিস্টার ইমন। এন্ড ডোন্ট কল মি ম্যাম। এই অফিসে আপনাকে আমার ভালো লাগে একটা বিশেষ কারণে। সেই কারণ কি আপনি জানেন?”
— “আসছি।”

ইমন বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। লিজা পেছন থেকেই ইমনের শার্ট ধরে টান দিয়েছে। লিজার গায়ে যেনো দানবীয় শক্তি ভর করেছে। একটানে ইমন এসে টেবিলের উপর চিৎ হয়েই পরলো। লিজা ইমনের গায়ে সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে বললো,

— “এই অফিসে আপনিই আছে সবচেয়ে জেন্টলম্যান। দ্যাটস হোয়াই আই লাইক ইউ।”

এমডির কেবিন থেকে দস্তাদস্তির আওয়াজ পেতেই সকলে সেদিকে জড়ো হয়ে গেলো। কেউ একজন সাহস করে গিয়ে দরজা খুলার আগেই ইমন দরজা খুলে বেরিয়ে আসার সময় বললো,

— “ইউ ব্লাডি বিচ, চাকরির ভয় দেখাস আমাকে? তোর চাকরি আমি করবো না। এক্ষুনি রিজাইন লেটার দিয়ে যাচ্ছি।”

এরমধ্যেই বড় স্যার চলে এলেন৷ তাকে দেখেই লিজা ইনিয়ে বিনিয়ে বলে সব দোষ ইমনের উপর চাপালো। ইমন হতবাক হয়ে গেলো মুহুর্তেই।

.
ইমনকে বিধ্বস্ত অবস্থায় বাসায় ফিরতে দেখে পিহু এবং আনোয়ারা বেগম দুজনেই অবাক হলেন। সেই সাথে চিন্তিত হয়ে পরলেন। ইমন সোফায় বসে গা এলিয়ে দিলো। পিহু জলদি রান্নাঘরে গিয়ে শরবত বানিয়ে আনলো। ইমনকে দিতেই ঢকঢক করে সব খেয়ে নিলো। আনোয়ারা বেগম ধীরেসুস্থে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে? এতেই ইমন মাকে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেললো। পিহু বেশ ঘাবড়ে গেছে। আনোয়ারা বেগম নিজেও ঘাবড়েছেন। ইমনকে শান্ত করতেই সব খুলে বললো। সব শুনে দুজনেই স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো।

শেষ দিকে বিচারে ইমনই জিতেছে। এর আগেও নাকি লিজার নামে এরকম কিছুর কমপ্ল্যান এসেছিলো। তাই বড়স্যার যথেষ্ট সন্দেহ করেছিলেন লিজাকে। তাছাড়া ইমনের শার্ট পেছনের দিক থেকে ছেঁড়া দেখে তিনি কনফার্ম হয়ে গেছিলেন। পরে সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে দেখার পর লিজাকে বরখাস্ত করেছেন। ইমন আসার সময়ই রিজাইন লেটার দিয়ে এসেছে।

পিহু ইমনকে ধরে নিয়ে গেলো রুমে। সে এখনো সেসব ভুলতে পারছেনা। আজকে আল্লাহ সহায় না হলে যেকোনো কিছু ঘটতে পারতো।

__________________________
সেই ঘটনার অনেকদিন পার হয়ে গেছে। ইমন সারাদিন ভাবনায় ডুবে থাকে কি কাজ করবে। এই ধরনের অফিসে সে আর কাজ করবে না৷ ফ্রিমিক্সিং কাজের ভয়াবহতা সে হারে হারে টের পেয়েছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে এসবই ভাবছিলো ইমন। ভরদুপুরে পিহু ইশপিকে কোলে নিয়ে রুমে ঢুকলো। মেয়েটা ঘুমিয়ে গেছে। ইশপিকে খাটে শুইয়ে দিয়ে পিহু মাথা চুলকাতে লাগলো। ইমন বললো,

— “তোমার মাথায় কি উঁকুন হয়েছে পিহুরাণী?”
— “হ্যাঁ।”
— “আসো তোমার মাথায় উঁকুন দেখি।”
— “আপনি পারবেন?”

ইমন কিছু না বলে পিহুকে টেনে বারান্দায় নিয়ে এলো। নিজে চেয়ারে বসে পিহুকে তার সামনের মোড়ায় বসিয়ে চুলে বিলি কাটতে শুরু করে। পিহুর বেশ ভালো লাগছে। ইমন বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো। উকুন পেয়েছেও কিন্তু বেচারা ধরার আগেই ফুড়ুৎ হয়ে গেছে। ইমন সেসব পিহুকে বর্ণনা করে বলছে আর পিহু হাসছে। দুজনের আনন্দে চারপাশের পরিবেশও যেনো আনন্দিত হয়ে উঠেছে।

.
একমাস পেরিয়েছে। এখনো কোনো কাজ জোগাড় করতে পারলো না ইমন। পিহু রুমে এসে ইমনের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,

— “কিছু কি ভেবে দেখেছেন?”
— “হু। আচ্ছা ব্যবসা করলে কেমন হয়? সেখানে ফ্রিমিক্সিং এর মতো ভয়াবহ কোনো ব্যাপার থাকবে না।”
— “হ্যাঁ। এটা বেশ ভালো আইডিয়া। কি ব্যবসা করবেন?”
— “মাছের ব্যবসা।” দুষ্টু হেসে বললো ইমন।
— “ইহ! আপনার গায়ে সারাদিন মাছের গন্ধ থাকবে।”
ইমন পিহুকে মৃদু আলিঙ্গন করে বললো,
— “কাছে আসবে না তখন?”
— “হু আসবো। লেপ্টে থাকবো আপনার সাথে। তারপর আপনাকে নিজের মনের মতো করে সাজিয়ে নিবো আমি।”
ইমন হেসে ফেললো। পিহু-ও হাসলো।

পরেরদিনই ইমন তাদের বাসার পাশে যেই খালি জমি আছে তাদের সেখানেই দোকান দিবে ভাবছে। মায়ের সাথে কথা বলে তার চাচাদের সাহায্যে কাজে নেমে পরলো। একমাসের মধ্যেই সব কমপ্লিট। ইমন সত্যিই মাছের ব্যবসা শুরু করেছে। সুন্দর করে লাইটিং করেছে দোকান। বড়বড় ডিপফ্রিজ বসিয়েছে। যারা জাহাজে করে মাছ আনে তাদের সাথে কন্ট্যাক্ট করেছে। সব শেষে কিছুদিনই হলো ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। অবশেষে একটা হালাল ব্যবসা শুরু করতে পেরেছে এতেই অনেক খুশি ইমন। রবের কাছে অনেক শুকরিয়া জানায় সে এবং তার পরিবার। যদিও ব্যবসা তেমন একটা ভালো চলে না। তবুও ইমনের বিশ্বাস একদিন তার ব্যবসার খুব উন্নতি হবে।

রাতে বাসায় ফিরে খাওয়া-দাওয়া শেষে পিহু এবং মেয়েকে সোফায় বসিয়ে দিলো ইমন। নিজে তাদের পায়ের কাছে বসে আলতার প্যাকেট বের করলো। পিহু বিষ্মিত হয়ে বললো,

— “আলতা?”
— “হু। তোমার খুব পছন্দের জিনিস এনেছি।”
— “আপনি কিভাবে জানলেন?”
— “তুমি হচ্ছো আমার হৃদয়ের রাণী। তোমার মনের খবর আমি না জানলে কে জানবে?”

খুশিতে পিহুর চোখে নোনাপানি চিকচিক করে উঠলো। ইমন যত্ন করে আলতা লাগিয়ে দিলো পিহুর পায়ে। তারপর লাগালো মেয়ের পায়ে। ইশপিকে কোলে নিয়ে পিহুর হাত টেনে নিয়ে গেলো ছাদে। আজকে তারা তিনজনে চন্দ্রবিলাশ করবে।

.
ইমনের ব্যবসার এখন কিছুটা উন্নতি হয়েছে। দুজন স্টাফ রেখেছে সেই সাথে অনলাইনেও ব্যবসা শুরু করেছে। অল্পস্বল্প যা আয় হয় তাতেই তাদের ছোট্ট সংসার চলে যায় সুন্দরভাবে।

আজকে ইমন দোকানে যায়নি। বাসায় ছিলো। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর মা-মেয়েকে সাজতে বলে সে রান্নাঘরে গেলো। সব কাজ শেষে রুমে এসে দেখলো দুজনে সেজে বসে আছে। ইমন মুচকি হেসে বারান্দার দরজা খুললো। সকাল থেকেই বন্ধ করে রেখেছিলো। এবং ধারা জারি করেছিলো পিহুর জন্য যাতে করে এখানে সে প্রবেশ না করে।

ইমন মাঝারি সাইজের বক্স বারান্দায় নিয়ে সব সাজিয়ে দুজনকে আসতে বললো। পিহু বারান্দায় এসে অবাক হয়ে গেলো। খুশিতে হেসে ফেলে পরেই আবার কেঁদে ফেললো। ইমন পিহুকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,

— “পিহুরাণী কাদছো কেনো?”
— “আপনি কিভাবে বুঝলেন আমার কিছুদিন ধরেই ফুসকা খেতে ইচ্ছে করছিলো?”
— “বললাম না, তুমি আমার হৃদয়ের রাণী। তোমার মনের কথা আমি না জানলে কে জানবে?”

পিহু ফের হেসে দিলো। ইমন বারান্দায় ছোট গোল একটা টেবিল বসিয়েছে। টেবিলের উপর সাদা কাপড় বিছিয়ে সেখানে কিছু ফুল ছড়িয়ে দিয়ে ফুসকার আইটেম সাজিয়েছে। দুইপাশে দুইটা চেয়ার। ইশমি হাত তালি দিয়ে হাসছে। বারান্দায় গ্রিলগুলো লতা ফুল দিয়ে সাজিয়েছে। এককথায় বারান্দাটা অসাধারণ দেখাচ্ছে। পিহু মনে মনে যেমন চাইতো তেমনই।

ইমন একটা চেয়ার টেনে দিয়ে বললো, ‘প্লিজ ম্যাম সিট হেয়ার।”

পিহু মুচকি হেসে এগিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসলো। ইমন ইশমিকে অন্য চেয়ারে বসিয়ে দিলো। ইমন মাথায় গামছা বেধে ফুসকা তৈরি করে পিহুর বাটিতে তুলে দিয়ে বললো,

— “নিন ম্যাম। খেয়ে দেখুন কেমন হয়েছে।”
— “আপনি বসবেন না?”
— “নাহ৷ আজকে আমি আপনাদের দুজনের জন্য ফুসকাওয়ালা। আরেকটা ফুসকা ওর্ডার করুন ম্যাম।”

পিহু খিলখিল করে হেসে দেয়। মায়ের দেখাদেখি ইশমিও হাসে। সেই সাথে যেনো হেসে উঠে বারান্দায় অবস্থান করা প্রতিটা রং-বেরঙের ফুল। বারান্দার বাইরে গাছের ডালে কৌকিল ডাকছে মধুর সূরে। এই বুঝি বসন্ত এসে গেছে।

® ‘নুরুন নাহার’

_________________ সমাপ্ত______________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here