প্রিয় অসুখ ও একাকিনী,পর্ব:১

0
585

“তোমার মতো কালি মেয়েরা গার্লফ্রেন্ড হওয়ার জন্যই ঠিক আছে কিন্তু বিয়ে…? তুমি আমার বউ হবে ভাবলে কী করে? তোমরা একটু আবেগ দেখালেই নিজের কষ্টে অর্জিত টিউশনির টাকা থেকে শুরু করে সব লুটিয়ে দাও সম্পর্ক টিকাতে। তাই তো আমার মতো ছেলেরাও তোমার মতো কালির সাথে সম্পর্ক জুড়ে ব্যবহার করার জন্য। ঠিক যেমন এই টিস্যু, এর প্রয়োজন খালি ঘামটা মোছা অবধি তারপর যায় ডাস্টবিনে। তোমরাও ওরকমই।”

তাচ্ছিল্যের সুরে কথাগুলো বলেই রেলস্টেশন থেকে বের হয়ে ছেলেটি। মেয়েটি রেলস্টেশনের সরব কোণে স্তব্ধ হয়ে চোখ থেকে টপটপ করে পড়ছে নীরব অশ্রু। ঘটনাটি আজও ভাসছে সামিয়ার চোখের সামনে।

খাটে বসে বই পড়ার ফাঁকে লালচে চা বা সাধারণ জনগণের ভাষায় রং চায়ের স্বাদ নিচ্ছিলো, হঠাৎ এক জায়গায় চোখ আটকে যায় তার। নিজের অতীত মনে করিয়ে দিচ্ছে যে।

অতি বেদনা হতাশা জর্জরিত দীর্ঘশ্বাস নির্গত হয় তার দেহ থেকে। বিড়বিড় করে বলে,
“বাড়াবাড়ি সৌন্দর্যহীন বা কুৎসিত মেয়েদের শুধু বিষধর এক অতীত থাকে না, বরং তাদের অতীত, বর্তমান দুটোই তাদের রূপের মতোই শ্রীহীন, কুৎসিত হয়, আর ভবিষ্যৎ…? তার তো ভাবনা করতেই ভয় হয়, না জানি তা কতটুকু ধ্বংসময় হয়!”

এমনসময় দরজায় নক করে কেউ। একটু অবাক হয় সে, তার ঘরে আবার কে এলো? বলা বাহুল্য, একাকি থাকার অভ্যাস তার, এজন্যই আড়ালে তাকে তার রুমমেটরা বলে একাকিনী। তারা ভাবে সে জানে না তার এই বিদ্রূপাত্মক নামটি, কিন্তু না, সে জানে। তবে না জানার ভান করে থাকে। তার ভাবনা কিছুটা ভিন্ন। ভাবনা হলো, যত সমস্যার মুখোমুখি হবে ততোই জটিলতার মাঝে ডুববে।

“কী হলো, সামি! গেট খোল! ”
তার ভাবাভাবির মাঝেই দরজার বাহিরে থাকা নারীটি বিরক্তির সুরে চেঁচিয়ে উঠে। নিশার গলা শুনে সামিয়া তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে যেয়ে দরজা খুলে।

নিশা সম্পর্কে সামিয়ার দুঃসম্পর্কের চাচার মেয়ে, খুব ছোট থাকতেই তার মা মরে যাওয়ায় বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে, বাবার দ্বিতীয় সংসারে স্থান না পেয়ে মেয়েটি যখন বাড়ি ছাড়া হওয়ার দুয়ারে তখন সামিয়ার বাবা সায়রাজ কবির নিশাকে নিয়ে আসে নিজ বাড়িতে। অবশ্য, মেয়ে হিসেবে নয় কাজের লোক হিসেবেই নিয়ে এসেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে মানুষ লাভ ছাড়া কিছু করে না। তবে সামিয়ার মা আলিফা খাতুন প্রচণ্ড আবেগী নারী তিনিই নিশাকে মেয়ের মতো আগলে নেন।

সামিয়া দরজা খুলতেই নিশা হচকচিয়ে ঘরে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে তার দরজা খুলতে এত দেরি কেন হলো। বই পড়ছিল বলে পুনরায় বিছানায় এসে বইয়ে মুখ ডুবায় সে। নিশা এক ঝটকায় বই ছিনিয়ে রুম থেকে দৌঁড়ে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার পূর্বে একদমে শুধু বলে,
“তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে চা বাগান ঘুরতে যামু। কোনো কাহিনী করলে কিন্তু বই দান কইরা দিমু।”

সামিয়া কিছু না ভেবেই তৈরি হতে শুরু করে, কারণ নিশা যা বলে তা করেই। যদিও গরীব ঘরের মেয়ে নয় তবুও হাত গুণা কয়েক হাজার টাকা দেওয়া হয় তাকে। তাই যেখানে নিজের খরচ চালাতেই হিমশিম খায় সে, সেখানে বই কিনা বিলাসিতার চেয়ে কম কিছু নয়। আর কেনা বই আবার কিনা নিছকই এক স্বপ্ন।

সিলেটের চা বাগান ভ্রমণ প্রতিটি মানুষেরই কাম্য, অন্যরা স্থানের সৌন্দর্যের সাথে নিজেদের টক্কর দিতে নিজেদের নানাভাবে সজ্জিত করছে। রূপসী সাজতে কেউ পরছে রঙিন সেলওয়ার-কামিজ, কুর্তি-জিন্স, আবার কেউ নিজকে আবেদনময়ী করে তুলতে জিন্সের সাথে পরছে লো কাট টপ বা উপরের তিন বাটন খোলা রেখে শার্ট। মেকআপের দ্বারা নিজেদের তকের ক্ষুত লুকানোর প্রচেষ্টা তো আছেই। কিন্তু সামিয়া?

তার পরনে যথেষ্ট ঢিলাঢালা কালো এক বোরখা, হিজাব এবং নিকাবের আড়ালে তার চোখ দুটো ছাড়া মুখমণ্ডলের কিছুই দৃশ্যমান নয়। এমন কি তার দেহের কিছুই দৃশ্যমান নয়, হাত-পা জোড়া আর নয়নযুগল ছাড়া। তবে সবাই বোরখা পর্দার জন্য পরলেও, সে পরে নিজের হীনমন্যতার জন্য। তার কুৎসিত রূপ দেখে যদি রাস্তার মানুষজনও তাচ্ছিল্য করে!

সে যে একদম সাজে না এমন নয়। বরং, দুচোখ ভরা নীল কাজল ছাড়া তাকে পাওয়াই যায় না, এতোটাই নীল কাজল প্রিয় ব্যক্তি সে। সাধারণত লেখকগণ কাজলা কালো চোখের রূপে মজলেও সামিয়া পছন্দ নীল কাজল, অন্যান্য নারীদের মতোন তার সাজসজ্জায় কালো কাজল নেই।

সে তৈরি হওয়ার খাণিক বাদেই তার ডাক পড়ে। অতঃপর সবার সাথে যাত্রা শুরু হয় জাতীয় চা বাগানে। গন্তব্যে পৌঁছে সবাই নিজেদের মতো আড্ডা দিতে দিতে হেঁটে চলে যাচ্ছে, নিশা তাকে জোর-জবরদস্তিতে আনলেও সেও সামিয়ার পাশে নেই। কানে আসছে সামনে হেঁটে চলে যাওয়া সকলের মৃদু কানাঘুষা। কেউ ব্যঙ্গ করে বলছে, “ঐ যে একাকিনী!”

কিন্তু আনমনা যুবতীর এসবে ধ্যান নেই সে অথবা ধ্যান না দিতেই কানে এয়ারফোন গুঁজে নিয়েছে। নিজের মতো চা বাগানটা ঘুরে দেখছে। আকাশটা অনেকটাই স্বচ্ছ নীল, শুভ্র রঙের মেঘরাশি ঘুরছে তার মাথার উপর দিয়ে, চা গাছে ভরপুর এবড়োখেবড়ো আনমনা হয়ে পথে হেঁটেই চলেছে সে।

হঠাৎ তার খেয়াল হলো অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে, আকাশের অবস্থাও সুবিধাজনক না, এই যেন অন্ধকার নামবে। চমকিত হয়ে আশেপাশে তাকায় সে, না, কেউ নেই কোথাও। বলা বাহুল্য, এমন একটা দিনে তারা এখানে এসেছে যখন এসব ভ্রমণকেন্দ্র ফাঁকা থাকে বললেই চলে। আশেপাশে কাউকে না দেখে সে একটু ভয়ই পায়। তবুও না ঘাবড়ে যেয়ে বাকিদের খুঁজতে তৎপর হয় সে।

____

আবরার বন্ধুদের সাথে আজ ঘুরতে এসেছে চা বাগানে। গলায় দামী ডিএসএলআর ক্যামেরা ঝুলিয়ে খটাখট বাংলা মায়ের অনন্য প্রকৃতির সুন্দর দৃশ্যগুলো বন্দী করছে। এমন সময় গুমট কান্নার মৃদু আওয়াজ, ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সে।

কালো বোরখা পরা এক নারী দুই হাঁটু জড়িয়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদছে। হুট করেই আবরারের চোখ আটকে যায় নারীটির উজ্জ্বল ছোট ছোট দুই পায়ে যা এমন ভাবে বসায় বোরখা থেকে বের হয়ে গেছে। সে ভাবছে,
“আহা! কী সুন্দর দুই পা! যেন কারো অত্যন্ত মন দিয়ে হাতে তৈরি কারুকার্য তা। আর পায়ে কী মানিয়েছেই না পায়েলটি। যার পা এত সুন্দর সে নিজে কত সুন্দর হবে?”

প্রশ্নটা মাথায় আসতেই নারীটির দিকে এগিয়ে যায় সে। বেশ নমনীয়তার সাথে কাঁধে হাত রাখে।

সামিয়া এমনিতেই ভয় পেয়েছিল তার উপর কারো স্পর্শ পেয়ে চমকিত হয়ে চোখ তুলে তাকায়। আবরার আরেকদফা শহীদ হয় যেন। মুহূর্তেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে চোখে গভীরতা মাপতে। না হরিণীর মতো, না বড় বড় দুই চোখ নারীটির। বরং, সাধারণ নীল কাজলে রাঙানো অশ্রুতে টলমলা ছোট ছোট দুই চোখ, কান্নার ফলেই কাজল লেপ্টে গেছে চোখের নিচের তকের, একটু বিদঘুটে বিষয়। তবুও কেন যেন ভালো লাগছে আবরারের। মনে হচ্ছে,
“নানা অনুভূতি রং খেলায় মেতে আছে এই দুই চোখ, বিশেষ করবে চোখের কোণে জমা এক বিন্দু অশ্রু, তাতো অশ্রু নয়, দামী চকচকে মুক্তা।”

এদিকে সামিয়া অচেনা এক যুবককে নিজের দিকে ঝুঁকে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে ধাক্কা দিয়ে বসে। আবরারের ঘোর ভাঙে। পুনরায় তাকায় এবার তেমন বিশেষ লাগছে না নারীটির চোখকে, বরং চোখ ভর্তি ভয় দেখতে পাচ্ছে নিজের প্রতি।

“ভয় পাবেন না, আমি আপনার কোনো ক্ষতি করবো না। আপনি কাঁদছেন কেন জানতে পারি?”
এই কথায় কিছুটা স্বস্তি পায় সামিয়া। মৃদু গলায় উত্তর দেয়,
“আমি… আসলে আমি ঘুরতে এসেছিলাম রুমমেটদের সাথে। হারিয়ে গিয়েছি।”

আবরার তো অবাক, মেয়েটাকে তরুণীই লাগছে, আর বলে কিনা হারিয়ে গেছে। পরক্ষণেই ভাবে হয়তো নতুন সে। তাই কথা না বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কোন হোটেলে উঠেছেন মনে আছে? তাহলে হয়তো আমি দিয়ে আসতে পারি।”
“না, না, হোটলে নয়। আমি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে পড়ি। আমাকে জাহানারা ইমাম ছাত্রী হলে নামিয়ে দিলেই হবে।”

আবরার আরও অবাক, কেমন অদ্ভুৎ মেয়ে এখানে পড়ে অথচ কিনা এখান থেকে হল পর্যন্ত রাস্তা চিনে না। এ নিয়ে কৌতূহল জমা হলেও প্রশ্ন করে না, মেয়েটার কথাবার্তাতে বরাবরই দ্বিধার ছাপ, প্রশ্ন করে কোনো সমস্যা দাঁড় করাতে চায় না সে।
“চলেন” বলে চুপচাপ সামিয়ার সাথে সাথে হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু অবাক করা কাণ্ড হলো বারবার তার চোখ ঐ দুজোড়া পায়েই আটকে যাচ্ছে। তার বেহায়া চোখ জোড়া বারবার অপেক্ষায় থাকছে কখন মেয়েটা পা বাড়াবে আর বোরখার আড়াল থেকে বের হওয়া পা দুটোর দর্শন পাবে।

চা বাগানের বাহিরে এসে পড়ে দুজন। আবরারের বন্ধুরা সেখানে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাকে একজন নারীর সাথে দেখে সকলের চোখ কপালে। তারা উদ্ভট কিছু বলবে তার পূর্বেই আবরার সামিয়াকে রেখে বন্ধুদের কাছে যেয়ে পরিস্থিতিটা বুঝায়। সবার কৌতূহল এবং বিস্ময় দুটোই দূর হয়। তারা সামিয়াকে হলের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়।

রাত প্রায় আড়াইটা,

আবরার হোটেলে ঘুমানোর চেষ্টা করছে, তবুও ঘুমের রেশ মাত্র নেই তার চোখে। বরং, নয়নযুগলে ভাসছে কালো বোরখার আড়ালে থাকা রমণীর ঐ আকর্ষণীয় দুই জোড়া পায়ের কথা। পাশেই তার বেস্টফ্রেন্ড শামিম শুয়ে ফোনে নিজের বর্তমান প্রেমিকার সাথে চ্যাটিং করছে, হুট করে আবরারকে এমন আনমনা এবং জেগে থাকতে দেখে সে অবাক হয়। কারণ আবরারের স্বভাবের মাঝেই পড়ে না এত রাত অবধি জাগা। সে জিজ্ঞেস করতে আবরার কোনো কিছু না ভেবেই বলে দেয় সব মনের কথা। প্রিয় বন্ধুই তো, কোনোকিছুই কোনোদিন লুকোয় না সে।

সব শুনে শামিমের সে কী হাসি! আবরার ভ্রুঁ কুঁচকে তাকানোতে হাসিয়ে থামিয়ে কিছুটা গম্ভীর ভাব ধরে সে।

“তুই আবার মেয়ের প্রেমে পড়িসনি তো দোস্ত? এত শত ভাবছিস, আবার এত সিরিয়াস ভাবসাব!”

আবরার নিজেই ভাবুক হয় এবার।

“সত্যিই প্রেমে পড়িনি তো অদ্ভুৎ মেয়েটির? মানুষ মুখ দেখে প্রেমে পড়ে, চুল দেখে প্রেমে পড়ে, চোখ দেখে প্রেমে পড়ে শুনেছি, কিন্তু পা দেখে…! কী সাঙ্ঘাতিক ব্যাপারস্যাপার আল্লাহ! মানুষ কী বলবে?”

চলবে…
#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী
– ঈপ্সিতা শিকদার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here