প্রিয় অসুখ ও একাকিনী,পর্ব:২+৩

#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী||২য় পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
“বিয়ের আসর থেকে ভালোবাসার মানুষের ভরসায় পালিয়ে যাওয়ার পর যখন সে মানুষটিই আমাকে স্টেশনে ফেলে চলে যায় এই বলে যে এই কুৎসিত মেয়ে তার যোগ্য নয়, তখনই শেষ হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর যখন কোনো উপায় না পেয়ে বাড়ি ফিরে এলে বাবা-মা আমাকে মৃত বলে তখন দ্বিতীয়বার শেষ হয়ে গিয়েছিলাম। এখন আমার নিকট এই হৃদয়হীন দেহ আর এই অসুখ নামক তুমি ছাড়া কেউ নেই। হ্যাঁ, জানি তুমি আমার মানসিক রোগ বৈকী কিছুই নয়, তবুও যে প্রিয়। তুমিও চলে যাবে? যাও, তবে মরণের শেষ মুহূর্তে তোমার ছোঁয়া এট্টু দিয়ো।”

তার কথা শুনে ছায়ামূর্তিটির কী যে হলো কে জানে সে সম্পূর্ণ নীরব হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ আগে,

মধ্যরাত্রি, তবুও সামিয়ার চোখে ঘুম নেই, জানালা বরাবর থাকা রকিং চেয়ারে গা এলিয়ে আছে। তার বন্ধ চোখজোড়ায় শুধুই অপেক্ষা তার প্রিয় মানুষটির আগমনের, কাব্যের আসার। তখনই তাকে ডেকে উঠে ভারী পুরুষালি গলায় কেউ,

“একাকিনী, ঘুমিয়ে গেলে নাকি? আজ বুঝি বেশি দেরি হয়ে গেল আসতে?”

চোখ বন্ধ অবস্থায়ই হেসে উঠে সামিয়া। অন্ধকার ঘর, আবছা আলোয় এই হাসি দেখা যাওয়ার কথা না। তবুও কোনো কারণেই সেই হাসি ধরা পড়েই কাব্যের চোখে। সে রিনরিনে গলায় বলে,

“আমাকে ঘায়েল করতেই বুঝি বারবার এই হৃদয়ঘাতক হাসি দাও? দাও তবে, তোমাতে তো আমি হাজার বার ঘায়েল হতে রাজি।”

“বাহ! আজকাল আমার হাসিতেও বুঝি দোষ?”

“না, রাগ করেছো আমার উপর একাকিনী? বেশ তাহলে, আর আসবো না তোমার দোয়ারে, আজই দাও আমায় শেষ বিদায়, দেখা হবে ঐ হাশরে।”

বলেই যুবক হাটা শুরু করে ঘরের দরজার দিকে। আবছা আলোয় যুবকের দেহের আকৃতিই বুঝতে পারছে সামিয়া চেহারা বুঝার উপায় নেই। তাকে চলে যেতে দেখে সামিয়া ঘাবড়ে যেয়ে চটজলদি উঠে দাঁড়িয়ে পিছন থেকে ঝাপটে ধরে পুরুষটিকে।

বর্তমানে,

সামিয়া পুনরায় বলল,

“প্লিজ যেয়ো না, কাব্য। তুমি ছাড়া আমার কে আছে বলো? আমি যে বড় একা, সবাই আমায় ত্যাগ করেছে। এই একাকিনীর বিন্দু প্রেমময়, বেদনাময় কথায় রচিয় কাব্য তুমি। তুমি চলে গেলে কাকে বলবো আমার মনের কথাগুলো?”

“কিন্তু আমি যে নেই, আমি যে তোমার মস্তিষ্কের বুনা মিথ্যে এক চরিত্র মাত্র। আমি নিছকই এক অসুখ তোমার, বাস্তব জীবনে আমার অস্তিত্ব তো নেই। ”

“তবুও আমার তোমাকে চাই। তুমি যদি আমার অসুখ হও, তবে প্রিয় অসুখ তুমি এই একাকিনীর। যেই অসুখের অস্তিত্ব শুধু আমার মাঝেই সীমাবদ্ধ।”

চোখে এক বিন্দু অশ্রুজল নিয়ে অত্যন্ত ব্যথাতুর গলায় উক্ত কথাগুলো বলেই কাব্যকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে জড়িয়ে ধরে সে। প্রিয় অসুখের উষ্ণ স্পর্শে চোখ বন্ধ করে ফেলে সামিয়া। থাক না তার বাস্তবতা ভিন্ন, না থাকুক কাব্যের অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে তার মাঝে তো আছে, এটাই যথেষ্ট।

কাব্য সামিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“আজ আকাশে কি থালার মতোন চাঁদ উঠেছে দেখেছো? চলো না আজ চন্দ্রবিলাশ করি।”

“বারান্দা নেই, ছাদও তো বন্ধ।”

“সমস্যা কী তুমি চেয়ারে বসবে আমি তোমার কোলে মাথা ঠেঁকিয়ে ফ্লোরে, হয়ে যাবে আমাদের সীমিত আকারে চন্দ্রবিলাশ।”

কাব্যর কথামতোই সবটা হয়। নানা আলাপ-আলোচনায় মেতে উঠে সামিয়া নিজের প্রিয় অসুখের সাথে। এক পর্যায়ে কাব্য প্রশ্ন করে,

“তুমি যে ঔষধ খাচ্ছো না। নিশা জানলে তো তোমার মাকে বলে দিবে।”

“উহু, ঐটা ঔষধ না বিষ আমার নিকট। যেই জিনিস আমাকে তোমার কাছে আসতে দেয় না তার আমার দরকার নেই। তুমি ভেবো না অত।”

আবারও কথোপকথনে মেতে উঠে তারা। সেই কথার মাঝেই সামিয়া ঘুমিয়ে যায়। আর কাব্যও মিলিয়ে যায় তার সাথেই, কারণ কাব্য নামক চরিত্রের অস্তিত্ব তো তাকে জুড়েই।

___

আজ চারদিন হলো সেই অদ্ভুৎ মেয়েটির সাথে সাক্ষাতের কিন্তু এখনো আবরার মেয়েটিকে ভুলতে পারছে না। না, মেয়েটিকে নয়, ঐ অনিন্দ্যসুন্দর এবং মনমোহিত করার মতো এক জোড়া পাকে। আজ আবরারের ঢাকা ফিরে যাওয়ার দিন, মূলত সিলেটে ভ্রমণের উদ্দেশ্যেই আসা হয়েছিল। কিন্তু সে কী আর জানতো এর বিনিময়ে তাকে নিজের চিন্তা, চেতনা, হাসি, ঘুম সব হারাতে হবে?

আবরার হোটলের বারান্দা ঘেঁষে এক কাপ এক্সপ্রেসো হাতে আবারও ঐ অদ্ভুৎ নারীটির কথাই ভাবছে। তার হৃদয় ছটফট করছে মেয়েটির দর্শন পেতে। তবুও নিজের মনের উপর যথাযথ জোর প্রয়োগ করছে সে। শামিম এসে আনমনা বন্ধুকে দেখে বুঝতে পারে তার মনের অবস্থা।

“যদি মন দিয়ে দিয়েই থাকিস বা ভালোবেসেই থাকিস তাহলে তাকে বলে দিয়েই যা। ভালোবাসা কেন যদি শুধুমাত্র অনেকটা ভালো লেগেও থাকে মেয়েটিকে, তবুও জানিয়ে যা তাকে। যদি একটু শান্তি পাস তাহলে।

নিজের হৃদয়ের উপর আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছে না আবরার। সে ভেবেই নিল, সে যাবে ঐ পা জোড়ার মালিকের দোয়ারে। আর কিছু না হোক যোগাযোগটা রাখার অনুরোধ টুকু সে করতেই পারে। ভেবেই সে শামিমকে নিয়ে যাত্রা শুরু করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সেখানে পৌঁছিয়ে পড়ে আরেক বিড়ম্বনায়। সে না জানে ঐ নারীটির নাম বা অন্যকিছু তবে কীভাবে খুঁজবে? তারপরও এদিক-ওদিক খুঁজে দেখে সে। সামিয়াকে না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে এক জায়গায় বসে পড়তেই মনে পড়ে ছাত্রী হলে যেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতেও তো পারে। কারণ এটুকু তো জানে মেয়েটি হারিয়ে গিয়েছিল ট্রিপ দিতে যেয়ে।

অতঃপর আবার শামিমকে নিয়ে ছুটে হলের উদ্দেশ্যে। শামিম দারোয়ানকে দেখেই চিনে ফেলে ঐদিন মেয়েটিকে এখানে নামায় দেওয়ার সময় এই লোকটি ছিল। তাই শামিম দ্রুত যেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে,

“চাচা আমাকে চিনেছেন? ঐ যে চারদিন আগে কালো বোরখা পরা যেই মেয়েটা হারিয়ে গিয়েছিল তাকে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিলাম, মনে আছে?”

“হ, হ, মনে পড়সে। তা কী হইসে বাবা?”

“আসলে মেয়েটার পার্স আমাদের কাছে রয়ে গেছে। তো আমরা আজ ঢাকা চলে যাচ্ছি, মেয়েটাকে যদি নিচে ডাকতেন ব্যাগটা নিতে…”

এই কথার বিপরীতে লোকটা যা বলল তা শুনতে প্রস্তুত ছিল না শামিম ও আবরার দুজনের কেউই। তিনি বললেন,

“ওহ, সামিয়া মা? কিন্তু উনার তো অনার্স পরীক্ষা শেষ দেইখা একটু আগেই বাড়ি ফেরত যাইতে বাইর হইসে। আর মনে হয় আসবো না এইখানে।”

আবরার এতোটাই বেশামাল হয়ে যায় কথাটা শুনে যে তার হাত থেকে তার প্রিয় ডিএসএলআরটা পড়ে যায়। শামিম ক্যামেরাটা উঠিয়ে কোনোরকম দারোয়ানকে বুঝিয়ে সেখান থেকে সরে আসে আবরারকে নিয়ে। সে আবরারকে বোঝাতে যাবে কিন্তু যুবকের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারে না। শুধু বলে,

“কপালে থাকলে আবার দেখা হবে।”

কিন্তু সত্যিই কি আবার দেখা হবে অদ্ভুৎ নারীটির সাথে? প্রশ্নটা ভাবতেই মাথাটা ভোঁভোঁ করছে তার। কিছু একটা ভাবতেই কোনো মতে নিজেকে সামলে শামিমের সাথে গাড়িতে উঠে আবরার।

___

নিশা ও বাদবাকি মেয়েরা বসেছে একসাথে। আর সামিয়া, সে তো একাই, একাকিনী বলে কথা। তার দুই কানে গুলিস্তানের পঞ্চাশ টাকার এয়ারফোন, আর মুখ ঢেকে আছে বইয়ে।

হঠাৎই শুনতে পায়,

“তোর এই মেয়েটিকে নিয়ে হয়েছে যত জ্বালা রে নিশা!ঐদিন হারিয়ে গেলেই ভালো হতো অন্তত তুই তো বাঁচতি।”

রুমমেটের কথায় নিশাও বিরক্তির সুরে বলল,
“তা যা বলেছিস! পুরা কেয়ারটেকার লাগে নিজেরে। এর সাথে তো আমার কথা বলতেও ভাল লাগে না। কিন্তু কী করব এর বাসায় থাকি, খাই একটু উপরে উপরে মিল না দেখালে তো খারাপ দেখায়।”

“হুম, তাও। আচ্ছা চল, খেতে যাই।”

সামিয়ার চোখে তার বিন্দু বিন্দু নোনাজল জমেছে। যদিও সে সবসময়ই জানে নিশা তাকে খুব একটা পছন্দ করে না, পুরোটাই অভিনয়। তবুও কেন যে কষ্ট পায়, অশ্র‍্য আসে কে জানে?

মেয়েদের আসলেই অশ্রু অনেক। তাদের কারণে অকারণে অশ্রু আসে; রাগে, দুঃখে, হাসিতে, জেদে সবকিছুর একটা মাত্রা হারালের তাদের চোখ সিক্ত হয়। তাদের নোনাজলের সমুদ্র কখনো শোকাবার নয়, যদিও শুকায় তাহলে তাও হবে সাময়িক।

সামিয়াও তো ভিন্ন কেউ নয় এক নারী। তারও কান্না পায়, একই কারণে বারবার কান্না পায়। সে চায় না কাঁদতে, তবুও কাঁদে।

চলবে…
#Ipshita_Shikdar

#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||৩য় পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
কেটে গেছে একমাস। ত্রিশটি দিবস কাটিয়ে উঠতে উঠতে আবরার প্রায় ভুলেই গেছে সেই অদ্ভুৎ মেয়েটিকে। বুড়ো-বুড়ি বলেই তো গেছে, চোখের আড়াল মানেই মনের আড়াল। তবুও কখনো কখনো আবরারের চোখের সম্মুখে ভেসে উঠে ঐ দুটি পা, তখন সূক্ষ্ম এক বেদনার সঞ্চার হয়, যেই বেদনার কারণ সে নিজেই জানে না।

আজ আবরার ঢাকা ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছে, তার বংশের একমাত্র মেয়ের বিয়ে। অবশ্য তার বাড়ি ঢাকার খুব বেশি দূরে নয়, এই বিক্রমপুরের এক ছোট্ট গ্রামে। গুলিস্তানের বাসে উঠে বসতেই পাশের সিটে একটা বোরখাওয়ালি নারীকে দেখতে পায় সে। কেন যেন মেয়েটিকে বড় চেনা চেনা লাগছে। আবরার ধ্যান দেয় না সেসবে, চোখ বন্ধ করে শীটে গা এলিয়ে দেয়, তার মন মেজাজ প্রচুর খারাপ।

উঠার আগে এক বোতল ঠাণ্ডা মজো নিয়েছে বেশ চড়া দাম দিয়েই, কারণ এখানে সবকিছুর দাম অনেকটা বেশিই। সবাই জানে এটা ইল্লিগাল, তবুও কেউ প্রতিবাদ করে না, বরং মানিয়ে নিয়েছে। এটাতেই যত বিরক্তি তার, তবে নিজেও যে প্রতিবাদ করে, তাও না। মেয়েটির হাতে হুমায়ূন আহমেদের “নিষাদ” বইটি দেখে। ল আনমনেই বলে ফেলে,

“মুনির চরিত্রটা কেমন লাগলো আপনার? মিসির আলি সিরিজের নীলুকে কেমন লাগে আপনার?”

মেয়েটি তীক্ষ্ম নজরে তাকালো। একদম পাশে বসা থাকায় নিকাব পরিধানের পরও তা দেখতে পায় আবরার। জিহ্বা কাটে সে। সরি জাতীয় কিছু বলবে তার পূর্বেই ক্ষীণ গলায় উত্তর আসে,

“নীলু বেশ ভালো লাগে তেমন নয়, খারাপ না আর কী। তাকে নিয়ে একখান প্রশ্ন আসে মনে তার ভালোবাসাটা কি হৃদয়ে তৈরি হয়েছে নাকি দেবীর দান? আর মুনির? তাকে বেশ অসহায় লাগে, আবার তার ঘটনাগুলোও বেশ ধোঁয়াশাময়, রিয়েল না হ্যালুসিনেশন প্রশ্ন থেকেই যায়।

আবরার পুনরায় মুখ খুলে।
“তাতো নিশিথিনী বইয়েও থাকে। ইন্ডিংটাই এমন দিয়েছেন লেখক।”

“তা ঠিক। দেবীর অস্তিত্বে প্রশ্ন একটা থেকেই যায়, মানে সে আছে নাকি নেই, এই কনফিউশন দূর হবার নয়। তবে দেবীর সিকুয়েলটা পড়ার সময় একটা গা ছমছম করা ভাব ছিল প্যারানরমাল এক্টভিটিসের ভয় আর কী… কিন্তু নিষাদ আবার হৃদয় ও মস্তিষ্ক সবকিছুকেই চিন্তায় ব্যস্ত করে, গভীর চিন্তায়।”

এ ধরনের নানা বই বিষয়ক কথা বা আড্ডাবাজী হতে থাকে তাদের মাঝে। দুজন বইপ্রেমি পাঠকের দেখা হলে যেমন ভাব জমে দই হওয়ার কথা তেমনটিই ঘটেছে তাদের মাঝে। কিন্তু এতসব কথার মাঝেও আবরার চিনতে পারেনি মেয়েটিকে। এই মেয়েটি আর কেউ নয় সেই অদ্ভুৎ নারী সামিয়া। অবশ্য আজ তার চোখজোড়াও নিকাবের আড়ালে, পায়ে মুজা পরা এজন্যই বোধয়

এদিকে সামিয়াও চিনতে পারেনি আবরার মাস্ক ও সানগ্লাস পরা থাকায়। তবে বেশ উৎফুল্ল সে, আজ প্রায় চার বছর পর সে একজন মানুষের সাথে মন খুলে কথা বলছে। তবে সেও এও মানে আজ তার মুখশ্রী লুকায়িত বলে এবং তার অতীত সম্পর্কে জানে না বলেই লোকটি তার সাথে এত আন্তরিক হয়ে কথা বলছে। দেখলে বা জানলে নিশ্চয়ই দূর দূর করতো।

সামিয়া ও আবরার থেকে বেশ দূরেই বসেছে নিশা। সে বেশ ফোঁস ফোঁস করছে রাগে, ছোটবেলা থেকে কী যেন কারণে সামিয়ার একটু আনন্দ বা সুখও সে দেখতে পারে না। আজও তাতে ব্যাঘাত ঘটাতে সামিয়ার মা আলিফাকে বললেন,

“মামনি, এই ছেলেটা কে গো? সামিয়া যে কথা বলছে।”

কথাটা শুনেই আলিফা চোখ দেয় সেদিকে। এই দৃষ্টিতেই যেন মেয়েকে ধ্বংস করে দিবেন তিনি। সামিয়া বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই তার চোখের বালি। তিনি মনে করেন তার মেয়ে বোধহয় নষ্ট চরিত্রের হয়ে গিয়েছে। অবশ্য এ ঘটনার আগেও যে খুব বেশি ভালোবাসতেন বা আগলে রাখতেন তেমনও নয়, তবে একদম অবহেলা করতেন তাও নয়। তিনি চাইতেন তার রংয়ের তথা শুভ্র এক ফুটফুটে কন্য, কিন্তু কীভাবে যে এমন কন্যার জননী হলেন…

তার ভাবাভাবির মাঝেই বাস থেমে যায়। আলিফা দুই সিট পিছনে বসেছিল সামিয়ার বাস থামতেই হনহন করে এগিয়ে যেয়ে মেয়ের হাত টেনে বাস থেকে নিচে নামান তিনি।

অত্যন্ত ধীর কিন্তু রাগের সুরে বলেন,

“একবার তো মান-ইজ্জত ডুবাইলিই শান্তি হয়নি।”

সামিয়ার চোখ ভিজে আসে। সে খুব করে চাইছে কেউ আসুক তার পক্ষে বলুক, কাব্যের আগমন হোক। কিন্তু সে জানে কাব্য আসবে না, সে যে নেই। বিড়বিড়িয়ে বলে,

“একখান আপন মানুষ দিলে কি খুব বেশি ক্ষতি হতো আল্লাহ?”

আবরার বাসে হতবাক হয়ে বসে আছে। মধ্যবয়স্ক মহিলাটি টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েটির নিকাব মানে চোখ ঢেকে রাখা অংশটি হালকা উঠেছিল, তাতেই কিছুটা চিনে ফেলে সে।

“এ আমার অদ্ভুৎ কন্যা নয় তো? আহ! কী মধু মাখা কণ্ঠ খানাই না তার ছিল!”

তার ভাবাভাবির মাঝেই বাসের হেল্পার এসে নামার জন্য বলে চেঁচিয়ে উঠায় ঘোর ভাঙে আবরারের। চোখ উঠিয়ে দেখে পাতলা গড়নের কালো এক কিশোর। দেখে ভাবে, এই বয়সে সে কতোই না মজা করেছে! আর ছেলেটির মাথা কাজের চিন্তায় ভরপুর। কিছু একটা ভাবতেই নিজের ব্যাগ তুলে দৌঁড়ে নামে সে, না আনাগোনা নেই সেই মেয়েটির। মাথার উপর সূর্যি মামা, প্রচণ্ড গরমে সে দরদর করে ঘামছে, মনে হচ্ছে এই বুঝি অজ্ঞান হয়ে যাবে সে। কিন্তু কথা হলো এই মুন্সিগঞ্জ সদরে কেউই তো তার চিনা নেই, কে তাকে নিয়ে যাবে বাড়িতে? তখনই একটা অটো এসে দাঁড়ায় তার সামনে। অতঃপর চোখের সম্মুখে সবটা অন্ধকার।

আবরার চোখ খুলতেই দেখতে পায় সবুজ বর্ণের ময়লা পড়া ফ্যান ঘুরছে। কিছু মুহূর্ত যায় সবটা মনে করতে, তারপর কোনো কারণ ছাড়াই ডানে তাকাতে যা দেখতে পায় তাতে সারা শরীরে শীতলতা বয়ে যায়। হ্যাঁ, সামিয়ার সেই নীল কাজল লেপ্টানো চোখ দুটো। এবার মুখটা ঢাকা হলেও চোখজোড়া খুলাই। তবুও একদম শতভাগ নিশ্চিত হতে আবরার নিজের দুই নয়ন কচলে মেঝেতে তাকায় উদ্দেশ্য পা দুটো দেখা। না, সেই একই পা।

অদ্ভুৎ নারীটিকে পাওয়ার উত্তেজনায় দিন-দুনিয়ার কথা ভুলে যায় সে, ঝাপটে ধরে সামিয়াকে। কিন্তু আসলেই সামিয়া সত্য তো নাকি নিছকই এক কল্পনা? সত্য হলেও কোথা থেকে এলো?

তার ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই “হায়! হায়!” বোধক শব্দ শুনতে পায় সে। একপলকেই বন্ধন মুক্ত করে সামিয়াকে। তার দাদী সন্দেহ এবং তিরস্কার মিশ্রিত গলায় বলে উঠে,

“আয়হায় নাতি! এ কী করলা! একজন পরনারীকে জড়ায় ধরলা? এই শিক্ষা দিসি বুজি আমরা?”

আবরার আরেক দফা জ্ঞান হারায়, তবে পার্থক্য হলো এবার পুরোটাই অভিনয়। আবার তার মুখে পানি ছিটানো হলো। সে পেশাদার অভিনেতার মতোন জ্ঞান ফেরার অভিনয় করে মাথায় হাত রাখে। ভাবখানা এমন কিছুই বুঝতে পারছে না।

“দাদী তুমি কোথায়?”

“এই যে বাজান! আমি এইখানে? তর কী হইসিল বাজান, আমি রজিম অটোওয়ালারে পাঠাইলাম তরে নিতে হ্যাওয় বিলে যায়া দেহে তুই পইড়া গেসোস মাটিতে। কী হইসিল রে বাজান?”

“আর বোলো না দাদী একটা ইয়া বড় পেত্নীর দিকে নজর গেসিল আমার। ভয় পাইয়া জ্ঞান হারাইসি, ভয়েই তো জ্ঞান ফিরার পর যারে সামনে পাইলাম তারে জড়ায় ধরলাম।”

বলেই সবার আড়ালে প্রেম মিশ্রিত নজরে তাকায় সামিয়ার দিকে। মনে মনে ভাবে,

“এবার বুঝি এই অপরূপা নারীর দর্শন পাবো?”

সামিয়া বেচারি নির্বোধের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার নির্দিষ্ট করে মনে আছে এই ছেলেটিই সেই ভদ্র পুরুষ যে তাকে নিরাপত্তার সাথে হোস্টেল পৌঁছিয়েছিল। কিন্তু বাসে যার সাথে আড্ডা দিচ্ছিল সেও কী এই ছেলে!

চলবে…
#Ipshita_Shikdar

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here