প্রিয় অসুখ ও একাকিনী,পর্ব:৪+৫

#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||৪র্থ পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
আজ কতদিন পর ওয়াইনে ঠোঁট ডুবাচ্ছে আবরার! ভাবতেই মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায়। এই ওয়াইন পানের সূচনাটা কলেজ জীবন থেকে, জীবনের প্রথম ব্রেকআপটা যে সেই সময়ই হয়েছিল।

হঠাৎ ছাদ থেকে খেয়াল করে পাশের বাড়ির সদর দরজার সামনে একটা মেয়ে বসে আছে, পরনে হয়তো শাড়ি। কারণ মৃদু হাওয়ায় শাড়ির আলোড়িত পাড়টা বেশ ভালোই চোখে পড়ছে তার। দ্বিতীয়ত আবরারদের বাড়ি এক তলা, আর সে বর্তমানে ছাদে তথা দু’তলায় দাঁড়িয়ে থাকায় ছাদের হলুদ আলোয় কিছুটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে।

“এই আবরার ভাই, কী এত ভাবছিস?”

পাশ থেকে তার ফুপাতো ভাই অর্ণব বলে উঠে। মুখে “কিছু না” বললেও মনে মনে সে বলে,

“মেয়েটাকে কেন যেন বেশ চেনা চেনা লাগছে। আমার সামিয়া নয়তো?”

বিষয়টা মাথায় আসতেই অনেক কাহিনী করে অর্ণবকে ঘুমাতে পাঠায়। যেহেতু অর্ণব তার থেকে দুই বছরের ছোট, তাই খুব একটা দ্বিমতও করতে পারে না সে, মুখটা ছোট করে নিচে নেমে যায়। আবরার কয়েক মুহূর্তে ছাদে দাঁড়িয়ে নিজেও সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়।

সামিয়া সদর দরজার শুভ্র আলোয় “অন্য ভুবন” বইটি পড়ছে। হঠাৎই চোখের সম্মুখে একটা পুরুষাকৃতি আসতে দেখে, পুরোটাই কাব্যের মতোন দেখতে।

“তবে কি আজ লোকটা তাড়াতাড়ি এসেছে? ইশ! এতোটাই বুঝি মনে পড়ছিল আমায়?”

ভাবতেই অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকায় সে। মোটামোটি কাছাকাছি আসতেই বুঝতে পারে লোকটি অন্যকেউ, কারণ কাব্য সবসময় আবছা আলোয় আসে ছায়ামূর্তি হয়ে, মানুষের মতোন রঙিন হয়ে নয়। দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে, আঁচল ঢাকে মাথা, বইয়ে মনযোগ দেয়।

আবরার দেখে সেই উজ্জ্বল পা, এখনো হাতে বই। দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“এত রাতে ঘরের বাইরে? তাও আবার বই নিয়ে। ”

কিছুটা জড়তা নিয়েই উত্তর দেয়,

“জী, ঘরে দম বন্ধ লাগছিল তাই…”

“ওহ। তা শুধু কি এসব বই-ই পড়েন। রোমাঞ্চকর বই বা রোমান্টিক বই পড়েন না? শরৎ, রবি, সমরেশা তাঁহাদের বই পড়েন না?”

“অত পড়া হয়নি, কিছু কিছু। তবে দেবদাস প্রচণ্ড প্রিয় আমার।”

ধীরে ধীরে জড়তা কাটছে মনে হচ্ছে। আবরার এবার একটা বিষয় খেয়াল করলো, মেয়েটা বই বিষয়ক কথা বললেই একদম সতেজ হয়ে উঠে, মানে প্রচণ্ড বইপ্রেমির ইঙ্গিত, আবার এও বোঝা যায় সে কথা বলতে কাউকে পায় না তেমন

“আপনি রবি ঠাকুরের অপরিচিতা ছোটগল্প পড়েছেন? আপনি যদি কারো জীবনের অপরিচিতা হন তাহলে?”

এই প্রশ্নটা কিছুটা চালাকি করেই প্রশ্ন করে আবরার। সে জানে অপরিচিতা গল্পটা পাঠ্যবইয়েই থাকে, সুতরাং কারো না পড়া থাকার কথা নয়। তাই অপরিচিতার নাম ধরেই ‘প্রেম’ বিষয়ক কথোপকথনের দিকে অগ্রসর হতে চাচ্ছে সে।

“অপরিচিতা আমি…? অপরিচিতা ছিল মায়াবিনী, অপরূপা সুন্দরী; যা দাগ কেটেছিল নায়কের হৃদয়ে। আর কোথায় আমি এক শ্রী হীন নারী। আমার কারো জীবনে অপরিচিতা হওয়ার যোগ্যতা নেই, তবে ‘একাকিনী’ হতে পারি, ‘ অপ্রিয় একাকিনী’।”

হুট করেই সামিয়ার হুশ আসে যে সে এক অচেনা পুরুষেএর সাথে অত কথা বলছে, মুহূর্তেই চোখেমুখে পুনরায় পড়ে দ্বিধার ছাপ।

“আপনি কে? চিনলাম না তো এত কথা বলছেন যে। ”

“ওমা! আমায় চিনলেন না? আমি আবরার, ঐ যে সকালে…”

সকালের ঘটনা মনে পড়তেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠে একাকিনীর চোখজোড়া, আবার কিছু একটা মনে পড়তেই ব্যথিত হয়ে পড়ে সে।

অতীত,

সকালে সামিয়ার ভাবাভাবির মাঝেই আবরার বলে উঠে,

“দাদী, ঐ আম্মা কে? যারে আমি ভুল কইরা জড়ায় ধরলাম।”

“আরে বাজান ওয় তোর আম্মা হয় না। তোর রমিজ কাকার ভাতিজি, রমিজের ঝির বিয়া খাইতে আইসে। ছোড বইনের মতোন আর কী!”

বোন শব্দটা শ্রবণপথে প্রবেশ হতেই মুখটা বিদঘুটে হয়ে যায় আবরারের।

“এহ। যারে বউ বানাইতে চাই, তারে তুমি বোন বানায় দিলা! কী ছিঃ মার্কা কথাবার্তা তোমার দাদী!”

সামিয়া চোখ বড় বড় করে যখন ঘটনাটা দেখছে তখনই তার হাত শক্ত করে চেপে ধরে কেউ। পাশে তাকাতেই দেখতে পারে আলিফা দাঁড়িয়ে। মাকে দেখে মাথা নত করে সে। আলিফা সবার থেকে বিদায় নেয়।

“আম্মা আসি, হ্যাঁ? মাত্র আসলাম সামিয়া রে নিয়া, এহন ওর একটু রেস্ট প্রয়োজন।”

সেখান থেকে বের হতে হতে মেয়েকে নিচু গলায় সতর্কবাণী শুনিয়ে দেয়।

“শোনো মেয়ে, শহরে যা নাম খারাপ করার করসো। এই গ্রামে আমার নাম-ডাক আর মাটিতে মিশায়ো না। সবকিছু থেকে যত দূরে দূরে থাকবা ততোই ভালো।”

সামিয়া শুধু শুনেই যায়, জবাব দেয় না। তবে তার খুব জানতে ইচ্ছে করছে একটু আগের ঘটনায় তার কী দোষ ছিল বা বাসের ঘটনাতেও তার কী দোষ ছিল; একটা ভুলই কি তাকে সব অপরাধের নির্ধারিত অপরাধী বানিয়ে দিল?

বর্তমানে,

“এই যে মিস একাকিনী? কোথায় হারিয়ে গেলেন?”

আবরারের ডাকে ঘোর ভাঙে সামিয়ার। ছেলেটার কথায় রসিকতার সুর থাকলেও সামিয়া চোখে টলমল করছে অশ্রু এবং অসংখ্য দ্বিধা।

“যেসব মানুষদের কেউ নেই তাদের হারাতেই হয়। কখনো অন্ধকারে, কখনো অজানাতে, কখনো মৃত্যুতে, কখনো বা ভাবনা এবং কল্পনাতে।”

থেমে একটু দ্বিধা নিয়েই ” আমি ঘরে যাচ্ছি ” বলে বেশ দ্রুত পায়েই হেঁটে চলে যায় সে। আবরার অবাক চাহনিতে দেখতে থাকে তার যাওয়া। বিড়বিড়িয়ে বলে,

“অদ্ভুৎ! বড় অদ্ভুৎ! আমার একাকিনী! তবে আজও তার দর্শন পাওয়া হলো না।”

(বিঃদ্রঃ বৃষ্টির কারণে কিনা জানি না তবে ওয়াইফাই ছিল না এতক্ষণ। তাই দেরি হলো।)

চলবে…

#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||৫ম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
হলুদের আমেজ সারা ঘরময়, কিন্তু সামিয়া মন খারাপ করে হয়ে বসে আছে বাড়ির এক কোণে। কাল সারাটা রাত পাড় করেছে সজাগ হয়ে, কাব্যের অপেক্ষায়, সে আসেনি।

“আজকাল প্রিয় অসুখটাও বুঝি পর হয়েছে? আমায় সাক্ষাৎ দেয় না। সে জানে না তাকে ছাড়া আমি এক জীবিত লাশ বৈকী কিছুই নয়? সে জানে, অবশ্যই জানে, জানে বলেই এতোটা দাম দেখায়।”

এসব অহেতুক ভাবনার মাঝেই রমিজ সাহেব কাঠের দরজায় কড়া নাড়ে। সামিয়া বিরসভাব নিয়েই দরজা খুলে দেয়, তাকিয়ে দেখে তার জেঠু আব্বু হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

“কী রে মা! সবাই আনন্দ-ফুর্তি করতাসে। তুই এমন ঘরের মদ্দে বইয়া আসোস কে? যা বাইরে যা! এই নে তোর জন্যে হলুদ শাড়ি আনসি আমি, পরলে তোরে যে কী সুন্দর লাগবো!”

বলে রমিজ সাহেব সাদা শপিং ব্যাগটা এগিয়ে দেয়। সামিয়ার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটেছে, উপহার কার না পছন্দ?

“আচ্ছা জেঠু আব্বু, আমি আসছি।”

রমিজ সাহেবর মুখেও হাসি ঝরছে ভাতিজির উজ্জ্বল মুখখানা দেখে। বড় আদরের চোখে দেখেন সামিয়াকে। তিনি মনে করেন এই মেয়ে হলো বংশের উন্নয়ন নিয়ে জন্মিয়েছে, কারণ সামিয়ার জন্মের সময় এই বাড়িটা আর একটা উর্বরা জমি বৈকী কিছুই অবশিষ্ট ছিল না তাদের। আর সামিয়ার জন্মের পর কী এমন হলো কে জানে, বাম্পার ফলন হলো রমিজ সাহেবের জমিতে, আবার সামিয়ার বাবা ব্যবসায় একের পর এক লাভ। এরপর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের।

সামিয়া গেট লাগিয়ে শাড়িটা পড়ে নেয়, অত সাজগোজ করেনি সে, ঐ নীল কাজল টুকুই। আয়নার দিকে তাকাতেই কাব্যের কথা মনে পড়ে যায়। নিজের সাদা প্যাডটা বের করে লিখে,

“প্রিয়,
তুমি চাঁদ হবে আমার? আঁধার রাত্রির চাঁদ? যে চাঁদ আমার অন্ধকার আকাশে একমাত্র আলোর উৎস হবে। আচ্ছা, চাঁদ নাহয় নাহলে, তবে তারা হবে তো? আকাশে ঝলমল করতে থাকা শুকতারা! আমি আগলে রাখবো তোমায় আমার আকাশে তুমি মিটমিট করে জ্বলবে, আমার অন্ধকারচ্ছন্ন আকাশকে মায়াময় বানাবে। আমার আকাশটা যে বড্ড ছন্নছাড়া আর শ্রী হীন তোমায় ছাড়া।
ইতি,
তোমার একাকিনী
সামিয়া। ”

কাগজটা ছিঁড়ে বাহিরে ফেলে দেয় সে।
___

আবরার হাই তুলতে তুলতে চেয়ার স্টেজ সাজাচ্ছে। কাল সারাটা রাত চোখের পাতা লাগাতে পারেনি ঐ নারীর জন্য। শুধু ভেবেছে একাকিনীর কথা। কাজ করতে করতে দৃষ্টি ফেলছে এদিক-ওদিক, একাকিনীর আগমনের অপেক্ষা তার দুই চোখ জুড়ে। আনমনেই বলছে,

“সামিয়াও নিশ্চিত ঘুমাতে পারেনি তাই তো এখনো বাড়ি থেকে বের হয়নি। মেয়েদের তো সিক্সথ্ সেন্স বেশ ভালো, নির্ঘাত আমার প্রেমের দৃষ্টি বুঝতে পেরে আমার ভাবনাতেই রাত পাড় করেছে। আহা! এবার বুঝি প্রেমটা জমবে! না, না, প্রেম না। আমি একবারে বিয়ে করে ঘরে তুলবো আমার একাকিনীকে।”

তারপর মাথায় কিছু একটা আসতেই রমিজ সাহেবের বাড়িতে ঢুকে সে।

“কী গো চাচী! খাইতে দিবেন না? খাইতে আয়া পড়সি।”

মুনিরা বানু গ্যাসের চুলো থেকে খিচুড়ি নামিয়েছে এমন সময় পরিচিত পুরুষালি কণ্ঠে একজন বলে এ কথা। মাটির চুলায় গ্রামের মানুষদের জন্য রান্না হচ্ছে তাই তাকে বাসার সবার রান্না সিলিন্ডার গ্যাসেই রাঁধতে হচ্ছে। যার ফলে চরম বিরক্তি তার, সারাজীবন মাটির চুলোয় রান্নাবান্না তার, তাই এভাবে রান্না তার জন্য মোটেও সন্তুষ্টি জনক নয়। সেই বিরক্তি নিয়েই বাহিরে উঁকি দিলেন তিনি।

“আরে আবরার বাজান, তুমি? আহো, আহো! খিচুড়ি আর ডিম ভাজি খায়া যাও আমগো সবার সাথে।”

আবরার ঠিক এটাই চেয়েছিল। আজ ঠিকই মেয়ের মুখশ্রীর দর্শন পাবে সে, ঘরে বসে খাওয়া তো আর এত মুখ লুকিয়ে সম্ভব নয়। বেশ সহজেই ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ে সে। একে একে সবাই এসে বসে টেবিলে কিন্তু যার অপেজক্ষায় সে, সেই নারী তো আসেনি। মনের সমস্ত আশার প্রদীপ যখন নিভে যাচ্ছে, তখনই কানে আসে চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ। কী যে মধুর সে ধ্বনি!

পাশে তাকায় সে। অত রূপসী নয় যত সে ভেবেছে, তবে চেহারায় অজানা এক মায়া আছে। সত্যিই আছে নাকি তারই এমন লাগছে? গোলগাল মুখ, মাঝারি আকারের গভীর চোখ, জোড়া ভ্রু নয় তবে ধনুকের মতোন আর ঘন আবার প্লাক করার ছাপ নেই, বোঁচকালো কোঁকড়ানো চুল, পুরু ঠোঁট। সব মিলিয়ে সাধারণ মুখশ্রীর এক মেয়ে, বিশেষ কিছু নয়। তবে আবরারের নজর কাটছে একটা দাগ, ঠোঁটের ঠিক উপরে এবং নাকের ঠিক নিচে হামের একটা দাগ আছে, যা উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণে বেশ ফুটে আছে।

“কী রে আবরার ঐভাবে ওদিকে তাকিয়ে আছিস কেন?”

মুনিরা বানু ভ্রুঁ কুঁচকে প্রশ্ন করেন। আবরারের ঘোর ভঙ্গ হয়, তাকিয়ে দেখে মেয়েটি আর ঐ জায়গায় নেই, বরং খাবার টেবিলে বসে বিড়াল ছানার মতোন একটু একটু করে খাচ্ছে।

” না, না, কিছু না।”

সেদিন কোনোরকম খেয়েদেয়ে বাড়ি চলে আসে সে। যাওয়ার পথে একটা চিরকুট দেখতে পায়। হ্যাঁ, এই চিরকুটটি আর কারো নয় সামিয়ার লিখা চিরকুটটি। পড়েই উত্তেজিত এবং আনন্দিত হয়ে যায় সে।

“ইয়াহু! আজই ব্যবস্থা করব তোমায় পুরো দমে নিজের করার।”

দাদী কী খুলে বলে যে সামিয়াকে বিয়ে করতে চায় সে। আবরারের বাবা নেই দাদীর কাছেই সে মানুষ, বাড়ির একমাত্র ছেলে সন্তান হওয়ায় চাচা-ফুপুরাও বেশ আদর-সোহাগ দিয়েই বড় করেছে। তাই তার কথা আর ফেলতে পারে না কেউ। সেদিনই রমিজের নিকট প্রস্তাব পাঠায় আবরারের দাদী নাসিমা বেগম।

___

বাসায় সবাই খুশি, আলিফা খাতুন তো পারছে না মেয়ের বিয়ের খুশিতে সারা বাড়িতে মিষ্টি বিলি করর। মেঘ জমে আছে শুধু নিশা ও সায়রাজ কবিরের চেহারায়। সামিয়ার বাবা কিছুতেই পারছে না মেয়ের বিবাহ সম্পর্ক মেনে নিতে এমন একটা চালচুলোহীন ছেলের সাথে, তাছাড়া তার মেয়ের যেই অবস্থা এই ছেলে আগলে রাখতে পারবে কি না তাও এক প্রশ্ন।

“সামিয়ার বাবা, কী এত ভাবছো? এত ভালো জায়গা থেকে বিয়ের সম্পর্ক এসেছে। ছেলে ঢাকা ম্যাডিকেলে সার্জন, আর তুমি কি না এমন উদাস হয়ে বসে আছো?”

“ছেলের ভালো চাকরি থাকলেই হয় না, কেমন ছেলে তা তো জানতে হবে। আমার দশটা না একটাই মেয়ে।”

“শোনো তোমার মেয়ে কোনো সুন্দরী রমণী বা একদম শুদ্ধি নারীও না যে সবদিক দিয়ে ষোল আনা পাবে। এদিকে কেউ জানে না তোমার মেয়ের কাহিনী তা-ই এগিয়েছে। তাই এত না ভেবে চটজলদি বিয়ে করিয়ে দাও।”

স্ত্রীকে কিছু বলতে যেয়েও থেমে যান তিনি। কারণ সায়রাজ জানেন তার স্ত্রী আসলে মেয়ের কোনো বিষয়েই জ্ঞাত নয়।।যে কিছু জানেই না তার কাছে ভালো উপদেশ আশা করাটা বোকামি ছাড়া কিছুই না।

আলিফা খাতুন, রমিজ সাহেব ও মুনিরা বানুর অগ্রাধিকারে বিয়ের কথাকথা পাকাপাকিই হয়ে যায়। নাসিমা বেগম প্রস্তাব দেন,

“যেহেতু কথাবার্তা সব পাকাপাকি হোয়াই গেসে তাহলে কাইলকাই আঙটি পড়ায়া কাবিন কইরা রাখি।”

“যা, আপনারা ঠিক মনে করেন।”

এসব কিছু দেখে জ্বলছে নিশা। এমন সুদর্শন পুরুষ কী করে সামিয়াকে পছন্দ করে ভেবেই পাচ্ছে না সে। প্রকৃতপক্ষে গ্রামে এসে আবরারকে দেখে তার খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। মৃদু বেগুনে বর্ণের ঠোঁটজোরা, ঘন পল্লব বিশিষ্ট চোখ, তীক্ষ্ম নাক, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, লম্বাটে গড়ন পছন্দ না হয়ে উপায় আছে। আবার গায়ের রঙটাও কী সুন্দর! না কালো, না ফর্সা। হিংসার আগুনে জ্বলতে জ্বলতে একটা পরিকল্পনা করে ফেলে সে সামিয়াকে অপদস্থ করার।

এদিকে সামিয়া এ বিষয়ে সামান্যতম জানে না। কথায় আছে, যার বিয়ে তার হুশ নাই আর পাড়া-পড়শির ঘুম নাই। এখানে ঠিক সে দশাই চলছে। সবাই পরেরদিনের জন্য ঘরে আয়োজন করছে, আর সামিয়া নিজের জগতে ডুবে আছে। সে জানেই না বাস্তবে তার জন্য কী এক অপেক্ষা করছে।

___

সকালে চোখের উপর একফালি আলোর আগমনে প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে ঘুম থেকে উঠে সামিয়া। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ শুনতে পায় সে, তারা সামিয়াকে নিজের ভাষায় শুভ সকাল বলছে নাকি তা সে জানে না। তবে মনটা ভালো হয়ে যায় তার। মাথায় উড়না দিয়ে ঘর থেকে বের হয়, উদ্দেশ্য গোসলখানায় যেয়ে হাত-মুখ ধুঁয়ে আসা।

ফ্রেশ হয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখে বিছানায় বাবা বসে। একটু না অনেকটাই অবাক হয় সে।

“মামনি, ওদিকে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এখানে এসে বস।”

ধীর পায়ে খাটে এসে বসে সামিয়া। তার দৃষ্টি মেঝেতে স্থির, কালো রঙের পাকা মেঝে, নতুনত্বের ছাপ আছে। বাবা-মেয়ের মাঝে নীরবতা চলমান, সেই নীরবতাতেই তার মাথায় আসছে যতসব অনর্থক কথাবার্তা।

“তোর এঙ্গেজমেন্ট আজ।”

হুট করেই বলে ফেলেন সায়রাজ কবির। সামিয়া ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তার পানে তাকায়। মেয়ের চাহনিতে ক্ষত-বিক্ষত হয় তার, সায়রাজ জানেন মেয়ের মানসিক অবস্থা। তবুও পাশে আছেন বুঝাতে হাতে হাত রাখেন তিনি।

দরজার আড়াল থেকে আলিফা খাতুন টলমলে চোখে এ দৃশ্য দেখছে। মেয়েটা তারও যে বড় আদরের, তবে ছোটবেলা থেকে কঠোরতা দেখিয়ে বড় করেছেন তিনি। শুনেছেন, বাবা-মায়ের মধ্যে একজন সন্তানের প্রতি নরম থাকলে আরেকজনের হতে হয় শক্ত বা কঠোর। তিনিও তেমনই ছিলেন, তবে এতে অঘোষিত ভাবে তাদের মাঝে দূরত্ব বেড়েই চলেছিল, অবশেষে সম্পর্কের চূড়ান্ত বাজে অবস্থা হয় সামিয়ার সেই ভুল পদক্ষেপে।

“আমার বিয়ে…?”

প্রায় কয়েক মিনিটের নীরবতার পর সামিয়া আশ্চর্যবোধক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, যেন বিষয়টি অবিশ্বাস্য।

“হ্যাঁ, মামনি তোমার বিয়ে। পাশের বাড়ির ছেলেটা দেখেছো না? আবরার? ওর সাথে। ছেলেটা তোমায় ভারী পছন্দ করেছে।”

“মিথ্যে বলছো কেন বাবা? আমার মতোন কুৎসিত নারীকে কেউ কেন পছন্দ করবে?”

“আমি মিথ্যে বলছি না। তাছাড়া তুমি অত ভেবো না। একবার বিশ্বাস করেই দেখো বাবা-মায়ের পছন্দকে।”

সামিয়া আর বলার মতো কিছু ভেবে পায় না, তার ঠোঁট জোড়া শুকিয়ে আসছে। তবে মনে মনে বেশ পুলকিত সে, কিছুটা আনন্দিতও হয়তো। সংসারের স্বপ্ন কোন নারীরই না থাকে? কারো আগের বুনার ইচ্ছে তো কারো পরে, তবে সবারই নিজের আলাদা একটা পৃথিবী চাই। পরক্ষ্ণেই ভাবে,

“কিন্তু কাব্য…?”

___

গাঢ় সাজে বসে আছে সামিয়া, পরনে বেনারসি শাড়ি, চোখে ব্রাউন শেডের উপর নীল কাজল, ঠোঁটে টুকটুকে লাল লিপস্টিক, ফাউন্ডেশন, পাউডার কী নেই তার সাজে! এতদিন সে সাজেনি, তার সাজার যে কোনো কারণ ছিল না।

রমণীরা সাজে দুই কারণে, এক কাঙ্ক্ষিত পুরুষের মন ভুলাতে এবং দুই নিজের রূপের মায়ায় নিজেই হারাতে। আজ সেই কারণ এসেছে তার দরবারে, সুতরাং সাজতে মানা কীসের?

একটু পরেই হয়তো আবরারের পরিবারের সামনে নিয়ে যাওয়া হবে তাকে। আয়নায় চোখ তুলে তাকাতে পারছে না সে লজ্জায়। তার অপেক্ষার অবশান ঘটিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বসার ঘরে।

সোফায় বসার কয়েক মুহূর্ত পরেই কারো মৃদু কথোপকথন শুনতে পায় সে।

“এত সুন্দর পোলা কী কইরা যে এমন মাইয়ারে পছন্দ করলো কে জানে? ”

“তা যা বলসো নিশা আমিও তো তাই ভাবি। না গায়ের রঙ ভালা, না চেহারা। কেমনে যে পছন্দ করলো?”

সায় দেয় মধ্যবয়স্ক মহিলা। সম্পর্কে নিশার আপন চাচী হয়। তাদের কথা শুনে আরও কিছু নারীদের মুখে কয়েক ধরনের বাণী শুনা যায়। এমনিতেই নাচুনু বুড়ি তার উপর ঢোলের বারি, এই প্রবাদই সত্য হতে দেখা যাচ্ছে। অনেক বাঙালিদের স্বভাবই ক্ষুত ধরা, তাই নিশা সুযোগ পেয়ে কথা তুলায় সবাই টিপ্পনী কাটতে দেরি করে না।

সামিয়ার ভালো লাগা, লাজ-লজ্জা সব মাটিতে মিশে যাচ্ছে। তার মাথাটা ভনভন করছে চাপে। মাথাটা চেপে ধরে “চুপ” বলে চেঁচিয়ে উঠে সে, তারপর বিড়বিড়াতে থাকে,

“কাব্য কোথায় তুমি? আমাকে নিয়ে যাও। ওর সবাই পঁচা, কেউ আমাকে ভালোবাসে না। আমি অনেক পঁচা…”

এসব আজগুবি কথা আওড়াতে আওড়াতে সেখানেই জ্ঞান হারায়। সামিয়ার বাবা সায়রাজ দেরি না করে কল লাগান কাউকে। তারপর রমিজ সাহেবের মেয়ে রায়না তার কানে কিছু একটা বলতেই ঠাশ করে এক চড় লাগান নিশার গালে।

আলিফা খাতুন বলে উঠেন,

“কী হলো! তুমি শুধু শুধু মেয়েটাকে মারলে কেন?”

তিনি উত্তর দিবেন তার পূর্বেই সাদা ডক্টরএপ্রোন পড়া এক লোক ঘরে প্রবেশ করেন। সায়রাজ কবির তাড়াতাড়ি তাকে মেয়ের ঘরে নিয়ে যান। ডাক্তার আহসানুল্লাহ সামিয়ার বিপি চেক করে বলেন,

“আপনাকে বলেছিলাম মেয়েটাকে দেখে রাখতে। আবার প্যানিক এটাক করেছে। তবে সমস্যা নেই এখন, আমি সুঁই দিয়ে দিয়েছি একটু পর জ্ঞান ফিরবে।”

“ডাক্তার, ও আবার কাব্য কাব্য করছে। আপনি তো বলেছিলেন পিলগুলো খেলে আর ঝামেলা থেকে দূরে থাকলে এসব সমস্যা হবে না, ঠিক হয়ে যাবে ধীরে ধীরে।”

“ও মনে হয় পিলগুলো খাচ্ছে না।”

আবরার আর চুপ থাকতে পারছে না। তার মাথায় ঘুরঘুর করছে “কাব্য” নামটা। সে জিজ্ঞেস করেই উঠে সামিয়ার বিষয়ে।

সায়রাজ কবির এক সুদীর্ঘ শ্বাস ফেলেন। তিনি কথাগুলো লুকাতে চান না, তাই বলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো সব জানার পর কি আবরার সামিয়াকে কাছে টেনে নিবে? এক মানসিক অসুস্থ মেয়েকে কি কেউ বিয়ে করতে রাজি হতে পারে? পাঠকমহল আপনারা করবেন কাউকে?

চলবে…
#Ipshita_Shikdar

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here