#প্রীতিলতা❤️
#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury
#৪র্থ_পর্ব🍂
আকাশের নিকষ অন্ধকার কাটিয়ে ঊষার আবির্ভাব ঘটেছে কিছুক্ষণ আগে। মুহূর্তের মধ্যে তার উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত করে ফেলল পুরো পৃথিবীটাকে।
আজ সকালটা আমার অন্যরকম ভাবে শুরু হল যেন। ফজরের নামাজ পড়ার পর হঠাৎ মনে পড়ল যে বাবা-মা সকাল ন’টার ট্রেনে ঢাকায় চলে যাবেন। তাই আর এক মুহূর্ত দেরি না করে রান্নাঘরের দিকে ছুটলাম।
গিয়ে দেখলাম রহিমা খালা এখন রান্নাঘরে আসেননি। অন্য দিনগুলোতে দেখেছি খালা আগে এসে সব কিছু কেটেকুটে গুছিয়ে রাখে আর মা দাঁড়িয়ে শুধু রান্না করে।
আমি কেটেকুটে সব কিছু গুছিয়ে রান্না করব। সালোয়ার কামিজের ওড়নাটা কোমরে ভালো করে বেঁধে নিয়ে নেমে পড়লাম কাজে। প্রথমে ফ্রিজ থেকে মাছ আর মাংস বের করলাম।
সেগুলোকে পানিতে ভেজাতে দিয়ে চপিং বোর্ডে পেঁয়াজ, আদা রসুন এর খোসা গুলো সব ছাড়ানো হয়ে গ্্ পানি দিয়ে ধুচ্ছিলাম এমন সময় পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো,
— নতুন বউ । তুমি এহন পাক ঘরে কি করতাছো?
পেছনে রহিমা খালার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললাম,
— খালা আজ আমি রান্না করবো। মা বাবা তো আজ ঢাকায় চলে যাবে অন্যদিন তো মা ই রান্না করে খাওয়ায় আমাদের। আজ না হয় আমি তাদেরকে একটু রান্না করে খাওয়ালাম।
— হায় আল্লাহ..!এই পাগলি মাইয়া বলে কি হুনছো নি..! তা তুমি আমারে ডাকবা না। আমি এসে তোমার হাতে হাতে কইরা দিলে তাড়াতাড়ি হইয়া যাইবো। দেখি সরো। আমি ঝাল পিয়াজ আদা রসুন কুচায় দিতাছি।
কথাগুলো বলে আমার হাত থেকে ডালাটা নিয়ে বটি পেতে কাটতে বসলেন। আমি আর কথা বাড়ালাম না । চাল ধুয়ে পানি ঝরাতে দিলাম।
রহিমা খালা হঠাৎ পেঁয়াজ রসুন কাটতে কাটতে বললেন
—তা নতুন বউ তোমার শরীর এখন ভালা আছে? কাল রাতে কেমনে অসুস্থ হইয়া পরলা।অমন কইরা কেউ রাত্তির বেলায় বৃষ্টিতে ভেজে? কতখানি জ্বর উঠছিল তুমি তো জানো না। তুমি তো বেহুশের লাগান বিছনায় পইড়া ছিল।
আমি হাতে কাজ করতে করতে পেছনে ঘুরে উত্তর দিলাম,
— এখন ভালো আছি খালা। শরীরে একটুও জ্বর নাই।
খালা সহাস্যে বললেন,
— ভালো না হইয়া যাবা কই। আমার ছোট বাজান তোমারে যেমনে যত্ন করছে সুস্থ না হইয়া যাইবা কি? কিন্তু তোমার বোকামির দন্ড হিসাবে বড় সাহেবের কাছ থেকে অনেক কথা হুনছে আমার ছোট বাজান। তুমি এটা মোটেও ঠিক করোনি বউ। এমন কাজ আর কোনদিন করবা না।
আমি হাতে মাছ ধুচ্ছিলাম আর খালার কথা শুনছিলাম। হঠাৎ মনে পড়লো কাল রাতে সাফওয়ান বলতে বলতে থেমে গিয়েছিলেন ,
তুমি জানো তোমার জন্য বাবা আমাকে….
ইশ্ মানুষটাকে আমার জন্য না জানি কত কথা শুনতে হয়েছে?
— না চাচী আর এমন কাজ কোনদিন করবো না।
— এইতো ভালো ম্যাইয়ার লাগান কথা। কাটাকুটি হইয়া গেছে আদা রসুন কি বেটে ফেলাবো।
— জ্বী। আচ্ছা চাচী তোমার ছোট বাবার প্রিয় খাবার কি?
ও মোর খোদা। এ মাইয়া বলে কি? বিয়া হইছে ১০-১২ দিন হইয়া গেল এখনো তোমার বরের প্রিয় খাবার তুমি জানো না?
ইতস্তত করে বললাম,
আসলে চাচির রান্নাঘরে তো মা তেমন ঢুকতে দেয় না। তারপর তোমার ছোট বাবাকে আমি খুব ভয় পাই। তাই আর কি…
আচ্ছা আচ্ছা আমি বলে দিচ্ছি। আমার ছোট বাজান পোলাও, গরুর মাংস ভুনা, সরষে ইলিশ খুব পছন্দ করে। আর গাজরের হালুয়া তার মেলা প্রিয়। বড় বাজানের ও এসব খাবার অনেক প্রিয়। এগুলো হইল দুই ভাইয়ের আর কিছু লাগে না। হে হে হে।
আচ্ছা খালা আপনি গাজর গুলো কুচিয়ে দিতে পারবেন গ্রেটার মেশিনে। আজকে গাজরের হালুয়া বানাবো আর সাথে এগুলো থাকবে।
— আইচ্ছা। যা বলবা এই বান্দা তা কইরা দেবে।
— আচ্ছা তাহলে আমরা কাজে লেগে পড়ি।
— হ।
কথা বলা শেষ করে প্রয়োজনীয় কাজ করা শুরু করলাম কারন হাতে বেশি সময় নেই। আটটার মধ্যে খাওয়ার রেডি করতে হবে।
খালা গাজর কুচাতে কুছাতে বললেন,
— বুঝলা নতুন বউ। বড় বউটা কোনদিন এরকম রান্নাঘরে আইসা, মুখ ফুইটা বলল না খালা আজ আমি রাধুম। এত ছুটির দিন যায়। একটা দিন রান্নাঘরের ধারের কাছে সে আহেনা।
খালা সে হলো ডাক্তার। সারাদিন কত রকম কাজে ব্যস্ত থাকে তারপরে কি আর শরীরে এনার্জি থাকে কাজ করার।
তারপর ও মানুষ নিজের স্বামীর জন্য তো পছন্দমত কিছু একটু রান্না করে। বড় বউ তো তাও করে না।
হাহ্ বড় বাজান হয়তো জানেনা তার বউয়ের হাতের রান্না কেমন?
________🌺🌺_______
ঘড়িতে সকাল ৬.:৩০ বাজে,
গরুর মাংস রান্না প্রায় শেষ। এখন রহিমা খালা ইলিশ মাছগুলো হালকা করে ভেজে তুলে রাখছিলেন ,আর আমি সরিষা বেটে নিচ্ছিলাম। সরিষা ইলিশের জন্য।
রান্নাঘরে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে আসলেন মা।
— ইশ্ কত দেরি হয়ে গেছে। রহিমা তুমি আমাকে ডাকো নি কেন? দেখতো আমি কখন এতো রান্নাবান্না ক….
দুই চুলার উপরে রান্না বসানো দেখে শায়লা বেগম তাজ্জব বনে গেলেন।
একি..! অসুস্থ শরীর নিয়ে রান্নাঘরে কেন এসেছ?
মায়ের কথা শুনে পেছনে ঘুরে মায়ের দিকে তাকালাম। খালা আমার দিকে তাকিয়ে মাছ ভাজার চুলাটা অফ করে মায়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
আবার নতুন বউয়ের জ্বর সেরে গেছে। আপনারা ঢাকায় যাবেন বলে আজ নতুন বউ নিজের হাতে রান্না বান্না করতেছে। আমি এসে দেখি নতুন বউ রান্নাবাড়া শুরু করে দিছে।আমি আপনারে আর কি ডাকুম?
মাংস রান্না শেষ। সরষে বাটা দিয়ে ইলিশ মাছ রান্না হবে এখন তারপর পোলাও আর গাজরের হালুয়া। একদম শেষের গরম গরম রান্না করে টেবিলে দেওয়া হবে। সব নতুন বউ নিজের হাতে রান্না করতেছে। তাই আপনাকে আর ডাকা হয়নি।
মা নিরব অদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। এই চোখ জোড়া আর সাফওয়ানের চোখ জোড়া যেন একই রং তুলিতে আঁকা হয়েছে। তার মত মায়ের চোখের ভাষা বুঝতে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে আমার। বুঝতে পারলাম না তিনি কি রাগ করেছেন নাকি খুশি হয়েছেন। আমি সৌজন্যমূলক হাসি হেসে কাজে লেগে পড়লাম।
আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে মাংসের কড়াইয়ের ঢাকনা তুলে দেখলেন তিনি। পাশের ডেক্সের থেকে ভাজা গরম মসলার গুঁড়ার পাত্র থেকে নিয়ে মসলা নিয়ে মাংসের উপরে ছিটিয়ে দিয়ে গ্যাসের চুলা অফ করে দিলেন। মাংসের কড়াই টা অন্যত্র সরিয়ে রাখলেন।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে নরম কন্ঠে বললেন,
— আরো দুটো আইটেম রান্না করতে হবে। মুরগির রোস্ট আর ফুলকপি গাজর দিয়ে একটা সবজি। বাসায় গেস্ট আসবে। তুমি সরিষা ইলিশটা রান্না করে ফেলো। তারপরে আইটেম দুটো রান্না করবো আমি।
আর রহিমা তুমি পেঁয়াজ আদা রসুন এগুলো বেটে ফেলো আর করে কিছু পেঁয়াজ কুচি করে রাখো বেরেস্তা তৈরির জন্য। দ্রুত হাত চালাও রহিমা।
— জে আপা।
বলে রহিমা নিজের কাজে লেগে পড়লো।
আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে ইতস্ত করে বললাম,
— মা।ওই দুটো আইটেম আমি রান্না করতে পারব। ইলিশ রান্না করতে তো বেশি সময় লাগবে না। এক্ষুনি হয়ে যাবে। আমি রোস্ট রান্না, আর
মা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
— সবাই মিলে একসাথে করলে তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। তুমি দ্রুত সরিষা ইলিশটা বসিয়ে দাও চুলায়। রোস্টের চিকেন কাটাই আছে। তুমি মসলা ম্যারিনেট করবে তাতে।
— আচ্ছা মা।
আমি রান্নার কাজে লেগে পড়লাম। মা ফুলকপি আর গাজর কাটতে কাটতে বললেন,
— বিয়ের আগে কি রান্না শিখেছো নাকি আগে থেকেই করতে?
— হাতে কলমে শিখিনি মা। আম্মু রান্না করতো আর আমি পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। এইটুকুই দেখে দেখে শিখেছি।
— ওহ
মুখে ছোট করে ওহ্ বললেও শায়লা বেগম এর মুখে ফুটে উঠলো তৃপ্তির হাসি। ছেলের জন্য বৌমা নির্বাচন করতে তিনি ভুল করেননি। এবার ছেলেটার মানে মানে শুধরে গেলেই হয় তার।
_________🌺🌺_________
ঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটার একটু বেশি বাজে।
সব রান্না প্রায় শেষের দিকে। শাশুড়ি মা গিয়েছিলেন গোসল করতে গোসল করে রেডি হয়ে রান্নাঘরে এসে জোরে সরে একটা হুকুম চালিয়ে বললেন,
— পোলাও আর হালুয়া তো প্রায় শেষের দিকে এবার যাও তুমি গোসল করে শাড়ি পড়ে আসো। আর সাফওয়ান কেউ বল দ্রুত রেডি হয়ে যেন নিচে নামে।
এত সকালে গোসল করতে হবে শুনে মুখটা কাচুমাচু করে বললাম,
— এত সকালে গোসল করব।
শাশুড়ি মা পাল্টা উত্তর বললেন,
— সারারাত জ্বরে ভুগেছো এখন যদি গোসল না করো শরীর আরো খারাপ হয়ে যাবে। বাথরুমে গিজার আছে । উষ্ণ গরম পানি দিয়ে গোসল করে আসে শরীর ভালো লাগবে।
কথাগুলো কাট কাট গলায় বললেও কথা গুলোর মধ্যে যে কতটা মায়া আর ভালোবাসা ছিল তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম।
খুব বুঝতে পারলাম যে মা আর ছেলে একই ধাঁচের। উপর উপর কঠোরতা দেখালেও ভিতরে ভিতরে কোমলতা বিদ্যমান। বাহ গত ১২ দিনে যে ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি এক রাতের ব্যবধানে তা অনেক খানি বুঝে ফেললাম।
তাই আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত চলে আসলাম।
উপরে উঠেই বাবা মায়ের পাশের রুমটা হচ্ছে পুতুলের। দরজা খুলে উঁকি মেরে দেখলাম ম্যাডাম বিছানায় ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে। পা টিপে টিপে ওর কাছে গিয়ে দেখলাম না এ জেগেই আছে। কাঁথার উপর দিয়ে ওকে চেপে ধরলাম,
— কিরে দুষ্ট বুড়ি আমার সাথে মশকরা করা হচ্ছে।
পুতুল খিল খিল করে হেসে বলল,
— তুমি সব সময় আমাকে কিভাবে ধরে ফেলো প্রীতিলতা?
— ম্যাজিক।
—- তা এখনো উঠছো না কেন ঘুম থেকে?
— উঠতে ভালো লাগছে না।
— আম্মু আব্বু চলে যাবে বলে মন খারাপ?
ও আমার দিকে কিছুক্ষণ নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। তারপর বলল
— না প্রীতিলতা তুমি আছো না আমার মন খারাপ করবে কেন?
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
— একদম মন খারাপ করে না সোনা। মাত্র তো কয়টা দিন। তুমি আর আমি ক্যালেন্ডারে দাগ দিতে দিতে আম্মু আব্বু চলে আসবে।
এখন যাও ফটাফট ফ্রেশ হয়ে নাও সবাইকে নিচে যেতে হবে। গেস্ট আসবে বাসায়। যাও যাও তাড়াতাড়ি যাও।
ওকে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে আমি চলে আসলাম নিজের ঘরে।
এসে দেখি এই মহাশয় ও বিছানার সাথে চিপকে আছে। বালিশের তলায় দুই হাত দিয়ে উবো হয়ে বালিশে মুখ বুজে শুয়ে আছে।
ইশ্ ঘুমানোর কি ছিরি……
ডাকতে গিয়েও হঠাৎ কাল রাতের কথা মনে পড়লো সারা রাত বেচারা জেগে ছিল আমার জন্য। থাক এখন ঘুমাক।
আলমারি থেকে জামা কাপড় নিয়ে ঢুকে গেলাম ওয়াশরুম রুমে।
_________🌺🌺_________
খট করে সিটকিনি খোলার শব্দে আয়নার দিকে তাকালাম। আঁচলটা গায়ে জড়ানো থাকলেও কুচিগুলো আমার হাতে। আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তোয়ালে হাতে মাথা মুছতে মুছতে বের হচ্ছে সাফওয়ান। পরনে ব্ল্যাক টাউজার আর উপরে ব্লু টি-শার্ট পরা।
আগে জানতাম গোসল করলে মেয়েদের স্নিগ্ধ সতেজ লাগে। ছেলেদের যে এত আকর্ষণীয় লাগে জানা ছিল না তো।হাহ্ এটা আমার বর ভাবতেও গর্বে বুক ভরে গেল আমার।
আমাকে কুচি হাতে এরকম অদ্ভুতভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুখে কি যেন বিড়বিড় করে বলে বারান্দায় চলে গেল। আর আমিও আহাম্মকের মত চেয়ে আছি তার পানে।
কাল থেকে সকাল সন্ধ্যা আয়তাল কুরসি পড়ে উনার গায়ে ফুঁক দেবো। কারোর বদ নজর যেন আমার বরের গায়ে না লাগে।
সকাল সকাল খাবার টেবিলে এত রকম পদের প্রিয় খাবার দেখে সকলের মনে যেন আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। এদিক থেকে আমার খুব ভালো লেগেছে ভাইবোনগুলো সবারই প্রায় খাবারের পছন্দের তালিকা একই রকম। তাই একজনের জন্য একটু বেশি করে রান্না করলে দুজনের মন জয় করে নেওয়া যাবে।
বাবা তো উত্তেজনায় বলেই ফেললেন?
— করেছ কি শাইলা? এত রান্না তুমি কখন করলে?
শাশুড়ি মা আমার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বাবাকে বললেন,
— এইসব রান্না তোমার ছোট বৌমা করেছে।
মায়ের কন্ঠে কেমন যেন আমাকে নিয়ে গর্বের আভাস ফুটে উঠলো। মুহূর্তের সবার দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে আটকে পড়লাম।
বাবার সহাসে বললেন,
— তাহলে কিন্তু ভাত আজ আরও এক প্লেট বেশি খাবো। গাজরের হালুয়া কিন্তু আরও এক বাটি চাই আমার।
আমি হেসে বাবাকে বললাম,
— নিশ্চিন্তে খেতে পারেন বাবা। এটা সুগার ফ্রি দিয়ে রান্না করা হয়েছে।
পুতুল ও চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
— আমিও খাব।
বড় ভাইয়া ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
— ওই। তোর আগে আমি খাব চুপ কর তুই। ছোট মানুষ ছোট মানুষের মতো থাক।
সবাই প্রশংসা করলেও টেবিলের ডান পাশে যে বসে আছেন তিনি ছিলেন একদম নীরব।
হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ শোনা গেল। বাবা মা একে অপরের দিকে তাকিয়ে বলল মনে হয় উনারা চলে এসেছেন।
বাবা মা দুজনেই উঠে গেলেন দরজার দিকে। তাদেরকে ভেতরে নিয়ে আসলেন।
পেছনে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি সত্যি…..!
#প্রীতিলতা❤️
#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury
#৫ম_পর্ব🍂
মানুষের জীবনে যত রাগ অভিমান থাকুক না কেন সে অভিমানের উচ্চতা যদি পাহাড় সমান হয় তবে কিছু প্রিয় মুখ আছে যা চোখের সামনে জীবন্ত ভেসে উঠলে মুহূর্তের সব রাগ অভিমানের বরফ গলে পানিতে পরিণত হয় এবং মনকে শীতল করে দিয়ে যায়।
একই যুক্তি আমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হলো। 12 দিনের সমস্ত রাগ অভিমান এই প্রিয় মুখগুলো দেখে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল। মাত্র ১২ দিন তাদের সাথে দেখা হয়নি আমার কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে দীর্ঘ 12 দশক পর আমি তাদেরকে দেখতে পেলাম।
চোখের সামনে মা-বাবাকে দেখে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। কোথায় আছি, কি করছি, সবাই কি ভাববে তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমার এখন এই উষ্ণ আলিঙ্গনটার খুব প্রয়োজন ।ব্যাস…
উফ বুকের ভেতর এত শান্তি লাগছে কেন? মনে হচ্ছে যেন এতদিনের খা খা মরুভূমির মাঝে এক পশলা রহমতের বৃষ্টি। যা শরীর ও মনের সকল দুঃখ, কষ্ট, ক্লান্তিকে নিজের মাঝে শুষে নিয়ে সতেজতায় ভরিয়ে দিচ্ছে আমার সারা শরীরকে।
হাউ মাউ করে কাঁদতে পারিনা কিন্তু অতি আবেগে চোখ জোড়া অশ্রুসিক্ত হতে ভুল করে না।। চোখ থেকে পানি ঝরছে অবিরাম মাকে জড়িয়ে রেখে বাবার দিকে তাকালাম । বাবার চোখ জোড়াও অশ্রুতে টুই টুম্বুর।
এই চোখের অনেক ভাষা আছে। মেয়ের বাবা হওয়ার ব্যর্থতার ভাষা। মেয়েকে এখন তিনি পাত্রস্থ করেছেন।দেখতে ইচ্ছে করলেই যে যখন তখন মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে হানা দেওয়া যায় না। আত্মসম্মান বলেও তো একটা কথা আছে নাকি।
আব্বু আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললেন,
— খালি মায়ের মাঝে আটকে থাকলে হবে। এদিকে যে আমিও এসেছি তোর ভাইও এসেছে আমাদের দিকে একটু তাকাবি না।
— তোমার সাথে আমার কোন কথা নেই। এতদিন একবারও আমার কথা মনে পড়েনি তোমার তাই না।
— মনে পড়েছে তো আমার আম্মাকে। প্রতিনিয়ত মনে পড়ে। কিন্তু সত্যিই আমি অনেক কাজে আটকে গিয়েছিলাম। এবারের মত তোমার ছেলেটাকে মাফ করে দাও। আর এমন ভুল হবে না।
বাবা আমার চোখমুখ মুছে দিতে দিতে বললেন,
—এবার তো কান্না থামান। অনেক তো কাঁদলেন। মুখটা একেবারে লাল করে ফেলেছেন। এত দূর থেকে নিশ্চয়ই আপনার কান্না দেখার জন্য আসি নাই। আসছি আপনার হাসি মুখটা দেখতে।
আম্মু ও চোখের পানি মুছে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে আমার শাশুড়িকে বললেন,
— আসলে এতদিন এভাবে মেয়েটা আমাদেরকে ছেড়ে কখনো থাকে নি তো তাই এমন পাগলামি করছে কিছু মনে করবেন না ভাবি।
আমার শাশুড়ি মা সামনে এগিয়ে এসে বললেন,
— এভাবে বলে আমাদেরকে লজ্জা দিবেন না ভাবি। যেখানে বিয়ের পরের দিনই মেয়েকে আপনাদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা। সেখানে আমরা ওকে বারো দিন আটকে রেখেছি। আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আর ভেতরে আসুন আমরা আপনাদের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছি।
সত্যি বলতে মা বাবাকে আমার পরিবারের সাথে করা আছে আচরণ দেখে প্রতিনিয়ত আমি মুগ্ধ হচ্ছি। আর এতদিনে নিজের মধ্যে গড়া ভুল ধারণা একটু একটু করে ভেঙে যাচ্ছে আমার।
আমি মনে করেছিলাম এরা আত্ম অহংকারী, সৌন্দর্যের পূজারী, অর্থলোভী কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটা আমার ভুল ধারণা। সম্পূর্ণ ভুল কিনা বুঝতে পারছি না। আম্মু আব্বু ভিতরে চলে গেলাম তাদের সাথে।
তখন আমার ভাই প্রীতম এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। ক্লাস নাইনে পড়ে। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। আর
আমার ক্রাইম পার্টনার। আমি যেমন ওর সকল হাঁড়ির খবর জানি। তেমনি ভাবে ও আমার সকল হাড়ির খবর জানে। যখন আমাদের দুজনের মধ্যে ঝগড়া লাগতো তখনই একজন আরেকজনের হাড়ি ফাটানো শুরু হতো।
গলা কাঁপছে আমার ভাইয়ের অনেক কষ্টে বলল,
— আমি তোকে অনেক মিস করি আপু। তুই চল আমার সাথে। আমি আর কখনো কোনো কিছু নিয়ে তোর সাথে ঝগড়া করবো না। তোর রুম তোর ই আছে। সবকিছু সেই ভাবে গোছানো। একটা জিনিস আমি নষ্ট করিনি। তুই আবার ফিরে চল না আপু।
নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্য হয়নি আমার। এবার সত্যিই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম ভাইকে জড়িয়ে ধরে। পৃথিবীর নিয়মটা এত কঠিন কেন? আর সব নিয়মই কেন মেয়েদের জন্য প্রযোজ্য।
সৃষ্টিকর্তা তো জানেন মেয়েদের মন কতটা স্পর্শ কাতর কতোটা আবেগপ্রবণ। তারা যে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে না।
__________🌺🌺_________
ভাইকে নিয়ে ডাইনিং রুমে প্রবেশ করতেই সে সরাসরি গিয়ে সাফওনের পাশে বসে পড়ল। আতঙ্কে আমার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। উনি যদি প্রিতমের সাথে কোন রকম খারাপ ব্যবহার করেন।
কিন্তু আমাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে তিনি প্রীতমের সাথে খুব ভালোভাবে কথা বললেন। এখন আবার দুজনের মধ্যে কি ব্যাপার নিয়ে কথা হচ্ছে। দুজনের হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে স্বস্তি পেলাম।
এগিয়ে গেলাম ডাইনিং টেবিলের দিকে দেখলাম মা সবাইকে সার্ভ করছে। আমি গিয়ে মাকে হাতে হাতে সাহায্য করা শুরু করলাম। সবাইকে সার্ভ করার পর আমি মাকে বললাম,
— মা আপনি এবার বসে পড়ুন খেতে। অলরেডি ৮ টার বেশি বাজে।
— হ্যাঁ বসছি। তুমিও বসে পড়ো। এরপর যার যা প্রয়োজন নিজে নিয়ে নেবে। এখানে তো সবাই আমরা আপন মানুষে বসে আছি তাই না।
আমি মুচকি হেসে বললাম,
— আচ্ছা মা।
আমি আমার আম্মুর পাশে বসলাম। খেতে খেতে হঠাৎ বাবা বলে উঠলেন,
— ভাইজান বললেন না তো খাবার কেমন হয়েছে?
আব্বু হেসে উত্তর দিলেন,
— জী চমৎকার স্বাদের রান্না হয়েছে।
— আপনার মেয়ে রান্না করেছে। মামনি চমৎকার হয়েছে কিন্তু তোমার হাতের রান্না। তোমার কিন্তু একটা উপহার পাওনা রইল। মক্কা থেকে ফিরে এসে তোমাকে উপহার দেব।
সাকলাইন ভাইয়া ও আমাকে ধন্যবাদ জানালো তাকে তার পছন্দের খাবার গুলো রান্না করে খাওয়ানোর জন্য। ভাবি ও রান্নার প্রশংসা করে বললেন,
— রান্না গুলো অসাধারণ হয়েছে।০
সকলের প্রশংসা শুনে আমার মা-বাবার খুশিতে চোখগুলো জ্বলজ্বল করে উঠলো।
তারপর আর কোন কথা হলো না। সবাই খাবারে মনোযোগ দিল।
হঠাৎ সাকলাইন ভাইয়া বাবার উদ্দেশ্যে বললেন,
— বাবা তোমাদের সকাল ন’টার ট্রেন তো ক্যান্সেল হয়ে গেছে। ঢাকা টু খুলনা গামী এক মালবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে। লাইনে কাজ চলছে ঠিক হলে তারপর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হবে। কী করবে এখন?
সবার খাওয়া শেষে হয়ে গেছে। হাত ধুতে ধুতে বাবা বললেন,
— এর পরের শিডিউল কয়টায়? তোমার মাকে নিয়ে বাস জার্নি করা যাবেনা।জানোই তো।
— রাত ৯ টায় বাবা।
— তোমার করিম চাচাকে ফোন দাও। ওই দুটো টিকিট ক্যানসেল করে, রাত ন’টার ট্রেনের জন্য দুটো টিকিট কাটতে বলো। রাত নটার ট্রেনে আমরা ঢাকায় যাব।
তারপর আব্বুর দিকে তাকিয়ে বললেন,
— চলেন ভাইজান। সময় যখন পেয়েছি। অনেকদিন আপনার সাথে বসে দাবা খেলা হয় না। আজ মনের আয়েশ মিটিয়ে দাবা খেলা যাবে।
শেষ করে বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
—চমৎকার রান্না করে খাইয়েছো মা। আর একটু কষ্ট করে দুই কাপ চা বানিয়ে দেবে।
— এক্ষুনি বানিয়ে দিচ্ছি বাবা।
________🌺🌺______
কতদিন পর মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি ,মা আস্তে আস্তে মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে। আর মুখে নানা রকম ঘটনা বলছেন। এ কয়দিন বাড়িতে কি হয়েছে না হয়েছে। আর আমি চুপচাপ মায়ের কোলে শুয়ে সবকিছু শুনছি।
হঠাৎ মা বলে উঠলেন,
— রুমির সাথে তোর কোন যোগাযোগ আছে নাকি? রুমির ব্যাপারে জানিস কিছু?
— ছোট মামার মেয়ে রুমি আপুর কথা বলছো? না ওর সাথে তো আমার কোন যোগাযোগ নেই। সেইতো বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে চলে গেল। জানিনা কি হয়েছে।
— হ্যাঁ। সেই মেয়ে ফেরত এসেছে বাপের বাড়িতে। চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। রুমির স্বামী ওকে মেরে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। বলেছে তার ব্যবসা করার জন্য পাঁচ লাখ টাকা না দিলে রুমিকে আর ঘরে তুলবে না।
চেহারার কি বাজে হাল হয়েছে রুমির। চোখ বসে গেছে। সারা গায়ে মারের দাগ। সারাদিন নাওয়া খাওয়া নেই জানালার ধারে বসে থাকে।
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,
— এমন তো হবেই। বিশ্বাস করে যাকে এত ভালবাসলো, তার জন্য পরিবারের বিরুদ্ধে গেল। সেই যখন বিশ্বাসঘাতকতা করে, তখন তো আর সহ্য করা যায় না।
মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
👉একটা কথা কি জানিস বর্তমানে ছেলে মেয়েরা বাবা মাকে নিজের সব থেকে বড় শত্রু মনে করে। তারা মনে করে বাবা-মায়েরা শুধু তাদের ভুলই ধরতে পারে। কিন্তু এই ভুল ধরার মাঝেই যে সন্তানকে সঠিক পথ দেখানোর মূল মন্ত্র থাকে,
*এটা তারা বুঝতে পারে না। তারা ভুলে যায় বাবা-মা ই একমাত্র সন্তানদের সর্বময় কল্যাণ কামনা করে কিন্তু তারা তো শুধু বাবা মাকে ভুল ই বুঝতে পারে। আর কেউ কেউ এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে বাবা-মার থেকে সন্তানকে আলাদা করে ফেলে। সুযোগ বুঝে মেয়েটাকে এমন ভাবে আঘাত করে তখন সে আঘাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সেই মেয়ের পক্ষে আর সম্ভব হয় না।
এদিক থেকে আমি সৌভাগ্যের অধিকারী। আল্লাহ আমাকে আমার মন মত একটা মেয়ে দিয়েছে। দেখিস তোর অনেক ভালো হবে। আমি আর তোর বাবা সবসময় তোর জন্য দোয়া করি। আর আমাদের জামাইও তো খুব ভালো। আর তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন ও তো খুব ভালো।
আমি মায়ের কোলে আরো আরাম করে শুয়ে বললাম,
— হ্যাঁ মা। আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন খুব ভালো। আর জামাই তো আরো ভালো।
_________🌺🌺_________
কিছুক্ষণ পরে ট্রেন ছেড়ে দেবে ঢাকার উদ্দেশ্যে। বাবা মাকে বিদায় জানানোর জন্য আমরা সবাই এসেছি। আম্মু আব্বু আর প্রীতম রাতের খাবার খেয়ে হজ্বের পরে সবাইকে তাদের বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে বাসায় চলে গেছেন। আসতে চেয়েছিল রেলস্টেশনে কিন্তু বাবাই নিষেধ করল।
নজর গেল মায়ের কোলে বসে থাকা পুতুলের দিকে। মেয়েটা আজ একদম চুপচাপ হয়ে গেছে। যতই মুখে বলুক না কেন হাজার হোক মা-বাবা তার অত দূরে চলে যাচ্ছে মন খারাপ তো স্বাভাবিক। কিন্তু কান্নাকাটি করছে না এটাই অস্বাভাবিক।
পরে ভাবির কাছে শুনলাম এর আগে কয়েকবার বাবা মা পুতুল কে রেখে ১০ দিন পর্যন্ত বাহিরে থেকে এসেছেন।তখন রহিমা খালা আর সাফওয়ান ওকে সামলাতো। এই জন্য সাফওয়ানের জন্য পুতুল এত পাগল।
ট্রেন এখনই ছেড়ে দেবে তাই সকল যাত্রীকে ট্রেনে উঠে বসার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। মা শক্ত করে পুতুলকে কিছুক্ষণ নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখলেন। তারপর ছেড়ে দিলে আমি গিয়ে পুতুলকে কোলে নিলাম। আমাকে বললেন পুতুলের খেয়াল রেখ। বাবা এসে আমাদের দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— ভালো থাকো। মামনি আমার মেয়েটার খেয়াল রেখ।
বলে পুতুলের গালে একটা চুমু দিলেন তারপর বাবা মা সবার থেকে বিদায় নিয়ে ট্রেনে উঠে বসলেন। মুহূর্তের মধ্যে ট্রেন চলছে শুরু করল।হাত নেড়ে আমরা সবাই তাদেরকে বিদায় দিলাম।
পুতুল আমার ঘাড়ে মুখ গুজে ফুপিয়ে কাঁদছে। আমি ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ কোথা থেকে সাফওয়ান এসে আমার কাছ থেকে পুতুল কে নিয়ে নিলেন। এবং বাইরে হেটে চলে যাচ্ছিলেন। আমি তার পিছু পিছু যাচ্ছিলাম।
কিন্তু একটা মেসেজ টোন আমাকে থমকে দিয়েছিল। আর মেসেজটা পড়ে তো আরও বেশি থমকে গেলাম।
চলবে….❣️
[