প্রীতিলতা পর্ব -০৮+৯

#প্রীতিলতা❤️

#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury

#৮ম_পর্ব🍂

সময় আর নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সে তার আপন গতিতে চলতে থাকে। প্রতিদিন নিয়ম করে সূর্য উদয় হয়ে সকালের আবির্ভাব হচ্ছে আবার সাঁঝের বেলায় সূর্য অস্তের মাধ্যমে দিনটার সমাপ্তি ঘটছে।

ঠিক একই ভাবে মাঝখানের কয়েকটা দিন কিভাবে কেটে গেল তা বুঝতেই পারলাম না। এখন পুরো সময়টা আমার ব্যস্ততার সাথেই কাটে। সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে রান্নাবান্না করা, তারপরে পুতুল সোনা কে রেডি করে স্কুলে পাঠানো। আবার ওকে স্কুল থেকে আনতে যাওয়া, দুপুরে খাইয়ে দেওয়া, হোমওয়ার্ক পাশাপাশি আবার কোচিংয়ে নিয়ে যাওয়া। এক কথায় বলতে গেলে বেশ দৌড়ের উপরে আছি আমি।

আর এই মেয়ে তো আমাকে ছাড়া কিছুই বোঝেনা। যদি বলি ড্রাইভার আঙ্কেলের সাথে স্কুল অথবা কোচিংয়ে যাও। ওমনি ছুটে এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলবে,

— প্রীতিলতা। তুমি কিন্তু আমাকে কিপটামো করে ভালোবাসছো। এরকম কিপটামো করলে কিন্তু আমি কান্না করে দেব। আমি আজ কোথাও যাবো না তাহলে এভাবেই সারাদিন তোমার গলা জড়িয়ে ধরে বসে থাকবো। পাগলি মেয়ে তাই না…!

খাইয়ে দিতে গেলেও তার তার আমাকে লাগে, রাতে ঘুম পাড়াতে গেলেও আমাকে লাগে। ঘুমিয়ে গেলে ওকে ঠিকঠাক করে শুইয়ে দিয়ে পা টিপে টিপে চলে আসি আমার ঘরে।

তার মধ্যে আবার আমার আরেক মহাশয় আছে তো।নিয়ম করে তিন বেলা তার পেছনে লাগতে আমার আবার ভুল হয় না। সারাদিন তো গম্ভীর মুখ করেই বসে থাকে। তার থেকে রাগী ফেসটাই আরো বেশি সুন্দর লাগে আমার কাছে। আর যখন খুব রেগে যায় তখন তেড়ে এসে বলে ,

তোমাকে তো আমি….

তখন আমিও মেকি হাসি দিয়ে বলি, ভালবাসতে ইচ্ছে করছে বুঝি। তা বাসুন না আমি কি নিষেধ করেছি নাকি।

এ পর্যন্তই বলার ক্ষমতা আছে তারপর বাবা আমি গা ঢাকা দেই। তখন সামনে থাকা সত্যিই বিপদজনক ধরতে পারলে যদি মার দেন।

কিন্তু এই কয়দিনে সম্পর্কের কেমন উন্নতি হয়েছে তা ঠিক বলতে পারব না । কিন্তু একটা উন্নতি হয়েছে উনার সম্মোধন টা পুরোপুরি ভাবে আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে।

মাঝে মাঝে আবার নাম ধরেও ডাকেন।

তার ওপর আবার রাত্রে বেলায় তার হাতের বাহু জড়িয়ে ধরে ঘুমাই আমি। এটা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। আমি জানিনা তিনি রাত্রে টের পান কিনা। কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে প্রতিদিনই আমার সকাল বেলার ঘুম ভাঙ্গে তার বুকের মাঝে। ব্যাপারটা আমার দারুন লাগে।

***********

যেমন আজকে সকালেও ঘুম থেকে উঠে তার বুকেই নিজের মাথাটা আবিষ্কার করলাম। দুই হাতে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে ছিলাম এতক্ষন। সকাল হয়েছে কিছুক্ষণ আগে ‌। জানালা থেকে পাখির কলকাকলি ভেসে আসছে ‌। শোয়া থেকে সোজা হয়ে উঠে বসে চুল গুলো হাত খোপা করে নিলাম।

তারপর ঝুঁকে সাফওয়ানের ঘুমন্ত মুখটা দেখছিলাম। এই লোকটা দিন দিন এত সুন্দর হয়ে যাচ্ছে কি করে। রান্না তো আমি করছি সে রান্না তো আমিও খাচ্ছি। কই আমি তো সুন্দর হচ্ছি না। কিন্তু একে দেখো দিনদিন যেন রূপ গজাচ্ছে। রূপচর্চা করে নাকি?

নাহ। যা দেখতেছি এবার নিজের দিকেও খেয়াল করতে হবে। না হলে এরপরে বর মশাই আর ফিরেও তাকাবে না। যেহেতু সে ঘুমিয়ে আছে মনের কথা তাই মুখ দিয়েই বললাম। তারপর কপালে চুম্বন দিয়ে। মর্নিং উইশ করতেই দেখি পাশ ফিরে কোলবালিশ জড়িয়ে নিলো। আমি আতকে উঠলাম।

এ ব্যাটা আবার টের পেয়ে গেল নাকি। ওদিকে উকি দিয়ে দেখলাম না ঘুমিয়ে আছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে চলে গেলাম।

_________🌺🌺________

আজ শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তেমন তাড়া নেই আমার। তাই আলসেমি ঝেড়ে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল আমার। ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে এসে দেখি রহিমা খালা কাজ করতে শুরু করে দিয়েছেন। আমাকে দেখে মুচকি হাসি হেসে বললেন,

— আজ তো শুক্রবার। এত তাড়াতাড়ি রান্না ঘরে আইতে গেলা কেন? সারা সপ্তাহেই তো রান্নাবান্না আর পুতুলরে নিয়ে ব্যস্ত থাকো। একটা দিন না হয় খালার হাতের রান্না খাইলা। তোমার মত অত ভালো রান্না করতে না পারলেও আমার হাতের রান্না খাইতে পারবা তুমি।

আমি হেসে দিয়ে বললাম,

— তুমিও তো সারা সপ্তাহ কাজ করো খালা। আমি শুধু রান্নাবান্না করি আর পুতুলের পেছনে আমার সারা দিন কেটে যায় তাছাড়া বাড়ির বাকি কাজ তো তুমি করো। তোমার ও তো বিশ্রামের প্রয়োজন।

হাত বুলিয়ে বললেন,

— তুই অনেক ভালা নয়া বউ। তুমি আমার জন্য এটুকু ভাবছো এটাই আমার কাছে অনেক। তোমার অনেক ভালো হবে।

আমি শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললাম

— আচ্ছা। আজ ইলিশ পোলাও রান্না করব। বড় ভাইয়া অনেকদিন ধরে খেতে চাইছিল তার পাশাপাশি তোমার ছোট বাবা আর পুতুল সোনার ও তো খুব পছন্দ এই খাবারটা।

কিন্তু তোমাদের যে সাকলাইন বাবার শ্বশুর বাড়িতে দাওয়াত আছে আজকে। তোমরা যাবা না?

কিন্তু খালা সেটা তো রাত্রে ডিনারের জন্য যাব। সারাদিন তো আমরা খাওয়া দাওয়া করবো তাই না।

আচ্ছা ঠিক আছে আমি সবকিছু গুছিয়ে দিচ্ছি তুমি শুধু আজকে রান্না করবে আর কিছু করা লাগবে না তোমার। লক্ষী মেয়ের মত আমার পাশে খাড়ায় থাকো।

মুচকি হেসে বললাম ,

—আচ্ছা।

__________🌺____

ঘড়িতে নয়টা বাজে ,

রান্না প্রায় শেষের দিকে।

এবাড়ির সকলের ঘুম থেকে উঠে চা বা কফি খাওয়ার অভ্যাস আছে। বড় ভাইয়ের জন্য কফি, রহিমা খালা দিয়ে এসেছেন।

আর আমি সাফওয়ানের জন্য উইদাউট সুগার এক মগ কফি তৈরি করে নিয়ে আসলাম। মর্নিং ওয়াক করে আসার পর উনার কফির দরকার পরে। খালা কফি দিয়ে এসে আমাকে জানালো সাফওয়ান মর্নিং ওয়াক থেকে ফিরে এসেছে।

তাই আমিও ছুটলাম কফির মগ নিয়ে।সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম।

সাফোয়ান পুতুলের রুমে উঁকি ঝুঁকি মারছে। ব্যাপারটা কি…! আমিও পা টিপে টিপে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তার কাজে এতটাই মগ্ন ছিল যে আমি কখন যে তার পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, সে বুঝতেই পারল না। আমিও সাইট থেকে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখলাম। পুতুল রুমে নেই। ওয়াশরুমে আছে বোধ হয়। কিন্তু উনি কাকে খুঁজছেন তাহলে?

আমি কফিটা সাইডের বক্সের উপরে রেখে ওনার কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম,

— আপনি কি আমাকে খুজছেন কুমড়ো পটাশ?

উনি যেন ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন। তারপর নিজেকে ধাতুস্ত করে আমতা আমতা করে বললেন,

— ন্ না। আমি তো পুতুলকে খুজছিলাম। ওকে দরকার ছিল। তোমাকে খুঁজতে যাব কেন আমি?

— কিন্তু আপনার ভাব ভঙ্গি দেখে তো মনে হচ্ছে আপনি আমাকে খুঁজছিলেন।

— প্রশ্নই আসে না।

— অবশ্যই প্রশ্ন আসে। না হলে আপনি পুতুলের ঘরে এভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছেন কেন। আর পুতুল তো রুমে নেই সেটা দেখতে পেয়েছেন তার পরেও ঝুঁকে কি দেখছেন মশাই?

— বড্ড বেশি কথা বলছো তুমি। এতো কথা বলো কি করে মুখ ব্যথা করে না তোমার?

বাহ্ দারুন কথা ঘোরাতে পারেন তো আপনি। আরে আমি বুঝি। নতুন নতুন বিয়ের পর এমন হয় বুঝেছেন। যতই অস্বীকার করুন না কেন আমি তো বুঝতে পারছি।

তিনি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

— তা কি বুঝতে পারলে তুমি।

আমি অধিক আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে উঠলাম,

— এই যে আপনি খুব খারাপ ভাবে ফেঁসে গেছেন।

— ফেঁসে গেছি মানে?

— হুম। খুব বাজে ভাবে ফেঁসে গেছেন তো। “আমার মায়ায়”। দেখুন না আমি কিন্তু কফি নিয়ে আপনার রুমে আসছিলাম। প্রত্যেকদিন তাই করি। আপনি সেটা খুব ভালো করেই জানেন।

কিন্তু তারপরেও আমাকে না দেখে, থাকতে না পেরে রুম থেকে বেরিয়ে এসে পুতুলের রুমে উঁকি ঝুঁকি মারছেন। আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনি আমার কোন লেভেলের মায়ায় জড়িয়ে গেছেন।

কথাগুলো শুনে সাফওয়ানের রিঅ্যাকশন দেখার মত ছিল। পেটের মধ্যে হাসির ব্লাস্ট হলেও মুখে তা প্রকাশ না করে। মুখে একটা লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে বললাম,

— ইশ্ আপনি যে এ রকম বউ পাগল হবেন আমি বুঝতেই পারিনি।

এ্যাই আপনি আবার আমার প্রেমে পড়ে গেলেন নাতো হুম।

এতক্ষন বকবক করলেও তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার সব হাওয়া বেরিয়ে গেল। রেগে এটোম বোম হয়ে গেছে থুরি কুমড়ো পটাশ হয়ে গেছে।

আমি মেকি হাসি দিয়ে বললাম,

— ঠিক আছে বলা লাগবে না। প্রেমে তো সবাই পড়ে, কজনে আর মুখ ফুটে বলে। থাক আপনাকেও আর বলা লাগবে না।

ব্যাস হয়ে গেল। আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছি এবার দৌড়ানোর পালা। আজ আর নিস্তার নেই। আমি ধীর পায়ে পিছাতে গেলেই উনি খপ করে ধরে ফেললেন আমার হাত। কিন্তুআমার ভাগ্য প্রসন্ন হলো। আমি উনার হাত ফসকে বেরিয়ে এসেছি।

কিছুটা দূরত্ব দাঁড়িয়ে এসে নাকের নিচে একটা আঙ্গুল ঘষে বললাম,

হুহ। আমাকে ধরা অতো সোজা নয় কুমড়া পটাশ। স্কুলে থাকতে ৪০০ মিটার দৌড়ে ফাস্ট হতাম। যতোই চেষ্টা করুন আমার নাগাল আপনি পাবেন না।

আমার কথা শুনে উনি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন,

— হাহ মিকি মাউস এর মত এটুকু শরীর নিয়ে আবার আমাকে চ্যালেঞ্জ করছে। হোয়াট এ জোকস

— কিহ আমি মিকি মাউস।

— কার্টুনের মতই তো দেখতে লাগে তোমাকে।

— আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে ধরে দেখান আমাকে। কেমন পারেন।

বলে দৌড়াতে শুরু করলাম আমি। তিনি ও আমার পিছু নিয়েছেন। আবার তার পেছন থেকে পুতুলের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে।

ওই প্রীতিলতা তোমরা ছোট বাচ্চাদের মত দৌড়াদৌড়ি খেলছো কেন। আমিও খেলব আমাকেও না সাথে।

দৌড়াতে দৌড়াতে ওদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ছাদে চলে আসলাম। এসেই ছোট্ট চিলেকোঠার মধ্যে লুকিয়ে পড়লাম। তার কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা দুজন ও ছাদে এসে পৌঁছালো। এদিকে ওদিকে আমাকে কিছুক্ষণ খোঁজ করে আবার নিচে নেমে গেল ওরা।

তার কিছুক্ষণ পর চিলেকোঠা থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতেই পিছন থেকে কেউ আমার কোমর জড়িয়ে ধরে শূন্যে তুলে ধরলো। হঠাৎ এমন হওয়ার কারণে আমি ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম। সাথে সাথে খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে আসলো আমার কানে। তার সাথে হাত তালির আওয়াজ।

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম পাশে পুতুল দাঁড়িয়ে আছে আর হাত তালি দিতে দিতে বলছে

— হিহিহি। প্রীতিলতা ধরা পড়ে গেছে ।ইয়েএএএএ

তারপর সাফওয়ান আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

কী ম্যাডাম। তখন তো বেশ বলছিলে আমি নাকি ফেঁসে গেছি। এখন তো তুমিই ফেঁসে গেছো আমার হাতের মুঠোর।

বলে শব্দ করে হেসে উঠলেন।এই প্রথম আমি তার প্রাণখোলা হাসির সাক্ষী হলাম।তার হাসির ঝংকারে আমার শরীর নিস্তেজ হয়ে গেল।তার কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে বললাম,

— হ্যাঁ। সত্যি ফেঁসেছি তোমার নেশাক্ত মায়ায়। সে নেশা থেকে হয়তো মৃত্যু ব্যতিত মুক্তি মিলবে না আমার।
#প্রীতিলতা ❤️

#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury

#পর্ব:- ৯🍂

শাওয়ার নিয়ে বের হয়েছি কিছুক্ষণ আগে। টাওয়েল দিয়ে আলতো হাতে চুল মুছে বারান্দায় নেড়ে দিলাম। চুল থেকে এখনো টপটপ করে পানি ঝরছে তাতে আমার কি আমার যে চুল মোছায় ভারী আলসেমি।

বিয়ের আগে মা মুছে দিত চুলগুলো। তেল দিয়ে দিত বেনী করে দিত রাত্রে শোয়ার আগে। আমার চুলের যত্ন আমার মাই করত। আমি শুধু মাথায় করে বয়ে বেড়াতাম।

বারান্দা থেকে রুমে চলে আসলাম। রুম এখন ফাঁকা। সাফওয়ান জুম্মার নামাজ পড়তে গেছে। নামাজ থেকে আসতে এখনো দেরি আছে‌। আমি ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে বসলাম আয়নায় ভেসে ওঠা নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালাম।

গোল্ডেন ব্লাউজের সাথে আসমানী রঙের সিল্কের শাড়ি পড়েছি আজকে। শাড়ি পড়া আমার তেমন পছন্দ না হলেও অপছন্দ নয়। তার কারণ শাড়ি তেমন সামলাতে পারি না।

হঠাৎ সাফওয়ানের কথাগুলো মনে পড়ে গেল।

— শাড়ি সামলাতে পারেন না যখন পড়েন কেন?

আনমনে হেসে উঠলাম আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করলাম,

— কীহ….! সারাদিন শুধু মাথার মধ্যে সাফওয়ান ঘোরে তাই না। সারাদিন কেমন আনমনা থাকিস? অকারণে হাসিস, তোর কি প্রেমের অসুখ করলো নাকি….!

আচ্ছা এই অসুখ কি ছোঁয়াচে? অবশ্যই হ্যাঁ না হলে পৃথিবীতে এত প্রেমিক যুগল আছে কি করে?

ড্রেসিং টেবিলের পাশে রাখা বক্সের উপরে সাফওয়ানের ফটো ফ্রেমের দিকে নজর পড়ে গেল। চোখ ছোট ছোট করে সেদিকে তাকিয়ে বললাম,

— বাধিয়ে দিলেন তো প্রেম অসুখ? এখন এর থেকে মুক্তি পাবো কি করে বলুন তো? আপনি তো আবার প্রেম টেম করবেন না। নিজের চারপাশে অ্যান্টি লাভ রেস্ট্রিকশন মেরে রেখে দিয়েছেন। এখন আমি কোথায় যাই? হুম

উঠে গিয়ে বক্সের এর উপর থেকে তার ছবিটা নিয়ে এসে খাটে বসে বললাম,

—ইস দেখো কত ইনোসেন্ট লাগছে একে। একে দেখে কে বলবে পা থেকে মাথা পর্যন্ত রাগ ঠুসে ঠুসে ভরা। আচ্ছা আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনার জন্য আমার মনে একটা কঠিন সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। যা ধীরে ধীরে আপনাতে বশীভূত করে ফেলেছে আমাকে। মুক্তির প্রতিষেধক ও আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

এখন আপনার পালা ।সেই একই সংক্রমনে আপনাকেও সংক্রমিত হতে হবে কিন্তু। তার পরে না হয় দুজন দুজনের মাঝে প্রতিষেধক খুঁজে নেব‌।

ফটো ফ্রেমটা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে জায়গায় রেখে দিলাম। তারপর ড্রেসিং টেবিলের থেকে লোশন নিয়ে হাতে পায়ে আলতো করে মেখে নিলাম। ক্রিমটাও মুখে লাগিয়ে নিলাম। আমার সারা জীবনের সাজগোজ। তারপর চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে গিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মাথায় আসলো আজ কাজল পড়লে কেমন হয়।

ড্রয়ার টেনে খুঁজতে শুরু করলাম কাজলের স্টিক । বৌভাতের দিন ওরা আমাকে সাজিয়ে গুছিয়ে জিনিসপত্রগুলোতে ড্রয়ারই রেখেছিল। কিছুক্ষণে খুঁজে ও পেয়ে গেলাম। কিন্তু তার পাশে ছোট একটা গয়নার বাক্স দেখে বের করে আনলাম।

খুলে দেখলাম তাতে ছোট একজোড়া কানের দুল, একটা নাকফুল, একটা স্বর্ণের চেন এবং এক জোড়া চিকন বালা।

তৎক্ষণাৎ মনে পরল শাশুড়ি মা বৌভাতের দিন এই বক্সটা আমার হাতে দিয়েছিল। দিয়ে কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু নিচ থেকে ডাক পরায় তাকে চলে যেতে হয়েছিল। তাড়াহুড়ের মধ্যে আমিও আর খুলে দেখিনি।

আজ কেন জানি আমার খুব সাজতে ইচ্ছা করছে। বক্সটা ড্রেসিং টেবিলের উপরে রেখে এক এক করে গহনাগুলো পরতে শুরু করলাম।

কানের দুল গুলো খুলে নতুন কানের দুল পড়ে নিলাম। গলায় চেন। নাকফুল টাও পাল্টে নিলাম। হাতে বালা গুলো পড়ে নিলাম।

আয়নার দিকে তাকাতে নিজেকে অন্যরকম ভাবে খুঁজে পেলাম। এতক্ষণ সাধারণ লাগলেও গহনাগুলো পড়ার পরে নিজের চেহারার মধ্যে একটা জৌলুস খুঁজে পেলাম। চুলগুলো পেছনে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম গন্তব্য এখন পুতুলের ঘর।

__________🌺🌺_________

ভাউ ……! বলে পুতুল কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম।

পুতুল আমার বাহুর মধ্যে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে বললাম,

— উফ প্রীতিলতা তুমি তো আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। আরেকটু হলে আমার ড্রয়িংটা খারাপ হয়ে যেত।

আমি এখনো ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে থেকে বললাম,

— সরিইইই। তা কী ড্রইং করলো আমার পুতুল সোনা।

— এই দেখ ।

বলে একটা ফ্যামিলি ফটো ড্রয়িং দেখালো আমাকে। যেখানে আমাদের সবার ছবি আঁকা আছে।

আমি পুতুলকে বললাম সোনা এরকম একটা ছবি আমাকে একে দেবে। আমি আমার কাছে রেখে দেবো।

— আচ্ছা এটা তুমি নাও। ওয়েট তোমাকে একটা জিনিস দেখানোর আছে।

— কী ?

খাতার মধ্যে থেকে আরেকটা পেপার বের করল। যাতে পুতুল আর আমার ছবি আঁকানো। এটা আর্টিস্টের হাতে আঁকানো নয় যে পুরোপুরি ফুটে উঠবে। কিন্তু

দেখে মনে হচ্ছে ও ওর যথাসম্ভব চেষ্টা করেছে ফুটিয়ে তোলার । ছবিটা এরকম যে পুতুল আমার কোলে বসে আছে। দুজনেই শাড়ি পড়ে আছি। চুল খোলা মুখে অমায়িক হাসি। রং পেন্সিল দিয়ে কালারও করেছে।

— ওরে বাবা রে । এই যে দেখি আমি আর আমার পুতুল সোনা। আবার দেখি শাড়ি ও পড়েছি সেম সেম।

— হ্যাঁ। কেমন হয়েছে ছবিটা প্রীতিলতা?

— খুব সুন্দর। সোনা আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। এর আগে চোখ বন্ধ করো তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।

— কি সারপ্রাইজ?

— আগে চোখ বন্ধ করো। আমি না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবে না। নো চিটিং।

— ওক্কে। চোখ ঢেকে বসে আছি।

আমি দৌড়ে নিজের রুমে আসলাম আলমারি থেকে নেভি ব্লু রংয়ের একটি শাড়ি বের করে নিয়ে আবার পুতুলের রুমে আসলাম।

— কি হলো প্রীতিলতা। কতক্ষণ?

— হয়ে গেছে সোনা আর একটু।

আমি ওর আলমারি থেকে সাদা রঙের একটা টপস বের করলাম। ছোট মানুষ তো তার ব্লাউজ পেটিকোট কিছুই নেই। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে সাজগোজের কিছু জিনিস নিয়ে বিছানার উপর রেখে বললাম এবার চোখ খোলো।

চোখ খুলে ওর নজরটা প্রথম আমার দিকে পরলো। লাফিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

— তুমি শাড়ি পরেছো প্রীতিলতা? কী সুন্দর লাগছে তোমাকে? একদম মিষ্টি বউ বউ লাগছে।

এবার তোমাকেও আমি মিষ্টি বউ বউ বানাবো। এই দেখো। তোমার জন্য আমি শাড়ি এনেছি। তুমি ছবিতে এঁকেছো না তুমি আর আমি সেম সেম শাড়ি পড়েছি। এখন আমি তোমাকেও শাড়ি পড়াবো। তারপরে তুমি আর আমি মিলে ওই ছবিটার মত পোজ দিয়ে ছবি তুলব। একদম জীবন্ত ছবি হবে আমাদের।

— ইয়েস… দাও আমাকে বউ সাজিয়ে দাও।

এসো আমার কাছে। আমি পুতুলকে শাড়ি পরাতে শুরু করলাম। তারপর একদম আমার মত সাজিয়ে গুছিয়ে বারান্দায় চলে গেলাম। পুতুল ছবিতে যেমন ড্রইং করেছে দোলনায় আমার কোলে বসে আছে ঠিক ওইভাবে দোলনায় বসে ছবি তোলার চেষ্টা করছি কিন্তু ঠিক মন মত আসছে না।আমাদের দুজনের মুখে বিরক্তির অভাব ফুটে উঠলো।

তখনই ঘরের দরজা খুলে পুতুলের ঘরে আসলো সাফওয়ান। থাই গ্লাসের ওপাশে আমরা দোলনায় বসে আছি। প্রথমে সাফোয়ানকে খেয়াল না করলেও পড়ে তাকিয়ে দেখি সে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি পুতুলকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। তার সাথে আমার দৃষ্টির বিনিময় হতে সে চোখ নামিয়ে নিল। কিন্তু আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম সাদা শুভ্র পাঞ্জাবি আর মাথায় কালো টুপি পরিহিত সাফওয়ান কে বেহেস্তের হুরের থেকে কম কিছু লাগছে না। এত সুন্দর কেন এই মানুষটা…!

ভাবনার ভেতরে থাই গ্লাসটা সরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো সে। তারপর বলল,

— তোমরা এখানে। ভাইয়া তোমাদের দুজনকে খুঁজছিল। তারা একটু পর বের হবে।

পুরো কথাটা সাফওয়ান অন্যদিকে তাকিয়ে বলল আমার দিকে ভুল করেও তাকালো না।

এই অপ্রস্তুত দৃষ্টির সূত্রপাত ঘটেছে সেই সকালের ঘটনার পর থেকে। তখন তিনি আমাকে আনমনে ই কোমর জড়িয়ে ধরে একপ্রকার কোলে উঠিয়ে নিয়েছিলো। যখন তিনি বুঝতে পারলো তখন তিনি ধীরে আমাকে নামিয়ে দিয়ে গম্ভীর মুখে ছাদ থেকে নেমে গিয়েছিলেন। আমিও আকস্মিক এমন ঘটনায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে ভুলে গিয়েছিলাম কিন্তু পরে ঠিকই নিজের মধ্যে একটা অপ্রস্তুত অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল। তবুও অনুভূতিটা অনেক মধুময় ছিল।

তাকে জালানোর জন্য যতই মুখে বলি না কেন ভালোবাসি। সত্যিকার অর্থে এমন পরিস্থিতিতে আমি অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলাম।

বর্তমানে তার চোরা দৃষ্টি দেখে আমিও মিটমিট করে হাসলাম। আমারও কেমন জানি তার সাথে কথা বলতে অস্বস্তি আর লজ্জা লাগছিল। তার মধ্যে হঠাৎ পুতুল একটা বায়না করে বসলো। সাফওয়ান এর হাতে ক্যামেরা তুলে দিয়ে বলল আমাদের দুজনের কয়েকটা ছবি তুলে দিতে। আশ্চর্যের বিষয় কোন বাক বিতর্ক ছড়ায় তিনি রাজি হয়ে গেলেন। তারপর পুতুলের আমার বেশ কয়েকটা ছবি তুলে দিলেন।

এরপর পুতুল আরও একটা ভয়ানক আবদার করে বসলো। দোলনায় আমার পাশে সাফওয়ানকে জোর করে বসিয়ে দিল। তারপর ক্যামেরাটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল,

— উফ্ এত দূরে দূরে বসেছ কেন তোমরা। তোমাদের দুজনের মাঝখান দিয়ে তো একটা ট্রাক চলে যেতে পারবে। ভাইয়া প্রীতিলতার দিকে চেপে বস। আমি কয়েকটা ছবি তুলব। তোমাদের দুজনকে আজ খুব সুন্দর লাগছে।

বোনের জেদের কাছে সাফওয়ান হার মানলো। তারপর তিনি আমার বেশ গা ঘেসে বসলেন। আমি তার দিকে তাকাতে তিনি আমার দিকে তাকালেন। তখনই ফ্লাশলাইট পরলো আমাদের মুখের উপর। তারপর আমাদের আরও কয়েকটা ছবি তুলল পুতুল। ছবি তোলা শেষে সাফওয়ান উঠে বারান্দার এক পাশে গিয়ে দাঁড়াল। পুতুল আমার পাশ ঘেঁষে দোলনায় বসে পুতুল ছবিগুলো দেখাতে লাগলো। বলল

— দেখো প্রীতিলতা ছবিগুলো কত সুন্দর উঠেছে। এই ভাইয়া এই ছবিগুলো আমায় তাড়াতাড়ি প্রিন্ট করে এনে দিবি আমি ফটো ফ্রেম তৈরি করব। দেরি করবি না কিন্তু একদম।

________🌺🌺_____

ভাইয়া ভাবি বেরিয়ে গেলেন কিছুক্ষণ আগে। যাবার আগে বারবার বলে গেলেন সন্ধ্যা নাগাদ যেন আমরা ওই বাড়িতে চলে যাই। আমি সম্মতি প্রকাশ করলেও একটা জিনিস খেয়াল করলাম যতবারই ভাবির বাপের বাড়িতে যাওয়ার কথা উঠছে।

ততবারই সাফওয়ান খুব বিরক্তি প্রকাশ করছে। কেন তা বুঝতে পারলাম না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে উনার ওই বাড়িতে যাওয়ার মোটেও ইচ্ছা নেই। এক প্রকার বাধ্য হয়ে যাচ্ছে তিনি।

আমরা দুপুরে খাওয়া দাওয়ার জন্য ডাইনিং এ খাবার গোছাচ্ছিলাম। সাফোয়ান চেয়ার টেনে বসলেন । পুতুল কে ডেকে এসেছি। ম্যাডাম শাড়ি খুলতেছে। একটু পরে আসবে বলল। আমি সাফওয়ানকে খাবার বেড়ে দিলাম। তারপর আমার আর পুতুলের জন্য খাবার নিচ্ছিলাম তখন সাফওয়ান বললেন,

— সন্ধ্যায় ওই বাসায় যাওয়ার জন্য কি শাড়ি পরবে?

— হ্যাঁ। শাড়ি ছাড়া আর থ্রি পিস আছে। বিয়ের পরে এই প্রথম দাওয়াত খেতে যাচ্ছি, শাড়ি না পড়ে আর কি পরবো?

সাফওয়ান আমার কথার প্রতি উত্তর করলেন না চুপচাপ খাবারে মনোযোগ দিলেন। তাই দেখে আমি ভাবলাম হয়তো শাড়ি পড়ে যাওয়ার জন্য সম্মতি দিয়েছেন।। আমিও আর কথা না বাড়িয়ে পুতুল চলে আসার পর একসাথে খেয়ে নিলাম।

খাওয়া শেষে সাফওয়ান উপরে চলে গেলেন। সবকিছু গুছিয়ে রেখে ওপরে গিয়ে দেখি। সাফওয়ান জিন্স টি-শার্ট পরে রেডি হচ্ছেন। চুলে ব্রাশ করতে করতে আমার দিকে এক ঝলক তাকালেন।

আমি তাকে প্রশ্ন করলাম ,

— এখন কোথায় যাচ্ছেন? দাওয়াতে যাওয়ার কথা তো সন্ধ্যায়।

আমরা বাইরে যাচ্ছি।আমি পুতুলকে বলে দিয়েছি তৈরি হতে। তুমিও তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।

— আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে গিয়ে বললাম,

— কিন্তু বাইরে যাচ্ছিটা কোথায়?

চিরুনি টা ড্রেসিং টেবিলের ওপরে রেখে আমার দিকে ঘুরে বললেন,

— আপনি কি আমার সাথে বাহিরে যেতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন?

— আরে না আমি ত….

আমাকে থামিয়ে দিয়ে সাফওয়ান বললেন,

— তাহলে আমি যেখানে নিয়ে যাচ্ছি চলুন আমার সাথে।

চলবে….!

👉আজ সকাল ৭ টা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত আমাদের এরিয়া বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল। ফোনে চার্জ ছিল না। তার উপর আবার আমার শেষ পরীক্ষা ছিল আজ। সব মিলিয়ে গুছিয়ে গল্প দিতে একটু দেরি হয়ে গেল। আশা করি আমার অসুবিধাটা আপনারা বুঝবেন। 😐

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here